মিহির কুমার রায়
১৬ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশ করেছে শিক্ষা বোর্ডগুলো। নয়টি সাধারণ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে এ বছর গড় পাসের হার ৫৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ, যা গত বছরের তুলনায় ১৮ দশমিক ৯৫ শতাংশ কম। গত বছর এই পরীক্ষায় পাসের হার ছিল ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এর আগে ২০০৪ সালে এইচএসসিতে পাস করেছিল ৪৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ শিক্ষার্থী, ২০০৫ সালে ছিল ৫৯ দশমিক ১৬ শতাংশ। এরপর থেকে পাসের হার আর কখনো এর নিচে নামেনি। সেই হিসাবে ২০ বছরের মধ্যে এবারই পাসের হার সবচেয়ে কম।
শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করছেন, মূলত তিনটি কারণে এবার পাশের হার ও জিপিএ-৫ কমেছেÑ
প্রথমত, রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানা কারণে পরীক্ষার্থীরা কলেজে ক্লাস কম পেয়েছে;
দ্বিতীয়ত, ইংরেজি, হিসাববিজ্ঞান ও আইসিটিতে পাসের হার তুলনামূলক কম;
তৃতীয়ত, উত্তরপত্র মূল্যায়নে কড়াকড়ি এবং গ্রাম-শহরের ফলাফলে ব্যাপক তারতম্য।
এবার এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছে পাঁচ লাখের বেশি শিক্ষার্থী। মোট ১২ লাখ ৩৫ হাজার ৬৬১ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছে ৭ লাখ ২৬ হাজার ৯৬০ জন, ফেল করেছে ৫ লাখ ৮ হাজার ৭০১ জন। ছাত্র ছিল ৬ লাখ ১১ হাজার ৪৪৬ জন, উত্তীর্ণ হয়েছে ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৮৬৪ জন। ছাত্রী ছিল ৬ লাখ ২৪ হাজার ২১৫ জন, উত্তীর্ণ হয়েছে ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৯৬ জন।
সার্বিক ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুই দশকের মধ্যে এবারই সবচেয়ে কম পাসের হার। ২০০৫ সালে গড় পাসের হার ছিল ৫৯ দশমিক ৭ শতাংশ; এরপর থেকে প্রায় প্রতিবছরই তা বেড়েছে বা সামান্য কমেছে। ২১ বছর পর শিক্ষার্থীদের ফলাফলে একপ্রকার ধস নেমেছে।
এবার ১১টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় গড় পাসের হার হয়েছে ৫৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ১৯ শতাংশ কম। একই সঙ্গে সর্বোচ্চ গ্রেড পয়েন্ট অ্যাভারেজ (জিপিএ–৫) পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও ব্যাপক হারে কমেছে। এ বছর জিপিএ–৫ পেয়েছে ৬৯ হাজার ৯৭ জন, গত বছর ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৯১১ জনÑ অর্থাৎ কমেছে ৭৬ হাজার ৮১৪ জন।
বিভাগভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়Ñ বিজ্ঞান বিভাগে পাসের হার ৭৮ দশমিক ৭২ শতাংশ, বাণিজ্যে ৫৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ, মানবিকে মাত্র ৪৮ দশমিক ২৩ শতাংশ।
মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীরা ইংরেজিতে সবচেয়ে বেশি খারাপ করেছে বলে শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
বিগত কয়েক বছরের মতো এবারও পাসের হার ও জিপিএ-৫ পাওয়ার দিক থেকে মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে। মেয়েদের পাসের হার ৬২ দশমিক ৯৭ শতাংশ এবং ছেলেদের ৫৪ দশমিক ৬০ শতাংশ।
এ বছর দেশের ২০২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থী পাস করতে পারেনিÑ গত বছর এ সংখ্যা ছিল ৬৫। আবার শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও কমেছে; এবার ৩৪৫টি, গত বছর ছিল ১ হাজার ৩৮৮টি।
শিক্ষা বোর্ডগুলোর তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে ইংরেজি ও তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়ে। বিশেষ করে ইংরেজিতে ফেল করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ২৫ শতাংশ বেড়েছে। শুধু দিনাজপুর বোর্ডেই ৩৫ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী এ বিষয়ে ফেল করেছে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, এই দুটি বিষয় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিক্ষার্থীদের শেখার ঘাটতির বড় সূচক হয়ে উঠেছে।
গ্রাম ও শহরের পার্থক্যও এবার প্রকট। শহুরে কিছু নামকরা কলেজে পাসের হার ৮০ শতাংশের ওপরে থাকলেও গ্রামীণ কলেজের অনেক জায়গায় তা ৪০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।
বোর্ডভিত্তিক ফলাফলে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড শীর্ষেÑ পাসের হার ৭৫ দশমিক ৬১ শতাংশ। সবচেয়ে কম পাস করেছে কুমিল্লা বোর্ড, ৪৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ।
নয়টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে পাসের হারে এগিয়ে ঢাকা বোর্ড (৬৪ দশমিক ৬২ শতাংশ), আর পিছিয়ে কুমিল্লা বোর্ড। অন্যান্য বোর্ডের মধ্যে রাজশাহী ৫৯ দশমিক ৪০, যশোর ৫০ দশমিক ২০, চট্টগ্রাম ৫২ দশমিক ৫৭, বরিশাল ৬২ দশমিক ৫৭, সিলেট ৫১ দশমিক ৮৬, দিনাজপুর ৫৭ দশমিক ৪৯, ময়মনসিংহ ৫১ দশমিক ৫৪ এবং কারিগরি বোর্ডে ৬২ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান বলেছেন, “ইংরেজিতে শিক্ষার্থীরা বরাবরই দুর্বল। হিসাববিজ্ঞানও কঠিন বিষয়। এসব বিষয়ে ভালো শিক্ষক নেই অনেক প্রতিষ্ঠানে। শিক্ষার্থীরা পড়ালেখার ব্যাপারে বিমুখ হয়ে পড়েছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে এ নিয়ে বসতে হবে, শিক্ষার্থীদেরও সচেতন হতে হবে।”
গুণগত শিক্ষার প্রশ্ন
ফলাফল প্রকাশের পর থেকেই শিক্ষাঙ্গন ও অভিভাবকদের মনে একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছেÑ জিপিএ-৫ কি সত্যিই গুণগত শিক্ষার প্রতিফলন, নাকি কেবল সংখ্যার খেলা?
উপরের পরিসংখ্যানগুলোই বলছে, শুধু জিপিএ-৫ গোনার মাধ্যমে শিক্ষার মান বিচার করা বাস্তবতাকে বিকৃত করে। প্রশ্নের মান, মূল্যায়নের সমতা, শিক্ষকের দক্ষতা, স্কুলভিত্তিক প্রস্তুতি ও অঞ্চলভেদে সুযোগের বৈষম্যÑ সবকিছুরই প্রভাব স্পষ্টভাবে পড়েছে এবারের ফলে।
এক শিক্ষার্থী (নটর ডেম কলেজ, ইংরেজি সংস্করণ) বলেন, “গ্রেস মার্কস সঠিকভাবে দেওয়া হলে, একই নির্দেশনা অনুসারে সব খাতা মূল্যায়ন করা হলে এবং ইংরেজি সংস্করণের খাতা দক্ষ শিক্ষকেরা মূল্যায়ন করলে ফলাফল আরও ভারসাম্যপূর্ণ হতো।”
এ মন্তব্যে প্রতিফলিত হয়েছে মূল্যায়ন পদ্ধতিতে অভিন্ন মানদ- ও দক্ষ পরীক্ষক নিয়োগের প্রয়োজনীয়তাÑ যা আজকের শিক্ষাব্যবস্থার বড় ঘাটতি।
জিপিএ-৫ নিঃসন্দেহে পরীক্ষায় সাফল্যের প্রতীক, কিন্তু ‘গুণগত শিক্ষা’ নয়। কারণ গুণগত শিক্ষার মূল মানে চিন্তা, বিশ্লেষণ, সমস্যা সমাধান, সৃজনশীলতা, গবেষণাভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি, ভাষা ও সংখ্যাজ্ঞান, দলগত কাজ ও নৈতিকতা। আমাদের বর্তমান মূল্যায়ন এখনো মুখস্থনির্ভর ও প্রশ্নকেন্দ্রিক। ফলে প্রশ্নের মান বা মূল্যায়নের নীতিতে সামান্য পরিবর্তন এলেই জিপিএ-৫-এর সংখ্যা দুলে ওঠে।
এবারের ফলাফল তাই একদিকে মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় বাস্তবতায় ফেরার ইঙ্গিত দিলেও, অন্যদিকে এটি বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর আত্মবিশ্বাসে আঘাত করেছে।
অভিভাবকদের প্রশ্নÑ এই বিপুল সংখ্যক অকৃতকার্য শিক্ষার্থী কি উচ্চশিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে? নাকি এই ফলাফল আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুনভাবে গঠন করার একটি সুযোগ এনে দিচ্ছে?
নেতিবাচক দিকে দুর্বল স্কুল ও নিম্ন আয়ের পরিবারের সন্তানরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শিক্ষক সংকট, কোচিং নির্ভরতা, ইংরেজি ও গণিতে দুর্বলতা, আর্থ-ুসামাজিক বৈষম্যÑ সব মিলিয়ে এই গোষ্ঠীতে অকৃতকার্যতার হার বেশি।
ইতিবাচক দিক হলো, জিপিএ-৫ কমে যাওয়ার অর্থ ‘গ্রেড ইনফ্লেশনে’ লাগাম টানা। এতে মেধা বাছাই তুলনামূলক নিরপেক্ষ হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন জিপিএর পাশাপাশি লিখিত পরীক্ষা, রচনা, প্রজেক্ট, পোর্টফোলিও ও সাক্ষাৎকারের ওপর জোর দিতে পারবে।
বোর্ডভিত্তিক পার্থক্য কমাতে প্রয়োজন লক্ষ্যভিত্তিক সহায়তা, দুর্বল স্কুলের জন্য ফাউন্ডেশন কোর্স, ডায়াগনস্টিক টেস্ট, শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও রিমেডিয়েশন প্রোগ্রাম। প্রশ্নপত্র বিশ্লেষণ করে কোন অংশে শিক্ষার্থীরা বেশি হোঁচট খাচ্ছে তা নির্ধারণ করা জরুরি।
২০২৫ সালের এই ফলাফল আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেÑ প্রাতিষ্ঠানিক মাননিয়ন্ত্রণ শক্তিশালী না হলে জাতির শিক্ষার মান কখনো স্থিতিশীল হবে না।
শিক্ষা কর্তৃপক্ষ ও নীতিনির্ধারকদের জন্য মূল বার্তা একটিÑ বিদ্যালয় শিক্ষা আর কতদিন অবহেলিত থাকবে?
রাজনৈতিক প্রভাবহীন বর্তমান শিক্ষা মন্ত্রণালয় পাসের হার বাড়িয়ে শিক্ষার উন্নতির ভান না করায় বাস্তব চিত্র স্পষ্ট হয়েছে। আগামী সরকার যেন আবার সেই পুরনো ‘সংখ্যার উন্নয়ন’ খেলায় না মেতে ওঠেÑ এটাই প্রত্যাশা।
যারা ভালো ফল করেছে, তারা অভিনন্দনের দাবিদার। কৃতিত্বের পেছনে বিদ্যালয়ের পরিবেশের চেয়ে বেশি ভূমিকা তাদের নিজস্ব অধ্যবসায় ও পরিবারের সহায়তার। মেয়েদের এগিয়ে থাকা একাগ্রতা ও দৃঢ়তার দৃষ্টান্ত।
আর যারা অকৃতকার্য বা আশানুরূপ ফল করতে পারেনি, তাদের জন্য বার্তাÑ হতাশ না হয়ে আবারও চেষ্টা করতে হবে। ব্যর্থতার কারণ চিহ্নিত করে তা জয় করার উদ্যোগ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, উচ্চতর ডিগ্রি নয়, আত্ম-আবিষ্কারই জীবনের সাফল্যের আসল চাবিকাঠি।
[লেখক: সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি]
মিহির কুমার রায়
সোমবার, ২০ অক্টোবর ২০২৫
১৬ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশ করেছে শিক্ষা বোর্ডগুলো। নয়টি সাধারণ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে এ বছর গড় পাসের হার ৫৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ, যা গত বছরের তুলনায় ১৮ দশমিক ৯৫ শতাংশ কম। গত বছর এই পরীক্ষায় পাসের হার ছিল ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এর আগে ২০০৪ সালে এইচএসসিতে পাস করেছিল ৪৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ শিক্ষার্থী, ২০০৫ সালে ছিল ৫৯ দশমিক ১৬ শতাংশ। এরপর থেকে পাসের হার আর কখনো এর নিচে নামেনি। সেই হিসাবে ২০ বছরের মধ্যে এবারই পাসের হার সবচেয়ে কম।
শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করছেন, মূলত তিনটি কারণে এবার পাশের হার ও জিপিএ-৫ কমেছেÑ
প্রথমত, রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানা কারণে পরীক্ষার্থীরা কলেজে ক্লাস কম পেয়েছে;
দ্বিতীয়ত, ইংরেজি, হিসাববিজ্ঞান ও আইসিটিতে পাসের হার তুলনামূলক কম;
তৃতীয়ত, উত্তরপত্র মূল্যায়নে কড়াকড়ি এবং গ্রাম-শহরের ফলাফলে ব্যাপক তারতম্য।
এবার এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছে পাঁচ লাখের বেশি শিক্ষার্থী। মোট ১২ লাখ ৩৫ হাজার ৬৬১ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছে ৭ লাখ ২৬ হাজার ৯৬০ জন, ফেল করেছে ৫ লাখ ৮ হাজার ৭০১ জন। ছাত্র ছিল ৬ লাখ ১১ হাজার ৪৪৬ জন, উত্তীর্ণ হয়েছে ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৮৬৪ জন। ছাত্রী ছিল ৬ লাখ ২৪ হাজার ২১৫ জন, উত্তীর্ণ হয়েছে ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৯৬ জন।
সার্বিক ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুই দশকের মধ্যে এবারই সবচেয়ে কম পাসের হার। ২০০৫ সালে গড় পাসের হার ছিল ৫৯ দশমিক ৭ শতাংশ; এরপর থেকে প্রায় প্রতিবছরই তা বেড়েছে বা সামান্য কমেছে। ২১ বছর পর শিক্ষার্থীদের ফলাফলে একপ্রকার ধস নেমেছে।
এবার ১১টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় গড় পাসের হার হয়েছে ৫৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ১৯ শতাংশ কম। একই সঙ্গে সর্বোচ্চ গ্রেড পয়েন্ট অ্যাভারেজ (জিপিএ–৫) পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও ব্যাপক হারে কমেছে। এ বছর জিপিএ–৫ পেয়েছে ৬৯ হাজার ৯৭ জন, গত বছর ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৯১১ জনÑ অর্থাৎ কমেছে ৭৬ হাজার ৮১৪ জন।
বিভাগভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়Ñ বিজ্ঞান বিভাগে পাসের হার ৭৮ দশমিক ৭২ শতাংশ, বাণিজ্যে ৫৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ, মানবিকে মাত্র ৪৮ দশমিক ২৩ শতাংশ।
মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীরা ইংরেজিতে সবচেয়ে বেশি খারাপ করেছে বলে শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
বিগত কয়েক বছরের মতো এবারও পাসের হার ও জিপিএ-৫ পাওয়ার দিক থেকে মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে। মেয়েদের পাসের হার ৬২ দশমিক ৯৭ শতাংশ এবং ছেলেদের ৫৪ দশমিক ৬০ শতাংশ।
এ বছর দেশের ২০২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থী পাস করতে পারেনিÑ গত বছর এ সংখ্যা ছিল ৬৫। আবার শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও কমেছে; এবার ৩৪৫টি, গত বছর ছিল ১ হাজার ৩৮৮টি।
শিক্ষা বোর্ডগুলোর তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে ইংরেজি ও তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়ে। বিশেষ করে ইংরেজিতে ফেল করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ২৫ শতাংশ বেড়েছে। শুধু দিনাজপুর বোর্ডেই ৩৫ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী এ বিষয়ে ফেল করেছে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, এই দুটি বিষয় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিক্ষার্থীদের শেখার ঘাটতির বড় সূচক হয়ে উঠেছে।
গ্রাম ও শহরের পার্থক্যও এবার প্রকট। শহুরে কিছু নামকরা কলেজে পাসের হার ৮০ শতাংশের ওপরে থাকলেও গ্রামীণ কলেজের অনেক জায়গায় তা ৪০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।
বোর্ডভিত্তিক ফলাফলে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড শীর্ষেÑ পাসের হার ৭৫ দশমিক ৬১ শতাংশ। সবচেয়ে কম পাস করেছে কুমিল্লা বোর্ড, ৪৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ।
নয়টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে পাসের হারে এগিয়ে ঢাকা বোর্ড (৬৪ দশমিক ৬২ শতাংশ), আর পিছিয়ে কুমিল্লা বোর্ড। অন্যান্য বোর্ডের মধ্যে রাজশাহী ৫৯ দশমিক ৪০, যশোর ৫০ দশমিক ২০, চট্টগ্রাম ৫২ দশমিক ৫৭, বরিশাল ৬২ দশমিক ৫৭, সিলেট ৫১ দশমিক ৮৬, দিনাজপুর ৫৭ দশমিক ৪৯, ময়মনসিংহ ৫১ দশমিক ৫৪ এবং কারিগরি বোর্ডে ৬২ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান বলেছেন, “ইংরেজিতে শিক্ষার্থীরা বরাবরই দুর্বল। হিসাববিজ্ঞানও কঠিন বিষয়। এসব বিষয়ে ভালো শিক্ষক নেই অনেক প্রতিষ্ঠানে। শিক্ষার্থীরা পড়ালেখার ব্যাপারে বিমুখ হয়ে পড়েছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে এ নিয়ে বসতে হবে, শিক্ষার্থীদেরও সচেতন হতে হবে।”
গুণগত শিক্ষার প্রশ্ন
ফলাফল প্রকাশের পর থেকেই শিক্ষাঙ্গন ও অভিভাবকদের মনে একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছেÑ জিপিএ-৫ কি সত্যিই গুণগত শিক্ষার প্রতিফলন, নাকি কেবল সংখ্যার খেলা?
উপরের পরিসংখ্যানগুলোই বলছে, শুধু জিপিএ-৫ গোনার মাধ্যমে শিক্ষার মান বিচার করা বাস্তবতাকে বিকৃত করে। প্রশ্নের মান, মূল্যায়নের সমতা, শিক্ষকের দক্ষতা, স্কুলভিত্তিক প্রস্তুতি ও অঞ্চলভেদে সুযোগের বৈষম্যÑ সবকিছুরই প্রভাব স্পষ্টভাবে পড়েছে এবারের ফলে।
এক শিক্ষার্থী (নটর ডেম কলেজ, ইংরেজি সংস্করণ) বলেন, “গ্রেস মার্কস সঠিকভাবে দেওয়া হলে, একই নির্দেশনা অনুসারে সব খাতা মূল্যায়ন করা হলে এবং ইংরেজি সংস্করণের খাতা দক্ষ শিক্ষকেরা মূল্যায়ন করলে ফলাফল আরও ভারসাম্যপূর্ণ হতো।”
এ মন্তব্যে প্রতিফলিত হয়েছে মূল্যায়ন পদ্ধতিতে অভিন্ন মানদ- ও দক্ষ পরীক্ষক নিয়োগের প্রয়োজনীয়তাÑ যা আজকের শিক্ষাব্যবস্থার বড় ঘাটতি।
জিপিএ-৫ নিঃসন্দেহে পরীক্ষায় সাফল্যের প্রতীক, কিন্তু ‘গুণগত শিক্ষা’ নয়। কারণ গুণগত শিক্ষার মূল মানে চিন্তা, বিশ্লেষণ, সমস্যা সমাধান, সৃজনশীলতা, গবেষণাভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি, ভাষা ও সংখ্যাজ্ঞান, দলগত কাজ ও নৈতিকতা। আমাদের বর্তমান মূল্যায়ন এখনো মুখস্থনির্ভর ও প্রশ্নকেন্দ্রিক। ফলে প্রশ্নের মান বা মূল্যায়নের নীতিতে সামান্য পরিবর্তন এলেই জিপিএ-৫-এর সংখ্যা দুলে ওঠে।
এবারের ফলাফল তাই একদিকে মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় বাস্তবতায় ফেরার ইঙ্গিত দিলেও, অন্যদিকে এটি বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর আত্মবিশ্বাসে আঘাত করেছে।
অভিভাবকদের প্রশ্নÑ এই বিপুল সংখ্যক অকৃতকার্য শিক্ষার্থী কি উচ্চশিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে? নাকি এই ফলাফল আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুনভাবে গঠন করার একটি সুযোগ এনে দিচ্ছে?
নেতিবাচক দিকে দুর্বল স্কুল ও নিম্ন আয়ের পরিবারের সন্তানরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শিক্ষক সংকট, কোচিং নির্ভরতা, ইংরেজি ও গণিতে দুর্বলতা, আর্থ-ুসামাজিক বৈষম্যÑ সব মিলিয়ে এই গোষ্ঠীতে অকৃতকার্যতার হার বেশি।
ইতিবাচক দিক হলো, জিপিএ-৫ কমে যাওয়ার অর্থ ‘গ্রেড ইনফ্লেশনে’ লাগাম টানা। এতে মেধা বাছাই তুলনামূলক নিরপেক্ষ হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন জিপিএর পাশাপাশি লিখিত পরীক্ষা, রচনা, প্রজেক্ট, পোর্টফোলিও ও সাক্ষাৎকারের ওপর জোর দিতে পারবে।
বোর্ডভিত্তিক পার্থক্য কমাতে প্রয়োজন লক্ষ্যভিত্তিক সহায়তা, দুর্বল স্কুলের জন্য ফাউন্ডেশন কোর্স, ডায়াগনস্টিক টেস্ট, শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও রিমেডিয়েশন প্রোগ্রাম। প্রশ্নপত্র বিশ্লেষণ করে কোন অংশে শিক্ষার্থীরা বেশি হোঁচট খাচ্ছে তা নির্ধারণ করা জরুরি।
২০২৫ সালের এই ফলাফল আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেÑ প্রাতিষ্ঠানিক মাননিয়ন্ত্রণ শক্তিশালী না হলে জাতির শিক্ষার মান কখনো স্থিতিশীল হবে না।
শিক্ষা কর্তৃপক্ষ ও নীতিনির্ধারকদের জন্য মূল বার্তা একটিÑ বিদ্যালয় শিক্ষা আর কতদিন অবহেলিত থাকবে?
রাজনৈতিক প্রভাবহীন বর্তমান শিক্ষা মন্ত্রণালয় পাসের হার বাড়িয়ে শিক্ষার উন্নতির ভান না করায় বাস্তব চিত্র স্পষ্ট হয়েছে। আগামী সরকার যেন আবার সেই পুরনো ‘সংখ্যার উন্নয়ন’ খেলায় না মেতে ওঠেÑ এটাই প্রত্যাশা।
যারা ভালো ফল করেছে, তারা অভিনন্দনের দাবিদার। কৃতিত্বের পেছনে বিদ্যালয়ের পরিবেশের চেয়ে বেশি ভূমিকা তাদের নিজস্ব অধ্যবসায় ও পরিবারের সহায়তার। মেয়েদের এগিয়ে থাকা একাগ্রতা ও দৃঢ়তার দৃষ্টান্ত।
আর যারা অকৃতকার্য বা আশানুরূপ ফল করতে পারেনি, তাদের জন্য বার্তাÑ হতাশ না হয়ে আবারও চেষ্টা করতে হবে। ব্যর্থতার কারণ চিহ্নিত করে তা জয় করার উদ্যোগ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, উচ্চতর ডিগ্রি নয়, আত্ম-আবিষ্কারই জীবনের সাফল্যের আসল চাবিকাঠি।
[লেখক: সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি]