এম এ হোসাইন
যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে আলোচনার অনিশ্চিত অবস্থা বিশ্বকে আরও গভীর সংঘাতের প্রান্তে নিয়ে গেছে। যদি এই আলোচনা ব্যর্থ হয়, তবে এর পরিণতি বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক কাঠামোকে প্রত্যাশিত ও অপ্রত্যাশিতÑ উভয়ভাবেই পুনর্গঠন করতে পারে।
কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ভেস্তে গেলে সবচেয়ে তাৎক্ষণিক এবং সুস্পষ্ট ফলাফল হবে শত্রুতার বৃদ্ধি। ইউক্রেন সম্ভবত রুশ ভূখ-ের গভীরে ড্রোন হামলা আরও তীব্র করবে যাতে মস্কোর রসদ সরবরাহের মূল অবকাঠামোকে দুর্বল করা যায়। একই সময়ে, রাশিয়া, যা ইতোমধ্যেই যুদ্ধ-অর্থনীতির দিকে ঝুঁকেছে, কৌশলগত সুবিধা নিশ্চিত করতে নতুন আক্রমণ শুরু করতে পারেÑ ডোনেস্ক, লুহানস্ক এবং সম্ভবত ওডেসার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ অর্জনের লক্ষ্যে।
পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় মিত্ররা, একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হবেÑ ইউক্রেনকে ব্যাপক সামরিক সহায়তা দেয়া, নাকি রাশিয়ার আরও অগ্রগতি মেনে নেয়া। উন্নত অস্ত্রব্যবস্থা, দীর্ঘপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র এবং বর্ধিত গোয়েন্দা সহযোগিতা ইউক্রেনের যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে, যদিও এতে ন্যাটো আরও সরাসরি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হবে।
ওয়াশিংটন যখন প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল এবং মধ্যপ্রাচ্যের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে, তখন ইউক্রেনের জন্য সহায়তার প্রধান দায়িত্ব ইউরোপের ওপর বর্তাবে। যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স ইতোমধ্যেই ‘ইচ্ছুকদের জোট’ গঠনের ধারণা সামনে এনেছে, যারা হয়তো শান্তিরক্ষা বাহিনী পাঠানো বা আকাশ ও নৌবাহিনীর উপস্থিতি নিশ্চিত করার মাধ্যমে সরাসরি সামরিক সহায়তা দিতে পারে। তবে এতে নানা ধরনের লজিস্টিক ও রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে।
একটি সম্ভাব্য কৌশল হিসেবে ইউক্রেনের ইইউ সদস্যপদ প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করার চিন্তাভাবনা চলছে, যা ইউরোপীয় ইউনিয়নের পারস্পরিক প্রতিরক্ষা ধারা (অনুচ্ছেদ ৪২.৭) কার্যকর করার পথ খুলে দিতে পারে। আরেকটি আরও আক্রমণাত্মক প্রস্তাব হলো ন্যাটোর সীমিত সদস্যপদ দেওয়া, যেখানে দখলকৃত অঞ্চলগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে না। এটি প্রতীকী হলেও, রাশিয়ার জন্য কৌশলগত সমীকরণ বদলে দিতে পারে এবং ইউরোপের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে পুনর্গঠন করতে পারে।
আলোচনা ব্যর্থ হলে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার মধ্যে অন্যতম হবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নতুন নিষেধাজ্ঞা। এগুলো প্রধানত রাশিয়ার তেল ও গ্যাস রাজস্ব বন্ধ করার দিক কেন্দ্রিক হবে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত এমন গৌণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে যা রাশিয়ার জ্বালানি ক্রয় করা দেশগুলোকেও (যেমন চীন ও ভারত) শাস্তির আওতায় আনবে।
তবে বৈশ্বিক অর্থনীতি আর আগের মতো স্থিতিশীল নয়। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক এখনো দৃঢ়, যেখানে ২০২৪ সালে তাদের মোট পণ্য বাণিজ্যের পরিমাণ ৫৮২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। ভারত, যা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অংশীদার (দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ১১৯ বিলিয়ন ডলার), এমন নিষেধাজ্ঞার কারণে কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে পারে। রুশ জ্বালানি রপ্তানি বন্ধ করার প্রচেষ্টা পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে গ্লোবাল সাউথের বিভাজন আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং পশ্চিমা অর্থনীতির ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করতে পারে, যা ইতোমধ্যেই মুদ্রাস্ফীতির চাপ মোকাবিলা করছে।
যদি কোনো পক্ষই সরাসরি সামরিক বিজয় অর্জন করতে না পারে, তাহলে কোরিয়ান যুদ্ধের মতো একটি অস্ত্রবিরতি চুক্তি দেখা দিতে পারেÑ একটি অনির্দিষ্টকালীন যুদ্ধবিরতি, তবে আনুষ্ঠানিক শান্তিচুক্তি ছাড়া। এই পরিস্থিতি রাশিয়ার দখলকৃত অঞ্চলগুলোর ওপর তার নিয়ন্ত্রণকে আরও সুসংহত করবে, আর ইউক্রেনকে একটি দীর্ঘমেয়াদি ভূ-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেবে।
তবে, প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বারবার স্পষ্ট করেছেন যে তিনি ভূখ- ছেড়ে দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার ধারণা মেনে নেবেন না, বিশেষত ক্রিমিয়ার ক্ষেত্রে। যদি ইউক্রেন তার অবস্থানে অনড় থাকে, তবে যুদ্ধ অনির্দিষ্টকালের জন্য দীর্ঘায়িত হতে পারে, যা ইসরায়েল ও হামাসের সংঘাতের মতো একটি চলমান সংঘর্ষে পরিণত হবেÑ যেখানে সমাধান নয়, বরং ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়েই টিকে থাকবে।
একটি দীর্ঘায়িত যুদ্ধ, যেখানে স্পষ্ট বিজয়ের পথ নেই, তা কিয়েভের জন্য রাজনৈতিকভাবে সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। ইতোমধ্যেই জেলেনস্কি ও ইউক্রেনের সামরিক নেতৃত্বের মধ্যে উত্তেজনা প্রকাশ পেয়েছেÑ বিশেষত সেনা নিয়োগ সংস্কার এবং যুদ্ধক্ষেত্রের কৌশল নিয়ে বিতর্ক তীব্র হয়েছে। আলোচনায় ব্যর্থতা ইউক্রেনের যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে দুর্বল করতে পারে এবং পশ্চিমা সামরিক সহায়তা অব্যাহত রাখার সংকল্পকেও চ্যালেঞ্জ করতে পারে।
একই সময়ে, ইউক্রেন তার সীমান্ত অতিক্রম করে হামলার মাত্রা বাড়িয়েছে, যেমন- সম্প্রতি বেলগোরোদে চালানো আক্রমণ। এই হামলাগুলোর মূল উদ্দেশ্য অস্পষ্টÑ রাশিয়াকে ফ্রন্টলাইন থেকে সৈন্য সরাতে বাধ্য করা, নাকি ভবিষ্যতের আলোচনায় কৌশলগত সুবিধা অর্জন করা? যেভাবেই হোক, ইউক্রেনের সামরিক অবস্থান স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে যে তারা একটি ‘স্থির সংঘাত’ বা ভূখ- ছাড়ার শর্ত মেনে নিতে রাজি নয়।
সবচেয়ে গুরুতর উদ্বেগের মধ্যে একটি হলো, কূটনৈতিক প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হলে রাশিয়া তার পারমাণবিক হুমকি আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। ক্রেমলিন ইতোমধ্যেই পরোক্ষ হুমকি দিয়েছে যে, যদি ন্যাটো সরাসরি হস্তক্ষেপ করে, তাহলে তারা কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে। যদি পশ্চিমা নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতি আরও বাড়ে, বিশেষত ইউরোপীয় সেনাদের পশ্চিম ইউক্রেনে উপস্থিতি নিশ্চিত হয়, তাহলে একটি বিপর্যয়কর ভুল গণনার ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যাবে।
বেশির ভাগ বিশ্লেষক মনে করেন যে, রাশিয়ার পারমাণবিক হুমকি মূলত কূটনৈতিক চাপে দেয়া বক্তব্য। কিন্তু ইতিহাস দেখায় যে, অনেক সময় চাপে পড়ে নেতারা ধ্বংসাত্মক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। ন্যাটোর সৈন্যরা যদি রাশিয়ার সীমান্তের কাছাকাছি চলে আসে, তাহলে পুতিন আগাম প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেন, যা যুক্তিযুক্ত না হলেও বাস্তবতায় বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী নীতির অনেকটাই নির্ভর করবে ডনাল্ড ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। বর্তমানে, ট্রাম্প রাশিয়ার আলোচনার কৌশল নিয়ে অসন্তুষ্ট এবং আলোচনা ব্যর্থ হলে কঠোর জ্বালানি নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়েছেন। তার প্রশাসন মূলত চীনকে ঠেকানোর দিকেই বেশি মনোযোগ কেন্দ্রীভূত, যার ফলে ইউরোপীয় থিয়েটারের গুরুত্ব কমিয়ে দিতে পারে।
যদি ট্রাম্প রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য করা দেশগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেন, তবে বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে বিশাল অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। তবে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলেও, তা সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রের সামরিক সমীকরণ বদলাবে না বরং, যদি যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগতভাবে ইউক্রেন থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেয়, তাহলে ইউরোপকে সিদ্ধান্ত নিতে হবেÑ তারা কি সত্যিই ইউক্রেনের প্রতিরক্ষার নেতৃত্ব নিতে প্রস্তুত?
যদি ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সরকার পতনের মুখে পড়ে, তাহলে ইউরোপের সবচেয়ে সম্ভাব্য বিকল্প হবে পশ্চিম ইউক্রেনে একটি সামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করাÑ সম্ভবত একটি ‘ট্রিপওয়্যার ফোর্স’ গঠন করে, যাতে রাশিয়ার আরও অগ্রগতি প্রতিহত করা যায়। কিন্তু সমস্যা হলো, ইউরোপের সামরিক সক্ষমতা সীমিত। যুক্তরাষ্ট্রের লজিস্টিক ও গোয়েন্দা সহায়তা ছাড়া, ইউরোপীয় সেনা মোতায়েন মূলত প্রতীকী হয়ে যাবে, কার্যকর নয়।
সর্বোত্তম পরিস্থিতিতেও, যদি যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স তাদের বিমান ও নৌবাহিনী মোতায়েন করে, তবে এগুলো রাশিয়ার শক্তিশালী বিমান প্রতিরক্ষা ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার সামনে দুর্বল থেকে যাবে। এবং যদি রাশিয়া ইউরোপীয় হস্তক্ষেপকে সরাসরি উসকানি হিসেবে দেখে, তাহলে পোল্যান্ড ও রোমানিয়ার সামরিক ঘাঁটিতে প্রতিশোধমূলক হামলা চালানো অসম্ভব নয়।
আলোচনার ব্যর্থতা কেবল যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার অর্থ বহন করবে নাÑ এটি নতুন ও অপ্রত্যাশিত বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। গৌণ নিষেধাজ্ঞার অর্থনৈতিক প্রভাব থেকে শুরু করে পারমাণবিক উত্তেজনার ঝুঁকি পর্যন্ত, প্রতিটি সম্ভাবনাই বড় ধরনের ঝুঁকি বহন করে।
মূল প্রশ্ন থেকেই যায়: পশ্চিমা বিশ্ব কি ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দেয়ার বাইরেও একটি সুস্পষ্ট কৌশল তৈরি করেছে? যদি আলোচনা ব্যর্থ হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপকে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবেÑ তারা কি তাদের সম্পৃক্ততা বাড়িয়ে আরও বড় সংঘাতের ঝুঁকি নেবে, নাকি এমন একটি আপস খুঁজবে, যা রাজনৈতিকভাবে অপ্রিয় হলেও বড় বিপর্যয় এড়াতে পারে? ভূ-রাজনীতিতে, সিদ্ধান্তহীনতাও ভুল সিদ্ধান্তের মতোই বিপজ্জনক হতে পারে। আসন্ন মাসগুলোতে বোঝা যাবে, পশ্চিমা বিশ্ব কি প্রয়োজনীয় ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত, নাকি তারা প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থানে যেতে বাধ্য হবে, যেখানে রাশিয়াই সংঘাতের গতিপথ নির্ধারণ করবে।
[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক]
এম এ হোসাইন
সোমবার, ০৭ এপ্রিল ২০২৫
যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে আলোচনার অনিশ্চিত অবস্থা বিশ্বকে আরও গভীর সংঘাতের প্রান্তে নিয়ে গেছে। যদি এই আলোচনা ব্যর্থ হয়, তবে এর পরিণতি বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক কাঠামোকে প্রত্যাশিত ও অপ্রত্যাশিতÑ উভয়ভাবেই পুনর্গঠন করতে পারে।
কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ভেস্তে গেলে সবচেয়ে তাৎক্ষণিক এবং সুস্পষ্ট ফলাফল হবে শত্রুতার বৃদ্ধি। ইউক্রেন সম্ভবত রুশ ভূখ-ের গভীরে ড্রোন হামলা আরও তীব্র করবে যাতে মস্কোর রসদ সরবরাহের মূল অবকাঠামোকে দুর্বল করা যায়। একই সময়ে, রাশিয়া, যা ইতোমধ্যেই যুদ্ধ-অর্থনীতির দিকে ঝুঁকেছে, কৌশলগত সুবিধা নিশ্চিত করতে নতুন আক্রমণ শুরু করতে পারেÑ ডোনেস্ক, লুহানস্ক এবং সম্ভবত ওডেসার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ অর্জনের লক্ষ্যে।
পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় মিত্ররা, একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হবেÑ ইউক্রেনকে ব্যাপক সামরিক সহায়তা দেয়া, নাকি রাশিয়ার আরও অগ্রগতি মেনে নেয়া। উন্নত অস্ত্রব্যবস্থা, দীর্ঘপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র এবং বর্ধিত গোয়েন্দা সহযোগিতা ইউক্রেনের যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে, যদিও এতে ন্যাটো আরও সরাসরি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হবে।
ওয়াশিংটন যখন প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল এবং মধ্যপ্রাচ্যের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে, তখন ইউক্রেনের জন্য সহায়তার প্রধান দায়িত্ব ইউরোপের ওপর বর্তাবে। যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স ইতোমধ্যেই ‘ইচ্ছুকদের জোট’ গঠনের ধারণা সামনে এনেছে, যারা হয়তো শান্তিরক্ষা বাহিনী পাঠানো বা আকাশ ও নৌবাহিনীর উপস্থিতি নিশ্চিত করার মাধ্যমে সরাসরি সামরিক সহায়তা দিতে পারে। তবে এতে নানা ধরনের লজিস্টিক ও রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে।
একটি সম্ভাব্য কৌশল হিসেবে ইউক্রেনের ইইউ সদস্যপদ প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করার চিন্তাভাবনা চলছে, যা ইউরোপীয় ইউনিয়নের পারস্পরিক প্রতিরক্ষা ধারা (অনুচ্ছেদ ৪২.৭) কার্যকর করার পথ খুলে দিতে পারে। আরেকটি আরও আক্রমণাত্মক প্রস্তাব হলো ন্যাটোর সীমিত সদস্যপদ দেওয়া, যেখানে দখলকৃত অঞ্চলগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে না। এটি প্রতীকী হলেও, রাশিয়ার জন্য কৌশলগত সমীকরণ বদলে দিতে পারে এবং ইউরোপের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে পুনর্গঠন করতে পারে।
আলোচনা ব্যর্থ হলে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার মধ্যে অন্যতম হবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নতুন নিষেধাজ্ঞা। এগুলো প্রধানত রাশিয়ার তেল ও গ্যাস রাজস্ব বন্ধ করার দিক কেন্দ্রিক হবে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত এমন গৌণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে যা রাশিয়ার জ্বালানি ক্রয় করা দেশগুলোকেও (যেমন চীন ও ভারত) শাস্তির আওতায় আনবে।
তবে বৈশ্বিক অর্থনীতি আর আগের মতো স্থিতিশীল নয়। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক এখনো দৃঢ়, যেখানে ২০২৪ সালে তাদের মোট পণ্য বাণিজ্যের পরিমাণ ৫৮২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। ভারত, যা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অংশীদার (দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ১১৯ বিলিয়ন ডলার), এমন নিষেধাজ্ঞার কারণে কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে পারে। রুশ জ্বালানি রপ্তানি বন্ধ করার প্রচেষ্টা পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে গ্লোবাল সাউথের বিভাজন আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং পশ্চিমা অর্থনীতির ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করতে পারে, যা ইতোমধ্যেই মুদ্রাস্ফীতির চাপ মোকাবিলা করছে।
যদি কোনো পক্ষই সরাসরি সামরিক বিজয় অর্জন করতে না পারে, তাহলে কোরিয়ান যুদ্ধের মতো একটি অস্ত্রবিরতি চুক্তি দেখা দিতে পারেÑ একটি অনির্দিষ্টকালীন যুদ্ধবিরতি, তবে আনুষ্ঠানিক শান্তিচুক্তি ছাড়া। এই পরিস্থিতি রাশিয়ার দখলকৃত অঞ্চলগুলোর ওপর তার নিয়ন্ত্রণকে আরও সুসংহত করবে, আর ইউক্রেনকে একটি দীর্ঘমেয়াদি ভূ-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেবে।
তবে, প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বারবার স্পষ্ট করেছেন যে তিনি ভূখ- ছেড়ে দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার ধারণা মেনে নেবেন না, বিশেষত ক্রিমিয়ার ক্ষেত্রে। যদি ইউক্রেন তার অবস্থানে অনড় থাকে, তবে যুদ্ধ অনির্দিষ্টকালের জন্য দীর্ঘায়িত হতে পারে, যা ইসরায়েল ও হামাসের সংঘাতের মতো একটি চলমান সংঘর্ষে পরিণত হবেÑ যেখানে সমাধান নয়, বরং ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়েই টিকে থাকবে।
একটি দীর্ঘায়িত যুদ্ধ, যেখানে স্পষ্ট বিজয়ের পথ নেই, তা কিয়েভের জন্য রাজনৈতিকভাবে সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। ইতোমধ্যেই জেলেনস্কি ও ইউক্রেনের সামরিক নেতৃত্বের মধ্যে উত্তেজনা প্রকাশ পেয়েছেÑ বিশেষত সেনা নিয়োগ সংস্কার এবং যুদ্ধক্ষেত্রের কৌশল নিয়ে বিতর্ক তীব্র হয়েছে। আলোচনায় ব্যর্থতা ইউক্রেনের যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে দুর্বল করতে পারে এবং পশ্চিমা সামরিক সহায়তা অব্যাহত রাখার সংকল্পকেও চ্যালেঞ্জ করতে পারে।
একই সময়ে, ইউক্রেন তার সীমান্ত অতিক্রম করে হামলার মাত্রা বাড়িয়েছে, যেমন- সম্প্রতি বেলগোরোদে চালানো আক্রমণ। এই হামলাগুলোর মূল উদ্দেশ্য অস্পষ্টÑ রাশিয়াকে ফ্রন্টলাইন থেকে সৈন্য সরাতে বাধ্য করা, নাকি ভবিষ্যতের আলোচনায় কৌশলগত সুবিধা অর্জন করা? যেভাবেই হোক, ইউক্রেনের সামরিক অবস্থান স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে যে তারা একটি ‘স্থির সংঘাত’ বা ভূখ- ছাড়ার শর্ত মেনে নিতে রাজি নয়।
সবচেয়ে গুরুতর উদ্বেগের মধ্যে একটি হলো, কূটনৈতিক প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হলে রাশিয়া তার পারমাণবিক হুমকি আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। ক্রেমলিন ইতোমধ্যেই পরোক্ষ হুমকি দিয়েছে যে, যদি ন্যাটো সরাসরি হস্তক্ষেপ করে, তাহলে তারা কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে। যদি পশ্চিমা নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতি আরও বাড়ে, বিশেষত ইউরোপীয় সেনাদের পশ্চিম ইউক্রেনে উপস্থিতি নিশ্চিত হয়, তাহলে একটি বিপর্যয়কর ভুল গণনার ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যাবে।
বেশির ভাগ বিশ্লেষক মনে করেন যে, রাশিয়ার পারমাণবিক হুমকি মূলত কূটনৈতিক চাপে দেয়া বক্তব্য। কিন্তু ইতিহাস দেখায় যে, অনেক সময় চাপে পড়ে নেতারা ধ্বংসাত্মক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। ন্যাটোর সৈন্যরা যদি রাশিয়ার সীমান্তের কাছাকাছি চলে আসে, তাহলে পুতিন আগাম প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেন, যা যুক্তিযুক্ত না হলেও বাস্তবতায় বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী নীতির অনেকটাই নির্ভর করবে ডনাল্ড ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। বর্তমানে, ট্রাম্প রাশিয়ার আলোচনার কৌশল নিয়ে অসন্তুষ্ট এবং আলোচনা ব্যর্থ হলে কঠোর জ্বালানি নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়েছেন। তার প্রশাসন মূলত চীনকে ঠেকানোর দিকেই বেশি মনোযোগ কেন্দ্রীভূত, যার ফলে ইউরোপীয় থিয়েটারের গুরুত্ব কমিয়ে দিতে পারে।
যদি ট্রাম্প রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য করা দেশগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেন, তবে বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে বিশাল অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। তবে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলেও, তা সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রের সামরিক সমীকরণ বদলাবে না বরং, যদি যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগতভাবে ইউক্রেন থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেয়, তাহলে ইউরোপকে সিদ্ধান্ত নিতে হবেÑ তারা কি সত্যিই ইউক্রেনের প্রতিরক্ষার নেতৃত্ব নিতে প্রস্তুত?
যদি ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সরকার পতনের মুখে পড়ে, তাহলে ইউরোপের সবচেয়ে সম্ভাব্য বিকল্প হবে পশ্চিম ইউক্রেনে একটি সামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করাÑ সম্ভবত একটি ‘ট্রিপওয়্যার ফোর্স’ গঠন করে, যাতে রাশিয়ার আরও অগ্রগতি প্রতিহত করা যায়। কিন্তু সমস্যা হলো, ইউরোপের সামরিক সক্ষমতা সীমিত। যুক্তরাষ্ট্রের লজিস্টিক ও গোয়েন্দা সহায়তা ছাড়া, ইউরোপীয় সেনা মোতায়েন মূলত প্রতীকী হয়ে যাবে, কার্যকর নয়।
সর্বোত্তম পরিস্থিতিতেও, যদি যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স তাদের বিমান ও নৌবাহিনী মোতায়েন করে, তবে এগুলো রাশিয়ার শক্তিশালী বিমান প্রতিরক্ষা ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার সামনে দুর্বল থেকে যাবে। এবং যদি রাশিয়া ইউরোপীয় হস্তক্ষেপকে সরাসরি উসকানি হিসেবে দেখে, তাহলে পোল্যান্ড ও রোমানিয়ার সামরিক ঘাঁটিতে প্রতিশোধমূলক হামলা চালানো অসম্ভব নয়।
আলোচনার ব্যর্থতা কেবল যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার অর্থ বহন করবে নাÑ এটি নতুন ও অপ্রত্যাশিত বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। গৌণ নিষেধাজ্ঞার অর্থনৈতিক প্রভাব থেকে শুরু করে পারমাণবিক উত্তেজনার ঝুঁকি পর্যন্ত, প্রতিটি সম্ভাবনাই বড় ধরনের ঝুঁকি বহন করে।
মূল প্রশ্ন থেকেই যায়: পশ্চিমা বিশ্ব কি ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দেয়ার বাইরেও একটি সুস্পষ্ট কৌশল তৈরি করেছে? যদি আলোচনা ব্যর্থ হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপকে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবেÑ তারা কি তাদের সম্পৃক্ততা বাড়িয়ে আরও বড় সংঘাতের ঝুঁকি নেবে, নাকি এমন একটি আপস খুঁজবে, যা রাজনৈতিকভাবে অপ্রিয় হলেও বড় বিপর্যয় এড়াতে পারে? ভূ-রাজনীতিতে, সিদ্ধান্তহীনতাও ভুল সিদ্ধান্তের মতোই বিপজ্জনক হতে পারে। আসন্ন মাসগুলোতে বোঝা যাবে, পশ্চিমা বিশ্ব কি প্রয়োজনীয় ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত, নাকি তারা প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থানে যেতে বাধ্য হবে, যেখানে রাশিয়াই সংঘাতের গতিপথ নির্ধারণ করবে।
[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক]