দীপংকর মজুমদার
কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার
“নির্ভিক সাংবাদিকতার কোন বন্ধু নাই”, “দেশ নষ্ট কপটে, প্রজামরে চপটে, কি করিবে রিপোটে”, “(ওহে) হরি দিন‘ত গেল সন্ধ্যা হ‘ল পার কর আমারে”, “যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখ তাই, পেলেও পাইতে পার লুকান রতন”-সহ অসংখ্য নীতি কথার জনক কে বলতে পারবেন? অনেকেই অনেকের নাম বলবেন, কিন্তু সঠিক ব্যক্তির নামটি অনেকেই জানেন না সবাই বলতে পারবেন না । কারণ তিনি মৃত্যুর ১২৯ বছর পরও অখ্যাত হয়ে রয়েছেন । যেমন টি করা হয়েছিল ১৮৫১ খ্রীষ্টাব্দে লিখিত “বিজয় বসন্ত“ উপন্যাসকে বাদ রেখে “আলালের ঘরের দুলাল “ উপন্যাসকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস ঘোষনা দেওয়া । অনেকে আবার তার কর্ম ব্যবহার করে অস্কারের মত পুরস্কার অর্জন করেছে । অনেকে আবার উল্লেখিত অখ্যাত ব্যক্তির উপর বিভিন্ন বিষয় লিখে ডিগ্রী অর্জন করেছেন । কোন না জানা কারনে আমরা তাকে হারিয়ে ফেলতে বসেছি ।
তিনি আর কেউ নন বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার কুন্ডুপাড়া গ্রামে বিখ্যাত মজুমদার পরিবারে অত্রষি বংশে মাতা কমলিনির কোল জুড়ে আর হলধর মজুমদারের পুত্র হয়ে ২০শে জুলাই ১৮৩৩ সালের বৃহস্পতিবার জন্মগ্রহণকারী শ্রী হরিনাথ মজুমদার ওরফে কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার । তার জীবনকাল ছিল মাত্র ৬৩ বছর । এই অল্প সময়ে ৭২ খানা গ্রন্থ রচনা করেছেন । যার মধ্যে ৪২ খানা প্রকাশিত আর ৩০ খানা অ-প্রকাশিত । ব্যবসা পরিচালনার জন্য স্থাপন করেছেন ছাপাখানা এম-এন প্রেস । সমাজ সংস্কার কল্পে ১১টি দল ও ৮টি প্রতিষ্ঠান তৈরী করেছেন । ডাকঘরে মানি অডার প্রচলনের প্রস্তাব নিজ সম্পাদিত গ্রমবার্ত্তা প্রকাশিকা পত্রিকায় ছেপেছেন । ক্ষুধা ও লজ্জা নিবারনের জন্য অন্যের দোকানে কাজ করতেও দ্বিধা করেনি । তিনি নিজে লেখাপড়া না জানলেও স্ব-শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নারী শিক্ষার দ্বিপ জ্বালাতে ১৮৫৭ সালের ১৩ই জানুয়ারী নিজ চন্ডী মন্ডপে প্রতিষ্ঠা করলেন কুমারখালী বালিকা বিদ্যালয় । যা আজও কুমারখালীর বুকে মাথা উচু করে দাড়িয়ে আছে ।
জমিদার পান্নালাল মজুমদার, যিনি বেশ কয়েকবার শিলাইদহ ঠাকুর জমিদারদের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে জয়ী হয়েছিলেন । সেই ঠাকুর এষ্টেটে জমিদারী করতে এসে পদধুলি দিয়ে ধন্য করেছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সোনাবন্ধুর দরগা, তন্ত্রাচার্য শীবচন্দ্র বিদ্যার্ণবের সর্বমঙ্গলা মন্দীর, খোরশেদপুরে পীর খোরশেদ পীরের মাজার ও রাণী রাসমণি নির্মিত গোপীনাথের মন্দীর, তালোয়ার মাজার শরীফ, কুমারখালীর ঐতিহাসিক পুতুলবাড়ী, মানব ধর্মের পথদিশারী সাধক কাঙ্গাল হরিনাথের জন্মস্থান কাঙ্গাল কুটির, ছেউরিয়ায় বাউল সাধক ফকির লালন শাহের মাজার, লাহিনীপাড়ায় কালজয়ী সাহিত্যিক মীর মশাররফের বাস্তুভিটা, ওসমানপুরে নীলকর সাহেবদের আবাসস্থল, ২১টি নীলকুঠি অফিসের প্রধান অফিস বর্তমান এম এন হাইস্কুল (নদীগর্ভে বিলীন), উইলিয়াম সাহেব প্রতিষ্ঠিত কুমারখালী হাট, মুদ্রণ জগতের প্রাচীন ছাপাখানা ও স্বদেশী আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত এম এন প্রেস, প্রজাপীড়নের কর্মস্থল জমিদারের গোলাবাড়ী, মীর্জাপুর বৌদ্ধমঠ, বাঘাযতীনের বাড়ী, অখন্ড ভারতবর্ষের প্রথম দূর্গাপুজাস্থল তাহেরপুরের জমিদারবাড়ী সহ অসংখ্য স্মৃতি রয়েছে এই কুমারখালীর । সেই কুমারখালীতে জন্ম নেয়া কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের কর্মময় জীবনের বিভিন্ন দিকও বর্তমান পেক্ষাপটে কি অবস্থায আছে তা নিয়ে আলোচনা করা যাক ।
স্ব শিক্ষিত কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের ছোটবেলা থেকে প্রবল ইচ্ছাছিল লেখাপড়া শিখার । কিন্তু অর্থনৈতিক টানাপোড়নের মধ্যে ও পিতৃ-মাতৃহীন থাকায় তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তেমন হয়ে ওঠেনি । তবুও তিনি নিজ চেষ্টায় বই-পুস্তক ভিক্ষাকরে কখনো -কখনো সতীর্থদের কাছথেকে বই ধার করে স্কুলের পাঠ্যপুস্তকের অভাব মেটাতেন । কাঙ্গাল হরিনাথের ভাষা শিক্ষার জন্য কবি ঈশ্বর গুপ্তের “সংবাদ প্রভাকর” (১৮১২-১৮৫৯) পত্রের ভূমিকাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । তিনি নিজ চেষ্টায় কুমারখালীতে ১৮৫৪ সালে বাংলা পাঠশালা স্থাপন করে । পরে ১৮৫৭ সালে নারী শিক্ষায় নিজ চন্ডি মন্ডপে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করে । প্রথমে তার কোন বেতন ছিলনা, বিদ্যালয়ের সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পরলে উড্ডো মাটিন প্রমুখ বিদ্যালয় পরিদর্শকের বিশেষ সুপারিশের কারণে হরিনাথ বেতন গ্রহন করেন । সেসময় জমিদার মহাজন, নীলকর, গোড়াপল্টন আমলাদের অত্যাচারে সাধারণ মানুস অতিষ্ট, তখন কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার নিঃস্ব-নিরক্ষর গ্রামবাসীদের অভাব-অভিযোগ, দুঃখ-দুর্দশা নিরসন এবং আমলাদের বর্বরোচিত নির্যাতন এর কাহিনীর সংবাদ ও প্রতিকার করবার জন্য ১৮৬৩ সালে গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করে । সেই সময় অখ্যাত মফস্বল পল্লী কুমারখালী থেকে পত্রিকা প্রকাশ একটি অসাধারণ ঘটনা । শিলাইদহ, শাহাজাদপুর এষ্টেটে ঠাকুর জমিদারদের প্রজাপীড়ন ও শোষন এবং প্রজাপালনের ব্যর্থতার কাহিণী গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকায় বহুবার প্রকাশ হলেও অজানা কারনে সে সমস্ত ছাপানো পত্রিকা সে সময়ই হারিয়ে যেত । ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় তার কাঙ্গাল জীবনিতে লিখেছিলেন কাঙ্গালের সেইসব রিপোট হুবহু উদ্ধৃত করায় বাধা আছে । অনুমান করা হয় জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের বিশেষ চাপের ফলে এ সকল রিপোট ছাপা হয়নি । স্বয়ং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাঙ্গালকে তার জীবদ্দশায় তার পিতা ঠাকুরের এই কাহিনী ছাপাতে নিষেধ করেছিলেন বলে সুকুমার মিত্র উল্লেখ করেছেন । কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার ছিলেন নির্ভিক সাংবাদিক । তখনকার পায়ে হাটার যুগে তিনি সংবাদ সংগ্রহের জন্য গ্রমের পর গ্রাম ঘুরতেন, তাই তিনি গ্রামীণ সাংবাদিকতার জনক হিসাবে খ্যাত ।
কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের গঠিত বাউল গানের দলের নাম ছিল ফিকির চাঁদের দল । তিনি পাবনা, নদীয়া, ফরিদপুর, ঢাকা, বরিশাল, যশোহর, কলিকাতা সহ বিভিন্ন স্থানে বহু পরিচিত ছিল । তিনি প্রায় হাজারের কোঠায় গান রচনা করেছেন। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্যঃ- “ওরে মন পাগলারে হরদমে আল্লাজির নাম নিও, ওরে দমে দমে নিও নাম কামাই নাহি দিও”, “ওরে দোকানদার দোকানি ভাই দোকান সারনা, আর কত করবে বেচাকেনা”, “হরি দিনতো গেল সন্ধ্যা হ‘ল পার কর আমারে” “দুলিয়ে বাঁশের দোলায়, যাচ্ছ কোথায়, বলরে ভাই তাই জিঞ্গাসী” । কাঙ্গাল হরিনাথের গান পশ্চিমবঙ্গের মত সর্বদা পূর্ব বঙ্গেও শ্রুত হোক এই কামনা সাংস্কৃতিক কর্মীরা সর্বদা কামনা করে । কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের সাহিত্যকর্ম নিয়ে আলোচনা করতে গেলে দেখাযায় তিনি অসংখ্য কাহিনি, উপন্যাস এবং ধর্মতত্ব সহ বহুবিধ বিষয়াদি নিয়ে লেখালেখি করেছেন ।
বাংলার প্রথম উপন্যাস বলে পরিচিত “আলালের ঘরের দুলাল” যখন রচিত হয়, তার অনেক আগেই কাঙ্গাল হরিনাথের “বিজয বসন্ত” লেখা হয় সুদুর মফস্বল শহর থেকে । যার ফলে বাংলার প্রথম উপন্যাস নিয়ে সঠিক তথ্যটি আজও অসংখ্য মানুষের অ-জানা রয়ে গেছে । শিবনাথশাস্ত্রী (১৮৪৭-১৯১৯) মন্তব্য করেছেন, কুমারখালীর হরিনাথ মজুমদারের প্রণীত “বিজয় বসন্ত” ও টেকচাঁদ ঠাকুরের “আলালের ঘরের দুলাল” বাংলার প্রথম উপন্যাস । তন্মধ্যে “বিজয় বসন্ত” তৎকালে প্রচলিত বিশুদ্ধ সংস্কৃত বহুল বাংলাতে লিখিত । কাঙ্গাল হরিনাথের ভাগ্য এমন হওয়া উচিত ছিল যে, বাংলার আরও অনেক সাহিত্যিক যেমন ভাবে বাংলার সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে খচিত হয়ে আছেন, তেমনিভাবে তার জীবনটা এমন প্রাপ্ততাই পরিপূর্ণ হওয়া ।
কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার রচিত গ্রন্থ গুলোর মধ্যে (১) বিজয়-বসন্ত (নীতিগর্ভ উপাখ্যান, ১৮৫১), (২) পদ্য পুন্ডুরিক(১৮৬২), (৩) চারু চরিত্র (১৮৬৩), (৪) কবিতা কৌমুদী (১৮৬৬), (৫) বিজয়া (১৮৬৯), (৬) কবিকল্প (১৮৭০), (৭) অক্রুর সংবাদ (১৮৭৩), (৮) সাবিত্রী নাটিকা (১৮৭৮), (৯) চিত্ত-চপলা (১৮৭৬), (১০) এক লভ্যের অধ্যবসায়, (১১) ভাবোচ্ছাস, (১২) কাঙ্গাল ফিকির চাঁদ ফকিরের গীতাবলী, (১৩) ব্রহ্মান্ডবেদ, (১৪) কৃষ্নকালী-লীলা, (১৫) মাতৃ মহীমা (১৬) কাঙ্গাল ফিকির চাঁদের বাউল সঙ্গীত, (১৭) পৌত্তপলিকতা পনেতা সহ বহুবই স্মৃতির অতলে চাপা পড়েছে । কাঙ্গালের অধিকাংশ বই বর্তমানে দুস্পাপ্য । কাঙ্গালের মৃত্যু পরবর্তী সময়ে যে সমস্ত ব্যক্তি কাঙ্গালের স্মৃতি চারণ করেছেন তাদের মধ্যে জলধর সেন, অক্ষয় কুমার মৌত্রেয়, শিবনাথশাস্ত্রী, রামতনু রাহিড়ী, শতীষ চন্দ্র মজুমদার, অশোক মজুমদার, প্রবীর মিত্র, ডঃ অশোক চট্টোপাধ্যায়, ম-মনিরুজ্জামান প্রমুখঃ । তারা তাদের লেখনির মধ্য দিয়ে কাঙ্গালকে বাচিয়ে রেখেছেন ।
কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাস্তব দেখার মত কিছু নেই । ১৮৯৬ সালে কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের তিরোধানের পর ’কাঙ্গাল হরিনাথ’ নামটা অমর করে ধরে রাখার জন্য তারই কনিষ্ঠ পুত্র সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার ১৯১৭ সালে শিলাইদহ ঠাকুর এষ্টেটে চেষ্টা করে লেখা লেখি করেছিলেন । কিন্তু কোন ফল হয়নি । বাংলাদেশ স্বাধীনের পর কাঙ্গালের চতুর্থ বংশধর অশোক মজুমদার নিজের সক্ষমতা না থাকায় অভাবের মধ্যে থেকে ১৯৭৮ সাল থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের কাছে বহু আবেদন-নিবেদন করেছেন । যখনই কোন ব্যক্তি ’কাঙ্গাল কুটির’ পরিদর্শনে এসেছেন তখনই তিনি তার কাছে দু-হাত পেতেছেন উন্নয়ন করার জন্য । ১৯৯১ সালে বরেন্দ্র গবেষনা জাদুঘরের এক চিঠিতে দেখাযায় তারা কাঙ্গাল কুটিরে কোন উন্নয়ন না করে কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের ব্যবহৃত ছাপাখানা মেশিনটি নিজেদের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছেন । অশোক মজুমদার তাতে রাজি হননি । চেয়েছে নিজ জন্মভূমি কুমারখালীতে কিছু করা যায় কিনা । ১৯৯৪ সালে কুমারখালীতে সাংস্কৃতিক বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের অধীন প্রথম উন্নয়ন কাজের শুরু হয় । পরে জেলা প্রশাসক কুষ্টিয়া, জেলা পরিষদ কুষ্টিয়ার অধীনে উন্নয়ন মূলক কাজ শুরু করে । সবশেষ ২০১৩ সালের ৫ই অক্টোবর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা জাতীয় জাদুঘরের অধীনে শাখা জাদুঘর হিসেবে সাংবাদিক কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার স্মৃতি জাদুঘর এর ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেন । দ্বিতল বিশিষ্ট ভবনটি তৈরীর পর ২০১৭ সালের ৯ই ডিসেম্বর জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয় । স্বপ্ন পূরণ হয় ১৮৯৩ সালে কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার দিব্যদর্শন লাভে ঈশ্বরের কাছ থেকে পাওয়া বর নিজ নামটা অমর করে রাখার । অবশেষে ১২৪ বছর পর বর লাভ সার্থক হয় ।
[লেখক: কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের পঞ্চম বংশধর]
দীপংকর মজুমদার
কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার
শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫
“নির্ভিক সাংবাদিকতার কোন বন্ধু নাই”, “দেশ নষ্ট কপটে, প্রজামরে চপটে, কি করিবে রিপোটে”, “(ওহে) হরি দিন‘ত গেল সন্ধ্যা হ‘ল পার কর আমারে”, “যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখ তাই, পেলেও পাইতে পার লুকান রতন”-সহ অসংখ্য নীতি কথার জনক কে বলতে পারবেন? অনেকেই অনেকের নাম বলবেন, কিন্তু সঠিক ব্যক্তির নামটি অনেকেই জানেন না সবাই বলতে পারবেন না । কারণ তিনি মৃত্যুর ১২৯ বছর পরও অখ্যাত হয়ে রয়েছেন । যেমন টি করা হয়েছিল ১৮৫১ খ্রীষ্টাব্দে লিখিত “বিজয় বসন্ত“ উপন্যাসকে বাদ রেখে “আলালের ঘরের দুলাল “ উপন্যাসকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস ঘোষনা দেওয়া । অনেকে আবার তার কর্ম ব্যবহার করে অস্কারের মত পুরস্কার অর্জন করেছে । অনেকে আবার উল্লেখিত অখ্যাত ব্যক্তির উপর বিভিন্ন বিষয় লিখে ডিগ্রী অর্জন করেছেন । কোন না জানা কারনে আমরা তাকে হারিয়ে ফেলতে বসেছি ।
তিনি আর কেউ নন বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার কুন্ডুপাড়া গ্রামে বিখ্যাত মজুমদার পরিবারে অত্রষি বংশে মাতা কমলিনির কোল জুড়ে আর হলধর মজুমদারের পুত্র হয়ে ২০শে জুলাই ১৮৩৩ সালের বৃহস্পতিবার জন্মগ্রহণকারী শ্রী হরিনাথ মজুমদার ওরফে কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার । তার জীবনকাল ছিল মাত্র ৬৩ বছর । এই অল্প সময়ে ৭২ খানা গ্রন্থ রচনা করেছেন । যার মধ্যে ৪২ খানা প্রকাশিত আর ৩০ খানা অ-প্রকাশিত । ব্যবসা পরিচালনার জন্য স্থাপন করেছেন ছাপাখানা এম-এন প্রেস । সমাজ সংস্কার কল্পে ১১টি দল ও ৮টি প্রতিষ্ঠান তৈরী করেছেন । ডাকঘরে মানি অডার প্রচলনের প্রস্তাব নিজ সম্পাদিত গ্রমবার্ত্তা প্রকাশিকা পত্রিকায় ছেপেছেন । ক্ষুধা ও লজ্জা নিবারনের জন্য অন্যের দোকানে কাজ করতেও দ্বিধা করেনি । তিনি নিজে লেখাপড়া না জানলেও স্ব-শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নারী শিক্ষার দ্বিপ জ্বালাতে ১৮৫৭ সালের ১৩ই জানুয়ারী নিজ চন্ডী মন্ডপে প্রতিষ্ঠা করলেন কুমারখালী বালিকা বিদ্যালয় । যা আজও কুমারখালীর বুকে মাথা উচু করে দাড়িয়ে আছে ।
জমিদার পান্নালাল মজুমদার, যিনি বেশ কয়েকবার শিলাইদহ ঠাকুর জমিদারদের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে জয়ী হয়েছিলেন । সেই ঠাকুর এষ্টেটে জমিদারী করতে এসে পদধুলি দিয়ে ধন্য করেছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সোনাবন্ধুর দরগা, তন্ত্রাচার্য শীবচন্দ্র বিদ্যার্ণবের সর্বমঙ্গলা মন্দীর, খোরশেদপুরে পীর খোরশেদ পীরের মাজার ও রাণী রাসমণি নির্মিত গোপীনাথের মন্দীর, তালোয়ার মাজার শরীফ, কুমারখালীর ঐতিহাসিক পুতুলবাড়ী, মানব ধর্মের পথদিশারী সাধক কাঙ্গাল হরিনাথের জন্মস্থান কাঙ্গাল কুটির, ছেউরিয়ায় বাউল সাধক ফকির লালন শাহের মাজার, লাহিনীপাড়ায় কালজয়ী সাহিত্যিক মীর মশাররফের বাস্তুভিটা, ওসমানপুরে নীলকর সাহেবদের আবাসস্থল, ২১টি নীলকুঠি অফিসের প্রধান অফিস বর্তমান এম এন হাইস্কুল (নদীগর্ভে বিলীন), উইলিয়াম সাহেব প্রতিষ্ঠিত কুমারখালী হাট, মুদ্রণ জগতের প্রাচীন ছাপাখানা ও স্বদেশী আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত এম এন প্রেস, প্রজাপীড়নের কর্মস্থল জমিদারের গোলাবাড়ী, মীর্জাপুর বৌদ্ধমঠ, বাঘাযতীনের বাড়ী, অখন্ড ভারতবর্ষের প্রথম দূর্গাপুজাস্থল তাহেরপুরের জমিদারবাড়ী সহ অসংখ্য স্মৃতি রয়েছে এই কুমারখালীর । সেই কুমারখালীতে জন্ম নেয়া কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের কর্মময় জীবনের বিভিন্ন দিকও বর্তমান পেক্ষাপটে কি অবস্থায আছে তা নিয়ে আলোচনা করা যাক ।
স্ব শিক্ষিত কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের ছোটবেলা থেকে প্রবল ইচ্ছাছিল লেখাপড়া শিখার । কিন্তু অর্থনৈতিক টানাপোড়নের মধ্যে ও পিতৃ-মাতৃহীন থাকায় তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তেমন হয়ে ওঠেনি । তবুও তিনি নিজ চেষ্টায় বই-পুস্তক ভিক্ষাকরে কখনো -কখনো সতীর্থদের কাছথেকে বই ধার করে স্কুলের পাঠ্যপুস্তকের অভাব মেটাতেন । কাঙ্গাল হরিনাথের ভাষা শিক্ষার জন্য কবি ঈশ্বর গুপ্তের “সংবাদ প্রভাকর” (১৮১২-১৮৫৯) পত্রের ভূমিকাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । তিনি নিজ চেষ্টায় কুমারখালীতে ১৮৫৪ সালে বাংলা পাঠশালা স্থাপন করে । পরে ১৮৫৭ সালে নারী শিক্ষায় নিজ চন্ডি মন্ডপে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করে । প্রথমে তার কোন বেতন ছিলনা, বিদ্যালয়ের সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পরলে উড্ডো মাটিন প্রমুখ বিদ্যালয় পরিদর্শকের বিশেষ সুপারিশের কারণে হরিনাথ বেতন গ্রহন করেন । সেসময় জমিদার মহাজন, নীলকর, গোড়াপল্টন আমলাদের অত্যাচারে সাধারণ মানুস অতিষ্ট, তখন কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার নিঃস্ব-নিরক্ষর গ্রামবাসীদের অভাব-অভিযোগ, দুঃখ-দুর্দশা নিরসন এবং আমলাদের বর্বরোচিত নির্যাতন এর কাহিনীর সংবাদ ও প্রতিকার করবার জন্য ১৮৬৩ সালে গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করে । সেই সময় অখ্যাত মফস্বল পল্লী কুমারখালী থেকে পত্রিকা প্রকাশ একটি অসাধারণ ঘটনা । শিলাইদহ, শাহাজাদপুর এষ্টেটে ঠাকুর জমিদারদের প্রজাপীড়ন ও শোষন এবং প্রজাপালনের ব্যর্থতার কাহিণী গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকায় বহুবার প্রকাশ হলেও অজানা কারনে সে সমস্ত ছাপানো পত্রিকা সে সময়ই হারিয়ে যেত । ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় তার কাঙ্গাল জীবনিতে লিখেছিলেন কাঙ্গালের সেইসব রিপোট হুবহু উদ্ধৃত করায় বাধা আছে । অনুমান করা হয় জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের বিশেষ চাপের ফলে এ সকল রিপোট ছাপা হয়নি । স্বয়ং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাঙ্গালকে তার জীবদ্দশায় তার পিতা ঠাকুরের এই কাহিনী ছাপাতে নিষেধ করেছিলেন বলে সুকুমার মিত্র উল্লেখ করেছেন । কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার ছিলেন নির্ভিক সাংবাদিক । তখনকার পায়ে হাটার যুগে তিনি সংবাদ সংগ্রহের জন্য গ্রমের পর গ্রাম ঘুরতেন, তাই তিনি গ্রামীণ সাংবাদিকতার জনক হিসাবে খ্যাত ।
কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের গঠিত বাউল গানের দলের নাম ছিল ফিকির চাঁদের দল । তিনি পাবনা, নদীয়া, ফরিদপুর, ঢাকা, বরিশাল, যশোহর, কলিকাতা সহ বিভিন্ন স্থানে বহু পরিচিত ছিল । তিনি প্রায় হাজারের কোঠায় গান রচনা করেছেন। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্যঃ- “ওরে মন পাগলারে হরদমে আল্লাজির নাম নিও, ওরে দমে দমে নিও নাম কামাই নাহি দিও”, “ওরে দোকানদার দোকানি ভাই দোকান সারনা, আর কত করবে বেচাকেনা”, “হরি দিনতো গেল সন্ধ্যা হ‘ল পার কর আমারে” “দুলিয়ে বাঁশের দোলায়, যাচ্ছ কোথায়, বলরে ভাই তাই জিঞ্গাসী” । কাঙ্গাল হরিনাথের গান পশ্চিমবঙ্গের মত সর্বদা পূর্ব বঙ্গেও শ্রুত হোক এই কামনা সাংস্কৃতিক কর্মীরা সর্বদা কামনা করে । কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের সাহিত্যকর্ম নিয়ে আলোচনা করতে গেলে দেখাযায় তিনি অসংখ্য কাহিনি, উপন্যাস এবং ধর্মতত্ব সহ বহুবিধ বিষয়াদি নিয়ে লেখালেখি করেছেন ।
বাংলার প্রথম উপন্যাস বলে পরিচিত “আলালের ঘরের দুলাল” যখন রচিত হয়, তার অনেক আগেই কাঙ্গাল হরিনাথের “বিজয বসন্ত” লেখা হয় সুদুর মফস্বল শহর থেকে । যার ফলে বাংলার প্রথম উপন্যাস নিয়ে সঠিক তথ্যটি আজও অসংখ্য মানুষের অ-জানা রয়ে গেছে । শিবনাথশাস্ত্রী (১৮৪৭-১৯১৯) মন্তব্য করেছেন, কুমারখালীর হরিনাথ মজুমদারের প্রণীত “বিজয় বসন্ত” ও টেকচাঁদ ঠাকুরের “আলালের ঘরের দুলাল” বাংলার প্রথম উপন্যাস । তন্মধ্যে “বিজয় বসন্ত” তৎকালে প্রচলিত বিশুদ্ধ সংস্কৃত বহুল বাংলাতে লিখিত । কাঙ্গাল হরিনাথের ভাগ্য এমন হওয়া উচিত ছিল যে, বাংলার আরও অনেক সাহিত্যিক যেমন ভাবে বাংলার সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে খচিত হয়ে আছেন, তেমনিভাবে তার জীবনটা এমন প্রাপ্ততাই পরিপূর্ণ হওয়া ।
কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার রচিত গ্রন্থ গুলোর মধ্যে (১) বিজয়-বসন্ত (নীতিগর্ভ উপাখ্যান, ১৮৫১), (২) পদ্য পুন্ডুরিক(১৮৬২), (৩) চারু চরিত্র (১৮৬৩), (৪) কবিতা কৌমুদী (১৮৬৬), (৫) বিজয়া (১৮৬৯), (৬) কবিকল্প (১৮৭০), (৭) অক্রুর সংবাদ (১৮৭৩), (৮) সাবিত্রী নাটিকা (১৮৭৮), (৯) চিত্ত-চপলা (১৮৭৬), (১০) এক লভ্যের অধ্যবসায়, (১১) ভাবোচ্ছাস, (১২) কাঙ্গাল ফিকির চাঁদ ফকিরের গীতাবলী, (১৩) ব্রহ্মান্ডবেদ, (১৪) কৃষ্নকালী-লীলা, (১৫) মাতৃ মহীমা (১৬) কাঙ্গাল ফিকির চাঁদের বাউল সঙ্গীত, (১৭) পৌত্তপলিকতা পনেতা সহ বহুবই স্মৃতির অতলে চাপা পড়েছে । কাঙ্গালের অধিকাংশ বই বর্তমানে দুস্পাপ্য । কাঙ্গালের মৃত্যু পরবর্তী সময়ে যে সমস্ত ব্যক্তি কাঙ্গালের স্মৃতি চারণ করেছেন তাদের মধ্যে জলধর সেন, অক্ষয় কুমার মৌত্রেয়, শিবনাথশাস্ত্রী, রামতনু রাহিড়ী, শতীষ চন্দ্র মজুমদার, অশোক মজুমদার, প্রবীর মিত্র, ডঃ অশোক চট্টোপাধ্যায়, ম-মনিরুজ্জামান প্রমুখঃ । তারা তাদের লেখনির মধ্য দিয়ে কাঙ্গালকে বাচিয়ে রেখেছেন ।
কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাস্তব দেখার মত কিছু নেই । ১৮৯৬ সালে কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের তিরোধানের পর ’কাঙ্গাল হরিনাথ’ নামটা অমর করে ধরে রাখার জন্য তারই কনিষ্ঠ পুত্র সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার ১৯১৭ সালে শিলাইদহ ঠাকুর এষ্টেটে চেষ্টা করে লেখা লেখি করেছিলেন । কিন্তু কোন ফল হয়নি । বাংলাদেশ স্বাধীনের পর কাঙ্গালের চতুর্থ বংশধর অশোক মজুমদার নিজের সক্ষমতা না থাকায় অভাবের মধ্যে থেকে ১৯৭৮ সাল থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের কাছে বহু আবেদন-নিবেদন করেছেন । যখনই কোন ব্যক্তি ’কাঙ্গাল কুটির’ পরিদর্শনে এসেছেন তখনই তিনি তার কাছে দু-হাত পেতেছেন উন্নয়ন করার জন্য । ১৯৯১ সালে বরেন্দ্র গবেষনা জাদুঘরের এক চিঠিতে দেখাযায় তারা কাঙ্গাল কুটিরে কোন উন্নয়ন না করে কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের ব্যবহৃত ছাপাখানা মেশিনটি নিজেদের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছেন । অশোক মজুমদার তাতে রাজি হননি । চেয়েছে নিজ জন্মভূমি কুমারখালীতে কিছু করা যায় কিনা । ১৯৯৪ সালে কুমারখালীতে সাংস্কৃতিক বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের অধীন প্রথম উন্নয়ন কাজের শুরু হয় । পরে জেলা প্রশাসক কুষ্টিয়া, জেলা পরিষদ কুষ্টিয়ার অধীনে উন্নয়ন মূলক কাজ শুরু করে । সবশেষ ২০১৩ সালের ৫ই অক্টোবর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা জাতীয় জাদুঘরের অধীনে শাখা জাদুঘর হিসেবে সাংবাদিক কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার স্মৃতি জাদুঘর এর ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেন । দ্বিতল বিশিষ্ট ভবনটি তৈরীর পর ২০১৭ সালের ৯ই ডিসেম্বর জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয় । স্বপ্ন পূরণ হয় ১৮৯৩ সালে কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার দিব্যদর্শন লাভে ঈশ্বরের কাছ থেকে পাওয়া বর নিজ নামটা অমর করে রাখার । অবশেষে ১২৪ বছর পর বর লাভ সার্থক হয় ।
[লেখক: কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের পঞ্চম বংশধর]