কবির উদ্দিন
প্রতি বছর ২৭শে সেপ্টেম্বর বিশ্ব পর্যটন দিবস উদ্যাপিত হয়। এটি শুধু আনন্দের দিন নয়, বরং পর্যটন খাতের সম্ভাবনা, চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা নিয়ে ভাবার সময়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই দিবসটি আরও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আমাদের দেশে অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও পর্যটন খাত এখনো তার পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারেনি। এর অন্যতম কারণ হলো পর্যটন-সম্পর্কিত শিক্ষা ও সচেতনতার ঘাটতি।
বাংলাদেশে পর্যটনের অন্যতম বড় সমস্যা হলো দায়িত্বশীল পর্যটক ও দক্ষ ব্যবস্থাপকের সদিচ্ছার অভাব। পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে যত্রতত্র ময়লা ফেলা এখন এক সাধারণ দৃশ্য। প্লাস্টিকের বোতল, খাবারের প্যাকেট কিংবা বাদামের খোসাÑএসব যেন আমাদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনিবার্য অংশে পরিণত হয়েছে। অথচ প্রায় প্রতিটি স্থানে ডাস্টবিন রয়েছে এবং পরিচ্ছন্নতা কর্মীরাও নিয়মিত কাজ করেন। তবুও কিছু পর্যটক নিজেরাই ময়লা ফেলেন, আবার নিজেই ময়লা ফেলার জন্য অন্যকে ধমক দেন। এই আচরণগত অসচেতনতার কারণে প্রতিদিনই পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে শুধু দেশি পর্যটকের বিরক্তি বাড়ছে না, বিদেশি পর্যটকদের কাছেও বাংলাদেশের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণœ হচ্ছে। পর্যটন শিক্ষার অন্যতম মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত পরিবেশের প্রতি সংবেদনশীলতা তৈরি করা। যখন আমরা সবাই দায়িত্বশীল আচরণ করব, তখনই পর্যটন হবে টেকসই ও বিশ্বমানের।
বাংলাদেশের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত হলেও আমরা এর সম্ভাবনার অল্প অংশই ব্যবহার করতে পেরেছি। আজ এটি মূলত সূর্যস্নান তো দূরের কথা, ছুটি কাটিয়ে সাগরে পা ভিজানোর জায়গা হিসেবেও পরিচিত। অথচ হাঙরমুক্ত সাগর ও বালুকাময় সৈকত সার্ফিং-এর মতো অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের জন্য এটিকে একটি অনন্য স্থান । কিন্তু আমরা এখনো সার্ফিংকে বিশ্বমানের ব্র্যান্ডিং করতে পারিনি। এর মূল কারণ হলো প্রশিক্ষণ, প্রচার ও পরিকল্পনার অভাব। পর্যটনকে শিক্ষায় রূপান্তর করার মানে হলো এমন সুযোগগুলো চিহ্নিত করা এবং দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা।
শুধু অবকাঠামো উন্নয়ন করলেই বিদেশি পর্যটক আকর্ষণ করা সম্ভব নয়। দামি ও আধুনিক ভবন তাদের নিজ দেশেই প্রচুর আছে। তারা কেবল দৃশ্য দেখতে আসে না; বরং চায় নির্ঝঞ্ঝাট ও আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা। কিন্তু বাংলাদেশে এসে অনেকেই নানা ঝামেলার সম্মুখীন হন। অযাচিত ছবি তোলার আবদার, পিছু নেওয়া কিংবা অপ্রয়োজনীয় ভিড়Ñএসব আচরণ বিদেশি পর্যটকদের জন্য অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি করে। আরও খারাপ অভিজ্ঞতা শুরু হয় বিমানবন্দর থেকেই, যেখানে ট্যাক্সি জট এবং শহরে প্রবেশের বিশৃঙ্খল যাতায়াত ব্যবস্থা তাদের প্রথম ধারণাকে নেতিবাচক করে তোলে। পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে এসব সমস্যা সমাধান করা জরুরি, আর এর মূল চাবিকাঠি হলো পর্যটন-সম্পর্কিত শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি।
পর্যটন কর্পোরেশনের পুরনো মোটেলগুলো এখন জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। নতুন হোটেল-মোটেল নির্মাণের পাশাপাশি পুরোনো অবকাঠামোর আধুনিকায়ন জরুরি। তবে অবকাঠামো নির্মাণই যথেষ্ট নয়; সেবার মান নিশ্চিত করাও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য দক্ষ জনবল তৈরি, আন্তর্জাতিক মানদ-ে প্রশিক্ষণ এবং পর্যটন ব্যবস্থাপনায় পেশাদারিত্ব আনা দরকার। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, যারা পর্যটন খাতকে এগিয়ে নিতে চান, তাদের নিজেদের পর্যটক হিসেবে অন্য দেশে ভ্রমণ করা উচিত। এতে তারা বুঝতে পারবেন একজন পর্যটকের প্রকৃত চাহিদা ও প্রত্যাশা কী।
পর্যটন কেবল অর্থনৈতিক খাত নয়, এটি বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের মধ্যে যোগাযোগ ও বোঝাপড়ার একটি সেতুবন্ধন। বিদেশি পর্যটকরা যখন আমাদের দেশে আসেন, তখন তারা আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং জীবনযাপন সম্পর্কে জানতে পারেন। একইভাবে আমরা তাদের কাছ থেকেও শিখি। এই পারস্পরিক বোঝাপড়া আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করে এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্েযর প্রতি সম্মান বাড়ায়। বাংলাদেশে কাপ্তাই লেক বা সুন্দরবনের মতো অনন্য পর্যটন সম্পদ রয়েছে, যেগুলোকে সহজেই বিশ্বমানের গন্তব্যে রূপান্তর করা সম্ভব। তবে এর জন্য প্রয়োজন সমন্বিত শিক্ষা ও সচেতনতা। স্থানীয় মানুষ, পর্যটন কর্মী এবং নীতিনির্ধারকÑসবাইকে পর্যটন বিষয়ে সঠিক জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ নিতে হবে। শিক্ষা কেবল তত্ত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি আচরণগত পরিবর্তন, পরিবেশের প্রতি সংবেদনশীলতা এবং অতিথিপরায়ণতার চর্চা শেখায়।
পর্যটন খাত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের এক গুরুত্বপূর্ণ উৎস হতে পারে। তবে এটি তখনই সম্ভব হবে, যখন আমরা পর্যটনকে শিক্ষার মাধ্যমে রূপান্তর করব। আমাদের প্রতিজ্ঞা হোকÑপরিবেশ রক্ষা, দায়িত্বশীল আচরণ, অতিথিপরায়ণতা এবং প্রযুক্তির সুচারু ব্যবহারকে ভিত্তি করে পর্যটনকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া। তবেই বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে একটি আকর্ষণীয় পর্যটন গন্তব্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। সবচেয়ে বড় কথা, বই পড়ে আমরা যা শিখতে পারি না, ভ্রমণ ও পর্যটনের মাধ্যমে যেন তা শিখতে পারিÑএই হোক বিশ্ব পর্যটন দিবসে আমাদের অঙ্গীকার।
[লেখক: ভৌগোলিক তথ্য ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ , ইসিমোড, নেপাল]
কবির উদ্দিন
রোববার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫
প্রতি বছর ২৭শে সেপ্টেম্বর বিশ্ব পর্যটন দিবস উদ্যাপিত হয়। এটি শুধু আনন্দের দিন নয়, বরং পর্যটন খাতের সম্ভাবনা, চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা নিয়ে ভাবার সময়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই দিবসটি আরও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আমাদের দেশে অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও পর্যটন খাত এখনো তার পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারেনি। এর অন্যতম কারণ হলো পর্যটন-সম্পর্কিত শিক্ষা ও সচেতনতার ঘাটতি।
বাংলাদেশে পর্যটনের অন্যতম বড় সমস্যা হলো দায়িত্বশীল পর্যটক ও দক্ষ ব্যবস্থাপকের সদিচ্ছার অভাব। পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে যত্রতত্র ময়লা ফেলা এখন এক সাধারণ দৃশ্য। প্লাস্টিকের বোতল, খাবারের প্যাকেট কিংবা বাদামের খোসাÑএসব যেন আমাদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনিবার্য অংশে পরিণত হয়েছে। অথচ প্রায় প্রতিটি স্থানে ডাস্টবিন রয়েছে এবং পরিচ্ছন্নতা কর্মীরাও নিয়মিত কাজ করেন। তবুও কিছু পর্যটক নিজেরাই ময়লা ফেলেন, আবার নিজেই ময়লা ফেলার জন্য অন্যকে ধমক দেন। এই আচরণগত অসচেতনতার কারণে প্রতিদিনই পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে শুধু দেশি পর্যটকের বিরক্তি বাড়ছে না, বিদেশি পর্যটকদের কাছেও বাংলাদেশের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণœ হচ্ছে। পর্যটন শিক্ষার অন্যতম মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত পরিবেশের প্রতি সংবেদনশীলতা তৈরি করা। যখন আমরা সবাই দায়িত্বশীল আচরণ করব, তখনই পর্যটন হবে টেকসই ও বিশ্বমানের।
বাংলাদেশের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত হলেও আমরা এর সম্ভাবনার অল্প অংশই ব্যবহার করতে পেরেছি। আজ এটি মূলত সূর্যস্নান তো দূরের কথা, ছুটি কাটিয়ে সাগরে পা ভিজানোর জায়গা হিসেবেও পরিচিত। অথচ হাঙরমুক্ত সাগর ও বালুকাময় সৈকত সার্ফিং-এর মতো অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের জন্য এটিকে একটি অনন্য স্থান । কিন্তু আমরা এখনো সার্ফিংকে বিশ্বমানের ব্র্যান্ডিং করতে পারিনি। এর মূল কারণ হলো প্রশিক্ষণ, প্রচার ও পরিকল্পনার অভাব। পর্যটনকে শিক্ষায় রূপান্তর করার মানে হলো এমন সুযোগগুলো চিহ্নিত করা এবং দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা।
শুধু অবকাঠামো উন্নয়ন করলেই বিদেশি পর্যটক আকর্ষণ করা সম্ভব নয়। দামি ও আধুনিক ভবন তাদের নিজ দেশেই প্রচুর আছে। তারা কেবল দৃশ্য দেখতে আসে না; বরং চায় নির্ঝঞ্ঝাট ও আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা। কিন্তু বাংলাদেশে এসে অনেকেই নানা ঝামেলার সম্মুখীন হন। অযাচিত ছবি তোলার আবদার, পিছু নেওয়া কিংবা অপ্রয়োজনীয় ভিড়Ñএসব আচরণ বিদেশি পর্যটকদের জন্য অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি করে। আরও খারাপ অভিজ্ঞতা শুরু হয় বিমানবন্দর থেকেই, যেখানে ট্যাক্সি জট এবং শহরে প্রবেশের বিশৃঙ্খল যাতায়াত ব্যবস্থা তাদের প্রথম ধারণাকে নেতিবাচক করে তোলে। পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে এসব সমস্যা সমাধান করা জরুরি, আর এর মূল চাবিকাঠি হলো পর্যটন-সম্পর্কিত শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি।
পর্যটন কর্পোরেশনের পুরনো মোটেলগুলো এখন জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। নতুন হোটেল-মোটেল নির্মাণের পাশাপাশি পুরোনো অবকাঠামোর আধুনিকায়ন জরুরি। তবে অবকাঠামো নির্মাণই যথেষ্ট নয়; সেবার মান নিশ্চিত করাও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য দক্ষ জনবল তৈরি, আন্তর্জাতিক মানদ-ে প্রশিক্ষণ এবং পর্যটন ব্যবস্থাপনায় পেশাদারিত্ব আনা দরকার। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, যারা পর্যটন খাতকে এগিয়ে নিতে চান, তাদের নিজেদের পর্যটক হিসেবে অন্য দেশে ভ্রমণ করা উচিত। এতে তারা বুঝতে পারবেন একজন পর্যটকের প্রকৃত চাহিদা ও প্রত্যাশা কী।
পর্যটন কেবল অর্থনৈতিক খাত নয়, এটি বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের মধ্যে যোগাযোগ ও বোঝাপড়ার একটি সেতুবন্ধন। বিদেশি পর্যটকরা যখন আমাদের দেশে আসেন, তখন তারা আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং জীবনযাপন সম্পর্কে জানতে পারেন। একইভাবে আমরা তাদের কাছ থেকেও শিখি। এই পারস্পরিক বোঝাপড়া আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করে এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্েযর প্রতি সম্মান বাড়ায়। বাংলাদেশে কাপ্তাই লেক বা সুন্দরবনের মতো অনন্য পর্যটন সম্পদ রয়েছে, যেগুলোকে সহজেই বিশ্বমানের গন্তব্যে রূপান্তর করা সম্ভব। তবে এর জন্য প্রয়োজন সমন্বিত শিক্ষা ও সচেতনতা। স্থানীয় মানুষ, পর্যটন কর্মী এবং নীতিনির্ধারকÑসবাইকে পর্যটন বিষয়ে সঠিক জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ নিতে হবে। শিক্ষা কেবল তত্ত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি আচরণগত পরিবর্তন, পরিবেশের প্রতি সংবেদনশীলতা এবং অতিথিপরায়ণতার চর্চা শেখায়।
পর্যটন খাত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের এক গুরুত্বপূর্ণ উৎস হতে পারে। তবে এটি তখনই সম্ভব হবে, যখন আমরা পর্যটনকে শিক্ষার মাধ্যমে রূপান্তর করব। আমাদের প্রতিজ্ঞা হোকÑপরিবেশ রক্ষা, দায়িত্বশীল আচরণ, অতিথিপরায়ণতা এবং প্রযুক্তির সুচারু ব্যবহারকে ভিত্তি করে পর্যটনকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া। তবেই বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে একটি আকর্ষণীয় পর্যটন গন্তব্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। সবচেয়ে বড় কথা, বই পড়ে আমরা যা শিখতে পারি না, ভ্রমণ ও পর্যটনের মাধ্যমে যেন তা শিখতে পারিÑএই হোক বিশ্ব পর্যটন দিবসে আমাদের অঙ্গীকার।
[লেখক: ভৌগোলিক তথ্য ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ , ইসিমোড, নেপাল]