আর কে চৌধুরী
ঐতিহ্যগতভাবে আবর্জনার শহর হিসেবে যে দুর্নাম গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের রাজধানীর, এত প্রচেষ্টার পরও তা থেকে রেহাই মিলছে না। ঢাকা মহানগরীর ময়লা-আবর্জনা ফেলার জন্য বিভিন্ন স্থানে রয়েছে সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস)। পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা বর্জ্য সংগ্রহের পর জমা করে এসব এসটিএসে। তারপর সেগুলো নিয়ে যাওয়া হয় সিটি করপোরেশনের বর্জ্য রাখার ভাগাড়ে। তবে প্রায় প্রতিটি এসটিএসের পাশে রাস্তায় পড়ে থাকে ময়লার স্তূপ। টোকাইরা প্লাস্টিক বোতলসহ অন্যান্য পণ্য নিতে ময়লা-আবর্জনা ঘাঁটাঘাঁটি করে যেখানে সেখানে ছিটিয়ে রাখে। রাজধানীতে ২ শতাধিক স্থানে এসটিএস না থাকায় আবর্জনা উন্মুক্ত ফেলে রাখা হয়।
পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ঢাকা উত্তরে ৫৪টি ওয়ার্ড থাকলেও এখন পর্যন্ত ২৭টিতে এসটিএস তৈরি করতে পারেনি সংস্থাটি। অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি এখন পর্যন্ত ৬১টি ওয়ার্ডে এসটিএস নির্মাণ করেছে। দুই সিটি এলাকায় প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ৬ হাজার মেট্রিক টনের বেশি ময়লা তৈরি হচ্ছে। যার ৩০ ভাগ বর্জ্য এখনো উন্মুক্ত স্থানে রাখা হয়। এছাড়া প্লাস্টিকের বোতল, চিপসের প্যাকেটসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের মোড়ক পথচারীরা রাস্তায় ফেলছেন। একই সঙ্গে বাসাবাড়ির বর্জ্য এখনো বিভিন্ন সড়কের পাশে ফেলা হচ্ছে বেপরোয়াভাবে। সব মিলিয়ে ২০ ভাগ বর্জ্য এখনো সংগ্রহের বাইরে থেকে যাচ্ছে। যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনার নোংরা পরিস্থিতি বদলাতে ২০১৭ সালে ১৫ বছর মেয়াদি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য ২০১৯ সালের নভেম্বরে সেটি স্থানীয় সরকার বিভাগে পাঠানো হয়। প্রায় ২৭ মাস ওই খসড়া আটকে থাকার পর ২০২২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি এর অনুমোদন দেয় স্থানীয় সরকার বিভাগ। তবে সেই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে কোনো গতি নেই বললেই চলে। রাজধানীকে ময়লা-আবর্জনার নগরী হিসেবে দেখতে না চাইলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় গতি আনতে হবে। যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে অর্থদ-ের বিধান রাখাও জরুরি। তবেই সুফলের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
দেশে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বেহালের বিষয়টি বহুল আলোচিত হলেও এক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। হাসপাতালের কর্মীদের একাংশ মেডিকেল বর্জ্য নষ্ট বা ধ্বংস না করে সংক্রমিত অবস্থাতেই ভাঙারি দোকান ও রিসাইক্লিং কারখানায় বিক্রি করে দেয়। জানা যায়, হাসপাতালগুলোয় এ বর্জ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও পরিবহণে পর্যাপ্ত কর্মী নেই। এছাড়া হাসপাতালে নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্মীদের অপর্যাপ্ত জ্ঞান চিকিৎসা বর্জ্যরে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার একটি বড় অন্তরায়। এর নেপথ্যেও রয়েছে দুর্নীতি। টিআইবির হিসাব অনুযায়ী- ৫০ শতাংশেরও বেশি বর্জ্যকর্মী নিয়োগ পেয়েছেন দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে। সরকারি হাসপাতালে বর্জ্যকর্মীর কাজ পেতে ঘুষ দিতে হয়েছে। উদ্বেগজনক তথ্য হলোÑ ৪০ শতাংশের বেশি বর্জ্যকর্মীর প্রশিক্ষণ নেই; ৬০ শতাংশের বেশি বর্জ্যকর্মী নিজের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত গুরুত্বপূর্ণ বহু তথ্য জানেন না। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ অরাজক পরিস্থিতির অবসানে আন্তর্জাতিক মানদ- অনুসরণ করে চিকিৎসা বর্জ্য (ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ) বিধিমালা সংশোধন করা দরকার।
বস্তুত যে কোনো বর্জ্যেের আধুনিক ব্যবস্থাপনার কাজটি জটিল ও ব্যয়বহুল। চিকিৎসা বর্জ্য পরিবেশ বিপর্যয়েরও বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর মেডিকেল বর্জ্য যত্রতত্র রাখা হলেও এটি যেন দেখার কেউ নেই। অনেক রোগ ছড়াতে পারে চিকিৎসা বর্জ্যরে অনিরাপদ নিষ্কাশনের কারণে। ব্যবহৃত সিরিঞ্জ দিয়ে ইঞ্জেকশন নেয়ার কারণে অনেকে দুরারোগ্য রোগে ভুগছেন। এছাড়া এসব বর্জ্য সংগ্রহকারীরও অনেকে নানা জটিল রোগে ভোগেন। মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষ দায়িত্বশীলতার পরিচয় না দিলে এ খাতে সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা কঠিন হতে পারে। দেশে আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অনেক বাধা রয়েছে। এ খাতে উন্নত দেশের মতো অর্থ বরাদ্দ দেয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। তবে যেটুকু বরাদ্দ দেয়া হয়, সেই অর্থের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। দেশে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে কয়েক হাজার অবৈধ বেসরকারি ক্লিনিক-হাসপাতাল-ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এসব প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসার নামে মানুষ প্রতিনিয়ত প্রতারণার শিকার হচ্ছে। এসব অবৈধ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া না হলে আলোচিত খাতে উল্লেখযোগ্য প্রাপ্তি ঘটবে কিনাÑ এ বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
[লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, রাজউক]
আর কে চৌধুরী
বুধবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
ঐতিহ্যগতভাবে আবর্জনার শহর হিসেবে যে দুর্নাম গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের রাজধানীর, এত প্রচেষ্টার পরও তা থেকে রেহাই মিলছে না। ঢাকা মহানগরীর ময়লা-আবর্জনা ফেলার জন্য বিভিন্ন স্থানে রয়েছে সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস)। পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা বর্জ্য সংগ্রহের পর জমা করে এসব এসটিএসে। তারপর সেগুলো নিয়ে যাওয়া হয় সিটি করপোরেশনের বর্জ্য রাখার ভাগাড়ে। তবে প্রায় প্রতিটি এসটিএসের পাশে রাস্তায় পড়ে থাকে ময়লার স্তূপ। টোকাইরা প্লাস্টিক বোতলসহ অন্যান্য পণ্য নিতে ময়লা-আবর্জনা ঘাঁটাঘাঁটি করে যেখানে সেখানে ছিটিয়ে রাখে। রাজধানীতে ২ শতাধিক স্থানে এসটিএস না থাকায় আবর্জনা উন্মুক্ত ফেলে রাখা হয়।
পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ঢাকা উত্তরে ৫৪টি ওয়ার্ড থাকলেও এখন পর্যন্ত ২৭টিতে এসটিএস তৈরি করতে পারেনি সংস্থাটি। অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি এখন পর্যন্ত ৬১টি ওয়ার্ডে এসটিএস নির্মাণ করেছে। দুই সিটি এলাকায় প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ৬ হাজার মেট্রিক টনের বেশি ময়লা তৈরি হচ্ছে। যার ৩০ ভাগ বর্জ্য এখনো উন্মুক্ত স্থানে রাখা হয়। এছাড়া প্লাস্টিকের বোতল, চিপসের প্যাকেটসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের মোড়ক পথচারীরা রাস্তায় ফেলছেন। একই সঙ্গে বাসাবাড়ির বর্জ্য এখনো বিভিন্ন সড়কের পাশে ফেলা হচ্ছে বেপরোয়াভাবে। সব মিলিয়ে ২০ ভাগ বর্জ্য এখনো সংগ্রহের বাইরে থেকে যাচ্ছে। যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনার নোংরা পরিস্থিতি বদলাতে ২০১৭ সালে ১৫ বছর মেয়াদি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য ২০১৯ সালের নভেম্বরে সেটি স্থানীয় সরকার বিভাগে পাঠানো হয়। প্রায় ২৭ মাস ওই খসড়া আটকে থাকার পর ২০২২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি এর অনুমোদন দেয় স্থানীয় সরকার বিভাগ। তবে সেই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে কোনো গতি নেই বললেই চলে। রাজধানীকে ময়লা-আবর্জনার নগরী হিসেবে দেখতে না চাইলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় গতি আনতে হবে। যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে অর্থদ-ের বিধান রাখাও জরুরি। তবেই সুফলের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
দেশে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বেহালের বিষয়টি বহুল আলোচিত হলেও এক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। হাসপাতালের কর্মীদের একাংশ মেডিকেল বর্জ্য নষ্ট বা ধ্বংস না করে সংক্রমিত অবস্থাতেই ভাঙারি দোকান ও রিসাইক্লিং কারখানায় বিক্রি করে দেয়। জানা যায়, হাসপাতালগুলোয় এ বর্জ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও পরিবহণে পর্যাপ্ত কর্মী নেই। এছাড়া হাসপাতালে নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্মীদের অপর্যাপ্ত জ্ঞান চিকিৎসা বর্জ্যরে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার একটি বড় অন্তরায়। এর নেপথ্যেও রয়েছে দুর্নীতি। টিআইবির হিসাব অনুযায়ী- ৫০ শতাংশেরও বেশি বর্জ্যকর্মী নিয়োগ পেয়েছেন দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে। সরকারি হাসপাতালে বর্জ্যকর্মীর কাজ পেতে ঘুষ দিতে হয়েছে। উদ্বেগজনক তথ্য হলোÑ ৪০ শতাংশের বেশি বর্জ্যকর্মীর প্রশিক্ষণ নেই; ৬০ শতাংশের বেশি বর্জ্যকর্মী নিজের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত গুরুত্বপূর্ণ বহু তথ্য জানেন না। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ অরাজক পরিস্থিতির অবসানে আন্তর্জাতিক মানদ- অনুসরণ করে চিকিৎসা বর্জ্য (ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ) বিধিমালা সংশোধন করা দরকার।
বস্তুত যে কোনো বর্জ্যেের আধুনিক ব্যবস্থাপনার কাজটি জটিল ও ব্যয়বহুল। চিকিৎসা বর্জ্য পরিবেশ বিপর্যয়েরও বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর মেডিকেল বর্জ্য যত্রতত্র রাখা হলেও এটি যেন দেখার কেউ নেই। অনেক রোগ ছড়াতে পারে চিকিৎসা বর্জ্যরে অনিরাপদ নিষ্কাশনের কারণে। ব্যবহৃত সিরিঞ্জ দিয়ে ইঞ্জেকশন নেয়ার কারণে অনেকে দুরারোগ্য রোগে ভুগছেন। এছাড়া এসব বর্জ্য সংগ্রহকারীরও অনেকে নানা জটিল রোগে ভোগেন। মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষ দায়িত্বশীলতার পরিচয় না দিলে এ খাতে সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা কঠিন হতে পারে। দেশে আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অনেক বাধা রয়েছে। এ খাতে উন্নত দেশের মতো অর্থ বরাদ্দ দেয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। তবে যেটুকু বরাদ্দ দেয়া হয়, সেই অর্থের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। দেশে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে কয়েক হাজার অবৈধ বেসরকারি ক্লিনিক-হাসপাতাল-ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এসব প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসার নামে মানুষ প্রতিনিয়ত প্রতারণার শিকার হচ্ছে। এসব অবৈধ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া না হলে আলোচিত খাতে উল্লেখযোগ্য প্রাপ্তি ঘটবে কিনাÑ এ বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
[লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, রাজউক]