মতিউর রহমান
নৈতিক মূল্যবোধ হলো এমন কিছু নির্দেশিকা, যা একজন ব্যক্তিকে সঠিক এবং ভুলের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে। দৈনন্দিন জীবনে সৎ, বিশ্বাসযোগ্য এবং সঠিক সম্পর্ক তৈরি করতে, মানুষের নৈতিকতার সচেতনতা- সঙ্গে আত্ম-সচেতনতা-অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
নৈতিক মূল্যবোধ একজন ব্যক্তিকে তার আচরণকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে সাহায্য করে। সুতরাং, নৈতিক মূল্যবোধ শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। জাতিকে নৈতিক মূল্যবোধের সংকট থেকে মুক্ত করতে শিক্ষার বিকল্প নেই।
আমাদের সমাজে প্রাচীন কিছু নৈতিক মূল্যবোধ রয়েছে, যা বাঙালিরা তাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির ধারক-বাহক হিসেবে গ্রহণ করেছে, যেমন সত্যবাদিতা, অহিংসা, শান্তি, ক্ষমা, অধ্যবসায়, সরলতা, জ্ঞানের তৃষ্ণা, সহনশীলতা, সহযোগিতা এবং শ্রদ্ধা। আমাদের ঐতিহ্যবাহী সমাজ শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় অনুশীলনের মাধ্যমে নৈতিক মূল্যবোধ শেখায়।
মানুষের নৈতিক জীবন ও নৈতিকতার মূল ভিত্তি হলো পরিবার থেকে গড়ে ওঠা মূল্যবোধ। পরিবার হলো নৈতিক মূল্যবোধের উৎস, যা মানুষ লালন করে এবং তাদের জীবনের বেশির ভাগ সময় অনুসরণ করে। বাংলাদেশ হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী সভ্যতা ও সংস্কৃতির পীঠস্থান। এই সমাজে, পারিবারিক ঐতিহ্য দীর্ঘকাল ধরে টিকে আছে, যা বৃহত্তম জনসংখ্যার জীবনধারা নিয়ন্ত্রণ করে।
কিন্তু সাম্প্রতিক নগরায়ণ, বিশ্বায়ন, অর্থনৈতিক জীবনের দ্রুত সম্প্রসারণ ও বিকাশ, প্রযুক্তির বিস্তার, বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি, মিডিয়ার প্রসার, টেলিভিশন ও অনলাইন বিনোদন বাণিজ্যের বিকাশ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং ব্যবসায়-বাণিজ্যের দ্রুত বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার দ্রুত স্থানান্তর,
বৈশ্বিক ও দেশীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং সংস্কৃতি ও শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ প্রথাগত মূল্যবোধকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে এবং দ্রুত পরিবর্তন করছে।
বিশ্বায়নের সাম্প্রতিক যুগে পারিবারিক মূল্যবোধ, নীতি ও নৈতিকতার ব্যাপক অবক্ষয় ঘটেছে। ফলে শিশুরা কোন নৈতিক মূল্যবোধ ছাড়াই বেড়ে উঠছে। পরিবার যখন তার নৈতিক মূল্যবোধ বিকাশের দায়িত্ব নিতে পারে না, তখন তার দায়িত্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর বর্তায়। দেখা যায় নানা প্রতিকূলতা, অবহেলা ও উদাসীনতার কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এ দায়িত্ব পালন করছে না। ফলে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না।
বাংলাদেশে আজকের সমাজ ব্যবস্থায় নৈতিক মূল্যবোধের সংকট লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আধুনিক জীবনের চাহিদার সঙ্গে বর্তমান মূল্যবোধের সংঘাতের কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংকট সৃষ্টি হয়। মূল্যবোধের সংকট বর্তমান সমাজে সুনির্দিষ্ট রূপ নিয়েছে এবং নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় সর্বব্যাপী। ব্যাপক দুর্নীতি, সন্ত্রাস, যুবকদের হতাশা এবং লক্ষ্যহীনতার করুণ চিত্রের পরিপ্রেক্ষিতে যে মানবিক সংকট দেখা দিয়েছে, তা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক।
ব্যক্তিজীবনে এসব মূল্যবোধের সংকট বিভিন্নভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। আধুনিক বাংলাদেশের সমাজের প্রকৃতি বিচার করলে আমরা দেখতে পাই সামাজিক, অর্থনৈতিক, নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়। দেশটি ঘুষ, দুর্নীতি, সামাজিক কলহ, ধর্মীয় গোঁড়ামি, নারী নির্যাতন, যৌন হয়রানি, গণপরিবহনে নারী ধর্ষণ ও হত্যা, পারিবারিক সহিংসতা, স্বামী কর্তৃক স্ত্রী হত্যা, স্ত্রী কর্তৃক স্বামী হত্যা, সন্তানসহ হত্যা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যকার সম্পর্কের পরিবর্তন, মাদক ও জুয়ার বিস্তার, নারী ও শিশু পাচার, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারীর প্রতি অবমাননাকর মন্তব্য ও গোপনে ভিডিও ধারণ করে ছড়িয়ে দেয়া, সম্পর্ক বা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ইত্যাদি বিষয়গুলো নৈতিক অবক্ষয় দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির পরিবর্তে তা রাজনীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় না আসায় অমেধাবীরা সেখানে ঢুকে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে টাকা-পয়সার আদান-প্রদানও শিক্ষার মানকে নিম্নগামী করছে। ফলে অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় নকলের প্রবণতা, প্রশ্নপত্র ফাঁস, অস্বাস্থ্যকর রাজনীতিতে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ, মারামারি, দলাদলি ও ক্ষমতার চর্চা, শিক্ষার্থীদের অসহিষ্ণুতা, অসামাজিক আচরণ, মাদক সেবন সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। আর এসবের মূলে রয়েছে আমাদের নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অনুপস্থিতি।
নীতি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় এক ভয়াবহ সামাজিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। অনেকের মতে, দেশে রাজনৈতিক আধিপত্য ও সামাজিক অবক্ষয়ের পরিবেশ বিরাজ করছে। শিক্ষকরা শিক্ষা ও গবেষণাসংক্রান্ত কাজের চেয়ে রাজনীতিতে বেশি সক্রিয় হয়ে পড়ছে। শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের মধ্যেও দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করেছে। শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও সংঘাত ছাড়াও আমরা এখন ছাত্রদের দ্বারা শিক্ষকদের অপমান, দুর্ব্যবহার, হয়রানি এবং এমনকি হত্যার মতো ভয়াবহ ঘটনার সাক্ষী। এ অবস্থা থেকে মুক্ত হতে হবে।
সমাজের মানুষ বিপদ থেকে, অনৈতিকতা থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করে। জাতি হিসেবে অগ্রসর হতে এবং বিশ্বে মর্যাদার সঙ্গে দাঁড়াতে হলে আমাদের অবশ্যই সমন্বিত অর্থনৈতিক ও নৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অবশ্যই মূল্যবোধের সংকট কাটিয়ে উঠতে হবে, জীবন-দর্শনের মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে এবং ঐতিহ্যগত ও আধুনিক জীবনধারার মধ্যে দ্বন্দ্ব এড়াতে হবে। জ্ঞান ও বিজ্ঞান প্রযুক্তিনির্ভর জীবনের সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী জীবনধারার মিলন ঘটাতে না পারলে মানব জীবনের গুরুত্বের সংকট দূর করা যাবে না। আর সমাজেও নিরাপত্তা ও শান্তি ফিরে আসবে না।
অর্থনৈতিক, সামাজিক, নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ সৃষ্টির জন্য শিক্ষার্থীসহ সব বয়সী মানুষের একদিকে যেমন উদ্ভাবনমূলক কাজের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে অন্যদিকে, স্বাধীন কর্মপন্থা বেছে নেয়া, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আত্ম-সচেতনতাও তৈরি করতে হবে। মানুষের অভ্যন্তরীণ জগতের উন্নতি হচ্ছে তার নৈতিক গুণের উন্নতি। শিক্ষা, ধর্ম এবং নীতির অনুভূতি এসবই নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টিতে অবদান রাখে।
ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে মানবিক, সাংস্কৃতিক, বিজ্ঞানভিত্তিক এবং সামাজিক মূল্যবোধ তৈরিতে শিক্ষার্থীদের মনন, কর্ম ও ব্যবহারিক জীবন প্রতিষ্ঠায় নৈতিকতার শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
তাছাড়া সমাজের সর্বস্তরের মানুষের নৈতিক শিক্ষা দরকার। ব্যক্তিজীবনের আদর্শ গড়ে তুলতে হলে মানুষের মধ্যে সর্বজনীন আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। আধ্যাত্মিক বিষয় মানুষকে সৎ করে তুলবে। এ ক্ষেত্রে পারিবারিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করতে হবে এবং পরিবারে নৈতিক শিক্ষাকে প্রসারিত ও শক্তিশালী করতে হবে। শিশুদের মধ্যে নৈতিক শিক্ষার প্রসারে পরিবারের ভূমিকার দিকে মনোযোগ দিতে অভিভাবকদের উৎসাহিত করতে হবে।
পরিবারের পরে, যে প্রতিষ্ঠানের কর্মকান্ড মানুষের নৈতিক জীবনে সবচেয়ে বেশি এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে তা হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশে শিক্ষা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটি অপরিহার্য দায়িত্ব রয়েছে। এ জন্য শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে রাজনীতিমুক্ত রাখা, মেধাবীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া, উপযুক্ত পারিশ্রমিক প্রদান করতে হবে। শুধু পাঠ্যপুস্তক বা তথ্যে নয়, বক্তব্যের মাধ্যমে নয়, অনুশীলনের মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে ব্যক্তিগত আচরণে নৈতিকতার চর্চা
অব্যাহত রাখতে হবে। আর এজন্য সমাজ থেকে অসমতা ও দারিদ্র্য দূরীকরণে সর্বাগ্রে মনোনিবেশ করতে হবে। ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার আন্দোলন শুরু করতে হবে। আর এজন্য রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে উদার হতে হবে। এছাড়া সমাজে নৈতিক মূল্যবোধের পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে না।
[লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]
মতিউর রহমান
বুধবার, ০৬ জুলাই ২০২২
নৈতিক মূল্যবোধ হলো এমন কিছু নির্দেশিকা, যা একজন ব্যক্তিকে সঠিক এবং ভুলের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে। দৈনন্দিন জীবনে সৎ, বিশ্বাসযোগ্য এবং সঠিক সম্পর্ক তৈরি করতে, মানুষের নৈতিকতার সচেতনতা- সঙ্গে আত্ম-সচেতনতা-অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
নৈতিক মূল্যবোধ একজন ব্যক্তিকে তার আচরণকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে সাহায্য করে। সুতরাং, নৈতিক মূল্যবোধ শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। জাতিকে নৈতিক মূল্যবোধের সংকট থেকে মুক্ত করতে শিক্ষার বিকল্প নেই।
আমাদের সমাজে প্রাচীন কিছু নৈতিক মূল্যবোধ রয়েছে, যা বাঙালিরা তাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির ধারক-বাহক হিসেবে গ্রহণ করেছে, যেমন সত্যবাদিতা, অহিংসা, শান্তি, ক্ষমা, অধ্যবসায়, সরলতা, জ্ঞানের তৃষ্ণা, সহনশীলতা, সহযোগিতা এবং শ্রদ্ধা। আমাদের ঐতিহ্যবাহী সমাজ শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় অনুশীলনের মাধ্যমে নৈতিক মূল্যবোধ শেখায়।
মানুষের নৈতিক জীবন ও নৈতিকতার মূল ভিত্তি হলো পরিবার থেকে গড়ে ওঠা মূল্যবোধ। পরিবার হলো নৈতিক মূল্যবোধের উৎস, যা মানুষ লালন করে এবং তাদের জীবনের বেশির ভাগ সময় অনুসরণ করে। বাংলাদেশ হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী সভ্যতা ও সংস্কৃতির পীঠস্থান। এই সমাজে, পারিবারিক ঐতিহ্য দীর্ঘকাল ধরে টিকে আছে, যা বৃহত্তম জনসংখ্যার জীবনধারা নিয়ন্ত্রণ করে।
কিন্তু সাম্প্রতিক নগরায়ণ, বিশ্বায়ন, অর্থনৈতিক জীবনের দ্রুত সম্প্রসারণ ও বিকাশ, প্রযুক্তির বিস্তার, বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি, মিডিয়ার প্রসার, টেলিভিশন ও অনলাইন বিনোদন বাণিজ্যের বিকাশ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং ব্যবসায়-বাণিজ্যের দ্রুত বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার দ্রুত স্থানান্তর,
বৈশ্বিক ও দেশীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং সংস্কৃতি ও শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ প্রথাগত মূল্যবোধকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে এবং দ্রুত পরিবর্তন করছে।
বিশ্বায়নের সাম্প্রতিক যুগে পারিবারিক মূল্যবোধ, নীতি ও নৈতিকতার ব্যাপক অবক্ষয় ঘটেছে। ফলে শিশুরা কোন নৈতিক মূল্যবোধ ছাড়াই বেড়ে উঠছে। পরিবার যখন তার নৈতিক মূল্যবোধ বিকাশের দায়িত্ব নিতে পারে না, তখন তার দায়িত্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর বর্তায়। দেখা যায় নানা প্রতিকূলতা, অবহেলা ও উদাসীনতার কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এ দায়িত্ব পালন করছে না। ফলে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না।
বাংলাদেশে আজকের সমাজ ব্যবস্থায় নৈতিক মূল্যবোধের সংকট লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আধুনিক জীবনের চাহিদার সঙ্গে বর্তমান মূল্যবোধের সংঘাতের কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংকট সৃষ্টি হয়। মূল্যবোধের সংকট বর্তমান সমাজে সুনির্দিষ্ট রূপ নিয়েছে এবং নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় সর্বব্যাপী। ব্যাপক দুর্নীতি, সন্ত্রাস, যুবকদের হতাশা এবং লক্ষ্যহীনতার করুণ চিত্রের পরিপ্রেক্ষিতে যে মানবিক সংকট দেখা দিয়েছে, তা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক।
ব্যক্তিজীবনে এসব মূল্যবোধের সংকট বিভিন্নভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। আধুনিক বাংলাদেশের সমাজের প্রকৃতি বিচার করলে আমরা দেখতে পাই সামাজিক, অর্থনৈতিক, নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়। দেশটি ঘুষ, দুর্নীতি, সামাজিক কলহ, ধর্মীয় গোঁড়ামি, নারী নির্যাতন, যৌন হয়রানি, গণপরিবহনে নারী ধর্ষণ ও হত্যা, পারিবারিক সহিংসতা, স্বামী কর্তৃক স্ত্রী হত্যা, স্ত্রী কর্তৃক স্বামী হত্যা, সন্তানসহ হত্যা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যকার সম্পর্কের পরিবর্তন, মাদক ও জুয়ার বিস্তার, নারী ও শিশু পাচার, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারীর প্রতি অবমাননাকর মন্তব্য ও গোপনে ভিডিও ধারণ করে ছড়িয়ে দেয়া, সম্পর্ক বা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ইত্যাদি বিষয়গুলো নৈতিক অবক্ষয় দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির পরিবর্তে তা রাজনীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় না আসায় অমেধাবীরা সেখানে ঢুকে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে টাকা-পয়সার আদান-প্রদানও শিক্ষার মানকে নিম্নগামী করছে। ফলে অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় নকলের প্রবণতা, প্রশ্নপত্র ফাঁস, অস্বাস্থ্যকর রাজনীতিতে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ, মারামারি, দলাদলি ও ক্ষমতার চর্চা, শিক্ষার্থীদের অসহিষ্ণুতা, অসামাজিক আচরণ, মাদক সেবন সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। আর এসবের মূলে রয়েছে আমাদের নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অনুপস্থিতি।
নীতি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় এক ভয়াবহ সামাজিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। অনেকের মতে, দেশে রাজনৈতিক আধিপত্য ও সামাজিক অবক্ষয়ের পরিবেশ বিরাজ করছে। শিক্ষকরা শিক্ষা ও গবেষণাসংক্রান্ত কাজের চেয়ে রাজনীতিতে বেশি সক্রিয় হয়ে পড়ছে। শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের মধ্যেও দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করেছে। শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও সংঘাত ছাড়াও আমরা এখন ছাত্রদের দ্বারা শিক্ষকদের অপমান, দুর্ব্যবহার, হয়রানি এবং এমনকি হত্যার মতো ভয়াবহ ঘটনার সাক্ষী। এ অবস্থা থেকে মুক্ত হতে হবে।
সমাজের মানুষ বিপদ থেকে, অনৈতিকতা থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করে। জাতি হিসেবে অগ্রসর হতে এবং বিশ্বে মর্যাদার সঙ্গে দাঁড়াতে হলে আমাদের অবশ্যই সমন্বিত অর্থনৈতিক ও নৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অবশ্যই মূল্যবোধের সংকট কাটিয়ে উঠতে হবে, জীবন-দর্শনের মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে এবং ঐতিহ্যগত ও আধুনিক জীবনধারার মধ্যে দ্বন্দ্ব এড়াতে হবে। জ্ঞান ও বিজ্ঞান প্রযুক্তিনির্ভর জীবনের সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী জীবনধারার মিলন ঘটাতে না পারলে মানব জীবনের গুরুত্বের সংকট দূর করা যাবে না। আর সমাজেও নিরাপত্তা ও শান্তি ফিরে আসবে না।
অর্থনৈতিক, সামাজিক, নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ সৃষ্টির জন্য শিক্ষার্থীসহ সব বয়সী মানুষের একদিকে যেমন উদ্ভাবনমূলক কাজের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে অন্যদিকে, স্বাধীন কর্মপন্থা বেছে নেয়া, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আত্ম-সচেতনতাও তৈরি করতে হবে। মানুষের অভ্যন্তরীণ জগতের উন্নতি হচ্ছে তার নৈতিক গুণের উন্নতি। শিক্ষা, ধর্ম এবং নীতির অনুভূতি এসবই নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টিতে অবদান রাখে।
ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে মানবিক, সাংস্কৃতিক, বিজ্ঞানভিত্তিক এবং সামাজিক মূল্যবোধ তৈরিতে শিক্ষার্থীদের মনন, কর্ম ও ব্যবহারিক জীবন প্রতিষ্ঠায় নৈতিকতার শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
তাছাড়া সমাজের সর্বস্তরের মানুষের নৈতিক শিক্ষা দরকার। ব্যক্তিজীবনের আদর্শ গড়ে তুলতে হলে মানুষের মধ্যে সর্বজনীন আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। আধ্যাত্মিক বিষয় মানুষকে সৎ করে তুলবে। এ ক্ষেত্রে পারিবারিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করতে হবে এবং পরিবারে নৈতিক শিক্ষাকে প্রসারিত ও শক্তিশালী করতে হবে। শিশুদের মধ্যে নৈতিক শিক্ষার প্রসারে পরিবারের ভূমিকার দিকে মনোযোগ দিতে অভিভাবকদের উৎসাহিত করতে হবে।
পরিবারের পরে, যে প্রতিষ্ঠানের কর্মকান্ড মানুষের নৈতিক জীবনে সবচেয়ে বেশি এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে তা হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশে শিক্ষা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটি অপরিহার্য দায়িত্ব রয়েছে। এ জন্য শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে রাজনীতিমুক্ত রাখা, মেধাবীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া, উপযুক্ত পারিশ্রমিক প্রদান করতে হবে। শুধু পাঠ্যপুস্তক বা তথ্যে নয়, বক্তব্যের মাধ্যমে নয়, অনুশীলনের মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে ব্যক্তিগত আচরণে নৈতিকতার চর্চা
অব্যাহত রাখতে হবে। আর এজন্য সমাজ থেকে অসমতা ও দারিদ্র্য দূরীকরণে সর্বাগ্রে মনোনিবেশ করতে হবে। ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার আন্দোলন শুরু করতে হবে। আর এজন্য রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে উদার হতে হবে। এছাড়া সমাজে নৈতিক মূল্যবোধের পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে না।
[লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]