গৌতম রায়
গত বছর (২০২৪) আগস্ট মাসের শুরুতে কলকাতার আর জি কর হাসপাতালে কর্মরত অবস্থায় পিজিটি ছাত্রী, এক ডাক্তার ধর্ষিতা হন এবং খুন হন। এই ধর্ষণ ও খুন ঘিরে সেই সময় গোটা পশ্চিমবঙ্গ উত্তাল হয়ে ওঠে। প্রবল গণ-আন্দোলনে পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার সেই সময়ে বেশ কোণঠাসা হয়ে পড়ে। জুনিয়র ডাক্তারবাবুরা আমরণ অনশনে বসেন। অনশনকালে কয়েকজন অসুস্থ হয়ে পড়েন। তবু ডাক্তারবাবুরা অনশনের কর্মসূচি থেকে সরে আসেননি।
শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে জুনিয়র ডাক্তারবাবুদের এই অনুষ্ঠানকে কটাক্ষ করা হয়। শাসকের রুচিহীন কটাক্ষ ঘিরে কোনো অবস্থাতেই প্ররোচিত হন না তরুণ চিকিৎসকেরা। তারা তাদের অনশন এবং আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। পরবর্তীতে মুখ্যমন্ত্রী বাধ্য হন রাজ্য প্রশাসনের সদর দপ্তর নবান্নতে জুনিয়র ডাক্তারবাবুদের সঙ্গে আলোচনা করতে। সেই আলোচনার লাইভ স্ক্রিনিং ঘিরে জুনিয়ার ডাক্তারবাবুদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হন মুখ্যমন্ত্রী। আর সেই লাইভ স্ট্রিটিংয়ের দৌলতে সাধারণ মানুষ দেখতে পান, কীভাবে ডাক্তারি শিক্ষার দুর্নীতি ঘিরে জুনিয়ার ডাক্তারবাবুরা সরাসরি অভিযোগ করেন মুখ্যমন্ত্রী তথা পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে।
জুনিয়র ডাক্তারবাবুদের সেই সমস্ত দাবি ঘিরে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে বিচার- বিবেচনার আশ্বাস দেয়া হলেও সেইসব দাবি আজ পর্যন্ত পরিপূর্ণভাবে পূরণ করবার ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার, তাদের দেয়া আশ্বাসের ধার পাশ দিয়ে হাঁটেনি। এই অবস্থায় ফাস্ট ট্রাক কোর্টে আর জি করের, ধর্ষিতা নিহত ছাত্রীটির ঘটনাক্রম ঘিরে সিভিক ভলেন্টিয়ার সঞ্জয় রাইকে গ্রেপ্তার করা হয়, তার রায়দান হয় এবং নিম্ন আদালত আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদ-ের দ-িত করেন।
এই ঘটনার পর অদ্ভুতভাবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সঞ্জয় রাইর ফাঁসির দাবিতে সোচ্চার হোন এবং রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়টি কলকাতা হাইকোর্টে পেশ করা হয়।
পশ্চিমবঙ্গ পুলিশে সিভিক ভলেন্টিয়ার নামক যে বিষয়টিকে সংযুক্ত করা হয় সেটি কিন্তু আগে কখনো পশ্চিমবঙ্গে ছিল না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর এই সিভিক ভলেন্টিয়ারের বিষয়টিকে তিনি নিয়ে আসেন। সিভিক ভলেন্টিয়ারদের কোনোরকম চাকরির নিরাপত্তা নেই। অবসরকালীন কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই। তারা যতদিন কর্মরত থাকবেন, ততদিন বেতন পাবে। তারপর কর্মরত না থাকলে কোনো রকম আর্থিক সুযোগ-সুবিধা তাদের জন্য রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া হবে না। এমনকি সিভিক ভলেন্টিয়ার হিসেবে কর্মরত থাকাকালীনও হেলথ স্কিম বা বাড়ি ভাড়াসহ অন্যান্য যে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা সরকারি কর্মীরা পান, তার কোনো কিছুই এইসব সিভিক ভলেন্টিয়ারদের দেয়ার ব্যবস্থা রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে করা হয়নি।
রাষ্ট্রযন্ত্র কখনো কোনো ব্যক্তির ফাঁসি চেয়ে আদালতে মামলা করে, তার পক্ষে রাষ্ট্রযন্ত্রের আইনজীবীরা সাওয়াল করেন, এমনটা বোধহয় স্বাধীন ভারতে খুব একটা দেখতে পাওয়া যায়নি। সাম্প্রতিক অতীতে তো নয়ই, সঞ্জয় রাইর ফাঁসির দাবিতে রাজ্য সরকারের করা মামলাটি যেহেতু আদালতের বিচারাধীন, সুতরাং সম্পর্কে আলোচনার মধ্যে প্রবেশ করতে চাই না।
কিন্তু ধর্ষিতা, খুন হওয়া ছাত্রীটির হত্যাকারী ধর্ষণকারীর শাস্তি ঘিরে, নিম্ন আদালতের সিদ্ধান্ত যেমন ছাত্রীদের পরিবার-পরিজন, বাবা-মা মেনে নিতে পারেননি, ঠিক তেমনিই তার বন্ধুবান্ধব, পেশাগত সতীর্থরা এবং সার্বিকভাবে পশ্চিমবঙ্গের জনসমাজ ও এটা মেনে নেননি। তিলোত্তমা নামে যে হতভাগ্য ছাত্রীটিকে পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক সমাজ অভিহিত করেছেন, সেই মেয়েটির জন্মদিন গেল গত ৯ ফেব্রুয়ারি। তার পরিবারের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট তারিখটিকে নতুন করে আন্দোলন, বিক্ষোভ, প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের সংকল্পে স্থিত হওয়ার জন্য নাগরিক সমাজের কাছে আবেদন জানানো হয়েছিল।
নাগরিক সমাজ তাদের মতো করে তিলোত্তমার বিচার চেয়ে আবার ধীরে ধীরে আন্দোলন স্থিত হচ্ছে। এই রকম একটি অবস্থায় পশ্চিমবঙ্গের শাসকদলের বেশ কিছু ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা যে ভাষায় যে ভঙ্গিমায়, তিলোত্তমার বাবা-মাকে আক্রমণ করেছে , তা ভাবতে পারা যায় না। আসলে পশ্চিমবঙ্গের বুকে এখন গোটা ভারতের মতোই রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত অন্যায়-অবিচার- হত্যাকা--লুটতরাজ-সংখ্যালঘুদের ওপর অমানবিক আচরণ, এই সমস্ত কিছু ঘিরে প্রতিরোধ তো দূরের কথা, প্রতিবাদ করার জায়গাটিকে পর্যন্ত রাষ্ট্রযন্ত্র শিথিল করে দিতে চায়। প্রতিরোধের সংকল্প তো দূরের কথা।
বিভিন্ন পর্যায়ের যারা তিলোত্তমার বিচার চেয়ে সরব হয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গ সরকার সেই সব মানুষদের ওপর পুলিশ দিয়ে যেভাবে হামলা করেছে, সেটি কখনো কোনো গণতান্ত্রিক পরিবেশের পরিচয়বাহী নয়। যে সমস্ত জুনিয়র ডাক্তারবাবুরা তিলোত্তমার বিচার চেয়ে এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সরকার এবং শাসক দলের সার্বিক ব্যর্থতা, স্বজনপোষণ, দুর্নীতি ঘিরে আন্দোলন করেছেন, অনশন করেছেন, সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বাদ-প্রতিবাদে জড়িয়েছেন তাদের নিগৃহীত করেছে মমতার সরকার পুলিশ দিয়ে। তিলোত্তমার বিচার চেয়ে আন্দোলনকারীদের একটা বড় অংশের মানুষদের যেভাবে পশ্চিমবঙ্গ সরকার যেভাবে নানা রকম পুলিশি হেনস্তার মুখে ফেলেছে, তার জন্য কোনো ভাষাই বোধহয় যথেষ্ট নয় নিন্দা করার। নতুন প্রজন্মের চিকিৎসক, যারা আত্মনিবেদিতভাবে সেবা কর্মে, জাতপাত, ধর্ম, ধনী-দরিদ্র, কোনোরকম ভেদাভেদ না রেখে ব্যতী রয়েছেন, তাদের কীভাবে পুলিশ হেনস্তা করা হয়েছে, তা ভাবতে পারা যায় না।
এই সমস্ত ডাক্তারবাবুদের অনেককেই আত্মরক্ষার জন্য আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়েছে এবং আদালত তাদের অভিযোগ শোনামাত্র এক কথাতেই তাদের রক্ষাকবচ দিয়েছেন। এ থেকেই বুঝতে পারা যাচ্ছে যে, রাষ্ট্রযন্ত্র, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নাগরিক সমাজের মানুষদের বিরুদ্ধে গোটা পুলিশ প্রশাসনকে ব্যবহার করছে; অর্থাৎ সাধারণ মানুষ যাতে কোনো অবস্থাতেই কোনোরকম প্রতিবাদে শামিল না হতে পারেন, সেজন্য এদের টার্গেট করে, গোটা নাগরিক সমাজকে ভয় দেখাচ্ছে রাষ্ট্রযন্ত্র।
বিগত সাতের দশকের গোড়ায় পশ্চিমবঙ্গে যেভাবে ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস কায়েম করা হয়েছিল, জরুরি অবস্থা সময়কালে যেভাবে গোটা ভারতব্যাপী আধা ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস কায়েম করা হয়েছিল রাষ্ট্রযন্ত্রের দ্বারা, এখন সেই পর্যায়টি, একটি অতীতের সমস্ত ধরনের কলঙ্কজনক অধ্যায় কে-ও ছাপিয়ে গেছে। রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিক সমাজ, কারো এখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করবার অধিকার পশ্চিমবঙ্গে নেই। রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায় এবং শাসকদলের সহায়তায় পশ্চিমবঙ্গের নারী সমাজের ওপর ধারাবাহিক আক্রমণ চলছে। আট থেকে আশিÑ কোনো বয়সী মহিলাই পশ্চিমবঙ্গে এখন শাসকদলের নানা ধরনের নোংরা আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। অথচ সাধারণ মানুষ যদি প্রতিবাদ করে, সেই প্রতিবাদ ঘিরে শাসক কোনো ব্যবস্থা নেয়া তো দূরের কথা, উল্টো প্রতিবাদী মানুষকে কীভাবে রাষ্ট্রীয় পেষণ যন্ত্রের দ্বারা হেনস্থা করতে পারা যায়, সেদিকেই রাষ্ট্রযন্ত্রের এক এবং একমাত্র লক্ষ্য।
আর জি করের ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্যব্যবস্থার স্বরূপটিকে। পশ্চিমবঙ্গে সরকারি হাসপাতালে কর্মরতা একজন পিজিটি ছাত্রীর নিরাপত্তাই যেখানে নেই। সেখানে পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নারী সমাজের নিরাপত্তার প্রশ্নটি কোথায়, তা একজন নারী মুখ্যমন্ত্রীর শাসনাধীনে বারবার প্রশ্নচিহ্নের সম্মুখীন হচ্ছে। সরকারি হাসপাতালে একজন কর্মরত নারী চিকিৎসকের ধর্ষণ এবং খুন ঘিরে পশ্চিমবঙ্গের মর্যাদা, সম্মানের প্রশ্নটি কেবল ভারতেই নয়, আন্তর্জাতিক স্তরে ধুলোয় লুটিয়ে গেছে। অথচ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রথম থেকেই নির্যাতিতা ডাক্তারের পরিবারকে টাকার লোক দেখিয়ে আসছেন।
নির্যাতিতার শেষকৃত্য ঘিরে যেভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিশ এবং তার দলের চিকিৎসক সেলের নেতারা, বিধায়কসহ বিভিন্ন কর্মীরা অনৈতিক ভূমিকা পালন করেছেন, তা থেকে খুব পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে একটি প্রচলিত বাংলা প্রবাদ; ঠাকুর ঘরে কে? আমি তো কলা খাইনি।
তিলোত্তমার ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনাটি যদি কায়েমি স্বার্থের দ্বারা সংঘটিত না-ই হয়ে থাকবে, কেবল একজন সিভিক পুলিশের দ্বারা সংঘটিত একটি অপরাধ হয়ে থাকবে, তাহলে কেন খুনের ঘটনা থেকে শুরু করে তিলোত্তমার শেষকৃত্য পর্যন্ত এত তৎপরতা শাসক শিবিরের? তাহলে কেন তিলোত্তমার ময়নাতদন্তের ঘটনাকে নানাভাবে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে শাসক শিবির খুনের ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একেবারে আদা জল খেয়ে নেমে পড়েছি?
তিলোত্তমা যে সেই অন্ধকার রাত্রে আর জি কর হাসপাতালের মধ্যে কর্মরত অবস্থায় ধর্ষিতা হয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন তাই নয়। তার সেই ভয়াবহ মৃত্যুর পর, তাকে পশ্চিমবঙ্গের শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে হাজারবার ধর্ষণ করা হয়েছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্টকে নানাভাবে প্রভাবিত করে, তার প্রতি গণধর্ষণ হয়নি শাসকদলের দ্বারা? ব্যক্তি বিশেষের ধর্ষণের দ্বারাই তিনি নিহত হয়েছেন, এই কথাটি সাধারণ মানুষকে বিশ্বাস করাতে, শাসক তৃণমূলের বড় বড় নেতাদের থেকে শুরু করে একেবারে ভূমিস্তরের কর্মী পর্যন্ত যে নক্কারজনক প্রচার চালিয়েছে, সেই সমস্ত প্রচারগুলোতে এক একবার করে ধর্ষণ করা হয়েছে তিলোত্তমাকে। তৃণমূলের একাধিক নেতা, প্রবীণ সাংসদ, তারা যেভাবে মৃতার পরিবারের প্রতি শাসক আরোপিত অর্থ লালসার কথাকে নিজেদের মতো করে পরিবেশিত করে, তাদের চূড়ান্ত অসম্মান, আমর্যাদা করেছে, তার দ্বারা হাজারবার ধর্ষিতা হয়েছেন তিলোত্তমা। হাজারবার ধর্ষিতা হয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের নারী সমাজ। দুর্ভাগ্যের বিষয় পশ্চিমবঙ্গে এই প্রথম একজন নারী মুখ্যমন্ত্রীর শাসনকালে এভাবে শাসকদলের দ্বারা নারী সমাজকে অপমানিত হতে হলো অসম্মানিত হতে হলো।
পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক সমাজের কোনো সদস্য যাতে তাদের পরিবার-পরিজন-বন্ধু- বান্ধব, কারো ওপর কোনো যৌন হেনস্থা হলে প্রতিবাদ করতে না পারে তার জন্য তিলোত্তমার বাবা-মাকে মনুষ্যত্বের অপমান করা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের বিভিন্ন স্তরের নেতাদের মাধ্যমে। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি সমাজ কিংবা অবাঙালি সমাজের কোনো মানুষ, শাসনযন্ত্রের জঘন্য ষড়যন্ত্রে নিহত হলে, তাদের আত্মীয়-বন্ধু-স্বজনরা যাতে কোনো অবস্থাতে প্রতিবাদে সামিল হতে না পারে মন, সেই কারণেই তিলোত্তমার বাবা-মায়ের উদ্দেশ্যে, তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। তাদের সংসদ আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে জেলখাটা মুখপাত্র বলেছে কত টাকা পেলে বাবা-মার মুখ বন্ধ হবে।
[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]
গৌতম রায়
সোমবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
গত বছর (২০২৪) আগস্ট মাসের শুরুতে কলকাতার আর জি কর হাসপাতালে কর্মরত অবস্থায় পিজিটি ছাত্রী, এক ডাক্তার ধর্ষিতা হন এবং খুন হন। এই ধর্ষণ ও খুন ঘিরে সেই সময় গোটা পশ্চিমবঙ্গ উত্তাল হয়ে ওঠে। প্রবল গণ-আন্দোলনে পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার সেই সময়ে বেশ কোণঠাসা হয়ে পড়ে। জুনিয়র ডাক্তারবাবুরা আমরণ অনশনে বসেন। অনশনকালে কয়েকজন অসুস্থ হয়ে পড়েন। তবু ডাক্তারবাবুরা অনশনের কর্মসূচি থেকে সরে আসেননি।
শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে জুনিয়র ডাক্তারবাবুদের এই অনুষ্ঠানকে কটাক্ষ করা হয়। শাসকের রুচিহীন কটাক্ষ ঘিরে কোনো অবস্থাতেই প্ররোচিত হন না তরুণ চিকিৎসকেরা। তারা তাদের অনশন এবং আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। পরবর্তীতে মুখ্যমন্ত্রী বাধ্য হন রাজ্য প্রশাসনের সদর দপ্তর নবান্নতে জুনিয়র ডাক্তারবাবুদের সঙ্গে আলোচনা করতে। সেই আলোচনার লাইভ স্ক্রিনিং ঘিরে জুনিয়ার ডাক্তারবাবুদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হন মুখ্যমন্ত্রী। আর সেই লাইভ স্ট্রিটিংয়ের দৌলতে সাধারণ মানুষ দেখতে পান, কীভাবে ডাক্তারি শিক্ষার দুর্নীতি ঘিরে জুনিয়ার ডাক্তারবাবুরা সরাসরি অভিযোগ করেন মুখ্যমন্ত্রী তথা পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে।
জুনিয়র ডাক্তারবাবুদের সেই সমস্ত দাবি ঘিরে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে বিচার- বিবেচনার আশ্বাস দেয়া হলেও সেইসব দাবি আজ পর্যন্ত পরিপূর্ণভাবে পূরণ করবার ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার, তাদের দেয়া আশ্বাসের ধার পাশ দিয়ে হাঁটেনি। এই অবস্থায় ফাস্ট ট্রাক কোর্টে আর জি করের, ধর্ষিতা নিহত ছাত্রীটির ঘটনাক্রম ঘিরে সিভিক ভলেন্টিয়ার সঞ্জয় রাইকে গ্রেপ্তার করা হয়, তার রায়দান হয় এবং নিম্ন আদালত আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদ-ের দ-িত করেন।
এই ঘটনার পর অদ্ভুতভাবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সঞ্জয় রাইর ফাঁসির দাবিতে সোচ্চার হোন এবং রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়টি কলকাতা হাইকোর্টে পেশ করা হয়।
পশ্চিমবঙ্গ পুলিশে সিভিক ভলেন্টিয়ার নামক যে বিষয়টিকে সংযুক্ত করা হয় সেটি কিন্তু আগে কখনো পশ্চিমবঙ্গে ছিল না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর এই সিভিক ভলেন্টিয়ারের বিষয়টিকে তিনি নিয়ে আসেন। সিভিক ভলেন্টিয়ারদের কোনোরকম চাকরির নিরাপত্তা নেই। অবসরকালীন কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই। তারা যতদিন কর্মরত থাকবেন, ততদিন বেতন পাবে। তারপর কর্মরত না থাকলে কোনো রকম আর্থিক সুযোগ-সুবিধা তাদের জন্য রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া হবে না। এমনকি সিভিক ভলেন্টিয়ার হিসেবে কর্মরত থাকাকালীনও হেলথ স্কিম বা বাড়ি ভাড়াসহ অন্যান্য যে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা সরকারি কর্মীরা পান, তার কোনো কিছুই এইসব সিভিক ভলেন্টিয়ারদের দেয়ার ব্যবস্থা রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে করা হয়নি।
রাষ্ট্রযন্ত্র কখনো কোনো ব্যক্তির ফাঁসি চেয়ে আদালতে মামলা করে, তার পক্ষে রাষ্ট্রযন্ত্রের আইনজীবীরা সাওয়াল করেন, এমনটা বোধহয় স্বাধীন ভারতে খুব একটা দেখতে পাওয়া যায়নি। সাম্প্রতিক অতীতে তো নয়ই, সঞ্জয় রাইর ফাঁসির দাবিতে রাজ্য সরকারের করা মামলাটি যেহেতু আদালতের বিচারাধীন, সুতরাং সম্পর্কে আলোচনার মধ্যে প্রবেশ করতে চাই না।
কিন্তু ধর্ষিতা, খুন হওয়া ছাত্রীটির হত্যাকারী ধর্ষণকারীর শাস্তি ঘিরে, নিম্ন আদালতের সিদ্ধান্ত যেমন ছাত্রীদের পরিবার-পরিজন, বাবা-মা মেনে নিতে পারেননি, ঠিক তেমনিই তার বন্ধুবান্ধব, পেশাগত সতীর্থরা এবং সার্বিকভাবে পশ্চিমবঙ্গের জনসমাজ ও এটা মেনে নেননি। তিলোত্তমা নামে যে হতভাগ্য ছাত্রীটিকে পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক সমাজ অভিহিত করেছেন, সেই মেয়েটির জন্মদিন গেল গত ৯ ফেব্রুয়ারি। তার পরিবারের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট তারিখটিকে নতুন করে আন্দোলন, বিক্ষোভ, প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের সংকল্পে স্থিত হওয়ার জন্য নাগরিক সমাজের কাছে আবেদন জানানো হয়েছিল।
নাগরিক সমাজ তাদের মতো করে তিলোত্তমার বিচার চেয়ে আবার ধীরে ধীরে আন্দোলন স্থিত হচ্ছে। এই রকম একটি অবস্থায় পশ্চিমবঙ্গের শাসকদলের বেশ কিছু ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা যে ভাষায় যে ভঙ্গিমায়, তিলোত্তমার বাবা-মাকে আক্রমণ করেছে , তা ভাবতে পারা যায় না। আসলে পশ্চিমবঙ্গের বুকে এখন গোটা ভারতের মতোই রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত অন্যায়-অবিচার- হত্যাকা--লুটতরাজ-সংখ্যালঘুদের ওপর অমানবিক আচরণ, এই সমস্ত কিছু ঘিরে প্রতিরোধ তো দূরের কথা, প্রতিবাদ করার জায়গাটিকে পর্যন্ত রাষ্ট্রযন্ত্র শিথিল করে দিতে চায়। প্রতিরোধের সংকল্প তো দূরের কথা।
বিভিন্ন পর্যায়ের যারা তিলোত্তমার বিচার চেয়ে সরব হয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গ সরকার সেই সব মানুষদের ওপর পুলিশ দিয়ে যেভাবে হামলা করেছে, সেটি কখনো কোনো গণতান্ত্রিক পরিবেশের পরিচয়বাহী নয়। যে সমস্ত জুনিয়র ডাক্তারবাবুরা তিলোত্তমার বিচার চেয়ে এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সরকার এবং শাসক দলের সার্বিক ব্যর্থতা, স্বজনপোষণ, দুর্নীতি ঘিরে আন্দোলন করেছেন, অনশন করেছেন, সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বাদ-প্রতিবাদে জড়িয়েছেন তাদের নিগৃহীত করেছে মমতার সরকার পুলিশ দিয়ে। তিলোত্তমার বিচার চেয়ে আন্দোলনকারীদের একটা বড় অংশের মানুষদের যেভাবে পশ্চিমবঙ্গ সরকার যেভাবে নানা রকম পুলিশি হেনস্তার মুখে ফেলেছে, তার জন্য কোনো ভাষাই বোধহয় যথেষ্ট নয় নিন্দা করার। নতুন প্রজন্মের চিকিৎসক, যারা আত্মনিবেদিতভাবে সেবা কর্মে, জাতপাত, ধর্ম, ধনী-দরিদ্র, কোনোরকম ভেদাভেদ না রেখে ব্যতী রয়েছেন, তাদের কীভাবে পুলিশ হেনস্তা করা হয়েছে, তা ভাবতে পারা যায় না।
এই সমস্ত ডাক্তারবাবুদের অনেককেই আত্মরক্ষার জন্য আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়েছে এবং আদালত তাদের অভিযোগ শোনামাত্র এক কথাতেই তাদের রক্ষাকবচ দিয়েছেন। এ থেকেই বুঝতে পারা যাচ্ছে যে, রাষ্ট্রযন্ত্র, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নাগরিক সমাজের মানুষদের বিরুদ্ধে গোটা পুলিশ প্রশাসনকে ব্যবহার করছে; অর্থাৎ সাধারণ মানুষ যাতে কোনো অবস্থাতেই কোনোরকম প্রতিবাদে শামিল না হতে পারেন, সেজন্য এদের টার্গেট করে, গোটা নাগরিক সমাজকে ভয় দেখাচ্ছে রাষ্ট্রযন্ত্র।
বিগত সাতের দশকের গোড়ায় পশ্চিমবঙ্গে যেভাবে ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস কায়েম করা হয়েছিল, জরুরি অবস্থা সময়কালে যেভাবে গোটা ভারতব্যাপী আধা ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস কায়েম করা হয়েছিল রাষ্ট্রযন্ত্রের দ্বারা, এখন সেই পর্যায়টি, একটি অতীতের সমস্ত ধরনের কলঙ্কজনক অধ্যায় কে-ও ছাপিয়ে গেছে। রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিক সমাজ, কারো এখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করবার অধিকার পশ্চিমবঙ্গে নেই। রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায় এবং শাসকদলের সহায়তায় পশ্চিমবঙ্গের নারী সমাজের ওপর ধারাবাহিক আক্রমণ চলছে। আট থেকে আশিÑ কোনো বয়সী মহিলাই পশ্চিমবঙ্গে এখন শাসকদলের নানা ধরনের নোংরা আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। অথচ সাধারণ মানুষ যদি প্রতিবাদ করে, সেই প্রতিবাদ ঘিরে শাসক কোনো ব্যবস্থা নেয়া তো দূরের কথা, উল্টো প্রতিবাদী মানুষকে কীভাবে রাষ্ট্রীয় পেষণ যন্ত্রের দ্বারা হেনস্থা করতে পারা যায়, সেদিকেই রাষ্ট্রযন্ত্রের এক এবং একমাত্র লক্ষ্য।
আর জি করের ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্যব্যবস্থার স্বরূপটিকে। পশ্চিমবঙ্গে সরকারি হাসপাতালে কর্মরতা একজন পিজিটি ছাত্রীর নিরাপত্তাই যেখানে নেই। সেখানে পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নারী সমাজের নিরাপত্তার প্রশ্নটি কোথায়, তা একজন নারী মুখ্যমন্ত্রীর শাসনাধীনে বারবার প্রশ্নচিহ্নের সম্মুখীন হচ্ছে। সরকারি হাসপাতালে একজন কর্মরত নারী চিকিৎসকের ধর্ষণ এবং খুন ঘিরে পশ্চিমবঙ্গের মর্যাদা, সম্মানের প্রশ্নটি কেবল ভারতেই নয়, আন্তর্জাতিক স্তরে ধুলোয় লুটিয়ে গেছে। অথচ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রথম থেকেই নির্যাতিতা ডাক্তারের পরিবারকে টাকার লোক দেখিয়ে আসছেন।
নির্যাতিতার শেষকৃত্য ঘিরে যেভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিশ এবং তার দলের চিকিৎসক সেলের নেতারা, বিধায়কসহ বিভিন্ন কর্মীরা অনৈতিক ভূমিকা পালন করেছেন, তা থেকে খুব পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে একটি প্রচলিত বাংলা প্রবাদ; ঠাকুর ঘরে কে? আমি তো কলা খাইনি।
তিলোত্তমার ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনাটি যদি কায়েমি স্বার্থের দ্বারা সংঘটিত না-ই হয়ে থাকবে, কেবল একজন সিভিক পুলিশের দ্বারা সংঘটিত একটি অপরাধ হয়ে থাকবে, তাহলে কেন খুনের ঘটনা থেকে শুরু করে তিলোত্তমার শেষকৃত্য পর্যন্ত এত তৎপরতা শাসক শিবিরের? তাহলে কেন তিলোত্তমার ময়নাতদন্তের ঘটনাকে নানাভাবে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে শাসক শিবির খুনের ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একেবারে আদা জল খেয়ে নেমে পড়েছি?
তিলোত্তমা যে সেই অন্ধকার রাত্রে আর জি কর হাসপাতালের মধ্যে কর্মরত অবস্থায় ধর্ষিতা হয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন তাই নয়। তার সেই ভয়াবহ মৃত্যুর পর, তাকে পশ্চিমবঙ্গের শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে হাজারবার ধর্ষণ করা হয়েছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্টকে নানাভাবে প্রভাবিত করে, তার প্রতি গণধর্ষণ হয়নি শাসকদলের দ্বারা? ব্যক্তি বিশেষের ধর্ষণের দ্বারাই তিনি নিহত হয়েছেন, এই কথাটি সাধারণ মানুষকে বিশ্বাস করাতে, শাসক তৃণমূলের বড় বড় নেতাদের থেকে শুরু করে একেবারে ভূমিস্তরের কর্মী পর্যন্ত যে নক্কারজনক প্রচার চালিয়েছে, সেই সমস্ত প্রচারগুলোতে এক একবার করে ধর্ষণ করা হয়েছে তিলোত্তমাকে। তৃণমূলের একাধিক নেতা, প্রবীণ সাংসদ, তারা যেভাবে মৃতার পরিবারের প্রতি শাসক আরোপিত অর্থ লালসার কথাকে নিজেদের মতো করে পরিবেশিত করে, তাদের চূড়ান্ত অসম্মান, আমর্যাদা করেছে, তার দ্বারা হাজারবার ধর্ষিতা হয়েছেন তিলোত্তমা। হাজারবার ধর্ষিতা হয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের নারী সমাজ। দুর্ভাগ্যের বিষয় পশ্চিমবঙ্গে এই প্রথম একজন নারী মুখ্যমন্ত্রীর শাসনকালে এভাবে শাসকদলের দ্বারা নারী সমাজকে অপমানিত হতে হলো অসম্মানিত হতে হলো।
পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক সমাজের কোনো সদস্য যাতে তাদের পরিবার-পরিজন-বন্ধু- বান্ধব, কারো ওপর কোনো যৌন হেনস্থা হলে প্রতিবাদ করতে না পারে তার জন্য তিলোত্তমার বাবা-মাকে মনুষ্যত্বের অপমান করা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের বিভিন্ন স্তরের নেতাদের মাধ্যমে। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি সমাজ কিংবা অবাঙালি সমাজের কোনো মানুষ, শাসনযন্ত্রের জঘন্য ষড়যন্ত্রে নিহত হলে, তাদের আত্মীয়-বন্ধু-স্বজনরা যাতে কোনো অবস্থাতে প্রতিবাদে সামিল হতে না পারে মন, সেই কারণেই তিলোত্তমার বাবা-মায়ের উদ্দেশ্যে, তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। তাদের সংসদ আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে জেলখাটা মুখপাত্র বলেছে কত টাকা পেলে বাবা-মার মুখ বন্ধ হবে।
[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]