গাজী তারেক আজিজ
সময়কে বুঝতে হলে যে প্রজন্মকে অনুধাবন করতে হয়, আজ সেই প্রজন্ম হলো জেনারেশন জেড বা জেন জি। তারা ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে জন্ম নেওয়া এক অদ্ভুত মিশ্রণ-ডিজিটাল ডিভাইস হাতে বড় হওয়া, তথ্যপ্রবাহের ঝড়ে গড়ে ওঠা, আবার একই সঙ্গে ভয়, দুশ্চিন্তা, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বৈশ্বিক অনিশ্চয়তায় দগ্ধ হওয়া। তাদের পথচলা যেন এক অস্থির অভিযাত্রা।
জেন জি হলো প্রথম প্রজন্ম যারা জন্মের পর থেকেই স্মার্টফোন, ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া, গুগল, ইউটিউবকে স্বাভাবিক জগৎ হিসেবে পেয়েছে। বুমার প্রজন্ম যেখানে পত্রিকা, রেডিও বা টিভিকে তথ্যের উৎস হিসেবে জানত, জেন জি শিখেছে গুগলে সার্চ করা মানেই সত্য। তাদের পড়াশোনা, বিনোদন, সম্পর্ক গড়ে ওঠা- সবকিছু প্রযুক্তিনির্ভর। এতটাই প্রযুক্তি নির্ভরতা যে, বাবা-মা কিংবা শিক্ষকের চেয়ে প্রযুক্তিতেই বিশ্বাস এবং ভরসা বেশি। কিন্তু এখানেই শুরু হয় দ্বন্দ্ব। প্রযুক্তি যেমন তাদের দ্রুত তথ্যপ্রাপ্তি ও যোগাযোগের সুযোগ দিয়েছে, তেমনি বাড়িয়েছে মনস্তাত্ত্বিক চাপ। সোশ্যাল মিডিয়ার ভার্চুয়াল প্রতিযোগিতা, লাইক-কমেন্টের ওপর নির্ভরতা, অনলাইন বুলিং বা হেট স্পিচ- সবকিছুই তাদের মনে তৈরি করেছে অদৃশ্য অস্থিরতা। তারা ভাবছে লাইক কমেন্টের রিয়েক্টগুলোই তাদের মূল্যায়নে মাত্রা যোগ করে।
বাংলাদেশ বা নেপালের জেন জি প্রজন্মের মূল শক্তি হলো তথ্যপ্রযুক্তি। তারা ইউটিউব, ফেসবুক, টিকটক বা ইনস্টাগ্রামে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটায়। তাদের হাতে স্মার্টফোন মানেই পৃথিবীর খবর, রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, বিনোদন, আবার একই সঙ্গে গুজব ও বিভ্রান্তি। এখানেই দেখা দেয় ধারাবাহিকতার সংকট। একদিন তারা রাস্তায় নামে ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে, আরেকদিন একই ভিড় দেখা যায় ক্যাম্পাসে শিক্ষক বা প্রশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে। নেপালের তরুণেরা কখনো ফেডারেল সরকারের করনীতি নিয়ে সোচ্চার হয়, আবার হঠাৎ পরিবেশ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়। যেন একটি স্থির এজেন্ডা নেই-কোনো বিষয়েই ধারাবাহিকতা বা কৌশলগত চিন্তা স্পষ্ট নয়।
এই অস্থিরতার কারণ হয়তো তাদের বাস্তবতা: দ্রুত পরিবর্তিত সামাজিক অবস্থা, অনিশ্চিত চাকরির বাজার, এবং রাজনীতির প্রতি গভীর অনাস্থা। তাদের ভেতর বিশ্বাস জন্মাতে থাকে তারাই আমূল বদলে দিতে সক্ষম। প্রবীণ বা পুরনো প্রজন্মকে তারা আর বিশ্বাসে নিতে চায় না। এই অতি বিরুদ্ধ ভাবাপন্ন হওয়ার কারণে শৃঙ্খলায় ব্যাঘাত ঘটছে প্রতিনিয়ত। যা প্রজন্মের মেধাবী এইসব তরুণদের থেকে কখনোই কাম্য বা প্রত্যাশার ছিল না।
বাংলাদেশে আমরা দেখেছি হঠাৎ ফেসবুক লাইভ বা পোস্টের সূত্র ধরে শত শত শিক্ষার্থী বা তরুণ রাস্তায় নেমে আসে। রাস্তা অবরোধ, ভাঙচুর, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ- এসব যেন আন্দোলনের নিয়মিত দৃশ্যপট হয়ে দাঁড়িয়েছে। নেপালেও একইরকম চিত্র। ছোটখাটো সামাজিক সমস্যা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দুর্নীতি পর্যন্ত যেকোনো ইস্যুতে তরুণদের রাস্তায় নামতে দেরি হয় না। কিন্তু শান্তিপূর্ণ দাবি-দাওয়া প্রক্রিয়াটি অল্প সময়ের মধ্যেই সহিংসতায় রূপ নেয়।
এভাবে দাবি আদায়ের নামে তারা যখন মব ভায়োলেন্সে জড়িয়ে পড়ে, তখন প্রশ্ন ওঠে- এটি কি তাদের সচেতনতার বহিঃপ্রকাশ, নাকি বেপরোয়া আবেগপ্রবণতার প্রকাশ? অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এটি এক ধরনের ফাস্ট-ফুড সংস্কৃতি; দ্রুত প্রতিক্রিয়া, তাৎক্ষণিক ফল চাওয়া, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে কোনো কৌশল বা দায়বদ্ধতা নেই।
এমন করতে পারাটাকেই তারা অর্জন ধরে নিলেও আদতে তা ছিল ধ্বংসের বিধ্বংসী রূপ। বাংলাদেশের ইতিহাসে তরুণ প্রজন্ম সবসময়ই রাজনীতির চালিকাশক্তি। একাত্তর, নব্বই কিংবা সাম্প্রতিক বিভিন্ন আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা সামনের সারিতে ছিল। কিন্তু জেন জিরা আলাদা। তারা রাজনীতিকে বিশ্বাস করে না, রাজনৈতিক দলকে দুর্নীতিগ্রস্ত ভাবে, অথচ আন্দোলনের সময় আবার সেই দলগুলোর ভাষ্য ব্যবহার করে। একদিকে “রাজনীতি চাই না” বলে তারা সোচ্চার, অন্যদিকে রাজনৈতিক স্লোগানকে আঁকড়ে ধরে মিছিল করে।
নেপালের তরুণ সমাজও একই দ্বন্দ্বে ভুগছে। একদিকে তারা ফেডারেল কাঠামো, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ও সংবিধান পরিবর্তনের দাবি তোলে, অন্যদিকে কোনো রাজনৈতিক দলে দীর্ঘস্থায়ী অংশগ্রহণে আগ্রহী নয়। ফলে প্রজন্মটি রাজনৈতিক স্থায়িত্ব গড়তে না পেরে বরং বিভক্ত মনোভাব ছড়িয়ে দেয়। প্রকৃতই তাদের লক্ষ্য নিয়ে সাধারণ জনগণ তো বটেই বোদ্ধা মহলেও বেশ বিভ্রান্তি লক্ষ্যণীয়। আর তা-ই যে কোন ফলপ্রসূ আন্দোলনও ব্যর্থ হতে সময় নেয় না। বলেই সামাজিক যোগাযোগ নির্ভরতার যুগে লাইক, কমেন্টের রিয়েকশনে তারা সহজভাবে ধাতস্ত হতে না পেরে আরও অস্থির হয়ে পড়ে। আর সেই অস্থিরতার আঁচ গিয়ে সমুদ্রের আগ্রাসী ঢেউয়ের মতো জাতীয় পর্যায়ে গিয়ে পড়ে। এতেই যত দ্বিধা এই প্রজন্মের। যা তাদেরই কর্মফল। কিন্তু তারা নিজেদের ব্যর্থতা মেনে নিতে পারে না।
বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশে জেন জির সবচেয়ে বড় চাপ আসে শিক্ষা থেকে ক্যারিয়ার গড়ে তোলার যাত্রায়। তারা এমন সময়ে বড় হয়েছে যখন বিশ্ব অর্থনীতি ক্রমাগত পরিবর্তিত হচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অটোমেশন, রোবোটিক্স অনেক চাকরি কেড়ে নিচ্ছে, আবার নতুন দক্ষতা দাবি করছে। দক্ষতার রাজত্বের এই সময়ে এসে তারা মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকেও বৈকল্যের ঝুঁকিতে পড়ে যাচ্ছে ক্রমশ।
তাদের অনেকে প্রশ্ন করে- “আমরা পড়াশোনা করছি কেন? এই ডিগ্রি দিয়ে চাকরি পাব তো? প্রচলিত চাকরির বাজারের সংকট, সরকারি নিয়োগের ধীরগতি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অনিশ্চয়তা- সব মিলিয়ে তারা ভবিষ্যৎ নিয়ে আতঙ্কিত। কেউ কেউ আবার অনলাইন ফ্রিল্যান্সিং, কনটেন্ট ক্রিয়েশন, স্টার্টআপে ঝুঁকছে। কিন্তু সেখানেও রয়েছে টিকে থাকার চ্যালেঞ্জ। এই জেন জি প্রজন্ম কি ভার্চুয়াল জগতের সেই চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত? সময়ই বলে দেবে এর উত্তর।
প্রতিটি প্রজন্মের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা তাদের মানসিকতা গড়ে দেয়। জেন জি বড় হয়েছে অস্থির রাজনৈতিক আবহে- ধর্মীয় উগ্রবাদ, গণতন্ত্রের সংকট, অর্থনৈতিক বৈষম্য, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি ইস্যুতে তারা সচেতন। ঠিক কতটুকু সচেতন প্রশ্ন করার সুযোগ থাকছেই। কারণ তারা পূর্বের ঘটনাপ্রবাহ থেকে জ্ঞান অর্জন করে প্রয়োগ কি ঘটাতে পারছে? যদি তা-ই না হয়, তবে সচেতন ভাবার যথেষ্ট কোন কারণও দেখছি না।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সহিংসতা, দমননীতির বাস্তবতা, বেকারত্ব, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ- সবকিছু জেন জিকে করেছে আরও হতাশ। কিন্তু আশার বিষয় হলো, এই প্রজন্ম আবার সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে নিজেদের কণ্ঠস্বর তুলতে পারে। তারা অন্যায়ের প্রতিবাদে ট্রেন্ড তৈরি করে, সৃজনশীল কনটেন্ট বানায়, অনলাইন পিটিশন চালু করে। কতটুকু কার্যকর তা-ও সময়েরই দায়।
বিশ্বব্যাপী জরিপ বলছে, জেন জিদের মধ্যে ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি ও একাকিত্ব সবচেয়ে বেশি। কারণ তারা তথ্যপ্রবাহে ক্লান্ত, প্রতিনিয়ত তুলনার চাপে থাকে। সামাজিক সম্পর্ক ভার্চুয়াল হয়ে গেছে, বাস্তবে বন্ধুত্ব বা পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে এখনও ট্যাবু আছে। ফলে জেন জি অনেকেই সমস্যার কথা লুকিয়ে রাখে, কাউন্সেলিং নিতে চায় না। এতে তাদের অস্থিরতা আরও বাড়ে। বাড়বাড়ন্ত সময়ে তাদের এই অস্থির চিত্ত এতটাই সংবেদনশীল যে, তাদের সাথে যে কোন বিষয় নিয়ে কথা বলতেও দ্বিতীয়বার ভাবতে হবে। কারণ সেই কথার প্রতিক্রিয়া কী হবে বা কতটুকু হবে বোঝা মুশকিল। তাই তাদের মনোজগত নিয়ে চিন্তা না করে কথা বলাটাও সমীচীন নয়।
জেন জি নিজেদের পরিচয়, আদর্শ ও মূল্যবোধ খুঁজছে। তারা চায় ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, লিঙ্গ সমতা, জলবায়ু ন্যায়বিচার, সামাজিক ন্যায়পরায়ণতা। একই সঙ্গে তারা ভোগবাদী বাজার সংস্কৃতির ফাঁদেও আটকে যায়- ব্র্যান্ড, ফ্যাশন, ডিজিটাল ট্রেন্ড তাদের জীবনকে প্রভাবিত করে। এ যেন এক দ্বন্দ্বময় অবস্থান-একদিকে তারা সচেতন নাগরিক হতে চায়, অন্যদিকে বিজ্ঞাপন ও অ্যালগরিদম তাদের জীবনধারা নিয়ন্ত্রণ করে।
কোভিড-১৯ মহামারি জেন জি প্রজন্মকে ভয়ানকভাবে আঘাত করেছে। পড়াশোনা, চাকরি, সামাজিক মেলামেশা- সবকিছুতে তৈরি হয়েছে শূন্যতা। এর পাশাপাশি ইউক্রেন যুদ্ধ, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, জলবায়ু বিপর্যয়, অভিবাসন সংকট-সবকিছু তাদের ভবিষ্যৎকে করেছে অনিশ্চিত। বাংলাদেশে আবার যোগ হয়েছে ডলার সংকট, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের ঘাটতি। ফলে জেন জি অনেকেই বিদেশমুখী হওয়ার চেষ্টা করছে, কেউ আবার হতাশ হয়ে পড়ছে।
তবে এই অস্থির অভিযাত্রার মধ্যেও জেন জির সম্ভাবনা অসীম। তারা সবচেয়ে বেশি প্রযুক্তি-সচেতন। তারা পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে বেশি উদ্বেল। তারা বৈচিত্র্য ও সমতার পক্ষে সোচ্চার। তারা নতুন ধারণা নিয়ে স্টার্টআপ ও সামাজিক উদ্যোক্তা হতে আগ্রহী। এই প্রজন্ম যদি সঠিক দিকনির্দেশনা, মানসিক সহায়তা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ পায়, তবে তারাই ভবিষ্যতের নেতৃত্ব দেবে।
জেন জির যাত্রা নিঃসন্দেহে অস্থির। তারা একদিকে অশেষ সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে, অন্যদিকে চরম অনিশ্চয়তা ও মানসিক চাপের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ইতিহাস বলে, প্রতিটি প্রজন্মই সংকটের মধ্য দিয়েই নিজেদের পরিচয় গড়ে তোলে। আজকের এই তরুণ প্রজন্মকে যদি আমরা বুঝতে পারি, তাদের সমস্যাকে গুরুত্ব দিই, সৃজনশীলতাকে উৎসাহ দিই, তবে তারা শুধু নিজেদের অস্থিরতা জয় করবে না- বরং সমাজ ও রাষ্ট্রকে নিয়ে যাবে এক নতুন অভিযাত্রায়।
[লেখক: অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]
গাজী তারেক আজিজ
বৃহস্পতিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
সময়কে বুঝতে হলে যে প্রজন্মকে অনুধাবন করতে হয়, আজ সেই প্রজন্ম হলো জেনারেশন জেড বা জেন জি। তারা ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে জন্ম নেওয়া এক অদ্ভুত মিশ্রণ-ডিজিটাল ডিভাইস হাতে বড় হওয়া, তথ্যপ্রবাহের ঝড়ে গড়ে ওঠা, আবার একই সঙ্গে ভয়, দুশ্চিন্তা, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বৈশ্বিক অনিশ্চয়তায় দগ্ধ হওয়া। তাদের পথচলা যেন এক অস্থির অভিযাত্রা।
জেন জি হলো প্রথম প্রজন্ম যারা জন্মের পর থেকেই স্মার্টফোন, ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া, গুগল, ইউটিউবকে স্বাভাবিক জগৎ হিসেবে পেয়েছে। বুমার প্রজন্ম যেখানে পত্রিকা, রেডিও বা টিভিকে তথ্যের উৎস হিসেবে জানত, জেন জি শিখেছে গুগলে সার্চ করা মানেই সত্য। তাদের পড়াশোনা, বিনোদন, সম্পর্ক গড়ে ওঠা- সবকিছু প্রযুক্তিনির্ভর। এতটাই প্রযুক্তি নির্ভরতা যে, বাবা-মা কিংবা শিক্ষকের চেয়ে প্রযুক্তিতেই বিশ্বাস এবং ভরসা বেশি। কিন্তু এখানেই শুরু হয় দ্বন্দ্ব। প্রযুক্তি যেমন তাদের দ্রুত তথ্যপ্রাপ্তি ও যোগাযোগের সুযোগ দিয়েছে, তেমনি বাড়িয়েছে মনস্তাত্ত্বিক চাপ। সোশ্যাল মিডিয়ার ভার্চুয়াল প্রতিযোগিতা, লাইক-কমেন্টের ওপর নির্ভরতা, অনলাইন বুলিং বা হেট স্পিচ- সবকিছুই তাদের মনে তৈরি করেছে অদৃশ্য অস্থিরতা। তারা ভাবছে লাইক কমেন্টের রিয়েক্টগুলোই তাদের মূল্যায়নে মাত্রা যোগ করে।
বাংলাদেশ বা নেপালের জেন জি প্রজন্মের মূল শক্তি হলো তথ্যপ্রযুক্তি। তারা ইউটিউব, ফেসবুক, টিকটক বা ইনস্টাগ্রামে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটায়। তাদের হাতে স্মার্টফোন মানেই পৃথিবীর খবর, রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, বিনোদন, আবার একই সঙ্গে গুজব ও বিভ্রান্তি। এখানেই দেখা দেয় ধারাবাহিকতার সংকট। একদিন তারা রাস্তায় নামে ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে, আরেকদিন একই ভিড় দেখা যায় ক্যাম্পাসে শিক্ষক বা প্রশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে। নেপালের তরুণেরা কখনো ফেডারেল সরকারের করনীতি নিয়ে সোচ্চার হয়, আবার হঠাৎ পরিবেশ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়। যেন একটি স্থির এজেন্ডা নেই-কোনো বিষয়েই ধারাবাহিকতা বা কৌশলগত চিন্তা স্পষ্ট নয়।
এই অস্থিরতার কারণ হয়তো তাদের বাস্তবতা: দ্রুত পরিবর্তিত সামাজিক অবস্থা, অনিশ্চিত চাকরির বাজার, এবং রাজনীতির প্রতি গভীর অনাস্থা। তাদের ভেতর বিশ্বাস জন্মাতে থাকে তারাই আমূল বদলে দিতে সক্ষম। প্রবীণ বা পুরনো প্রজন্মকে তারা আর বিশ্বাসে নিতে চায় না। এই অতি বিরুদ্ধ ভাবাপন্ন হওয়ার কারণে শৃঙ্খলায় ব্যাঘাত ঘটছে প্রতিনিয়ত। যা প্রজন্মের মেধাবী এইসব তরুণদের থেকে কখনোই কাম্য বা প্রত্যাশার ছিল না।
বাংলাদেশে আমরা দেখেছি হঠাৎ ফেসবুক লাইভ বা পোস্টের সূত্র ধরে শত শত শিক্ষার্থী বা তরুণ রাস্তায় নেমে আসে। রাস্তা অবরোধ, ভাঙচুর, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ- এসব যেন আন্দোলনের নিয়মিত দৃশ্যপট হয়ে দাঁড়িয়েছে। নেপালেও একইরকম চিত্র। ছোটখাটো সামাজিক সমস্যা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দুর্নীতি পর্যন্ত যেকোনো ইস্যুতে তরুণদের রাস্তায় নামতে দেরি হয় না। কিন্তু শান্তিপূর্ণ দাবি-দাওয়া প্রক্রিয়াটি অল্প সময়ের মধ্যেই সহিংসতায় রূপ নেয়।
এভাবে দাবি আদায়ের নামে তারা যখন মব ভায়োলেন্সে জড়িয়ে পড়ে, তখন প্রশ্ন ওঠে- এটি কি তাদের সচেতনতার বহিঃপ্রকাশ, নাকি বেপরোয়া আবেগপ্রবণতার প্রকাশ? অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এটি এক ধরনের ফাস্ট-ফুড সংস্কৃতি; দ্রুত প্রতিক্রিয়া, তাৎক্ষণিক ফল চাওয়া, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে কোনো কৌশল বা দায়বদ্ধতা নেই।
এমন করতে পারাটাকেই তারা অর্জন ধরে নিলেও আদতে তা ছিল ধ্বংসের বিধ্বংসী রূপ। বাংলাদেশের ইতিহাসে তরুণ প্রজন্ম সবসময়ই রাজনীতির চালিকাশক্তি। একাত্তর, নব্বই কিংবা সাম্প্রতিক বিভিন্ন আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা সামনের সারিতে ছিল। কিন্তু জেন জিরা আলাদা। তারা রাজনীতিকে বিশ্বাস করে না, রাজনৈতিক দলকে দুর্নীতিগ্রস্ত ভাবে, অথচ আন্দোলনের সময় আবার সেই দলগুলোর ভাষ্য ব্যবহার করে। একদিকে “রাজনীতি চাই না” বলে তারা সোচ্চার, অন্যদিকে রাজনৈতিক স্লোগানকে আঁকড়ে ধরে মিছিল করে।
নেপালের তরুণ সমাজও একই দ্বন্দ্বে ভুগছে। একদিকে তারা ফেডারেল কাঠামো, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ও সংবিধান পরিবর্তনের দাবি তোলে, অন্যদিকে কোনো রাজনৈতিক দলে দীর্ঘস্থায়ী অংশগ্রহণে আগ্রহী নয়। ফলে প্রজন্মটি রাজনৈতিক স্থায়িত্ব গড়তে না পেরে বরং বিভক্ত মনোভাব ছড়িয়ে দেয়। প্রকৃতই তাদের লক্ষ্য নিয়ে সাধারণ জনগণ তো বটেই বোদ্ধা মহলেও বেশ বিভ্রান্তি লক্ষ্যণীয়। আর তা-ই যে কোন ফলপ্রসূ আন্দোলনও ব্যর্থ হতে সময় নেয় না। বলেই সামাজিক যোগাযোগ নির্ভরতার যুগে লাইক, কমেন্টের রিয়েকশনে তারা সহজভাবে ধাতস্ত হতে না পেরে আরও অস্থির হয়ে পড়ে। আর সেই অস্থিরতার আঁচ গিয়ে সমুদ্রের আগ্রাসী ঢেউয়ের মতো জাতীয় পর্যায়ে গিয়ে পড়ে। এতেই যত দ্বিধা এই প্রজন্মের। যা তাদেরই কর্মফল। কিন্তু তারা নিজেদের ব্যর্থতা মেনে নিতে পারে না।
বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশে জেন জির সবচেয়ে বড় চাপ আসে শিক্ষা থেকে ক্যারিয়ার গড়ে তোলার যাত্রায়। তারা এমন সময়ে বড় হয়েছে যখন বিশ্ব অর্থনীতি ক্রমাগত পরিবর্তিত হচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অটোমেশন, রোবোটিক্স অনেক চাকরি কেড়ে নিচ্ছে, আবার নতুন দক্ষতা দাবি করছে। দক্ষতার রাজত্বের এই সময়ে এসে তারা মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকেও বৈকল্যের ঝুঁকিতে পড়ে যাচ্ছে ক্রমশ।
তাদের অনেকে প্রশ্ন করে- “আমরা পড়াশোনা করছি কেন? এই ডিগ্রি দিয়ে চাকরি পাব তো? প্রচলিত চাকরির বাজারের সংকট, সরকারি নিয়োগের ধীরগতি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অনিশ্চয়তা- সব মিলিয়ে তারা ভবিষ্যৎ নিয়ে আতঙ্কিত। কেউ কেউ আবার অনলাইন ফ্রিল্যান্সিং, কনটেন্ট ক্রিয়েশন, স্টার্টআপে ঝুঁকছে। কিন্তু সেখানেও রয়েছে টিকে থাকার চ্যালেঞ্জ। এই জেন জি প্রজন্ম কি ভার্চুয়াল জগতের সেই চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত? সময়ই বলে দেবে এর উত্তর।
প্রতিটি প্রজন্মের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা তাদের মানসিকতা গড়ে দেয়। জেন জি বড় হয়েছে অস্থির রাজনৈতিক আবহে- ধর্মীয় উগ্রবাদ, গণতন্ত্রের সংকট, অর্থনৈতিক বৈষম্য, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি ইস্যুতে তারা সচেতন। ঠিক কতটুকু সচেতন প্রশ্ন করার সুযোগ থাকছেই। কারণ তারা পূর্বের ঘটনাপ্রবাহ থেকে জ্ঞান অর্জন করে প্রয়োগ কি ঘটাতে পারছে? যদি তা-ই না হয়, তবে সচেতন ভাবার যথেষ্ট কোন কারণও দেখছি না।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সহিংসতা, দমননীতির বাস্তবতা, বেকারত্ব, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ- সবকিছু জেন জিকে করেছে আরও হতাশ। কিন্তু আশার বিষয় হলো, এই প্রজন্ম আবার সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে নিজেদের কণ্ঠস্বর তুলতে পারে। তারা অন্যায়ের প্রতিবাদে ট্রেন্ড তৈরি করে, সৃজনশীল কনটেন্ট বানায়, অনলাইন পিটিশন চালু করে। কতটুকু কার্যকর তা-ও সময়েরই দায়।
বিশ্বব্যাপী জরিপ বলছে, জেন জিদের মধ্যে ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি ও একাকিত্ব সবচেয়ে বেশি। কারণ তারা তথ্যপ্রবাহে ক্লান্ত, প্রতিনিয়ত তুলনার চাপে থাকে। সামাজিক সম্পর্ক ভার্চুয়াল হয়ে গেছে, বাস্তবে বন্ধুত্ব বা পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে এখনও ট্যাবু আছে। ফলে জেন জি অনেকেই সমস্যার কথা লুকিয়ে রাখে, কাউন্সেলিং নিতে চায় না। এতে তাদের অস্থিরতা আরও বাড়ে। বাড়বাড়ন্ত সময়ে তাদের এই অস্থির চিত্ত এতটাই সংবেদনশীল যে, তাদের সাথে যে কোন বিষয় নিয়ে কথা বলতেও দ্বিতীয়বার ভাবতে হবে। কারণ সেই কথার প্রতিক্রিয়া কী হবে বা কতটুকু হবে বোঝা মুশকিল। তাই তাদের মনোজগত নিয়ে চিন্তা না করে কথা বলাটাও সমীচীন নয়।
জেন জি নিজেদের পরিচয়, আদর্শ ও মূল্যবোধ খুঁজছে। তারা চায় ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, লিঙ্গ সমতা, জলবায়ু ন্যায়বিচার, সামাজিক ন্যায়পরায়ণতা। একই সঙ্গে তারা ভোগবাদী বাজার সংস্কৃতির ফাঁদেও আটকে যায়- ব্র্যান্ড, ফ্যাশন, ডিজিটাল ট্রেন্ড তাদের জীবনকে প্রভাবিত করে। এ যেন এক দ্বন্দ্বময় অবস্থান-একদিকে তারা সচেতন নাগরিক হতে চায়, অন্যদিকে বিজ্ঞাপন ও অ্যালগরিদম তাদের জীবনধারা নিয়ন্ত্রণ করে।
কোভিড-১৯ মহামারি জেন জি প্রজন্মকে ভয়ানকভাবে আঘাত করেছে। পড়াশোনা, চাকরি, সামাজিক মেলামেশা- সবকিছুতে তৈরি হয়েছে শূন্যতা। এর পাশাপাশি ইউক্রেন যুদ্ধ, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, জলবায়ু বিপর্যয়, অভিবাসন সংকট-সবকিছু তাদের ভবিষ্যৎকে করেছে অনিশ্চিত। বাংলাদেশে আবার যোগ হয়েছে ডলার সংকট, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের ঘাটতি। ফলে জেন জি অনেকেই বিদেশমুখী হওয়ার চেষ্টা করছে, কেউ আবার হতাশ হয়ে পড়ছে।
তবে এই অস্থির অভিযাত্রার মধ্যেও জেন জির সম্ভাবনা অসীম। তারা সবচেয়ে বেশি প্রযুক্তি-সচেতন। তারা পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে বেশি উদ্বেল। তারা বৈচিত্র্য ও সমতার পক্ষে সোচ্চার। তারা নতুন ধারণা নিয়ে স্টার্টআপ ও সামাজিক উদ্যোক্তা হতে আগ্রহী। এই প্রজন্ম যদি সঠিক দিকনির্দেশনা, মানসিক সহায়তা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ পায়, তবে তারাই ভবিষ্যতের নেতৃত্ব দেবে।
জেন জির যাত্রা নিঃসন্দেহে অস্থির। তারা একদিকে অশেষ সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে, অন্যদিকে চরম অনিশ্চয়তা ও মানসিক চাপের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ইতিহাস বলে, প্রতিটি প্রজন্মই সংকটের মধ্য দিয়েই নিজেদের পরিচয় গড়ে তোলে। আজকের এই তরুণ প্রজন্মকে যদি আমরা বুঝতে পারি, তাদের সমস্যাকে গুরুত্ব দিই, সৃজনশীলতাকে উৎসাহ দিই, তবে তারা শুধু নিজেদের অস্থিরতা জয় করবে না- বরং সমাজ ও রাষ্ট্রকে নিয়ে যাবে এক নতুন অভিযাত্রায়।
[লেখক: অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]