রেজাউল করিম খোকন
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউর সামনে প্রতিদিন একই দৃশ্যÑদশ-বারোজন উদ্বিগ্ন স্বজন সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকেন। কারও চোখে অশ্রু, কারও মুখে অদ্ভুত চাপা আতঙ্ক। যন্ত্রপাতির শব্দের আড়ালে ভেতরে চলছে জীবন-মৃত্যুর খেলা। চিকিৎসক-নার্সরা প্রাণপণে লড়ছেন, কিন্তু বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো কেবল প্রার্থনা করেনÑ“হায় আল্লাহ, যেন বাঁচে।”
আইসিইউ, অর্থাৎ ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট, চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। মারাত্মক অসুস্থ রোগীদের জন্য এটি জীবনরক্ষাকারী ব্যবস্থা। অথচ বাংলাদেশে আজও আইসিইউ একটি সীমিত সুবিধা। দেশের অধিকাংশ জেলায় এই সেবা নেই। যারা বেসরকারি হাসপাতালে যেতে পারেন না, তাদের জন্য পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা মাত্র ১ হাজার ১২৬টি। বেসরকারি পর্যায়ে আরও প্রায় ১ হাজার শয্যা আছে। মোট সংখ্যা দাঁড়ায় দুই হাজারের সামান্য বেশি। অথচ বাংলাদেশে মানুষের সংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। অর্থাৎ প্রতি দেড় লাখ মানুষের জন্য গড়ে একটি আইসিইউ শয্যা।
তুলনামূলকভাবে দেখতে গেলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। ভারতে গড়ে প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য ২.৩টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে আরও বহুগুণ বেশি। সেখানে উন্নত অবকাঠামো ও দক্ষ জনবল মিলে সংকট সামাল দেওয়া যায়। কিন্তু বাংলাদেশে পরিস্থিতি ঠিক উল্টোÑশয্যা কম, জনবল কম, সরঞ্জাম সীমিত।
দেশের কমপক্ষে ২২টি জেলায় সরকারি হাসপাতালে কোনো আইসিইউ নেই। মানে, দুর্ঘটনা বা গুরুতর অসুস্থতার শিকার হলে সেসব জেলার মানুষকে রাজধানী বা বিভাগীয় শহরে ছুটতে হয়। পথে রোগীর মৃত্যু হলে তার দায় কে নেবে?
উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়, কুড়িগ্রাম বা নীলফামারীর মতো দূরবর্তী জেলায় গুরুতর অসুস্থ রোগীকে যদি রাতারাতি ঢাকায় আনা সম্ভব না হয়, তবে সেই রোগীর মৃত্যুই অনিবার্য হয়ে ওঠে। গ্রামীণ মানুষদের জন্য এটি প্রতিদিনের বাস্তবতা।
সরকারি হাসপাতালে আইসিইউর খরচ তুলনামূলকভাবে কম। কিন্তু শয্যা এত সীমিত যে সাধারণ মানুষ সেখানে জায়গা পান না। ফলে বাধ্য হয়ে তাদের বেসরকারি হাসপাতালে যেতে হয়।
বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিন একটি আইসিইউ বেডে চিকিৎসার খরচ দাঁড়ায় ৩০-৩৫ হাজার টাকা। দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিলে খরচ গড়ে কয়েক লাখ টাকা পর্যন্ত পৌঁছায়। বাংলাদেশের গড় আয়ের মানুষদের পক্ষে এটি বহন করা একেবারেই অসম্ভব। অনেক পরিবার শেষ সম্বল বিক্রি করে চিকিৎসা করাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। তবু রোগীকে বাঁচানো যায় না।
এই বৈষম্য একদিকে যেমন অর্থনৈতিক বৈপরীত্য তুলে ধরে, তেমনি রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যনীতি কতটা ব্যর্থ হয়েছে, তাও স্পষ্ট করে।
করোনাভাইরাস মহামারি যখন আঘাত হানে, তখন বাংলাদেশে আইসিইউ সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। রোগীরা এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটে বেড়াতেন, অথচ কোথাও আইসিইউ শয্যা খালি থাকত না। অনেক রোগী অ্যাম্বুলেন্সেই মারা যেতেন।
করোনার সময়ে সরকার তড়িঘড়ি করে কিছু জেলা হাসপাতালে আইসিইউ চালু করেছিল। প্রায় ৪০০ জনকে বিশেষ প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মহামারি কমতেই সেই সেবাগুলো টেকসইভাবে চালু রাখা হয়নি। যন্ত্রপাতির রক্ষণাবেক্ষণ হয়নি, অনেক স্থানে দক্ষ জনবলের অভাবে সেগুলো অকেজো হয়ে গেছে। অর্থাৎ, সংকট থেকে শিক্ষা নেওয়ার পরিবর্তে আমরা আবার আগের অবস্থাতেই ফিরে গেছি।
স্বাস্থ্য খাত নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বড় বড় কথা বলেন। নতুন হাসপাতাল, নতুন ভবন নির্মাণ হয়; কিন্তু আসল সেবার জায়গায় গাফিলতি থেকে যায়। চিকিৎসক নিয়োগ যথেষ্ট হয় না, নার্সের অভাব দীর্ঘস্থায়ী, যন্ত্রপাতি কিনলেও তা রক্ষণাবেক্ষণ হয় না।
আইসিইউ হলো উচ্চমানের চিকিৎসার একটি অংশ। এটি কেবল শয্যা বসানো নয়; বরং এখানে প্রয়োজন দক্ষ ডাক্তার, বিশেষ প্রশিক্ষিত নার্স, পর্যাপ্ত ভেন্টিলেটর, মনিটর, ওষুধ এবং বিদ্যুৎব্যবস্থা। এসব না থাকলে আইসিইউ নামমাত্র হয়ে দাঁড়ায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, একটি দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা শক্তিশালী হতে হলে প্রতি লাখ মানুষের জন্য অন্তত ৫টি আইসিইউ শয্যা থাকা উচিত। সে হিসাবে বাংলাদেশে দরকার ছিল অন্তত ৮,৫০০ আইসিইউ শয্যা। অথচ আমাদের আছে কেবল দুই হাজার।
তুলনামূলকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশও আমাদের চেয়ে এগিয়ে। শ্রীলঙ্কার মতো ছোট দেশেও আইসিইউ সেবার মান ও বিস্তার বাংলাদেশের চেয়ে উন্নত।
মোহাম্মদপুরের গৃহিণী শিরিন আক্তার তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন: “আমার স্বামী হঠাৎ স্ট্রোকে আক্রান্ত হলেন। ঢামেক হাসপাতালে আনি, কিন্তু সেখানে কোনো আইসিইউ ফাঁকা ছিল না। বেসরকারি হাসপাতালে গেলাম, খরচ শুনে চোখে অন্ধকার দেখলাম। শেষ পর্যন্ত বাড়ি ফিরিয়ে আনতে হলো। তিনদিন পর উনি মারা গেলেন।”
এমন গল্প অসংখ্য। যারা হারিয়েছেন স্বজনকে, তাদের কষ্ট ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। কিন্তু প্রতিটি মৃত্যু আমাদের স্বাস্থ্যখাতের ব্যর্থতার নির্মম দলিল।
সমাধান কী হতে পারে? প্রতিটি জেলায় আইসিইউ চালু করা: শুধু চালু নয়, সেগুলো সচল রাখার জন্য পর্যাপ্ত বাজেট ও জনবল নিশ্চিত করতে হবে।
জনবল প্রশিক্ষণ ও নিয়োগ: আইসিইউ পরিচালনায় বিশেষ দক্ষতার চিকিৎসক ও নার্স দরকার। দেশে সেই প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।
সরঞ্জাম রক্ষণাবেক্ষণ: শুধু ভেন্টিলেটর কিনলেই হবে না, সেগুলোর নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে।
খরচ সাশ্রয়ী করা: সরকারি হাসপাতালের সেবা বৃদ্ধি করে বেসরকারি পর্যায়ের অস্বাভাবিক খরচ কমাতে হবে।
জরুরি স্বাস্থ্যবীমা ব্যবস্থা: সাধারণ মানুষের জন্য স্বাস্থ্যবীমা চালু করা জরুরি। এতে হঠাৎ আইসিইউ খরচ বহন সহজ হবে।
৬. কোভিড থেকে শিক্ষা নেওয়া: মহামারির সময়ে তৈরি করা অবকাঠামো স্থায়ীভাবে রক্ষা ও ব্যবহার করতে হবে।
মানুষের জীবনের চেয়ে মূল্যবান কিছু নেই। উন্নয়নের সুফল যদি মানুষের মৌলিক স্বাস্থ্যসেবায় না পৌঁছায়, তবে সেই উন্নয়ন কাগুজে থেকে যায়। আইসিইউর সংকট শুধু চিকিৎসা অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতা নয়, বরং এটি রাষ্ট্রের দায়িত্বহীনতার প্রতীক।
এখনও সময় আছেÑনীতিনির্ধারকেরা যদি আন্তরিক হন, তবে প্রতিটি জেলায় মানসম্পন্ন আইসিইউ সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব। মানুষের জীবন বাঁচানোই উন্নয়নের আসল সূচক। তাই স্বাস্থ্যখাতে অগ্রাধিকার দিয়ে এই সংকট নিরসন এখন সময়ের দাবি।
[লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]
রেজাউল করিম খোকন
সোমবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউর সামনে প্রতিদিন একই দৃশ্যÑদশ-বারোজন উদ্বিগ্ন স্বজন সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকেন। কারও চোখে অশ্রু, কারও মুখে অদ্ভুত চাপা আতঙ্ক। যন্ত্রপাতির শব্দের আড়ালে ভেতরে চলছে জীবন-মৃত্যুর খেলা। চিকিৎসক-নার্সরা প্রাণপণে লড়ছেন, কিন্তু বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো কেবল প্রার্থনা করেনÑ“হায় আল্লাহ, যেন বাঁচে।”
আইসিইউ, অর্থাৎ ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট, চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। মারাত্মক অসুস্থ রোগীদের জন্য এটি জীবনরক্ষাকারী ব্যবস্থা। অথচ বাংলাদেশে আজও আইসিইউ একটি সীমিত সুবিধা। দেশের অধিকাংশ জেলায় এই সেবা নেই। যারা বেসরকারি হাসপাতালে যেতে পারেন না, তাদের জন্য পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা মাত্র ১ হাজার ১২৬টি। বেসরকারি পর্যায়ে আরও প্রায় ১ হাজার শয্যা আছে। মোট সংখ্যা দাঁড়ায় দুই হাজারের সামান্য বেশি। অথচ বাংলাদেশে মানুষের সংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। অর্থাৎ প্রতি দেড় লাখ মানুষের জন্য গড়ে একটি আইসিইউ শয্যা।
তুলনামূলকভাবে দেখতে গেলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। ভারতে গড়ে প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য ২.৩টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে আরও বহুগুণ বেশি। সেখানে উন্নত অবকাঠামো ও দক্ষ জনবল মিলে সংকট সামাল দেওয়া যায়। কিন্তু বাংলাদেশে পরিস্থিতি ঠিক উল্টোÑশয্যা কম, জনবল কম, সরঞ্জাম সীমিত।
দেশের কমপক্ষে ২২টি জেলায় সরকারি হাসপাতালে কোনো আইসিইউ নেই। মানে, দুর্ঘটনা বা গুরুতর অসুস্থতার শিকার হলে সেসব জেলার মানুষকে রাজধানী বা বিভাগীয় শহরে ছুটতে হয়। পথে রোগীর মৃত্যু হলে তার দায় কে নেবে?
উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়, কুড়িগ্রাম বা নীলফামারীর মতো দূরবর্তী জেলায় গুরুতর অসুস্থ রোগীকে যদি রাতারাতি ঢাকায় আনা সম্ভব না হয়, তবে সেই রোগীর মৃত্যুই অনিবার্য হয়ে ওঠে। গ্রামীণ মানুষদের জন্য এটি প্রতিদিনের বাস্তবতা।
সরকারি হাসপাতালে আইসিইউর খরচ তুলনামূলকভাবে কম। কিন্তু শয্যা এত সীমিত যে সাধারণ মানুষ সেখানে জায়গা পান না। ফলে বাধ্য হয়ে তাদের বেসরকারি হাসপাতালে যেতে হয়।
বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিন একটি আইসিইউ বেডে চিকিৎসার খরচ দাঁড়ায় ৩০-৩৫ হাজার টাকা। দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিলে খরচ গড়ে কয়েক লাখ টাকা পর্যন্ত পৌঁছায়। বাংলাদেশের গড় আয়ের মানুষদের পক্ষে এটি বহন করা একেবারেই অসম্ভব। অনেক পরিবার শেষ সম্বল বিক্রি করে চিকিৎসা করাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। তবু রোগীকে বাঁচানো যায় না।
এই বৈষম্য একদিকে যেমন অর্থনৈতিক বৈপরীত্য তুলে ধরে, তেমনি রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যনীতি কতটা ব্যর্থ হয়েছে, তাও স্পষ্ট করে।
করোনাভাইরাস মহামারি যখন আঘাত হানে, তখন বাংলাদেশে আইসিইউ সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। রোগীরা এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটে বেড়াতেন, অথচ কোথাও আইসিইউ শয্যা খালি থাকত না। অনেক রোগী অ্যাম্বুলেন্সেই মারা যেতেন।
করোনার সময়ে সরকার তড়িঘড়ি করে কিছু জেলা হাসপাতালে আইসিইউ চালু করেছিল। প্রায় ৪০০ জনকে বিশেষ প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মহামারি কমতেই সেই সেবাগুলো টেকসইভাবে চালু রাখা হয়নি। যন্ত্রপাতির রক্ষণাবেক্ষণ হয়নি, অনেক স্থানে দক্ষ জনবলের অভাবে সেগুলো অকেজো হয়ে গেছে। অর্থাৎ, সংকট থেকে শিক্ষা নেওয়ার পরিবর্তে আমরা আবার আগের অবস্থাতেই ফিরে গেছি।
স্বাস্থ্য খাত নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বড় বড় কথা বলেন। নতুন হাসপাতাল, নতুন ভবন নির্মাণ হয়; কিন্তু আসল সেবার জায়গায় গাফিলতি থেকে যায়। চিকিৎসক নিয়োগ যথেষ্ট হয় না, নার্সের অভাব দীর্ঘস্থায়ী, যন্ত্রপাতি কিনলেও তা রক্ষণাবেক্ষণ হয় না।
আইসিইউ হলো উচ্চমানের চিকিৎসার একটি অংশ। এটি কেবল শয্যা বসানো নয়; বরং এখানে প্রয়োজন দক্ষ ডাক্তার, বিশেষ প্রশিক্ষিত নার্স, পর্যাপ্ত ভেন্টিলেটর, মনিটর, ওষুধ এবং বিদ্যুৎব্যবস্থা। এসব না থাকলে আইসিইউ নামমাত্র হয়ে দাঁড়ায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, একটি দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা শক্তিশালী হতে হলে প্রতি লাখ মানুষের জন্য অন্তত ৫টি আইসিইউ শয্যা থাকা উচিত। সে হিসাবে বাংলাদেশে দরকার ছিল অন্তত ৮,৫০০ আইসিইউ শয্যা। অথচ আমাদের আছে কেবল দুই হাজার।
তুলনামূলকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশও আমাদের চেয়ে এগিয়ে। শ্রীলঙ্কার মতো ছোট দেশেও আইসিইউ সেবার মান ও বিস্তার বাংলাদেশের চেয়ে উন্নত।
মোহাম্মদপুরের গৃহিণী শিরিন আক্তার তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন: “আমার স্বামী হঠাৎ স্ট্রোকে আক্রান্ত হলেন। ঢামেক হাসপাতালে আনি, কিন্তু সেখানে কোনো আইসিইউ ফাঁকা ছিল না। বেসরকারি হাসপাতালে গেলাম, খরচ শুনে চোখে অন্ধকার দেখলাম। শেষ পর্যন্ত বাড়ি ফিরিয়ে আনতে হলো। তিনদিন পর উনি মারা গেলেন।”
এমন গল্প অসংখ্য। যারা হারিয়েছেন স্বজনকে, তাদের কষ্ট ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। কিন্তু প্রতিটি মৃত্যু আমাদের স্বাস্থ্যখাতের ব্যর্থতার নির্মম দলিল।
সমাধান কী হতে পারে? প্রতিটি জেলায় আইসিইউ চালু করা: শুধু চালু নয়, সেগুলো সচল রাখার জন্য পর্যাপ্ত বাজেট ও জনবল নিশ্চিত করতে হবে।
জনবল প্রশিক্ষণ ও নিয়োগ: আইসিইউ পরিচালনায় বিশেষ দক্ষতার চিকিৎসক ও নার্স দরকার। দেশে সেই প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।
সরঞ্জাম রক্ষণাবেক্ষণ: শুধু ভেন্টিলেটর কিনলেই হবে না, সেগুলোর নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে।
খরচ সাশ্রয়ী করা: সরকারি হাসপাতালের সেবা বৃদ্ধি করে বেসরকারি পর্যায়ের অস্বাভাবিক খরচ কমাতে হবে।
জরুরি স্বাস্থ্যবীমা ব্যবস্থা: সাধারণ মানুষের জন্য স্বাস্থ্যবীমা চালু করা জরুরি। এতে হঠাৎ আইসিইউ খরচ বহন সহজ হবে।
৬. কোভিড থেকে শিক্ষা নেওয়া: মহামারির সময়ে তৈরি করা অবকাঠামো স্থায়ীভাবে রক্ষা ও ব্যবহার করতে হবে।
মানুষের জীবনের চেয়ে মূল্যবান কিছু নেই। উন্নয়নের সুফল যদি মানুষের মৌলিক স্বাস্থ্যসেবায় না পৌঁছায়, তবে সেই উন্নয়ন কাগুজে থেকে যায়। আইসিইউর সংকট শুধু চিকিৎসা অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতা নয়, বরং এটি রাষ্ট্রের দায়িত্বহীনতার প্রতীক।
এখনও সময় আছেÑনীতিনির্ধারকেরা যদি আন্তরিক হন, তবে প্রতিটি জেলায় মানসম্পন্ন আইসিইউ সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব। মানুষের জীবন বাঁচানোই উন্নয়নের আসল সূচক। তাই স্বাস্থ্যখাতে অগ্রাধিকার দিয়ে এই সংকট নিরসন এখন সময়ের দাবি।
[লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]