বাবুল রবিদাস
কারাতে সম্পর্কে ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের অনুসন্ধান আজও চলমান। যদিও অনেক মনীষী কারাতের উৎপত্তি নিয়ে মতভেদ পোষণ করেন, তথাপি বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের মতে, এর সূচনা প্রায় দেড় হাজার বছর আগে দক্ষিণ ভারতের এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী দারুমা তাইশীর মাধ্যমে। তিনি ধর্মীয় জ্ঞানচর্চার উদ্দেশ্যে ভারত থেকে চীনের হুনান প্রদেশের শাওলিন (সোরিনজি) মন্দিরে গমন করেন এবং সেখানেই খালি হাতে আত্মরক্ষার একটি কৌশল শিক্ষাদান শুরু করেন।
দারুমা শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়লে তার অনুসারীদের চেতনা ধরে রাখতে তিনি একটি ব্যায়াম-পদ্ধতি চালু করেন, যার নাম ছিল একি-কিনকিয়ো (ঊকও-কওঘকণঙ)। এটি ছিল চীনের আত্মরক্ষামূলক কৌশল কেন পো (কঊঘচঙ)-এর ভিত্তি। এই ধারা থেকেই চাইনিজ ফিস্ট নামে পরিচিত আত্মরক্ষা কৌশল বিকাশ লাভ করে, যা চীনে বহু শতাব্দী ধরে প্রচলিত ছিল।
এই কৌশল পরে ওকিনাওয়া দ্বীপে ছড়িয়ে পড়ে। পঞ্চদশ শতকে ওকিনাওয়ার রাজা ভারী অস্ত্র নিষিদ্ধ করলে ¯ানীয় অধিবাসীরা খালি হাতে আত্মরক্ষার কৌশল রপ্ত করতে বাধ্য হন। চীনা এবং ¯ানীয় কৌশল একীভূত হয়ে ওকিনাওয়াতে একটি নতুন পদ্ধতির জন্ম দেয়, যার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে বহু প্রশিক্ষণ শিবির।
১৯০৫ সালে ওকিনাওয়ার স্কুল পাঠ্যক্রমে এই আত্মরক্ষা পদ্ধতি যুক্ত করা হয়। মাষ্টার আনহো ইতোসুর তত্ত্বাবধানে এখানে শিক্ষাগ্রহণ করেন কারাতের জনকখ্যাত মাস্টার গিসিন ফুনাকোসি। ফুনাকোসি ১৯১৬ সালে জাপানে এই কৌশল প্রচার করেন এবং ডা. জিগারো কানোর সহযোগিতায় জুডো এবং দার্শনিক চর্চার সাথে একীভূত করেন।
১৯৩৬ সালে ফুনাকোসি একটি ¯ায়ী ক্লাব গঠন করেন এবং পরবর্তীতে জাপানে নানা সংগঠন গড়ে উঠে। বলা যায়, আত্মরক্ষার কৌশলের জন্ম চীনে, পরিপূর্ণতা ওকিনাওয়াতে এবং কাঠামোগত রূপ পায় জাপানে।
১৯৩৬ সালে ওকিনাওয়ার এক পত্রিকার উদ্যোগে কারাতে বিশেষজ্ঞদের সভায় “কারা” শব্দের স্বীকৃতি লাভ করে এবং ফুনাকোসি এর সঙ্গে দো শব্দ যুক্ত করেন, যার ফলে নাম হয় কারাতে-দো Ñ অর্থাৎ খালি হাতের পথ।
প্রথম দিকে কেবল কাতা বা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে কারাতে অনুশীলন হতো, যা ছিল সীমিত কার্যকর। পরবর্তীতে মাষ্টার ইয়ামাগুচি ও ওতসুকা কারাতে অনুশীলনে আক্রমণ ও আত্মরক্ষার বাস্তব কৌশল সংযুক্ত করেন। এতে কারাতের জনপ্রিয়তা দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ ধারায় বিকাশ ঘটে।
কারাতে চর্চার ধারাবাহিকতায় একতা আনার জন্য ফুনাকোসি ১৯৪৭ সালে ‘অল জাপান কারাতে অ্যাসোসিয়েশন’ গঠন করেন। যদিও প্রথম উদ্যোগ ব্যর্থ হয়, পরে ১৯৫৫ সালে দি জাপান কারাতে অ্যাসোসিয়েশন গঠনের মাধ্যমে নতুন ধারা সূচিত হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিশ্বজুড়ে কারাতের বিস্তার ঘটে। বিশেষত ফ্রান্স, ব্রিটেন ও আমেরিকায় কারাতে দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করে। জাপানি প্রশিক্ষকগণ ইউরোপ ও আমেরিকায় পেশাগত প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করলে বহু কারাতে ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ফেডারেশন অফ অল জাপান কারাতে দো অর্গানাইজেশন (ঋঅঔকঙ) এবং ১৯৭০ সালে টোকিওতে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম বিশ্ব কারাতে প্রতিযোগিতা। এরপর গঠিত হয় ওয়ার্ল্ড ইউনিয়ন অফ কারাতে দো অর্গানাইজেশন (ডটকঙ) ও ইউরোপিয়ান কারাতে ইউনিয়ন।
আধুনিক প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিকতা :
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী কারাতে শুধু খেলা নয়, এটি শৃঙ্খলা, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আত্মরক্ষার অন্যতম শক্তিশালী পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত হছে। বাংলাদেশেও অপরাধ প্রবণতা, জানমালের অনিরাপত্তা এবং সামাজিক অ¯িরতার পরিপ্রেক্ষিতে আত্মরক্ষা শেখার প্রয়োজনীয়তা ক্রমেই বাড়ছে। বাংলাদেশ দ-বিধি অনুযায়ী আত্মরক্ষা ও সম্পত্তি রক্ষার অধিকার আইনত স্বীকৃতÑএমনকি আক্রমণকারীর মৃত্যু ঘটানোও আইনি সীমার মধ্যে থাকতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে কারাতে কেবল শারীরিক কৌশল নয়, বরং আত্মবিশ্বাস, সংযম এবং মনোবলের চর্চাও বটে। সুতরাং ব্যক্তি, পরিবার এবং সমাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কারাতে প্রশিক্ষণ হতে পারে এক বাস্তব ও কার্যকর সমাধান।
[ লেখক : আইনজীবী, জজ কোর্ট, জয়পুরহাট ]
বাবুল রবিদাস
বুধবার, ০৭ মে ২০২৫
কারাতে সম্পর্কে ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের অনুসন্ধান আজও চলমান। যদিও অনেক মনীষী কারাতের উৎপত্তি নিয়ে মতভেদ পোষণ করেন, তথাপি বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের মতে, এর সূচনা প্রায় দেড় হাজার বছর আগে দক্ষিণ ভারতের এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী দারুমা তাইশীর মাধ্যমে। তিনি ধর্মীয় জ্ঞানচর্চার উদ্দেশ্যে ভারত থেকে চীনের হুনান প্রদেশের শাওলিন (সোরিনজি) মন্দিরে গমন করেন এবং সেখানেই খালি হাতে আত্মরক্ষার একটি কৌশল শিক্ষাদান শুরু করেন।
দারুমা শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়লে তার অনুসারীদের চেতনা ধরে রাখতে তিনি একটি ব্যায়াম-পদ্ধতি চালু করেন, যার নাম ছিল একি-কিনকিয়ো (ঊকও-কওঘকণঙ)। এটি ছিল চীনের আত্মরক্ষামূলক কৌশল কেন পো (কঊঘচঙ)-এর ভিত্তি। এই ধারা থেকেই চাইনিজ ফিস্ট নামে পরিচিত আত্মরক্ষা কৌশল বিকাশ লাভ করে, যা চীনে বহু শতাব্দী ধরে প্রচলিত ছিল।
এই কৌশল পরে ওকিনাওয়া দ্বীপে ছড়িয়ে পড়ে। পঞ্চদশ শতকে ওকিনাওয়ার রাজা ভারী অস্ত্র নিষিদ্ধ করলে ¯ানীয় অধিবাসীরা খালি হাতে আত্মরক্ষার কৌশল রপ্ত করতে বাধ্য হন। চীনা এবং ¯ানীয় কৌশল একীভূত হয়ে ওকিনাওয়াতে একটি নতুন পদ্ধতির জন্ম দেয়, যার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে বহু প্রশিক্ষণ শিবির।
১৯০৫ সালে ওকিনাওয়ার স্কুল পাঠ্যক্রমে এই আত্মরক্ষা পদ্ধতি যুক্ত করা হয়। মাষ্টার আনহো ইতোসুর তত্ত্বাবধানে এখানে শিক্ষাগ্রহণ করেন কারাতের জনকখ্যাত মাস্টার গিসিন ফুনাকোসি। ফুনাকোসি ১৯১৬ সালে জাপানে এই কৌশল প্রচার করেন এবং ডা. জিগারো কানোর সহযোগিতায় জুডো এবং দার্শনিক চর্চার সাথে একীভূত করেন।
১৯৩৬ সালে ফুনাকোসি একটি ¯ায়ী ক্লাব গঠন করেন এবং পরবর্তীতে জাপানে নানা সংগঠন গড়ে উঠে। বলা যায়, আত্মরক্ষার কৌশলের জন্ম চীনে, পরিপূর্ণতা ওকিনাওয়াতে এবং কাঠামোগত রূপ পায় জাপানে।
১৯৩৬ সালে ওকিনাওয়ার এক পত্রিকার উদ্যোগে কারাতে বিশেষজ্ঞদের সভায় “কারা” শব্দের স্বীকৃতি লাভ করে এবং ফুনাকোসি এর সঙ্গে দো শব্দ যুক্ত করেন, যার ফলে নাম হয় কারাতে-দো Ñ অর্থাৎ খালি হাতের পথ।
প্রথম দিকে কেবল কাতা বা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে কারাতে অনুশীলন হতো, যা ছিল সীমিত কার্যকর। পরবর্তীতে মাষ্টার ইয়ামাগুচি ও ওতসুকা কারাতে অনুশীলনে আক্রমণ ও আত্মরক্ষার বাস্তব কৌশল সংযুক্ত করেন। এতে কারাতের জনপ্রিয়তা দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ ধারায় বিকাশ ঘটে।
কারাতে চর্চার ধারাবাহিকতায় একতা আনার জন্য ফুনাকোসি ১৯৪৭ সালে ‘অল জাপান কারাতে অ্যাসোসিয়েশন’ গঠন করেন। যদিও প্রথম উদ্যোগ ব্যর্থ হয়, পরে ১৯৫৫ সালে দি জাপান কারাতে অ্যাসোসিয়েশন গঠনের মাধ্যমে নতুন ধারা সূচিত হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিশ্বজুড়ে কারাতের বিস্তার ঘটে। বিশেষত ফ্রান্স, ব্রিটেন ও আমেরিকায় কারাতে দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করে। জাপানি প্রশিক্ষকগণ ইউরোপ ও আমেরিকায় পেশাগত প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করলে বহু কারাতে ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ফেডারেশন অফ অল জাপান কারাতে দো অর্গানাইজেশন (ঋঅঔকঙ) এবং ১৯৭০ সালে টোকিওতে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম বিশ্ব কারাতে প্রতিযোগিতা। এরপর গঠিত হয় ওয়ার্ল্ড ইউনিয়ন অফ কারাতে দো অর্গানাইজেশন (ডটকঙ) ও ইউরোপিয়ান কারাতে ইউনিয়ন।
আধুনিক প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিকতা :
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী কারাতে শুধু খেলা নয়, এটি শৃঙ্খলা, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আত্মরক্ষার অন্যতম শক্তিশালী পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত হছে। বাংলাদেশেও অপরাধ প্রবণতা, জানমালের অনিরাপত্তা এবং সামাজিক অ¯িরতার পরিপ্রেক্ষিতে আত্মরক্ষা শেখার প্রয়োজনীয়তা ক্রমেই বাড়ছে। বাংলাদেশ দ-বিধি অনুযায়ী আত্মরক্ষা ও সম্পত্তি রক্ষার অধিকার আইনত স্বীকৃতÑএমনকি আক্রমণকারীর মৃত্যু ঘটানোও আইনি সীমার মধ্যে থাকতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে কারাতে কেবল শারীরিক কৌশল নয়, বরং আত্মবিশ্বাস, সংযম এবং মনোবলের চর্চাও বটে। সুতরাং ব্যক্তি, পরিবার এবং সমাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কারাতে প্রশিক্ষণ হতে পারে এক বাস্তব ও কার্যকর সমাধান।
[ লেখক : আইনজীবী, জজ কোর্ট, জয়পুরহাট ]