এম মনির উদ্দিন
কৃষি উন্নয়নশীল বাংলাদেশের মূল চালিকাশক্তি। কৃষি প্রধান এই দেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশÑঅর্থাৎ প্রায় ১২ কোটি মানুষÑপ্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে জড়িত। বিশ্ব জনসংখ্যার বিচারে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম এবং এশিয়ায় পঞ্চম। তাই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও টেকসই প্রবৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় কৃষির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের মোট দেশীয় উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ১৬ শতাংশ আসে কৃষি খাত থেকে এবং শ্রমশক্তির প্রায় ৪৭ শতাংশ এ খাতের ওপর নির্ভরশীল।
বাংলাদেশে জনসংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে, কিন্তু আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ দিন দিন কমছে। এই পরিস্থিতিতে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কৃষিতে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক। কৃষিতে সরকারের বাজেটের বড় একটি অংশ ব্যয় হয় ভর্তুকি খাতে এবং এই ভর্তুকির প্রায় ৭৫ শতাংশেরও বেশি ব্যয় হয় রাসায়নিক সারের পেছনে।
রাসায়নিক সারের আধিক্য ও তার প্রভাব
ফসলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও জীবনচক্রের জন্য ১৭ ধরনের পুষ্টি উপাদান প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে বিগত কয়েক দশক ধরে জমিতে মূলত তিন ধরনের রাসায়নিক সারÑনাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়ামÑপ্রয়োগ হয়ে আসছে। দেশে রাসায়নিক সারের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৭০ লাখ টন। এর মধ্যে ইউরিয়ার পরিমাণ প্রায় ৩৫ লাখ টন এবং বাকি ৩৫ লাখ টন হলো ফসফেট, টিএসপি, এমওপি ইত্যাদি। ভর্তুকির কারণে বর্তমানে দেশের প্রায় ৯৮ শতাংশ জমিতে নিয়মিতভাবে এই রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয়।
কৃষকরা রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করে স্বল্পমেয়াদে ফলন বৃদ্ধি পেলেও দীর্ঘমেয়াদে মাটির জৈব পদার্থ দ্রুত কমে যাচ্ছে। এর ফলে মাটির উর্বরতা ও উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে, ফসলের গুণগত মান কমছে এবং উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
এছাড়া, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘনঘন সংঘটন এবং ফসলের ফলন হ্রাসের কারণে ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তা মারাত্মক হুমকির মুখে পড়তে পারে। তাই কৃষিজমির হারানো স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনতে এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটাতে জৈব সারের ব্যবহার এখন অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মাটির জৈব পদার্থের অবস্থা
আদর্শ উর্বর জমিতে মাটির জৈব পদার্থের পরিমাণ হওয়া উচিত অন্তত ৫ শতাংশ। অথচ বর্তমানে বাংলাদেশের বেশিরভাগ আবাদি জমিতে এ হার কমে দাঁড়িয়েছে ২ শতাংশে, কোথাও কোথাও তা ১ শতাংশেরও নিচে নেমে গেছে। অথচ রাসায়নিক সার সঠিকভাবে কাজ করার জন্য মাটিতে অন্তত ৩ শতাংশ জৈব পদার্থ থাকা জরুরি।
রাসায়নিক সারের একক আধিক্যের কারণে মাটির উপকারী অনুজীবও দ্রুত কমে যাচ্ছে। এর ফলে মাটির ভেতরে জটিল পুষ্টিচক্র ভেঙে পড়ছে এবং উদ্ভিদ প্রাকৃতিকভাবে প্রয়োজনীয় পুষ্টি আহরণ করতে পারছে না। অনেক ক্ষেত্রে বেশি পরিমাণ সার প্রয়োগ করেও কাক্সিক্ষত ফল পাওয়া যাচ্ছে না।
টেকসই কৃষি ও জৈব সারের গুরুত্ব
টেকসই কৃষির জন্য প্রয়োজন উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করা। শুধুমাত্র রাসায়নিক সার নয়, বরং জৈব সার এবং সবুজ সারকেও সমান গুরুত্ব দিয়ে ব্যবহার করতে হবে।
১৯৭০-এর দশকের আগে বাংলাদেশে শস্যের বহুমুখীকরণ ছিল প্রচলিত। বিভিন্ন ফসল চাষের মাধ্যমে এবং গোবর, আবর্জনা ইত্যাদি জৈব সার ব্যবহারের কারণে মাটিতে প্রাকৃতিকভাবে জৈব পদার্থ যোগ হতো। এতে মাটির স্বাস্থ্য বজায় থাকত। কিন্তু এখন জমির ওপর বাড়তি চাপ এবং নিবিড় চাষাবাদের কারণে কৃষকরা রাসায়নিক সারের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন।
ফলে একদিকে যেমন জমির উৎপাদনশীলতা কমছে, অন্যদিকে মানুষও অণুপুষ্টির ঘাটতিতে ভুগছে। মাটিতে জৈব পদার্থ ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের ঘাটতির কারণে উৎপাদিত ফসলে মানবদেহের জন্য প্রয়োজনীয় অণুপুষ্টির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এর ফলস্বরূপ মানুষের মধ্যে অপুষ্টি বাড়ছে।
সবুজ সার: একটি টেকসই বিকল্প
সবুজ সার হলো শিম জাতীয় বা নাইট্রোজেন সংযুক্তকারী উদ্ভিদ, যা মাটিতে মিশিয়ে দিলে জৈব পদার্থ বৃদ্ধি করে এবং নাইট্রোজেন সরবরাহ করে। এসব উদ্ভিদের মূল ও কা-ের নোডিউলে থাকা ব্যাকটেরিয়া বায়ুম-লীয় নাইট্রোজেন স্থায়ী করে মাটিকে উর্বর করে তোলে।
বাংলাদেশে ধানভিত্তিক ফসল পদ্ধতিতে ধৈঞ্চা অন্যতম প্রধান সবুজ সার ফসল। স্থানীয় ধৈঞ্চা ও আফ্রিকান ধৈঞ্চা দুই প্রজাতিই ব্যাপকভাবে ব্যবহার হয়।
ধৈঞ্চার প্রজাতি ও বৈশিষ্ট্য
১. দেশি ধৈঞ্চা
এটি স্থানীয় প্রজাতি, সবুজ সার হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত হচ্ছে। দ্রুত বৃদ্ধি পায়, রসালো প্রকৃতির এবং লবণাক্ত বা জলাবদ্ধ জমিতেও ভালো জন্মে। খরা ও চরাঞ্চলেও এটি চাষ করা সম্ভব।
২. আফ্রিকান ধৈঞ্চা
১৯৮৬ সালে বাংলাদেশে প্রবর্তিত। অত্যন্ত দ্রুত বর্ধনশীল, রসালো ও শক্তিশালী উদ্ভিদ। প্রতি হেক্টরে প্রায় ৪৩৫ কেজি ইউরিয়ার সমপরিমাণ নাইট্রোজেন যোগ করতে সক্ষম। এর নাইট্রোজেনের পরিমাণ দেশি ধৈঞ্চার দ্বিগুণেরও বেশি (১.২% বনাম ০.৬২%)।
তবে এর বীজ উৎপাদনে সময় বেশি লাগেÑ৭–৮ মাস। তাই কৃষকরা মাঠে সহজে বীজ উৎপাদন করতে চান না। যদিও আমনের জমিতে পার্সিং করলে এই গাছে প্রচুর পাখি বসে পোকামাকড় দমন করে এবং মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন সম্ভব হয়।
সবুজ সারের সুফল
১. নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ করা
ধৈঞ্চার মূল নোডিউলের ব্যাকটেরিয়া বায়ুম-লীয় নাইট্রোজেন স্থায়ী করে মাটিতে যোগ করে। এতে রাসায়নিক নাইট্রোজেন সারের ব্যবহার অন্তত ২৫% কমানো যায়।
২. মাটির স্বাস্থ্য উন্নত করা
সবুজ সারের জৈব বস্তুর পচন মাটির গঠন ও পানি ধারণক্ষমতা বাড়ায়। মাটিতে পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল নিশ্চিত হয় এবং উপকারী অনুজীবের কার্যকলাপ বাড়ে।
৩. ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি
মাটির উর্বরতা বৃদ্ধির কারণে ধানসহ অন্যান্য ফসলের উৎপাদন বেড়ে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, রোপা আমন ধানের আগে ধৈঞ্চা চাষ করলে ফলন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়।
৪. ক্ষয়প্রাপ্ত জমি পুনরুদ্ধার
ধৈঞ্চা খরাপ্রবণ, লবণাক্ত ও চরের জমিতে মাটি ক্ষয় রোধ করে। দ্রুত ও ঘন বৃদ্ধির কারণে আগাছা জন্মাতে পারে না, ফলে আগাছানাশকের প্রয়োজন পড়ে না।
ফসল চক্রে সবুজ সারের ব্যবহার
সাধারণত ধান–ভিত্তিক ফসল চক্রে ব্যবহার করা হয়। বোরো ধান কাটার পর রোপা আমন লাগানোর আগে ৫০-৯০ দিন জমি পতিত থাকে। এ সময় ধৈঞ্চা চাষ করে ৪০-৬০ দিনের গাছ মাটিতে মিশিয়ে দিলে প্রচুর জৈব পদার্থ জমে এবং পরবর্তী ফসল উপকৃত হয়।
সবুজ সারের মাধ্যমে অপুষ্টি নিরসন
সবুজ সারের ব্যবহার শুধু মাটির জন্যই নয়, মানুষের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এতে মাটিতে বিভিন্ন মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট যুক্ত হয়, যা ফসলের মধ্যে স্থানান্তরিত হয়ে খাদ্যশস্যকে পুষ্টিসমৃদ্ধ করে তোলে। ফলস্বরূপ মানুষের দৈহিক পুষ্টিমান উন্নত হয় এবং অপুষ্টি রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশের কৃষি বর্তমানে একটি সংকটময় সময় অতিক্রম করছে। একদিকে জনসংখ্যার চাপ, অন্যদিকে আবাদি জমির হ্রাস। রাসায়নিক সারের অতিরিক্ত ব্যবহার সাময়িকভাবে ফলন বাড়ালেও দীর্ঘমেয়াদে মাটির উর্বরতা কমিয়ে দিচ্ছে এবং মানুষের অপুষ্টির সমস্যা বাড়াচ্ছে।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সবুজ সার একটি কার্যকর, পরিবেশবান্ধব ও টেকসই সমাধান। ধান–ভিত্তিক ফসল চক্রে ধৈঞ্চা চাষ সম্প্রসারণ করে জমিতে জৈব পদার্থ ও নাইট্রোজেনের ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব। এতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমবে, জমির স্বাস্থ্য ফিরবে এবং মানুষের পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।
অতএব, কৃষি উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে এবং অপুষ্টি ও মাটির অবক্ষয় রোধে সবুজ সার ব্যবহারের বিকল্প নেই। সরকার, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগকে একযোগে কাজ করে এর প্রসার ঘটাতে হবে।
[লেখক: প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর, গেইন বাংলাদেশ]
এম মনির উদ্দিন
সোমবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫
কৃষি উন্নয়নশীল বাংলাদেশের মূল চালিকাশক্তি। কৃষি প্রধান এই দেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশÑঅর্থাৎ প্রায় ১২ কোটি মানুষÑপ্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে জড়িত। বিশ্ব জনসংখ্যার বিচারে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম এবং এশিয়ায় পঞ্চম। তাই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও টেকসই প্রবৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় কৃষির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের মোট দেশীয় উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ১৬ শতাংশ আসে কৃষি খাত থেকে এবং শ্রমশক্তির প্রায় ৪৭ শতাংশ এ খাতের ওপর নির্ভরশীল।
বাংলাদেশে জনসংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে, কিন্তু আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ দিন দিন কমছে। এই পরিস্থিতিতে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কৃষিতে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক। কৃষিতে সরকারের বাজেটের বড় একটি অংশ ব্যয় হয় ভর্তুকি খাতে এবং এই ভর্তুকির প্রায় ৭৫ শতাংশেরও বেশি ব্যয় হয় রাসায়নিক সারের পেছনে।
রাসায়নিক সারের আধিক্য ও তার প্রভাব
ফসলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও জীবনচক্রের জন্য ১৭ ধরনের পুষ্টি উপাদান প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে বিগত কয়েক দশক ধরে জমিতে মূলত তিন ধরনের রাসায়নিক সারÑনাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়ামÑপ্রয়োগ হয়ে আসছে। দেশে রাসায়নিক সারের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৭০ লাখ টন। এর মধ্যে ইউরিয়ার পরিমাণ প্রায় ৩৫ লাখ টন এবং বাকি ৩৫ লাখ টন হলো ফসফেট, টিএসপি, এমওপি ইত্যাদি। ভর্তুকির কারণে বর্তমানে দেশের প্রায় ৯৮ শতাংশ জমিতে নিয়মিতভাবে এই রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয়।
কৃষকরা রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করে স্বল্পমেয়াদে ফলন বৃদ্ধি পেলেও দীর্ঘমেয়াদে মাটির জৈব পদার্থ দ্রুত কমে যাচ্ছে। এর ফলে মাটির উর্বরতা ও উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে, ফসলের গুণগত মান কমছে এবং উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
এছাড়া, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘনঘন সংঘটন এবং ফসলের ফলন হ্রাসের কারণে ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তা মারাত্মক হুমকির মুখে পড়তে পারে। তাই কৃষিজমির হারানো স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনতে এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটাতে জৈব সারের ব্যবহার এখন অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মাটির জৈব পদার্থের অবস্থা
আদর্শ উর্বর জমিতে মাটির জৈব পদার্থের পরিমাণ হওয়া উচিত অন্তত ৫ শতাংশ। অথচ বর্তমানে বাংলাদেশের বেশিরভাগ আবাদি জমিতে এ হার কমে দাঁড়িয়েছে ২ শতাংশে, কোথাও কোথাও তা ১ শতাংশেরও নিচে নেমে গেছে। অথচ রাসায়নিক সার সঠিকভাবে কাজ করার জন্য মাটিতে অন্তত ৩ শতাংশ জৈব পদার্থ থাকা জরুরি।
রাসায়নিক সারের একক আধিক্যের কারণে মাটির উপকারী অনুজীবও দ্রুত কমে যাচ্ছে। এর ফলে মাটির ভেতরে জটিল পুষ্টিচক্র ভেঙে পড়ছে এবং উদ্ভিদ প্রাকৃতিকভাবে প্রয়োজনীয় পুষ্টি আহরণ করতে পারছে না। অনেক ক্ষেত্রে বেশি পরিমাণ সার প্রয়োগ করেও কাক্সিক্ষত ফল পাওয়া যাচ্ছে না।
টেকসই কৃষি ও জৈব সারের গুরুত্ব
টেকসই কৃষির জন্য প্রয়োজন উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করা। শুধুমাত্র রাসায়নিক সার নয়, বরং জৈব সার এবং সবুজ সারকেও সমান গুরুত্ব দিয়ে ব্যবহার করতে হবে।
১৯৭০-এর দশকের আগে বাংলাদেশে শস্যের বহুমুখীকরণ ছিল প্রচলিত। বিভিন্ন ফসল চাষের মাধ্যমে এবং গোবর, আবর্জনা ইত্যাদি জৈব সার ব্যবহারের কারণে মাটিতে প্রাকৃতিকভাবে জৈব পদার্থ যোগ হতো। এতে মাটির স্বাস্থ্য বজায় থাকত। কিন্তু এখন জমির ওপর বাড়তি চাপ এবং নিবিড় চাষাবাদের কারণে কৃষকরা রাসায়নিক সারের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন।
ফলে একদিকে যেমন জমির উৎপাদনশীলতা কমছে, অন্যদিকে মানুষও অণুপুষ্টির ঘাটতিতে ভুগছে। মাটিতে জৈব পদার্থ ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের ঘাটতির কারণে উৎপাদিত ফসলে মানবদেহের জন্য প্রয়োজনীয় অণুপুষ্টির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এর ফলস্বরূপ মানুষের মধ্যে অপুষ্টি বাড়ছে।
সবুজ সার: একটি টেকসই বিকল্প
সবুজ সার হলো শিম জাতীয় বা নাইট্রোজেন সংযুক্তকারী উদ্ভিদ, যা মাটিতে মিশিয়ে দিলে জৈব পদার্থ বৃদ্ধি করে এবং নাইট্রোজেন সরবরাহ করে। এসব উদ্ভিদের মূল ও কা-ের নোডিউলে থাকা ব্যাকটেরিয়া বায়ুম-লীয় নাইট্রোজেন স্থায়ী করে মাটিকে উর্বর করে তোলে।
বাংলাদেশে ধানভিত্তিক ফসল পদ্ধতিতে ধৈঞ্চা অন্যতম প্রধান সবুজ সার ফসল। স্থানীয় ধৈঞ্চা ও আফ্রিকান ধৈঞ্চা দুই প্রজাতিই ব্যাপকভাবে ব্যবহার হয়।
ধৈঞ্চার প্রজাতি ও বৈশিষ্ট্য
১. দেশি ধৈঞ্চা
এটি স্থানীয় প্রজাতি, সবুজ সার হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত হচ্ছে। দ্রুত বৃদ্ধি পায়, রসালো প্রকৃতির এবং লবণাক্ত বা জলাবদ্ধ জমিতেও ভালো জন্মে। খরা ও চরাঞ্চলেও এটি চাষ করা সম্ভব।
২. আফ্রিকান ধৈঞ্চা
১৯৮৬ সালে বাংলাদেশে প্রবর্তিত। অত্যন্ত দ্রুত বর্ধনশীল, রসালো ও শক্তিশালী উদ্ভিদ। প্রতি হেক্টরে প্রায় ৪৩৫ কেজি ইউরিয়ার সমপরিমাণ নাইট্রোজেন যোগ করতে সক্ষম। এর নাইট্রোজেনের পরিমাণ দেশি ধৈঞ্চার দ্বিগুণেরও বেশি (১.২% বনাম ০.৬২%)।
তবে এর বীজ উৎপাদনে সময় বেশি লাগেÑ৭–৮ মাস। তাই কৃষকরা মাঠে সহজে বীজ উৎপাদন করতে চান না। যদিও আমনের জমিতে পার্সিং করলে এই গাছে প্রচুর পাখি বসে পোকামাকড় দমন করে এবং মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন সম্ভব হয়।
সবুজ সারের সুফল
১. নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ করা
ধৈঞ্চার মূল নোডিউলের ব্যাকটেরিয়া বায়ুম-লীয় নাইট্রোজেন স্থায়ী করে মাটিতে যোগ করে। এতে রাসায়নিক নাইট্রোজেন সারের ব্যবহার অন্তত ২৫% কমানো যায়।
২. মাটির স্বাস্থ্য উন্নত করা
সবুজ সারের জৈব বস্তুর পচন মাটির গঠন ও পানি ধারণক্ষমতা বাড়ায়। মাটিতে পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল নিশ্চিত হয় এবং উপকারী অনুজীবের কার্যকলাপ বাড়ে।
৩. ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি
মাটির উর্বরতা বৃদ্ধির কারণে ধানসহ অন্যান্য ফসলের উৎপাদন বেড়ে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, রোপা আমন ধানের আগে ধৈঞ্চা চাষ করলে ফলন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়।
৪. ক্ষয়প্রাপ্ত জমি পুনরুদ্ধার
ধৈঞ্চা খরাপ্রবণ, লবণাক্ত ও চরের জমিতে মাটি ক্ষয় রোধ করে। দ্রুত ও ঘন বৃদ্ধির কারণে আগাছা জন্মাতে পারে না, ফলে আগাছানাশকের প্রয়োজন পড়ে না।
ফসল চক্রে সবুজ সারের ব্যবহার
সাধারণত ধান–ভিত্তিক ফসল চক্রে ব্যবহার করা হয়। বোরো ধান কাটার পর রোপা আমন লাগানোর আগে ৫০-৯০ দিন জমি পতিত থাকে। এ সময় ধৈঞ্চা চাষ করে ৪০-৬০ দিনের গাছ মাটিতে মিশিয়ে দিলে প্রচুর জৈব পদার্থ জমে এবং পরবর্তী ফসল উপকৃত হয়।
সবুজ সারের মাধ্যমে অপুষ্টি নিরসন
সবুজ সারের ব্যবহার শুধু মাটির জন্যই নয়, মানুষের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এতে মাটিতে বিভিন্ন মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট যুক্ত হয়, যা ফসলের মধ্যে স্থানান্তরিত হয়ে খাদ্যশস্যকে পুষ্টিসমৃদ্ধ করে তোলে। ফলস্বরূপ মানুষের দৈহিক পুষ্টিমান উন্নত হয় এবং অপুষ্টি রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশের কৃষি বর্তমানে একটি সংকটময় সময় অতিক্রম করছে। একদিকে জনসংখ্যার চাপ, অন্যদিকে আবাদি জমির হ্রাস। রাসায়নিক সারের অতিরিক্ত ব্যবহার সাময়িকভাবে ফলন বাড়ালেও দীর্ঘমেয়াদে মাটির উর্বরতা কমিয়ে দিচ্ছে এবং মানুষের অপুষ্টির সমস্যা বাড়াচ্ছে।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সবুজ সার একটি কার্যকর, পরিবেশবান্ধব ও টেকসই সমাধান। ধান–ভিত্তিক ফসল চক্রে ধৈঞ্চা চাষ সম্প্রসারণ করে জমিতে জৈব পদার্থ ও নাইট্রোজেনের ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব। এতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমবে, জমির স্বাস্থ্য ফিরবে এবং মানুষের পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।
অতএব, কৃষি উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে এবং অপুষ্টি ও মাটির অবক্ষয় রোধে সবুজ সার ব্যবহারের বিকল্প নেই। সরকার, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগকে একযোগে কাজ করে এর প্রসার ঘটাতে হবে।
[লেখক: প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর, গেইন বাংলাদেশ]