গাজী তারেক আজিজ
দেখতে দেখতে ছয় মাস পার করল অন্তর্বর্তী সরকার। পার করছে চরম বৈরী সময়। এরই মধ্যে ঘটে গেল আরেক নির্মমতা। গুঁড়িয়ে দেয়া হলো স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের তীর্থস্থান খ্যাত ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি। যে বাড়িতে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যাকা-ের শিকার হন বঙ্গবন্ধুসহ একই পরিবারের মোট ১৭ জন সদস্য শহীদ হন। এ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে নিকটআত্মীয় আরও ৯ জন শহীদ হন। সর্বমোট ২৬ জনকে খুনিরা নৃশংসভাবে সে রাতে খুন করে, যা ছিল নজিরবিহীন এক হত্যাযজ্ঞ। ভয়ংকর সেই হত্যাকা- ঘটানোর পর ওই সময় খুনিরা প্রকাশ্যে তাদের এ হত্যাকা-ের ঘটনা বিভিন্ন বিদেশি সংবাদমাধ্যমে স্বীকার করে। এ হত্যাকা- কোনোভাবেই বিচারের আওতায় যেন কোনদিন না আসে তাই দেশে নতুন আইন ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ চালু করা হয়, যা কালো আইন বলে খ্যাত। নির্মম এই হত্যাকা- যারা করেছে তাদের বিচারের আওতায় না এনে উল্টো বিচারের পথ আইনগতভাবে রূদ্ধ করার বেআইনি প্রক্রিয়া জাতিকে করেছিল কলুষিত। শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনি ব্যবস্থা থেকে অনাক্রম্যতা বা শাস্তি এড়াবার ব্যবস্থা প্রদানের জন্যই মূলত বাংলাদেশে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল।
১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তারিখে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ এ ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করেন। এতে করে তৎকালীন সময়ে বিচার পাওয়ার পথ স্থায়ীভাবে বন্ধ করা হয়েছে বলে মনে করা হলেও আদতে তা হয়নি। ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায় থেকে বিচার ও শাস্তি নিশ্চিতের মাধ্যমে সেই কালো আইন কিংবা বিচারহীনতার যে আইনানুগ সংস্কৃতি তা থেকেও দেশ, দেশের বিচারব্যবস্থা ও বিচারালয় কলুষমুক্ত হতে পেরেছিল বলেও ধরে নেয়া হয়। তথাপিও আরেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে চট্টগ্রামে সার্কিট হাউসে হত্যা করে। তখন বুঝতে বাকি থাকে না, দেশের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে বসে থাকা দেশবিরোধী চক্র থেমে ছিল না।
আর সেটা যুগে যুগে চলমান ছিল, আছে এবং থাকবে। রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন ব্যক্তিকে ক্ষমতা থেকে হটানো কিংবা হটাতে চক্রান্ত করে দেশকে চরম অস্থিতিশীল করেও কেমন যেন এক ধরনের আনন্দ অনুভব করে আরেক ধরনের লোক। এ অবস্থা থেকে বাঁচতে হলে হয় কৌশলী হতে হবে অথবা ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকা চাই। যুগে যুগে এই ধরনের অবস্থা বা সংকট থেকে উত্তরণ ঘটাতে শাসকদের কেউ কেউ এতটাই কঠোর ও কঠিন হয়েছে যে তা নির্মমতার মাত্রা অতিক্রান্ত করেছে। একটা পর্যায়ে তারা স্বৈরশাসক তকমা পেয়ে আরো বেশিমাত্রায় কঠোর হয়েছেন। সবার কেউ কেউ আরো বেপরোয়া হতেও দ্বিধা করেননি। এই পরিস্থিতি উতরিয়ে কেউ মহান হতে পেরেছেন তেমনটা দেখা যায় না খুব একটা। আবার শাসকের রোষানলে পড়ে নিজেদের জীবন-যৌবন কাটিয়েছেন কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। এসব নেতারা গণমানুষের রাজনীতি করে জীবন-যৌবন উৎসর্গ করেছেন। তেমনই একজন ছিলেন বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি মানুষকে ভালোবেসে, বিশ্বাস করে আত্মবলিদান করেছেন সমহিমায়, সগৌরবে। বাংলাদেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে একটা স্বাধীন সার্বভৌম ভূখ- উপহার দিয়েছিলেন। আর এই সময়ে এসে তাকেও চরম দেশপ্রেমের পরীক্ষায় পড়তে হচ্ছে! তা না হলে কেন তার নিজের বাসভবন ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও শেষে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়।
সভ্য সমাজ তো দূরে থাক, অতীতের সব সংকটেও কেউ যে বাড়ির দিকে আঙুল তুলে কথা বলার সাহস করেনি, তাই হলো। তারপর কী দেখলাম? মিডিয়ার অতি উৎসাহ যতটা না মানুষকে বিদ্বেষ ছড়িয়েছে ঠিক ততটাই নজিরবিহীন পাহারাদারের ভূমিকাও ছিল লক্ষণীয়। সেটা কেমন? প্রশ্ন থেকে যেতে পারে! তা হচ্ছে আরেক ধরনের গুজব রটিয়ে ফায়দা ওঠানো। যেমন ৩২ নাম্বারের সেই বাড়িটার পার্কিং বেজমেন্টে তথাকথিত আয়নাঘরের সন্ধান লাভের আশায় কথিত ভিউ ব্যবসায়ী অনলাইন মাল্টিমিডিয়ার ক্যামেরা। না হলে সুযোগ মতো সেখানটায়ও কোন না কোন হাড়গোড় রেখে আরেক গল্পের ফাঁদ পেতে মিডিয়ার খোরাক বানানো যেত, যা মিডিয়ার কল্যাণে আর হয়নি।
দীর্ঘ কয়েকদিনের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। আর হতাশ হয় তথাকথিত ‘মবকারীরা’। কিছুই পাওয়া গেল তো না-ই! একটা যেনতেন ছোট কয়েক ইঞ্চি সাইজের হাড় নিয়েও গবেষণার কোন কমতি নেই! একেকজন যেন বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। তা ভালো কথা! পাশাপাশি সারাদেশে শুরু হলো ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা। গাজীপুরে হলো ব্যতিক্রম। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাসায় অগ্নিসংযোগ আর লুটপাট করতে গেলে স্থানীয় জনতার দাবড়ানি খেয়ে পালাতে তো পারলোই না উল্টো হামলার শিকার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কতিপয় নেতাকর্মীর। এতে ক্ষেপে যায় কেন্দ্রীয় নেতারা। তারা ও স্থানীয় নেতাদের দাবি তারা সাবেক মন্ত্রী মোজাম্মেল হকের বাড়ি রক্ষা করতেই গিয়েছিল। আর হামলার শিকার হয়েছে। তারা ভাবতেই পারেনি এভাবে প্রবল বিরোধিতায় পড়তে হতে পারে! কেন্দ্রীয় সমন্বয়কদের কর্মসূচি চলে। এই কয়দিনে আরো দেখা হয় ৩২ নম্বরের ইট রডসহ খুলে নিয়ে যেতে। সারাদেশে সাঁড়াশি অভিযানের নামে সেনাবাহিনীসহ যৌথ বাহিনীর নেতৃত্বে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’। ধরা হতে থাকে আওয়ামী লীগ, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী, সমর্থকদের। বলা হয়েছিল গায়েবি মামলা হচ্ছে। হয়েছেও তাই। সরকারে থেকেই আইন উপদেষ্টা বললেন, মামলায় নাম থাকলেই যেনতেন গ্রেপ্তার নয়। পুলিশপ্রধানও একই কথা বারবার বলেছেন। তারপরও অনেক নিরীহ লোককে ধরে উল্লেখিত গায়েবি মামলায় ফরওয়ার্ড করতে দেখা যাচ্ছে। পাশাপাশি যাদের নাম এজাহারে উল্লেখ করেছে কিন্তু অভ্যুত্থান তথা আন্দোলনে কোন ভূমিকা ছিল না তেমন লোকদের ধরে চালান করা হচ্ছে। এতে কী হচ্ছে? একটা পরিবার আর্থিক ও মানবিক বিপর্যয়ে পড়ছে। উপরন্তু গ্রেপ্তার হলে জামিন পেতে ব্যাপক ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। আর এক শ্রেণীর লোক মামলার তদ্বির বাণিজ্য করে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। এই পর্যন্ত ডেভিল হান্টে গ্রেপ্তার হয়েছে প্রায় ২ হাজার লোক। জানা হয়নি সবাই আওয়ামী লীগ কর্মী-সমর্থক কিনা? তাছাড়া সরকার থেকে গ্রেপ্তারকৃতদের এবং অন্য যারা গ্রেপ্তার হচ্ছে তাদের ‘ডেভিল’ বলে সম্বোধন করা হচ্ছে। এক শ্রেণির আওয়ামী লীগ কর্মী-সমর্থকরা তৎকালীন সময়েও যেমন বেনিফিশিয়ারি নয়। তেমনই এখনও মানবেতর জীবনযাপন করছে বলে শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েও কি রক্ষা হচ্ছে? বোধ করি অনেকটাই অনাকাক্সিক্ষত এই ঝড় তৃণমূলের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত থাকা কর্মীদের জন্য অশনিঝড়। এদিকে সরকার থেকেও ঘোষণা করা হচ্ছে আগামী ডিসেম্বর নাগাদ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে। এতেও কেউ কেউ সন্দিহান। কারণও অনেকটা স্পষ্ট। রাজনীতিকদের দ্বিচারিতা। তাদের একেক সময় একেক ধরনের বয়ান। কখনো সংস্কারের কথা বলে নির্বাচন পিছিয়ে দেয়া। আবার কখনো প্রয়োজনীয় সংস্কারের দাবি জোরালো করা; আবার যাদের ভোটের মাঠে অতিশয় দুর্বল বলে ভাবা হচ্ছে তারাই আবার প্রার্থী চূড়ান্ত করে ঘোষণা দিতেও শুরু করেছে। অন্যদিকে ভোটের রাজনীতিতে অপেক্ষাকৃত বড় দল বিএনপি ভোটের বিকল্প কিছুই ভাবছে না। তাদের দাবি প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচন। আবার নেতাদের একেক কথাও পরিষ্কার যথাসময়ে ভোট অনুষ্ঠান হওয়া নিয়ে।
এদিকে ভোটের মাঠে যোগ বিয়োগ গুন ভাগের যে সমীকরণ এতে করে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের আরেকটি কমিটি, জাতীয় নাগরিক কমিটিও রাজনৈতিক দল গঠন তথা আত্মপ্রকাশ নিয়ে ঘোষণা দিতেই যদিও বিএনপি স্বাগত জানিয়েছে তথাপিও সতর্ক উচ্চারণে বলেছে সরকারে থেকে কেউ রাজনৈতিক দল গঠন করলে জনগণ ভালোভাবে নিবে না। মূলত, জনগণের দোহাই দিয়ে নিজেদের অভিব্যক্তিই প্রকাশ করেছে দলটি। যদিও অভ্যুত্থান-পরবর্তী তারা যথেষ্ট চাঙ্গা থাকলেও এখন এই ঘোরচক্র সময়ে কিছুটা হলেও আতিশয্যে ভাটা পড়তে শুরু করেছে। আবার জামায়াত ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের জোট গঠন করে চমকে দিতে চাইলেও কতটুকু সক্ষমতা রয়েছে তা নিয়েও বোদ্ধামহল তথা অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোও যথেষ্ট সন্দিহান। আবার ছন্নছাড়া আওয়ামী লীগ থেকে বলা হচ্ছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক কমিটি, এবি পার্টিসহ আরো কিছু দল মূলত জামায়াতের বি টিম হয়েই মাঠে রয়েছে। আর যদি ছাত্রদের দল জামায়াতের সঙ্গে ভোটের জোট করে সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সে অভিযোগ নেহাতই উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই বলেও অনেকেই তেমনটা মনে করছেন। সর্বোপরি সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে আহ্বান করা হচ্ছে মব থামাতে। চলছে অপারেশন ডেভিল হান্ট। চলছে গ্রেপ্তার। নির্বাচনী আয়োজন। তথাপিও রাষ্ট্রীয় যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে কেউ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকটাও দেখতে হবে। কথায় আছে ছোটবেলায় পুকুরে ব্যাঙ দেখে বাচ্চাদের ঢিল ছোড়ার আনন্দে যেন ব্যাঙের পরিবারে বিষাদের ছায়া না নেমে আসে! ডেভিল বলা হোক আর সন্ত্রাসী বলা হোক নিরীহ লোক গ্রেপ্তার করে বাহবা না কুড়িয়ে সংখ্যা কম হোক তবু যথাযথ হোক। সেটাই কাম্য। আরো উদ্বেগ ভর করেছে দেশের সাজাপ্রাপ্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের জামিন এবং খালাস ও খালাসের প্রক্রিয়ায়। তেমন দৃষ্টান্ত না হোক যা ভবিষ্যতে নিজের বিরুদ্ধে যায়!
[লেখক : অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]
গাজী তারেক আজিজ
রোববার, ১৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
দেখতে দেখতে ছয় মাস পার করল অন্তর্বর্তী সরকার। পার করছে চরম বৈরী সময়। এরই মধ্যে ঘটে গেল আরেক নির্মমতা। গুঁড়িয়ে দেয়া হলো স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের তীর্থস্থান খ্যাত ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি। যে বাড়িতে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যাকা-ের শিকার হন বঙ্গবন্ধুসহ একই পরিবারের মোট ১৭ জন সদস্য শহীদ হন। এ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে নিকটআত্মীয় আরও ৯ জন শহীদ হন। সর্বমোট ২৬ জনকে খুনিরা নৃশংসভাবে সে রাতে খুন করে, যা ছিল নজিরবিহীন এক হত্যাযজ্ঞ। ভয়ংকর সেই হত্যাকা- ঘটানোর পর ওই সময় খুনিরা প্রকাশ্যে তাদের এ হত্যাকা-ের ঘটনা বিভিন্ন বিদেশি সংবাদমাধ্যমে স্বীকার করে। এ হত্যাকা- কোনোভাবেই বিচারের আওতায় যেন কোনদিন না আসে তাই দেশে নতুন আইন ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ চালু করা হয়, যা কালো আইন বলে খ্যাত। নির্মম এই হত্যাকা- যারা করেছে তাদের বিচারের আওতায় না এনে উল্টো বিচারের পথ আইনগতভাবে রূদ্ধ করার বেআইনি প্রক্রিয়া জাতিকে করেছিল কলুষিত। শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনি ব্যবস্থা থেকে অনাক্রম্যতা বা শাস্তি এড়াবার ব্যবস্থা প্রদানের জন্যই মূলত বাংলাদেশে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল।
১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তারিখে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ এ ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করেন। এতে করে তৎকালীন সময়ে বিচার পাওয়ার পথ স্থায়ীভাবে বন্ধ করা হয়েছে বলে মনে করা হলেও আদতে তা হয়নি। ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায় থেকে বিচার ও শাস্তি নিশ্চিতের মাধ্যমে সেই কালো আইন কিংবা বিচারহীনতার যে আইনানুগ সংস্কৃতি তা থেকেও দেশ, দেশের বিচারব্যবস্থা ও বিচারালয় কলুষমুক্ত হতে পেরেছিল বলেও ধরে নেয়া হয়। তথাপিও আরেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে চট্টগ্রামে সার্কিট হাউসে হত্যা করে। তখন বুঝতে বাকি থাকে না, দেশের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে বসে থাকা দেশবিরোধী চক্র থেমে ছিল না।
আর সেটা যুগে যুগে চলমান ছিল, আছে এবং থাকবে। রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন ব্যক্তিকে ক্ষমতা থেকে হটানো কিংবা হটাতে চক্রান্ত করে দেশকে চরম অস্থিতিশীল করেও কেমন যেন এক ধরনের আনন্দ অনুভব করে আরেক ধরনের লোক। এ অবস্থা থেকে বাঁচতে হলে হয় কৌশলী হতে হবে অথবা ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকা চাই। যুগে যুগে এই ধরনের অবস্থা বা সংকট থেকে উত্তরণ ঘটাতে শাসকদের কেউ কেউ এতটাই কঠোর ও কঠিন হয়েছে যে তা নির্মমতার মাত্রা অতিক্রান্ত করেছে। একটা পর্যায়ে তারা স্বৈরশাসক তকমা পেয়ে আরো বেশিমাত্রায় কঠোর হয়েছেন। সবার কেউ কেউ আরো বেপরোয়া হতেও দ্বিধা করেননি। এই পরিস্থিতি উতরিয়ে কেউ মহান হতে পেরেছেন তেমনটা দেখা যায় না খুব একটা। আবার শাসকের রোষানলে পড়ে নিজেদের জীবন-যৌবন কাটিয়েছেন কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। এসব নেতারা গণমানুষের রাজনীতি করে জীবন-যৌবন উৎসর্গ করেছেন। তেমনই একজন ছিলেন বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি মানুষকে ভালোবেসে, বিশ্বাস করে আত্মবলিদান করেছেন সমহিমায়, সগৌরবে। বাংলাদেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে একটা স্বাধীন সার্বভৌম ভূখ- উপহার দিয়েছিলেন। আর এই সময়ে এসে তাকেও চরম দেশপ্রেমের পরীক্ষায় পড়তে হচ্ছে! তা না হলে কেন তার নিজের বাসভবন ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও শেষে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়।
সভ্য সমাজ তো দূরে থাক, অতীতের সব সংকটেও কেউ যে বাড়ির দিকে আঙুল তুলে কথা বলার সাহস করেনি, তাই হলো। তারপর কী দেখলাম? মিডিয়ার অতি উৎসাহ যতটা না মানুষকে বিদ্বেষ ছড়িয়েছে ঠিক ততটাই নজিরবিহীন পাহারাদারের ভূমিকাও ছিল লক্ষণীয়। সেটা কেমন? প্রশ্ন থেকে যেতে পারে! তা হচ্ছে আরেক ধরনের গুজব রটিয়ে ফায়দা ওঠানো। যেমন ৩২ নাম্বারের সেই বাড়িটার পার্কিং বেজমেন্টে তথাকথিত আয়নাঘরের সন্ধান লাভের আশায় কথিত ভিউ ব্যবসায়ী অনলাইন মাল্টিমিডিয়ার ক্যামেরা। না হলে সুযোগ মতো সেখানটায়ও কোন না কোন হাড়গোড় রেখে আরেক গল্পের ফাঁদ পেতে মিডিয়ার খোরাক বানানো যেত, যা মিডিয়ার কল্যাণে আর হয়নি।
দীর্ঘ কয়েকদিনের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। আর হতাশ হয় তথাকথিত ‘মবকারীরা’। কিছুই পাওয়া গেল তো না-ই! একটা যেনতেন ছোট কয়েক ইঞ্চি সাইজের হাড় নিয়েও গবেষণার কোন কমতি নেই! একেকজন যেন বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। তা ভালো কথা! পাশাপাশি সারাদেশে শুরু হলো ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা। গাজীপুরে হলো ব্যতিক্রম। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাসায় অগ্নিসংযোগ আর লুটপাট করতে গেলে স্থানীয় জনতার দাবড়ানি খেয়ে পালাতে তো পারলোই না উল্টো হামলার শিকার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কতিপয় নেতাকর্মীর। এতে ক্ষেপে যায় কেন্দ্রীয় নেতারা। তারা ও স্থানীয় নেতাদের দাবি তারা সাবেক মন্ত্রী মোজাম্মেল হকের বাড়ি রক্ষা করতেই গিয়েছিল। আর হামলার শিকার হয়েছে। তারা ভাবতেই পারেনি এভাবে প্রবল বিরোধিতায় পড়তে হতে পারে! কেন্দ্রীয় সমন্বয়কদের কর্মসূচি চলে। এই কয়দিনে আরো দেখা হয় ৩২ নম্বরের ইট রডসহ খুলে নিয়ে যেতে। সারাদেশে সাঁড়াশি অভিযানের নামে সেনাবাহিনীসহ যৌথ বাহিনীর নেতৃত্বে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’। ধরা হতে থাকে আওয়ামী লীগ, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী, সমর্থকদের। বলা হয়েছিল গায়েবি মামলা হচ্ছে। হয়েছেও তাই। সরকারে থেকেই আইন উপদেষ্টা বললেন, মামলায় নাম থাকলেই যেনতেন গ্রেপ্তার নয়। পুলিশপ্রধানও একই কথা বারবার বলেছেন। তারপরও অনেক নিরীহ লোককে ধরে উল্লেখিত গায়েবি মামলায় ফরওয়ার্ড করতে দেখা যাচ্ছে। পাশাপাশি যাদের নাম এজাহারে উল্লেখ করেছে কিন্তু অভ্যুত্থান তথা আন্দোলনে কোন ভূমিকা ছিল না তেমন লোকদের ধরে চালান করা হচ্ছে। এতে কী হচ্ছে? একটা পরিবার আর্থিক ও মানবিক বিপর্যয়ে পড়ছে। উপরন্তু গ্রেপ্তার হলে জামিন পেতে ব্যাপক ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। আর এক শ্রেণীর লোক মামলার তদ্বির বাণিজ্য করে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। এই পর্যন্ত ডেভিল হান্টে গ্রেপ্তার হয়েছে প্রায় ২ হাজার লোক। জানা হয়নি সবাই আওয়ামী লীগ কর্মী-সমর্থক কিনা? তাছাড়া সরকার থেকে গ্রেপ্তারকৃতদের এবং অন্য যারা গ্রেপ্তার হচ্ছে তাদের ‘ডেভিল’ বলে সম্বোধন করা হচ্ছে। এক শ্রেণির আওয়ামী লীগ কর্মী-সমর্থকরা তৎকালীন সময়েও যেমন বেনিফিশিয়ারি নয়। তেমনই এখনও মানবেতর জীবনযাপন করছে বলে শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েও কি রক্ষা হচ্ছে? বোধ করি অনেকটাই অনাকাক্সিক্ষত এই ঝড় তৃণমূলের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত থাকা কর্মীদের জন্য অশনিঝড়। এদিকে সরকার থেকেও ঘোষণা করা হচ্ছে আগামী ডিসেম্বর নাগাদ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে। এতেও কেউ কেউ সন্দিহান। কারণও অনেকটা স্পষ্ট। রাজনীতিকদের দ্বিচারিতা। তাদের একেক সময় একেক ধরনের বয়ান। কখনো সংস্কারের কথা বলে নির্বাচন পিছিয়ে দেয়া। আবার কখনো প্রয়োজনীয় সংস্কারের দাবি জোরালো করা; আবার যাদের ভোটের মাঠে অতিশয় দুর্বল বলে ভাবা হচ্ছে তারাই আবার প্রার্থী চূড়ান্ত করে ঘোষণা দিতেও শুরু করেছে। অন্যদিকে ভোটের রাজনীতিতে অপেক্ষাকৃত বড় দল বিএনপি ভোটের বিকল্প কিছুই ভাবছে না। তাদের দাবি প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচন। আবার নেতাদের একেক কথাও পরিষ্কার যথাসময়ে ভোট অনুষ্ঠান হওয়া নিয়ে।
এদিকে ভোটের মাঠে যোগ বিয়োগ গুন ভাগের যে সমীকরণ এতে করে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের আরেকটি কমিটি, জাতীয় নাগরিক কমিটিও রাজনৈতিক দল গঠন তথা আত্মপ্রকাশ নিয়ে ঘোষণা দিতেই যদিও বিএনপি স্বাগত জানিয়েছে তথাপিও সতর্ক উচ্চারণে বলেছে সরকারে থেকে কেউ রাজনৈতিক দল গঠন করলে জনগণ ভালোভাবে নিবে না। মূলত, জনগণের দোহাই দিয়ে নিজেদের অভিব্যক্তিই প্রকাশ করেছে দলটি। যদিও অভ্যুত্থান-পরবর্তী তারা যথেষ্ট চাঙ্গা থাকলেও এখন এই ঘোরচক্র সময়ে কিছুটা হলেও আতিশয্যে ভাটা পড়তে শুরু করেছে। আবার জামায়াত ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের জোট গঠন করে চমকে দিতে চাইলেও কতটুকু সক্ষমতা রয়েছে তা নিয়েও বোদ্ধামহল তথা অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোও যথেষ্ট সন্দিহান। আবার ছন্নছাড়া আওয়ামী লীগ থেকে বলা হচ্ছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক কমিটি, এবি পার্টিসহ আরো কিছু দল মূলত জামায়াতের বি টিম হয়েই মাঠে রয়েছে। আর যদি ছাত্রদের দল জামায়াতের সঙ্গে ভোটের জোট করে সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সে অভিযোগ নেহাতই উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই বলেও অনেকেই তেমনটা মনে করছেন। সর্বোপরি সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে আহ্বান করা হচ্ছে মব থামাতে। চলছে অপারেশন ডেভিল হান্ট। চলছে গ্রেপ্তার। নির্বাচনী আয়োজন। তথাপিও রাষ্ট্রীয় যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে কেউ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকটাও দেখতে হবে। কথায় আছে ছোটবেলায় পুকুরে ব্যাঙ দেখে বাচ্চাদের ঢিল ছোড়ার আনন্দে যেন ব্যাঙের পরিবারে বিষাদের ছায়া না নেমে আসে! ডেভিল বলা হোক আর সন্ত্রাসী বলা হোক নিরীহ লোক গ্রেপ্তার করে বাহবা না কুড়িয়ে সংখ্যা কম হোক তবু যথাযথ হোক। সেটাই কাম্য। আরো উদ্বেগ ভর করেছে দেশের সাজাপ্রাপ্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের জামিন এবং খালাস ও খালাসের প্রক্রিয়ায়। তেমন দৃষ্টান্ত না হোক যা ভবিষ্যতে নিজের বিরুদ্ধে যায়!
[লেখক : অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]