অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার_
জলবায়ু পরিবর্তন এখন আর কোনো অনুমানভিত্তিক ভবিষ্যৎ সমস্যা বা বৈজ্ঞানিক বিতর্কের বিষয় নয়; বরং এটি বাস্তব এবং চলমান বৈশ্বিক বিপর্যয়। এটি প্রতিনিয়ত মানবসভ্যতাকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছে। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়, তাপপ্রবাহ, বন্যা, খরা, বনানল, বরফ গলার দ্রুততা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, চরম আবহাওয়া, খাদ্য সংকট, স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং বাস্তুসংস্থানের ধ্বংসের মতো পরিস্থিতি দৃশ্যমান। বৈশ্বিক এই সংকট মোকাবিলায় বিশ্বের প্রধান প্ল্যাটফর্ম হলো জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন (UNFCCC), এবং তার বাৎসরিক সম্মেলন “কনফারেন্স অব পার্টিস (কপ)”। প্রতি বছর বিশ্বনেতা, বিজ্ঞানী, আন্তর্জাতিক সংস্থা, সিভিল সোসাইটি ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কপ-এর আয়োজন করা হয়। ২০২৫ সালে অনুষ্ঠিতব্য এই কপ৩০ আগের যেকোনো সম্মেলনের তুলনায় আরও তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, কারণ এটি এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হবে যখন প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য, নিঃসরণ হ্রাসের অগ্রগতি, জলবায়ু অর্থায়ন, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং লস ও ড্যামেজ ফান্ডের বাস্তবায়ন আন্তর্জাতিকভাবে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কপ২৮ থেকে কপ২৯ এরই ধারাবাহিকতায় আসছে কপ৩০ যা ১০ থেকে ২১ নভেম্বর ব্রাজিলের আমাজনের রেইনফরেস্ট অঞ্চলের কোল ঘেঁষে অবস্থিত শহর বেলেমে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রায় ১৫০ দেশের প্রতিনিধি তাদের নিজ দেশের জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় করণীয় নির্ধারণে একত্রিত হবেন কপ৩০। ব্রাজিলের জলবায়ু, জ্বালানি ও পরিবেশ বিষয়ক সচিব আন্দ্রে কোরিয়া দো লাগো সভাপতি হিসেবে কপ৩০-এর নেতৃত্ব দেবেন। তবে, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে (দ্বিতীয়বারের জন্য) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করার পরেও কপ৩০-কে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু অগ্রাধিকারগুলি বিশ্লেষণ এবং মোকাবেলা করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাব মোকাবিলার লক্ষ্যে ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত হয় বহুল আলোচিত প্যারিস চুক্তি। এই চুক্তির মূল উদ্দেশ্য ছিল বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা—বিশেষত শিল্পায়নের পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় উষ্ণতার হার ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখা এবং সর্বোচ্চ চেষ্টা করে তা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা। একই সঙ্গে উন্নত দেশগুলোর জন্য একটি বাধ্যতামূলক দায়িত্ব নির্ধারণ করা হয়, যাতে তারা জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলা, অভিযোজন সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং ক্ষয়ক্ষতি কমানোর লক্ষ্যে উন্নয়নশীল ও ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তা, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং সক্ষমতা উন্নয়নে সহযোগিতা প্রদান করবে। অর্থাৎ, বিশ্বকে জলবায়ুর বিপর্যয় থেকে রক্ষা করা এবং ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়াই ছিল প্যারিস চুক্তির প্রধান লক্ষ্য। ২০১৬ সালের নভেম্বরে কার্যকর হওয়া এই চুক্তিতে আরও উল্লেখ ছিল যে, ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমপক্ষে ৩০ শতাংশ হ্রাস এবং ২০৫০ সালের মধ্যে নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় নামাতে হবে। তবে সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও আন্তর্জাতিক জলবায়ু মূল্যায়নের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্যারিস চুক্তির নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এখনো বৈশ্বিক অগ্রগতি অত্যন্ত ধীর। দেশগুলোর বর্তমান প্রতিশ্রুতি ও কার্যক্রম বাস্তবায়নের গতিধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রায় ২.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে কপ৩০-এর সবচেয়ে বড় গুরুত্ব হলো প্যারিস চুক্তির ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস লক্ষ্য রক্ষা করা। আন্তর্জাতিক জলবায়ু গবেষণা সংস্থাগুলোর গবেষণা বলছে, শিল্পপূর্ব সময়ের তুলনায় পৃথিবীর তাপমাত্রা ইতোমধ্যে প্রায় ১.২ ডিগ্রি বেড়েছে, এবং বর্তমান গতিতে কার্বন নিঃসরণ চলতে থাকলে অল্প সময়ের মধ্যেই পৃথিবী ১.৫ ডিগ্রি সীমা অতিক্রম করবে। এই সীমা অতিক্রম করলে উপকূলীয় অঞ্চল ডুবে যাওয়া, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস, বৈশ্বিক খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হওয়া, পানযোগ্য পানির সংকট বৃদ্ধি, মহামারি ও স্বাস্থ্যঝুঁকি তীব্র হওয়া এবং কোটি কোটি মানুষের বাস্তুচ্যুত হয়ে জলবায়ু শরণার্থী হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। তাই কপ৩০ দেশগুলোতে বৈজ্ঞানিক প্রমাণের ভিত্তিতে আরও কঠোর নিঃসরণ হ্রাস পরিকল্পনা, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে দ্রুত রূপান্তর এবং জীবাশ্ম জ্বালানি ত্যাগের সময়সীমা নির্ধারণের মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণের একটি অপরিহার্য বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম।
এবারের কপ৩০ গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি বৈশ্বিক জ্বালানি খাতে ন্যায্যভিত্তিক রূপান্তরের (Just Energy Transition) প্রক্রিয়াকে সামনে নিয়ে আসবে। বর্তমানে বিশ্বে ব্যবহৃত শক্তির বৃহত্তর অংশই কয়লা, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। জীবাশ্ম জ্বালানি পৃথিবীর উষ্ণায়নের প্রধান উৎস হলেও অনেক দেশ তাদের অর্থনীতি এই জ্বালানির ওপরই টিকিয়ে রেখেছে। তবে এই কয়লা, গ্যাস এবং তেলের ওপর নির্ভরতা কমাতে আন্তর্জাতিক নীতি, অর্থায়ন ও প্রযুক্তি সহযোগিতা অপরিহার্য। উন্নত ও শিল্পোন্নত দেশগুলোকে শুধু নিজেদের নিঃসরণ কমানোই নয়, বরং উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে প্রযুক্তি ও আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে অনেক দেশ নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ, প্রযুক্তি ও অবকাঠামো এখনো অসম। তাই কপ৩০ বৈশ্বিক জ্বালানি রূপান্তরের গতিকে ত্বরান্বিত করার একটি কৌশলগত টার্নিং পয়েন্ট হয়ে উঠতে পারে।
Loss and Damage তহবিলের সঠিক স্বীকৃতি এবং ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য পূর্ণাঙ্গ এবং কার্যকর ক্ষতিপূরণ কাঠামো তৈরিও কপ৩০-এর আরেকটি বড় লক্ষ্য। উন্নত দেশগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শিল্পায়নের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ করেছে, যার ফল ভোগ করছে উন্নয়নশীল ও ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, নদীভাঙন, কৃষি ক্ষতি, অবকাঠামো ধ্বংস, পানির সংকট, উপকূল ভাঙনে সব কিছুর ক্ষতি পূরণে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিশ্রুতি দীর্ঘদিন ধরেই অসম্পূর্ণ। কপ২৮-এ লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিল প্রতিষ্ঠিত হলেও সেটি কীভাবে পরিচালিত হবে, কোন দেশের কত অবদান থাকবে, অর্থ কীভাবে বণ্টিত হবে—এসব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত কপ৩০-এ আসতে পারে, যা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর পক্ষে একটি ঐতিহাসিক সাফল্য হবে।
কপ৩০ বাংলাদেশের জন্য বৈশ্বিক পর্যায়ে জলবায়ু ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার একটি গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকার শীর্ষে থাকা বাংলাদেশ প্রতি বছর বড় ধরনের বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন, লবণাক্ততা বৃদ্ধি এবং কৃষি উৎপাদন হ্রাসের মতো সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বৃদ্ধি হলে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ স্থায়ীভাবে পানির নিচে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, এবং লাখ লাখ মানুষের বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই কপ৩০-এ বাংলাদেশের মূল দাবি হবে অ্যাডাপটেশন ফান্ড, লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিল এবং জলবায়ু অর্থায়নে বৈষম্য কমিয়ে সহজ শর্তে অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করা। কারণ বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য উপকূল সুরক্ষা, বাঁধ নির্মাণ, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র বৃদ্ধি, নদী খনন, লবণাক্ততা সহনশীল ফসল, পানিসংরক্ষণ এবং সবুজ অবকাঠামো নির্মাণের জন্য বড় বিনিয়োগ দরকার।
অন্যদিকে, কপ৩০ বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার সুযোগ এনে দিতে পারে। এশিয়ার অন্যতম কার্বন ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে সৌর ও বায়ু শক্তির পরিধি বাড়াচ্ছে, তবে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি, অর্থায়ন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এখনো পর্যাপ্ত নয়। কপ৩০-এ প্রযুক্তি হস্তান্তর, গ্রিন এনার্জি ফান্ড এবং গ্লোবাল কার্বন ট্রেডিং মত সিদ্ধান্ত বাংলাদেশকে পরিচ্ছন্ন জ্বালানি ব্যবস্থায় এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
কপ৩০ শুধু একটি বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলন নয়, বরং এটি পৃথিবীর ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব রক্ষার জন্য একটি বৈশ্বিক জবাবদিহির প্ল্যাটফর্ম। উন্নয়নশীল দেশগুলো সাধারণত অর্থায়নে বৈষম্যের কারণে বড় সমস্যায় পড়ে। উন্নত রাষ্ট্রগুলোকে তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে বাধ্য করা, কার্বন নিঃসরণ দ্রুত কমানো, নবায়নযোগ্য শক্তিতে রূপান্তর ত্বরান্বিত করা এবং জলবায়ু–ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অর্থনৈতিক সহায়তা নিশ্চিত করাই এর কেন্দ্রীয় লক্ষ্য। কপ৩০-এ নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তরের জন্য সমন্বিত আন্তর্জাতিক নীতি, প্রযুক্তি হস্তান্তর, কার্বন বাজার উন্নয়ন এবং বিনিয়োগ সহজীকরণের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। পৃথিবীর জন্য যেমন এই সম্মেলন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, তেমনি বাংলাদেশের জন্যও এটি টিকে থাকার লড়াইকে আন্তর্জাতিকভাবে আরও শক্তিশালী করার এক মহাসুযোগ। তাই কপ৩০ সফল হওয়া মানে শুধু একটি বৈশ্বিক সিদ্ধান্ত নয়, এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ পৃথিবী নিশ্চিত করার একটি অন্যন্য প্রচেষ্টা।
অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার, ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ; অধ্যাপক, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ; যুগ্ম সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এবং চেয়ারম্যান, বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)।
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার_
শনিবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৫
জলবায়ু পরিবর্তন এখন আর কোনো অনুমানভিত্তিক ভবিষ্যৎ সমস্যা বা বৈজ্ঞানিক বিতর্কের বিষয় নয়; বরং এটি বাস্তব এবং চলমান বৈশ্বিক বিপর্যয়। এটি প্রতিনিয়ত মানবসভ্যতাকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছে। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়, তাপপ্রবাহ, বন্যা, খরা, বনানল, বরফ গলার দ্রুততা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, চরম আবহাওয়া, খাদ্য সংকট, স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং বাস্তুসংস্থানের ধ্বংসের মতো পরিস্থিতি দৃশ্যমান। বৈশ্বিক এই সংকট মোকাবিলায় বিশ্বের প্রধান প্ল্যাটফর্ম হলো জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন (UNFCCC), এবং তার বাৎসরিক সম্মেলন “কনফারেন্স অব পার্টিস (কপ)”। প্রতি বছর বিশ্বনেতা, বিজ্ঞানী, আন্তর্জাতিক সংস্থা, সিভিল সোসাইটি ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কপ-এর আয়োজন করা হয়। ২০২৫ সালে অনুষ্ঠিতব্য এই কপ৩০ আগের যেকোনো সম্মেলনের তুলনায় আরও তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, কারণ এটি এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হবে যখন প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য, নিঃসরণ হ্রাসের অগ্রগতি, জলবায়ু অর্থায়ন, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং লস ও ড্যামেজ ফান্ডের বাস্তবায়ন আন্তর্জাতিকভাবে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কপ২৮ থেকে কপ২৯ এরই ধারাবাহিকতায় আসছে কপ৩০ যা ১০ থেকে ২১ নভেম্বর ব্রাজিলের আমাজনের রেইনফরেস্ট অঞ্চলের কোল ঘেঁষে অবস্থিত শহর বেলেমে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রায় ১৫০ দেশের প্রতিনিধি তাদের নিজ দেশের জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় করণীয় নির্ধারণে একত্রিত হবেন কপ৩০। ব্রাজিলের জলবায়ু, জ্বালানি ও পরিবেশ বিষয়ক সচিব আন্দ্রে কোরিয়া দো লাগো সভাপতি হিসেবে কপ৩০-এর নেতৃত্ব দেবেন। তবে, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে (দ্বিতীয়বারের জন্য) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করার পরেও কপ৩০-কে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু অগ্রাধিকারগুলি বিশ্লেষণ এবং মোকাবেলা করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাব মোকাবিলার লক্ষ্যে ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত হয় বহুল আলোচিত প্যারিস চুক্তি। এই চুক্তির মূল উদ্দেশ্য ছিল বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা—বিশেষত শিল্পায়নের পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় উষ্ণতার হার ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখা এবং সর্বোচ্চ চেষ্টা করে তা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা। একই সঙ্গে উন্নত দেশগুলোর জন্য একটি বাধ্যতামূলক দায়িত্ব নির্ধারণ করা হয়, যাতে তারা জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলা, অভিযোজন সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং ক্ষয়ক্ষতি কমানোর লক্ষ্যে উন্নয়নশীল ও ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তা, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং সক্ষমতা উন্নয়নে সহযোগিতা প্রদান করবে। অর্থাৎ, বিশ্বকে জলবায়ুর বিপর্যয় থেকে রক্ষা করা এবং ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়াই ছিল প্যারিস চুক্তির প্রধান লক্ষ্য। ২০১৬ সালের নভেম্বরে কার্যকর হওয়া এই চুক্তিতে আরও উল্লেখ ছিল যে, ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমপক্ষে ৩০ শতাংশ হ্রাস এবং ২০৫০ সালের মধ্যে নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় নামাতে হবে। তবে সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও আন্তর্জাতিক জলবায়ু মূল্যায়নের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্যারিস চুক্তির নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এখনো বৈশ্বিক অগ্রগতি অত্যন্ত ধীর। দেশগুলোর বর্তমান প্রতিশ্রুতি ও কার্যক্রম বাস্তবায়নের গতিধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রায় ২.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে কপ৩০-এর সবচেয়ে বড় গুরুত্ব হলো প্যারিস চুক্তির ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস লক্ষ্য রক্ষা করা। আন্তর্জাতিক জলবায়ু গবেষণা সংস্থাগুলোর গবেষণা বলছে, শিল্পপূর্ব সময়ের তুলনায় পৃথিবীর তাপমাত্রা ইতোমধ্যে প্রায় ১.২ ডিগ্রি বেড়েছে, এবং বর্তমান গতিতে কার্বন নিঃসরণ চলতে থাকলে অল্প সময়ের মধ্যেই পৃথিবী ১.৫ ডিগ্রি সীমা অতিক্রম করবে। এই সীমা অতিক্রম করলে উপকূলীয় অঞ্চল ডুবে যাওয়া, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস, বৈশ্বিক খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হওয়া, পানযোগ্য পানির সংকট বৃদ্ধি, মহামারি ও স্বাস্থ্যঝুঁকি তীব্র হওয়া এবং কোটি কোটি মানুষের বাস্তুচ্যুত হয়ে জলবায়ু শরণার্থী হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। তাই কপ৩০ দেশগুলোতে বৈজ্ঞানিক প্রমাণের ভিত্তিতে আরও কঠোর নিঃসরণ হ্রাস পরিকল্পনা, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে দ্রুত রূপান্তর এবং জীবাশ্ম জ্বালানি ত্যাগের সময়সীমা নির্ধারণের মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণের একটি অপরিহার্য বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম।
এবারের কপ৩০ গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি বৈশ্বিক জ্বালানি খাতে ন্যায্যভিত্তিক রূপান্তরের (Just Energy Transition) প্রক্রিয়াকে সামনে নিয়ে আসবে। বর্তমানে বিশ্বে ব্যবহৃত শক্তির বৃহত্তর অংশই কয়লা, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। জীবাশ্ম জ্বালানি পৃথিবীর উষ্ণায়নের প্রধান উৎস হলেও অনেক দেশ তাদের অর্থনীতি এই জ্বালানির ওপরই টিকিয়ে রেখেছে। তবে এই কয়লা, গ্যাস এবং তেলের ওপর নির্ভরতা কমাতে আন্তর্জাতিক নীতি, অর্থায়ন ও প্রযুক্তি সহযোগিতা অপরিহার্য। উন্নত ও শিল্পোন্নত দেশগুলোকে শুধু নিজেদের নিঃসরণ কমানোই নয়, বরং উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে প্রযুক্তি ও আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে অনেক দেশ নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ, প্রযুক্তি ও অবকাঠামো এখনো অসম। তাই কপ৩০ বৈশ্বিক জ্বালানি রূপান্তরের গতিকে ত্বরান্বিত করার একটি কৌশলগত টার্নিং পয়েন্ট হয়ে উঠতে পারে।
Loss and Damage তহবিলের সঠিক স্বীকৃতি এবং ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য পূর্ণাঙ্গ এবং কার্যকর ক্ষতিপূরণ কাঠামো তৈরিও কপ৩০-এর আরেকটি বড় লক্ষ্য। উন্নত দেশগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শিল্পায়নের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ করেছে, যার ফল ভোগ করছে উন্নয়নশীল ও ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, নদীভাঙন, কৃষি ক্ষতি, অবকাঠামো ধ্বংস, পানির সংকট, উপকূল ভাঙনে সব কিছুর ক্ষতি পূরণে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিশ্রুতি দীর্ঘদিন ধরেই অসম্পূর্ণ। কপ২৮-এ লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিল প্রতিষ্ঠিত হলেও সেটি কীভাবে পরিচালিত হবে, কোন দেশের কত অবদান থাকবে, অর্থ কীভাবে বণ্টিত হবে—এসব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত কপ৩০-এ আসতে পারে, যা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর পক্ষে একটি ঐতিহাসিক সাফল্য হবে।
কপ৩০ বাংলাদেশের জন্য বৈশ্বিক পর্যায়ে জলবায়ু ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার একটি গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকার শীর্ষে থাকা বাংলাদেশ প্রতি বছর বড় ধরনের বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন, লবণাক্ততা বৃদ্ধি এবং কৃষি উৎপাদন হ্রাসের মতো সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বৃদ্ধি হলে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ স্থায়ীভাবে পানির নিচে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, এবং লাখ লাখ মানুষের বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই কপ৩০-এ বাংলাদেশের মূল দাবি হবে অ্যাডাপটেশন ফান্ড, লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিল এবং জলবায়ু অর্থায়নে বৈষম্য কমিয়ে সহজ শর্তে অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করা। কারণ বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য উপকূল সুরক্ষা, বাঁধ নির্মাণ, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র বৃদ্ধি, নদী খনন, লবণাক্ততা সহনশীল ফসল, পানিসংরক্ষণ এবং সবুজ অবকাঠামো নির্মাণের জন্য বড় বিনিয়োগ দরকার।
অন্যদিকে, কপ৩০ বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার সুযোগ এনে দিতে পারে। এশিয়ার অন্যতম কার্বন ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে সৌর ও বায়ু শক্তির পরিধি বাড়াচ্ছে, তবে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি, অর্থায়ন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এখনো পর্যাপ্ত নয়। কপ৩০-এ প্রযুক্তি হস্তান্তর, গ্রিন এনার্জি ফান্ড এবং গ্লোবাল কার্বন ট্রেডিং মত সিদ্ধান্ত বাংলাদেশকে পরিচ্ছন্ন জ্বালানি ব্যবস্থায় এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
কপ৩০ শুধু একটি বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলন নয়, বরং এটি পৃথিবীর ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব রক্ষার জন্য একটি বৈশ্বিক জবাবদিহির প্ল্যাটফর্ম। উন্নয়নশীল দেশগুলো সাধারণত অর্থায়নে বৈষম্যের কারণে বড় সমস্যায় পড়ে। উন্নত রাষ্ট্রগুলোকে তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে বাধ্য করা, কার্বন নিঃসরণ দ্রুত কমানো, নবায়নযোগ্য শক্তিতে রূপান্তর ত্বরান্বিত করা এবং জলবায়ু–ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অর্থনৈতিক সহায়তা নিশ্চিত করাই এর কেন্দ্রীয় লক্ষ্য। কপ৩০-এ নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তরের জন্য সমন্বিত আন্তর্জাতিক নীতি, প্রযুক্তি হস্তান্তর, কার্বন বাজার উন্নয়ন এবং বিনিয়োগ সহজীকরণের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। পৃথিবীর জন্য যেমন এই সম্মেলন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, তেমনি বাংলাদেশের জন্যও এটি টিকে থাকার লড়াইকে আন্তর্জাতিকভাবে আরও শক্তিশালী করার এক মহাসুযোগ। তাই কপ৩০ সফল হওয়া মানে শুধু একটি বৈশ্বিক সিদ্ধান্ত নয়, এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ পৃথিবী নিশ্চিত করার একটি অন্যন্য প্রচেষ্টা।
অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার, ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ; অধ্যাপক, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ; যুগ্ম সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এবং চেয়ারম্যান, বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)।