আল শাহারিয়া
বিশ্বজুড়ে যখন ক্ষুধা ও অপুষ্টিমুক্ত বিশ্ব গড়ার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা হবে, তখন বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদনের সাফল্যগাথা নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রশংসিত হবে। ধান উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয়, মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতার মতো অর্জনগুলো আমাদের জাতীয় গর্বের ভিত্তি। কিন্তু এই উজ্জ্বল পরিসংখ্যান আর উদযাপনের আড়ালেই লুকিয়ে আছে এক গভীর অন্ধকার বাস্তবতা। দেশের দক্ষিণ উপকূলের কয়েক কোটি মানুষের জীবন আজ লবণাক্ত জলের আগ্রাসনে বিপন্ন। তাই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, আমাদের নীতিনির্ধারকেরা কি উপকূলের এই নীরব খাদ্যসংকট নিয়ে গুরুত্বের সাথে ভাবার ফুরসত পাচ্ছেন?
বাংলাদেশের উপকূলীয় ১৯টি জেলা একসময় পরিচিত ছিল প্রাচুর্যময় ভূমি হিসেবে। এখানকার উর্বর পলিমাটি আর জালের মতো ছড়িয়ে থাকা নদী-নালার আশীর্বাদ যুগ যুগ ধরে কোটি কোটি মানুষের জীবিকার জোগান দিয়েছে। ঐতিহ্যগতভাবে, এই অঞ্চলের কৃষি ব্যবস্থা ছিল প্রকৃতি-নির্ভর এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ। বর্ষার মিঠা পানিতে আমন ধানের সবুজ গালিচা বিছিয়ে যেত দিগন্তজুড়ে, যা ছিল স্থানীয় জনগোষ্ঠীর প্রধান খাদ্যশস্য এবং আয়ের উৎস। শুষ্ক মৌসুমে কিছু জমি পতিত থাকলেও, খালের পাড়ে বা নিচু জমিতে ফলত ডাল, তেলবীজসহ নানা ধরনের রবিশস্য।
তবে এই মাঠের ফসলের পাশাপাশি উপকূলীয় খাদ্য নিরাপত্তার এক নীরব অথচ শক্তিশালী স্তম্ভ ছিল প্রতিটি বাড়ির আঙিনায় গড়ে ওঠা বসতভিটার কৃষি। যখন প্রাকৃতিক কারণে বা অন্য কোনো বিপর্যয়ে মাঠের ফসলহানি হতো, তখন এই বসতভিটাই হয়ে উঠত পরিবারের পুষ্টি চাহিদা মেটানোয় প্রধান সহায়ক। এখানে সারি সারি নারিকেল, পেয়ারা, আমড়া, সফেদা আর কুলের গাছ ছায়া দিত; মাচায় ঝুলত লাউ, কুমড়ো, শিম; আর উঠোনে চরে বেড়াত হাঁস-মুরগির দল। পুকুরে ভরা ছিল রুই, কাতলা, শিং, মাগুরের মতো মিঠা পানির মাছ। বিশেষ করে নারীরা এসবের মাধ্যমে পরিবারের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় এক অপরিহার্য ভূমিকা পালন করতেন। একটি পরিবার তাদের প্রয়োজনীয় চাল, ডাল, সবজি থেকে শুরু করে মাছ-মাংস-ডিম-দুধ পর্যন্ত নিজেরাই উৎপাদন করত, যা এক স্থিতিশীল ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামীণ অর্থনীতি টিকিয়ে রেখেছিল।
আশির দশক থেকে বাংলাদেশের উপকূলে শুরু হওয়া তথাকথিত ‘নীল বিপ্লব’ ছিল এক পরিবেশগত বিপর্যয়ের সূচনা। আন্তর্জাতিক বাজারে চিংড়ির চাহিদা ও মুনাফার প্রলোভনে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের হাজার হাজার হেক্টর উর্বর ধানক্ষেত লবণাক্ত পানির ঘেরে পরিণত হয়। চিংড়ি দ্রুত অন্যতম প্রধান রপ্তানি খাতে পরিণত হলেও, এর পেছনে জমি, পানি ও মানুষের দুর্ভোগের ইতিহাস গড়ে ওঠে। চিংড়ি চাষে নদীর লবণাক্ত পানি প্রবেশ করানোর ফলে আশপাশের কৃষিজমি ও ভূগর্ভস্থ পানি দূষিত হয়। ফলে ধান, শাকসবজি ও গবাদিপশু পালন প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। কৃষকেরা জীবিকা হারিয়ে শহরের বস্তিতে পাড়ি দেন, আর তাদের ফেলে যাওয়া অনুর্বর জমি আরও চিংড়ি ঘেরে পরিণত হয়।
উপকূলে আজ সবচেয়ে বড় সংকট লবণাক্ততা। এটি কৃষি উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে, মিঠাপানির অভাব তৈরি করেছে এবং মানুষের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ, ডাইরিয়া ও গর্ভকালীন জটিলতার মতো স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে লবণাক্ততা আরও বিস্তৃত হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, ২১০০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে দেশের প্রায় ১১ শতাংশ ভূমি ডুবে যাবে এবং কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। জলবায়ু–জনিত অভিবাসন ক্রমেই তীব্র আকার নিচ্ছে। গ্রাম থেকে শহরে এক সংকট থেকে অন্য সংকটে মানুষ ঢুকে পড়ছে।
পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক এই সংকটের সবচেয়ে করুণ শিকার হচ্ছে উপকূলের শিশুরা। খুলনা ও বাগেরহাটের মতো জেলাগুলোতে শিশু অপুষ্টির চিত্র যেকোনো বিবেকবান মানুষকে নাড়া দেবে। বাংলাদেশে শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে অপুষ্টি একটি গুরুতর ও দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা। তবে জাতীয় পর্যায়ের তুলনায় উপকূলীয় অঞ্চলে শিশুদের দীর্ঘমেয়াদী অপুষ্টির চিত্রটি বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। যেখানে জাতীয়ভাবে শিশুদের মধ্যে খর্বাকৃতির (স্টান্টিং) হার প্রায় ২৪%, সেখানে উপকূলীয় অঞ্চলে এটি ৩১% পর্যন্ত পৌঁছেছে। এই উচ্চ হার নির্দেশ করে যে শিশুদের দীর্ঘমেয়াদী বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলের সমস্যার মূল কারণ হলো লবণাক্ত মাটি, বন্যা ও সাইক্লোনের নিয়মিত আঘাত, স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশনের সীমাবদ্ধতা, দারিদ্র্য এবং খাদ্যের বৈচিত্র্যের অভাব। এর ফলে স্থানীয় জনগণ দীর্ঘমেয়াদী খাদ্যসংকট ও পুষ্টি অভাবের শিকার হচ্ছে, যা শিক্ষার সুযোগ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং স্বাস্থ্য পরিস্থিতিকেও মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে।
এই বিপর্যয়ের মূল কারণ খাদ্যাভ্যাসের কাঠামোগত অবনতি। লবণাক্ততার কারণে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পুষ্টিকর খাবার যেমন তাজা শাকসবজি, মৌসুমি ফল, দেশি মুরগির ডিম এবং মিঠা পানির মাছের উৎপাদন ও ভোগ দুটোই অনেক কমে গেছে। যে পরিবারগুলো একসময় খাদ্য উৎপাদক ছিল তারাই এখন খাদ্য মূল্যস্ফীতির শিকার হয়ে নিজেদের সন্তানদের মুখে পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার তুলে দিতে পারছে না। পরিবেশগত বিপর্যয় জীবিকা কেড়ে নিচ্ছে, জীবিকার অভাব ক্রয়ক্ষমতা কমাচ্ছে, এবং ক্রয়ক্ষমতার অভাবে শিশুরা অপুষ্টির শিকার হচ্ছে, যা তাদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দিচ্ছে।
এই গভীর সংকট থেকে উত্তরণের জন্য একটি সমন্বিত ও বহুমুখী কৌশল অপরিহার্য। আশার কথা হলো, নীতিগত পর্যায়ে এর স্বীকৃতি রয়েছে। বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ এবং জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনার মতো শক্তিশালী নীতি কাঠামো আমাদের আছে, যেখানে উপকূলের চ্যালেঞ্জগুলোকে গুরুত্বের সাথে তুলে ধরা হয়েছে।
মূল প্রশ্নটি হলো নীতি, পরিকল্পনা এবং প্রযুক্তিগুলো কি তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে? লবণ-সহনশীল ধানের বীজ কি প্রান্তিক কৃষক সময়মতো এবং সাশ্রয়ী মূল্যে পাচ্ছেন? অপরিকল্পিত চিংড়ি ঘেরের আগ্রাসন বন্ধ করে কৃষি জমি রক্ষায় যে কঠোর ভূমি ব্যবহার নীতির কথা বলা হয়, তার বাস্তবায়ন কোথায়? বাস্তবতা হলো, শক্তিশালী রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং কার্যকর প্রয়োগের অভাবে অনেক ভালো উদ্যোগই কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে। আমাদের অবশ্যই ‘অভিযোজন ফাঁদ’ সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। চিংড়ি চাষকেও একসময় লবণাক্ত পরিবেশে একটি অর্থনৈতিক অভিযোজন হিসেবে দেখানো হয়েছিল, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি সংকটকে আরও গভীর করেছে। সুতরাং, যেকোনো সমাধান গ্রহণের পূর্বে তার সম্ভাব্য সামাজিক ও পরিবেশগত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো সামগ্রিকভাবে মূল্যায়ন করা অপরিহার্য।
উপকূলীয় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আজকের সিদ্ধান্তের উপর। এই সংকট মোকাবেলায় বিচ্ছিন্ন কোনো পদক্ষেপ বা প্রকল্পভিত্তিক সমাধান যথেষ্ট নয়। একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। চিংড়ি চাষের অর্থনৈতিক গুরুত্ব অস্বীকার করা না গেলেও, এটিকে অবশ্যই একটি টেকসই ব্যবস্থাপনার অধীনে আনতে হবে। এজন্য সমন্বিত ভূমি ও পানি ব্যবহার নীতি প্রণয়ন এবং কঠোরভাবে প্রয়োগ করা জরুরি। কঠোর জোনিং আইন প্রয়োগের মাধ্যমে কৃষিজমি, মিঠা পানির উৎস ও জলাভূমি রক্ষা করতে হবে, এবং কোনোভাবেই উর্বর ধানক্ষেতকে লবণাক্ত পানির ঘেরে রূপান্তর করতে দেওয়া যাবে না। পাশাপাশি জলবায়ু-সহনশীল কৃষির সম্প্রসারণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লবণ-সহনশীল ফসলের জাত, সরজন পদ্ধতি এবং বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মতো প্রমাণিত প্রযুক্তি তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে হবে শক্তিশালী কৃষি সম্প্রসারণ সেবার মাধ্যমে। এর জন্য সরকারি বিনিয়োগের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের সক্রিয় অংশগ্রহণও প্রয়োজন।
এছাড়া, যেকোনো উন্নয়নমূলক বা অভিযোজন প্রকল্পের সাফল্য নির্ভর করে স্থানীয় মানুষের অংশগ্রহণের উপর। তাই কমিউনিটি-নেতৃত্বাধীন অভিযোজন পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে অর্থায়ন বাড়াতে হবে, যাতে সমাধানগুলো স্থানীয় বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় এবং মানুষের মালিকানা নিশ্চিত করে। উপকূলের মানুষকে কেবল ত্রাণগ্রহীতা হিসেবে নয়, বরং জলবায়ু যোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। সর্বশেষে, উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য একটি বিশেষায়িত জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টি কর্মসূচি গ্রহণ করা জরুরি, যার মূল লক্ষ্য হবে শিশু ও মাতৃ-অপুষ্টি মোকাবেলা করা। নিরাপদ খাবার পানির সরবরাহ নিশ্চিত করাও এই কর্মসূচির একটি অপরিহার্য অংশ হতে হবে।
দিনশেষে, উপকূল যদি ভালো না থাকে, তবে বাংলাদেশ ভালো থাকবে না। জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তার অর্জন অর্থহীন হয়ে যাবে যদি দেশের একটি বিশাল অংশের মানুষ অভুক্ত বা অপুষ্টিতে ভোগে। এই সংকটের সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের নীতিনির্ধারকদের কাছে এটাই প্রশ্ন- উপকূলের লবণাক্ত জলে ভেসে যাওয়া লক্ষ লক্ষ মানুষের হাহাকার কি তাদের কর্ণকুহরে পৌঁছাচ্ছে? নাকি তাদের ভাবনা এখনও জাতীয় গড় পরিসংখ্যানের বৃত্তেই সীমাবদ্ধ?
[লেখক: শিক্ষার্থী, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর]
আল শাহারিয়া
বুধবার, ২২ অক্টোবর ২০২৫
বিশ্বজুড়ে যখন ক্ষুধা ও অপুষ্টিমুক্ত বিশ্ব গড়ার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা হবে, তখন বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদনের সাফল্যগাথা নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রশংসিত হবে। ধান উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয়, মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতার মতো অর্জনগুলো আমাদের জাতীয় গর্বের ভিত্তি। কিন্তু এই উজ্জ্বল পরিসংখ্যান আর উদযাপনের আড়ালেই লুকিয়ে আছে এক গভীর অন্ধকার বাস্তবতা। দেশের দক্ষিণ উপকূলের কয়েক কোটি মানুষের জীবন আজ লবণাক্ত জলের আগ্রাসনে বিপন্ন। তাই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, আমাদের নীতিনির্ধারকেরা কি উপকূলের এই নীরব খাদ্যসংকট নিয়ে গুরুত্বের সাথে ভাবার ফুরসত পাচ্ছেন?
বাংলাদেশের উপকূলীয় ১৯টি জেলা একসময় পরিচিত ছিল প্রাচুর্যময় ভূমি হিসেবে। এখানকার উর্বর পলিমাটি আর জালের মতো ছড়িয়ে থাকা নদী-নালার আশীর্বাদ যুগ যুগ ধরে কোটি কোটি মানুষের জীবিকার জোগান দিয়েছে। ঐতিহ্যগতভাবে, এই অঞ্চলের কৃষি ব্যবস্থা ছিল প্রকৃতি-নির্ভর এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ। বর্ষার মিঠা পানিতে আমন ধানের সবুজ গালিচা বিছিয়ে যেত দিগন্তজুড়ে, যা ছিল স্থানীয় জনগোষ্ঠীর প্রধান খাদ্যশস্য এবং আয়ের উৎস। শুষ্ক মৌসুমে কিছু জমি পতিত থাকলেও, খালের পাড়ে বা নিচু জমিতে ফলত ডাল, তেলবীজসহ নানা ধরনের রবিশস্য।
তবে এই মাঠের ফসলের পাশাপাশি উপকূলীয় খাদ্য নিরাপত্তার এক নীরব অথচ শক্তিশালী স্তম্ভ ছিল প্রতিটি বাড়ির আঙিনায় গড়ে ওঠা বসতভিটার কৃষি। যখন প্রাকৃতিক কারণে বা অন্য কোনো বিপর্যয়ে মাঠের ফসলহানি হতো, তখন এই বসতভিটাই হয়ে উঠত পরিবারের পুষ্টি চাহিদা মেটানোয় প্রধান সহায়ক। এখানে সারি সারি নারিকেল, পেয়ারা, আমড়া, সফেদা আর কুলের গাছ ছায়া দিত; মাচায় ঝুলত লাউ, কুমড়ো, শিম; আর উঠোনে চরে বেড়াত হাঁস-মুরগির দল। পুকুরে ভরা ছিল রুই, কাতলা, শিং, মাগুরের মতো মিঠা পানির মাছ। বিশেষ করে নারীরা এসবের মাধ্যমে পরিবারের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় এক অপরিহার্য ভূমিকা পালন করতেন। একটি পরিবার তাদের প্রয়োজনীয় চাল, ডাল, সবজি থেকে শুরু করে মাছ-মাংস-ডিম-দুধ পর্যন্ত নিজেরাই উৎপাদন করত, যা এক স্থিতিশীল ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামীণ অর্থনীতি টিকিয়ে রেখেছিল।
আশির দশক থেকে বাংলাদেশের উপকূলে শুরু হওয়া তথাকথিত ‘নীল বিপ্লব’ ছিল এক পরিবেশগত বিপর্যয়ের সূচনা। আন্তর্জাতিক বাজারে চিংড়ির চাহিদা ও মুনাফার প্রলোভনে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের হাজার হাজার হেক্টর উর্বর ধানক্ষেত লবণাক্ত পানির ঘেরে পরিণত হয়। চিংড়ি দ্রুত অন্যতম প্রধান রপ্তানি খাতে পরিণত হলেও, এর পেছনে জমি, পানি ও মানুষের দুর্ভোগের ইতিহাস গড়ে ওঠে। চিংড়ি চাষে নদীর লবণাক্ত পানি প্রবেশ করানোর ফলে আশপাশের কৃষিজমি ও ভূগর্ভস্থ পানি দূষিত হয়। ফলে ধান, শাকসবজি ও গবাদিপশু পালন প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। কৃষকেরা জীবিকা হারিয়ে শহরের বস্তিতে পাড়ি দেন, আর তাদের ফেলে যাওয়া অনুর্বর জমি আরও চিংড়ি ঘেরে পরিণত হয়।
উপকূলে আজ সবচেয়ে বড় সংকট লবণাক্ততা। এটি কৃষি উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে, মিঠাপানির অভাব তৈরি করেছে এবং মানুষের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ, ডাইরিয়া ও গর্ভকালীন জটিলতার মতো স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে লবণাক্ততা আরও বিস্তৃত হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, ২১০০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে দেশের প্রায় ১১ শতাংশ ভূমি ডুবে যাবে এবং কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। জলবায়ু–জনিত অভিবাসন ক্রমেই তীব্র আকার নিচ্ছে। গ্রাম থেকে শহরে এক সংকট থেকে অন্য সংকটে মানুষ ঢুকে পড়ছে।
পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক এই সংকটের সবচেয়ে করুণ শিকার হচ্ছে উপকূলের শিশুরা। খুলনা ও বাগেরহাটের মতো জেলাগুলোতে শিশু অপুষ্টির চিত্র যেকোনো বিবেকবান মানুষকে নাড়া দেবে। বাংলাদেশে শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে অপুষ্টি একটি গুরুতর ও দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা। তবে জাতীয় পর্যায়ের তুলনায় উপকূলীয় অঞ্চলে শিশুদের দীর্ঘমেয়াদী অপুষ্টির চিত্রটি বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। যেখানে জাতীয়ভাবে শিশুদের মধ্যে খর্বাকৃতির (স্টান্টিং) হার প্রায় ২৪%, সেখানে উপকূলীয় অঞ্চলে এটি ৩১% পর্যন্ত পৌঁছেছে। এই উচ্চ হার নির্দেশ করে যে শিশুদের দীর্ঘমেয়াদী বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলের সমস্যার মূল কারণ হলো লবণাক্ত মাটি, বন্যা ও সাইক্লোনের নিয়মিত আঘাত, স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশনের সীমাবদ্ধতা, দারিদ্র্য এবং খাদ্যের বৈচিত্র্যের অভাব। এর ফলে স্থানীয় জনগণ দীর্ঘমেয়াদী খাদ্যসংকট ও পুষ্টি অভাবের শিকার হচ্ছে, যা শিক্ষার সুযোগ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং স্বাস্থ্য পরিস্থিতিকেও মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে।
এই বিপর্যয়ের মূল কারণ খাদ্যাভ্যাসের কাঠামোগত অবনতি। লবণাক্ততার কারণে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পুষ্টিকর খাবার যেমন তাজা শাকসবজি, মৌসুমি ফল, দেশি মুরগির ডিম এবং মিঠা পানির মাছের উৎপাদন ও ভোগ দুটোই অনেক কমে গেছে। যে পরিবারগুলো একসময় খাদ্য উৎপাদক ছিল তারাই এখন খাদ্য মূল্যস্ফীতির শিকার হয়ে নিজেদের সন্তানদের মুখে পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার তুলে দিতে পারছে না। পরিবেশগত বিপর্যয় জীবিকা কেড়ে নিচ্ছে, জীবিকার অভাব ক্রয়ক্ষমতা কমাচ্ছে, এবং ক্রয়ক্ষমতার অভাবে শিশুরা অপুষ্টির শিকার হচ্ছে, যা তাদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দিচ্ছে।
এই গভীর সংকট থেকে উত্তরণের জন্য একটি সমন্বিত ও বহুমুখী কৌশল অপরিহার্য। আশার কথা হলো, নীতিগত পর্যায়ে এর স্বীকৃতি রয়েছে। বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ এবং জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনার মতো শক্তিশালী নীতি কাঠামো আমাদের আছে, যেখানে উপকূলের চ্যালেঞ্জগুলোকে গুরুত্বের সাথে তুলে ধরা হয়েছে।
মূল প্রশ্নটি হলো নীতি, পরিকল্পনা এবং প্রযুক্তিগুলো কি তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে? লবণ-সহনশীল ধানের বীজ কি প্রান্তিক কৃষক সময়মতো এবং সাশ্রয়ী মূল্যে পাচ্ছেন? অপরিকল্পিত চিংড়ি ঘেরের আগ্রাসন বন্ধ করে কৃষি জমি রক্ষায় যে কঠোর ভূমি ব্যবহার নীতির কথা বলা হয়, তার বাস্তবায়ন কোথায়? বাস্তবতা হলো, শক্তিশালী রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং কার্যকর প্রয়োগের অভাবে অনেক ভালো উদ্যোগই কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে। আমাদের অবশ্যই ‘অভিযোজন ফাঁদ’ সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। চিংড়ি চাষকেও একসময় লবণাক্ত পরিবেশে একটি অর্থনৈতিক অভিযোজন হিসেবে দেখানো হয়েছিল, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি সংকটকে আরও গভীর করেছে। সুতরাং, যেকোনো সমাধান গ্রহণের পূর্বে তার সম্ভাব্য সামাজিক ও পরিবেশগত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো সামগ্রিকভাবে মূল্যায়ন করা অপরিহার্য।
উপকূলীয় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আজকের সিদ্ধান্তের উপর। এই সংকট মোকাবেলায় বিচ্ছিন্ন কোনো পদক্ষেপ বা প্রকল্পভিত্তিক সমাধান যথেষ্ট নয়। একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। চিংড়ি চাষের অর্থনৈতিক গুরুত্ব অস্বীকার করা না গেলেও, এটিকে অবশ্যই একটি টেকসই ব্যবস্থাপনার অধীনে আনতে হবে। এজন্য সমন্বিত ভূমি ও পানি ব্যবহার নীতি প্রণয়ন এবং কঠোরভাবে প্রয়োগ করা জরুরি। কঠোর জোনিং আইন প্রয়োগের মাধ্যমে কৃষিজমি, মিঠা পানির উৎস ও জলাভূমি রক্ষা করতে হবে, এবং কোনোভাবেই উর্বর ধানক্ষেতকে লবণাক্ত পানির ঘেরে রূপান্তর করতে দেওয়া যাবে না। পাশাপাশি জলবায়ু-সহনশীল কৃষির সম্প্রসারণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লবণ-সহনশীল ফসলের জাত, সরজন পদ্ধতি এবং বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মতো প্রমাণিত প্রযুক্তি তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে হবে শক্তিশালী কৃষি সম্প্রসারণ সেবার মাধ্যমে। এর জন্য সরকারি বিনিয়োগের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের সক্রিয় অংশগ্রহণও প্রয়োজন।
এছাড়া, যেকোনো উন্নয়নমূলক বা অভিযোজন প্রকল্পের সাফল্য নির্ভর করে স্থানীয় মানুষের অংশগ্রহণের উপর। তাই কমিউনিটি-নেতৃত্বাধীন অভিযোজন পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে অর্থায়ন বাড়াতে হবে, যাতে সমাধানগুলো স্থানীয় বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় এবং মানুষের মালিকানা নিশ্চিত করে। উপকূলের মানুষকে কেবল ত্রাণগ্রহীতা হিসেবে নয়, বরং জলবায়ু যোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। সর্বশেষে, উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য একটি বিশেষায়িত জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টি কর্মসূচি গ্রহণ করা জরুরি, যার মূল লক্ষ্য হবে শিশু ও মাতৃ-অপুষ্টি মোকাবেলা করা। নিরাপদ খাবার পানির সরবরাহ নিশ্চিত করাও এই কর্মসূচির একটি অপরিহার্য অংশ হতে হবে।
দিনশেষে, উপকূল যদি ভালো না থাকে, তবে বাংলাদেশ ভালো থাকবে না। জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তার অর্জন অর্থহীন হয়ে যাবে যদি দেশের একটি বিশাল অংশের মানুষ অভুক্ত বা অপুষ্টিতে ভোগে। এই সংকটের সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের নীতিনির্ধারকদের কাছে এটাই প্রশ্ন- উপকূলের লবণাক্ত জলে ভেসে যাওয়া লক্ষ লক্ষ মানুষের হাহাকার কি তাদের কর্ণকুহরে পৌঁছাচ্ছে? নাকি তাদের ভাবনা এখনও জাতীয় গড় পরিসংখ্যানের বৃত্তেই সীমাবদ্ধ?
[লেখক: শিক্ষার্থী, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর]