শরীফ চৌহান
বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য এখন আর কেবল চিকিৎসার বিষয় নয়; এটি এক গভীর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মানবাধিকারের প্রশ্ন। দ্রুত নগরায়ণ, তরুণ বেকারত্ব, ডিজিটাল সহিংসতা, সামাজিক অস্থিরতা, জলবায়ুজনিত দুর্যোগ ও শরণার্থী সংকট-সব মিলিয়ে মানুষের মানসিক স্থিতি ও মর্যাদা আজ কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে।
যে রাষ্ট্র তার নাগরিকের মনের শান্তি রক্ষা করতে পারে না, সেখানে টেকসই উন্নয়ন কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকে। তাই মানসিক স্বাস্থ্য এখন জাতীয় নীতি, উন্নয়ন ও মানবাধিকারের অন্যতম মৌলিক ক্ষেত্র।
বাংলাদেশে মানসিক কষ্টকে এখনো “লজ্জা” বা “দুর্বলতা” হিসেবে দেখা হয়। ফলে মানুষ মানসিক সমস্যা নিয়ে কথা বলতে বা চিকিৎসা নিতে দ্বিধা করে। অথচ আধুনিক স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের মতে, মানুষের সুস্থতার ছয়টি দিক-শারীরিক, মানসিক, আবেগিক, সামাজিক, পরিবেশগত ও আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্য-একটির সঙ্গে অন্যটি নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। একটিতে ভারসাম্য নষ্ট হলে অন্যগুলোও আক্রান্ত হয়।
অতএব মানসিক স্বাস্থ্য কোনো বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়, এটি সামগ্রিক মানবকল্যাণ ও মর্যাদার ভিত্তি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞায় স্বাস্থ্য মানে “শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে পূর্ণ সুস্থতা।” অর্থাৎ মানসিক স্থিতি, মর্যাদা ও নিরাপত্তা-সবই মানুষের মৌলিক অধিকার।
মানসিক স্বাস্থ্য ও মানবাধিকারের সম্পর্ক: মানসিক স্বাস্থ্য কেবল চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার নয়; এটি মর্যাদা, নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার অধিকারও। জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা (১৯৪৮) এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার চুক্তি (১৯৬৬)-তে মানসিক স্বাস্থ্যের অধিকারকে মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫, ১৮ ও ৩২ অনুচ্ছেদ জীবন, স্বাস্থ্য ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার নিশ্চিত করেছে-যা মানসিক সুস্থতার সুরক্ষাকেও অন্তর্ভুক্ত করে।
তবু বাস্তবে মানসিক রোগে আক্রান্ত মানুষ অবহেলা, বৈষম্য ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতার শিকার হন। সমাজে তাদের জন্য সহানুভূতির বদলে প্রায়ই উপহাস, ভয় বা দূরত্ব কাজ করে। এই অদৃশ্য বঞ্চনাই মানবাধিকারের ভিত দুর্বল করে দেয়।
বাংলাদেশের বাস্তব চিত্র : জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ২০১৯ সালের জরিপ অনুযায়ী, দেশে প্রায় ১৮ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। প্রতি সাতজন কিশোরের একজন মানসিক ঝুঁকিতে রয়েছে। অথচ দেশে নিবন্ধিত মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সংখ্যা মাত্র কয়েকশো, যার বেশির ভাগই রাজধানীকেন্দ্রিক। ফলে গ্রামের মানুষ কার্যত সেবা থেকে বঞ্চিত।
বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণের প্রধান পাঁচ চ্যালেঞ্জ হলো-জনবল সংকট, বাজেটের স্বল্পতা, সামাজিক লজ্জা, সচেতনতার অভাব এবং প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা।
ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, ভূমিধস বা বাস্তুচ্যুতি মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলে, অথচ এসব পরিস্থিতিতে মানসিক সহায়তা প্রায় অনুপস্থিত থাকে-যা পুনর্বাসন প্রক্রিয়াকে অসম্পূর্ণ রাখে।
আইন ও নীতিগত কাঠামো : ২০১৮ সালে “মানসিক স্বাস্থ্য আইন” পাস হয়, যেখানে রোগীর অধিকার, চিকিৎসার গোপনীয়তা ও মানবিক আচরণের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। ২০২২ সালে প্রণীত “জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য নীতি”-তে সমাজভিত্তিক সেবা নিশ্চিতের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
তবে বাস্তবে এই নীতি কাগজেই সীমাবদ্ধ: বাজেট স্বল্প, জেলা পর্যায়ে ইউনিট সীমিত, প্রশিক্ষিত জনবল প্রায় অনুপস্থিত। দুর্যোগকালীন মানসিক সহায়তার ক্ষেত্রেও আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় জরুরি।
প্রবীণ, প্রতিবন্ধী ও নারীর ঝুঁকি : জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদনে দেখা যায়, কারাগার, আশ্রয়কেন্দ্র ও কিছু মানসিক হাসপাতালে অনুপযুক্ত পরিবেশ ও অবহেলার অভিযোগ রয়েছে। নারী, শিশু, প্রবীণ ও প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী মানসিক কষ্টের সবচেয়ে নীরব শিকার।
একাকীত্ব, চলাচল সীমাবদ্ধতা ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা প্রবীণদের মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করে; প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা প্রায়ই শিক্ষা, চিকিৎসা ও সামাজিক যোগাযোগ থেকে বঞ্চিত থাকেন, যা আত্মবিশ্বাস ক্ষয় করে।
অর্থনৈতিক বৈষম্য ও সামাজিক অস্থিরতা : চাকরির সংকট, আয়ের বৈষম্য ও সামাজিক অস্থিরতা মানসিক অস্বস্তির মূল কারণ। তরুণ বেকারত্ব, জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধি, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সহিংসতা মানুষের উদ্বেগ, হতাশা ও অনিশ্চয়তা বাড়াচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়ায় অনেকেই মাদক, অনলাইন আসক্তি বা আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকছেন।
অতএব কর্মসংস্থান, সামাজিক নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাও মানসিক স্বাস্থ্যের অবিচ্ছেদ্য শর্ত।
ডিজিটাল সহিংসতা ও মানসিক নিরাপত্তা : ডিজিটাল যুগে মানসিক সহিংসতার নতুন রূপ হলো অনলাইন হয়রানি। বহু নারী ও কিশোরী ভুয়া ছবি, অপমানজনক মন্তব্য ও হুমকির শিকার হচ্ছেন। নিরাপদ ডিজিটাল পরিবেশ, মানসিক সহায়তা ও দ্রুত বিচারÑএই তিনটি এখন সময়ের দাবি।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য : রোহিঙ্গা শিবিরে নারী ও শিশুরা দীর্ঘদিন সহিংসতা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে বসবাস করছে। পরিবার হারানো, উচ্ছেদ ও যৌন সহিংসতার অভিজ্ঞতা তাদের মানসিক স্থিতিকে গভীরভাবে আঘাত করেছে।
শিশুদের জন্য খেলাধুলা, শিক্ষা ও সামাজিক কার্যক্রম মানসিক পুনর্বাসনে সহায়ক হলেও নিরাপত্তাহীনতা ও সীমিত সহায়তা বড় বাধা। শরণার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যকে মানবাধিকারের মূল অংশ হিসেবে বিবেচনা করা জরুরি।
সমাজ ও নাগরিক দায়িত্ব : রাষ্ট্রের পাশাপাশি শিক্ষক, সাংবাদিক, মনোবিজ্ঞানী ও সামাজিক সংগঠনগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। স্কুল, কলেজ ও কর্মস্থলে কাউন্সেলিং সেবা চালু করা দরকার।
দুর্যোগ ও সংকটকালে মানসিক সহায়তা বাড়াতে স্থানীয় পর্যায়ে শিক্ষক, ইমাম, স্বাস্থ্যকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে “কমিউনিটি সাপোর্ট নেটওয়ার্ক” গঠন করা যেতে পারে।
জনবল সংকট ও উচ্চশিক্ষার ভূমিকা : দেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে প্রশিক্ষিত জনবলের ঘাটতি অন্যতম বড় বাধা। বর্তমানে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির সীমিত কাঠামোতে এক-একজন রোগীর সঙ্গে “ওয়ান-টু-ওয়ান” সেবা প্রদান করা হয়-যা বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য কার্যকর নয়। এত বিপুল পরিসরে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিকল্প থেরাপি-ভিত্তিক উচ্চশিক্ষা কোর্স চালু করা জরুরি।
প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে “গ্রুপ সাইকোথেরাপি” বা “এক্সপ্রেসিভ থেরাপি” ভিত্তিক অনার্স ও মাস্টার্স প্রোগ্রাম চালু করা হলে প্রশিক্ষিত জনবল দ্রুত তৈরি হবে এবং বর্তমান সেবা সংকট অনেকাংশে দূর হবে। এতে সেবা আরও মানবিক, অংশগ্রহণমূলক ও সমাজভিত্তিক রূপ পাবে।
করণীয় : মানসিক স্বাস্থ্যসেবা জাতীয় উন্নয়নের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা জরুরি। এজন্য প্রয়োজন-
মানসিক স্বাস্থ্য বাজেট বৃদ্ধি এবং জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সেবা সম্প্রসারণ;
কমিউনিটি কাউন্সেলর ও স্বেচ্ছাসেবী তৈরি;
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে নিয়মিত কাউন্সেলিং সেবা চালু;
প্রবীণ ও প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ মানসিক সহায়তা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা;
মানবাধিকার কমিশনের অধীনে তদারকি ও জবাবদিহি ব্যবস্থা গঠন;
ডিজিটাল সহিংসতার বিরুদ্ধে কঠোর আইন ও দ্রুত বিচার;
দুর্যোগ ও সংঘাত-পরবর্তী পুনর্বাসনে মানসিক স্বাস্থ্য অন্তর্ভুক্তি;
এবং সর্বোপরি, মানসিক স্বাস্থ্য জনবল সংকট মোকাবিলায় প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিকল্প থেরাপি-ভিত্তিক অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালুর উদ্যোগ গ্রহণ।
শেষ কথা : মানুষের মানসিক শান্তি ও মর্যাদা রক্ষাই মানবাধিকারের প্রথম ধাপ। রাষ্ট্র যদি নাগরিকের মনকে সুস্থ রাখার দায়িত্ব নিতে না পারে, তবে অন্য কোনো উন্নয়নই টেকসই হবে না।
মানসিক স্বাস্থ্য কেবল ব্যক্তিগত নয়-এটি সমাজ ও রাষ্ট্রের মানসিকতার প্রতিচ্ছবি।
যে সমাজে মনের প্রতি শ্রদ্ধা থাকে, সেই সমাজই প্রকৃত অর্থে সভ্য।
[লেখক: সভাপতি, মেন্টাল হেলথ অ্যাডভোকেসি অ্যাসোসিয়েশন]
শরীফ চৌহান
বুধবার, ২২ অক্টোবর ২০২৫
বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য এখন আর কেবল চিকিৎসার বিষয় নয়; এটি এক গভীর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মানবাধিকারের প্রশ্ন। দ্রুত নগরায়ণ, তরুণ বেকারত্ব, ডিজিটাল সহিংসতা, সামাজিক অস্থিরতা, জলবায়ুজনিত দুর্যোগ ও শরণার্থী সংকট-সব মিলিয়ে মানুষের মানসিক স্থিতি ও মর্যাদা আজ কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে।
যে রাষ্ট্র তার নাগরিকের মনের শান্তি রক্ষা করতে পারে না, সেখানে টেকসই উন্নয়ন কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকে। তাই মানসিক স্বাস্থ্য এখন জাতীয় নীতি, উন্নয়ন ও মানবাধিকারের অন্যতম মৌলিক ক্ষেত্র।
বাংলাদেশে মানসিক কষ্টকে এখনো “লজ্জা” বা “দুর্বলতা” হিসেবে দেখা হয়। ফলে মানুষ মানসিক সমস্যা নিয়ে কথা বলতে বা চিকিৎসা নিতে দ্বিধা করে। অথচ আধুনিক স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের মতে, মানুষের সুস্থতার ছয়টি দিক-শারীরিক, মানসিক, আবেগিক, সামাজিক, পরিবেশগত ও আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্য-একটির সঙ্গে অন্যটি নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। একটিতে ভারসাম্য নষ্ট হলে অন্যগুলোও আক্রান্ত হয়।
অতএব মানসিক স্বাস্থ্য কোনো বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়, এটি সামগ্রিক মানবকল্যাণ ও মর্যাদার ভিত্তি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞায় স্বাস্থ্য মানে “শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে পূর্ণ সুস্থতা।” অর্থাৎ মানসিক স্থিতি, মর্যাদা ও নিরাপত্তা-সবই মানুষের মৌলিক অধিকার।
মানসিক স্বাস্থ্য ও মানবাধিকারের সম্পর্ক: মানসিক স্বাস্থ্য কেবল চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার নয়; এটি মর্যাদা, নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার অধিকারও। জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা (১৯৪৮) এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার চুক্তি (১৯৬৬)-তে মানসিক স্বাস্থ্যের অধিকারকে মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫, ১৮ ও ৩২ অনুচ্ছেদ জীবন, স্বাস্থ্য ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার নিশ্চিত করেছে-যা মানসিক সুস্থতার সুরক্ষাকেও অন্তর্ভুক্ত করে।
তবু বাস্তবে মানসিক রোগে আক্রান্ত মানুষ অবহেলা, বৈষম্য ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতার শিকার হন। সমাজে তাদের জন্য সহানুভূতির বদলে প্রায়ই উপহাস, ভয় বা দূরত্ব কাজ করে। এই অদৃশ্য বঞ্চনাই মানবাধিকারের ভিত দুর্বল করে দেয়।
বাংলাদেশের বাস্তব চিত্র : জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ২০১৯ সালের জরিপ অনুযায়ী, দেশে প্রায় ১৮ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। প্রতি সাতজন কিশোরের একজন মানসিক ঝুঁকিতে রয়েছে। অথচ দেশে নিবন্ধিত মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সংখ্যা মাত্র কয়েকশো, যার বেশির ভাগই রাজধানীকেন্দ্রিক। ফলে গ্রামের মানুষ কার্যত সেবা থেকে বঞ্চিত।
বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণের প্রধান পাঁচ চ্যালেঞ্জ হলো-জনবল সংকট, বাজেটের স্বল্পতা, সামাজিক লজ্জা, সচেতনতার অভাব এবং প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা।
ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, ভূমিধস বা বাস্তুচ্যুতি মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলে, অথচ এসব পরিস্থিতিতে মানসিক সহায়তা প্রায় অনুপস্থিত থাকে-যা পুনর্বাসন প্রক্রিয়াকে অসম্পূর্ণ রাখে।
আইন ও নীতিগত কাঠামো : ২০১৮ সালে “মানসিক স্বাস্থ্য আইন” পাস হয়, যেখানে রোগীর অধিকার, চিকিৎসার গোপনীয়তা ও মানবিক আচরণের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। ২০২২ সালে প্রণীত “জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য নীতি”-তে সমাজভিত্তিক সেবা নিশ্চিতের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
তবে বাস্তবে এই নীতি কাগজেই সীমাবদ্ধ: বাজেট স্বল্প, জেলা পর্যায়ে ইউনিট সীমিত, প্রশিক্ষিত জনবল প্রায় অনুপস্থিত। দুর্যোগকালীন মানসিক সহায়তার ক্ষেত্রেও আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় জরুরি।
প্রবীণ, প্রতিবন্ধী ও নারীর ঝুঁকি : জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদনে দেখা যায়, কারাগার, আশ্রয়কেন্দ্র ও কিছু মানসিক হাসপাতালে অনুপযুক্ত পরিবেশ ও অবহেলার অভিযোগ রয়েছে। নারী, শিশু, প্রবীণ ও প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী মানসিক কষ্টের সবচেয়ে নীরব শিকার।
একাকীত্ব, চলাচল সীমাবদ্ধতা ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা প্রবীণদের মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করে; প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা প্রায়ই শিক্ষা, চিকিৎসা ও সামাজিক যোগাযোগ থেকে বঞ্চিত থাকেন, যা আত্মবিশ্বাস ক্ষয় করে।
অর্থনৈতিক বৈষম্য ও সামাজিক অস্থিরতা : চাকরির সংকট, আয়ের বৈষম্য ও সামাজিক অস্থিরতা মানসিক অস্বস্তির মূল কারণ। তরুণ বেকারত্ব, জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধি, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সহিংসতা মানুষের উদ্বেগ, হতাশা ও অনিশ্চয়তা বাড়াচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়ায় অনেকেই মাদক, অনলাইন আসক্তি বা আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকছেন।
অতএব কর্মসংস্থান, সামাজিক নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাও মানসিক স্বাস্থ্যের অবিচ্ছেদ্য শর্ত।
ডিজিটাল সহিংসতা ও মানসিক নিরাপত্তা : ডিজিটাল যুগে মানসিক সহিংসতার নতুন রূপ হলো অনলাইন হয়রানি। বহু নারী ও কিশোরী ভুয়া ছবি, অপমানজনক মন্তব্য ও হুমকির শিকার হচ্ছেন। নিরাপদ ডিজিটাল পরিবেশ, মানসিক সহায়তা ও দ্রুত বিচারÑএই তিনটি এখন সময়ের দাবি।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য : রোহিঙ্গা শিবিরে নারী ও শিশুরা দীর্ঘদিন সহিংসতা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে বসবাস করছে। পরিবার হারানো, উচ্ছেদ ও যৌন সহিংসতার অভিজ্ঞতা তাদের মানসিক স্থিতিকে গভীরভাবে আঘাত করেছে।
শিশুদের জন্য খেলাধুলা, শিক্ষা ও সামাজিক কার্যক্রম মানসিক পুনর্বাসনে সহায়ক হলেও নিরাপত্তাহীনতা ও সীমিত সহায়তা বড় বাধা। শরণার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যকে মানবাধিকারের মূল অংশ হিসেবে বিবেচনা করা জরুরি।
সমাজ ও নাগরিক দায়িত্ব : রাষ্ট্রের পাশাপাশি শিক্ষক, সাংবাদিক, মনোবিজ্ঞানী ও সামাজিক সংগঠনগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। স্কুল, কলেজ ও কর্মস্থলে কাউন্সেলিং সেবা চালু করা দরকার।
দুর্যোগ ও সংকটকালে মানসিক সহায়তা বাড়াতে স্থানীয় পর্যায়ে শিক্ষক, ইমাম, স্বাস্থ্যকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে “কমিউনিটি সাপোর্ট নেটওয়ার্ক” গঠন করা যেতে পারে।
জনবল সংকট ও উচ্চশিক্ষার ভূমিকা : দেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে প্রশিক্ষিত জনবলের ঘাটতি অন্যতম বড় বাধা। বর্তমানে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির সীমিত কাঠামোতে এক-একজন রোগীর সঙ্গে “ওয়ান-টু-ওয়ান” সেবা প্রদান করা হয়-যা বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য কার্যকর নয়। এত বিপুল পরিসরে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিকল্প থেরাপি-ভিত্তিক উচ্চশিক্ষা কোর্স চালু করা জরুরি।
প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে “গ্রুপ সাইকোথেরাপি” বা “এক্সপ্রেসিভ থেরাপি” ভিত্তিক অনার্স ও মাস্টার্স প্রোগ্রাম চালু করা হলে প্রশিক্ষিত জনবল দ্রুত তৈরি হবে এবং বর্তমান সেবা সংকট অনেকাংশে দূর হবে। এতে সেবা আরও মানবিক, অংশগ্রহণমূলক ও সমাজভিত্তিক রূপ পাবে।
করণীয় : মানসিক স্বাস্থ্যসেবা জাতীয় উন্নয়নের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা জরুরি। এজন্য প্রয়োজন-
মানসিক স্বাস্থ্য বাজেট বৃদ্ধি এবং জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সেবা সম্প্রসারণ;
কমিউনিটি কাউন্সেলর ও স্বেচ্ছাসেবী তৈরি;
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে নিয়মিত কাউন্সেলিং সেবা চালু;
প্রবীণ ও প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ মানসিক সহায়তা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা;
মানবাধিকার কমিশনের অধীনে তদারকি ও জবাবদিহি ব্যবস্থা গঠন;
ডিজিটাল সহিংসতার বিরুদ্ধে কঠোর আইন ও দ্রুত বিচার;
দুর্যোগ ও সংঘাত-পরবর্তী পুনর্বাসনে মানসিক স্বাস্থ্য অন্তর্ভুক্তি;
এবং সর্বোপরি, মানসিক স্বাস্থ্য জনবল সংকট মোকাবিলায় প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিকল্প থেরাপি-ভিত্তিক অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালুর উদ্যোগ গ্রহণ।
শেষ কথা : মানুষের মানসিক শান্তি ও মর্যাদা রক্ষাই মানবাধিকারের প্রথম ধাপ। রাষ্ট্র যদি নাগরিকের মনকে সুস্থ রাখার দায়িত্ব নিতে না পারে, তবে অন্য কোনো উন্নয়নই টেকসই হবে না।
মানসিক স্বাস্থ্য কেবল ব্যক্তিগত নয়-এটি সমাজ ও রাষ্ট্রের মানসিকতার প্রতিচ্ছবি।
যে সমাজে মনের প্রতি শ্রদ্ধা থাকে, সেই সমাজই প্রকৃত অর্থে সভ্য।
[লেখক: সভাপতি, মেন্টাল হেলথ অ্যাডভোকেসি অ্যাসোসিয়েশন]