জিয়াউদ্দীন আহমেদ
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আমৃত্যু দন্ডাদেশপ্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ও সাবেক এমপি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ১৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কারাহেফাজতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ১৩ আগস্ট বিকালে বুকের ব্যথায় অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়; কিন্তু সেখানে অবস্থার অবনতি হলে তাকে ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়।
জন্ম-মৃত্যু আল্লাহতালার নির্ধারিত সময়ে হয় বলে চিকিৎসকদের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও তাকে বাঁচানো যায়নি। প্রায় একই সময় ঢাকাসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় ৫.৫ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে; আর এই ভূমিকম্পকে সাঈদীর মৃত্যুর সঙ্গে সম্পর্কিত করেছেন কিছু কুসংস্কারাচ্ছন্ন আবেগপ্রবণ মানুষ।
কিন্তু আল্লাহর হুকুম না থাকলে পৃথিবীর এমন কোন শক্তি নেই, যে শক্তি কারো জীবন নিতে পারে। কার কোথায় কখন কিভাবে মৃত্যু হবে তা পূর্বনির্ধারিত, জেল-জরিমানা-ফাঁসি উছিলা মাত্র। যখন সময় আসবে তখন মুহূর্তকালও কেউ দেরি করতে পারবে না অথবা তাড়াতাড়িও করতে পারবে না। ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি, মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল সাঈদীকে মৃত্যুদন্ডাদেশ দিলে তাকে চাঁদে দেখা গেছে গুজব ছড়িয়ে বগুড়া, রাজশাহী, নাটোর, জয়পুরহাট, ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরা ও চট্টগ্রামসহ ৩৪ জেলায় ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। সহিসংতার প্রথম দিনেই ২২ জন নিহত হয়, শুধু বগুড়াতেই নিহত হয় ১১ জন। এই সহিংসতায় সর্বমোট নিহত হয় ৭৮ জন। পুলিশ ফাঁড়ি ও পুলিশের গাড়িতে আগুন দেয়া ছাড়াও উত্তেজিত জনতা বিভিন্ন উপজেলা কার্যালয়ে হামলা চালায়, বাস ও আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। জামায়াতের কিছু কর্মী মসজিদের মাইক এবং মোবাইল ফোনের মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে সাঈদীর সমর্থকদের বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল।
ধর্মকে কাজে লাগিয়ে সাধারণ মানুষের আবেগকে তাড়িত করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করার কৌশল যুগ যুগ ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। জীবিত থাকাকালীন পাকিস্তানের সেনা প্রেসিডেন্ট দম্ভ করে বলেছিলেন, তিনি আল্লাহর ‘মিশন’ বাস্তবায়নের জন্য আল্লাহর দ্বারা ‘নিয়োগপ্রাপ্ত’ বলে তাকে কোন বিপ্লব বা আন্দোলন দ্বারা সরানো যাবে না। অবশ্য হয়েছিলও তা-ই- আল্লাহর হুকুমে তার মৃত্যু হয়েছিল ১৯৮৮ সালে বিমান দুর্ঘটনায়। সেনাশাসক জিয়াউল হককে বহনকারী বিমানটি বোমা বিস্ফোরণে ধ্বংস হলে জিয়াউল হকসহ আমেরিকান রাষ্ট্রদূতও মারা যান। জিয়াউল হক পাকিস্তানে শরিয়া আইনের প্রবর্তক বিধায় তার মাহাত্ম তুলে ধরার অভিপ্রায়ে প্রচার করা হয় যে, জিয়াউল হক পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও তার বুকে বেঁধে রাখা কোরআন শরীফ অক্ষত ছিল।
১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার আমলে সংঘটিত ঘূর্ণিঝড়ে ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত করে এবং এই জলোচ্ছ্বসে চট্টগ্রাম জেলার উপকূল ও উপকূলীয় দ্বীপসমূহে প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ নিহত হয়। তখনো প্রচার করা হয়েছিল যে, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে সবকিছু নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও বহু জায়গায় কোরআন শরীফ অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেছে।
এছাড়া খালেদা জিয়ার ক্ষমতায় আসার পরপর প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘনঘটায় ধর্মান্ধরা বলাবলি শুরু করে দিল যে, ‘মহিলা প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় আল্লাহর গজব নেমেছে’। তখন মাহমুদুর রহমান মান্না একটি কলাম লিখে উল্লেখ করেছিলেন যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে নারীর প্রধানমন্ত্রীত্বের কোন সম্পর্ক নেই। কথা বলতে গিয়ে ভুল করার সঙ্গে সুচিন্তিতভাবে বলা মিথ্যা কথার পার্থক্য অনেক।
১৯৬৯ সালে চাঁদে মানুষের পদার্পণের পর বলা শুরু হলো- যারা চাঁদে গিয়েছেন তারা চাঁদে আজানের আওয়াজ শুনতে পেয়েছেন, চাঁদ দুই ভাগ হওয়ার চিহ্নও তারা দেখে এসেছেন, পৃথিবীতে ফেরত এসে নীল আর্মস্ট্রং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। ভুল ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে ধর্মকে গৌরবান্বিত করার এই অপচেষ্টা আর থামানো যায়নি। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক কোন উদ্দেশ্য ছিল না, উদ্দেশ্য ছিল ধর্মগ্রন্থের মাহাত্ম প্রচার করা।
এই মিথ্যা ও বিভ্রান্ত সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন ইনকিলাবের ‘কাজীর দরবার’-এর লেখক। তিনি লিখেছিলেন, এসব মিথ্যার মধ্যে মানুষ যখন পরবর্তীতে সত্যতা খুঁজে পায় না তখন ধর্মের ব্যাপারে হতাশার সৃষ্টি হয়। ইসলামকে মহিমান্বিত করার জন্য যেসব গুজব বা মিথ্যার প্রচার করা হয় তাতে মিথ্যার বেসাতি হয়। কোরআনের মাহাত্ম প্রচার করতে গিয়ে মাওলানা আমির হামজা বলেছিলেন, কোন মুসলমানের করোনা হলে কোরআন মিথ্যা হয়ে যাবে। এভাবে ডাহা মিথ্যা না বলে ইসলামকে মহিমান্বিত করার দায়িত্ব আল্লাহর ওপর ছেড়ে দেয়াই সমীচীন।
আমরা যারা পাঠক তাদেরও দায় আছে, সত্যাসত্য বিচারের ধার ধারি না। কেউ কিছু বললেই সেটিকে সত্য জ্ঞান করার অভ্যাসও ত্যাগ করতে হবে।শ্রোতার কাছে মুখ্য হওয়া উচিত বক্তব্য, বক্তা নয়। মানব সমাজে এরিস্টটল একজন গুরুত্বপূর্ণ মনীষী, কিন্তু তাই বলে তার সব কথা বিনা বিচারে গ্রহণ করি না- নারীদের মুখে দাঁতের সংখ্যা পুরুষদের চেয়ে কম; গর্ভধারণ করা উচিত শীতকালে, যখন বাতাস উত্তর দিক থেকে বয়; কম বয়সে বিয়ে করলে মেয়ে বাচ্চা হবে; পুরুষদের চেয়ে নারীদের রক্ত অধিক কালো ইত্যাদি কেউ মানে না।
তাই শুধু পড়াশোনা করলে হবে না, পড়াশোনা করার সময় গ্রহণ-বর্জনের সক্ষমতাকে জাগিয়ে তুলতে হবে। আমাদের জানতে হবে, বুঝতে হবে, যুক্তির নিরিখে বিচার করতে হবে। কারণ ইসলাম ধর্মের মালিকানা আল্লাহ কোনো মাওলানা গোষ্ঠীকে দিয়ে দিয়েছেন, এরকমটি শোনা যায় না। সত্তর দশকে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র- থাকি ফজলুল হক হলে। একদিন হাইকোর্টের ভেতর সাঈদীর ওয়াজ শুনতে গিয়ে আটকে গিয়েছিলাম। ওয়াজ থেকে কোনভাবেই আসতে পারছিলাম না, কারণ সাঈদী সাহেবের হুঁশিয়ারি ছিল, কেউ শয়তানের আছরে পড়তে চাইলে ওয়াজ ছেড়ে মাঝপথে চলে যাবে। শয়তানের আছরের ভয়ে পুরো ওয়াজ শুনেছি।
শাহ আবদুল হান্নান যখন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর তখন সাঈদী সাহেবের সঙ্গে আবার দেখা, বাংলাদেশ ব্যাংকের সিরাতুন্নবীর এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে দাওয়াত দিতে হান্নান সাহেব আমাদের কয়েকজনকে সাঈদীর কাছে পাঠান। আমি তখন বাংলাদেশ ব্যাংক অফিসার্স ওয়েলফেয়ার কাউন্সিলের সভাপতি; সাঈদী সাহেবকে হান্নান স্যারের দাওয়াতের কথা জানানোর পর তিনি বললেন, ‘আপনারা যদি পরিবহন সরবরাহ করেন তাহলে ৪ হাজার টাকা রেখে যান’। সাঈদীর মৃত্যুর কারণে ভূমিকম্প হওয়ার কথা যারা বলছেন তারা ধর্মের মাহাত্মের প্রচার করছেন না, তারা করছেন রাজনীতি, যে রাজনীতি পবিত্র ধর্মকে কলুষিত করছে।
হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর পুত্র ইব্রাহীম (রা.) যে দিন ইন্তেকাল করেন সেদিন সূর্যগ্রহণ হলে লোকেরা বলাবলি করতে লাগল, ইব্রাহীম (রা.)-এর মৃত্যুর কারণেই সূর্যগ্রহণ হয়েছে; তখন নবীজী বললেন, কারো মৃত্যু অথবা জন্মের কারণে সূর্য বা চন্দ্রগ্রহণ হয় না। কিন্তু প্রকৃতির তান্ডবে মানুষের অসহায়ত্ব বেড়ে যায়, অসহায়ত্ব বেড়ে গেলে সহজাত প্রবৃত্তি থেকে মানুষ ধর্মকর্মে মনোযোগী হয় বেশি।
ধর্মপ্রাণ লোকদের আবেগ অনুভূতির পুরোটাই দখল করে রেখেছে ধর্ম, তাই তারা সহজেই আন্দোলিত হন। শুধু অশিক্ষিত-নিরক্ষর লোক নয়, শিক্ষিত লোকেরাও অলৌকিক কুদরতিতে বিশ্বাস করেন। মানুষের জ্ঞান, বিজ্ঞানের যুক্তি দ্বারা সমৃদ্ধ না হলে কুসংস্কার বাসা বাঁধবেই। এক সময় প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তির বশীভূত ছিল মানুষ, তখন যাকেই তার সম্মুখে তার চেয়ে বেশি ক্ষমতাবান মনে হয়েছে তাকেই সঙ্গে সঙ্গে আরাধনা শুরু করেছে। অধিক শক্তির আধারকে শুধু আরাধনা করেই ক্ষান্ত হতো না, তাকে তুষ্ট করতে নানা অর্ঘ বা উপাচারও উৎসর্গ করত।
পৃথিবীতে এখনো প্রচুর অগ্নি উপাসক রয়েছে, কারণ আগুনকে মানুষ করায়ত্ব করতে পারছে না। জলাশয় আর বনজঙ্গল যত হ্রাস পাচ্ছে সর্প পূজা তত কমছে। কিন্তু সূর্যের পূজা থামেনি। চাঁদ নরম আলো বিতরণ করে বিধায় চাঁদের উপাসনা বোধহয় নেই। ঝড়-বৃষ্টি-কলেরা-বসন্তসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থামানোর জন্য রুষ্ট দেবতাকে তুষ্ট করতে নরবলির প্রথাও এই মনুষ্য সমাজে প্রচলন ছিল। খনন করা নতুন পুকুরে পানি পাওয়ার প্রত্যাশায় রাজা বা জমিদারের নির্দেশে শিশু বলি দেয়ার কাহিনী বাল্যকাল থেকেই শুনে আসছি। এখনো ভারতে কোন দুর্যোগের জন্য দায়ী করে বৃদ্ধা নারীদের ডাইনি আখ্যা দিয়ে পিটিয়ে বা আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়। অজ্ঞতা, অশিক্ষা, কুশিক্ষা থেকে মুক্তি পেতে বিজ্ঞান শিক্ষার বিকল্প নেই, কিন্তু শিক্ষিত মুলসলমানদের মিথ্যা এবং গুজব থেকে রক্ষা পেতে আল্লাহতালার হেদায়েত জরুরি।
[লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সাবেক এমডি, টাকশাল]
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
শনিবার, ১৯ আগস্ট ২০২৩
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আমৃত্যু দন্ডাদেশপ্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ও সাবেক এমপি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ১৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কারাহেফাজতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ১৩ আগস্ট বিকালে বুকের ব্যথায় অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়; কিন্তু সেখানে অবস্থার অবনতি হলে তাকে ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়।
জন্ম-মৃত্যু আল্লাহতালার নির্ধারিত সময়ে হয় বলে চিকিৎসকদের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও তাকে বাঁচানো যায়নি। প্রায় একই সময় ঢাকাসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় ৫.৫ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে; আর এই ভূমিকম্পকে সাঈদীর মৃত্যুর সঙ্গে সম্পর্কিত করেছেন কিছু কুসংস্কারাচ্ছন্ন আবেগপ্রবণ মানুষ।
কিন্তু আল্লাহর হুকুম না থাকলে পৃথিবীর এমন কোন শক্তি নেই, যে শক্তি কারো জীবন নিতে পারে। কার কোথায় কখন কিভাবে মৃত্যু হবে তা পূর্বনির্ধারিত, জেল-জরিমানা-ফাঁসি উছিলা মাত্র। যখন সময় আসবে তখন মুহূর্তকালও কেউ দেরি করতে পারবে না অথবা তাড়াতাড়িও করতে পারবে না। ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি, মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল সাঈদীকে মৃত্যুদন্ডাদেশ দিলে তাকে চাঁদে দেখা গেছে গুজব ছড়িয়ে বগুড়া, রাজশাহী, নাটোর, জয়পুরহাট, ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরা ও চট্টগ্রামসহ ৩৪ জেলায় ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। সহিসংতার প্রথম দিনেই ২২ জন নিহত হয়, শুধু বগুড়াতেই নিহত হয় ১১ জন। এই সহিংসতায় সর্বমোট নিহত হয় ৭৮ জন। পুলিশ ফাঁড়ি ও পুলিশের গাড়িতে আগুন দেয়া ছাড়াও উত্তেজিত জনতা বিভিন্ন উপজেলা কার্যালয়ে হামলা চালায়, বাস ও আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। জামায়াতের কিছু কর্মী মসজিদের মাইক এবং মোবাইল ফোনের মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে সাঈদীর সমর্থকদের বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল।
ধর্মকে কাজে লাগিয়ে সাধারণ মানুষের আবেগকে তাড়িত করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করার কৌশল যুগ যুগ ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। জীবিত থাকাকালীন পাকিস্তানের সেনা প্রেসিডেন্ট দম্ভ করে বলেছিলেন, তিনি আল্লাহর ‘মিশন’ বাস্তবায়নের জন্য আল্লাহর দ্বারা ‘নিয়োগপ্রাপ্ত’ বলে তাকে কোন বিপ্লব বা আন্দোলন দ্বারা সরানো যাবে না। অবশ্য হয়েছিলও তা-ই- আল্লাহর হুকুমে তার মৃত্যু হয়েছিল ১৯৮৮ সালে বিমান দুর্ঘটনায়। সেনাশাসক জিয়াউল হককে বহনকারী বিমানটি বোমা বিস্ফোরণে ধ্বংস হলে জিয়াউল হকসহ আমেরিকান রাষ্ট্রদূতও মারা যান। জিয়াউল হক পাকিস্তানে শরিয়া আইনের প্রবর্তক বিধায় তার মাহাত্ম তুলে ধরার অভিপ্রায়ে প্রচার করা হয় যে, জিয়াউল হক পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও তার বুকে বেঁধে রাখা কোরআন শরীফ অক্ষত ছিল।
১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার আমলে সংঘটিত ঘূর্ণিঝড়ে ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত করে এবং এই জলোচ্ছ্বসে চট্টগ্রাম জেলার উপকূল ও উপকূলীয় দ্বীপসমূহে প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ নিহত হয়। তখনো প্রচার করা হয়েছিল যে, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে সবকিছু নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও বহু জায়গায় কোরআন শরীফ অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেছে।
এছাড়া খালেদা জিয়ার ক্ষমতায় আসার পরপর প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘনঘটায় ধর্মান্ধরা বলাবলি শুরু করে দিল যে, ‘মহিলা প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় আল্লাহর গজব নেমেছে’। তখন মাহমুদুর রহমান মান্না একটি কলাম লিখে উল্লেখ করেছিলেন যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে নারীর প্রধানমন্ত্রীত্বের কোন সম্পর্ক নেই। কথা বলতে গিয়ে ভুল করার সঙ্গে সুচিন্তিতভাবে বলা মিথ্যা কথার পার্থক্য অনেক।
১৯৬৯ সালে চাঁদে মানুষের পদার্পণের পর বলা শুরু হলো- যারা চাঁদে গিয়েছেন তারা চাঁদে আজানের আওয়াজ শুনতে পেয়েছেন, চাঁদ দুই ভাগ হওয়ার চিহ্নও তারা দেখে এসেছেন, পৃথিবীতে ফেরত এসে নীল আর্মস্ট্রং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। ভুল ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে ধর্মকে গৌরবান্বিত করার এই অপচেষ্টা আর থামানো যায়নি। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক কোন উদ্দেশ্য ছিল না, উদ্দেশ্য ছিল ধর্মগ্রন্থের মাহাত্ম প্রচার করা।
এই মিথ্যা ও বিভ্রান্ত সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন ইনকিলাবের ‘কাজীর দরবার’-এর লেখক। তিনি লিখেছিলেন, এসব মিথ্যার মধ্যে মানুষ যখন পরবর্তীতে সত্যতা খুঁজে পায় না তখন ধর্মের ব্যাপারে হতাশার সৃষ্টি হয়। ইসলামকে মহিমান্বিত করার জন্য যেসব গুজব বা মিথ্যার প্রচার করা হয় তাতে মিথ্যার বেসাতি হয়। কোরআনের মাহাত্ম প্রচার করতে গিয়ে মাওলানা আমির হামজা বলেছিলেন, কোন মুসলমানের করোনা হলে কোরআন মিথ্যা হয়ে যাবে। এভাবে ডাহা মিথ্যা না বলে ইসলামকে মহিমান্বিত করার দায়িত্ব আল্লাহর ওপর ছেড়ে দেয়াই সমীচীন।
আমরা যারা পাঠক তাদেরও দায় আছে, সত্যাসত্য বিচারের ধার ধারি না। কেউ কিছু বললেই সেটিকে সত্য জ্ঞান করার অভ্যাসও ত্যাগ করতে হবে।শ্রোতার কাছে মুখ্য হওয়া উচিত বক্তব্য, বক্তা নয়। মানব সমাজে এরিস্টটল একজন গুরুত্বপূর্ণ মনীষী, কিন্তু তাই বলে তার সব কথা বিনা বিচারে গ্রহণ করি না- নারীদের মুখে দাঁতের সংখ্যা পুরুষদের চেয়ে কম; গর্ভধারণ করা উচিত শীতকালে, যখন বাতাস উত্তর দিক থেকে বয়; কম বয়সে বিয়ে করলে মেয়ে বাচ্চা হবে; পুরুষদের চেয়ে নারীদের রক্ত অধিক কালো ইত্যাদি কেউ মানে না।
তাই শুধু পড়াশোনা করলে হবে না, পড়াশোনা করার সময় গ্রহণ-বর্জনের সক্ষমতাকে জাগিয়ে তুলতে হবে। আমাদের জানতে হবে, বুঝতে হবে, যুক্তির নিরিখে বিচার করতে হবে। কারণ ইসলাম ধর্মের মালিকানা আল্লাহ কোনো মাওলানা গোষ্ঠীকে দিয়ে দিয়েছেন, এরকমটি শোনা যায় না। সত্তর দশকে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র- থাকি ফজলুল হক হলে। একদিন হাইকোর্টের ভেতর সাঈদীর ওয়াজ শুনতে গিয়ে আটকে গিয়েছিলাম। ওয়াজ থেকে কোনভাবেই আসতে পারছিলাম না, কারণ সাঈদী সাহেবের হুঁশিয়ারি ছিল, কেউ শয়তানের আছরে পড়তে চাইলে ওয়াজ ছেড়ে মাঝপথে চলে যাবে। শয়তানের আছরের ভয়ে পুরো ওয়াজ শুনেছি।
শাহ আবদুল হান্নান যখন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর তখন সাঈদী সাহেবের সঙ্গে আবার দেখা, বাংলাদেশ ব্যাংকের সিরাতুন্নবীর এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে দাওয়াত দিতে হান্নান সাহেব আমাদের কয়েকজনকে সাঈদীর কাছে পাঠান। আমি তখন বাংলাদেশ ব্যাংক অফিসার্স ওয়েলফেয়ার কাউন্সিলের সভাপতি; সাঈদী সাহেবকে হান্নান স্যারের দাওয়াতের কথা জানানোর পর তিনি বললেন, ‘আপনারা যদি পরিবহন সরবরাহ করেন তাহলে ৪ হাজার টাকা রেখে যান’। সাঈদীর মৃত্যুর কারণে ভূমিকম্প হওয়ার কথা যারা বলছেন তারা ধর্মের মাহাত্মের প্রচার করছেন না, তারা করছেন রাজনীতি, যে রাজনীতি পবিত্র ধর্মকে কলুষিত করছে।
হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর পুত্র ইব্রাহীম (রা.) যে দিন ইন্তেকাল করেন সেদিন সূর্যগ্রহণ হলে লোকেরা বলাবলি করতে লাগল, ইব্রাহীম (রা.)-এর মৃত্যুর কারণেই সূর্যগ্রহণ হয়েছে; তখন নবীজী বললেন, কারো মৃত্যু অথবা জন্মের কারণে সূর্য বা চন্দ্রগ্রহণ হয় না। কিন্তু প্রকৃতির তান্ডবে মানুষের অসহায়ত্ব বেড়ে যায়, অসহায়ত্ব বেড়ে গেলে সহজাত প্রবৃত্তি থেকে মানুষ ধর্মকর্মে মনোযোগী হয় বেশি।
ধর্মপ্রাণ লোকদের আবেগ অনুভূতির পুরোটাই দখল করে রেখেছে ধর্ম, তাই তারা সহজেই আন্দোলিত হন। শুধু অশিক্ষিত-নিরক্ষর লোক নয়, শিক্ষিত লোকেরাও অলৌকিক কুদরতিতে বিশ্বাস করেন। মানুষের জ্ঞান, বিজ্ঞানের যুক্তি দ্বারা সমৃদ্ধ না হলে কুসংস্কার বাসা বাঁধবেই। এক সময় প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তির বশীভূত ছিল মানুষ, তখন যাকেই তার সম্মুখে তার চেয়ে বেশি ক্ষমতাবান মনে হয়েছে তাকেই সঙ্গে সঙ্গে আরাধনা শুরু করেছে। অধিক শক্তির আধারকে শুধু আরাধনা করেই ক্ষান্ত হতো না, তাকে তুষ্ট করতে নানা অর্ঘ বা উপাচারও উৎসর্গ করত।
পৃথিবীতে এখনো প্রচুর অগ্নি উপাসক রয়েছে, কারণ আগুনকে মানুষ করায়ত্ব করতে পারছে না। জলাশয় আর বনজঙ্গল যত হ্রাস পাচ্ছে সর্প পূজা তত কমছে। কিন্তু সূর্যের পূজা থামেনি। চাঁদ নরম আলো বিতরণ করে বিধায় চাঁদের উপাসনা বোধহয় নেই। ঝড়-বৃষ্টি-কলেরা-বসন্তসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থামানোর জন্য রুষ্ট দেবতাকে তুষ্ট করতে নরবলির প্রথাও এই মনুষ্য সমাজে প্রচলন ছিল। খনন করা নতুন পুকুরে পানি পাওয়ার প্রত্যাশায় রাজা বা জমিদারের নির্দেশে শিশু বলি দেয়ার কাহিনী বাল্যকাল থেকেই শুনে আসছি। এখনো ভারতে কোন দুর্যোগের জন্য দায়ী করে বৃদ্ধা নারীদের ডাইনি আখ্যা দিয়ে পিটিয়ে বা আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়। অজ্ঞতা, অশিক্ষা, কুশিক্ষা থেকে মুক্তি পেতে বিজ্ঞান শিক্ষার বিকল্প নেই, কিন্তু শিক্ষিত মুলসলমানদের মিথ্যা এবং গুজব থেকে রক্ষা পেতে আল্লাহতালার হেদায়েত জরুরি।
[লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সাবেক এমডি, টাকশাল]