alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

দোসর, বাই ডিফল্ট!

আনোয়ারুল হক

: শুক্রবার, ১৭ অক্টোবর ২০২৫

সাম্প্রতিক সময়ে কিছু কিছু অনুষ্ঠান, সভা হঠাৎ করে বন্ধ বা বাতিল হয়ে যাচ্ছে। কোনোটা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা সভাস্থলের কতৃপক্ষ বন্ধ করে দিচ্ছে এই যুক্তিতে যে, অনুষ্ঠানটি করার মাধ্যমে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টার অভিযোগ এসেছে বা অনুষ্ঠান ঘিরে হাঙ্গামার আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাই অনুষ্ঠান করা যাবে না। আবার কখনো বলা হচ্ছে আয়োজকদের মধ্যে ‘আওয়ামী দোসর’ আছে।

প্রতিদিন এত দোসরের উদ্ভব কোথা থেকে হচ্ছে? দোসরমুক্ত দেশ গড়ার জন্য সেই ফেব্রুয়ারি মাস থেকে অপারেশন ‘ডেভিল হান্ট’ শুরু হয়েছে এবং হাজারে হাজারে ‘আওয়ামী ডেভিল ও দোসর’কে গ্রেপ্তার করে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। তারপরেও কেনো সরকার, তৌহিদী জনতা, ‘ফ্যাসিবাদ’ বিরোধী অসংখ্য ‘মব মঞ্চ’ মিলিতভাবেও দেশকে দোসর ও ডেভিলমুক্ত করতে পারছে না?

এ ধরনের অভিযোগে চারুকলার বকুলতলায় আয়োজিত শরৎ উৎসব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বন্ধ করে দেয়, এবং পরবর্তীতে স্থান পরিবর্তন করে গেন্ডারিয়ায় কিশলয় কচি-কাঁচার মেলার মাঠে আয়োজন করার চেষ্টা করা হলে পুলিশ বন্ধ করে দেয়। দিন কয়েক আগে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের মিলনায়তনে আয়োজিত ‘রবীন্দ্র স্মরণ দ্রোহে, জাগরণে রবীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠান আয়োজকদের মধ্যে ‘দোসর’ আছে এ অভিযোগ তুলে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের সামনে ১০/১২ জনের ‘ফ্যাসিবাদ বিরোধী’ মব সংগঠিত হলে কতৃপক্ষ অনুষ্ঠানটি করার অনুমতি বাতিল করতে বাধ্য হয়।আরো কয়েকদিন পূর্বে ‘দোসর’রা আড্ডা দেয় অভিযোগ তুলে উত্তরায় একটি উন্মুক্ত লাইব্রেরি ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়।

উপরে উল্লিখিত অনুষ্ঠানের আয়োজক ‘দোসররা’ সৌভাগ্যবান যে তাদের কাউকেই খুনের মামলা বা সন্ত্রাস বিরোধী আইনে গ্রেফতার করা হয় নি। কিন্তু কিছুদিন আগে মুক্তিযুদ্ধ আর সংবিধান বিষয়ক এক আলোচনা সভায় অংশ নেওয়ার পর দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা বা মব তৈরি করে হেনস্তা করা হয় মুক্তিযোদ্ধা লতিফ সিদ্দিকীকে। অভিযোগ তোলা হয় যে তিনি আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রী ছিলেন এবং ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’। অথচ ২০১৫ সালেই তাকে দল থেকে বহিষ্কার করে আওয়ামী লীগ। জুলাই আন্দোলনের শুরুর দিক থেকেই দেন সরাসরি সমর্থন। মব সৃষ্টি করা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে হেনস্তার শিকার ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেই সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দেওয়া হয় মামলা, এবং দোসর হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা লতিফ সিদ্দিকী, সাবেক সচিব আবু আলম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক হাফিজুর রহমান কার্জনসহ আরো অনেককেই নেওয়া হয় কারাগারে।

সামাজিক মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলাপ তুললেই কাউকে ‘আওয়ামী লীগের দোসর’ ট্যাগ দিয়ে হেনস্তা ও ব্যক্তিগত আক্রমণের ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে জামায়াত-শিবিরের ভূমিকা ও এনসিপি নেতৃত্বের কারো কারো মন্তব্য নিয়ে এক সময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা, মুক্তিযোদ্ধা ও বিএনপি নেতা ফজলুর রহমানের বাসার সামনে জামায়াত ও এনসিপির কর্মীরা মব তৈরি করে। পুলিশ দীর্ঘ সময় যাবত এই মব সৃষ্টিকারীদের তার বাসার সামনে অরাজকতা এবং আপত্তিকর শ্লোগান দেয়ার সুযোগ করে দেয়। পরবর্তীতে দেখা যায় এই মব সৃষ্টিকারীদের অধিকাংশই দূস্কৃতিকারীও বটে। কেউ কেউ চাঁদাবাজি করতে যেয়ে গ্রেপ্তারও হয়েছে। মাস দুই আগে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও মহানগর বিএনপির সাবেক সহসভাপতি আতাউর রহমান মুকুলকে ‘আওয়ামী লীগের দোসর’ আখ্যা দিয়ে মারধর ও জামাকাপড় ছিঁড়ে লাঞ্ছিত করার ঘটনা ঘটেছিল।

প্রশ্ন হলো, প্রতিদিন এত দোসরের উদ্ভব কোথা থেকে হচ্ছে? দোসরমুক্ত দেশ গড়ার জন?্য সেই ফেব্রুয়ারি মাস থেকে অপারেশন ‘ডেভিল হান্ট’ শুরু হয়েছে এবং হাজারে হাজারে ‘আওয়ামী ডেভিল ও দোসর’কে গ্রেপ্তার করে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। তারপরেও কেনো সরকার, তৌহিদী জনতা, ‘ফ্যাসিবাদ’ বিরোধী অসংখ্যা ‘মব মঞ্চ’ মিলিতভাবেও দেশকে দোসর ও ডেভিলমুক্ত করতে পারছে না? প্রধান কারণ রাজনীতির সাথে থাকুক না থাকুক, আওয়ামী সমর্থক হোক বা আওয়ামী বিরোধী হোক দেশের বুকে প্রগতিবাদী, উদার, মুক্তমনা, অসাম্প্রদায়িক এবং বাংলাদেশের জন্মযুদ্ধের প্রতি অনুগত ও শ্রদ্ধাশীল মানুষ তো কোটি কোটি। বর্তমান বয়ান অনুযায়ী-ই তো তারা সব দোসর। তবে ‘বাই ডিফল্ট দোসর’!

সারা বাংলাদেশ জানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে এক বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন।তিনি রাজনৈতিক দল না করলেও সকল সময় আওয়ামী বলয়ের বাইরে ছিলেন ও আছেন। তাকে পর্যন্ত বলতে হচ্ছে, ‘আমাদের অনেক সদস্যকেই আলাদাভাবে টার্গেট করে ধর্মবিদ্বেষী, শাহবাগী,আওয়ামী দোসর এসব বলে ট্যাগ দেয়া হচ্ছে। জবাবদিহিতা চাইলে কেউ আওয়ামী দোসর ট্যাগ দিলে দেবে’। অনেকটা একই কথা বলেছেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেছেন, ‘যারা মুক্তিযুদ্ধকে আক্রমণ করতে চায় তাদের জন্য এটা খুব সহজ যে আওয়ামী লীগ বিরোধিতার নামে তারা মুক্তিযুদ্ধকেই খারিজ করে দিতে চায় এবং সেই চেষ্টাই তারা করছে এখন পর্যন্ত’। সে চেষ্টার এক প্রকার কৌশল এই ‘দোসর ট্যগ’। শেখ হাসিনার পদত্যাগ দাবি করে সেদিনের সেই ঐতিহাসিক দ্রোহযাত্রার প্রধান মুখ আনু মুহাম্মদকেও কি দোসর বলবেন?

গত বছর ৫ আগস্টের পর ঢাকাসহ সারা দেশ থেকেই শেখ মুজিবের ভাস্কর্য ও স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলা হয়েছে। তারপরেও এই ২০২৫-এ ১৫ আগস্টের ৫০ বছর পূর্তিতে মুজিবের একজন সমালোচক প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ইতিহাসের নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে পত্রিকায় কলাম লিখলেন। সেখানে তিনি লিখেছেন “সত্তরের নির্বাচন ও মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে একজীবনে শেখ মুজিব জনপ্রিয়তার যে শীর্ষে পৌঁছেছিলেন, অন্য কোনো বাঙালি নেতার পক্ষে সেখানে পৌঁছা সম্ভব হয়নি। যতই মুছে ফেলার চেষ্টা হোক; ইতিহাসে তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’ হিসেবেই টিকে থাকবেন। মহাকাব্যের এই নায়কের মৃত্যু নেই। ভিন্ন নায়কেরা হয়তো আসবেন, ভিন্ন রূপে। কিন্তু তাকে সরিয়ে দিয়ে নয়, তার কাজটা যেখানে এসে থেমে গেছে, সেখান থেকে ওই ধারাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে।” এখন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকেও কি দোসর বলবেন? মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের নেতার পক্ষে লিখেছেন।বাই ডিফল্ট দোসর তো বটেই!

সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় সম্মাননায় ভূষিত হলেন কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন। এটা খুবই ভালো সংবাদ হলেও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কি কোনো ভুল করে ফেললো? সাবিনা ইয়াসমিন মুজিব শতবর্ষের অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার উপস্থিতিতে বেশ কয়েকটি গান পরিবেশন করেছিলেন। এছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি গাইতেন, ‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত, বঙ্গবন্ধু মরে নাই ...’ গানটি। শুধু তাই নয়, তিনি তো বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ‘নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্র লীগের সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭০-এর ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে তিনি রোকেয়া হল ছাত্রী সংসদে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন (অবশ্য ঐ পদে বিজয়ী হয়েছিলেন ছাত্র ইউনিয়ন প্রার্থী নৃত্যশিল্পী লায়লা হাসান)। দেশের এই গুণী শিল্পীও কি বাই ডিফল্ট দোসর নন? কিন্ত তার আকাশছোঁয়া কীর্তি আর সাফল্য এমন জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে হয়তো মনে অনেক কষ্ট নিয়েও এই ‘দোসর’কে রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত করতে হচ্ছে।

আবার এক ধরনের দোসরদের মধ্যে প্রকারভেদ আছে। যেমন ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ চলচ্চিত্রে শেখ হাসিনার চরিত্রে অভিনয় করে নুসরাত ফারিয়া দোসর হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গ্রেপ্তার হয়ে জেলখানা ঘুরে এসেছেন। শেখ মুজিব চরিত্রে অভিনয় করে দোসর উপাধি পেয়েছেন আরিফিন শুভ। অন্যদিকে ফজিলাতুন্নেছা মুজিব চরিত্রে অভিনয় করেও অভিনেত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশা বীরদর্পে উপদেষ্টা স্বামীর সঙ্গে ‘জুলাই যোদ্ধাদের’ কাতারে আছেন। ফজলুর রহমান বাবু খন্দকার মোশতাকের চরিত্রে অভিনয় করায় তাকে ‘সূর্য সন্তান’ উপাধি দেওয়া হয়েছে কিনা জানা যায়নি! ‘বৈষম্যমুক্ত অন্তর্বর্তী সরকার’ এই চলচ্চিত্রে অভিনয়ের অপরাধে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমুক্ত সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়নি।

আসলে এই ‘দোসর দোসর নাটকের’ উদ্দেশ্য একটাই- যা অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের ভাষায় “মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ও তাদের উত্তরসূরিদের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয় নাই। সেই কারণে, মুক্তিযুদ্ধকে আক্রমণ করা তাদের প্রতিহিংসার মধ্য থেকে আসে এবং একইসঙ্গে তাদের মতাদর্শিক অবস্থানকে সামনে আরও অগ্রসর করার জন্য তারা রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে এটাকে ব্যবহার করে”। আসলে এই দোসর নাটক একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ ও অন্যায়কে না মুছতে পারলেও অন্তত ঢেকে রাখার একটা প্রয়াস।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ‘দোসর’ সংখ্যার আধিক্য। কোনোভাবেই নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রকৃত আওয়ামী দোসররা তো মাঠে নেই। ওরা আগেও দলীয় কাজ অপেক্ষা বরং নেত্রীর আশেপাশে ঘুরঘুর করতে পছন্দ করতেন। আর এখন ঘুর ঘুর করতে না পারলেও নেত্রীর অবস্থানের আশেপাশেই আছেন দলে দলে, হাজারে হাজারে। কিন্ত বাই ডিফল্ট দোসরেরা দেশেই আছেন। তারা বাই ডিফল্ট মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের দোসর হিসাবেই থাকবেন। ‘কলিজা ছিঁড়ে ফেললেও’ থাকবেন।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

[লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা]

কমরেড ইলা মিত্রের শততম জন্মজয়ন্তী

কত মৃত্যু হলে জাগবে বিবেক?

বৈষম্যের বিবিধ মুখ

মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় জরুরি আইনি সহায়তা

গাজা : এখন শান্তি রক্ষা করবে কে?

জমি কেনা দাগে দাগে কিন্তু ভোগদখল একদাগে

রাষ্ট্র কি শুধু শিক্ষকদের বেলায় এসে দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে?

শতরঞ্জ কি খিলাড়ী

শিক্ষক থাকে রাজপথে, আর পুলিশ ছাড়ে থানা

উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা : স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবিষ্যৎ কী?

ছবি

শ্লীলতা, অশ্লীলতার রাজনৈতিক সংস্কৃতি

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: অবক্ষয়ের চোরাবালিতে আলোর দিশারী

অটোমেশন ও দেশের যুব কর্মসংস্থানের ভবিষ্যৎ

দুর্যোগে ভয় নয়, প্রস্তুতিই শক্তি

বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন

ছবি

‘আল্লাহ তুই দেহিস’: এ কোন ঘৃণার আগুন, ছড়িয়ে গেল সবখানে!

চেকের মামলায় আসামী যেসব ডিফেন্স নিয়ে খালাস পেতে পারেন

খেলনাশিল্প: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

ছবি

প্রান্তিক মানুষের হৃদয়ে ফিরে আসা কালো মেঘ

গীর্জায় হামলার নেপথ্যে কী?

সংঘের শতবর্ষের রাজনৈতিক তাৎপর্য

দুর্নীতি আর চাঁদাবাজি রাজনৈতিক-সংস্কৃতির অংশ

বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস

বাংলার সংস্কৃতি : উৎস, বিবর্তন ও বর্তমান সমাজ-মনন

রম্যগদ্য: শিক্ষা সহজ, বিদ্যা কঠিন

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় জনগণের ভূমিকা উপেক্ষিত

শ্রমজীবী মানুষের শোভন কর্মসংস্থান

মূল্যস্ফীতি মোকাবেলায় বাংলাদেশের বাস্তবতা

প্রবারণার আলোয় আলোকিত হোক মানবজাতি

অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে ওয়াশিংটনের শেষ সুযোগ?

পাহাড় থেকে সমতল: আদিবাসী নারীর নিরাপত্তা

সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ সংস্কৃতি: আসক্তি নাকি নতুন যোগাযোগ?

জাতিসংঘে রোহিঙ্গা ইস্যু

মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক পরিবর্তন: আমরা কী শিক্ষা নিতে পারি

রম্যগদ্য: “কেশ ফ্যালায় ভাই, কেশ ফ্যালায়...”

লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থীর অধিকার: বিসিএস ও শিক্ষা ক্যাডারের বৈষম্য

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

দোসর, বাই ডিফল্ট!

আনোয়ারুল হক

শুক্রবার, ১৭ অক্টোবর ২০২৫

সাম্প্রতিক সময়ে কিছু কিছু অনুষ্ঠান, সভা হঠাৎ করে বন্ধ বা বাতিল হয়ে যাচ্ছে। কোনোটা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা সভাস্থলের কতৃপক্ষ বন্ধ করে দিচ্ছে এই যুক্তিতে যে, অনুষ্ঠানটি করার মাধ্যমে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টার অভিযোগ এসেছে বা অনুষ্ঠান ঘিরে হাঙ্গামার আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাই অনুষ্ঠান করা যাবে না। আবার কখনো বলা হচ্ছে আয়োজকদের মধ্যে ‘আওয়ামী দোসর’ আছে।

প্রতিদিন এত দোসরের উদ্ভব কোথা থেকে হচ্ছে? দোসরমুক্ত দেশ গড়ার জন্য সেই ফেব্রুয়ারি মাস থেকে অপারেশন ‘ডেভিল হান্ট’ শুরু হয়েছে এবং হাজারে হাজারে ‘আওয়ামী ডেভিল ও দোসর’কে গ্রেপ্তার করে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। তারপরেও কেনো সরকার, তৌহিদী জনতা, ‘ফ্যাসিবাদ’ বিরোধী অসংখ্য ‘মব মঞ্চ’ মিলিতভাবেও দেশকে দোসর ও ডেভিলমুক্ত করতে পারছে না?

এ ধরনের অভিযোগে চারুকলার বকুলতলায় আয়োজিত শরৎ উৎসব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বন্ধ করে দেয়, এবং পরবর্তীতে স্থান পরিবর্তন করে গেন্ডারিয়ায় কিশলয় কচি-কাঁচার মেলার মাঠে আয়োজন করার চেষ্টা করা হলে পুলিশ বন্ধ করে দেয়। দিন কয়েক আগে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের মিলনায়তনে আয়োজিত ‘রবীন্দ্র স্মরণ দ্রোহে, জাগরণে রবীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠান আয়োজকদের মধ্যে ‘দোসর’ আছে এ অভিযোগ তুলে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের সামনে ১০/১২ জনের ‘ফ্যাসিবাদ বিরোধী’ মব সংগঠিত হলে কতৃপক্ষ অনুষ্ঠানটি করার অনুমতি বাতিল করতে বাধ্য হয়।আরো কয়েকদিন পূর্বে ‘দোসর’রা আড্ডা দেয় অভিযোগ তুলে উত্তরায় একটি উন্মুক্ত লাইব্রেরি ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়।

উপরে উল্লিখিত অনুষ্ঠানের আয়োজক ‘দোসররা’ সৌভাগ্যবান যে তাদের কাউকেই খুনের মামলা বা সন্ত্রাস বিরোধী আইনে গ্রেফতার করা হয় নি। কিন্তু কিছুদিন আগে মুক্তিযুদ্ধ আর সংবিধান বিষয়ক এক আলোচনা সভায় অংশ নেওয়ার পর দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা বা মব তৈরি করে হেনস্তা করা হয় মুক্তিযোদ্ধা লতিফ সিদ্দিকীকে। অভিযোগ তোলা হয় যে তিনি আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রী ছিলেন এবং ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’। অথচ ২০১৫ সালেই তাকে দল থেকে বহিষ্কার করে আওয়ামী লীগ। জুলাই আন্দোলনের শুরুর দিক থেকেই দেন সরাসরি সমর্থন। মব সৃষ্টি করা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে হেনস্তার শিকার ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেই সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দেওয়া হয় মামলা, এবং দোসর হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা লতিফ সিদ্দিকী, সাবেক সচিব আবু আলম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক হাফিজুর রহমান কার্জনসহ আরো অনেককেই নেওয়া হয় কারাগারে।

সামাজিক মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলাপ তুললেই কাউকে ‘আওয়ামী লীগের দোসর’ ট্যাগ দিয়ে হেনস্তা ও ব্যক্তিগত আক্রমণের ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে জামায়াত-শিবিরের ভূমিকা ও এনসিপি নেতৃত্বের কারো কারো মন্তব্য নিয়ে এক সময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা, মুক্তিযোদ্ধা ও বিএনপি নেতা ফজলুর রহমানের বাসার সামনে জামায়াত ও এনসিপির কর্মীরা মব তৈরি করে। পুলিশ দীর্ঘ সময় যাবত এই মব সৃষ্টিকারীদের তার বাসার সামনে অরাজকতা এবং আপত্তিকর শ্লোগান দেয়ার সুযোগ করে দেয়। পরবর্তীতে দেখা যায় এই মব সৃষ্টিকারীদের অধিকাংশই দূস্কৃতিকারীও বটে। কেউ কেউ চাঁদাবাজি করতে যেয়ে গ্রেপ্তারও হয়েছে। মাস দুই আগে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও মহানগর বিএনপির সাবেক সহসভাপতি আতাউর রহমান মুকুলকে ‘আওয়ামী লীগের দোসর’ আখ্যা দিয়ে মারধর ও জামাকাপড় ছিঁড়ে লাঞ্ছিত করার ঘটনা ঘটেছিল।

প্রশ্ন হলো, প্রতিদিন এত দোসরের উদ্ভব কোথা থেকে হচ্ছে? দোসরমুক্ত দেশ গড়ার জন?্য সেই ফেব্রুয়ারি মাস থেকে অপারেশন ‘ডেভিল হান্ট’ শুরু হয়েছে এবং হাজারে হাজারে ‘আওয়ামী ডেভিল ও দোসর’কে গ্রেপ্তার করে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। তারপরেও কেনো সরকার, তৌহিদী জনতা, ‘ফ্যাসিবাদ’ বিরোধী অসংখ্যা ‘মব মঞ্চ’ মিলিতভাবেও দেশকে দোসর ও ডেভিলমুক্ত করতে পারছে না? প্রধান কারণ রাজনীতির সাথে থাকুক না থাকুক, আওয়ামী সমর্থক হোক বা আওয়ামী বিরোধী হোক দেশের বুকে প্রগতিবাদী, উদার, মুক্তমনা, অসাম্প্রদায়িক এবং বাংলাদেশের জন্মযুদ্ধের প্রতি অনুগত ও শ্রদ্ধাশীল মানুষ তো কোটি কোটি। বর্তমান বয়ান অনুযায়ী-ই তো তারা সব দোসর। তবে ‘বাই ডিফল্ট দোসর’!

সারা বাংলাদেশ জানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে এক বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন।তিনি রাজনৈতিক দল না করলেও সকল সময় আওয়ামী বলয়ের বাইরে ছিলেন ও আছেন। তাকে পর্যন্ত বলতে হচ্ছে, ‘আমাদের অনেক সদস্যকেই আলাদাভাবে টার্গেট করে ধর্মবিদ্বেষী, শাহবাগী,আওয়ামী দোসর এসব বলে ট্যাগ দেয়া হচ্ছে। জবাবদিহিতা চাইলে কেউ আওয়ামী দোসর ট্যাগ দিলে দেবে’। অনেকটা একই কথা বলেছেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেছেন, ‘যারা মুক্তিযুদ্ধকে আক্রমণ করতে চায় তাদের জন্য এটা খুব সহজ যে আওয়ামী লীগ বিরোধিতার নামে তারা মুক্তিযুদ্ধকেই খারিজ করে দিতে চায় এবং সেই চেষ্টাই তারা করছে এখন পর্যন্ত’। সে চেষ্টার এক প্রকার কৌশল এই ‘দোসর ট্যগ’। শেখ হাসিনার পদত্যাগ দাবি করে সেদিনের সেই ঐতিহাসিক দ্রোহযাত্রার প্রধান মুখ আনু মুহাম্মদকেও কি দোসর বলবেন?

গত বছর ৫ আগস্টের পর ঢাকাসহ সারা দেশ থেকেই শেখ মুজিবের ভাস্কর্য ও স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলা হয়েছে। তারপরেও এই ২০২৫-এ ১৫ আগস্টের ৫০ বছর পূর্তিতে মুজিবের একজন সমালোচক প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ইতিহাসের নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে পত্রিকায় কলাম লিখলেন। সেখানে তিনি লিখেছেন “সত্তরের নির্বাচন ও মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে একজীবনে শেখ মুজিব জনপ্রিয়তার যে শীর্ষে পৌঁছেছিলেন, অন্য কোনো বাঙালি নেতার পক্ষে সেখানে পৌঁছা সম্ভব হয়নি। যতই মুছে ফেলার চেষ্টা হোক; ইতিহাসে তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’ হিসেবেই টিকে থাকবেন। মহাকাব্যের এই নায়কের মৃত্যু নেই। ভিন্ন নায়কেরা হয়তো আসবেন, ভিন্ন রূপে। কিন্তু তাকে সরিয়ে দিয়ে নয়, তার কাজটা যেখানে এসে থেমে গেছে, সেখান থেকে ওই ধারাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে।” এখন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকেও কি দোসর বলবেন? মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের নেতার পক্ষে লিখেছেন।বাই ডিফল্ট দোসর তো বটেই!

সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় সম্মাননায় ভূষিত হলেন কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন। এটা খুবই ভালো সংবাদ হলেও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কি কোনো ভুল করে ফেললো? সাবিনা ইয়াসমিন মুজিব শতবর্ষের অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার উপস্থিতিতে বেশ কয়েকটি গান পরিবেশন করেছিলেন। এছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি গাইতেন, ‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত, বঙ্গবন্ধু মরে নাই ...’ গানটি। শুধু তাই নয়, তিনি তো বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ‘নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্র লীগের সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭০-এর ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে তিনি রোকেয়া হল ছাত্রী সংসদে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন (অবশ্য ঐ পদে বিজয়ী হয়েছিলেন ছাত্র ইউনিয়ন প্রার্থী নৃত্যশিল্পী লায়লা হাসান)। দেশের এই গুণী শিল্পীও কি বাই ডিফল্ট দোসর নন? কিন্ত তার আকাশছোঁয়া কীর্তি আর সাফল্য এমন জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে হয়তো মনে অনেক কষ্ট নিয়েও এই ‘দোসর’কে রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত করতে হচ্ছে।

আবার এক ধরনের দোসরদের মধ্যে প্রকারভেদ আছে। যেমন ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ চলচ্চিত্রে শেখ হাসিনার চরিত্রে অভিনয় করে নুসরাত ফারিয়া দোসর হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গ্রেপ্তার হয়ে জেলখানা ঘুরে এসেছেন। শেখ মুজিব চরিত্রে অভিনয় করে দোসর উপাধি পেয়েছেন আরিফিন শুভ। অন্যদিকে ফজিলাতুন্নেছা মুজিব চরিত্রে অভিনয় করেও অভিনেত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশা বীরদর্পে উপদেষ্টা স্বামীর সঙ্গে ‘জুলাই যোদ্ধাদের’ কাতারে আছেন। ফজলুর রহমান বাবু খন্দকার মোশতাকের চরিত্রে অভিনয় করায় তাকে ‘সূর্য সন্তান’ উপাধি দেওয়া হয়েছে কিনা জানা যায়নি! ‘বৈষম্যমুক্ত অন্তর্বর্তী সরকার’ এই চলচ্চিত্রে অভিনয়ের অপরাধে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমুক্ত সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়নি।

আসলে এই ‘দোসর দোসর নাটকের’ উদ্দেশ্য একটাই- যা অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের ভাষায় “মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ও তাদের উত্তরসূরিদের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয় নাই। সেই কারণে, মুক্তিযুদ্ধকে আক্রমণ করা তাদের প্রতিহিংসার মধ্য থেকে আসে এবং একইসঙ্গে তাদের মতাদর্শিক অবস্থানকে সামনে আরও অগ্রসর করার জন্য তারা রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে এটাকে ব্যবহার করে”। আসলে এই দোসর নাটক একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ ও অন্যায়কে না মুছতে পারলেও অন্তত ঢেকে রাখার একটা প্রয়াস।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ‘দোসর’ সংখ্যার আধিক্য। কোনোভাবেই নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রকৃত আওয়ামী দোসররা তো মাঠে নেই। ওরা আগেও দলীয় কাজ অপেক্ষা বরং নেত্রীর আশেপাশে ঘুরঘুর করতে পছন্দ করতেন। আর এখন ঘুর ঘুর করতে না পারলেও নেত্রীর অবস্থানের আশেপাশেই আছেন দলে দলে, হাজারে হাজারে। কিন্ত বাই ডিফল্ট দোসরেরা দেশেই আছেন। তারা বাই ডিফল্ট মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের দোসর হিসাবেই থাকবেন। ‘কলিজা ছিঁড়ে ফেললেও’ থাকবেন।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

[লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা]

back to top