alt

উপ-সম্পাদকীয়

গ্রামীণ জনজীবনে বজ্রপাতের ঝুঁকি

মিহির কুমার রায়

: বৃহস্পতিবার, ২৫ মে ২০২৩

সাম্প্রতিক কালে জলবায়ু পরিবর্তন ও জনজীবনে তার প্রভাব নিয়ে খুব আলোচনা হচ্ছে। ‘বজ্রপাত’ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একটি সাধারণ ইস্যু হলেও এশিয়া মহাদেশে বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়াতে বজ্রপাতের প্রভাব প্রকট। সম্প্রতি বাংলাদেশে এর প্রবণতা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। যদিও বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত ঘটে ভেনিজুয়েলা ও ব্রাজিলে; কিন্তু সেখানকার তুলনায় বাংলাদেশে মৃত্যুর হার বেশি।

পরিবেশবিজ্ঞানীরা বলছেন, সাধারণত কিউমুলোনিম্বাস বা ঝড়োপুঞ্জ মেঘ থেকে বজ্রপাত ও বৃষ্টি হয়। তাই একে বজ্রগর্ভ মেঘও বলা হয়ে থাকে। কয়েক বছর ধরে এপ্রিল-মে মাসে দেশে বজ্রগর্ভ মেঘের পরিমাণ বেড়েছে। তার একটা অন্যতম কারণ বাতাসে জলীয়বাষ্পের আধিক্য, আরেকটা হলো তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া।

তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত দূষণ। বায়ুতে দূষণের মাত্রা যত বাড়ছে, গড় তাপমাত্রা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, গাছপালা কেটে ফেলা, বাতাসে ধূলিকণা বেড়ে যাওয়া এবং মোবাইল টাওয়ারের মতো আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে বেড়েছে বজ্রপাত। তবে আমাদের দেশে বজ্রপাতের মূল কারণ ভৌগোলিক অবস্থান। এর কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে তাল, নারিকেল, সুপারি ও বটবৃক্ষের মতো বড় গাছের অভার, কৃষি যন্ত্রপাতিতে ধাতব দ্রব্যের ব্যবহার বৃদ্ধি, নদ-নদী শুকিয়ে যাওয়া, জলাভূমি ভরাট হওয়া, গাছপালা ধংসের কারণে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি বজ্রপাতের হার বাড়ার অন্যতম কারণ।

দেশের প্রতি বর্গকিলোমিটার এলাকায় গড়ে ৪০টি বজ্রপাত হয়ে থাকে। বিশ্বব্যাপী বজ্রপাতের অবস্থান নির্ণয়ের গবেষণায় দেখা যায় যে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশে মোট বজ্রপাতের সংখ্যা ১৮০০ ছাড়িছে গেছে প্রতি বর্গকিলোমিটারে। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্ট সেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় বলা হয়েছে- হিমালয়ের পাদদেশ থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত জলবায়ুর পরিবর্তনে বাংলাদেশে অতিমাত্রায় বজ্রপাত হয়ে থাকে।

গবেষণায় এটাও বলা হয় যে, বর্তমানে বিশ্বে বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর হার বাংলাদেশে। নাসার জিআইএসএসের গবেষক কাল প্রাইস তার গবেষণায় উল্লেখ করেছেন- জলবায়ু পরিবর্তন দুটি প্রকৃতিক দুর্যোগ যেমন- বজ্রপাত ও দাবানলকে বিশেষভাবে প্রবাভিত করে থাকে এবং পরিবেশে এখন যে পরিমাণ কার্বন আছে তার যদি দ্বিগুণ বৃদ্ধি ঘটে তা হলে বজ্রপাত ঘটবে ৩২ ভাগ। তারমতে বায়ুদূষণের সঙ্গে বজ্রপাতের সম্পর্ক খুব নিবিড়। বেশির ভাগ গবেষকই মনে করেন বাতাসে সালফার ও নাইট্রোজেনের যৌগগুলোর পরিমাণ, তাপ শোষণ ও সাময়িক সংরক্ষণকারী গ্যাসের মাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে বজ্রপাত বাড়া কিংবা কমার সম্পর্ক রয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় বলা হয়েছে- বিশ্বের গড় তাপমাত্রা এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে বজ্রপাত অন্তত ১৫ শতাংশ এবং ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে ৫০ শতাংশের বেশি বজ্রপাত হতে পারে। কয়েকটি দেশের হিসাব কষে এ ফল দেয়া হয়েছে। কঙ্গোয় ভূমি থেকে এক হাজার মিটারের বেশি উচ্চতায় কিফুকা পর্বতের এক গ্রামে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয়- বছরে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১৫০ বার। পরবর্তী অবস্থানে আছে ভেনিজুয়েলা, উত্তর ব্রাজিল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা, টেক্সাস, ক্যালিফোর্নিয়া। বিশ্বে প্রতি সেকেন্ডে গড়ে ৪৫ বার বজ্রপাত হয়। সেই হিসাবে বছরে এ সংখ্যা প্রায় দেড়শ কোটি বার। বিশ্বের হিসাব যাই থাক বাংলাদেশে বজ্রপাতের হার বেড়ে গিয়ে যে মৃত্যুর সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে তা রোধে কোন ব্যবস্থা নেই। সচেতনতাও গড়ে তোলা হয়নি।

প্রকৃতিতে কার্বন-ডাই অক্সাইড নিঃসরণ ক্রমাগতভাবেই বেড়ে চলছে বিধায় বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে মেঘে মেঘে সংঘর্ষ বজ্রপাতকে ত্বরান্বিত করছে। আবার বিভিন্ন গবেষক বিজ্ঞানীরা বলছেন- বজ্রপাত বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে বায়ুম-লের তাপমাত্রা বৃদ্ধির একটি সম্পর্ক রয়েছে, যা প্রমাণিত এবং প্রাকৃতির এক ভয়াবহ পরিণাম যে, বজ্রপাতে কয়েক মিলি সেকেন্ডে তাপমাত্রা সূর্যপৃষ্ঠের তাপমাত্রার কাছাকাছি চলে যায়। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে বিগত কয়েক বছরে ঢাকার বাতাসে কার্বনের পরিমাণ ৪% এর বেশি বেড়েছে এবং বাতাসে ধূলিকণার মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে ২০০ মাইক্রোগ্রামের মনে করা হলেও এলাকা ভেদে প্রতি ঘনমিটারে ৬৬৫ থেকে ২০০০ পর্যন্ত মাইক্রোগ্রাম পাওয়া গেছে ।

ঢাকা শহরে দেশের সবচাইতে বজ্রপাতপ্রবণ এলাকা হওয়ার কথা থাকলেও তা বৈদ্যুতিক তাদের বেড়াজালের কারণে বুঝা যায় না সত্যি, কিন্তু বিদ্যুৎচালিত যন্ত্রপাতি যেমন বাল্ব, রেফ্রিজারেটর, টেলিভিশন, ওভেন, এয়ারকুলার ইত্যাদি যন্ত্রপাতির ক্ষতিসাধন হয়ে থাকে। এই ক্ষতি আবার সাধারণ ভোক্তাদের মেরামত খরচ বাড়িয়ে তোলে; যা তাদের সাংসারিক বাজেট-বহির্ভূত।

দেশে বজ্রপাতের সংখ্যা না বাড়লেও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। গত ৪ মে সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরামে (এসএসটিএফ) এ তথ্য জানিয়েছে যে, গত বছরের এপ্রিল থেকে চলতি মাসের ৪ মে পর্যন্ত বজ্রপাতে ৩৪২ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত বছরের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বজ্রপাতে মারা যান ২৭৪ জন, এর মধ্যে ২৩৯ জন পুরুষ ও ৩৫ জন নারী। এদের মধ্যে শিশু রয়েছে ১২ জন, আর এ বছরের এপ্রিল মাসেই প্রাণ হারিয়েছেন ৫০ জন।

বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিরাজগঞ্জ, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, পাবনা, নওগাঁ, বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, জামালপুর, গাইবান্ধা ও টাঙ্গাইল সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতপ্রবণ জেলা। ফলে এ ১৫ জেলায় মৃত্যুও বেশি। এর মধ্যে মার্চ-এপ্রিল ও মে মাসে বজ্রপাত বেশি হয় হাওরাঞ্চলের কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট ও নেত্রকোনা জেলায়। জুন, জুলাই, আগস্টে হয়ে থাকে সুনামগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, মানিকগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও বরিশালে। অন্যদিকে কুড়িগ্রাম ও পঞ্চগড়ে বজ্রপাত বেশি হয় সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে। নভেম্বরে পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও কক্সবাজারে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয়।

শহরের চেয়ে গ্রামীণ এলাকায় বজ্রপাতে মৃত্যুর হার অনেক বেশি, বিশেষ করে ফাঁকা মাঠে চাষের কাজ করতে গিয়ে মৃত্যু হচ্ছে অনেকের। এর অন্যতম কারণ হিসেবে কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহার করা উন্নত যন্ত্রপাতিকে দায়ী করছেন পরিবেশবিদরা। কেননা এসব যন্ত্রে আকর্ষিত হয় বিদ্যুৎ, সেই সঙ্গে ফাঁকা মাঠে কোনো উঁচু জায়গা বা গাছ না থাকায় মানুষের ওপর বজ্রপাতের ঘটনা অনেক বেশি হচ্ছে। একেকটি বজ্রপাতের সময় প্রায় ৬০০ মেগা ভোল্ট বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়, যেখানে একজন মানুষের মৃত্যুর জন্য মাত্র ১০০ ভোল্ট বিদ্যুৎই যথেষ্ট।

বজ্রপাতের সময় বাড়ির ধাতব কল, সিঁড়ির ধাতব রেলিং, পাইপ ইত্যাদি স্পর্শ করা যাবে না, বাড়িতে যদি পর্যাপ্ত নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা না থাকে তাহলে সবাই এককক্ষে না থেকে আলাদা আলাদা কক্ষে যেতে হবে, যেহেতু বৈদ্যুতিক শকের চেয়ে বেশি শক্তিসম্পন্ন বজ্রপাত শক, সেহেতু বজ্রপাতে কেউ আহত হলে বৈদ্যুতিক শকে আহতদের মতো করেই চিকিৎসা করতে হবে। প্রয়োজনে দ্রুত চিকিৎসককে ডাকতে হবে, হাসপাতালে নিতে হবে, বজ্র আহত ব্যক্তির শ্বাস-প্রশ্বাস ও হৃদস্পন্দন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। বজ্রপাতে মৃত্যু ঠেকানোর জন্য উঁচু তালগাছই সবচেয়ে কার্যকর; যা বাড়ির আঙিনায় লাগাতে হবে।

বজ্রপাত সতর্কতা বিষয়ে সব জানতে হবে, সতর্কতামূলক কাজগুলো যথাযথভাবে নিজে পালন করতে হবে এবং অন্যকেও নিয়ম পালনে সাহায্য করতে হবে। দেশের বজ্রপাতপ্রবণ এলাকাগুলো শনাক্ত করতে হবে আবহাওয়া জরিপের ভিত্তিতে। গত কয়েক বছরে প্রায় চার হাজার নারী-পুরুষ বজ্রপাতের কারণে আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। তাদের বেঁচে থাকার জন্য ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি সু-চিকিৎসার ব্যবস্থাও করতে হবে। উৎকণ্ঠার বিষয় হলো- বাংলাদেশে এত বেশি মৃত্যুহার হলেও বজ্রপাত নিয়ে কোনো গবেষণা ও তা থেকে মৃত্যুরোধের কোনো কার্যক্রম নেই। সীমিত পরিসরে বজ্রপাত সম্পর্কে শুধু পুস্তিকা এবং সেমিনারের মাধ্যমে সরকারি কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রয়েছে।

সচেতনতার অভাব, বজ্রনিরোধক এবং উল্ল্যেখযোগ্য সরকারি কোনো কার্যক্রম না থাকায় প্রতি বছর এতগুলো প্রাণ ঝরে যাচ্ছে। বজ্রপাতের কারণে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়, যেহেতু বজ্রপাত প্রতিরোধের কোনো উপায় বের হয়নি সেহেতু বজ্রপাতের সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। একই সঙ্গে গবেষণা সম্প্রসারণের জন্য গবেষকদের অনুপ্রাণিত করতে হবে; যাতে উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে বজ্রপাতের তীব্রতা, নিখুঁত সময় ও আরো নতুন তথ্য জানা যায়। মানুষের পাশাপাশি সরকারকেউ নিরন্তরভাবে এগিয়ে যেতে হবে মুক্ত পরিবেশ গড়ার লক্ষ্যে।

[লেখক : ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি]

সর্বজনীন শিক্ষার বলয়ের বাইরে আদিবাসীরা : অন্তর্ভুক্তির লড়াইয়ে বৈষম্যের দেয়াল

শোনার গান, দেখার টান : অনুভূতির ভোঁতা সময়

ছবি

ছিন্নপত্রে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও রবীন্দ্র চেতনা

ভেতরের অদৃশ্য অপরাধ : সমাজের বিপন্ন মানসিকতা

দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসনে খাসজমি ও জলার গুরুত্ব

অবহেলিত কৃষক ও বাজার ব্যবস্থার বৈষম্য

রাক্ষুসে মাছের দাপটে বিপন্ন দেশীয় মাছ : করণীয় কী?

বজ্রপাতের আতঙ্কে জনজীবন

তাহলে কি ঘৃণায় ছেয়ে যাবে দেশ, মানবজমিন রইবে পতিত

কর্পোরেট ও ব্যক্তিগত সামাজিক দায়বদ্ধতা

‘রাখাইন করিডর’ : একটি ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

ভিন্নমতের ভয়, নির্বাচনের দোলাচল ও অন্তর্বর্তী সরকারের কৌশলী অবস্থান

সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

কৃষি শিক্ষা হোক উদ্যোক্তা গড়ার মাধ্যম

রঙ্গব্যঙ্গ : কোটের কেবল রং বদলায়

মে দিবসের চেতনা বনাম বাস্তবতা

শ্রম আইন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় চাই আন্তরিকতা

বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকা কেন এত পিছিয়ে

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল : নিরাপদ যাত্রার প্রত্যাশা

কর ফাঁকি : অর্থনীতির জন্য এক অশনি সংকেত

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় : উপকূলীয় সুরক্ষার শিক্ষা

যখন নদীগুলো অস্ত্র হয়ে ওঠে

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুণগত মান উন্নয়নে গবেষণা ও উদ্ভাবন

বজ্রপাত ও তালগাছ : প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা

কুষ্ঠ ও বৈষম্য : মানবাধিকারের প্রশ্নে একটি অবহেলিত অধ্যায়

ছবি

প্রান্তজনের বাংলাদেশ

অতীতের ছায়ায় নতুন বাংলাদেশ : দুর্নীতি, উগ্রপন্থা ও সরকারের দায়

সাইবার নিরাপত্তা : অদৃশ্য যুদ্ধের সামনে আমাদের প্রস্তুতি

ছবি

বাহান্নর গর্ভে জন্ম নেয়া এক ঝড়ের পাখি

প্রবাসী শ্রমিক : অর্থের যন্ত্র নয়, রাষ্ট্রের সহযোদ্ধা

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির এক যুগ

ভোগবাদের বিরুদ্ধে পোপ ফ্রান্সিসের জলবায়ু বার্তা

রম্যগদ্য : হাসি নিষেধ...

পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের আন্দোলন : দাবি ও সমাধানের পথ

সিরিয়ার পতন কিভাবে আমেরিকার স্বার্থকে হুমকিতে ফেলছে

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র : বিকল্প রাষ্ট্রচিন্তার সন্ধানে

tab

উপ-সম্পাদকীয়

গ্রামীণ জনজীবনে বজ্রপাতের ঝুঁকি

মিহির কুমার রায়

বৃহস্পতিবার, ২৫ মে ২০২৩

সাম্প্রতিক কালে জলবায়ু পরিবর্তন ও জনজীবনে তার প্রভাব নিয়ে খুব আলোচনা হচ্ছে। ‘বজ্রপাত’ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একটি সাধারণ ইস্যু হলেও এশিয়া মহাদেশে বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়াতে বজ্রপাতের প্রভাব প্রকট। সম্প্রতি বাংলাদেশে এর প্রবণতা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। যদিও বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত ঘটে ভেনিজুয়েলা ও ব্রাজিলে; কিন্তু সেখানকার তুলনায় বাংলাদেশে মৃত্যুর হার বেশি।

পরিবেশবিজ্ঞানীরা বলছেন, সাধারণত কিউমুলোনিম্বাস বা ঝড়োপুঞ্জ মেঘ থেকে বজ্রপাত ও বৃষ্টি হয়। তাই একে বজ্রগর্ভ মেঘও বলা হয়ে থাকে। কয়েক বছর ধরে এপ্রিল-মে মাসে দেশে বজ্রগর্ভ মেঘের পরিমাণ বেড়েছে। তার একটা অন্যতম কারণ বাতাসে জলীয়বাষ্পের আধিক্য, আরেকটা হলো তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া।

তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত দূষণ। বায়ুতে দূষণের মাত্রা যত বাড়ছে, গড় তাপমাত্রা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, গাছপালা কেটে ফেলা, বাতাসে ধূলিকণা বেড়ে যাওয়া এবং মোবাইল টাওয়ারের মতো আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে বেড়েছে বজ্রপাত। তবে আমাদের দেশে বজ্রপাতের মূল কারণ ভৌগোলিক অবস্থান। এর কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে তাল, নারিকেল, সুপারি ও বটবৃক্ষের মতো বড় গাছের অভার, কৃষি যন্ত্রপাতিতে ধাতব দ্রব্যের ব্যবহার বৃদ্ধি, নদ-নদী শুকিয়ে যাওয়া, জলাভূমি ভরাট হওয়া, গাছপালা ধংসের কারণে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি বজ্রপাতের হার বাড়ার অন্যতম কারণ।

দেশের প্রতি বর্গকিলোমিটার এলাকায় গড়ে ৪০টি বজ্রপাত হয়ে থাকে। বিশ্বব্যাপী বজ্রপাতের অবস্থান নির্ণয়ের গবেষণায় দেখা যায় যে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশে মোট বজ্রপাতের সংখ্যা ১৮০০ ছাড়িছে গেছে প্রতি বর্গকিলোমিটারে। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্ট সেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় বলা হয়েছে- হিমালয়ের পাদদেশ থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত জলবায়ুর পরিবর্তনে বাংলাদেশে অতিমাত্রায় বজ্রপাত হয়ে থাকে।

গবেষণায় এটাও বলা হয় যে, বর্তমানে বিশ্বে বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর হার বাংলাদেশে। নাসার জিআইএসএসের গবেষক কাল প্রাইস তার গবেষণায় উল্লেখ করেছেন- জলবায়ু পরিবর্তন দুটি প্রকৃতিক দুর্যোগ যেমন- বজ্রপাত ও দাবানলকে বিশেষভাবে প্রবাভিত করে থাকে এবং পরিবেশে এখন যে পরিমাণ কার্বন আছে তার যদি দ্বিগুণ বৃদ্ধি ঘটে তা হলে বজ্রপাত ঘটবে ৩২ ভাগ। তারমতে বায়ুদূষণের সঙ্গে বজ্রপাতের সম্পর্ক খুব নিবিড়। বেশির ভাগ গবেষকই মনে করেন বাতাসে সালফার ও নাইট্রোজেনের যৌগগুলোর পরিমাণ, তাপ শোষণ ও সাময়িক সংরক্ষণকারী গ্যাসের মাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে বজ্রপাত বাড়া কিংবা কমার সম্পর্ক রয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় বলা হয়েছে- বিশ্বের গড় তাপমাত্রা এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে বজ্রপাত অন্তত ১৫ শতাংশ এবং ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে ৫০ শতাংশের বেশি বজ্রপাত হতে পারে। কয়েকটি দেশের হিসাব কষে এ ফল দেয়া হয়েছে। কঙ্গোয় ভূমি থেকে এক হাজার মিটারের বেশি উচ্চতায় কিফুকা পর্বতের এক গ্রামে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয়- বছরে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১৫০ বার। পরবর্তী অবস্থানে আছে ভেনিজুয়েলা, উত্তর ব্রাজিল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা, টেক্সাস, ক্যালিফোর্নিয়া। বিশ্বে প্রতি সেকেন্ডে গড়ে ৪৫ বার বজ্রপাত হয়। সেই হিসাবে বছরে এ সংখ্যা প্রায় দেড়শ কোটি বার। বিশ্বের হিসাব যাই থাক বাংলাদেশে বজ্রপাতের হার বেড়ে গিয়ে যে মৃত্যুর সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে তা রোধে কোন ব্যবস্থা নেই। সচেতনতাও গড়ে তোলা হয়নি।

প্রকৃতিতে কার্বন-ডাই অক্সাইড নিঃসরণ ক্রমাগতভাবেই বেড়ে চলছে বিধায় বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে মেঘে মেঘে সংঘর্ষ বজ্রপাতকে ত্বরান্বিত করছে। আবার বিভিন্ন গবেষক বিজ্ঞানীরা বলছেন- বজ্রপাত বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে বায়ুম-লের তাপমাত্রা বৃদ্ধির একটি সম্পর্ক রয়েছে, যা প্রমাণিত এবং প্রাকৃতির এক ভয়াবহ পরিণাম যে, বজ্রপাতে কয়েক মিলি সেকেন্ডে তাপমাত্রা সূর্যপৃষ্ঠের তাপমাত্রার কাছাকাছি চলে যায়। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে বিগত কয়েক বছরে ঢাকার বাতাসে কার্বনের পরিমাণ ৪% এর বেশি বেড়েছে এবং বাতাসে ধূলিকণার মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে ২০০ মাইক্রোগ্রামের মনে করা হলেও এলাকা ভেদে প্রতি ঘনমিটারে ৬৬৫ থেকে ২০০০ পর্যন্ত মাইক্রোগ্রাম পাওয়া গেছে ।

ঢাকা শহরে দেশের সবচাইতে বজ্রপাতপ্রবণ এলাকা হওয়ার কথা থাকলেও তা বৈদ্যুতিক তাদের বেড়াজালের কারণে বুঝা যায় না সত্যি, কিন্তু বিদ্যুৎচালিত যন্ত্রপাতি যেমন বাল্ব, রেফ্রিজারেটর, টেলিভিশন, ওভেন, এয়ারকুলার ইত্যাদি যন্ত্রপাতির ক্ষতিসাধন হয়ে থাকে। এই ক্ষতি আবার সাধারণ ভোক্তাদের মেরামত খরচ বাড়িয়ে তোলে; যা তাদের সাংসারিক বাজেট-বহির্ভূত।

দেশে বজ্রপাতের সংখ্যা না বাড়লেও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। গত ৪ মে সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরামে (এসএসটিএফ) এ তথ্য জানিয়েছে যে, গত বছরের এপ্রিল থেকে চলতি মাসের ৪ মে পর্যন্ত বজ্রপাতে ৩৪২ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত বছরের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বজ্রপাতে মারা যান ২৭৪ জন, এর মধ্যে ২৩৯ জন পুরুষ ও ৩৫ জন নারী। এদের মধ্যে শিশু রয়েছে ১২ জন, আর এ বছরের এপ্রিল মাসেই প্রাণ হারিয়েছেন ৫০ জন।

বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিরাজগঞ্জ, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, পাবনা, নওগাঁ, বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, জামালপুর, গাইবান্ধা ও টাঙ্গাইল সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতপ্রবণ জেলা। ফলে এ ১৫ জেলায় মৃত্যুও বেশি। এর মধ্যে মার্চ-এপ্রিল ও মে মাসে বজ্রপাত বেশি হয় হাওরাঞ্চলের কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট ও নেত্রকোনা জেলায়। জুন, জুলাই, আগস্টে হয়ে থাকে সুনামগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, মানিকগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও বরিশালে। অন্যদিকে কুড়িগ্রাম ও পঞ্চগড়ে বজ্রপাত বেশি হয় সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে। নভেম্বরে পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও কক্সবাজারে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয়।

শহরের চেয়ে গ্রামীণ এলাকায় বজ্রপাতে মৃত্যুর হার অনেক বেশি, বিশেষ করে ফাঁকা মাঠে চাষের কাজ করতে গিয়ে মৃত্যু হচ্ছে অনেকের। এর অন্যতম কারণ হিসেবে কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহার করা উন্নত যন্ত্রপাতিকে দায়ী করছেন পরিবেশবিদরা। কেননা এসব যন্ত্রে আকর্ষিত হয় বিদ্যুৎ, সেই সঙ্গে ফাঁকা মাঠে কোনো উঁচু জায়গা বা গাছ না থাকায় মানুষের ওপর বজ্রপাতের ঘটনা অনেক বেশি হচ্ছে। একেকটি বজ্রপাতের সময় প্রায় ৬০০ মেগা ভোল্ট বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়, যেখানে একজন মানুষের মৃত্যুর জন্য মাত্র ১০০ ভোল্ট বিদ্যুৎই যথেষ্ট।

বজ্রপাতের সময় বাড়ির ধাতব কল, সিঁড়ির ধাতব রেলিং, পাইপ ইত্যাদি স্পর্শ করা যাবে না, বাড়িতে যদি পর্যাপ্ত নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা না থাকে তাহলে সবাই এককক্ষে না থেকে আলাদা আলাদা কক্ষে যেতে হবে, যেহেতু বৈদ্যুতিক শকের চেয়ে বেশি শক্তিসম্পন্ন বজ্রপাত শক, সেহেতু বজ্রপাতে কেউ আহত হলে বৈদ্যুতিক শকে আহতদের মতো করেই চিকিৎসা করতে হবে। প্রয়োজনে দ্রুত চিকিৎসককে ডাকতে হবে, হাসপাতালে নিতে হবে, বজ্র আহত ব্যক্তির শ্বাস-প্রশ্বাস ও হৃদস্পন্দন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। বজ্রপাতে মৃত্যু ঠেকানোর জন্য উঁচু তালগাছই সবচেয়ে কার্যকর; যা বাড়ির আঙিনায় লাগাতে হবে।

বজ্রপাত সতর্কতা বিষয়ে সব জানতে হবে, সতর্কতামূলক কাজগুলো যথাযথভাবে নিজে পালন করতে হবে এবং অন্যকেও নিয়ম পালনে সাহায্য করতে হবে। দেশের বজ্রপাতপ্রবণ এলাকাগুলো শনাক্ত করতে হবে আবহাওয়া জরিপের ভিত্তিতে। গত কয়েক বছরে প্রায় চার হাজার নারী-পুরুষ বজ্রপাতের কারণে আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। তাদের বেঁচে থাকার জন্য ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি সু-চিকিৎসার ব্যবস্থাও করতে হবে। উৎকণ্ঠার বিষয় হলো- বাংলাদেশে এত বেশি মৃত্যুহার হলেও বজ্রপাত নিয়ে কোনো গবেষণা ও তা থেকে মৃত্যুরোধের কোনো কার্যক্রম নেই। সীমিত পরিসরে বজ্রপাত সম্পর্কে শুধু পুস্তিকা এবং সেমিনারের মাধ্যমে সরকারি কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রয়েছে।

সচেতনতার অভাব, বজ্রনিরোধক এবং উল্ল্যেখযোগ্য সরকারি কোনো কার্যক্রম না থাকায় প্রতি বছর এতগুলো প্রাণ ঝরে যাচ্ছে। বজ্রপাতের কারণে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়, যেহেতু বজ্রপাত প্রতিরোধের কোনো উপায় বের হয়নি সেহেতু বজ্রপাতের সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। একই সঙ্গে গবেষণা সম্প্রসারণের জন্য গবেষকদের অনুপ্রাণিত করতে হবে; যাতে উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে বজ্রপাতের তীব্রতা, নিখুঁত সময় ও আরো নতুন তথ্য জানা যায়। মানুষের পাশাপাশি সরকারকেউ নিরন্তরভাবে এগিয়ে যেতে হবে মুক্ত পরিবেশ গড়ার লক্ষ্যে।

[লেখক : ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি]

back to top