alt

উপ-সম্পাদকীয়

ডিজিটাল শিল্পযুগ

মোস্তাফা জব্বার

: সোমবার, ২০ নভেম্বর ২০২৩

দশ ॥

টেকসই উন্নয়নের জন্য সোসাইটি ৫.০ এজেন্ডা ২০৩০ এর দিকে যাত্রার জন্য প্রস্তুত: আবে ক্যাবিনেটের গ্রোথ স্ট্যাটেজি (বৃদ্ধির কৌশল) এবং কেইদানরেনের নিজস্ব নীতি প্রস্তাব উভয়ই আশা করে যে সোসাইটি ৫.০ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যে (ঝউএং) একটি বড় অবদান রাখবে। যেহেতু সোসাইটি ৫.০ সামাজিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং একটি টেকসই, অন্তর্ভুক্তিমূলক, মানবকেন্দ্রিক সমাজকে অনুভব করার জন্য প্রস্তুত, তাই জাপান সরকার এবং কেইদানরেন এটি থেকে অনুমান করে যে, সোসাইটি ৫.০ এবং টেকসই উন্নয়ন উভয়ের লক্ষ্য (ঝউএং) এক।

কবরফধহৎবহ এমনকি নভেম্বর ২০১৭-এ তার আইন সংশোধন করেছে, এবং এর সংস্থাগুলোকে সোসাইটি ৫.০ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সক্রিয়ভাবে টেকসই উন্নয়নের জন্য আহ্বান জানিয়েছে।

কেন জাপানি সমাজ সোসাইটি ৫.০ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ? জাপান সামগ্রিকভাবে সোসাইটি ৫.০ এর দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি ক্রমবর্ধমান প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে মনে হচ্ছে। কারণ জাপানি সরকার এবং ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে দীর্ঘস্থায়ী প্রতিকূল বিষয়গুলোকে প্রতিহত করার জন্য এই সুবর্ণসুযোগটি কাজে লাগাতে চাইছে।

২০১৭ সালে টানা ষষ্ঠ বছরে জাপানের অর্থনীতি ২% এরও কম বৃদ্ধি পেয়েছে। ইউনেস্কো বিজ্ঞান প্রতিবেদন (২০১৫) দ্বারা স্মরণ করা হয়েছে, জাপান ১৯৯০ সাল থেকে দীর্ঘ অর্থনৈতিক স্থবিরতার সম্মুখীন হয়েছে, কারণ হিসেবে ক্রমাগত তীব্র বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা, নতুন ডিজিটাল অর্থনীতিতে পরিবর্তিত কাঠামো, জনসংখ্যা এবং বার্ধক্য এবং সামাজিক নিরাপত্তার ওপর ক্রমবর্ধমান সরকারি ব্যয় থেকে তৈরি আর্থিক চাপকে উল্লেখ করা হয়। সোসাইটি ৫.০ অনুসরণ করে জাপান এই ধরনের অসুবিধাগুলো কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হতে পারে। যদিও জাপান এখন পর্যন্ত ডিজিটাল শিল্পে খুব বেশি অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারেনি। যদিও যান্ত্রিক এবং প্রকৌশলে তার ঐতিহ্যগত শক্তির সদ্ব্যবহার করে সক্ষম হতে পারে। কর্মক্ষেত্রে সক্রিয়ভাবে অও চালু করার মাধ্যমে, কম শ্রম-নিবিড় অর্থনীতিতে জনসংখ্যা এবং বার্ধক্য অসুবিধাগুলো তাদের সুবিধাতে পরিণত হতে পারে।

জাপান কিছু কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে কিন্তু সরকার এবং ব্যবসায়ী নেতারা সোসাইটি ৫.০-এর ধারণাটিকে এ সংকটগুলো কাটিয়ে ওঠার উপায় হিসেবে দেখছেন। তারা যুক্তি দেয় যে জাপান বাকি বিশ্বের সঙ্গে তার নিজস্ব অভিজ্ঞতাগুলো ভাগ করে নেয়ার অবস্থানে থাকবে, কারণ অন্য দেশগুলো শীঘ্রই বা পরে একই রকম সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। ইতোমধ্যে, জাপানই কেবল একমাত্র উচ্চ আয়ের দেশ নয় যেখানে বার্ধক্যজনিত জনসংখ্যা এবং ধীর জনসংখ্যাগত বৃদ্ধির সম্মুখীন হচ্ছে, নতুন ডিজিটাল অর্থনীতিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য সংগ্রাম করছে।

জাপান সরকার এখন সোসাইটি ৫.০ এর জন্য তার দৃষ্টিভঙ্গি এবং সোসাইটি ৫.০ এবং ঝউএ-এর মধ্যে সংযোগটি জুনে ওসাকায় এ২০ শীর্ষ সম্মেলনে উপস্থাপন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

ঊঢচঙ ২০২৫, যা ঝউএং এবং সোসাইটি ৫.০ এর কর্মসূচি নিয়ে ওসাকায় অনুষ্ঠিত হবে, জাপানকে ভবিষ্যতের জন্য তার অভিনব দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্বের সঙ্গে শেয়ার করার আরেকটি সুযোগ দেয়া যেতে পারে।

ডিজিটাল বাংলাদেশ ও ডিজিটাল প্রসঙ্গ: আমাকে যদি ডিজিটাল শিল্প বিপ্লব ৪.০ বা সমাজ ৫.০ সম্পর্কে মতামত দিতে বলা হয় তবে সবিনয়ে আমরা এটি জানাতে চাই যে ২০০৮ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা করে আমরা সারা দুনিয়ার কাছেই একটি সার্বজনীন লক্ষ্য প্রকাশ করেছি। কেউ যদি আমার লেখা ২০০৭ সালের ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা ও তার পরবর্তী নিবন্ধগুলো বা ২০১৮ সালে প্রকাশিত (সর্বশেষ সংস্করণ) ডিজিটাল বাংলাদেশ বইটি পাঠ করেন তবে এটি উপলব্ধি করবেন যে, আমরা আর যাই থাকি না কেন চিন্তার দৈন্যদশায় নেই। বরং আমরা সারা বিশ্বের কাছে ডিজিটাল রূপান্তরের ইশতেহারও ঘোষণা করেছি। ২০০৯ সাল থেকে অব্যাহতভাবে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। ২০১৯ সালে আমরা সারা দুনিয়াকে ডিজিটাল রূপান্তরের স্বরূপ রচনা করে দিচ্ছি।

এখন অবস্থাটি এরকম যে, আমাদের মতো দেশগুলো আমাদের কর্মসূচিকে তাদের মতো সাজিয়ে অনুসরণ করতে পারে। জাপান, ব্রিটেন, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর বা জার্মানি যেমন করে আংশিক ডিজিটাল রূপান্তরের কথা বলছে আমরা তার চাইতে বহু পথ সামনে রয়েছি। একটু বাড়াবাড়ি হলেও আমি বলতে চাই যে, জাপানও ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণা থেকে শিক্ষা নিতে পারে। তাদের পরিকল্পনা মোটেই বাংলাদেশের চাইতে আগানো নয়। বরং আমার মনে হয় ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে আমরা যে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ছি জাপানের পঞ্চম সমাজ তার চাইতে এগিয়ে থাকা কিছু নয়।

বিশেষত চতুর্থ শিল্প বিপ্লব, পঞ্চম শিল্প বিপ্লব বা সোসাইটি ৫.০ থেকে আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশের মূল পার্থক্যটা হলো যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার মধ্য দিয়ে আমরা কেবল শিল্প বিপ্লব করতে চাই না, একটি ক্ষুধা-দারিদ্রমুক্ত-বৈষম্যহীন উন্নত বাংলাদেশকে তার জন্মের ঠিকানায় স্থাপন করতে চাই। এটি মনে রাখা দরকার যে, বাংলাদেশ পাকিস্তান-হিন্দুস্তানের মতো ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র নয়, বরং এটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলা ভাষাভিত্তিক জাতি রাষ্ট্র। সেজন্যই বাংলাদেশকে জন্মের ঠিকানায় স্থাপন করাটা কেবল একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা বা উৎপাদন ব্যবস্থা নয়। সেজন্য এটি কেবল ডিজিটাল প্রযুক্তির বিষয় নয়-অনেক বেশি অর্থনৈতিক বৈষম্যহীন ও বাঙালি জাতীয়তাবাদভিত্তিক। উপমহাদেশে পাকিস্তান ও ভারতে সাম্প্রদায়িকতার অস্বাভাবিক বিকাশের বিপরীতে ডিজিটাল বাংলাদেশ হচ্ছে ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতিস্বত্ত্বার অনন্য সাধারণ দৃষ্টান্ত।

বিশেষত চতুর্থ শিল্প বিপ্লব, পঞ্চম শিল্প বিপ্লব বা সোসাইটি ৫.০ থেকে আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশের মূল পার্থক্যটা হলো যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার মধ্য দিয়ে আমরা কেবল শিল্প বিপ্লব করতে চাই না, একটি ক্ষুধা-দারিদ্রমুক্ত-বৈষম্যহীন উন্নত বাংলাদেশকে তার জন্মের ঠিকানায় স্থাপন করতে চাই

ঐতিহাসিকভাবেই বাঙালি তার জাতিস্বত্ত্বার বিকাশে কৃষি যুগের পরবর্তী কোন রূপান্তর করতে পারেনি। খুব সঙ্গতকারণেই এখন সমাজটি গড়ে ওঠেছে অনেকটাই প্রাচীন বাংলা কৃষিতান্ত্রিক সামন্তবাদের ওপর ভিত্তি করে। শিল্পোন্নত দেশগুলোতে যেভাবে পুঁজির বিকাশ ঘটেছে এখানে সেটা ঘটেনি। বিগত এক দশকে শেখ হাসিনা সরকারের অদম্য প্রচেষ্টায় দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটছে; জাতীয় পুঁজির বিকাশ এবং বেসরকারি বিনিয়োগও ঘটেছে। অবকাঠামোগত উন্নয়নে এই এক দশক বস্তুত কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের জন্য স্বর্ণযুগ। দারিদ্র হ্রাস থেকে শুরু করে সব সূচকেই বাংলাদেশের অগ্রগতি অভাবনীয়। বাংলাদেশের স্বপ্নটাও কিন্তু তেমনি বড়। এই বাংলাদেশ ৪১ সালে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ আর উন্নত বাংলাদেশের পরিকল্পনা করেছে। বাংলাদেশের রয়েছে স্বাধীনতার শতবর্ষ পূর্তির প্রত্যয় এবং ২১০০ সালের বদ্বীপ পরিকল্পনা। যে বিষয়টি আমার কাছে খুবই জরুরি বিবেচ্য বিষয় বলে মনে হয় সেটি কেবল বস্তুগত সমৃদ্ধি নয়, আমাদের দেশটির জন্মের প্রতিজ্ঞায় স্থাপন করা এখন রীতিমতো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই দেশের খুব কম নাগরিকই আমাদের সংবিধানের চার নীতির সবগুলো এবং তার ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম নয়। ব্রিটিশ ভারতের বাকি দুটো রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান মৌলবাদকে প্রশ্রয় দিচ্ছে বিধায় সেখানে রাষ্ট্রযন্ত্র নিজেই মৌলবাদের পৃষ্ঠপোষক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের জন্য তাই একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়েছে। বিশ্বটা পুঁজিবাদী অর্থনীতির একচেটিয়া রূপ ধারণ করায় আমাদের সংবিধানের সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য অর্জন বা জাতির পিতার দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়ন আমাদের জন্য অতি প্রয়োজনীয়। যখনই দারিদ্র হ্রাস বা বৈষম্যহীন সমাজ তথা সমাজতন্ত্রের কথা বলা হয় তখনই শিল্পোন্নত দেশগুলো কল্যাণ রাষ্ট্রকে উদাহরণ হিসেবে স্থাপন করে। কিন্তু তারা অনুভব করে না যে ডিজিটাল যুগে একচেটিয়া পুঁজিবাদ-চরম বৈষম্য বা চরম দারিদ্র টিকিয়ে রাখা যাবে না। এমনকি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসেবেও পুঁজিবাদের অস্তিত্ত্ব বজায় রাখা কঠিন হবে।

একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বা মেধাশ্রমিকের দেশ মেধার বিচারে সমতা আনতে না পারলে তার অবিশ্বাস্য প্রবৃদ্ধিও চরম হুমকির মুখে পড়বে। সর্বোপরি ডিজিটাল রূপান্তরের যুগে নিজের দেশের মানবসম্পদকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারা এবং তাদেরকে কায়িক শ্রমিক থেকে মেধা শ্রমিকে পরিণত করাটা চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠবে। কোনকোন ক্ষেত্রে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রযুক্তি আমাদের সমগ্র রাষ্ট্র কাঠামোর জন্য চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবে। আমাদেরকে সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই টিকতে হবে। কোন দ্বিধা নেই একথা বলতে যে আমরা তাতে জয়ী হব। (সমাপ্ত)

ঢাকা। আপডেট ২২ অক্টোবর, ২০২৩।

[লেখক: তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, বিজয় কিবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং বিজয় ডিজিটাল শিক্ষা সফটওয়্যারের উদ্ভাবক]

সর্বজনীন শিক্ষার বলয়ের বাইরে আদিবাসীরা : অন্তর্ভুক্তির লড়াইয়ে বৈষম্যের দেয়াল

শোনার গান, দেখার টান : অনুভূতির ভোঁতা সময়

ছবি

ছিন্নপত্রে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও রবীন্দ্র চেতনা

ভেতরের অদৃশ্য অপরাধ : সমাজের বিপন্ন মানসিকতা

দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসনে খাসজমি ও জলার গুরুত্ব

অবহেলিত কৃষক ও বাজার ব্যবস্থার বৈষম্য

রাক্ষুসে মাছের দাপটে বিপন্ন দেশীয় মাছ : করণীয় কী?

বজ্রপাতের আতঙ্কে জনজীবন

তাহলে কি ঘৃণায় ছেয়ে যাবে দেশ, মানবজমিন রইবে পতিত

কর্পোরেট ও ব্যক্তিগত সামাজিক দায়বদ্ধতা

‘রাখাইন করিডর’ : একটি ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

ভিন্নমতের ভয়, নির্বাচনের দোলাচল ও অন্তর্বর্তী সরকারের কৌশলী অবস্থান

সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

কৃষি শিক্ষা হোক উদ্যোক্তা গড়ার মাধ্যম

রঙ্গব্যঙ্গ : কোটের কেবল রং বদলায়

মে দিবসের চেতনা বনাম বাস্তবতা

শ্রম আইন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় চাই আন্তরিকতা

বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকা কেন এত পিছিয়ে

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল : নিরাপদ যাত্রার প্রত্যাশা

কর ফাঁকি : অর্থনীতির জন্য এক অশনি সংকেত

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় : উপকূলীয় সুরক্ষার শিক্ষা

যখন নদীগুলো অস্ত্র হয়ে ওঠে

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুণগত মান উন্নয়নে গবেষণা ও উদ্ভাবন

বজ্রপাত ও তালগাছ : প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা

কুষ্ঠ ও বৈষম্য : মানবাধিকারের প্রশ্নে একটি অবহেলিত অধ্যায়

ছবি

প্রান্তজনের বাংলাদেশ

অতীতের ছায়ায় নতুন বাংলাদেশ : দুর্নীতি, উগ্রপন্থা ও সরকারের দায়

সাইবার নিরাপত্তা : অদৃশ্য যুদ্ধের সামনে আমাদের প্রস্তুতি

ছবি

বাহান্নর গর্ভে জন্ম নেয়া এক ঝড়ের পাখি

প্রবাসী শ্রমিক : অর্থের যন্ত্র নয়, রাষ্ট্রের সহযোদ্ধা

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির এক যুগ

ভোগবাদের বিরুদ্ধে পোপ ফ্রান্সিসের জলবায়ু বার্তা

রম্যগদ্য : হাসি নিষেধ...

পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের আন্দোলন : দাবি ও সমাধানের পথ

সিরিয়ার পতন কিভাবে আমেরিকার স্বার্থকে হুমকিতে ফেলছে

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র : বিকল্প রাষ্ট্রচিন্তার সন্ধানে

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ডিজিটাল শিল্পযুগ

মোস্তাফা জব্বার

সোমবার, ২০ নভেম্বর ২০২৩

দশ ॥

টেকসই উন্নয়নের জন্য সোসাইটি ৫.০ এজেন্ডা ২০৩০ এর দিকে যাত্রার জন্য প্রস্তুত: আবে ক্যাবিনেটের গ্রোথ স্ট্যাটেজি (বৃদ্ধির কৌশল) এবং কেইদানরেনের নিজস্ব নীতি প্রস্তাব উভয়ই আশা করে যে সোসাইটি ৫.০ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যে (ঝউএং) একটি বড় অবদান রাখবে। যেহেতু সোসাইটি ৫.০ সামাজিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং একটি টেকসই, অন্তর্ভুক্তিমূলক, মানবকেন্দ্রিক সমাজকে অনুভব করার জন্য প্রস্তুত, তাই জাপান সরকার এবং কেইদানরেন এটি থেকে অনুমান করে যে, সোসাইটি ৫.০ এবং টেকসই উন্নয়ন উভয়ের লক্ষ্য (ঝউএং) এক।

কবরফধহৎবহ এমনকি নভেম্বর ২০১৭-এ তার আইন সংশোধন করেছে, এবং এর সংস্থাগুলোকে সোসাইটি ৫.০ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সক্রিয়ভাবে টেকসই উন্নয়নের জন্য আহ্বান জানিয়েছে।

কেন জাপানি সমাজ সোসাইটি ৫.০ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ? জাপান সামগ্রিকভাবে সোসাইটি ৫.০ এর দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি ক্রমবর্ধমান প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে মনে হচ্ছে। কারণ জাপানি সরকার এবং ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে দীর্ঘস্থায়ী প্রতিকূল বিষয়গুলোকে প্রতিহত করার জন্য এই সুবর্ণসুযোগটি কাজে লাগাতে চাইছে।

২০১৭ সালে টানা ষষ্ঠ বছরে জাপানের অর্থনীতি ২% এরও কম বৃদ্ধি পেয়েছে। ইউনেস্কো বিজ্ঞান প্রতিবেদন (২০১৫) দ্বারা স্মরণ করা হয়েছে, জাপান ১৯৯০ সাল থেকে দীর্ঘ অর্থনৈতিক স্থবিরতার সম্মুখীন হয়েছে, কারণ হিসেবে ক্রমাগত তীব্র বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা, নতুন ডিজিটাল অর্থনীতিতে পরিবর্তিত কাঠামো, জনসংখ্যা এবং বার্ধক্য এবং সামাজিক নিরাপত্তার ওপর ক্রমবর্ধমান সরকারি ব্যয় থেকে তৈরি আর্থিক চাপকে উল্লেখ করা হয়। সোসাইটি ৫.০ অনুসরণ করে জাপান এই ধরনের অসুবিধাগুলো কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হতে পারে। যদিও জাপান এখন পর্যন্ত ডিজিটাল শিল্পে খুব বেশি অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারেনি। যদিও যান্ত্রিক এবং প্রকৌশলে তার ঐতিহ্যগত শক্তির সদ্ব্যবহার করে সক্ষম হতে পারে। কর্মক্ষেত্রে সক্রিয়ভাবে অও চালু করার মাধ্যমে, কম শ্রম-নিবিড় অর্থনীতিতে জনসংখ্যা এবং বার্ধক্য অসুবিধাগুলো তাদের সুবিধাতে পরিণত হতে পারে।

জাপান কিছু কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে কিন্তু সরকার এবং ব্যবসায়ী নেতারা সোসাইটি ৫.০-এর ধারণাটিকে এ সংকটগুলো কাটিয়ে ওঠার উপায় হিসেবে দেখছেন। তারা যুক্তি দেয় যে জাপান বাকি বিশ্বের সঙ্গে তার নিজস্ব অভিজ্ঞতাগুলো ভাগ করে নেয়ার অবস্থানে থাকবে, কারণ অন্য দেশগুলো শীঘ্রই বা পরে একই রকম সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। ইতোমধ্যে, জাপানই কেবল একমাত্র উচ্চ আয়ের দেশ নয় যেখানে বার্ধক্যজনিত জনসংখ্যা এবং ধীর জনসংখ্যাগত বৃদ্ধির সম্মুখীন হচ্ছে, নতুন ডিজিটাল অর্থনীতিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য সংগ্রাম করছে।

জাপান সরকার এখন সোসাইটি ৫.০ এর জন্য তার দৃষ্টিভঙ্গি এবং সোসাইটি ৫.০ এবং ঝউএ-এর মধ্যে সংযোগটি জুনে ওসাকায় এ২০ শীর্ষ সম্মেলনে উপস্থাপন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

ঊঢচঙ ২০২৫, যা ঝউএং এবং সোসাইটি ৫.০ এর কর্মসূচি নিয়ে ওসাকায় অনুষ্ঠিত হবে, জাপানকে ভবিষ্যতের জন্য তার অভিনব দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্বের সঙ্গে শেয়ার করার আরেকটি সুযোগ দেয়া যেতে পারে।

ডিজিটাল বাংলাদেশ ও ডিজিটাল প্রসঙ্গ: আমাকে যদি ডিজিটাল শিল্প বিপ্লব ৪.০ বা সমাজ ৫.০ সম্পর্কে মতামত দিতে বলা হয় তবে সবিনয়ে আমরা এটি জানাতে চাই যে ২০০৮ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা করে আমরা সারা দুনিয়ার কাছেই একটি সার্বজনীন লক্ষ্য প্রকাশ করেছি। কেউ যদি আমার লেখা ২০০৭ সালের ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা ও তার পরবর্তী নিবন্ধগুলো বা ২০১৮ সালে প্রকাশিত (সর্বশেষ সংস্করণ) ডিজিটাল বাংলাদেশ বইটি পাঠ করেন তবে এটি উপলব্ধি করবেন যে, আমরা আর যাই থাকি না কেন চিন্তার দৈন্যদশায় নেই। বরং আমরা সারা বিশ্বের কাছে ডিজিটাল রূপান্তরের ইশতেহারও ঘোষণা করেছি। ২০০৯ সাল থেকে অব্যাহতভাবে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। ২০১৯ সালে আমরা সারা দুনিয়াকে ডিজিটাল রূপান্তরের স্বরূপ রচনা করে দিচ্ছি।

এখন অবস্থাটি এরকম যে, আমাদের মতো দেশগুলো আমাদের কর্মসূচিকে তাদের মতো সাজিয়ে অনুসরণ করতে পারে। জাপান, ব্রিটেন, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর বা জার্মানি যেমন করে আংশিক ডিজিটাল রূপান্তরের কথা বলছে আমরা তার চাইতে বহু পথ সামনে রয়েছি। একটু বাড়াবাড়ি হলেও আমি বলতে চাই যে, জাপানও ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণা থেকে শিক্ষা নিতে পারে। তাদের পরিকল্পনা মোটেই বাংলাদেশের চাইতে আগানো নয়। বরং আমার মনে হয় ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে আমরা যে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ছি জাপানের পঞ্চম সমাজ তার চাইতে এগিয়ে থাকা কিছু নয়।

বিশেষত চতুর্থ শিল্প বিপ্লব, পঞ্চম শিল্প বিপ্লব বা সোসাইটি ৫.০ থেকে আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশের মূল পার্থক্যটা হলো যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার মধ্য দিয়ে আমরা কেবল শিল্প বিপ্লব করতে চাই না, একটি ক্ষুধা-দারিদ্রমুক্ত-বৈষম্যহীন উন্নত বাংলাদেশকে তার জন্মের ঠিকানায় স্থাপন করতে চাই। এটি মনে রাখা দরকার যে, বাংলাদেশ পাকিস্তান-হিন্দুস্তানের মতো ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র নয়, বরং এটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলা ভাষাভিত্তিক জাতি রাষ্ট্র। সেজন্যই বাংলাদেশকে জন্মের ঠিকানায় স্থাপন করাটা কেবল একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা বা উৎপাদন ব্যবস্থা নয়। সেজন্য এটি কেবল ডিজিটাল প্রযুক্তির বিষয় নয়-অনেক বেশি অর্থনৈতিক বৈষম্যহীন ও বাঙালি জাতীয়তাবাদভিত্তিক। উপমহাদেশে পাকিস্তান ও ভারতে সাম্প্রদায়িকতার অস্বাভাবিক বিকাশের বিপরীতে ডিজিটাল বাংলাদেশ হচ্ছে ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতিস্বত্ত্বার অনন্য সাধারণ দৃষ্টান্ত।

বিশেষত চতুর্থ শিল্প বিপ্লব, পঞ্চম শিল্প বিপ্লব বা সোসাইটি ৫.০ থেকে আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশের মূল পার্থক্যটা হলো যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার মধ্য দিয়ে আমরা কেবল শিল্প বিপ্লব করতে চাই না, একটি ক্ষুধা-দারিদ্রমুক্ত-বৈষম্যহীন উন্নত বাংলাদেশকে তার জন্মের ঠিকানায় স্থাপন করতে চাই

ঐতিহাসিকভাবেই বাঙালি তার জাতিস্বত্ত্বার বিকাশে কৃষি যুগের পরবর্তী কোন রূপান্তর করতে পারেনি। খুব সঙ্গতকারণেই এখন সমাজটি গড়ে ওঠেছে অনেকটাই প্রাচীন বাংলা কৃষিতান্ত্রিক সামন্তবাদের ওপর ভিত্তি করে। শিল্পোন্নত দেশগুলোতে যেভাবে পুঁজির বিকাশ ঘটেছে এখানে সেটা ঘটেনি। বিগত এক দশকে শেখ হাসিনা সরকারের অদম্য প্রচেষ্টায় দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটছে; জাতীয় পুঁজির বিকাশ এবং বেসরকারি বিনিয়োগও ঘটেছে। অবকাঠামোগত উন্নয়নে এই এক দশক বস্তুত কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের জন্য স্বর্ণযুগ। দারিদ্র হ্রাস থেকে শুরু করে সব সূচকেই বাংলাদেশের অগ্রগতি অভাবনীয়। বাংলাদেশের স্বপ্নটাও কিন্তু তেমনি বড়। এই বাংলাদেশ ৪১ সালে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ আর উন্নত বাংলাদেশের পরিকল্পনা করেছে। বাংলাদেশের রয়েছে স্বাধীনতার শতবর্ষ পূর্তির প্রত্যয় এবং ২১০০ সালের বদ্বীপ পরিকল্পনা। যে বিষয়টি আমার কাছে খুবই জরুরি বিবেচ্য বিষয় বলে মনে হয় সেটি কেবল বস্তুগত সমৃদ্ধি নয়, আমাদের দেশটির জন্মের প্রতিজ্ঞায় স্থাপন করা এখন রীতিমতো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই দেশের খুব কম নাগরিকই আমাদের সংবিধানের চার নীতির সবগুলো এবং তার ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম নয়। ব্রিটিশ ভারতের বাকি দুটো রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান মৌলবাদকে প্রশ্রয় দিচ্ছে বিধায় সেখানে রাষ্ট্রযন্ত্র নিজেই মৌলবাদের পৃষ্ঠপোষক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের জন্য তাই একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়েছে। বিশ্বটা পুঁজিবাদী অর্থনীতির একচেটিয়া রূপ ধারণ করায় আমাদের সংবিধানের সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য অর্জন বা জাতির পিতার দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়ন আমাদের জন্য অতি প্রয়োজনীয়। যখনই দারিদ্র হ্রাস বা বৈষম্যহীন সমাজ তথা সমাজতন্ত্রের কথা বলা হয় তখনই শিল্পোন্নত দেশগুলো কল্যাণ রাষ্ট্রকে উদাহরণ হিসেবে স্থাপন করে। কিন্তু তারা অনুভব করে না যে ডিজিটাল যুগে একচেটিয়া পুঁজিবাদ-চরম বৈষম্য বা চরম দারিদ্র টিকিয়ে রাখা যাবে না। এমনকি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসেবেও পুঁজিবাদের অস্তিত্ত্ব বজায় রাখা কঠিন হবে।

একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বা মেধাশ্রমিকের দেশ মেধার বিচারে সমতা আনতে না পারলে তার অবিশ্বাস্য প্রবৃদ্ধিও চরম হুমকির মুখে পড়বে। সর্বোপরি ডিজিটাল রূপান্তরের যুগে নিজের দেশের মানবসম্পদকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারা এবং তাদেরকে কায়িক শ্রমিক থেকে মেধা শ্রমিকে পরিণত করাটা চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠবে। কোনকোন ক্ষেত্রে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রযুক্তি আমাদের সমগ্র রাষ্ট্র কাঠামোর জন্য চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবে। আমাদেরকে সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই টিকতে হবে। কোন দ্বিধা নেই একথা বলতে যে আমরা তাতে জয়ী হব। (সমাপ্ত)

ঢাকা। আপডেট ২২ অক্টোবর, ২০২৩।

[লেখক: তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, বিজয় কিবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং বিজয় ডিজিটাল শিক্ষা সফটওয়্যারের উদ্ভাবক]

back to top