alt

উপ-সম্পাদকীয়

সর্বজনীন শিক্ষার বলয়ের বাইরে আদিবাসীরা : অন্তর্ভুক্তির লড়াইয়ে বৈষম্যের দেয়াল

মিথুশিলাক মুরমু

: বৃহস্পতিবার, ০৮ মে ২০২৫

গত ৩ মে বাংলাদেশের একটি শীর্ষস্থানীয় জাতীয় দৈনিকে একটি হৃদয়স্পর্শী শিরোনাম ছাপা হয়Ñ ‘দেশ স্বাধীনের পর ওয়াংরাইপাড়ায় প্রথম বাজলো স্কুলের ঘণ্টা’। এই খবর শুধু একটি বিদ্যালয় উদ্বোধনের সংবাদ ছিল না, এটি ছিল অন্ধকারে আবিষ্ট একটি অঞ্চল থেকে শিক্ষার নতুন ভোর দেখার মুহূর্ত। বান্দরবান জেলার থানচি উপজেলার রেমাক্রি ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী দুর্গম ত্রিমতি কারবারিপাড়ায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত হলো ‘ওয়াংরাইপাড়া বিজিবি প্রাথমিক বিদ্যালয়’। এই বিদ্যালয়ের মাধ্যমে ৫টি পাড়ার ৪২টি পরিবারের শিশুরা প্রথমবারের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পা রাখল।

বিদ্যালয়টির উদ্বোধন করেন ৫৭ বিজিবি ব্যাটালিয়নের আলীকদম পরিচালক লে. কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মেহেদী। জাতীয় পতাকা উত্তোলন, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে জাতীয় সংগীত পরিবেশন এবং পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষা উপকরণ বিতরণসহ এক গর্বময় সূচনার সাক্ষী হয় এলাকাটি। ২৫ জন শিক্ষার্থী এককালীন আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে প্রাথমিক শিক্ষার প্রথম ধাপে পা রাখে।

এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। এটি প্রমাণ করে, সীমান্ত রক্ষা ছাড়াও বিজিবি পাহাড়ি অঞ্চলে সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে জনকল্যাণমূলক কাজে অবদান রাখছে। দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলের জটিল ভৌগোলিক প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে যে শিশুরা শিক্ষার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে, তাদের সংকল্প সত্যিই উৎসাহব্যঞ্জক। একদিন এই শিশুরাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পৌঁছে দেশ গড়ায় অবদান রাখবেÑ এই প্রত্যাশাই আমাদের অনুপ্রাণিত করে।

কিন্তু বিপরীত চিত্রও বিদ্যমান। একই দিনে, দেশের একেবারে অন্যপ্রান্তে, উত্তরবঙ্গের রংপুর জেলার পীরগাছার ধলখানা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আদিবাসী উরাঁও সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি সুমি খালকো শিক্ষা ব্যবস্থার তীব্র ব্যর্থতা ও বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরেন। তার বক্তব্য ছিল আবেগময়, হতাশাপূর্ণ এবং অপ্রিয় হলেও নির্মম বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি।

তিনি বলেন, আমাদের অনেক দাবি আছে। স্কুল আছে, কিন্তু সময়মতো খোলে না। ৯টার বদলে ১১টায় শিক্ষক আসেন। আমাদের আর্থিক সামর্থ্য নেই। কিন্ডারগার্টেন বা বেসরকারি স্কুলে পাঠাতে পারি না। আমাদের বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। তিনি আরও জানান, বিদ্যালয়ে কম্পিউটার দেওয়া হয়েছে, কিন্তু আমাদের সন্তানরা শিখতে পারছে না। অনেকেই ঝরে পড়েছে। প্রাইভেট পড়ানোর সামর্থ্য আমাদের নেই।

সুমি খালকোর কথায় উঠে এসেছে অব্যবস্থাপনার আক্ষেপ, বঞ্চনার হাহাকার, আর সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উদ্বেগ। শুধু তার নয়, এমন অসংখ্য আদিবাসী মা-বাবার কণ্ঠস্বর আমরা শুনতে পাই না। আমাদের রাষ্ট্রীয় শিক্ষানীতি হয়তো সর্বজনীনতার কথা বলে, কিন্তু বাস্তবে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য সে সর্বজনীনতা আজও অধরা।

বাংলাদেশে সামগ্রিকভাবে শিক্ষিতের হার যেখানে প্রায় ৭৫ শতাংশ, সেখানে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের শিক্ষার হার মাত্র ৩০ থেকে ৩২ শতাংশ। নারীদের ক্ষেত্রে তা আরও করুণÑ মাত্র ১৫ থেকে ১৭ শতাংশ। উত্তরবঙ্গের আদিবাসী সম্প্রদায়Ñ যেমন সাঁওতাল, উরাঁও, মু-া, মাহালি, বাগদি, ভূমিজ, মালো, মাহাতো, ভীল, রাই, তুরি, খন্দ, বেদিয়া, সিং ইত্যাদিÑ প্রতিটি পদক্ষেপে বৈষম্যের মুখোমুখি হচ্ছে। এদের মধ্যে অনেক সম্প্রদায় গভীর দারিদ্র্যসীমার নিচে জীবন কাটায়, যার ফলে শিক্ষা হয় একপ্রকার বিলাসিতা।

তথ্য যা ভাবায়

‘গণস্বাক্ষরতা অভিযান’-এর এক জরিপে উঠে এসেছেÑ রাজশাহীতে ৩৩.২৫ শতাংশ, নওগাঁয় ১৯.৮ শতাংশ, গাইবান্ধায় ১৩ শতাংশ আদিবাসী শিক্ষার্থী স্কুল থেকে ঝরে পড়ে। আয়বর্ধক কাজে যুক্ত থাকার কারণে রাজশাহীতে ২৪ শতাংশ ও দিনাজপুরে ১৮.৭ শতাংশ শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে যেতে পারে না। এছাড়া আদিবাসী নারী শিক্ষার্থীদের ৩১.৩ শতাংশ বিদ্যালয়ে যেতে ব্যর্থ হয়, যা নওগাঁয় সর্বোচ্চ ৩৯.৭ শতাংশ এবং হবিগঞ্জে সর্বনিম্ন ১৩.১ শতাংশ। এসব পরিসংখ্যানই বলে দেয়, শিক্ষার বৈষম্য কতটা গভীরে গাঁথা।

চ্যালেঞ্জগুলো কী?

বিদ্যালয় সময়মতো না খোলা। শিক্ষক-অবহেলা এবং জবাবদিহির অভাব। ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা (বাংলা ভাষায় পাঠ্যক্রম, যেখানে শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষা ভিন্ন)। প্রাইভেট টিউশনের অনুপস্থিতি। দারিদ্র্য এবং আর্থিক অনুপস্থিতি। ঝরে পড়া এবং শিশু শ্রম। অনিরাপদ যাতায়াত ও অপর্যাপ্ত স্যানিটেশন। বাল্যবিবাহ এবং গার্হস্থ্য দায়িত্ব।

এছাড়াও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আদিবাসী প্রতিনিধিত্বের অভাব, শিক্ষকদের মধ্যে আদিবাসী-বিষয়ক সংবেদনশীলতার অভাব, বৈষম্যমূলক মনোভাব এবং পাঠ্যক্রমে সাংস্কৃতিক অন্তর্ভুক্তির অনুপস্থিতি শিক্ষার্থীদের নিরুৎসাহিত করছে।

সমাধান কোথায়?

১. অবকাঠামো ও শিক্ষক নিয়োগে বৈপ্লবিক পদক্ষেপ : আদিবাসী এলাকায় শিক্ষক পাঠানোর পাশাপাশি স্থানীয় ভাষাভিত্তিক শিক্ষকদের নিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন।

২. মাতৃভাষাভিত্তিক প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা : ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় ইতোমধ্যে কিছু প্রকল্প চালু হলেও তা সার্বিক নয়।

৩. সচেতনতা ও অভিভাবকদের সহায়তা : অভিভাবকদের শিক্ষা বিষয়ে সচেতন করা, বাল্যবিবাহ রোধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ।

৪. অর্থনৈতিক সহায়তা : দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তি ও শিক্ষাসামগ্রী বিতরণ।

৫. প্রশিক্ষিত ও সংবেদনশীল শিক্ষক গড়ে তোলা : যাঁরা আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও ভাষাকে সম্মান করবেন।

৬. প্রতিটি উপজেলায় আদিবাসী শিক্ষা মনিটরিং সেল গঠন : যারা নিয়মিত বিদ্যালয় পরিদর্শন করবে।

শেষ কথা

একদিকে যখন বিজিবি একটি সীমান্তবর্তী জনপদে শিক্ষার আলো জ্বালায়, অন্যদিকে অন্য কোনো অঞ্চলে আদিবাসী শিশুরা শিক্ষা থেকে ছিটকে পড়ে। এই বৈপরীত্য আমাদের ভাবায়। সার্বজনীন শিক্ষা তখনই বাস্তবায়ন হবে, যখন তা সব জাতিগোষ্ঠী, শ্রেণি ও লিঙ্গের কাছে সমানভাবে পৌঁছবে। শুধু অবকাঠামো নয়, প্রয়োজন মানসিকতা ও রাষ্ট্রীয় সদিচ্ছার সমন্বয়। শিক্ষা অধিকারÑ এটি কেবল কাগজে নয়, বাস্তবতায় প্রতিষ্ঠা পেলে তবেই আমরা বলতে পারি, আমরা একটি মানবিক রাষ্ট্র গড়তে পেরেছি।

[লেখক : কলামিস্ট]

শোনার গান, দেখার টান : অনুভূতির ভোঁতা সময়

ছবি

ছিন্নপত্রে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও রবীন্দ্র চেতনা

ভেতরের অদৃশ্য অপরাধ : সমাজের বিপন্ন মানসিকতা

দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসনে খাসজমি ও জলার গুরুত্ব

অবহেলিত কৃষক ও বাজার ব্যবস্থার বৈষম্য

রাক্ষুসে মাছের দাপটে বিপন্ন দেশীয় মাছ : করণীয় কী?

বজ্রপাতের আতঙ্কে জনজীবন

তাহলে কি ঘৃণায় ছেয়ে যাবে দেশ, মানবজমিন রইবে পতিত

কর্পোরেট ও ব্যক্তিগত সামাজিক দায়বদ্ধতা

‘রাখাইন করিডর’ : একটি ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

ভিন্নমতের ভয়, নির্বাচনের দোলাচল ও অন্তর্বর্তী সরকারের কৌশলী অবস্থান

সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

কৃষি শিক্ষা হোক উদ্যোক্তা গড়ার মাধ্যম

রঙ্গব্যঙ্গ : কোটের কেবল রং বদলায়

মে দিবসের চেতনা বনাম বাস্তবতা

শ্রম আইন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় চাই আন্তরিকতা

বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকা কেন এত পিছিয়ে

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল : নিরাপদ যাত্রার প্রত্যাশা

কর ফাঁকি : অর্থনীতির জন্য এক অশনি সংকেত

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় : উপকূলীয় সুরক্ষার শিক্ষা

যখন নদীগুলো অস্ত্র হয়ে ওঠে

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুণগত মান উন্নয়নে গবেষণা ও উদ্ভাবন

বজ্রপাত ও তালগাছ : প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা

কুষ্ঠ ও বৈষম্য : মানবাধিকারের প্রশ্নে একটি অবহেলিত অধ্যায়

ছবি

প্রান্তজনের বাংলাদেশ

অতীতের ছায়ায় নতুন বাংলাদেশ : দুর্নীতি, উগ্রপন্থা ও সরকারের দায়

সাইবার নিরাপত্তা : অদৃশ্য যুদ্ধের সামনে আমাদের প্রস্তুতি

ছবি

বাহান্নর গর্ভে জন্ম নেয়া এক ঝড়ের পাখি

প্রবাসী শ্রমিক : অর্থের যন্ত্র নয়, রাষ্ট্রের সহযোদ্ধা

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির এক যুগ

ভোগবাদের বিরুদ্ধে পোপ ফ্রান্সিসের জলবায়ু বার্তা

রম্যগদ্য : হাসি নিষেধ...

পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের আন্দোলন : দাবি ও সমাধানের পথ

সিরিয়ার পতন কিভাবে আমেরিকার স্বার্থকে হুমকিতে ফেলছে

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র : বিকল্প রাষ্ট্রচিন্তার সন্ধানে

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

tab

উপ-সম্পাদকীয়

সর্বজনীন শিক্ষার বলয়ের বাইরে আদিবাসীরা : অন্তর্ভুক্তির লড়াইয়ে বৈষম্যের দেয়াল

মিথুশিলাক মুরমু

বৃহস্পতিবার, ০৮ মে ২০২৫

গত ৩ মে বাংলাদেশের একটি শীর্ষস্থানীয় জাতীয় দৈনিকে একটি হৃদয়স্পর্শী শিরোনাম ছাপা হয়Ñ ‘দেশ স্বাধীনের পর ওয়াংরাইপাড়ায় প্রথম বাজলো স্কুলের ঘণ্টা’। এই খবর শুধু একটি বিদ্যালয় উদ্বোধনের সংবাদ ছিল না, এটি ছিল অন্ধকারে আবিষ্ট একটি অঞ্চল থেকে শিক্ষার নতুন ভোর দেখার মুহূর্ত। বান্দরবান জেলার থানচি উপজেলার রেমাক্রি ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী দুর্গম ত্রিমতি কারবারিপাড়ায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত হলো ‘ওয়াংরাইপাড়া বিজিবি প্রাথমিক বিদ্যালয়’। এই বিদ্যালয়ের মাধ্যমে ৫টি পাড়ার ৪২টি পরিবারের শিশুরা প্রথমবারের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পা রাখল।

বিদ্যালয়টির উদ্বোধন করেন ৫৭ বিজিবি ব্যাটালিয়নের আলীকদম পরিচালক লে. কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মেহেদী। জাতীয় পতাকা উত্তোলন, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে জাতীয় সংগীত পরিবেশন এবং পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষা উপকরণ বিতরণসহ এক গর্বময় সূচনার সাক্ষী হয় এলাকাটি। ২৫ জন শিক্ষার্থী এককালীন আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে প্রাথমিক শিক্ষার প্রথম ধাপে পা রাখে।

এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। এটি প্রমাণ করে, সীমান্ত রক্ষা ছাড়াও বিজিবি পাহাড়ি অঞ্চলে সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে জনকল্যাণমূলক কাজে অবদান রাখছে। দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলের জটিল ভৌগোলিক প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে যে শিশুরা শিক্ষার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে, তাদের সংকল্প সত্যিই উৎসাহব্যঞ্জক। একদিন এই শিশুরাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পৌঁছে দেশ গড়ায় অবদান রাখবেÑ এই প্রত্যাশাই আমাদের অনুপ্রাণিত করে।

কিন্তু বিপরীত চিত্রও বিদ্যমান। একই দিনে, দেশের একেবারে অন্যপ্রান্তে, উত্তরবঙ্গের রংপুর জেলার পীরগাছার ধলখানা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আদিবাসী উরাঁও সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি সুমি খালকো শিক্ষা ব্যবস্থার তীব্র ব্যর্থতা ও বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরেন। তার বক্তব্য ছিল আবেগময়, হতাশাপূর্ণ এবং অপ্রিয় হলেও নির্মম বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি।

তিনি বলেন, আমাদের অনেক দাবি আছে। স্কুল আছে, কিন্তু সময়মতো খোলে না। ৯টার বদলে ১১টায় শিক্ষক আসেন। আমাদের আর্থিক সামর্থ্য নেই। কিন্ডারগার্টেন বা বেসরকারি স্কুলে পাঠাতে পারি না। আমাদের বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। তিনি আরও জানান, বিদ্যালয়ে কম্পিউটার দেওয়া হয়েছে, কিন্তু আমাদের সন্তানরা শিখতে পারছে না। অনেকেই ঝরে পড়েছে। প্রাইভেট পড়ানোর সামর্থ্য আমাদের নেই।

সুমি খালকোর কথায় উঠে এসেছে অব্যবস্থাপনার আক্ষেপ, বঞ্চনার হাহাকার, আর সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উদ্বেগ। শুধু তার নয়, এমন অসংখ্য আদিবাসী মা-বাবার কণ্ঠস্বর আমরা শুনতে পাই না। আমাদের রাষ্ট্রীয় শিক্ষানীতি হয়তো সর্বজনীনতার কথা বলে, কিন্তু বাস্তবে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য সে সর্বজনীনতা আজও অধরা।

বাংলাদেশে সামগ্রিকভাবে শিক্ষিতের হার যেখানে প্রায় ৭৫ শতাংশ, সেখানে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের শিক্ষার হার মাত্র ৩০ থেকে ৩২ শতাংশ। নারীদের ক্ষেত্রে তা আরও করুণÑ মাত্র ১৫ থেকে ১৭ শতাংশ। উত্তরবঙ্গের আদিবাসী সম্প্রদায়Ñ যেমন সাঁওতাল, উরাঁও, মু-া, মাহালি, বাগদি, ভূমিজ, মালো, মাহাতো, ভীল, রাই, তুরি, খন্দ, বেদিয়া, সিং ইত্যাদিÑ প্রতিটি পদক্ষেপে বৈষম্যের মুখোমুখি হচ্ছে। এদের মধ্যে অনেক সম্প্রদায় গভীর দারিদ্র্যসীমার নিচে জীবন কাটায়, যার ফলে শিক্ষা হয় একপ্রকার বিলাসিতা।

তথ্য যা ভাবায়

‘গণস্বাক্ষরতা অভিযান’-এর এক জরিপে উঠে এসেছেÑ রাজশাহীতে ৩৩.২৫ শতাংশ, নওগাঁয় ১৯.৮ শতাংশ, গাইবান্ধায় ১৩ শতাংশ আদিবাসী শিক্ষার্থী স্কুল থেকে ঝরে পড়ে। আয়বর্ধক কাজে যুক্ত থাকার কারণে রাজশাহীতে ২৪ শতাংশ ও দিনাজপুরে ১৮.৭ শতাংশ শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে যেতে পারে না। এছাড়া আদিবাসী নারী শিক্ষার্থীদের ৩১.৩ শতাংশ বিদ্যালয়ে যেতে ব্যর্থ হয়, যা নওগাঁয় সর্বোচ্চ ৩৯.৭ শতাংশ এবং হবিগঞ্জে সর্বনিম্ন ১৩.১ শতাংশ। এসব পরিসংখ্যানই বলে দেয়, শিক্ষার বৈষম্য কতটা গভীরে গাঁথা।

চ্যালেঞ্জগুলো কী?

বিদ্যালয় সময়মতো না খোলা। শিক্ষক-অবহেলা এবং জবাবদিহির অভাব। ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা (বাংলা ভাষায় পাঠ্যক্রম, যেখানে শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষা ভিন্ন)। প্রাইভেট টিউশনের অনুপস্থিতি। দারিদ্র্য এবং আর্থিক অনুপস্থিতি। ঝরে পড়া এবং শিশু শ্রম। অনিরাপদ যাতায়াত ও অপর্যাপ্ত স্যানিটেশন। বাল্যবিবাহ এবং গার্হস্থ্য দায়িত্ব।

এছাড়াও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আদিবাসী প্রতিনিধিত্বের অভাব, শিক্ষকদের মধ্যে আদিবাসী-বিষয়ক সংবেদনশীলতার অভাব, বৈষম্যমূলক মনোভাব এবং পাঠ্যক্রমে সাংস্কৃতিক অন্তর্ভুক্তির অনুপস্থিতি শিক্ষার্থীদের নিরুৎসাহিত করছে।

সমাধান কোথায়?

১. অবকাঠামো ও শিক্ষক নিয়োগে বৈপ্লবিক পদক্ষেপ : আদিবাসী এলাকায় শিক্ষক পাঠানোর পাশাপাশি স্থানীয় ভাষাভিত্তিক শিক্ষকদের নিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন।

২. মাতৃভাষাভিত্তিক প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা : ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় ইতোমধ্যে কিছু প্রকল্প চালু হলেও তা সার্বিক নয়।

৩. সচেতনতা ও অভিভাবকদের সহায়তা : অভিভাবকদের শিক্ষা বিষয়ে সচেতন করা, বাল্যবিবাহ রোধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ।

৪. অর্থনৈতিক সহায়তা : দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তি ও শিক্ষাসামগ্রী বিতরণ।

৫. প্রশিক্ষিত ও সংবেদনশীল শিক্ষক গড়ে তোলা : যাঁরা আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও ভাষাকে সম্মান করবেন।

৬. প্রতিটি উপজেলায় আদিবাসী শিক্ষা মনিটরিং সেল গঠন : যারা নিয়মিত বিদ্যালয় পরিদর্শন করবে।

শেষ কথা

একদিকে যখন বিজিবি একটি সীমান্তবর্তী জনপদে শিক্ষার আলো জ্বালায়, অন্যদিকে অন্য কোনো অঞ্চলে আদিবাসী শিশুরা শিক্ষা থেকে ছিটকে পড়ে। এই বৈপরীত্য আমাদের ভাবায়। সার্বজনীন শিক্ষা তখনই বাস্তবায়ন হবে, যখন তা সব জাতিগোষ্ঠী, শ্রেণি ও লিঙ্গের কাছে সমানভাবে পৌঁছবে। শুধু অবকাঠামো নয়, প্রয়োজন মানসিকতা ও রাষ্ট্রীয় সদিচ্ছার সমন্বয়। শিক্ষা অধিকারÑ এটি কেবল কাগজে নয়, বাস্তবতায় প্রতিষ্ঠা পেলে তবেই আমরা বলতে পারি, আমরা একটি মানবিক রাষ্ট্র গড়তে পেরেছি।

[লেখক : কলামিস্ট]

back to top