alt

opinion » post-editorial

বাংলাদেশের গিগ অর্থনীতি: উন্নয়নের হাতিয়ার নাকি অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ?

মতিউর রহমান

: রোববার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশের শ্রমবাজার নীরবে কিন্তু দ্রুত রূপান্তরিত হচ্ছে। শহরের রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে গ্রামীণ জনপদ পর্যন্ত, স্মার্টফোনের মৃদু শব্দ আজ নতুন ধরনের কাজের ইঙ্গিত দিচ্ছে। উবার, পাঠাও-এর মতো রাইড-শেয়ারিং সেবা, চালডাল বা ফুডপান্ডার মতো অনলাইন ডেলিভারি প্ল্যাটফর্ম এবং দ্রুত বিস্তৃত ফ্রিল্যান্সিং সেক্টর এক নতুন অর্থনৈতিক ধারাÑগিগ অর্থনীতিকেÑবাংলাদেশে দৃশ্যমান করেছে। এই অর্থনীতি যেন শ্রমিকদের কাছে স্বায়ত্তশাসন, নমনীয়তা ও উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ এনে দিয়েছে। বিশেষ করে তরুণ-তরুণী, নারী এবং প্রথাগত কর্মসংস্থানের বাইরে থাকা মানুষদের জন্য এটি এক নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে।

গিগ অর্থনীতি বলতে এমন একটি শ্রমবাজারকে বোঝানো হয় যেখানে চুক্তিভিত্তিক, খ-কালীন বা অস্থায়ী কাজের সম্পর্ক বিদ্যমান থাকে, যা মূলত ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এটি এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে কর্মীরা ঐতিহ্যবাহী পূর্ণকালীন চাকরির পরিবর্তে স্বাধীন ঠিকাদার বা ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করেন, নির্দিষ্ট কাজ বা ‘গিগ’-এর বিনিময়ে পারিশ্রমিক পান। এই অর্থনীতিতে কর্মসংস্থান মূলত স্বল্পমেয়াদী প্রকল্প, কাজ, অথবা সেবা প্রদানের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে।

গিগ অর্থনীতির উত্থান ও এর পরিসর গিগ অর্থনীতি, যেখানে অস্থায়ী বা খ-কালীন কাজের চুক্তিভিত্তিক সম্পর্ক বিদ্যমান, বাংলাদেশের শ্রমবাজারে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নিয়েছে। এর প্রসারে প্রযুক্তির ভূমিকা অনস্বীকার্য। স্মার্টফোনের সহজলভ্যতা ও ইন্টারনেটের দ্রুত প্রসার এই অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে।

বাংলাদেশে গিগ অর্থনীতির পরিসর চোখে পড়ার মতো। প্রায় ৬.৫ লক্ষ সক্রিয় ফ্রিল্যান্সার কাজ করছেন এবং এই খাত ইতিমধ্যেই প্রায় এক বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি মূল্য অর্জন করেছে। ঢাকাতেই প্রায় চল্লিশ হাজার ড্রাইভার রাইড-শেয়ারিং-এর সঙ্গে যুক্ত। ২০২৪ সালে উবারের একটি অর্থনৈতিক প্রভাব সমীক্ষা দেখায়, প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রমের আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৫৫ বিলিয়ন টাকা এবং তাদের ড্রাইভাররা গড়ে বিকল্প কর্মসংস্থানের তুলনায় ৪২ শতাংশ বেশি আয় করেন।

বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশের জিডিপিতে গিগ অর্থনীতির অবদান ২০২০ সালের ৫ শতাংশ থেকে দ্বিগুণ হতে পারে। ইতিমধ্যেই ২০২০ সালের পর থেকে এক হাজারেরও বেশি নতুন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম চালু হয়েছে, যা এই খাতের দ্রুত বিস্তার ও সম্ভাবনাকে প্রমাণ করে।

গিগ অর্থনীতি আপাতদৃষ্টিতে স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দিলেও, এর আড়ালে এক জটিল বাস্তবতা লুকিয়ে আছে। নিক শ্রিনিচেকের প্ল্যাটফর্ম ক্যাপিটালিজম তত্ত্ব এবং আন্তোনিও দে স্টেফানোর গিগ অর্থনীতি বিশ্লেষণ আমাদের দেখায়, “নিজের বস হওয়া”-র যে প্রতিশ্রুতি প্ল্যাটফর্মগুলো দেয়, তার ভেতর লুকানো থাকে শোষণ ও অনিশ্চয়তার গভীর কাঠামো।

শ্রিনিচেকের প্ল্যাটফর্ম ক্যাপিটালিজম তত্ত্ব আমাদের বোঝায়, প্ল্যাটফর্মগুলো আসলে শুধু সেবাপ্রদানকারী ও গ্রাহকের সংযোগকারী নয়। তারা বিশাল ডিজিটাল ইকোসিস্টেম তৈরি করে যেখানে ব্যবহারকারীর সক্রিয়তা ও ডেটা প্রধান পণ্য। অ্যালগরিদম, রেটিং সিস্টেম এবং লুকানো নিয়মের মাধ্যমে এই প্ল্যাটফর্মগুলো শ্রমিকদের উপর সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখে। ফলস্বরূপ, শ্রমিকরা যতই স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন বলে মনে করুন না কেন, বাস্তবে তারা নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন প্ল্যাটফর্মের উপর, যেটি মুহূর্তেই তাদের কাজ, আয় বা দৃশ্যমানতার সুযোগ কেড়ে নিতে পারে। স্বাধীনতা এখানে এক মরীচিকা, যা প্ল্যাটফর্ম মালিকদের ক্ষমতা আড়াল করে এবং শ্রমিকদের এক নতুন প্রকারের অদৃশ্য শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখে।

আন্তোনিও দে স্টেফানো গিগ অর্থনীতিকে চিহ্নিত করেছেন “জাস্ট-ইন-টাইম ওয়ার্কফোর্স” হিসেবে। এখানে শ্রমিকরা আনুষ্ঠানিক সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত, অ্যালগরিদমিক তত্ত্বাবধানে কাজ করেন, এবং চিরস্থায়ী অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, গিগ শ্রমিকরা স্বাধীন ঠিকাদার হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ হওয়ায় সব ধরনের খরচÑগাড়ির জ্বালানি, মোবাইল, রক্ষণাবেক্ষণ বা সময়ের অপচয়Ñনিজেদের বহন করতে হয়। তারা স্বাস্থ্যসেবা, পেনশন বা বেতনসহ ছুটির মতো মৌলিক সুবিধা পান না। আয়ের তারতম্য এতটাই প্রবল যে অনেক তরুণ শ্রমিক মাসে কখনও ভালো আয় করেন আবার কখনও একেবারেই কাজ পান না। ক্যারিয়ার উন্নয়ন বা দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগও নেই বললেই চলে। তাছাড়া অ্যালগরিদম-ভিত্তিক রেটিং ও প্রতিযোগিতা শ্রমিকদের মানসিক চাপ ও উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে তোলে।

বাংলাদেশের শ্রমবাজারে প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষ এখনও অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন এবং এই খাত থেকে জিডিপির প্রায় ৪৩ শতাংশ আসে। ফলে যারা গিগ অর্থনীতিতে যুক্ত হচ্ছেন তারা অনেক সময় পূর্বের অনিরাপদ কাজ থেকে নতুন কিন্তু একই রকম অসুরক্ষিত শ্রমে প্রবেশ করছেন। নারীরা আর্থিকভাবে কিছুটা স্বাধীনতা পেলেও অ্যালগরিদমিক পক্ষপাত বা সামাজিক সীমাবদ্ধতার কারণে তাদের আয় সীমিত থাকে। তরুণরা পড়াশোনার পাশাপাশি আয়ের জন্য গিগ কাজে যুক্ত হচ্ছেন, কিন্তু অনিশ্চিত সময়সূচি ও আয়ের অস্থিরতা তাদের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা কঠিন করে তুলছে। উদ্যোক্তা হওয়ার প্রতিশ্রুতি বাস্তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই টেকসই জীবিকা বা মর্যাদাপূর্ণ কাজের রূপ নেয় না।

গিগ অর্থনীতি কেবল অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক কাঠামোতেও প্রভাব ফেলছে। তরুণদের কাছে এটি নতুন ধরনের সুযোগ তৈরি করছে, কিন্তু আয়ের অস্থিরতা ও প্রতিযোগিতার চাপ অনেকের প্রত্যাশার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। নারীদের জন্য একদিকে আর্থিক স্বাবলম্বিতা, অন্যদিকে পারিবারিক দায়িত্ব ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা মিলে দ্বৈত চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। অ্যালগরিদম প্রায়শই সামাজিক বৈষম্যকে আরও জোরদার করে তোলে। ফলে সমাজে বিদ্যমান অসমতা ডিজিটাল খাতেও বহাল থাকে।

বাংলাদেশের শহরে যানজট, জ্বালানি খরচ বা গণপরিবহনের সীমাবদ্ধতা সরাসরি রাইড-শেয়ারিং শ্রমিকদের অর্থনৈতিক টেকসইতাকে প্রভাবিত করে। অন্যদিকে গ্রামীণ ও প্রান্তিক অঞ্চলে ইন্টারনেট সংযোগ ও ডিজিটাল দক্ষতার অভাব শ্রমিকদের গিগ অর্থনীতিতে যুক্ত হওয়ার সুযোগ কমিয়ে দেয়। ফলে নগর-গ্রাম বিভাজন আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

তবুও গিগ অর্থনীতি বাংলাদেশের জন্য উন্নয়নের এক সম্ভাবনাময় হাতিয়ার। যদি সঠিকভাবে পরিচালিত হয়, তবে এটি আর্থিক অন্তর্ভুক্তি, শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ এবং ডিজিটাল দক্ষতার প্রসার ঘটাতে পারে। এজন্য নীতিনির্ধারকদের সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ প্রয়োজন। ডিজিটাল শ্রমের জন্য দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি, গিগ শ্রমিকদের আইনি স্বীকৃতি ও সুরক্ষা, প্ল্যাটফর্মগুলোর দায়িত্ব নির্ধারণ, ন্যায্য মজুরি এবং বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা জরুরি। শ্রমিকদের সমষ্টিগত দরকষাকষির অধিকার স্বীকৃতি দিতে হবে। বিকল্প হিসেবে পাবলিকলি ওউনড বা সমবায়ভিত্তিক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা যেতে পারে, যাতে মুনাফা সমভাবে বণ্টিত হয়।

গিগ শ্রমিকদের জন্য ঐতিহ্যবাহী ট্রেড ইউনিয়ন বা আইনি সুরক্ষা কার্যকর নয়। শ্রমিকদের সংগঠিত প্রচেষ্টা অনেক সময় প্ল্যাটফর্মগুলোর প্রতিরোধের মুখে পড়ে। শ্রম আইন মূলত আনুষ্ঠানিক চাকরির জন্য তৈরি হওয়ায় গিগ শ্রমিকরা আইনের ধূসর অঞ্চলে পড়ে থাকেন। স্বাস্থ্যবিমা, দুর্ঘটনা কভারেজ, অবসরভাতাÑএসব সুবিধা নিশ্চিত করতে নতুন আইনি কাঠামো তৈরি জরুরি।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলোÑগিগ অর্থনীতি শ্রমের মর্যাদা ও নৈতিকতার নতুন প্রশ্ন তৈরি করছে। শ্রমিকরা যে স্বাধীনতার স্বপ্নে এই কাজে আসেন, তা আসলে শর্তাধীন। অ্যালগরিদম নির্ধারণ করে তারা কখন, কতক্ষণ ও কত আয় করতে পারবেন। ফলে স্বাধীনতার বয়ান আসলে প্ল্যাটফর্মের উপর নির্ভরতার এক নতুন রূপ, যা প্রযুক্তিগত অগ্রগতির আড়ালে সামাজিক ন্যায়বিচারকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

বাংলাদেশে শ্রমের ‘গিগিফিকেশন’ এক দ্বিমুখী বাস্তবতা। একদিকে এটি শ্রমিকদের জন্য নতুন সুযোগ, আয় ও নমনীয়তা এনে দিয়েছে। অন্যদিকে এটি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অনিশ্চয়তা, বৈষম্য ও শোষণকে স্থায়ী করে তুলছে। তাই শ্রমিকদের প্রকৃত স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতে হলে নীতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপ অপরিহার্য।

গিগ শ্রমিকদের আইনি স্বীকৃতি, সামাজিক সুরক্ষা, সমষ্টিগত দরকষাকষির অধিকার এবং দক্ষতা উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। নগর-গ্রাম উভয় প্রেক্ষাপটে সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে অবকাঠামো ও ডিজিটাল শিক্ষায় বিনিয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি সমবায়ভিত্তিক বা জন-অধিভুক্ত প্ল্যাটফর্ম মডেল চালু করে বৈষম্যমূলক মুনাফা বণ্টন কমাতে হবে।

গিগ অর্থনীতি শুধু অর্থনৈতিক পরিবর্তন নয়, এটি বাংলাদেশের সমাজের জন্য এক গভীর সামাজিক রূপান্তর। তাই স্বাধীনতার মিথকে ভেঙে দিয়ে মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই শ্রম কাঠামো নির্মাণ করাই এখন সময়ের দাবি। এভাবেই বাংলাদেশের ডিজিটাল অর্থনীতি কেবল বেঁচে থাকার উপায় নয়, বরং মর্যাদাপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমৃদ্ধির প্রকৃত হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।

[লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]

দায়িত্বশীল আচরণে গড়ে উঠুক দেশের পর্যটন খাত

এশিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় নতুন সমীকরণ

জলাতঙ্ক: প্রতিরোধযোগ্য তবু প্রাণঘাতী

বেড়ে চলা বৈষম্যের দেওয়াল

নৃশংসতার ভিডিও, নীরব দর্শক আর হারিয়ে যাওয়া মানবতা

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা ও জনস্বাস্থ্যের সংকট

জেন জি’র অস্থির অভিযাত্রা

রম্যগদ্য: রবার্ট ব্রুস ও মাকড়শা

জাতিসংঘের নিউইয়র্ক সম্মেলন

বিশ্ব ফুসফুস দিবস: সুস্থ শ্বাসের অঙ্গীকার

সংখ্যার আড়ালে অর্থনীতির অদেখা বাস্তবতা

সঙ্গীত চর্চা ও ধর্ম শিক্ষা: তর্ক-বিতর্কের জায়গাটি কোথায়?

অপুষ্টি ও মাটির অবক্ষয় রোধে সবুজ সার

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘পোষ্য কোটা’ পুনর্বহাল বিতর্ক

আইসিইউ সেবার সংকট

পরশ্রীকাতরতা: সামাজিক ব্যাধির অদৃশ্য শেকল

চার্লি কার্ক হত্যাকাণ্ড: ট্রাম্প কি সহিংসতাকেই রাজনীতির হাতিয়ার বানাচ্ছেন?

যুব বেকারত্ব: অর্থনৈতিক সংকট থেকে সামাজিক বিপর্যয়

চাই স্বাধীনভাবে ধর্ম পালনের পরিবেশ

সার সংকট, ভর্তুকি ও সিন্ডিকেট

দ. কোরিয়ার শ্রমবাজার : কোটা পূরণে ব্যর্থ বাংলাদেশ

ভারতের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন বনাম আমেরিকার শুল্ক কূটনীতি

সংবিধান কাটাছেঁড়ার সুযোগ আছে কি?

সংসদে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব

চা-জনগোষ্ঠীর দণ্ডপূজা ও উপেক্ষিত অধিকার

মেরিটোক্রেসি: সমাজ ও রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা

রম্যগদ্য: হাতের মুঠোয় বিশ্ব

শারদীয় পূজার দিনলিপি

ঋণের জন্য আত্মহত্যা, ঋণ নিয়েই চল্লিশা

জাকসু নির্বাচন ও হট্টগোল: আমাদের জন্য শিক্ষণীয় কী?

নরসুন্দর পেশার গুরুত্ব ও সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন

বিভাগভিত্তিক এমপিআর নির্বাচন পদ্ধতি

প্ল্যাটফর্ম সমাজে বাংলাদেশ: জ্ঞানের ভবিষ্যৎ কার হাতে?

আনন্দবেদনার হাসপাতাল: সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার বাস্তবতা

ছবি

ভিন্ন ধরনের নির্বাচন, ভিন্ন ধরনের ফল

বেসরকারি খাতে সিআইবি’র যাত্রা: ঋণ ব্যবস্থার নতুন দিগন্ত

tab

opinion » post-editorial

বাংলাদেশের গিগ অর্থনীতি: উন্নয়নের হাতিয়ার নাকি অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ?

মতিউর রহমান

রোববার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশের শ্রমবাজার নীরবে কিন্তু দ্রুত রূপান্তরিত হচ্ছে। শহরের রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে গ্রামীণ জনপদ পর্যন্ত, স্মার্টফোনের মৃদু শব্দ আজ নতুন ধরনের কাজের ইঙ্গিত দিচ্ছে। উবার, পাঠাও-এর মতো রাইড-শেয়ারিং সেবা, চালডাল বা ফুডপান্ডার মতো অনলাইন ডেলিভারি প্ল্যাটফর্ম এবং দ্রুত বিস্তৃত ফ্রিল্যান্সিং সেক্টর এক নতুন অর্থনৈতিক ধারাÑগিগ অর্থনীতিকেÑবাংলাদেশে দৃশ্যমান করেছে। এই অর্থনীতি যেন শ্রমিকদের কাছে স্বায়ত্তশাসন, নমনীয়তা ও উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ এনে দিয়েছে। বিশেষ করে তরুণ-তরুণী, নারী এবং প্রথাগত কর্মসংস্থানের বাইরে থাকা মানুষদের জন্য এটি এক নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে।

গিগ অর্থনীতি বলতে এমন একটি শ্রমবাজারকে বোঝানো হয় যেখানে চুক্তিভিত্তিক, খ-কালীন বা অস্থায়ী কাজের সম্পর্ক বিদ্যমান থাকে, যা মূলত ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এটি এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে কর্মীরা ঐতিহ্যবাহী পূর্ণকালীন চাকরির পরিবর্তে স্বাধীন ঠিকাদার বা ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করেন, নির্দিষ্ট কাজ বা ‘গিগ’-এর বিনিময়ে পারিশ্রমিক পান। এই অর্থনীতিতে কর্মসংস্থান মূলত স্বল্পমেয়াদী প্রকল্প, কাজ, অথবা সেবা প্রদানের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে।

গিগ অর্থনীতির উত্থান ও এর পরিসর গিগ অর্থনীতি, যেখানে অস্থায়ী বা খ-কালীন কাজের চুক্তিভিত্তিক সম্পর্ক বিদ্যমান, বাংলাদেশের শ্রমবাজারে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নিয়েছে। এর প্রসারে প্রযুক্তির ভূমিকা অনস্বীকার্য। স্মার্টফোনের সহজলভ্যতা ও ইন্টারনেটের দ্রুত প্রসার এই অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে।

বাংলাদেশে গিগ অর্থনীতির পরিসর চোখে পড়ার মতো। প্রায় ৬.৫ লক্ষ সক্রিয় ফ্রিল্যান্সার কাজ করছেন এবং এই খাত ইতিমধ্যেই প্রায় এক বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি মূল্য অর্জন করেছে। ঢাকাতেই প্রায় চল্লিশ হাজার ড্রাইভার রাইড-শেয়ারিং-এর সঙ্গে যুক্ত। ২০২৪ সালে উবারের একটি অর্থনৈতিক প্রভাব সমীক্ষা দেখায়, প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রমের আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৫৫ বিলিয়ন টাকা এবং তাদের ড্রাইভাররা গড়ে বিকল্প কর্মসংস্থানের তুলনায় ৪২ শতাংশ বেশি আয় করেন।

বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশের জিডিপিতে গিগ অর্থনীতির অবদান ২০২০ সালের ৫ শতাংশ থেকে দ্বিগুণ হতে পারে। ইতিমধ্যেই ২০২০ সালের পর থেকে এক হাজারেরও বেশি নতুন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম চালু হয়েছে, যা এই খাতের দ্রুত বিস্তার ও সম্ভাবনাকে প্রমাণ করে।

গিগ অর্থনীতি আপাতদৃষ্টিতে স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দিলেও, এর আড়ালে এক জটিল বাস্তবতা লুকিয়ে আছে। নিক শ্রিনিচেকের প্ল্যাটফর্ম ক্যাপিটালিজম তত্ত্ব এবং আন্তোনিও দে স্টেফানোর গিগ অর্থনীতি বিশ্লেষণ আমাদের দেখায়, “নিজের বস হওয়া”-র যে প্রতিশ্রুতি প্ল্যাটফর্মগুলো দেয়, তার ভেতর লুকানো থাকে শোষণ ও অনিশ্চয়তার গভীর কাঠামো।

শ্রিনিচেকের প্ল্যাটফর্ম ক্যাপিটালিজম তত্ত্ব আমাদের বোঝায়, প্ল্যাটফর্মগুলো আসলে শুধু সেবাপ্রদানকারী ও গ্রাহকের সংযোগকারী নয়। তারা বিশাল ডিজিটাল ইকোসিস্টেম তৈরি করে যেখানে ব্যবহারকারীর সক্রিয়তা ও ডেটা প্রধান পণ্য। অ্যালগরিদম, রেটিং সিস্টেম এবং লুকানো নিয়মের মাধ্যমে এই প্ল্যাটফর্মগুলো শ্রমিকদের উপর সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখে। ফলস্বরূপ, শ্রমিকরা যতই স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন বলে মনে করুন না কেন, বাস্তবে তারা নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন প্ল্যাটফর্মের উপর, যেটি মুহূর্তেই তাদের কাজ, আয় বা দৃশ্যমানতার সুযোগ কেড়ে নিতে পারে। স্বাধীনতা এখানে এক মরীচিকা, যা প্ল্যাটফর্ম মালিকদের ক্ষমতা আড়াল করে এবং শ্রমিকদের এক নতুন প্রকারের অদৃশ্য শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখে।

আন্তোনিও দে স্টেফানো গিগ অর্থনীতিকে চিহ্নিত করেছেন “জাস্ট-ইন-টাইম ওয়ার্কফোর্স” হিসেবে। এখানে শ্রমিকরা আনুষ্ঠানিক সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত, অ্যালগরিদমিক তত্ত্বাবধানে কাজ করেন, এবং চিরস্থায়ী অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, গিগ শ্রমিকরা স্বাধীন ঠিকাদার হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ হওয়ায় সব ধরনের খরচÑগাড়ির জ্বালানি, মোবাইল, রক্ষণাবেক্ষণ বা সময়ের অপচয়Ñনিজেদের বহন করতে হয়। তারা স্বাস্থ্যসেবা, পেনশন বা বেতনসহ ছুটির মতো মৌলিক সুবিধা পান না। আয়ের তারতম্য এতটাই প্রবল যে অনেক তরুণ শ্রমিক মাসে কখনও ভালো আয় করেন আবার কখনও একেবারেই কাজ পান না। ক্যারিয়ার উন্নয়ন বা দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগও নেই বললেই চলে। তাছাড়া অ্যালগরিদম-ভিত্তিক রেটিং ও প্রতিযোগিতা শ্রমিকদের মানসিক চাপ ও উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে তোলে।

বাংলাদেশের শ্রমবাজারে প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষ এখনও অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন এবং এই খাত থেকে জিডিপির প্রায় ৪৩ শতাংশ আসে। ফলে যারা গিগ অর্থনীতিতে যুক্ত হচ্ছেন তারা অনেক সময় পূর্বের অনিরাপদ কাজ থেকে নতুন কিন্তু একই রকম অসুরক্ষিত শ্রমে প্রবেশ করছেন। নারীরা আর্থিকভাবে কিছুটা স্বাধীনতা পেলেও অ্যালগরিদমিক পক্ষপাত বা সামাজিক সীমাবদ্ধতার কারণে তাদের আয় সীমিত থাকে। তরুণরা পড়াশোনার পাশাপাশি আয়ের জন্য গিগ কাজে যুক্ত হচ্ছেন, কিন্তু অনিশ্চিত সময়সূচি ও আয়ের অস্থিরতা তাদের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা কঠিন করে তুলছে। উদ্যোক্তা হওয়ার প্রতিশ্রুতি বাস্তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই টেকসই জীবিকা বা মর্যাদাপূর্ণ কাজের রূপ নেয় না।

গিগ অর্থনীতি কেবল অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক কাঠামোতেও প্রভাব ফেলছে। তরুণদের কাছে এটি নতুন ধরনের সুযোগ তৈরি করছে, কিন্তু আয়ের অস্থিরতা ও প্রতিযোগিতার চাপ অনেকের প্রত্যাশার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। নারীদের জন্য একদিকে আর্থিক স্বাবলম্বিতা, অন্যদিকে পারিবারিক দায়িত্ব ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা মিলে দ্বৈত চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। অ্যালগরিদম প্রায়শই সামাজিক বৈষম্যকে আরও জোরদার করে তোলে। ফলে সমাজে বিদ্যমান অসমতা ডিজিটাল খাতেও বহাল থাকে।

বাংলাদেশের শহরে যানজট, জ্বালানি খরচ বা গণপরিবহনের সীমাবদ্ধতা সরাসরি রাইড-শেয়ারিং শ্রমিকদের অর্থনৈতিক টেকসইতাকে প্রভাবিত করে। অন্যদিকে গ্রামীণ ও প্রান্তিক অঞ্চলে ইন্টারনেট সংযোগ ও ডিজিটাল দক্ষতার অভাব শ্রমিকদের গিগ অর্থনীতিতে যুক্ত হওয়ার সুযোগ কমিয়ে দেয়। ফলে নগর-গ্রাম বিভাজন আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

তবুও গিগ অর্থনীতি বাংলাদেশের জন্য উন্নয়নের এক সম্ভাবনাময় হাতিয়ার। যদি সঠিকভাবে পরিচালিত হয়, তবে এটি আর্থিক অন্তর্ভুক্তি, শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ এবং ডিজিটাল দক্ষতার প্রসার ঘটাতে পারে। এজন্য নীতিনির্ধারকদের সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ প্রয়োজন। ডিজিটাল শ্রমের জন্য দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি, গিগ শ্রমিকদের আইনি স্বীকৃতি ও সুরক্ষা, প্ল্যাটফর্মগুলোর দায়িত্ব নির্ধারণ, ন্যায্য মজুরি এবং বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা জরুরি। শ্রমিকদের সমষ্টিগত দরকষাকষির অধিকার স্বীকৃতি দিতে হবে। বিকল্প হিসেবে পাবলিকলি ওউনড বা সমবায়ভিত্তিক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা যেতে পারে, যাতে মুনাফা সমভাবে বণ্টিত হয়।

গিগ শ্রমিকদের জন্য ঐতিহ্যবাহী ট্রেড ইউনিয়ন বা আইনি সুরক্ষা কার্যকর নয়। শ্রমিকদের সংগঠিত প্রচেষ্টা অনেক সময় প্ল্যাটফর্মগুলোর প্রতিরোধের মুখে পড়ে। শ্রম আইন মূলত আনুষ্ঠানিক চাকরির জন্য তৈরি হওয়ায় গিগ শ্রমিকরা আইনের ধূসর অঞ্চলে পড়ে থাকেন। স্বাস্থ্যবিমা, দুর্ঘটনা কভারেজ, অবসরভাতাÑএসব সুবিধা নিশ্চিত করতে নতুন আইনি কাঠামো তৈরি জরুরি।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলোÑগিগ অর্থনীতি শ্রমের মর্যাদা ও নৈতিকতার নতুন প্রশ্ন তৈরি করছে। শ্রমিকরা যে স্বাধীনতার স্বপ্নে এই কাজে আসেন, তা আসলে শর্তাধীন। অ্যালগরিদম নির্ধারণ করে তারা কখন, কতক্ষণ ও কত আয় করতে পারবেন। ফলে স্বাধীনতার বয়ান আসলে প্ল্যাটফর্মের উপর নির্ভরতার এক নতুন রূপ, যা প্রযুক্তিগত অগ্রগতির আড়ালে সামাজিক ন্যায়বিচারকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

বাংলাদেশে শ্রমের ‘গিগিফিকেশন’ এক দ্বিমুখী বাস্তবতা। একদিকে এটি শ্রমিকদের জন্য নতুন সুযোগ, আয় ও নমনীয়তা এনে দিয়েছে। অন্যদিকে এটি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অনিশ্চয়তা, বৈষম্য ও শোষণকে স্থায়ী করে তুলছে। তাই শ্রমিকদের প্রকৃত স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতে হলে নীতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপ অপরিহার্য।

গিগ শ্রমিকদের আইনি স্বীকৃতি, সামাজিক সুরক্ষা, সমষ্টিগত দরকষাকষির অধিকার এবং দক্ষতা উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। নগর-গ্রাম উভয় প্রেক্ষাপটে সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে অবকাঠামো ও ডিজিটাল শিক্ষায় বিনিয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি সমবায়ভিত্তিক বা জন-অধিভুক্ত প্ল্যাটফর্ম মডেল চালু করে বৈষম্যমূলক মুনাফা বণ্টন কমাতে হবে।

গিগ অর্থনীতি শুধু অর্থনৈতিক পরিবর্তন নয়, এটি বাংলাদেশের সমাজের জন্য এক গভীর সামাজিক রূপান্তর। তাই স্বাধীনতার মিথকে ভেঙে দিয়ে মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই শ্রম কাঠামো নির্মাণ করাই এখন সময়ের দাবি। এভাবেই বাংলাদেশের ডিজিটাল অর্থনীতি কেবল বেঁচে থাকার উপায় নয়, বরং মর্যাদাপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমৃদ্ধির প্রকৃত হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।

[লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]

back to top