রেজাউল করিম খোকন
এখন বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহর ঢাকা। যান চলাচলে এই ধীরগতির নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে। দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যেও বাংলাদেশের শহরগুলোতে গতি কম। অন্যান্য দরিদ্র দেশের তুলনায় বাংলাদেশে গতি গড়ে ২০ শতাংশ কম।
দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই পরিকল্পনার বদলে স্বল্পমেয়াদি সমাধানের চেষ্টা এখানে বেশি হয়েছে। এখন বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, কিন্তু সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ছাড়া কেবল প্রকল্প দিয়ে সমস্যার সমাধান হয় না। ঢাকার ওপর চাপ কমাতে বিকেন্দ্রীকরণ দরকার
নাগরিক গতির একটি নির্ধারক হলো বড় রাস্তা। বড় রাস্তা মানেই ভিড় কমবে, এমন নয়; বরং বড় রাস্তা গতি বাড়ায়। দ্বিতীয়ত, শহরে বহু মানুষ কর্মক্ষেত্র, স্কুল ও বিনোদনকেন্দ্রের হাঁটার দূরত্বে বসবাস করে না। তারা দ্রুতগতির ও নির্ভরযোগ্য যাতায়াত ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করতে চায়। আধুনিক মহানগরের অপরিহার্য শর্ত হলো দ্রুতগতির যান্ত্রিক যান। জটিল উৎপাদন নেটওয়ার্ক ও বিচিত্র ভোগের এই সময়ে হেঁটে যাতায়াতের চিন্তা মধ্যযুগীয়।
তৃতীয়ত, পরিবার ও সরকার উভয়ই নগর যাতায়াতে প্রচুর সময় ও অর্থ ব্যয় করে। কিন্তু একটি শহর ভ্রমণ বা চলাচলের জন্য কতটা উপযোগী-তা কমই জানা থাকে। নগর পরিকল্পনাবিদেরা খুব কমই জানেন, একই ধরনের শহরের তুলনায় তাদের শহর কতটা পিছিয়ে বা কেন পিছিয়ে। মানুষের চলাচল একটি জরুরি বিষয়; শহর গড়ে উঠেছে মূলত শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বিনোদনের সুবিধা অল্প জায়গায় এনে দেওয়ার জন্য, যাতে মানুষ দ্রুত চলাচল করে সেসব সুবিধা নিতে পারে। কিন্তু ঢাকায় দ্রুত চলাচলের সুবিধা নেই।
দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই পরিকল্পনার বদলে স্বল্পমেয়াদি সমাধানের চেষ্টা এখানে বেশি হয়েছে। এখন বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, কিন্তু সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ছাড়া কেবল প্রকল্প দিয়ে সমস্যার সমাধান হয় না। ঢাকার ওপর চাপ কমাতে বিকেন্দ্রীকরণ দরকার। শহরে ছোট গাড়ি, রিকশা ও মোটরসাইকেল কমাতে হবে-তা না করে আমরা কাজ করছি উল্টো পথে। ফলে বিপুল ব্যয়ে প্রকল্প হলেও সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।
রাজধানীর যানজট পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়েছে বলা যায় না। সব সড়কেই এখন যানজট আগের মতোই, বরং গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলোতে ভয়াবহতা বেড়েছে। রাজধানীর নাগরিক দুর্ভোগ অনেকটাই কমবে-এমন প্রত্যাশা ছিল সবার। এই সমস্যা সমাধানে গত দুই দশকে নানা পরিকল্পনা নেওয়া হলেও, বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলো দিয়ে কি সত্যিই সংকট মোকাবিলা সম্ভব? একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে এমন প্রশ্ন যে কারও মনে আসতে পারে।
বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও এখন ঢাকায় আগ্রহী, কিন্তু শহরে প্রবেশের পর যানজটে পড়েই তাঁদের উৎসাহে ধাক্কা লাগে। প্রশ্ন উঠতেই পারে-এ কেমন শহর, যেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় বসে থাকতে হয়? যানজট নিরসনে শত কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া ছাড়া কি বিকল্প নেই? আছে, অবশ্যই আছে।
বড় বিনিয়োগ ছাড়াই যানজট কমানোর বিকল্প উপায় বহুদিন ধরে আলোচনায় আছে, কিন্তু সরকার, পরামর্শক ও দাতা সংস্থার উৎসাহ খুবই কম। অথচ সময়ের বাস্তবতা বলছে-বিপুল অর্থের প্রকল্প নয়, বিকল্প ভাবনাই এখন জরুরি। ’৯০-এর দশক থেকেই রাজধানীর যানজট নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, ২০০১ সালের পর তা আরও বেড়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র উন্নয়ন প্রকল্পে যানজট কমানো সম্ভব নয়-প্রয়োজন বিকেন্দ্রীকরণ। ঢাকামুখী জনস্রোত কমানো না গেলে যানজটও নিরসন অসম্ভব।
একটির পর একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও বিকেন্দ্রীকরণে সরকারের তেমন উদ্যোগ নেই। নগরবাসীকে যানজটের মহাদুর্ভোগ থেকে মুক্তি দিতে জরুরি প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন। গার্মেন্টসহ বিভিন্ন শিল্প-কারখানা নগরের বাইরে স্থানান্তর করতে হবে। নতুন শিল্প কারখানা শহরে স্থাপনের অনুমতি দেওয়া বন্ধ করতে হবে।
সারা দেশে এখন ভালো যোগাযোগ নেটওয়ার্ক আছে; পণ্য আনা-নেওয়ায় অসুবিধা হবে না। এতে ঢাকার ওপর চাপ কমবে, শ্রমিকরাও মফস্বল শহরে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করতে পারবেন। বিভাগীয় পর্যায়ে বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাস সম্প্রসারণ করা যেতে পারে। অনলাইননির্ভর নাগরিকসেবা বাড়ানো গেলে মানুষ কম ঘর থেকে বের হবে।
নতুন যুক্ত হওয়া এলাকাগুলোর নগরায়ণ পরিকল্পিতভাবে করতে হবে। সরু রাস্তাগুলো প্রশস্ত করা ও নতুন রাস্তা নির্মাণ-দুটিই জরুরি। বস্তিবাসী ও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের নিজ এলাকায় পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও নিতে হবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো-ঢাকার ট্রাফিক সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ কেবল পুলিশ করে, কিন্তু অন্য সড়কগুলো কার্যত নিয়ন্ত্রণহীন। গাড়ি নষ্ট হয়ে থাকা, রাস্তা দখল করে পার্কিং, মালামাল রাখা, যেখানে সেখানে যাত্রী ওঠানো-নামানো, টেম্পো স্ট্যান্ড-সব মিলিয়ে বিশৃঙ্খলা চরমে। রাজধানীতে আইন না মানার প্রবণতা সর্বাধিক।
তাই পুলিশি নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি আরও সিসি ক্যামেরা স্থাপন করতে হবে। আইনভঙ্গ হলে সঙ্গে সঙ্গে শাস্তি দিতে হবে। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে ট্রাফিক আইনভঙ্গের জন্য মামলা ও ড্রাইভারের পয়েন্ট কাটা শুরু হলে সচেতনতা বাড়বে। তবেই যানজট অনেকটা কমানো সম্ভব।
রাস্তায় গর্ত, বাসরুটের বিশৃঙ্খলা, অবৈধ পার্কিং, ট্রাফিক সিগন্যাল বিকল অবস্থা এবং ঘন ঘন দুর্ঘটনা-সবকিছুর দায় সবসময় ‘অন্য কারও’ ওপর চাপানো হয়। অথচ বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থার প্রতিটি অংশ-সড়ক নির্মাণ, আইন প্রয়োগ, লাইসেন্স, ফিটনেস, নগর পরিকল্পনা, জরুরি সেবা, জনসচেতনতা-সবই বিভিন্ন সংস্থার হাতে।
কোনো সংস্থা এককভাবে এই বহুমুখী সমস্যা সমাধানে পর্যাপ্ত ক্ষমতা, অর্থায়ন বা সমন্বয়ের সুযোগ পায় না। বিআরটিএ লাইসেন্স ও নিবন্ধন দেয়, কিন্তু রাস্তায় আইন প্রয়োগ করতে পারে না। ডিএমপি ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করে, কিন্তু সড়ক নকশা বা বাসরুট নির্ধারণে ভূমিকা নেই। সিটি করপোরেশন রাস্তা সংস্কার করে, কিন্তু গণপরিবহন পরিকল্পনায় প্রায়ই বাদ পড়ে।
এই বিভাজনের ফাঁকে দুর্নীতি, স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর প্রভাব, মালিক-শ্রমিক সমিতির চাপ ও ঘুষ সংস্কৃতি প্রশাসনিক সিদ্ধান্তকে স্তিমিত করে। ফলে জনগণের জীবন ঝুঁকিতে থেকেও কার্যকর জবাবদিহি হয় না।
এ মুহূর্তে ঢাকাকে নতুন এক বিপদে ফেলেছে ব্যাটারিচালিত রিকশা। একসময় এরা প্রধান সড়কে চলাচল করতে পারত না, কেবল অলি-গলিতে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে কোনো আইন-শৃঙ্খলার তোয়াক্কা না করে এরা রাজধানীর প্রধান সড়কেও অবাধে চলতে শুরু করেছে।
অদক্ষ ও অপরিপক্ক চালকদের কারণে দুর্ঘটনা বাড়ছে। এসব রিকশায় যাত্রীদের জীবন ঝুঁকির মুখে। অথচ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ। কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করে এদের চলাচল কেবল পাড়া-মহল্লায় সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। নগর বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন-এভাবে চলতে থাকলে একসময় রাস্তাগুলো পুরোপুরি দখল হয়ে যাবে।
যত বড় অবকাঠামোই গড়া হোক, নাগরিক আচরণ না বদলালে সফলতা আসবে না। বর্তমানে রাস্তায় প্রভাবশালী মানেই জয়ী-লাল বাতি মানা হয় না, অ্যাম্বুলেন্স আটকে থাকে, পথচারী হয় বিপন্ন। একটি নতুন সড়ক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে, যেখানে পথচারীর অধিকার সংরক্ষিত থাকবে, অ্যাম্বুলেন্স অগ্রাধিকার পাবে, শিশুরা নিরাপদে সাইকেল চালাতে পারবে, বয়স্করা নিশ্চিন্তে ফুটপাতে হাঁটতে পারবেন।
এসব কেবল দুর্ঘটনা কমাবে না, নাগরিক জীবনে সহমর্মিতা ও আস্থাও ফিরিয়ে আনবে। রাষ্ট্রকে ভাবতে হবে-নগরের সড়ক ও উন্মুক্ত স্থানগুলোয় নাগরিকদের কী দেওয়া উচিত, এবং নাগরিকদেরও সচেতন হতে হবে।
আমরা আমাদের রাস্তাঘাটকে দৈনন্দিন অবিচার বা নৈরাজ্যের প্রতীক হতে দিতে পারি না। কারণ দিন শেষে যানজটই আসল সমস্যা নয়-এর প্রতি আমাদের অবজ্ঞাই হলো মূল সমস্যা। এই অবজ্ঞা থেকে বেরিয়ে আসার পথ আমাদের হাতেই। এটি শুধু যানজট বা সড়কের নয়-এটি আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রশ্ন।
[লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]
রেজাউল করিম খোকন
বুধবার, ২২ অক্টোবর ২০২৫
এখন বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহর ঢাকা। যান চলাচলে এই ধীরগতির নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে। দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যেও বাংলাদেশের শহরগুলোতে গতি কম। অন্যান্য দরিদ্র দেশের তুলনায় বাংলাদেশে গতি গড়ে ২০ শতাংশ কম।
দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই পরিকল্পনার বদলে স্বল্পমেয়াদি সমাধানের চেষ্টা এখানে বেশি হয়েছে। এখন বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, কিন্তু সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ছাড়া কেবল প্রকল্প দিয়ে সমস্যার সমাধান হয় না। ঢাকার ওপর চাপ কমাতে বিকেন্দ্রীকরণ দরকার
নাগরিক গতির একটি নির্ধারক হলো বড় রাস্তা। বড় রাস্তা মানেই ভিড় কমবে, এমন নয়; বরং বড় রাস্তা গতি বাড়ায়। দ্বিতীয়ত, শহরে বহু মানুষ কর্মক্ষেত্র, স্কুল ও বিনোদনকেন্দ্রের হাঁটার দূরত্বে বসবাস করে না। তারা দ্রুতগতির ও নির্ভরযোগ্য যাতায়াত ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করতে চায়। আধুনিক মহানগরের অপরিহার্য শর্ত হলো দ্রুতগতির যান্ত্রিক যান। জটিল উৎপাদন নেটওয়ার্ক ও বিচিত্র ভোগের এই সময়ে হেঁটে যাতায়াতের চিন্তা মধ্যযুগীয়।
তৃতীয়ত, পরিবার ও সরকার উভয়ই নগর যাতায়াতে প্রচুর সময় ও অর্থ ব্যয় করে। কিন্তু একটি শহর ভ্রমণ বা চলাচলের জন্য কতটা উপযোগী-তা কমই জানা থাকে। নগর পরিকল্পনাবিদেরা খুব কমই জানেন, একই ধরনের শহরের তুলনায় তাদের শহর কতটা পিছিয়ে বা কেন পিছিয়ে। মানুষের চলাচল একটি জরুরি বিষয়; শহর গড়ে উঠেছে মূলত শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বিনোদনের সুবিধা অল্প জায়গায় এনে দেওয়ার জন্য, যাতে মানুষ দ্রুত চলাচল করে সেসব সুবিধা নিতে পারে। কিন্তু ঢাকায় দ্রুত চলাচলের সুবিধা নেই।
দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই পরিকল্পনার বদলে স্বল্পমেয়াদি সমাধানের চেষ্টা এখানে বেশি হয়েছে। এখন বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, কিন্তু সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ছাড়া কেবল প্রকল্প দিয়ে সমস্যার সমাধান হয় না। ঢাকার ওপর চাপ কমাতে বিকেন্দ্রীকরণ দরকার। শহরে ছোট গাড়ি, রিকশা ও মোটরসাইকেল কমাতে হবে-তা না করে আমরা কাজ করছি উল্টো পথে। ফলে বিপুল ব্যয়ে প্রকল্প হলেও সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।
রাজধানীর যানজট পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়েছে বলা যায় না। সব সড়কেই এখন যানজট আগের মতোই, বরং গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলোতে ভয়াবহতা বেড়েছে। রাজধানীর নাগরিক দুর্ভোগ অনেকটাই কমবে-এমন প্রত্যাশা ছিল সবার। এই সমস্যা সমাধানে গত দুই দশকে নানা পরিকল্পনা নেওয়া হলেও, বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলো দিয়ে কি সত্যিই সংকট মোকাবিলা সম্ভব? একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে এমন প্রশ্ন যে কারও মনে আসতে পারে।
বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও এখন ঢাকায় আগ্রহী, কিন্তু শহরে প্রবেশের পর যানজটে পড়েই তাঁদের উৎসাহে ধাক্কা লাগে। প্রশ্ন উঠতেই পারে-এ কেমন শহর, যেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় বসে থাকতে হয়? যানজট নিরসনে শত কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া ছাড়া কি বিকল্প নেই? আছে, অবশ্যই আছে।
বড় বিনিয়োগ ছাড়াই যানজট কমানোর বিকল্প উপায় বহুদিন ধরে আলোচনায় আছে, কিন্তু সরকার, পরামর্শক ও দাতা সংস্থার উৎসাহ খুবই কম। অথচ সময়ের বাস্তবতা বলছে-বিপুল অর্থের প্রকল্প নয়, বিকল্প ভাবনাই এখন জরুরি। ’৯০-এর দশক থেকেই রাজধানীর যানজট নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, ২০০১ সালের পর তা আরও বেড়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র উন্নয়ন প্রকল্পে যানজট কমানো সম্ভব নয়-প্রয়োজন বিকেন্দ্রীকরণ। ঢাকামুখী জনস্রোত কমানো না গেলে যানজটও নিরসন অসম্ভব।
একটির পর একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও বিকেন্দ্রীকরণে সরকারের তেমন উদ্যোগ নেই। নগরবাসীকে যানজটের মহাদুর্ভোগ থেকে মুক্তি দিতে জরুরি প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন। গার্মেন্টসহ বিভিন্ন শিল্প-কারখানা নগরের বাইরে স্থানান্তর করতে হবে। নতুন শিল্প কারখানা শহরে স্থাপনের অনুমতি দেওয়া বন্ধ করতে হবে।
সারা দেশে এখন ভালো যোগাযোগ নেটওয়ার্ক আছে; পণ্য আনা-নেওয়ায় অসুবিধা হবে না। এতে ঢাকার ওপর চাপ কমবে, শ্রমিকরাও মফস্বল শহরে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করতে পারবেন। বিভাগীয় পর্যায়ে বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাস সম্প্রসারণ করা যেতে পারে। অনলাইননির্ভর নাগরিকসেবা বাড়ানো গেলে মানুষ কম ঘর থেকে বের হবে।
নতুন যুক্ত হওয়া এলাকাগুলোর নগরায়ণ পরিকল্পিতভাবে করতে হবে। সরু রাস্তাগুলো প্রশস্ত করা ও নতুন রাস্তা নির্মাণ-দুটিই জরুরি। বস্তিবাসী ও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের নিজ এলাকায় পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও নিতে হবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো-ঢাকার ট্রাফিক সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ কেবল পুলিশ করে, কিন্তু অন্য সড়কগুলো কার্যত নিয়ন্ত্রণহীন। গাড়ি নষ্ট হয়ে থাকা, রাস্তা দখল করে পার্কিং, মালামাল রাখা, যেখানে সেখানে যাত্রী ওঠানো-নামানো, টেম্পো স্ট্যান্ড-সব মিলিয়ে বিশৃঙ্খলা চরমে। রাজধানীতে আইন না মানার প্রবণতা সর্বাধিক।
তাই পুলিশি নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি আরও সিসি ক্যামেরা স্থাপন করতে হবে। আইনভঙ্গ হলে সঙ্গে সঙ্গে শাস্তি দিতে হবে। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে ট্রাফিক আইনভঙ্গের জন্য মামলা ও ড্রাইভারের পয়েন্ট কাটা শুরু হলে সচেতনতা বাড়বে। তবেই যানজট অনেকটা কমানো সম্ভব।
রাস্তায় গর্ত, বাসরুটের বিশৃঙ্খলা, অবৈধ পার্কিং, ট্রাফিক সিগন্যাল বিকল অবস্থা এবং ঘন ঘন দুর্ঘটনা-সবকিছুর দায় সবসময় ‘অন্য কারও’ ওপর চাপানো হয়। অথচ বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থার প্রতিটি অংশ-সড়ক নির্মাণ, আইন প্রয়োগ, লাইসেন্স, ফিটনেস, নগর পরিকল্পনা, জরুরি সেবা, জনসচেতনতা-সবই বিভিন্ন সংস্থার হাতে।
কোনো সংস্থা এককভাবে এই বহুমুখী সমস্যা সমাধানে পর্যাপ্ত ক্ষমতা, অর্থায়ন বা সমন্বয়ের সুযোগ পায় না। বিআরটিএ লাইসেন্স ও নিবন্ধন দেয়, কিন্তু রাস্তায় আইন প্রয়োগ করতে পারে না। ডিএমপি ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করে, কিন্তু সড়ক নকশা বা বাসরুট নির্ধারণে ভূমিকা নেই। সিটি করপোরেশন রাস্তা সংস্কার করে, কিন্তু গণপরিবহন পরিকল্পনায় প্রায়ই বাদ পড়ে।
এই বিভাজনের ফাঁকে দুর্নীতি, স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর প্রভাব, মালিক-শ্রমিক সমিতির চাপ ও ঘুষ সংস্কৃতি প্রশাসনিক সিদ্ধান্তকে স্তিমিত করে। ফলে জনগণের জীবন ঝুঁকিতে থেকেও কার্যকর জবাবদিহি হয় না।
এ মুহূর্তে ঢাকাকে নতুন এক বিপদে ফেলেছে ব্যাটারিচালিত রিকশা। একসময় এরা প্রধান সড়কে চলাচল করতে পারত না, কেবল অলি-গলিতে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে কোনো আইন-শৃঙ্খলার তোয়াক্কা না করে এরা রাজধানীর প্রধান সড়কেও অবাধে চলতে শুরু করেছে।
অদক্ষ ও অপরিপক্ক চালকদের কারণে দুর্ঘটনা বাড়ছে। এসব রিকশায় যাত্রীদের জীবন ঝুঁকির মুখে। অথচ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ। কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করে এদের চলাচল কেবল পাড়া-মহল্লায় সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। নগর বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন-এভাবে চলতে থাকলে একসময় রাস্তাগুলো পুরোপুরি দখল হয়ে যাবে।
যত বড় অবকাঠামোই গড়া হোক, নাগরিক আচরণ না বদলালে সফলতা আসবে না। বর্তমানে রাস্তায় প্রভাবশালী মানেই জয়ী-লাল বাতি মানা হয় না, অ্যাম্বুলেন্স আটকে থাকে, পথচারী হয় বিপন্ন। একটি নতুন সড়ক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে, যেখানে পথচারীর অধিকার সংরক্ষিত থাকবে, অ্যাম্বুলেন্স অগ্রাধিকার পাবে, শিশুরা নিরাপদে সাইকেল চালাতে পারবে, বয়স্করা নিশ্চিন্তে ফুটপাতে হাঁটতে পারবেন।
এসব কেবল দুর্ঘটনা কমাবে না, নাগরিক জীবনে সহমর্মিতা ও আস্থাও ফিরিয়ে আনবে। রাষ্ট্রকে ভাবতে হবে-নগরের সড়ক ও উন্মুক্ত স্থানগুলোয় নাগরিকদের কী দেওয়া উচিত, এবং নাগরিকদেরও সচেতন হতে হবে।
আমরা আমাদের রাস্তাঘাটকে দৈনন্দিন অবিচার বা নৈরাজ্যের প্রতীক হতে দিতে পারি না। কারণ দিন শেষে যানজটই আসল সমস্যা নয়-এর প্রতি আমাদের অবজ্ঞাই হলো মূল সমস্যা। এই অবজ্ঞা থেকে বেরিয়ে আসার পথ আমাদের হাতেই। এটি শুধু যানজট বা সড়কের নয়-এটি আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রশ্ন।
[লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]