alt

উপ-সম্পাদকীয়

ডিজিটাল আসক্তি প্রতিরোধের উপায়

মাহমুদুল হাছান

: বুধবার, ১১ আগস্ট ২০২১

টেকনোলজি ও ইন্টারনেটের প্রতি আসক্তিই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে ডিজিটাল আসক্তি নামে পরিচিত। ডিজিটাল আসক্তির তিনটি ধরন রয়েছে, যথা ফোন আসক্তি, ইন্টারনেট আসক্তি এবং সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তি। সব বয়সের মানুষের মধ্যে এ আসক্তি দেখা দিলেও কিশোর-কিশোরী শিক্ষার্থীরা এ আসক্তিতে বেশি আক্রান্ত।

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের মতে, চার থেকে ১৭ বছর বয়সী অন্তত ৬০ লাখ শিশু-কিশোর বর্তমানে ‘এডিএইচডি’তে (অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাক্টিভিটি ডিসঅর্ডার) আক্রান্ত। মাত্রাতিরিক্ত ইন্টারনেট ও মোবাইলের প্রতি আসক্তি এডিএইচডি নামক মানসিক রোগের সৃষ্টি করে। এই ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তি নির্দিষ্ট কোন কাজে পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারে না। গত দুই দশকে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়েছে এবং মোবাইল ডিভাইসে অতিরিক্ত আসক্তিকেই এর মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। শিশুদের কল্পনাশক্তি এবং চিন্তাশক্তিও কমে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

ডিজিটাল আসক্তিতে শিশু কিশোর শিক্ষার্থীরা মানসিক ও শারীরিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মানসিক স্বাস্থ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে তাদের মধ্যে বিষণ্নতা, খিটখিটে স্বভাব, উগ্রতা, হঠাৎ রেগে যাওয়া, অপরাধ প্রবণতা, উদ্বেগ, একাকিত্ব থাকতে ইচ্ছা করা, বুদ্ধির বন্ধাত্ব, নিয়মিত স্কুল যেতে ইচ্ছা না করা, ভালো কথার নেগেটিভ রিয়্যাক্ট করা, স্মৃতিশক্তি হ্রাস, মানসিক উন্মাদনা ইত্যাদি নানাবিধ জটিলতা দেখা দেয় এমনকি একপর্যায়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে না পেরে আত্মহত্যার মতো ঝুঁকিও নিয়ে থাকে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে এমন অনেকগুলো দুর্ঘটনাও ঘটেছে।

ইন্টারনেটের আসক্তিকে কীভাবে প্রতিরোধ যায়, সে সম্পর্কে নিম্নের কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে :

১। মোবাইল বা কম্পিউটারে ইন্টারনেট ব্যবহারের সময় পর্যাপ্ত অপ্রাসংগিক নোটিফিকেশন বা বিজ্ঞাপন ভেসে ওঠে, যা ছেলেমেয়েদের অনলাইনে যাওয়ার ইচ্ছা বাড়িয়ে দেয়। এ বিজ্ঞাপন বন্ধ করতে পারলে শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল আসক্তি দূর করতে সহযোগিতা করবে।

২। অভিভাবক বা শিক্ষকদের মোবাইল ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ছেলেমেয়েরা তাদের বাবা-মা বা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের যা করতে দেখে তাই অনুকরণ করে থাকে। তাই অভিভাবকদের অনলাইন ব্যবহারের অভ্যাস পর্যালোচনা করে নেতিবাচক আচরণ বর্জন করতে হবে। তাহলে সন্তানদের ইন্টারনেটের আসক্তি থেকে মুক্ত রাখা সহজ হবে।

৩। অন্যের সঙ্গে তথা আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে সন্তানদের সম্পর্ক দৃঢ় রাখতে হবে এবং তাদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় সময় ব্যয় করতে হবে। ইন্টারনেটে বেশি সময় ও শক্তি ব্যয় করলে অন্যের সঙ্গে সুসম্পর্ক নষ্ট হয় এবং ডিজিটাল আসক্তি বৃদ্ধি পায়। সুতরাং কাছের মানুষদের সঙ্গে উপযুক্ত সম্পর্ক স্থাপন করতে পারলে সন্তানদের এ জাতীয় আসক্তি থেকে দূরে রাখা সম্ভব হবে।

৪। সংযত জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে হবে। ইন্টারনেট এবং প্রযুক্তি উভয়ই ছেলেমেয়েদের কম্পিউটারে শপিং করা, গেম খেলা বা লগ ইন করার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করে, যা ডিজিটাল আসক্তি তৈরির অন্যতম কারণ। সুতরাং ডিভাইস ব্যবহারে নিজেদের যেমন সংযত থাকতে হবে, তেমনি সন্তানদেরও সময় নির্ধারণ করে মোবাইল বা কম্পিউটার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তাহলে, ছেলেমেয়েদের ডিজিটাল আসক্তি কমে যাবে।

৫। বাসাবাড়িতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত প্রযুক্তিগত ডিভাইস ও মোবাইল থাকা এবং সেগুলো যত্রতত্র রাখা ঠিক নয়। কারণ ঘুরতে ফিরতে ছেলেমেয়েরা তা স্পর্শ করতে আগ্রহী হয় এবং ধীরে ধীরে আসক্ত হয়ে পড়ে। সুতরাং বাসাতে ডিভাইসগুলোর জন্য নির্দিষ্ট স্থান বরাদ্দ রাখা উচিত এবং সেগুলিকে অন্য জায়গায় ব্যবহার করতে নিষেধ করতে হবে। শয়নকক্ষ, স্টাডি রুম এবং ডাইনিং অঞ্চলগুলি অবশ্যই এড়িয়ে চলতে হবে।

৬। অভিভাবকদের ব্যবহার্য ডিভাইসের স্ক্রিনের সময়টি ট্র্যাক করা ডিজিটাল আসক্তি রোধের অন্যতম কার্যকর উপায়। এমন কিছু অ্যাপ্লিকেশন রয়েছে, যা সময় ট্র্যাক করতে এবং প্রযুক্তির আসক্তি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে সহায়তা করে। এছাড়াও প্যারেন্টিং অ্যাপস রয়েছে, যা ছেলেমেয়েদের ডিভাইসে সময় ট্রাকিং সেট করতে এবং আসক্তি রোধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

৭। ডিজিটাল ডিটক্স ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি মাঝে মাঝে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার সবচেয়ে ভালো উপায়। ডিজিটাল ডিটক্স এবং পুনরায় সংযোগ কীভাবে করা যায় সে সম্পর্কে এটিতে ১০টি সহজ পদক্ষেপ রয়েছে। শিক্ষক, অভিভাবক ও ছেলেমেয়েরা এ পদক্ষেপগুলো প্রয়োগ করতে পারেন। ডিজিটাল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখলে শিক্ষার্থীরা ডিজিটাল আসক্তি থেকে রক্ষা পেতে পারে।

৮। মোবাইলের স্ক্রিনের ডিজাইন বারবার পরিবর্তন করা উচিত নয়। স্ক্রিনের বর্ণিল নানা ধরনের ডিজাইন ছেলেমেয়েদের মোবাইলের প্রতি বেশি আসক্ত করে তোলে। সুতরাং মোবাইল স্ক্রিন সেটিংসের ক্ষেত্রে সর্বদা স্বাভাবিক ডিসপ্লে ব্যবহার করা আবশ্যক।

৯। ইন্টারনেট ব্যবহার করার জন্য নির্দিষ্ট সময় বরাদ্দ রাখা আবশ্যক। যখন তখন অভিভাবক বা শিক্ষকদের খেয়াল খুশিমতো ইন্টারনেট ব্যবহার করা ঠিক নয়। সময়ে অসময়ে অভিভাবকদের ইন্টারনেটে ব্যবহার করতে দেখলে, ছেলেমেয়েরাও আস্তে আস্তে ডিজিটাল এপ্লিকেশনের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। কথোপকথনের সময় বা রেস্টরুমে যাওয়ার সময় কিংবা খাওয়ার সময় কোনোভাবেই মোবাইল ব্যবহার করা উচিত নয়। ডিজিটাল আসক্তি দূর করতে সময়ের চাকাগুলো যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আমেরিকান পেডিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন ও আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন সে দেশের অভিভাবকদের পরামর্শ দিচ্ছে, ছেলেমেয়েদের ‘স্ক্রিন টাইম লিমিট’ বেঁধে দিতে হবে।

১০। কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ইন্টারনেট আসক্তির অন্যতম প্রধান কারণ সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম। এটিকে পজিটিভলি ব্যবহার করতে পারলে ডিজিটাল আসক্তি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। শিক্ষার্থীরা অনলাইন কার্যক্রমের ফাঁকে বিভিন্ন অসামাজিক কাজে তারা লিপ্ত হয়ে যায়। এজন্য ‘মেন্টাল আপে’র মতো উপকারী এবং শিক্ষামূলক অ্যাপ্লিকেশনগুলো ডাউনলোড করে রাখা উচিত, যা ছেলেমেয়েদের শুধু বিনোদনই দেয় না, বরং মানসিক দক্ষতা এবং অন্যান্য অনেক জ্ঞানীয় দক্ষতাও উন্নত করে।

১১। শিক্ষার্থী ছেলেমেয়েদের পর্যাপ্ত বই পড়ার প্রতি উৎসাহিত করতে হবে। বই পড়লে মনের বিকাশ লাভ হয়, বুদ্ধি বৃদ্ধি পায়, জ্ঞানের গভীরতা তৈরি হয় এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ফলে, ডিজিটাল আসক্তি থেকে শিক্ষার্থীরা দূরে থাকতে পারে। আমেরিকার সিনসিনাটি চিলড্রেনস রিসার্চ ফাউন্ডেশনের গবেষকেরা সম্প্রতি ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং (এমআরআই) প্রযুক্তির সাহায্যে শিশুদের মস্তিষ্কের ক্রিয়াকর্ম পর্যবেক্ষণ করেছেন। তারা লক্ষ্য করেছেন, শিশুরা যখন কিছু পড়ে, তখন তাদের মস্তিষ্কের সংযোগ (ফাংশনাল ব্রেইন কানেকটিভিটি) বেড়ে যায়। আর যখন ডিজিটাল যন্ত্রের পর্দায় অডিওভিজ্যুয়াল কনটেন্ট দেখে, তখন তাদের মস্তিষ্কের সংযোগ কমে যায়। তাই গবেষকদের পরামর্শ হলো, শিশুদের মস্তিষ্কের সুস্থ বিকাশের জন্য পড়ার সময় বাড়াতে হবে, স্ক্রিনে চোখ রাখার সময় কমিয়ে আনতে হবে।

১২। একটি সুস্থ শরীর মানে একটি সুস্থ মন। শারীরিক অনুশীলন ছেলেমেয়েদের একঘেয়েমি থেকে মুক্তি দেয় এবং মনোজাগতিক শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এজন্য তাদের আউটডোর একটিভিটিতে শরীর চর্চার প্রতি উৎসাহিত করতে হবে এবং উন্মুুক্ত মাঠে তাদের নিয়মিত যাতায়াতের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেটের আসক্তি রোধ করতে সহায়তা করবে।

এটা আজ আর অত্যুক্তি নয় যে, ডিজিটাল আসক্তি ড্রাগ আসক্তির মতো একটি ভয়ঙ্কর ব্যাধি, যা থেকে শিশু-কিশোর শিক্ষার্থী ছেলেমেয়েদের রক্ষা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। ডিজিটাল আসক্তিকে অনেকে ডিজিটাল ড্রাগ বলেও এখন ব্যাখ্যা করছেন। এ আসক্তি এতটাই ভয়াবহ যে স্বয়ং মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস তার দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে দীর্ঘকাল পর্যন্ত ফোন ব্যবহার করতে দেননি। ফেসবুকের প্রথম চেয়ারম্যান সিয়ান পারকার ফেসবুক ছেড়ে দেয়ার পরে ফেসবুক সম্পর্কে নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছিলেন, ‘এই যে ক্ষণিক, ডোপামিনতাড়িত ফিডব্যাক লুপস আমরা তৈরি করেছি, এটা আমাদের সমাজের স্বাভাবিক সক্রিয়তা নষ্ট করে দিচ্ছে। সামাজিক আলাপ-আলোচনা নেই, পারস্পরিক সহযোগিতা নেই; আছে ভুল তথ্য আর মিথ্যা।’

সিলিকন ভ্যালির প্রযুক্তিবিদদের ৯০০’র বেশি পরিবার ছেলেমেয়েদের ডিজিটাল আসক্তি কমানোর সংগ্রামে নেমেছে। শিশুদের সব ধরনের ডিজিটাল যন্ত্র ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, এমন পরিবারের সংখ্যা দ্রুতগতিতে বাড়ছে। এই পরিবারগুলোকে বলা হচ্ছে ‘নো টেক হোমস’। এমনকি ওসব পরিবারে শিশুদের দেখাশোনার জন্য ন্যানিদেরও চুক্তি করতে হচ্ছে যে তারা যতক্ষণ ওই বাসায় থাকবেন, ততক্ষণ ফোন ব্যবহার করবেন না।

তাই, আসুন আমরা যেভাবে মাদকাসক্তিকে সামাজিকভাবে বর্জন করে ‘মাদককে না বলো’ স্লোগান আবিষ্কার করেছি, ঠিক সেভাবে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বন্ধ করে নয় বরং এটিকে নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় রেখে আমাদের ছেলেমেয়েদের ‘ডিজিটাল প্রযুক্তি, দূর হোক আসক্তি’ এ স্লোগানে উদ্বুদ্ধ করি এবং ডিজিটাল আসক্তিমুক্ত আদর্শ সমাজ গঠনে ব্রতি হই। উপরে বর্ণিত পদক্ষেপগুলো কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে আমাদের শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল আসক্তিমুক্ত করে বাংলাদেশে একটি উন্নত জাতি গঠন করা সহজ ও সম্ভব হবে।

[লেখক : প্রিন্সিপাল, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা]

সর্বজনীন শিক্ষার বলয়ের বাইরে আদিবাসীরা : অন্তর্ভুক্তির লড়াইয়ে বৈষম্যের দেয়াল

শোনার গান, দেখার টান : অনুভূতির ভোঁতা সময়

ছবি

ছিন্নপত্রে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও রবীন্দ্র চেতনা

ভেতরের অদৃশ্য অপরাধ : সমাজের বিপন্ন মানসিকতা

দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসনে খাসজমি ও জলার গুরুত্ব

অবহেলিত কৃষক ও বাজার ব্যবস্থার বৈষম্য

রাক্ষুসে মাছের দাপটে বিপন্ন দেশীয় মাছ : করণীয় কী?

বজ্রপাতের আতঙ্কে জনজীবন

তাহলে কি ঘৃণায় ছেয়ে যাবে দেশ, মানবজমিন রইবে পতিত

কর্পোরেট ও ব্যক্তিগত সামাজিক দায়বদ্ধতা

‘রাখাইন করিডর’ : একটি ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

ভিন্নমতের ভয়, নির্বাচনের দোলাচল ও অন্তর্বর্তী সরকারের কৌশলী অবস্থান

সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

কৃষি শিক্ষা হোক উদ্যোক্তা গড়ার মাধ্যম

রঙ্গব্যঙ্গ : কোটের কেবল রং বদলায়

মে দিবসের চেতনা বনাম বাস্তবতা

শ্রম আইন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় চাই আন্তরিকতা

বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকা কেন এত পিছিয়ে

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল : নিরাপদ যাত্রার প্রত্যাশা

কর ফাঁকি : অর্থনীতির জন্য এক অশনি সংকেত

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় : উপকূলীয় সুরক্ষার শিক্ষা

যখন নদীগুলো অস্ত্র হয়ে ওঠে

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুণগত মান উন্নয়নে গবেষণা ও উদ্ভাবন

বজ্রপাত ও তালগাছ : প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা

কুষ্ঠ ও বৈষম্য : মানবাধিকারের প্রশ্নে একটি অবহেলিত অধ্যায়

ছবি

প্রান্তজনের বাংলাদেশ

অতীতের ছায়ায় নতুন বাংলাদেশ : দুর্নীতি, উগ্রপন্থা ও সরকারের দায়

সাইবার নিরাপত্তা : অদৃশ্য যুদ্ধের সামনে আমাদের প্রস্তুতি

ছবি

বাহান্নর গর্ভে জন্ম নেয়া এক ঝড়ের পাখি

প্রবাসী শ্রমিক : অর্থের যন্ত্র নয়, রাষ্ট্রের সহযোদ্ধা

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির এক যুগ

ভোগবাদের বিরুদ্ধে পোপ ফ্রান্সিসের জলবায়ু বার্তা

রম্যগদ্য : হাসি নিষেধ...

পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের আন্দোলন : দাবি ও সমাধানের পথ

সিরিয়ার পতন কিভাবে আমেরিকার স্বার্থকে হুমকিতে ফেলছে

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র : বিকল্প রাষ্ট্রচিন্তার সন্ধানে

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ডিজিটাল আসক্তি প্রতিরোধের উপায়

মাহমুদুল হাছান

বুধবার, ১১ আগস্ট ২০২১

টেকনোলজি ও ইন্টারনেটের প্রতি আসক্তিই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে ডিজিটাল আসক্তি নামে পরিচিত। ডিজিটাল আসক্তির তিনটি ধরন রয়েছে, যথা ফোন আসক্তি, ইন্টারনেট আসক্তি এবং সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তি। সব বয়সের মানুষের মধ্যে এ আসক্তি দেখা দিলেও কিশোর-কিশোরী শিক্ষার্থীরা এ আসক্তিতে বেশি আক্রান্ত।

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের মতে, চার থেকে ১৭ বছর বয়সী অন্তত ৬০ লাখ শিশু-কিশোর বর্তমানে ‘এডিএইচডি’তে (অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাক্টিভিটি ডিসঅর্ডার) আক্রান্ত। মাত্রাতিরিক্ত ইন্টারনেট ও মোবাইলের প্রতি আসক্তি এডিএইচডি নামক মানসিক রোগের সৃষ্টি করে। এই ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তি নির্দিষ্ট কোন কাজে পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারে না। গত দুই দশকে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়েছে এবং মোবাইল ডিভাইসে অতিরিক্ত আসক্তিকেই এর মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। শিশুদের কল্পনাশক্তি এবং চিন্তাশক্তিও কমে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

ডিজিটাল আসক্তিতে শিশু কিশোর শিক্ষার্থীরা মানসিক ও শারীরিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মানসিক স্বাস্থ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে তাদের মধ্যে বিষণ্নতা, খিটখিটে স্বভাব, উগ্রতা, হঠাৎ রেগে যাওয়া, অপরাধ প্রবণতা, উদ্বেগ, একাকিত্ব থাকতে ইচ্ছা করা, বুদ্ধির বন্ধাত্ব, নিয়মিত স্কুল যেতে ইচ্ছা না করা, ভালো কথার নেগেটিভ রিয়্যাক্ট করা, স্মৃতিশক্তি হ্রাস, মানসিক উন্মাদনা ইত্যাদি নানাবিধ জটিলতা দেখা দেয় এমনকি একপর্যায়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে না পেরে আত্মহত্যার মতো ঝুঁকিও নিয়ে থাকে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে এমন অনেকগুলো দুর্ঘটনাও ঘটেছে।

ইন্টারনেটের আসক্তিকে কীভাবে প্রতিরোধ যায়, সে সম্পর্কে নিম্নের কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে :

১। মোবাইল বা কম্পিউটারে ইন্টারনেট ব্যবহারের সময় পর্যাপ্ত অপ্রাসংগিক নোটিফিকেশন বা বিজ্ঞাপন ভেসে ওঠে, যা ছেলেমেয়েদের অনলাইনে যাওয়ার ইচ্ছা বাড়িয়ে দেয়। এ বিজ্ঞাপন বন্ধ করতে পারলে শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল আসক্তি দূর করতে সহযোগিতা করবে।

২। অভিভাবক বা শিক্ষকদের মোবাইল ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ছেলেমেয়েরা তাদের বাবা-মা বা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের যা করতে দেখে তাই অনুকরণ করে থাকে। তাই অভিভাবকদের অনলাইন ব্যবহারের অভ্যাস পর্যালোচনা করে নেতিবাচক আচরণ বর্জন করতে হবে। তাহলে সন্তানদের ইন্টারনেটের আসক্তি থেকে মুক্ত রাখা সহজ হবে।

৩। অন্যের সঙ্গে তথা আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে সন্তানদের সম্পর্ক দৃঢ় রাখতে হবে এবং তাদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় সময় ব্যয় করতে হবে। ইন্টারনেটে বেশি সময় ও শক্তি ব্যয় করলে অন্যের সঙ্গে সুসম্পর্ক নষ্ট হয় এবং ডিজিটাল আসক্তি বৃদ্ধি পায়। সুতরাং কাছের মানুষদের সঙ্গে উপযুক্ত সম্পর্ক স্থাপন করতে পারলে সন্তানদের এ জাতীয় আসক্তি থেকে দূরে রাখা সম্ভব হবে।

৪। সংযত জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে হবে। ইন্টারনেট এবং প্রযুক্তি উভয়ই ছেলেমেয়েদের কম্পিউটারে শপিং করা, গেম খেলা বা লগ ইন করার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করে, যা ডিজিটাল আসক্তি তৈরির অন্যতম কারণ। সুতরাং ডিভাইস ব্যবহারে নিজেদের যেমন সংযত থাকতে হবে, তেমনি সন্তানদেরও সময় নির্ধারণ করে মোবাইল বা কম্পিউটার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তাহলে, ছেলেমেয়েদের ডিজিটাল আসক্তি কমে যাবে।

৫। বাসাবাড়িতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত প্রযুক্তিগত ডিভাইস ও মোবাইল থাকা এবং সেগুলো যত্রতত্র রাখা ঠিক নয়। কারণ ঘুরতে ফিরতে ছেলেমেয়েরা তা স্পর্শ করতে আগ্রহী হয় এবং ধীরে ধীরে আসক্ত হয়ে পড়ে। সুতরাং বাসাতে ডিভাইসগুলোর জন্য নির্দিষ্ট স্থান বরাদ্দ রাখা উচিত এবং সেগুলিকে অন্য জায়গায় ব্যবহার করতে নিষেধ করতে হবে। শয়নকক্ষ, স্টাডি রুম এবং ডাইনিং অঞ্চলগুলি অবশ্যই এড়িয়ে চলতে হবে।

৬। অভিভাবকদের ব্যবহার্য ডিভাইসের স্ক্রিনের সময়টি ট্র্যাক করা ডিজিটাল আসক্তি রোধের অন্যতম কার্যকর উপায়। এমন কিছু অ্যাপ্লিকেশন রয়েছে, যা সময় ট্র্যাক করতে এবং প্রযুক্তির আসক্তি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে সহায়তা করে। এছাড়াও প্যারেন্টিং অ্যাপস রয়েছে, যা ছেলেমেয়েদের ডিভাইসে সময় ট্রাকিং সেট করতে এবং আসক্তি রোধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

৭। ডিজিটাল ডিটক্স ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি মাঝে মাঝে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার সবচেয়ে ভালো উপায়। ডিজিটাল ডিটক্স এবং পুনরায় সংযোগ কীভাবে করা যায় সে সম্পর্কে এটিতে ১০টি সহজ পদক্ষেপ রয়েছে। শিক্ষক, অভিভাবক ও ছেলেমেয়েরা এ পদক্ষেপগুলো প্রয়োগ করতে পারেন। ডিজিটাল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখলে শিক্ষার্থীরা ডিজিটাল আসক্তি থেকে রক্ষা পেতে পারে।

৮। মোবাইলের স্ক্রিনের ডিজাইন বারবার পরিবর্তন করা উচিত নয়। স্ক্রিনের বর্ণিল নানা ধরনের ডিজাইন ছেলেমেয়েদের মোবাইলের প্রতি বেশি আসক্ত করে তোলে। সুতরাং মোবাইল স্ক্রিন সেটিংসের ক্ষেত্রে সর্বদা স্বাভাবিক ডিসপ্লে ব্যবহার করা আবশ্যক।

৯। ইন্টারনেট ব্যবহার করার জন্য নির্দিষ্ট সময় বরাদ্দ রাখা আবশ্যক। যখন তখন অভিভাবক বা শিক্ষকদের খেয়াল খুশিমতো ইন্টারনেট ব্যবহার করা ঠিক নয়। সময়ে অসময়ে অভিভাবকদের ইন্টারনেটে ব্যবহার করতে দেখলে, ছেলেমেয়েরাও আস্তে আস্তে ডিজিটাল এপ্লিকেশনের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। কথোপকথনের সময় বা রেস্টরুমে যাওয়ার সময় কিংবা খাওয়ার সময় কোনোভাবেই মোবাইল ব্যবহার করা উচিত নয়। ডিজিটাল আসক্তি দূর করতে সময়ের চাকাগুলো যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আমেরিকান পেডিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন ও আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন সে দেশের অভিভাবকদের পরামর্শ দিচ্ছে, ছেলেমেয়েদের ‘স্ক্রিন টাইম লিমিট’ বেঁধে দিতে হবে।

১০। কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ইন্টারনেট আসক্তির অন্যতম প্রধান কারণ সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম। এটিকে পজিটিভলি ব্যবহার করতে পারলে ডিজিটাল আসক্তি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। শিক্ষার্থীরা অনলাইন কার্যক্রমের ফাঁকে বিভিন্ন অসামাজিক কাজে তারা লিপ্ত হয়ে যায়। এজন্য ‘মেন্টাল আপে’র মতো উপকারী এবং শিক্ষামূলক অ্যাপ্লিকেশনগুলো ডাউনলোড করে রাখা উচিত, যা ছেলেমেয়েদের শুধু বিনোদনই দেয় না, বরং মানসিক দক্ষতা এবং অন্যান্য অনেক জ্ঞানীয় দক্ষতাও উন্নত করে।

১১। শিক্ষার্থী ছেলেমেয়েদের পর্যাপ্ত বই পড়ার প্রতি উৎসাহিত করতে হবে। বই পড়লে মনের বিকাশ লাভ হয়, বুদ্ধি বৃদ্ধি পায়, জ্ঞানের গভীরতা তৈরি হয় এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ফলে, ডিজিটাল আসক্তি থেকে শিক্ষার্থীরা দূরে থাকতে পারে। আমেরিকার সিনসিনাটি চিলড্রেনস রিসার্চ ফাউন্ডেশনের গবেষকেরা সম্প্রতি ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং (এমআরআই) প্রযুক্তির সাহায্যে শিশুদের মস্তিষ্কের ক্রিয়াকর্ম পর্যবেক্ষণ করেছেন। তারা লক্ষ্য করেছেন, শিশুরা যখন কিছু পড়ে, তখন তাদের মস্তিষ্কের সংযোগ (ফাংশনাল ব্রেইন কানেকটিভিটি) বেড়ে যায়। আর যখন ডিজিটাল যন্ত্রের পর্দায় অডিওভিজ্যুয়াল কনটেন্ট দেখে, তখন তাদের মস্তিষ্কের সংযোগ কমে যায়। তাই গবেষকদের পরামর্শ হলো, শিশুদের মস্তিষ্কের সুস্থ বিকাশের জন্য পড়ার সময় বাড়াতে হবে, স্ক্রিনে চোখ রাখার সময় কমিয়ে আনতে হবে।

১২। একটি সুস্থ শরীর মানে একটি সুস্থ মন। শারীরিক অনুশীলন ছেলেমেয়েদের একঘেয়েমি থেকে মুক্তি দেয় এবং মনোজাগতিক শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এজন্য তাদের আউটডোর একটিভিটিতে শরীর চর্চার প্রতি উৎসাহিত করতে হবে এবং উন্মুুক্ত মাঠে তাদের নিয়মিত যাতায়াতের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেটের আসক্তি রোধ করতে সহায়তা করবে।

এটা আজ আর অত্যুক্তি নয় যে, ডিজিটাল আসক্তি ড্রাগ আসক্তির মতো একটি ভয়ঙ্কর ব্যাধি, যা থেকে শিশু-কিশোর শিক্ষার্থী ছেলেমেয়েদের রক্ষা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। ডিজিটাল আসক্তিকে অনেকে ডিজিটাল ড্রাগ বলেও এখন ব্যাখ্যা করছেন। এ আসক্তি এতটাই ভয়াবহ যে স্বয়ং মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস তার দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে দীর্ঘকাল পর্যন্ত ফোন ব্যবহার করতে দেননি। ফেসবুকের প্রথম চেয়ারম্যান সিয়ান পারকার ফেসবুক ছেড়ে দেয়ার পরে ফেসবুক সম্পর্কে নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছিলেন, ‘এই যে ক্ষণিক, ডোপামিনতাড়িত ফিডব্যাক লুপস আমরা তৈরি করেছি, এটা আমাদের সমাজের স্বাভাবিক সক্রিয়তা নষ্ট করে দিচ্ছে। সামাজিক আলাপ-আলোচনা নেই, পারস্পরিক সহযোগিতা নেই; আছে ভুল তথ্য আর মিথ্যা।’

সিলিকন ভ্যালির প্রযুক্তিবিদদের ৯০০’র বেশি পরিবার ছেলেমেয়েদের ডিজিটাল আসক্তি কমানোর সংগ্রামে নেমেছে। শিশুদের সব ধরনের ডিজিটাল যন্ত্র ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, এমন পরিবারের সংখ্যা দ্রুতগতিতে বাড়ছে। এই পরিবারগুলোকে বলা হচ্ছে ‘নো টেক হোমস’। এমনকি ওসব পরিবারে শিশুদের দেখাশোনার জন্য ন্যানিদেরও চুক্তি করতে হচ্ছে যে তারা যতক্ষণ ওই বাসায় থাকবেন, ততক্ষণ ফোন ব্যবহার করবেন না।

তাই, আসুন আমরা যেভাবে মাদকাসক্তিকে সামাজিকভাবে বর্জন করে ‘মাদককে না বলো’ স্লোগান আবিষ্কার করেছি, ঠিক সেভাবে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বন্ধ করে নয় বরং এটিকে নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় রেখে আমাদের ছেলেমেয়েদের ‘ডিজিটাল প্রযুক্তি, দূর হোক আসক্তি’ এ স্লোগানে উদ্বুদ্ধ করি এবং ডিজিটাল আসক্তিমুক্ত আদর্শ সমাজ গঠনে ব্রতি হই। উপরে বর্ণিত পদক্ষেপগুলো কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে আমাদের শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল আসক্তিমুক্ত করে বাংলাদেশে একটি উন্নত জাতি গঠন করা সহজ ও সম্ভব হবে।

[লেখক : প্রিন্সিপাল, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা]

back to top