মুহম্মদ গোলাম রাব্বি
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির গল্প বলার সময় আমরা প্রায়শই সংখ্যার জাদুতে এতটাই মুগ্ধ হয়ে যাই যে ভুলে যাই সেই সংখ্যার পেছনের মানুষের গল্প। আমরা ভুলে যাই সংখ্যার বাস্তবতার গল্প এবং এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। পরিসংখ্যান যেমন সত্য, তেমনি সত্য হলো এই পরিসংখ্যান তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়া এবং তার সীমাবদ্ধতা। তাই অর্থনৈতিক অগ্রগতির পূর্ণাঙ্গ চিত্র পেতে হলে শুধু সংখ্যায় বিশ্বাস না রেখে এর পেছনের গল্পগুলোকেও গুরুত্ব দিতে হবে।
গত মাসে একটি সংস্থার প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশীয় উদ্যোক্তাদের মধ্যে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা ৬০ শতাংশ। বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি শিক্ষা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতেও নারীদের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। এই পরিসংখ্যান দেখে মনে হবে দেশে নারীর ক্ষমতায়ন অভূতপূর্ব হারে বেড়েছে। কিন্তু একই সময়ে ঢাকার একটি পোশাক কারখানার নারী শ্রমিক সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করেও ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এবং ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছেন। মাইক্রোক্রেডিট প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য অনুযায়ী, তাদের ৯৫ শতাংশ ঋণ গ্রহীতা নারী। এই দুই বাস্তবতার মধ্যে একটি পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। এই পার্থক্য দেখে মনে প্রশ্ন আসে, কোনটি আসল সত্য? একদিকে যখন নারীর ক্ষমতায়নের জয়গান গাওয়া হয়, অন্যদিকে তখন একজন নারী শ্রমিককে নুন আনতে পান্তা ফুরায় এমন অবস্থায় দিন কাটাতে হয় ।
গত দশকে বাংলাদেশে ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা প্রায় তিনগুণ বেড়েছে, যা ১৬ কোটিরও বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, আমানত হিসাবের সংখ্যা ব্যাংক ঋণ হিসাবের চেয়ে পাঁচ গুণ বেড়েছে। একই সময়ে, মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ আট বছরে প্রায় ১৩৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের মোট আমানতের ৪২ শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করে মাত্র ০.১ শতাংশ হিসাবধারী। এ থেকে বোঝা যায়, অর্থনৈতিক বৈষম্য কতটা প্রকট। এছাড়াও, মোট ব্যাংক হিসাবের ৪০ শতাংশেরও বেশি নিষ্ক্রিয়, যেখানে অনেক হিসাবে ১০০ টাকাও নেই। এসব হিসাবের অধিকাংশই সরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের জন্য খোলা হয়েছিল। এ কারণে ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা বাড়লেও আর্থিক অন্তর্ভুক্তির প্রকৃত সূচক হিসেবে এগুলো কতটা কার্যকর, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।
একইভাবে, বাংলাদেশের প্রায় ৮০ শতাংশ শ্রমশক্তি সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও এসএমই খাতের সঙ্গে যুক্ত। এই সংখ্যা দেখে মনে হতে পারে দেশে উদ্যোক্তা উন্নয়ন বেশ ভালো অবস্থায়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই এসএমইগুলোর বেশিরভাগই অতি ক্ষুদ্র, একক মালিকানাধীন ব্যবসা। তাদের মধ্যে কতজন প্রকৃত অর্থে আধুনিক ব্যবসায়িক পদ্ধতি মেনে চলেন, নিয়মিত কর বা ভ্যাট দেন, তা একটি ভিন্ন আলোচনার বিষয়।
কৃষিক্ষেত্রেও এমন বিভ্রান্তিকর চিত্র দেখা যায়। সরকারি হিসাবে বাংলাদেশ এখন চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। গত মৌসুমে ফলনও ভালো হয়েছে। কিন্তু প্রতি বছরই আমদানি করতে হচ্ছে লাখ টন চাল। সরকারি তথ্যসূত্রে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে ১৩ লাখ মেট্রিক টনের মতো চাল আমদানি হয়েছে। কিন্তু এতে চালের দাম কমেনি, বরং বাড়ছে। এর কারণ হলো, আমাদের উৎপাদন পরিসংখ্যান অনেক সময় লক্ষ্যনির্ভর, বাস্তবতানির্ভর নয়। ফসলের উৎপাদনশীলতা হিসাব করার সময় আবহাওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কীটনাশকের কার্যকারিতা এসব বিষয়ে যে অনিশ্চয়তা রয়েছে, সেগুলো অনেক সময় বিবেচনায় আসে না।
আমাদের রেমিট্যান্স আয়ের চিত্রও এমনই জটিল। আনুষ্ঠানিক চ্যানেল দিয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছে ৩০ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু হুন্ডির মাধ্যমে কত টাকা আসে, তার সঠিক হিসাব নেই। কিছু গবেষণা বলছে, অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে আসা টাকার পরিমাণ আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের অর্ধেকের বেশি। কিন্তু এই টাকা আমাদের অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানে ধরা পড়ে না। যার ফলে দেশের প্রকৃত বৈদেশিক মুদ্রার আয় আড়ালে থেকে যায়, যা দেশের অর্থনৈতিক দুর্বলতার একটি হতাশার দিক।
দেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী খাত হিসেবে রিয়েল এস্টেটের কথা বলা হয়। প্রতি বছর জমির দাম প্রায় ১২-১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। বর্তমানে এই খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ১০ লাখ কোটি টাকারও বেশি ছাড়িয়েছে। তবে এই বিনিয়োগের সব অংশই উৎপাদনশীল অর্থনৈতিক কর্মকা- থেকে এসেছে এমনটি বলা যাবে না। অনেক বিনিয়োগ ব্যক্তিগত বা অপ্রকাশিত সঞ্চয় থেকে এসেছে, যা সরাসরি দেশের উৎপাদনশীল খাতের সাথে সম্পর্কিত নয়। ফলে এই খাতের উন্নতি দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যের পরিচায়ক এটি বলার সুযোগ নেই।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আঞ্চলিক বৈষম্য। জাতীয় পর্যায়ে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেলেও, এর সুফল সব অঞ্চলে সমানভাবে পৌঁছায়নি। উদাহরণস্বরূপ, অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী ঢাকা বিভাগের তুলনায় উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে মাথাপিছু আয় প্রায় ৬০ শতাংশ কম। এই বিশাল পার্থক্য প্রমাণ করে যে, দেশের সব অঞ্চলের মানুষ সমান অর্থনৈতিক সুবিধা পাচ্ছে না।
আঞ্চলিক বৈষম্যের আরেকটি স্পষ্ট উদাহরণ হলো শ্রমিকের মজুরি। সিলেটের চা বাগানগুলোতে কর্মরত শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি মাত্র ১৭০ টাকা। এটি জাতীয় ন্যূনতম মজুরির অর্ধেকেরও কম। এই অপ্রতুল মজুরি তাদের জীবনযাত্রার মানকে নিম্ন স্তরে আটকে রেখেছে। যেখানে শহরাঞ্চলের শ্রমিকরা তুলনামূলকভাবে বেশি মজুরি পেলেও প্রান্তিক অঞ্চলের শ্রমিকরা অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকছে। এই বৈষম্য জাতীয় গড় সূচকে প্রতিফলিত হয় না, যা দেশের প্রকৃত অর্থনৈতিক চিত্রকে অস্পষ্ট করে তোলে।
দুর্নীতির অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়েও আমাদের কোনো নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান নেই। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দুর্নীতির কারণে জিডিপির ২-৫ শতাংশ ক্ষতি হয়। বাংলাদেশে এর প্রকৃত হার অজানা এবং এটি অর্থনৈতিক পরিকল্পনার সময়ও বিবেচনা করা হয় না। এর ফলে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রকৃত চিত্র অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
এই সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। পরিসংখ্যান সংগ্রহের পদ্ধতি আরো নিখুঁত করতে হবে। বিবিএসের জনবল ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়াতে হবে। তৃতীয় পক্ষের যাচাইকরণ ব্যবস্থা চালু করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে সহযোগিতার মাধ্যমে পরিসংখ্যানের নির্ভুলতা নিশ্চিত করতে হবে। অঞ্চলভিত্তিক ও শ্রেণিভিত্তিক পরিসংখ্যান আলাদাভাবে প্রকাশ করতে হবে।
শুধু জাতীয় গড় নয়, বরং বিভিন্ন অঞ্চল ও জনগোষ্ঠীর আলাদা অবস্থা তুলে ধরতে হবে। অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির হিসাব রাখার জন্য আধুনিক পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। সামাজিক সূচকের পাশাপাশি পরিবেশগত সূচকও নিয়মিত প্রকাশ করতে হবে। গ্রিন জিডিপি, কার্বন ফুটপ্রিন্ট, পরিবেশ দূষণের আর্থিক ক্ষতি এসব হিসাব রাখতে হবে। নীতিনির্ধারণে জনঅংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বিভিন্ন অংশীজনের মতামত নিতে হবে।
উন্নয়নের পরিমাপক শুধু অর্থনৈতিক সূচক হতে পারে না। মানুষের সুখ, সন্তুষ্টি, নিরাপত্তাবোধ, সামাজিক সংহতি এসব বিষয়কেও গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্য অনস্বীকার্য। কিন্তু সেই সাফল্যের পূর্ণ চিত্র তুলে ধরতে হলে পরিসংখ্যানের পাশাপাশি বাস্তবতাকেও গুরুত্ব দিতে হবে। সংখ্যার খেলায় হারিয়ে গেলে চলবে না, মানুষের প্রকৃত কল্যাণই হতে হবে উন্নয়নের মূল লক্ষ্য। তবেই আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা হবে অর্থবহ ও টেকসই।
[লেখক: শিক্ষার্থী, পরিসংখ্যান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়]
মুহম্মদ গোলাম রাব্বি
বুধবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির গল্প বলার সময় আমরা প্রায়শই সংখ্যার জাদুতে এতটাই মুগ্ধ হয়ে যাই যে ভুলে যাই সেই সংখ্যার পেছনের মানুষের গল্প। আমরা ভুলে যাই সংখ্যার বাস্তবতার গল্প এবং এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। পরিসংখ্যান যেমন সত্য, তেমনি সত্য হলো এই পরিসংখ্যান তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়া এবং তার সীমাবদ্ধতা। তাই অর্থনৈতিক অগ্রগতির পূর্ণাঙ্গ চিত্র পেতে হলে শুধু সংখ্যায় বিশ্বাস না রেখে এর পেছনের গল্পগুলোকেও গুরুত্ব দিতে হবে।
গত মাসে একটি সংস্থার প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশীয় উদ্যোক্তাদের মধ্যে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা ৬০ শতাংশ। বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি শিক্ষা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতেও নারীদের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। এই পরিসংখ্যান দেখে মনে হবে দেশে নারীর ক্ষমতায়ন অভূতপূর্ব হারে বেড়েছে। কিন্তু একই সময়ে ঢাকার একটি পোশাক কারখানার নারী শ্রমিক সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করেও ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এবং ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছেন। মাইক্রোক্রেডিট প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য অনুযায়ী, তাদের ৯৫ শতাংশ ঋণ গ্রহীতা নারী। এই দুই বাস্তবতার মধ্যে একটি পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। এই পার্থক্য দেখে মনে প্রশ্ন আসে, কোনটি আসল সত্য? একদিকে যখন নারীর ক্ষমতায়নের জয়গান গাওয়া হয়, অন্যদিকে তখন একজন নারী শ্রমিককে নুন আনতে পান্তা ফুরায় এমন অবস্থায় দিন কাটাতে হয় ।
গত দশকে বাংলাদেশে ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা প্রায় তিনগুণ বেড়েছে, যা ১৬ কোটিরও বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, আমানত হিসাবের সংখ্যা ব্যাংক ঋণ হিসাবের চেয়ে পাঁচ গুণ বেড়েছে। একই সময়ে, মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ আট বছরে প্রায় ১৩৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের মোট আমানতের ৪২ শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করে মাত্র ০.১ শতাংশ হিসাবধারী। এ থেকে বোঝা যায়, অর্থনৈতিক বৈষম্য কতটা প্রকট। এছাড়াও, মোট ব্যাংক হিসাবের ৪০ শতাংশেরও বেশি নিষ্ক্রিয়, যেখানে অনেক হিসাবে ১০০ টাকাও নেই। এসব হিসাবের অধিকাংশই সরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের জন্য খোলা হয়েছিল। এ কারণে ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা বাড়লেও আর্থিক অন্তর্ভুক্তির প্রকৃত সূচক হিসেবে এগুলো কতটা কার্যকর, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।
একইভাবে, বাংলাদেশের প্রায় ৮০ শতাংশ শ্রমশক্তি সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও এসএমই খাতের সঙ্গে যুক্ত। এই সংখ্যা দেখে মনে হতে পারে দেশে উদ্যোক্তা উন্নয়ন বেশ ভালো অবস্থায়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই এসএমইগুলোর বেশিরভাগই অতি ক্ষুদ্র, একক মালিকানাধীন ব্যবসা। তাদের মধ্যে কতজন প্রকৃত অর্থে আধুনিক ব্যবসায়িক পদ্ধতি মেনে চলেন, নিয়মিত কর বা ভ্যাট দেন, তা একটি ভিন্ন আলোচনার বিষয়।
কৃষিক্ষেত্রেও এমন বিভ্রান্তিকর চিত্র দেখা যায়। সরকারি হিসাবে বাংলাদেশ এখন চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। গত মৌসুমে ফলনও ভালো হয়েছে। কিন্তু প্রতি বছরই আমদানি করতে হচ্ছে লাখ টন চাল। সরকারি তথ্যসূত্রে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে ১৩ লাখ মেট্রিক টনের মতো চাল আমদানি হয়েছে। কিন্তু এতে চালের দাম কমেনি, বরং বাড়ছে। এর কারণ হলো, আমাদের উৎপাদন পরিসংখ্যান অনেক সময় লক্ষ্যনির্ভর, বাস্তবতানির্ভর নয়। ফসলের উৎপাদনশীলতা হিসাব করার সময় আবহাওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কীটনাশকের কার্যকারিতা এসব বিষয়ে যে অনিশ্চয়তা রয়েছে, সেগুলো অনেক সময় বিবেচনায় আসে না।
আমাদের রেমিট্যান্স আয়ের চিত্রও এমনই জটিল। আনুষ্ঠানিক চ্যানেল দিয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছে ৩০ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু হুন্ডির মাধ্যমে কত টাকা আসে, তার সঠিক হিসাব নেই। কিছু গবেষণা বলছে, অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে আসা টাকার পরিমাণ আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের অর্ধেকের বেশি। কিন্তু এই টাকা আমাদের অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানে ধরা পড়ে না। যার ফলে দেশের প্রকৃত বৈদেশিক মুদ্রার আয় আড়ালে থেকে যায়, যা দেশের অর্থনৈতিক দুর্বলতার একটি হতাশার দিক।
দেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী খাত হিসেবে রিয়েল এস্টেটের কথা বলা হয়। প্রতি বছর জমির দাম প্রায় ১২-১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। বর্তমানে এই খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ১০ লাখ কোটি টাকারও বেশি ছাড়িয়েছে। তবে এই বিনিয়োগের সব অংশই উৎপাদনশীল অর্থনৈতিক কর্মকা- থেকে এসেছে এমনটি বলা যাবে না। অনেক বিনিয়োগ ব্যক্তিগত বা অপ্রকাশিত সঞ্চয় থেকে এসেছে, যা সরাসরি দেশের উৎপাদনশীল খাতের সাথে সম্পর্কিত নয়। ফলে এই খাতের উন্নতি দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যের পরিচায়ক এটি বলার সুযোগ নেই।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আঞ্চলিক বৈষম্য। জাতীয় পর্যায়ে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেলেও, এর সুফল সব অঞ্চলে সমানভাবে পৌঁছায়নি। উদাহরণস্বরূপ, অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী ঢাকা বিভাগের তুলনায় উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে মাথাপিছু আয় প্রায় ৬০ শতাংশ কম। এই বিশাল পার্থক্য প্রমাণ করে যে, দেশের সব অঞ্চলের মানুষ সমান অর্থনৈতিক সুবিধা পাচ্ছে না।
আঞ্চলিক বৈষম্যের আরেকটি স্পষ্ট উদাহরণ হলো শ্রমিকের মজুরি। সিলেটের চা বাগানগুলোতে কর্মরত শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি মাত্র ১৭০ টাকা। এটি জাতীয় ন্যূনতম মজুরির অর্ধেকেরও কম। এই অপ্রতুল মজুরি তাদের জীবনযাত্রার মানকে নিম্ন স্তরে আটকে রেখেছে। যেখানে শহরাঞ্চলের শ্রমিকরা তুলনামূলকভাবে বেশি মজুরি পেলেও প্রান্তিক অঞ্চলের শ্রমিকরা অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকছে। এই বৈষম্য জাতীয় গড় সূচকে প্রতিফলিত হয় না, যা দেশের প্রকৃত অর্থনৈতিক চিত্রকে অস্পষ্ট করে তোলে।
দুর্নীতির অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়েও আমাদের কোনো নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান নেই। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দুর্নীতির কারণে জিডিপির ২-৫ শতাংশ ক্ষতি হয়। বাংলাদেশে এর প্রকৃত হার অজানা এবং এটি অর্থনৈতিক পরিকল্পনার সময়ও বিবেচনা করা হয় না। এর ফলে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রকৃত চিত্র অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
এই সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। পরিসংখ্যান সংগ্রহের পদ্ধতি আরো নিখুঁত করতে হবে। বিবিএসের জনবল ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়াতে হবে। তৃতীয় পক্ষের যাচাইকরণ ব্যবস্থা চালু করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে সহযোগিতার মাধ্যমে পরিসংখ্যানের নির্ভুলতা নিশ্চিত করতে হবে। অঞ্চলভিত্তিক ও শ্রেণিভিত্তিক পরিসংখ্যান আলাদাভাবে প্রকাশ করতে হবে।
শুধু জাতীয় গড় নয়, বরং বিভিন্ন অঞ্চল ও জনগোষ্ঠীর আলাদা অবস্থা তুলে ধরতে হবে। অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির হিসাব রাখার জন্য আধুনিক পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। সামাজিক সূচকের পাশাপাশি পরিবেশগত সূচকও নিয়মিত প্রকাশ করতে হবে। গ্রিন জিডিপি, কার্বন ফুটপ্রিন্ট, পরিবেশ দূষণের আর্থিক ক্ষতি এসব হিসাব রাখতে হবে। নীতিনির্ধারণে জনঅংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বিভিন্ন অংশীজনের মতামত নিতে হবে।
উন্নয়নের পরিমাপক শুধু অর্থনৈতিক সূচক হতে পারে না। মানুষের সুখ, সন্তুষ্টি, নিরাপত্তাবোধ, সামাজিক সংহতি এসব বিষয়কেও গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্য অনস্বীকার্য। কিন্তু সেই সাফল্যের পূর্ণ চিত্র তুলে ধরতে হলে পরিসংখ্যানের পাশাপাশি বাস্তবতাকেও গুরুত্ব দিতে হবে। সংখ্যার খেলায় হারিয়ে গেলে চলবে না, মানুষের প্রকৃত কল্যাণই হতে হবে উন্নয়নের মূল লক্ষ্য। তবেই আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা হবে অর্থবহ ও টেকসই।
[লেখক: শিক্ষার্থী, পরিসংখ্যান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়]