alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

বিনা ভোট, নিশি ভোট, ডামি ভোটের পরে এবার নাকি গণভোট!

আনোয়ারুল হক

: সোমবার, ২০ অক্টোবর ২০২৫

প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস প্রায়শই বলেন তার সরকারের তত্ত্বাবধানে এবারে এমন একটি চমৎকার ভোট হবে যা এই জাতি ইতিপূর্বে দেখে নাই। ২০২৬ সনের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই তা অনুষ্ঠিত হবে। এবং নির্বাচন শেষে তিনিসহ উপদেষ্টারা যার যার কাজে ফিরে যাবেন। অবশ্য এমন কথাও তিনি বলেছেন অনেকেই তাকে ৫ বছর, ১০ বছর এমনকি ৫০ বছর পর্যন্ত ক্ষমতায় দেখতে চায়। সেটা কীভাবে সম্ভব তা তিনি ব্যখ্যা করেননি। অবশ্য একটা সময় কোনো কোনো মহল ‘সংস্কার সংস্কার মাতম’ তুলে নির্বাচনের বিরোধিতা করে আসছিলেন। এখন আবার একই মহল সুর ঘুরিয়ে বলছেন ‘সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদ কার্যকর করে নভেম্বর মাসে গণভোটের আয়োজন করে তারপর জাতীয় নির্বাচন। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, বিশেষ আদেশের ভিত্তিতে জুলাই সনদকে গণভোটে দেওয়ার সুপারিশ করার কথা নাকি ঐকমত্য কমিশনও ভাবছে। জাতীয় নির্বাচনকে ঝুলিয়ে দেয়ার ‘সংস্কারবাদী নতুন বন্দোবস্ত’ কিনা কে জানে!

তবে তার চেয়ে বড় প্রশ্ন জনমনে উত্থাপিত হয়েছে গত কয়েকদিনে এনসিপি, জামাত ও বিএনপি নেতৃবৃন্দকতৃক অন্তর্বর্তী সরকার সম্পর্কে কতক কঠোর মন্তব্যে। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা আখের গুছিয়ে নিয়েছেন এবং সেফ এক্সিট খুঁজছেন।’ এনসিপি নেত্রী সামান্থা শারমিন বলছেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের প্রত্যেক উপদেষ্টা নিজের আখের গোছানোর কাজ করে রেখেছেন।’ আরো এক কাঠি উপরে উঠে এনসিপির দক্ষিণ অঞ্চলের সিপাহসালার অন্তর্বর্তী সরকারকে মোনাফেক সরকার হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

জামায়াতে ইসলামের নায়েবে আমীর সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের আরো গুরুতর অভিযোগ করে বলেছেন, সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, এমনকি তাদের ‘কণ্ঠরেকর্ড’ পর্যন্ত আছে। তিনি ইঙ্গিত করেছেন, প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের নিকটতমদের কেউ কেউ নীলনকশার নির্বাচন আয়োজনের চেষ্টা করছেন। তারা মিটিংয়ে কী আলোচনা করেন তার খবরও নাকি তাদের কাছে আছে।

বিএনপি নেতৃবৃন্দ অবশ্য কিছুটা নরম কণ্ঠে বলছেন, কিছু উপদেষ্টার আচরণ সরকারের নিরপেক্ষতাকে ক্ষুণœ করছে। বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী অভিযোগ করেছেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশাসনে খুঁজে খুঁজে শিবির ক্যাডার ও জামায়াতে ইসলামী মতাদর্শের লোকজনকে’ বসানো হচ্ছে। আবার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম আগেই বলেছেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী কাড়াকাড়ি করে প্রশাসনিক জায়গাগুলোতে তাদের লোক নিয়োগ করিয়েছে।’

অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে ভূমিকা রাখা দলগুলোÑজামায়াত, এনসিপি ও বিএনপি বিশেষত প্রধান উপদেষ্টার নিয়োগকর্তারা এবং যাদের সাথে নিয়ে তিনি বিশ্ব মঞ্চ মাতিয়ে এলেন তারাই যখন তার সরকারের বিরুদ্ধে গুরুতর সব অভিযোগ তুলেছেন তাতে করে সরকারের নৈতিক কতৃত্ব নড়বড়ে হয়ে যাওয়ার কথা। ইউনূস বলছেন, সেরা নির্বাচন উপহার দেবেন আর জামায়াত বলছে প্রধান উপদেষ্টার নিকটতম লোকজন নীল নকশার নির্বাচন আয়োজনের চেষ্টা করছেন। আর তার নিয়োগকর্তারা বলছেন, সরকারের প্রত্যেক উপদেষ্টা আখের গুছিয়ে এখন সেফ এক্সিট খুঁজছেন।

এটা সবারই জানা, অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে ও দায়িত্বে বিএনপি, জামায়াতসমর্থিত ব্যক্তিরা রয়েছেন। এনসিপি ঘনিষ্ঠ দুজন ছাত্র উপদেষ্টা এখনো সরকারে আছেন এবং সরকার ও প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে নানা কৌশলে এনসিপিও জায়গা করে নিয়েছে। কার্যত সরকার তিনদলীয় অন্তর্বর্তী সরকারে রূপ নিয়েছে। নির্বাচন হলে ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে নিজেদের বাদ পড়ার ভয়ে উদ্বিগ্ন নেতারা নানা উক্তি হয়তোবা করছেন। কিন্তু উপদেষ্টাদের কলরেকর্ড জামায়াতের কাছে কিভাবে পৌঁছেছে? উপদেষ্টাদের সভায় কি আলোচনা হয় সেটাও নাকি তারা সব জানেন। এসব কথার যদি সত্যতা থাকে তবে এ ধরনের সরকারের কাছে কি আইনের শাসন ও নিরপেক্ষতা আশা করা যায়? এ ধরনের সরকারের পক্ষে কি দেশের সেরা নির্বাচন তো দূরের কথা একটি শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ ও স্বাভাবিক নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব?

সম্ভব, যদি সেটা গনভোট হয়! তাই তো জামায়াত আর এনসিপি-র গণভোট নিয়ে এতো তোড়জোড়। জেনারেল জিয়ার শাসনকালকে বৈধতা দেওয়ার লক্ষ্যে সামরিক শাসনের মধ্যে ৩০মে ১৯৭৭ সালে গণভোট বা হ্যাঁ-না ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই অধম সেই গণভোটে ভোট দিতে গিয়েছিলো। ভোটকেন্দ্র ছিলো খুলনা শহরের টুটপাড়া প্রাইমারি স্কুল। প্রথমত নির্বাচনী কর্মকর্তারা খুবই বিরক্ত হলেন ভোটের শেষ দিকে আমাকে দেখে। কেননা তখন তারা ব্যস্ত ছিলেন উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মোতাবেক ভোটার উপস্থিতি এবং হ্যাঁ ভোট, না ভোট, বাতিল ভোট সংখ্যা ইত্যাদি পরিকল্পনামতো সাজাতে। আমি ঘণ্টাখানেক ভোটকেন্দ্রের আশেপাশে ছিলাম, আমার মতো ‘নাগরিক অধিকার সচেতন’ একজন ভোটারকেও পেলাম না। পুরো এলাকাজুড়ে শান্তিপূর্ণ নীরবতা। যাহোক সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী, সেই গণভোটে ৮৮ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছিলেন। এর মধ্যে ‘হ্যাঁ’ ভোট পড়েছিল ৯৮ দশমিক ৯ শতাংশ। অন্যদিকে ‘না’ ভোট পড়েছিল ১ দশমিক ১ শতাংশ।

দ্বিতীয় দফা গণভোট হয়েছিলো হুসেন মুহাম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনকে বৈধতা দেওয়ার জন্য ২১শে মার্চ ১৯৮৫ সালে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী ফলাফল ছিল ৯৪.৫% হ্যাঁ এবং ৫.৫% না। ভোট পড়েছিল ৭২.২%। ভোটার উপস্থিতি এবং হ্যাঁ ভোট প্রাপ্তির হারে ১৯৭৭-এর প্রথম গণভোটই প্রথম স্থানে ছিলো। তৃতীয় গণভোটটি হয়েছিলো সংসদীয় ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের লক্ষ্যে ১৯৯১ সনের ১৫ সেপ্টেম্বরে যা দ্বাদশ সংশোধনী বিল হিসেবে বহুল পরিচিত। বিএনপি ও আওয়ামী লীগসহ সকল দল হ্যাঁ ভোট দেয়ার আহবান জানালেও ভোটার উপস্থিতির হার ছিলো মাত্র ৩৫.২%। হ্যাঁ ভোট পড়ে ৮৩.৬% এবং না ভোট পড়ে ১৫.২%। সংবিধানসম্মত পন্থায় গণভোট আইন ১৯৯১ অনুযায়ী একমাত্র এই গণভোটটি অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। তারপরেও ‘ভোটার উপস্থিতি’ এবং ‘হ্যাঁ ভোট প্রাপ্তির ’ ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ‘সেরা ও চমৎকার’ নির্বাচন ছিল সামরিক শাসনের অধীনে অনুষ্ঠিত গণভোট দু’টি।

তাই সামরিক আদেশের ন্যায় ‘সাংবিধানিক আদেশ’ বা বিশেষ আদেশ বলে সেরা নির্বাচন (গণভোট) করতে জামায়াত, এনসিপি আর সরকারের ‘ঐকমত্য কমিশনের’ এত আগ্রহ। বিনা ভোট, নিশি ভোট ও ড্যামি ভোট ম্যানেজ করা বেশ জটিল প্রক্রিয়া এবং সংঘাত, রক্তপাতের সম্ভাবনা থাকে। তাই গণভোটের মাধ্যমে সেরা(!) নির্বাচন অনুষ্ঠান করা অপেক্ষাকৃত সহজ। কিন্তু এ ধরনের গণভোট সংবিধান সম্মত হবে না এবং ভবিষ্যতে জটিলতার সৃষ্টি করবে। সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজনে আগে তা সংশোধিত হতে হবে আইন সভায়। তারপর রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পূর্বে তা গণভোটে গৃহীত হতে হবে। এর ব্যত্যয় করে কিছু করলে তা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে এবং রাজনীতিতে বিভাজন আরো বাড়বে।

সে বিভাজন ইতোমধ্যে করেই ফেললো ঐকমত্য কমিশন। অথচ ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি প্রধান উপদেষ্টা কিন্তু শুরুতে বলেছিলেন যেটুকুতে সবাই একমত হবে সেটুকুই নিয়েই জুলাই সনদ ও সংস্কার হবে। কিন্তু সে অবস্থানে তিনি থাকলেন না। অসংখ্য ‘নোট অফ ডিসেন্ট’ সম্বলিত ‘জুলাই সনদ’- এর ভবিষ্যৎ কি তা দেখার জন্য আরো অপেক্ষা করতে হবে।

এটা খুবই স্বাভাবিক যে ‘জুলাই সনদ’ হবে ‘২৪- এর জুলাই আন্দোলন সংগ্রামকে ঘিরে। ঐকমত্য কমিশন তা শুরু করলো বৃটিশ আমলের ‘জুলাই মাস’ থেকে। তা করতে যেয়ে এবং বাংলাদেশের জন্মযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের খুশি করতে স্বাভাবিকভাবেই তাদেরকে ইতিহাস বিকৃতির পথে হাঁটতে হয়েছে। তাই ইতোমধ্যে দেশের বামপন্থীরা সুস্পষ্টভাবেই জানিয়ে দিয়েছেন “সনদে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাস এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাস সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়নি। এ বিষয়ে সংশোধনী দিলেও ঐকমত্য কমিশন সেগুলো সন্নিবেশিত করেনি। নোট অব ডিসেন্টগুলো কীভাবে সংবিধানে যুক্ত হবে- তাও বোধগম্য নয়। জুলাই সনদ নিয়ে কেউ আদালতের শরণাপন্ন হতে পারবে না- এটা নাগরিকের মৌলিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকারের সম্পূর্ণ পরিপন্থি। স্বাধীনতার ঘোষণা ডিক্লারেশন অব ইনডিপেন্ডেন্স এবং প্রোক্লেমেশন অব ইনডিপেনডেন্স বাদ দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি। এ সব বিষয় নিষ্পত্তি না হলে বামপন্থীরা সনদে স্বাক্ষর করবে না। তবে যে সব বিষয়ে তারা কমিশনের সাথে ঐকমত্য পোষণ করেছে তা বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ আছে ও থাকবে।” মজার ব্যপার জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান হয়ে যাওয়ার পরে ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে আবার বলা হচ্ছে সনদ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা বাদ দেয়া হবে না। তবে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা থাকবে না। স্বৈরাচারী হাসিনাকে তো ক্ষমতা থেকে টেনে নামানো হলো, দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতাকে নিয়ে এতো টানাটানি কেনো? এই টানাটানির সংস্কৃতি ভবিষ্যতে বুমেরাং হতে পারে।

নানা পক্ষকে খুশী করতে যেয়ে সনদে শুধু বিকৃতি নয় অসত্য বয়ানও আছে। কলেবর না বাড়িয়ে একটি উদাহরণ দেই। যেমন, জুলাই সনদের পটভূমি বর্ণনা করতে যেয়ে ১৯৭৯ সালের পরে লাফ দিয়ে তৃতীয় প্যারায় এসে বলা হয়েছে, “২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে লগি-বৈঠার তা-বে দেশে কয়েকটি নৃশংস হত্যাকা- সংঘটিত হয় এবং সেই ধারাবাহিকতায় দেশে ২০০৭ সনে জরুরি অবস্থা জারি ও একটি অস্বাভাবিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়।” প্রথম খসড়ায় এটা ছিলো না। পরে যুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এই বয়ান কি সত্য? ঐ অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টির প্রধান দায় তো তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোটের। তৎকালীন ক্ষমতাসীন জোট তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নিজ পক্ষে রাখার জন্য বিচারপতিদের চাকরির বয়স সীমা বাড়িয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলে এবং রাজনীতির মাঠে এক সংঘাতমূলক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ১/১১ ডেকে আনতে প্রধান ভূমিকা রাখে। অধ্যাপক আলী রীয়াজের কি স্মৃতি বিভ্রাট ঘটেছে?

লগি-বৈঠার মিছিল পল্টন মোড়ে আসলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী নিয়ন্ত্রণ না করে বায়তুল মোকাররম এলাকা থেকে জামায়াত নিয়ন্ত্রণ করতে এসে কেনো রক্তাক্ত সংঘাতে জড়িয়ে পড়লো? লগি-বৈঠাকে যদি ইতিহাসের পাতায় রাখতে হয় তবে ২০০৪ সনের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা বাদ গেলো কেনো? তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে দিবালোকে প্রকাশ্য জনসভায় গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ২৪ জনকে হত্যা এবং ৩০০ জনের অধিককে আহত করার ঘটনা তো নজিরবিহীন। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা না নিয়ে জজ মিয়া নাটকের মাধ্যমে দুই প্রধান দলের মধ্যে তিক্ততার যে দুর্ভেদ্য দেয়াল তৈরি হলো যা আর অতিক্রম করা গেলো না। এ দায় কার? সনদে ইতিহাসের উল্লেখ থাকলে তা বস্তুনিষ্ঠ হতে হবে।

একটি গণতান্ত্রিক দেশে ছোট-বড় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থাকবে। তাদের আদর্শ, লক্ষ্য ও বাস্তবায়নের পথ ভিন্ন ভিন্ন থাকে। একটা বিশেষ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সব দলকে সব বিষয়ে একমত করার প্রচেষ্টা ভবিষ্যতে কোনো ভালো ফল বয়ে আনবে বলে মনে হয় না। রাজনীতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন দল লক্ষ্য ও কর্মসূচিতে কাছাকাছি আসে এবং সেটা টেকসই হয়। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া ঐকমত্য টেকসই হবে বলে মনে হয় না। যেমন সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের পরদিনই এনসিপির আহ্বায়ক তাদের মিত্র দল জামায়াত ইসলাম সম্পর্কে বলেছেন, “ঐকমত্য কমিশনে তাদের (জামাতের) হঠাৎ সংস্কারের সমর্থন ছিল বিশ্বাসের কাজ নয়, বরং একটি কৌশলগত অনুপ্রবেশ, সংস্কারবাদের ছদ্মবেশে রাজনৈতিক নাশকতা। তাদের পিআর আন্দোলন একটি সুচিন্তিত রাজনৈতিক প্রতারণা”।ভবিষ্যতে আমাদের এমনতর আরো অনেক কিছুই হয়তো শুনতে হবে।

তা ছাড়া ইতিহাসের সবকিছু আইনের অংশ হয় না, সংবিধানের অংশ হয় না। অথচ ঐকমত্য কমিশন শেখ হাসিনার সাথে পাল্লা দিয়ে তাদের মতো করে ইতিহাসের বয়ানকে - যা কোথাও বিকৃত, কোথাও অসত্য আবার কোথাও অসম্পূর্ণ তা আইন ও সংবিধানের সাথে যুক্ত করতে চাইছে। এজন্য তাদের জন্য প্রয়োজন ১৯৭৭ ও ১৯৮৫ সনের সামরিক শাসনের গনভোটের মতো ‘চমৎকার’ একটি গণভোট। ইউনূস কি সে পথে হাঁটবেন, না তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আগে আইনসভার নির্বাচন সম্পন্ন করে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে অগ্রসর হবেন?

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

[লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা]

এইচএসসি ফল: সংখ্যার খেল না কি শিক্ষার বাস্তব চিত্র?

কমরেড ইলা মিত্রের শততম জন্মজয়ন্তী

কত মৃত্যু হলে জাগবে বিবেক?

বৈষম্যের বিবিধ মুখ

মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় জরুরি আইনি সহায়তা

গাজা : এখন শান্তি রক্ষা করবে কে?

দোসর, বাই ডিফল্ট!

জমি কেনা দাগে দাগে কিন্তু ভোগদখল একদাগে

রাষ্ট্র কি শুধু শিক্ষকদের বেলায় এসে দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে?

শতরঞ্জ কি খিলাড়ী

শিক্ষক থাকে রাজপথে, আর পুলিশ ছাড়ে থানা

উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা : স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবিষ্যৎ কী?

ছবি

শ্লীলতা, অশ্লীলতার রাজনৈতিক সংস্কৃতি

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: অবক্ষয়ের চোরাবালিতে আলোর দিশারী

অটোমেশন ও দেশের যুব কর্মসংস্থানের ভবিষ্যৎ

দুর্যোগে ভয় নয়, প্রস্তুতিই শক্তি

বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন

ছবি

‘আল্লাহ তুই দেহিস’: এ কোন ঘৃণার আগুন, ছড়িয়ে গেল সবখানে!

চেকের মামলায় আসামী যেসব ডিফেন্স নিয়ে খালাস পেতে পারেন

খেলনাশিল্প: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

ছবি

প্রান্তিক মানুষের হৃদয়ে ফিরে আসা কালো মেঘ

গীর্জায় হামলার নেপথ্যে কী?

সংঘের শতবর্ষের রাজনৈতিক তাৎপর্য

দুর্নীতি আর চাঁদাবাজি রাজনৈতিক-সংস্কৃতির অংশ

বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস

বাংলার সংস্কৃতি : উৎস, বিবর্তন ও বর্তমান সমাজ-মনন

রম্যগদ্য: শিক্ষা সহজ, বিদ্যা কঠিন

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় জনগণের ভূমিকা উপেক্ষিত

শ্রমজীবী মানুষের শোভন কর্মসংস্থান

মূল্যস্ফীতি মোকাবেলায় বাংলাদেশের বাস্তবতা

প্রবারণার আলোয় আলোকিত হোক মানবজাতি

অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে ওয়াশিংটনের শেষ সুযোগ?

পাহাড় থেকে সমতল: আদিবাসী নারীর নিরাপত্তা

সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ সংস্কৃতি: আসক্তি নাকি নতুন যোগাযোগ?

জাতিসংঘে রোহিঙ্গা ইস্যু

মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক পরিবর্তন: আমরা কী শিক্ষা নিতে পারি

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

বিনা ভোট, নিশি ভোট, ডামি ভোটের পরে এবার নাকি গণভোট!

আনোয়ারুল হক

সোমবার, ২০ অক্টোবর ২০২৫

প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস প্রায়শই বলেন তার সরকারের তত্ত্বাবধানে এবারে এমন একটি চমৎকার ভোট হবে যা এই জাতি ইতিপূর্বে দেখে নাই। ২০২৬ সনের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই তা অনুষ্ঠিত হবে। এবং নির্বাচন শেষে তিনিসহ উপদেষ্টারা যার যার কাজে ফিরে যাবেন। অবশ্য এমন কথাও তিনি বলেছেন অনেকেই তাকে ৫ বছর, ১০ বছর এমনকি ৫০ বছর পর্যন্ত ক্ষমতায় দেখতে চায়। সেটা কীভাবে সম্ভব তা তিনি ব্যখ্যা করেননি। অবশ্য একটা সময় কোনো কোনো মহল ‘সংস্কার সংস্কার মাতম’ তুলে নির্বাচনের বিরোধিতা করে আসছিলেন। এখন আবার একই মহল সুর ঘুরিয়ে বলছেন ‘সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদ কার্যকর করে নভেম্বর মাসে গণভোটের আয়োজন করে তারপর জাতীয় নির্বাচন। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, বিশেষ আদেশের ভিত্তিতে জুলাই সনদকে গণভোটে দেওয়ার সুপারিশ করার কথা নাকি ঐকমত্য কমিশনও ভাবছে। জাতীয় নির্বাচনকে ঝুলিয়ে দেয়ার ‘সংস্কারবাদী নতুন বন্দোবস্ত’ কিনা কে জানে!

তবে তার চেয়ে বড় প্রশ্ন জনমনে উত্থাপিত হয়েছে গত কয়েকদিনে এনসিপি, জামাত ও বিএনপি নেতৃবৃন্দকতৃক অন্তর্বর্তী সরকার সম্পর্কে কতক কঠোর মন্তব্যে। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা আখের গুছিয়ে নিয়েছেন এবং সেফ এক্সিট খুঁজছেন।’ এনসিপি নেত্রী সামান্থা শারমিন বলছেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের প্রত্যেক উপদেষ্টা নিজের আখের গোছানোর কাজ করে রেখেছেন।’ আরো এক কাঠি উপরে উঠে এনসিপির দক্ষিণ অঞ্চলের সিপাহসালার অন্তর্বর্তী সরকারকে মোনাফেক সরকার হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

জামায়াতে ইসলামের নায়েবে আমীর সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের আরো গুরুতর অভিযোগ করে বলেছেন, সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, এমনকি তাদের ‘কণ্ঠরেকর্ড’ পর্যন্ত আছে। তিনি ইঙ্গিত করেছেন, প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের নিকটতমদের কেউ কেউ নীলনকশার নির্বাচন আয়োজনের চেষ্টা করছেন। তারা মিটিংয়ে কী আলোচনা করেন তার খবরও নাকি তাদের কাছে আছে।

বিএনপি নেতৃবৃন্দ অবশ্য কিছুটা নরম কণ্ঠে বলছেন, কিছু উপদেষ্টার আচরণ সরকারের নিরপেক্ষতাকে ক্ষুণœ করছে। বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী অভিযোগ করেছেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশাসনে খুঁজে খুঁজে শিবির ক্যাডার ও জামায়াতে ইসলামী মতাদর্শের লোকজনকে’ বসানো হচ্ছে। আবার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম আগেই বলেছেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী কাড়াকাড়ি করে প্রশাসনিক জায়গাগুলোতে তাদের লোক নিয়োগ করিয়েছে।’

অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে ভূমিকা রাখা দলগুলোÑজামায়াত, এনসিপি ও বিএনপি বিশেষত প্রধান উপদেষ্টার নিয়োগকর্তারা এবং যাদের সাথে নিয়ে তিনি বিশ্ব মঞ্চ মাতিয়ে এলেন তারাই যখন তার সরকারের বিরুদ্ধে গুরুতর সব অভিযোগ তুলেছেন তাতে করে সরকারের নৈতিক কতৃত্ব নড়বড়ে হয়ে যাওয়ার কথা। ইউনূস বলছেন, সেরা নির্বাচন উপহার দেবেন আর জামায়াত বলছে প্রধান উপদেষ্টার নিকটতম লোকজন নীল নকশার নির্বাচন আয়োজনের চেষ্টা করছেন। আর তার নিয়োগকর্তারা বলছেন, সরকারের প্রত্যেক উপদেষ্টা আখের গুছিয়ে এখন সেফ এক্সিট খুঁজছেন।

এটা সবারই জানা, অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে ও দায়িত্বে বিএনপি, জামায়াতসমর্থিত ব্যক্তিরা রয়েছেন। এনসিপি ঘনিষ্ঠ দুজন ছাত্র উপদেষ্টা এখনো সরকারে আছেন এবং সরকার ও প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে নানা কৌশলে এনসিপিও জায়গা করে নিয়েছে। কার্যত সরকার তিনদলীয় অন্তর্বর্তী সরকারে রূপ নিয়েছে। নির্বাচন হলে ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে নিজেদের বাদ পড়ার ভয়ে উদ্বিগ্ন নেতারা নানা উক্তি হয়তোবা করছেন। কিন্তু উপদেষ্টাদের কলরেকর্ড জামায়াতের কাছে কিভাবে পৌঁছেছে? উপদেষ্টাদের সভায় কি আলোচনা হয় সেটাও নাকি তারা সব জানেন। এসব কথার যদি সত্যতা থাকে তবে এ ধরনের সরকারের কাছে কি আইনের শাসন ও নিরপেক্ষতা আশা করা যায়? এ ধরনের সরকারের পক্ষে কি দেশের সেরা নির্বাচন তো দূরের কথা একটি শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ ও স্বাভাবিক নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব?

সম্ভব, যদি সেটা গনভোট হয়! তাই তো জামায়াত আর এনসিপি-র গণভোট নিয়ে এতো তোড়জোড়। জেনারেল জিয়ার শাসনকালকে বৈধতা দেওয়ার লক্ষ্যে সামরিক শাসনের মধ্যে ৩০মে ১৯৭৭ সালে গণভোট বা হ্যাঁ-না ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই অধম সেই গণভোটে ভোট দিতে গিয়েছিলো। ভোটকেন্দ্র ছিলো খুলনা শহরের টুটপাড়া প্রাইমারি স্কুল। প্রথমত নির্বাচনী কর্মকর্তারা খুবই বিরক্ত হলেন ভোটের শেষ দিকে আমাকে দেখে। কেননা তখন তারা ব্যস্ত ছিলেন উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মোতাবেক ভোটার উপস্থিতি এবং হ্যাঁ ভোট, না ভোট, বাতিল ভোট সংখ্যা ইত্যাদি পরিকল্পনামতো সাজাতে। আমি ঘণ্টাখানেক ভোটকেন্দ্রের আশেপাশে ছিলাম, আমার মতো ‘নাগরিক অধিকার সচেতন’ একজন ভোটারকেও পেলাম না। পুরো এলাকাজুড়ে শান্তিপূর্ণ নীরবতা। যাহোক সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী, সেই গণভোটে ৮৮ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছিলেন। এর মধ্যে ‘হ্যাঁ’ ভোট পড়েছিল ৯৮ দশমিক ৯ শতাংশ। অন্যদিকে ‘না’ ভোট পড়েছিল ১ দশমিক ১ শতাংশ।

দ্বিতীয় দফা গণভোট হয়েছিলো হুসেন মুহাম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনকে বৈধতা দেওয়ার জন্য ২১শে মার্চ ১৯৮৫ সালে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী ফলাফল ছিল ৯৪.৫% হ্যাঁ এবং ৫.৫% না। ভোট পড়েছিল ৭২.২%। ভোটার উপস্থিতি এবং হ্যাঁ ভোট প্রাপ্তির হারে ১৯৭৭-এর প্রথম গণভোটই প্রথম স্থানে ছিলো। তৃতীয় গণভোটটি হয়েছিলো সংসদীয় ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের লক্ষ্যে ১৯৯১ সনের ১৫ সেপ্টেম্বরে যা দ্বাদশ সংশোধনী বিল হিসেবে বহুল পরিচিত। বিএনপি ও আওয়ামী লীগসহ সকল দল হ্যাঁ ভোট দেয়ার আহবান জানালেও ভোটার উপস্থিতির হার ছিলো মাত্র ৩৫.২%। হ্যাঁ ভোট পড়ে ৮৩.৬% এবং না ভোট পড়ে ১৫.২%। সংবিধানসম্মত পন্থায় গণভোট আইন ১৯৯১ অনুযায়ী একমাত্র এই গণভোটটি অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। তারপরেও ‘ভোটার উপস্থিতি’ এবং ‘হ্যাঁ ভোট প্রাপ্তির ’ ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ‘সেরা ও চমৎকার’ নির্বাচন ছিল সামরিক শাসনের অধীনে অনুষ্ঠিত গণভোট দু’টি।

তাই সামরিক আদেশের ন্যায় ‘সাংবিধানিক আদেশ’ বা বিশেষ আদেশ বলে সেরা নির্বাচন (গণভোট) করতে জামায়াত, এনসিপি আর সরকারের ‘ঐকমত্য কমিশনের’ এত আগ্রহ। বিনা ভোট, নিশি ভোট ও ড্যামি ভোট ম্যানেজ করা বেশ জটিল প্রক্রিয়া এবং সংঘাত, রক্তপাতের সম্ভাবনা থাকে। তাই গণভোটের মাধ্যমে সেরা(!) নির্বাচন অনুষ্ঠান করা অপেক্ষাকৃত সহজ। কিন্তু এ ধরনের গণভোট সংবিধান সম্মত হবে না এবং ভবিষ্যতে জটিলতার সৃষ্টি করবে। সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজনে আগে তা সংশোধিত হতে হবে আইন সভায়। তারপর রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পূর্বে তা গণভোটে গৃহীত হতে হবে। এর ব্যত্যয় করে কিছু করলে তা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে এবং রাজনীতিতে বিভাজন আরো বাড়বে।

সে বিভাজন ইতোমধ্যে করেই ফেললো ঐকমত্য কমিশন। অথচ ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি প্রধান উপদেষ্টা কিন্তু শুরুতে বলেছিলেন যেটুকুতে সবাই একমত হবে সেটুকুই নিয়েই জুলাই সনদ ও সংস্কার হবে। কিন্তু সে অবস্থানে তিনি থাকলেন না। অসংখ্য ‘নোট অফ ডিসেন্ট’ সম্বলিত ‘জুলাই সনদ’- এর ভবিষ্যৎ কি তা দেখার জন্য আরো অপেক্ষা করতে হবে।

এটা খুবই স্বাভাবিক যে ‘জুলাই সনদ’ হবে ‘২৪- এর জুলাই আন্দোলন সংগ্রামকে ঘিরে। ঐকমত্য কমিশন তা শুরু করলো বৃটিশ আমলের ‘জুলাই মাস’ থেকে। তা করতে যেয়ে এবং বাংলাদেশের জন্মযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের খুশি করতে স্বাভাবিকভাবেই তাদেরকে ইতিহাস বিকৃতির পথে হাঁটতে হয়েছে। তাই ইতোমধ্যে দেশের বামপন্থীরা সুস্পষ্টভাবেই জানিয়ে দিয়েছেন “সনদে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাস এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাস সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়নি। এ বিষয়ে সংশোধনী দিলেও ঐকমত্য কমিশন সেগুলো সন্নিবেশিত করেনি। নোট অব ডিসেন্টগুলো কীভাবে সংবিধানে যুক্ত হবে- তাও বোধগম্য নয়। জুলাই সনদ নিয়ে কেউ আদালতের শরণাপন্ন হতে পারবে না- এটা নাগরিকের মৌলিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকারের সম্পূর্ণ পরিপন্থি। স্বাধীনতার ঘোষণা ডিক্লারেশন অব ইনডিপেন্ডেন্স এবং প্রোক্লেমেশন অব ইনডিপেনডেন্স বাদ দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি। এ সব বিষয় নিষ্পত্তি না হলে বামপন্থীরা সনদে স্বাক্ষর করবে না। তবে যে সব বিষয়ে তারা কমিশনের সাথে ঐকমত্য পোষণ করেছে তা বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ আছে ও থাকবে।” মজার ব্যপার জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান হয়ে যাওয়ার পরে ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে আবার বলা হচ্ছে সনদ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা বাদ দেয়া হবে না। তবে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা থাকবে না। স্বৈরাচারী হাসিনাকে তো ক্ষমতা থেকে টেনে নামানো হলো, দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতাকে নিয়ে এতো টানাটানি কেনো? এই টানাটানির সংস্কৃতি ভবিষ্যতে বুমেরাং হতে পারে।

নানা পক্ষকে খুশী করতে যেয়ে সনদে শুধু বিকৃতি নয় অসত্য বয়ানও আছে। কলেবর না বাড়িয়ে একটি উদাহরণ দেই। যেমন, জুলাই সনদের পটভূমি বর্ণনা করতে যেয়ে ১৯৭৯ সালের পরে লাফ দিয়ে তৃতীয় প্যারায় এসে বলা হয়েছে, “২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে লগি-বৈঠার তা-বে দেশে কয়েকটি নৃশংস হত্যাকা- সংঘটিত হয় এবং সেই ধারাবাহিকতায় দেশে ২০০৭ সনে জরুরি অবস্থা জারি ও একটি অস্বাভাবিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়।” প্রথম খসড়ায় এটা ছিলো না। পরে যুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এই বয়ান কি সত্য? ঐ অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টির প্রধান দায় তো তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোটের। তৎকালীন ক্ষমতাসীন জোট তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নিজ পক্ষে রাখার জন্য বিচারপতিদের চাকরির বয়স সীমা বাড়িয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলে এবং রাজনীতির মাঠে এক সংঘাতমূলক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ১/১১ ডেকে আনতে প্রধান ভূমিকা রাখে। অধ্যাপক আলী রীয়াজের কি স্মৃতি বিভ্রাট ঘটেছে?

লগি-বৈঠার মিছিল পল্টন মোড়ে আসলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী নিয়ন্ত্রণ না করে বায়তুল মোকাররম এলাকা থেকে জামায়াত নিয়ন্ত্রণ করতে এসে কেনো রক্তাক্ত সংঘাতে জড়িয়ে পড়লো? লগি-বৈঠাকে যদি ইতিহাসের পাতায় রাখতে হয় তবে ২০০৪ সনের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা বাদ গেলো কেনো? তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে দিবালোকে প্রকাশ্য জনসভায় গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ২৪ জনকে হত্যা এবং ৩০০ জনের অধিককে আহত করার ঘটনা তো নজিরবিহীন। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা না নিয়ে জজ মিয়া নাটকের মাধ্যমে দুই প্রধান দলের মধ্যে তিক্ততার যে দুর্ভেদ্য দেয়াল তৈরি হলো যা আর অতিক্রম করা গেলো না। এ দায় কার? সনদে ইতিহাসের উল্লেখ থাকলে তা বস্তুনিষ্ঠ হতে হবে।

একটি গণতান্ত্রিক দেশে ছোট-বড় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থাকবে। তাদের আদর্শ, লক্ষ্য ও বাস্তবায়নের পথ ভিন্ন ভিন্ন থাকে। একটা বিশেষ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সব দলকে সব বিষয়ে একমত করার প্রচেষ্টা ভবিষ্যতে কোনো ভালো ফল বয়ে আনবে বলে মনে হয় না। রাজনীতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন দল লক্ষ্য ও কর্মসূচিতে কাছাকাছি আসে এবং সেটা টেকসই হয়। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া ঐকমত্য টেকসই হবে বলে মনে হয় না। যেমন সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের পরদিনই এনসিপির আহ্বায়ক তাদের মিত্র দল জামায়াত ইসলাম সম্পর্কে বলেছেন, “ঐকমত্য কমিশনে তাদের (জামাতের) হঠাৎ সংস্কারের সমর্থন ছিল বিশ্বাসের কাজ নয়, বরং একটি কৌশলগত অনুপ্রবেশ, সংস্কারবাদের ছদ্মবেশে রাজনৈতিক নাশকতা। তাদের পিআর আন্দোলন একটি সুচিন্তিত রাজনৈতিক প্রতারণা”।ভবিষ্যতে আমাদের এমনতর আরো অনেক কিছুই হয়তো শুনতে হবে।

তা ছাড়া ইতিহাসের সবকিছু আইনের অংশ হয় না, সংবিধানের অংশ হয় না। অথচ ঐকমত্য কমিশন শেখ হাসিনার সাথে পাল্লা দিয়ে তাদের মতো করে ইতিহাসের বয়ানকে - যা কোথাও বিকৃত, কোথাও অসত্য আবার কোথাও অসম্পূর্ণ তা আইন ও সংবিধানের সাথে যুক্ত করতে চাইছে। এজন্য তাদের জন্য প্রয়োজন ১৯৭৭ ও ১৯৮৫ সনের সামরিক শাসনের গনভোটের মতো ‘চমৎকার’ একটি গণভোট। ইউনূস কি সে পথে হাঁটবেন, না তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আগে আইনসভার নির্বাচন সম্পন্ন করে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে অগ্রসর হবেন?

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

[লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা]

back to top