এম এ হোসাইন
চীনের সাম্প্রতিক সিজে-১০০০ হাইপারসনিক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র উন্মোচনে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এক নতুন নিরাপত্তা বাস্তবতার জন্ম দিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ের ৮০তম বার্ষিকীতে আয়োজিত কুচকাওয়াজে এই ক্ষেপণাস্ত্র প্রদর্শন নিছক সামরিক শক্তির প্রদর্শনী ছিল না; এটি ছিল এক সুস্পষ্ট কৌশলগত বার্তা। চীন এভাবে জানিয়ে দিল যে প্রযুক্তিগত সক্ষমতায় তারা এখন পশ্চিমা শক্তির সঙ্গে পাল্লা দিতে প্রস্তুত এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার নির্মাণে তারা এক ধাপ এগিয়ে গেছে।
সিজে-১০০০ বা “লং সোর্ড-১০০০” একটি স্ক্র্যামজেট-চালিত হাইপারসনিক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, যা শব্দের গতির পাঁচ থেকে দশগুণ গতিতে পৃথিবীর বায়ুম-লের ভেতর দিয়ে ছুটে যেতে সক্ষম। প্রচলিত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের মতো এটি পূর্বানুমেয় পথে চলে না; বরং নিচু উচ্চতায় উড়ে মাঝপথে দিক পরিবর্তন করতে পারে এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এড়িয়ে যেতে সক্ষম। এর ফলে আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যেমন থাড, এইজিস বা প্যাট্রিয়ট এই ক্ষেপণাস্ত্রের বিরুদ্ধে প্রায়ই অকার্যকর। চীনের দাবি অনুযায়ী, ক্ষেপণাস্ত্রটির পাল্লা ছয় হাজার কিলোমিটার, যা মূল ভূখ- চীন থেকে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এমনকি গুয়ামে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিতেও আঘাত হানতে সক্ষম। ফলে যে ভৌগোলিক দূরত্ব এতদিন মার্কিন বাহিনীকে সুরক্ষা দিত, তা আর কার্যকর থাকছে না।
চীনের এই প্রযুক্তিগত উন্নয়ন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত শক্তিকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করছে। বহু দশক ধরে প্রশান্ত মহাসাগরে আমেরিকার সামরিক উপস্থিতি নির্ভর করেছে বিমানবাহী রণতরী ও অগ্রবর্তী ঘাঁটির উপর। সেগুলোকে একসময় অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতার প্রতীক ধরা হতো। কিন্তু হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র এই অবস্থানকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। এক আঘাতেই বিমানবাহী রণতরী অকেজো হয়ে পড়ার সম্ভাবনা এখন বাস্তব, যা মার্কিন প্রতিরোধ নীতির জন্য এক বড় ধাক্কা। চীনের অ্যান্টি-অ্যাকসেস/এরিয়া-ডিনায়েল কৌশল তাই নতুন মাত্রা পেয়েছে, যা দক্ষিণ চীন সাগর ও তাইওয়ান প্রণালীতে বিদেশি হস্তক্ষেপ ঠেকাতে কার্যকর হাতিয়ার হয়ে উঠবে।
হাইপারসনিক অস্ত্র মোতায়েনের সবচেয়ে তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়বে এশিয়ার উত্তপ্ত অঞ্চলগুলোতে। তাইওয়ান প্রণালিতে, বেইজিং কতৃক মার্কিন ঘাঁটি ও বিমানবাহী রণতরীতে আঘাত হানার সক্ষমতা ওয়াশিংটনের তাইপেকে দেওয়া নিরাপত্তা নিশ্চয়তাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করছে। প্রতিরক্ষার সমীকরণ চীনের পক্ষে ঝুঁকে পড়ছে, কারণ সম্ভাব্য যেকোনো সংঘাতে দ্রুত উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়ার ঝুঁকি নিয়ে এখন মার্কিন নেতাদের নতুন করে ভাবতে হচ্ছে।
দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা সমীকরণেও হাইপারসনিক প্রযুক্তির অত্যন্ত গভীর প্রভাব পড়েছে। ভারত ইতোমধ্যেই রাশিয়ার সঙ্গে অংশীদারিত্বে হাইপারসনিক প্রযুক্তি উন্নয়নে কাজ করছে, যা পাকিস্তানে নতুন উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। প্রচলিত সামরিক সক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কারণে ইসলামাবাদ হয়তো আরও বেশি করে পারমাণবিক ভীতি প্রদর্শনের উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠবে। এর ফলে উপমহাদেশে সূক্ষ্ম প্রতিরক্ষা ভারসাম্য ভেঙে পড়তে পারে এবং ছোটখাটো সঙ্কটও দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। অন্যদিকে কোরীয় উপদ্বীপেও নতুন হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছে। উত্তর কোরিয়া নিজেদের টিকে থাকার গ্যারান্টি হিসেবে হাইপারসনিক প্রযুক্তি অর্জনের চেষ্টা করবে, আর দক্ষিণ কোরিয়া আরও দৃঢ়ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ছাতার উপর নির্ভরশীল হবে। ফলে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের ত্রিপক্ষীয় নিরাপত্তা সহযোগিতা আরও গভীর হবে, যা চীনের কৌশলগত ভবিষ্যৎ কে জটিল করে তুলবে। সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, হাইপারসনিক যুগ এশিয়ার প্রতিটি উত্তেজনাপূর্ণ অঞ্চলে কূটনীতির সময়সীমা সংকুচিত করছে, পারস্পরিক অবিশ্বাস বাড়াচ্ছে এবং প্রথম আঘাতের ঝুঁকি বহুগুণ বৃদ্ধি করছে।
প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্যেও এই প্রযুক্তি এক নতুন চ্যালেঞ্জ। ইতিহাসে যেমন সবসময় দেখা গেছে, আক্রমণাত্মক সক্ষমতা বাড়লে প্রতিরক্ষাও অভিযোজনে বাধ্য হয়। যুক্তরাষ্ট্র নতুন প্রজন্মের ইন্টারসেপ্টর, যেমন গ্লাইড ব্রেকার, নিয়ে কাজ করছে যা মাঝপথে হাইপারসনিক যান ধ্বংস করার জন্য নকশা করা হয়েছে। রাশিয়া তাদের এস-৫০০ ব্যবস্থা নিয়ে বড়াই করছে, যদিও এর স্বাধীন যাচাই এখনো হয়নি। এদিকে মহাকাশভিত্তিক নজরদারি এখন সবচেয়ে সম্ভাবনাময় সমাধান হিসেবে উঠে আসছে। কারণ হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র অনেক সময় ভূমিতে স্থাপিত রাডারকে ফাঁকি দিতে সক্ষম। উন্নত ইনফ্রারেড সেন্সর-সজ্জিত স্যাটেলাইট এগুলোকে শনাক্ত করতে সক্ষম। পাশাপাশি লেজার ও মাইক্রোওয়েভ প্রযুক্তিনির্ভর নির্দেশিত শক্তি অস্ত্রও উন্নয়নের পর্যায়ে রয়েছে, যা লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছানোর আগেই ক্ষেপণাস্ত্রকে অকার্যকর করতে পারে। তবে এখনো পর্যন্ত কোনো পূর্ণাঙ্গ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। ফলে আপাতত আক্রমণকারীর পক্ষেই সুবিধা বিদ্যমান।
সিজে-১০০০ যে বৈশ্বিক রণকৌশল পুনর্গঠনের প্রথম অস্ত্র নয়, ইতিহাস তার সাক্ষী। বিশ শতকের শুরুতে ব্রিটিশ ড্রেডনট যুদ্ধজাহাজ ইউরোপে নৌ অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু করেছিল, যা শেষ পর্যন্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল। একইভাবে, বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে পারমাণবিক অস্ত্র উদ্ভাবন ঠান্ডা যুদ্ধের প্রতিরক্ষানীতি ও অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার জন্ম দিয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতায় হাইপারসনিক প্রযুক্তিও যুগ পরিবর্তনের মুহূর্ত হয়ে উঠছে, যা আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও নিরাপত্তা কাঠামোকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করবে।
সিজে-১০০০ কেবল একটি ক্ষেপণাস্ত্র নয়Ñচীনের জন্য এটি কৌশলগত অভিপ্রায়ের ঘোষণা। এটি চীনের প্রতিরক্ষা শক্তি জোরদার করবে, এবং এ২/এডি কৌশল সম্প্রসারণ করে এবং অন্যান্য পরাশক্তির সঙ্গে প্রযুক্তিগত তুলনামূলক একটি চিত্র তুলে ধরে। আর অঞ্চলিক ভাবে এটি সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময়সীমাকে সংকুচিত করবে, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে দুর্বল করবে এবং অস্ত্র প্রতিযোগিতাকে আরও ত্বরান্বিত করে।
তবে হাইপারসনিক যুগের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ শুধু প্রযুক্তিগত নয়, কূটনৈতিকও। যদি কোনো ধরনের আন্তর্জাতিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বা সহযোগিতামূলক পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে এই প্রযুক্তি এশিয়ার ভঙ্গুর শান্তিকে সহজেই এক ভুল যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করতে পারে। ইতিহাস আমাদের শেখায়, প্রযুক্তি যখন প্রতিরক্ষার ভারসাম্য ভেঙে দেয়, তখন যুদ্ধের সম্ভাবনা বহুগুণে বেড়ে যায়। তাই আজ এশিয়ার সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হলো প্রতিযোগিতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা, কূটনৈতিক উদ্যোগ বাড়ানো এবং শান্তির কাঠামোকে শক্তিশালী করা। অন্যথায়, হাইপারসনিক যুগ কেবল সামরিক শক্তির নতুন অধ্যায় নয়, এশিয়ার জন্য এক বিপজ্জনক ভবিষ্যতের পূর্বাভাস হয়ে দাঁড়াবে।
[লেখক : প্রাবন্ধিক]
এম এ হোসাইন
রোববার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫
চীনের সাম্প্রতিক সিজে-১০০০ হাইপারসনিক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র উন্মোচনে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এক নতুন নিরাপত্তা বাস্তবতার জন্ম দিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ের ৮০তম বার্ষিকীতে আয়োজিত কুচকাওয়াজে এই ক্ষেপণাস্ত্র প্রদর্শন নিছক সামরিক শক্তির প্রদর্শনী ছিল না; এটি ছিল এক সুস্পষ্ট কৌশলগত বার্তা। চীন এভাবে জানিয়ে দিল যে প্রযুক্তিগত সক্ষমতায় তারা এখন পশ্চিমা শক্তির সঙ্গে পাল্লা দিতে প্রস্তুত এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার নির্মাণে তারা এক ধাপ এগিয়ে গেছে।
সিজে-১০০০ বা “লং সোর্ড-১০০০” একটি স্ক্র্যামজেট-চালিত হাইপারসনিক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, যা শব্দের গতির পাঁচ থেকে দশগুণ গতিতে পৃথিবীর বায়ুম-লের ভেতর দিয়ে ছুটে যেতে সক্ষম। প্রচলিত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের মতো এটি পূর্বানুমেয় পথে চলে না; বরং নিচু উচ্চতায় উড়ে মাঝপথে দিক পরিবর্তন করতে পারে এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এড়িয়ে যেতে সক্ষম। এর ফলে আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যেমন থাড, এইজিস বা প্যাট্রিয়ট এই ক্ষেপণাস্ত্রের বিরুদ্ধে প্রায়ই অকার্যকর। চীনের দাবি অনুযায়ী, ক্ষেপণাস্ত্রটির পাল্লা ছয় হাজার কিলোমিটার, যা মূল ভূখ- চীন থেকে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এমনকি গুয়ামে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিতেও আঘাত হানতে সক্ষম। ফলে যে ভৌগোলিক দূরত্ব এতদিন মার্কিন বাহিনীকে সুরক্ষা দিত, তা আর কার্যকর থাকছে না।
চীনের এই প্রযুক্তিগত উন্নয়ন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত শক্তিকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করছে। বহু দশক ধরে প্রশান্ত মহাসাগরে আমেরিকার সামরিক উপস্থিতি নির্ভর করেছে বিমানবাহী রণতরী ও অগ্রবর্তী ঘাঁটির উপর। সেগুলোকে একসময় অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতার প্রতীক ধরা হতো। কিন্তু হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র এই অবস্থানকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। এক আঘাতেই বিমানবাহী রণতরী অকেজো হয়ে পড়ার সম্ভাবনা এখন বাস্তব, যা মার্কিন প্রতিরোধ নীতির জন্য এক বড় ধাক্কা। চীনের অ্যান্টি-অ্যাকসেস/এরিয়া-ডিনায়েল কৌশল তাই নতুন মাত্রা পেয়েছে, যা দক্ষিণ চীন সাগর ও তাইওয়ান প্রণালীতে বিদেশি হস্তক্ষেপ ঠেকাতে কার্যকর হাতিয়ার হয়ে উঠবে।
হাইপারসনিক অস্ত্র মোতায়েনের সবচেয়ে তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়বে এশিয়ার উত্তপ্ত অঞ্চলগুলোতে। তাইওয়ান প্রণালিতে, বেইজিং কতৃক মার্কিন ঘাঁটি ও বিমানবাহী রণতরীতে আঘাত হানার সক্ষমতা ওয়াশিংটনের তাইপেকে দেওয়া নিরাপত্তা নিশ্চয়তাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করছে। প্রতিরক্ষার সমীকরণ চীনের পক্ষে ঝুঁকে পড়ছে, কারণ সম্ভাব্য যেকোনো সংঘাতে দ্রুত উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়ার ঝুঁকি নিয়ে এখন মার্কিন নেতাদের নতুন করে ভাবতে হচ্ছে।
দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা সমীকরণেও হাইপারসনিক প্রযুক্তির অত্যন্ত গভীর প্রভাব পড়েছে। ভারত ইতোমধ্যেই রাশিয়ার সঙ্গে অংশীদারিত্বে হাইপারসনিক প্রযুক্তি উন্নয়নে কাজ করছে, যা পাকিস্তানে নতুন উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। প্রচলিত সামরিক সক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কারণে ইসলামাবাদ হয়তো আরও বেশি করে পারমাণবিক ভীতি প্রদর্শনের উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠবে। এর ফলে উপমহাদেশে সূক্ষ্ম প্রতিরক্ষা ভারসাম্য ভেঙে পড়তে পারে এবং ছোটখাটো সঙ্কটও দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। অন্যদিকে কোরীয় উপদ্বীপেও নতুন হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছে। উত্তর কোরিয়া নিজেদের টিকে থাকার গ্যারান্টি হিসেবে হাইপারসনিক প্রযুক্তি অর্জনের চেষ্টা করবে, আর দক্ষিণ কোরিয়া আরও দৃঢ়ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ছাতার উপর নির্ভরশীল হবে। ফলে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের ত্রিপক্ষীয় নিরাপত্তা সহযোগিতা আরও গভীর হবে, যা চীনের কৌশলগত ভবিষ্যৎ কে জটিল করে তুলবে। সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, হাইপারসনিক যুগ এশিয়ার প্রতিটি উত্তেজনাপূর্ণ অঞ্চলে কূটনীতির সময়সীমা সংকুচিত করছে, পারস্পরিক অবিশ্বাস বাড়াচ্ছে এবং প্রথম আঘাতের ঝুঁকি বহুগুণ বৃদ্ধি করছে।
প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্যেও এই প্রযুক্তি এক নতুন চ্যালেঞ্জ। ইতিহাসে যেমন সবসময় দেখা গেছে, আক্রমণাত্মক সক্ষমতা বাড়লে প্রতিরক্ষাও অভিযোজনে বাধ্য হয়। যুক্তরাষ্ট্র নতুন প্রজন্মের ইন্টারসেপ্টর, যেমন গ্লাইড ব্রেকার, নিয়ে কাজ করছে যা মাঝপথে হাইপারসনিক যান ধ্বংস করার জন্য নকশা করা হয়েছে। রাশিয়া তাদের এস-৫০০ ব্যবস্থা নিয়ে বড়াই করছে, যদিও এর স্বাধীন যাচাই এখনো হয়নি। এদিকে মহাকাশভিত্তিক নজরদারি এখন সবচেয়ে সম্ভাবনাময় সমাধান হিসেবে উঠে আসছে। কারণ হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র অনেক সময় ভূমিতে স্থাপিত রাডারকে ফাঁকি দিতে সক্ষম। উন্নত ইনফ্রারেড সেন্সর-সজ্জিত স্যাটেলাইট এগুলোকে শনাক্ত করতে সক্ষম। পাশাপাশি লেজার ও মাইক্রোওয়েভ প্রযুক্তিনির্ভর নির্দেশিত শক্তি অস্ত্রও উন্নয়নের পর্যায়ে রয়েছে, যা লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছানোর আগেই ক্ষেপণাস্ত্রকে অকার্যকর করতে পারে। তবে এখনো পর্যন্ত কোনো পূর্ণাঙ্গ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। ফলে আপাতত আক্রমণকারীর পক্ষেই সুবিধা বিদ্যমান।
সিজে-১০০০ যে বৈশ্বিক রণকৌশল পুনর্গঠনের প্রথম অস্ত্র নয়, ইতিহাস তার সাক্ষী। বিশ শতকের শুরুতে ব্রিটিশ ড্রেডনট যুদ্ধজাহাজ ইউরোপে নৌ অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু করেছিল, যা শেষ পর্যন্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল। একইভাবে, বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে পারমাণবিক অস্ত্র উদ্ভাবন ঠান্ডা যুদ্ধের প্রতিরক্ষানীতি ও অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার জন্ম দিয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতায় হাইপারসনিক প্রযুক্তিও যুগ পরিবর্তনের মুহূর্ত হয়ে উঠছে, যা আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও নিরাপত্তা কাঠামোকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করবে।
সিজে-১০০০ কেবল একটি ক্ষেপণাস্ত্র নয়Ñচীনের জন্য এটি কৌশলগত অভিপ্রায়ের ঘোষণা। এটি চীনের প্রতিরক্ষা শক্তি জোরদার করবে, এবং এ২/এডি কৌশল সম্প্রসারণ করে এবং অন্যান্য পরাশক্তির সঙ্গে প্রযুক্তিগত তুলনামূলক একটি চিত্র তুলে ধরে। আর অঞ্চলিক ভাবে এটি সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময়সীমাকে সংকুচিত করবে, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে দুর্বল করবে এবং অস্ত্র প্রতিযোগিতাকে আরও ত্বরান্বিত করে।
তবে হাইপারসনিক যুগের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ শুধু প্রযুক্তিগত নয়, কূটনৈতিকও। যদি কোনো ধরনের আন্তর্জাতিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বা সহযোগিতামূলক পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে এই প্রযুক্তি এশিয়ার ভঙ্গুর শান্তিকে সহজেই এক ভুল যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করতে পারে। ইতিহাস আমাদের শেখায়, প্রযুক্তি যখন প্রতিরক্ষার ভারসাম্য ভেঙে দেয়, তখন যুদ্ধের সম্ভাবনা বহুগুণে বেড়ে যায়। তাই আজ এশিয়ার সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হলো প্রতিযোগিতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা, কূটনৈতিক উদ্যোগ বাড়ানো এবং শান্তির কাঠামোকে শক্তিশালী করা। অন্যথায়, হাইপারসনিক যুগ কেবল সামরিক শক্তির নতুন অধ্যায় নয়, এশিয়ার জন্য এক বিপজ্জনক ভবিষ্যতের পূর্বাভাস হয়ে দাঁড়াবে।
[লেখক : প্রাবন্ধিক]