alt

opinion » post-editorial

ভারতের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন বনাম আমেরিকার শুল্ক কূটনীতি

এম এ হোসাইন

: শনিবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ডনাল্ড ট্রাম্প ও নরেন্দ্র মোদি যখন হাত মেলান, বলেন “সীমাহীন সম্ভাবনা” আর তাদের বন্ধুত্বের দৃঢ়তার ঘোষণা দেন, তখন দৃশ্যপট দেখে মনে হয় পৃথিবী যেন এক নতুন বাণিজ্য অধ্যায়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। তবে সেই সৌহার্দ্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে কঠিন বাস্তবতা। দুই নেতার প্রকাশ্য হাসিমুখ আর আশাবাদী বার্তার ভেতরে জমে আছে গভীর অমিল, যা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত করে তুলছে।

ট্রাম্পের রাজনৈতিক স্টাইল চিরকালই ভিন্ন। নিজেকে তিনি “ডিল মেকার” হিসেবে উপস্থাপন করতে ভালোবাসেন। তাই আলোচনার প্রেক্ষাপট যত জটিল হোক না কেন, তিনি আত্মবিশ্বাসের সুরেই কথা বলেন। অন্যদিকে মোদি ভারতের ভাবমূর্তি তুলে ধরতে মরিয়াÑএক উদীয়মান শক্তি, যা বিশ্ব রাজনীতিতে অপরিহার্য। এজন্য তার কাছে ওয়াশিংটনের স্বীকৃতি ও অংশীদারিত্ব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই সম্পর্কের উপর ভারি ছায়া ফেলছে শুল্ক, নিষেধাজ্ঞা ও পরাশক্তিদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা।

তবে সৌহার্দ্যের ভাষার আড়ালে রয়ে গেছে তীব্র মতপার্থক্য। শুল্কনীতি, নিষেধাজ্ঞা আর পরাশক্তিদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ভবিষ্যৎ সহযোগিতার উপর দীর্ঘ ছায়া ফেলছে। ট্রাম্প আমলে আমেরিকা দ্বিগুণ জোরে শুল্ক কূটনীতিতে নেমেছে। ভারতীয় আমদানির উপর ৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক চাপানো হয়েছে। এই শাস্তি ভারতের রাশিয়ার সাথে বাণিজ্যের সম্পর্কের কারণে। ট্রাম্পের কাছে এটি কেবল বাণিজ্য ভারসাম্যের প্রশ্ন নয়; বরং ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে মস্কোর কৌশলের টুটি চেপে ধরার প্রচেষ্টা। কিন্তু মোদির কাছে এই শুল্কনীতি ভারতের পররাষ্ট্রনীতির মূল দর্শনের সাথে সাংঘর্ষিক। ‘কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন’-এর ভিত্তিতেই ভারত বিশ্বরাজনীতিতে স্বাধীন অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা করে। ট্রাম্পের শুল্ক চাপ আসলে সেই সূক্ষ্ম ভারসাম্যকেই চ্যালেঞ্জ করছে।

এই পার্থক্য শুধু অর্থনীতির নয়, বরং এক গভীর বাস্তবতার প্রতিফলন। শীর্ষ নেতাদের বক্তৃতা যতই আশাবাদী শুনাক, বাণিজ্য চুক্তি কেবল বাণিজ্য নয়; এর ভেতরে থাকে রাজনীতি, শক্তি ও জাতীয় স্বার্থ।

ভারতের নীতি-বিভাজন বুঝতে হলে ইতিহাসে ফিরতে হয়। স্বাধীনতার পর নেহরু নেতৃত্বাধীন ভারত জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের পথে হাঁটে। কৌশলগতভাবে ভারত চায়নি শীতল যুদ্ধের কোনো শক্তি-গোষ্ঠীর ফাঁদে আটকা পড়তে। বাস্তবে এর মানে ছিল মস্কোর ঘনিষ্ঠতা যা অস্ত্র, জ্বালানি ও কূটনৈতিক সমর্থনের বার্তা। আজও সেই ঐতিহ্যের ছাপ ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে অটল।

বর্তমানে সস্তা দামে বিক্রি হওয়া রুশ তেল ভারতের প্রবৃদ্ধিকে গতিশীল করছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখছে। ট্যাঙ্ক থেকে যুদ্ধবিমানÑভারতের সামরিক শক্তির মেরুদ- এখনো রুশ অস্ত্রনির্ভর। ওয়াশিংটনের চাপে হঠাৎ মস্কো থেকে সরে আসা মানে শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, বরং চীনের সাথে তীব্র নিরাপত্তাজনিত দ্বন্দ্বের সময়ে নিজেকে দুর্বল করে ফেলা।

এ কারণেই ট্রাম্পের শুল্কের মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ উল্টো ফল দিতে পারে। ছোট অর্থনীতি হলে ভিন্ন কথা, কিন্তু ভারত বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি এবং ইন্দো-প্যাসিফি কৌশলে অপরিহার্য অংশীদার। কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন ভারতের হাতে সেই সুবিধাই দেয় যার একদিকে রয়েছে ওয়াশিংটনের সাথে প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তি সহযোগিতা, অন্যদিকে রাশিয়ার জ্বালানি ও অস্ত্র ব্যবহার। মস্কোর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি আসলে ভারতীয় রাষ্ট্রকৌশলকেই ভুলভাবে বোঝা।

ইতিহাস এখানে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় ওয়াশিংটন যখন পাকিস্তানের পাশে দাঁড়িয়েছিল, তখন মস্কো ভারতের কূটনৈতিক সঙ্গী হয়ে উঠে, জাতিসংঘে ভেটো দিয়ে দিল্লিকে অবরুদ্ধ হওয়া থেকে বাঁচায়। এমন স্মৃতি সহজে মুছে যায় না। ভারতীয় নেতাদের কাছে রাশিয়া কেবল অর্থনৈতিক অংশীদার নয়, বরং সংকট মুহূর্তের কৌশলগত আশ্রয়দাতা।

ট্রাম্পের বিস্তৃত শুল্ক এজেন্ডা বিষয়টিকে আরও জটিল করেছে। তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নকে চীন ও ভারতের পণ্যের ওপর শতভাগ শুল্ক আরোপের আহ্বান জানিয়েছেন। তার যুক্তিÑএভাবে রাশিয়ার যুদ্ধে অর্থনৈতিক সমর্থন বন্ধ করা যাবে। পরিকল্পনাটি সাহসী হলেও সাহস সবসময় প্রজ্ঞার সমার্থক নয়। ভারতকে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের সাথে একই পাল্লায় মেপে দিল্লির উপর চাপ সৃষ্টি করলে ওয়াশিংটন হয়তো এক গুরুত্বপূর্ণ মিত্রকেই দূরে ঠেলে দিবে।

এরূপ পরিস্থিতিতে ভøাদিমির পুতিন সুযোগটি কাজে লাগিয়েছেন। তিনি মার্কিনীদের সমালোচনা করে বলেছেন, ভারত ও চীনের সাথে “ঔপনিবেশিক সুরে” কথা বলা গ্রহণযোগ্য নয়। ভারতের মতো দেশ, যারা উপনিবেশিক শাসনের তিক্ত অভিজ্ঞতা বহন করে, তারা এমন ভাষার প্রতি স্বভাবতই সংবেদনশীল। ট্রাম্পের হুমকি সেই ক্ষতকে আরও উসকে দিতে পারে। এতে রাশিয়া ও চীনের প্রচার কৌশল আরও শক্তিশালী হবেÑপশ্চিমা দেশগুলো আসলে আধিপত্য চায়, প্রকৃত অংশীদারিত্ব নয়।

ফলত ট্রাম্পের শুল্ক-কূটনীতি উল্টো ফল দিতে পারে। মস্কো-বেইজিং থেকে ভারতকে দূরে টানার বদলে হয়তো কাছে ঠেলে দিবে। বাণিজ্য দিয়ে চাপ সৃষ্টি করলে দ্রুত ফল পাওয়া যায় বটে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি আস্থাভিত্তিক সম্পর্ক গড়া যায় না।

প্রশ্ন উঠতেই পারে, এতে কি ট্রাম্প ও মোদির মধ্যে কোনো সমঝোতা সম্ভব নয়? হয়ত পুরোপুরি নয়। দুই নেতা-ই প্রতীকের রাজনীতিতে সিদ্ধহস্ত। মোদির প্রধান লক্ষ্য দেশে শক্তিশালী চিত্র তুলে ধরাÑতিনি কখনো বিদেশি চাপের কাছে মাথা নত করেন না। ট্রাম্পের অগ্রাধিকার ভিন্নÑতিনি এমন এক চুক্তি চান, যা তার প্রচারণায় তুলে ধরতে পারবেন। এই ভিন্ন লক্ষ্য বড় ধরনের সমঝোতাকে অনিশ্চিত করে। সম্ভবত তারা সীমিত, কিন্তু কৌশলগতভাবে সাজানো চুক্তিতেই পৌঁছাবেনÑযেমন আমেরিকান প্রাকৃতিক গ্যাসের ক্রয় বৃদ্ধি, ভারতের কৃষি ও ডিজিটাল খাতে মার্কিন কোম্পানির প্রবেশাধিকার বৃদ্ধি, কিংবা সীমিত প্রতিরক্ষা সহযোগিতা।

এসব পদক্ষেপ মৌলিক দ্বন্দ্ব সমাধান করবে না। আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা-নির্ভর বাণিজ্যনীতি ও ভারতের স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতির কৌশলগত তাগিদ একই জায়গায় মিলবে না। তবে উভয় পক্ষকেই সাময়িক সাফল্য দাবি করার সুযোগ দেবে। ট্রাম্প দেখাতে পারবেন যে শুল্ক কার্যকর। মোদি প্রমাণ করতে পারবেন যে ভারত তার অবস্থানে থেকেও ওয়াশিংটনের ঘনিষ্ঠ।

তবু ভুল হিসাবের ঝুঁকি থেকেই যায়। ট্রাম্পের একগুঁয়ে ধারা আপসের জায়গা কমিয়ে দেয়। তিনি যদি চান ভারত পুরোপুরি ছেড়ে দিক, তবে আলোচনা ভেস্তে যাবে। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা যেকোনো ছাড়কে “বিদেশি শক্তির কাছে নতি স্বীকার” বলে আক্রমণ করবে। তখন মোদির বাধ্য হয়ে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। এর প্রভাব শুধু প্রতীকী হবে না; ইন্দো-প্যাসিফিক সহযোগিতাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যা চীনের মোকাবেলায় উভয়ের যৌথ প্রচেষ্টাকে দুর্বল করবে।

ট্রাম্প-মোদি শুল্ক যুদ্ধ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, বিশ্বব্যবস্থা কতটা ভঙ্গুর। এক সময় বাণিজ্য ছিল জাতিগুলোর সেতু, এখন তা প্রায়শই অস্ত্র। জোটগুলোও বদলে গেছে। আর কেবল অভিন্ন মূল্যবোধের উপর দাঁড়ায় না, বরং সমঝোতা, চাপ আর প্রয়োজনের ভিত্তিতে দাঁড়ায়। ভারত, এর উজ্জ্বল উদাহরণÑজ্বালানির জন্য রাশিয়ার দিকে তাকায়, বাজারের জন্য পশ্চিমের দিকে, আর নিরাপত্তার জন্য নিজের দিকে।

সবচেয়ে ভালো হয়তবা হতে পারে, তারা এক অস্থায়ী শান্তি চুক্তিতে পৌঁছাবে। তা হয়তো ভাঙন ঠেকাবে, কিন্তু মূল দ্বন্দ্ব মেটাবে না। কূটনৈতিক আশাবাদ পরিবেশকে নরম করতে পারে, কিন্তু দ্বন্দ্ব লুকাতে পারে না। আমেরিকা বাণিজ্যকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চায়, ভারত খোঁজে ভারসাম্য, আর এতে পুতিন কৌশলগত লাভ খুঁজে নেন। এই অনিশ্চিত ত্রিভুজেই বিশ্বব্যবস্থা নতুনভাবে রূপ নিচ্ছে।

যদি ছোট কোনো চুক্তি হয়, ট্রাম্প ও মোদি সেটিকে ঐতিহাসিক বলে প্রচার করবেন। যদি আলোচনা ভেঙে যায়, প্রভাব ছড়িয়ে পড়বে ওয়াশিংটন-নয়াদিল্লির বাইরেও। তা প্রকাশ করবে আমেরিকার শুল্কনির্ভর কূটনীতির সীমাবদ্ধতা, পশ্চিমা শিবিরে বিভাজনকে গভীর করবে এবং ভারতকে আরও দৃঢ়ভাবে নিজের স্বাধীন কৌশলগত পথে এগিয়ে দেবে।

[লেখক: প্রাবন্ধিক]

দায়িত্বশীল আচরণে গড়ে উঠুক দেশের পর্যটন খাত

এশিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় নতুন সমীকরণ

বাংলাদেশের গিগ অর্থনীতি: উন্নয়নের হাতিয়ার নাকি অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ?

জলাতঙ্ক: প্রতিরোধযোগ্য তবু প্রাণঘাতী

বেড়ে চলা বৈষম্যের দেওয়াল

নৃশংসতার ভিডিও, নীরব দর্শক আর হারিয়ে যাওয়া মানবতা

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা ও জনস্বাস্থ্যের সংকট

জেন জি’র অস্থির অভিযাত্রা

রম্যগদ্য: রবার্ট ব্রুস ও মাকড়শা

জাতিসংঘের নিউইয়র্ক সম্মেলন

বিশ্ব ফুসফুস দিবস: সুস্থ শ্বাসের অঙ্গীকার

সংখ্যার আড়ালে অর্থনীতির অদেখা বাস্তবতা

সঙ্গীত চর্চা ও ধর্ম শিক্ষা: তর্ক-বিতর্কের জায়গাটি কোথায়?

অপুষ্টি ও মাটির অবক্ষয় রোধে সবুজ সার

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘পোষ্য কোটা’ পুনর্বহাল বিতর্ক

আইসিইউ সেবার সংকট

পরশ্রীকাতরতা: সামাজিক ব্যাধির অদৃশ্য শেকল

চার্লি কার্ক হত্যাকাণ্ড: ট্রাম্প কি সহিংসতাকেই রাজনীতির হাতিয়ার বানাচ্ছেন?

যুব বেকারত্ব: অর্থনৈতিক সংকট থেকে সামাজিক বিপর্যয়

চাই স্বাধীনভাবে ধর্ম পালনের পরিবেশ

সার সংকট, ভর্তুকি ও সিন্ডিকেট

দ. কোরিয়ার শ্রমবাজার : কোটা পূরণে ব্যর্থ বাংলাদেশ

সংবিধান কাটাছেঁড়ার সুযোগ আছে কি?

সংসদে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব

চা-জনগোষ্ঠীর দণ্ডপূজা ও উপেক্ষিত অধিকার

মেরিটোক্রেসি: সমাজ ও রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা

রম্যগদ্য: হাতের মুঠোয় বিশ্ব

শারদীয় পূজার দিনলিপি

ঋণের জন্য আত্মহত্যা, ঋণ নিয়েই চল্লিশা

জাকসু নির্বাচন ও হট্টগোল: আমাদের জন্য শিক্ষণীয় কী?

নরসুন্দর পেশার গুরুত্ব ও সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন

বিভাগভিত্তিক এমপিআর নির্বাচন পদ্ধতি

প্ল্যাটফর্ম সমাজে বাংলাদেশ: জ্ঞানের ভবিষ্যৎ কার হাতে?

আনন্দবেদনার হাসপাতাল: সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার বাস্তবতা

ছবি

ভিন্ন ধরনের নির্বাচন, ভিন্ন ধরনের ফল

বেসরকারি খাতে সিআইবি’র যাত্রা: ঋণ ব্যবস্থার নতুন দিগন্ত

tab

opinion » post-editorial

ভারতের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন বনাম আমেরিকার শুল্ক কূটনীতি

এম এ হোসাইন

শনিবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ডনাল্ড ট্রাম্প ও নরেন্দ্র মোদি যখন হাত মেলান, বলেন “সীমাহীন সম্ভাবনা” আর তাদের বন্ধুত্বের দৃঢ়তার ঘোষণা দেন, তখন দৃশ্যপট দেখে মনে হয় পৃথিবী যেন এক নতুন বাণিজ্য অধ্যায়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। তবে সেই সৌহার্দ্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে কঠিন বাস্তবতা। দুই নেতার প্রকাশ্য হাসিমুখ আর আশাবাদী বার্তার ভেতরে জমে আছে গভীর অমিল, যা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত করে তুলছে।

ট্রাম্পের রাজনৈতিক স্টাইল চিরকালই ভিন্ন। নিজেকে তিনি “ডিল মেকার” হিসেবে উপস্থাপন করতে ভালোবাসেন। তাই আলোচনার প্রেক্ষাপট যত জটিল হোক না কেন, তিনি আত্মবিশ্বাসের সুরেই কথা বলেন। অন্যদিকে মোদি ভারতের ভাবমূর্তি তুলে ধরতে মরিয়াÑএক উদীয়মান শক্তি, যা বিশ্ব রাজনীতিতে অপরিহার্য। এজন্য তার কাছে ওয়াশিংটনের স্বীকৃতি ও অংশীদারিত্ব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই সম্পর্কের উপর ভারি ছায়া ফেলছে শুল্ক, নিষেধাজ্ঞা ও পরাশক্তিদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা।

তবে সৌহার্দ্যের ভাষার আড়ালে রয়ে গেছে তীব্র মতপার্থক্য। শুল্কনীতি, নিষেধাজ্ঞা আর পরাশক্তিদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ভবিষ্যৎ সহযোগিতার উপর দীর্ঘ ছায়া ফেলছে। ট্রাম্প আমলে আমেরিকা দ্বিগুণ জোরে শুল্ক কূটনীতিতে নেমেছে। ভারতীয় আমদানির উপর ৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক চাপানো হয়েছে। এই শাস্তি ভারতের রাশিয়ার সাথে বাণিজ্যের সম্পর্কের কারণে। ট্রাম্পের কাছে এটি কেবল বাণিজ্য ভারসাম্যের প্রশ্ন নয়; বরং ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে মস্কোর কৌশলের টুটি চেপে ধরার প্রচেষ্টা। কিন্তু মোদির কাছে এই শুল্কনীতি ভারতের পররাষ্ট্রনীতির মূল দর্শনের সাথে সাংঘর্ষিক। ‘কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন’-এর ভিত্তিতেই ভারত বিশ্বরাজনীতিতে স্বাধীন অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা করে। ট্রাম্পের শুল্ক চাপ আসলে সেই সূক্ষ্ম ভারসাম্যকেই চ্যালেঞ্জ করছে।

এই পার্থক্য শুধু অর্থনীতির নয়, বরং এক গভীর বাস্তবতার প্রতিফলন। শীর্ষ নেতাদের বক্তৃতা যতই আশাবাদী শুনাক, বাণিজ্য চুক্তি কেবল বাণিজ্য নয়; এর ভেতরে থাকে রাজনীতি, শক্তি ও জাতীয় স্বার্থ।

ভারতের নীতি-বিভাজন বুঝতে হলে ইতিহাসে ফিরতে হয়। স্বাধীনতার পর নেহরু নেতৃত্বাধীন ভারত জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের পথে হাঁটে। কৌশলগতভাবে ভারত চায়নি শীতল যুদ্ধের কোনো শক্তি-গোষ্ঠীর ফাঁদে আটকা পড়তে। বাস্তবে এর মানে ছিল মস্কোর ঘনিষ্ঠতা যা অস্ত্র, জ্বালানি ও কূটনৈতিক সমর্থনের বার্তা। আজও সেই ঐতিহ্যের ছাপ ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে অটল।

বর্তমানে সস্তা দামে বিক্রি হওয়া রুশ তেল ভারতের প্রবৃদ্ধিকে গতিশীল করছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখছে। ট্যাঙ্ক থেকে যুদ্ধবিমানÑভারতের সামরিক শক্তির মেরুদ- এখনো রুশ অস্ত্রনির্ভর। ওয়াশিংটনের চাপে হঠাৎ মস্কো থেকে সরে আসা মানে শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, বরং চীনের সাথে তীব্র নিরাপত্তাজনিত দ্বন্দ্বের সময়ে নিজেকে দুর্বল করে ফেলা।

এ কারণেই ট্রাম্পের শুল্কের মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ উল্টো ফল দিতে পারে। ছোট অর্থনীতি হলে ভিন্ন কথা, কিন্তু ভারত বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি এবং ইন্দো-প্যাসিফি কৌশলে অপরিহার্য অংশীদার। কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন ভারতের হাতে সেই সুবিধাই দেয় যার একদিকে রয়েছে ওয়াশিংটনের সাথে প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তি সহযোগিতা, অন্যদিকে রাশিয়ার জ্বালানি ও অস্ত্র ব্যবহার। মস্কোর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি আসলে ভারতীয় রাষ্ট্রকৌশলকেই ভুলভাবে বোঝা।

ইতিহাস এখানে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় ওয়াশিংটন যখন পাকিস্তানের পাশে দাঁড়িয়েছিল, তখন মস্কো ভারতের কূটনৈতিক সঙ্গী হয়ে উঠে, জাতিসংঘে ভেটো দিয়ে দিল্লিকে অবরুদ্ধ হওয়া থেকে বাঁচায়। এমন স্মৃতি সহজে মুছে যায় না। ভারতীয় নেতাদের কাছে রাশিয়া কেবল অর্থনৈতিক অংশীদার নয়, বরং সংকট মুহূর্তের কৌশলগত আশ্রয়দাতা।

ট্রাম্পের বিস্তৃত শুল্ক এজেন্ডা বিষয়টিকে আরও জটিল করেছে। তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নকে চীন ও ভারতের পণ্যের ওপর শতভাগ শুল্ক আরোপের আহ্বান জানিয়েছেন। তার যুক্তিÑএভাবে রাশিয়ার যুদ্ধে অর্থনৈতিক সমর্থন বন্ধ করা যাবে। পরিকল্পনাটি সাহসী হলেও সাহস সবসময় প্রজ্ঞার সমার্থক নয়। ভারতকে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের সাথে একই পাল্লায় মেপে দিল্লির উপর চাপ সৃষ্টি করলে ওয়াশিংটন হয়তো এক গুরুত্বপূর্ণ মিত্রকেই দূরে ঠেলে দিবে।

এরূপ পরিস্থিতিতে ভøাদিমির পুতিন সুযোগটি কাজে লাগিয়েছেন। তিনি মার্কিনীদের সমালোচনা করে বলেছেন, ভারত ও চীনের সাথে “ঔপনিবেশিক সুরে” কথা বলা গ্রহণযোগ্য নয়। ভারতের মতো দেশ, যারা উপনিবেশিক শাসনের তিক্ত অভিজ্ঞতা বহন করে, তারা এমন ভাষার প্রতি স্বভাবতই সংবেদনশীল। ট্রাম্পের হুমকি সেই ক্ষতকে আরও উসকে দিতে পারে। এতে রাশিয়া ও চীনের প্রচার কৌশল আরও শক্তিশালী হবেÑপশ্চিমা দেশগুলো আসলে আধিপত্য চায়, প্রকৃত অংশীদারিত্ব নয়।

ফলত ট্রাম্পের শুল্ক-কূটনীতি উল্টো ফল দিতে পারে। মস্কো-বেইজিং থেকে ভারতকে দূরে টানার বদলে হয়তো কাছে ঠেলে দিবে। বাণিজ্য দিয়ে চাপ সৃষ্টি করলে দ্রুত ফল পাওয়া যায় বটে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি আস্থাভিত্তিক সম্পর্ক গড়া যায় না।

প্রশ্ন উঠতেই পারে, এতে কি ট্রাম্প ও মোদির মধ্যে কোনো সমঝোতা সম্ভব নয়? হয়ত পুরোপুরি নয়। দুই নেতা-ই প্রতীকের রাজনীতিতে সিদ্ধহস্ত। মোদির প্রধান লক্ষ্য দেশে শক্তিশালী চিত্র তুলে ধরাÑতিনি কখনো বিদেশি চাপের কাছে মাথা নত করেন না। ট্রাম্পের অগ্রাধিকার ভিন্নÑতিনি এমন এক চুক্তি চান, যা তার প্রচারণায় তুলে ধরতে পারবেন। এই ভিন্ন লক্ষ্য বড় ধরনের সমঝোতাকে অনিশ্চিত করে। সম্ভবত তারা সীমিত, কিন্তু কৌশলগতভাবে সাজানো চুক্তিতেই পৌঁছাবেনÑযেমন আমেরিকান প্রাকৃতিক গ্যাসের ক্রয় বৃদ্ধি, ভারতের কৃষি ও ডিজিটাল খাতে মার্কিন কোম্পানির প্রবেশাধিকার বৃদ্ধি, কিংবা সীমিত প্রতিরক্ষা সহযোগিতা।

এসব পদক্ষেপ মৌলিক দ্বন্দ্ব সমাধান করবে না। আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা-নির্ভর বাণিজ্যনীতি ও ভারতের স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতির কৌশলগত তাগিদ একই জায়গায় মিলবে না। তবে উভয় পক্ষকেই সাময়িক সাফল্য দাবি করার সুযোগ দেবে। ট্রাম্প দেখাতে পারবেন যে শুল্ক কার্যকর। মোদি প্রমাণ করতে পারবেন যে ভারত তার অবস্থানে থেকেও ওয়াশিংটনের ঘনিষ্ঠ।

তবু ভুল হিসাবের ঝুঁকি থেকেই যায়। ট্রাম্পের একগুঁয়ে ধারা আপসের জায়গা কমিয়ে দেয়। তিনি যদি চান ভারত পুরোপুরি ছেড়ে দিক, তবে আলোচনা ভেস্তে যাবে। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা যেকোনো ছাড়কে “বিদেশি শক্তির কাছে নতি স্বীকার” বলে আক্রমণ করবে। তখন মোদির বাধ্য হয়ে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। এর প্রভাব শুধু প্রতীকী হবে না; ইন্দো-প্যাসিফিক সহযোগিতাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যা চীনের মোকাবেলায় উভয়ের যৌথ প্রচেষ্টাকে দুর্বল করবে।

ট্রাম্প-মোদি শুল্ক যুদ্ধ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, বিশ্বব্যবস্থা কতটা ভঙ্গুর। এক সময় বাণিজ্য ছিল জাতিগুলোর সেতু, এখন তা প্রায়শই অস্ত্র। জোটগুলোও বদলে গেছে। আর কেবল অভিন্ন মূল্যবোধের উপর দাঁড়ায় না, বরং সমঝোতা, চাপ আর প্রয়োজনের ভিত্তিতে দাঁড়ায়। ভারত, এর উজ্জ্বল উদাহরণÑজ্বালানির জন্য রাশিয়ার দিকে তাকায়, বাজারের জন্য পশ্চিমের দিকে, আর নিরাপত্তার জন্য নিজের দিকে।

সবচেয়ে ভালো হয়তবা হতে পারে, তারা এক অস্থায়ী শান্তি চুক্তিতে পৌঁছাবে। তা হয়তো ভাঙন ঠেকাবে, কিন্তু মূল দ্বন্দ্ব মেটাবে না। কূটনৈতিক আশাবাদ পরিবেশকে নরম করতে পারে, কিন্তু দ্বন্দ্ব লুকাতে পারে না। আমেরিকা বাণিজ্যকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চায়, ভারত খোঁজে ভারসাম্য, আর এতে পুতিন কৌশলগত লাভ খুঁজে নেন। এই অনিশ্চিত ত্রিভুজেই বিশ্বব্যবস্থা নতুনভাবে রূপ নিচ্ছে।

যদি ছোট কোনো চুক্তি হয়, ট্রাম্প ও মোদি সেটিকে ঐতিহাসিক বলে প্রচার করবেন। যদি আলোচনা ভেঙে যায়, প্রভাব ছড়িয়ে পড়বে ওয়াশিংটন-নয়াদিল্লির বাইরেও। তা প্রকাশ করবে আমেরিকার শুল্কনির্ভর কূটনীতির সীমাবদ্ধতা, পশ্চিমা শিবিরে বিভাজনকে গভীর করবে এবং ভারতকে আরও দৃঢ়ভাবে নিজের স্বাধীন কৌশলগত পথে এগিয়ে দেবে।

[লেখক: প্রাবন্ধিক]

back to top