alt

মুক্ত আলোচনা

বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল : বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রূপরেখা

বিচারপতি মোহাম্মদ মমতাজ উদ্দিন আহমেদ

: শুক্রবার, ১৪ আগস্ট ২০২০

http://thesangbad.net/images/2020/August/14Aug20/news/sangbad_bangla_1597416369.jpg

এবারে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল দিবস পালিত হচ্ছে মুজিববর্ষের মহাক্ষণে। এ মহান নেতার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের প্রধান পাথেয় ছিল তার গভীর দেশপ্রেম। মানুষের প্রতি ছিল তার অসীম ভালোবাসা। তিনি বাঙালি জাতিকে শুধু স্বপ্ন দেখিয়ে ক্ষান্ত হননি, এ দেশের জনমানুষের স্বপ্নকে তিনি বাস্তবে রূপদান করেছিলেন। তারই নেতৃত্বে ও আহ্বানে এ দেশের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল স্বাধীনতার লড়াইয়ে। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির প্রতি, তার অবদান ও আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে এবারে পালিত হচ্ছে প্রেস কাউন্সিল দিবস।

সংবাদপত্র হচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রের আয়না। সংবাদপত্রের মাধ্যমে জনগণকে শিক্ষাদান, মৌলিক অধিকার রক্ষা ও বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীকে কাজে উৎসাহিত করা এবং সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করা- এই ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্দেশ্য। কিন্তু তিনি তা দেখে যেতে পারেননি। তার সুযোগ্যকন্যা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বিশ্বনেতা এবং বাংলাদেশের গৌরব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে আজ তার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণে দেশের সব ক্ষেত্রে উন্নয়নসহ গণমাধ্যমের কাক্সিক্ষত উন্নয়ন হয়েছে। এ সাফল্যের অংশীদার দেশের সব সাংবাদিক ও গণমাধ্যম পেশার মানুষ।

বঙ্গবন্ধু বাঙ্গালি জাতির আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। পাশাপাশি তিনি একসময় যুক্ত ছিলেন সাংবাদিকতার সঙ্গে। এই পেশার সমস্যা, সংকট উত্তরণের প্রয়াস সম্পর্কে বিস্তারিত জানা ছিল তার। তাই স্বাধীনতা লাভের পর দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি এ পেশার উন্নয়নের প্রতি দৃষ্টি দেন। তিনি বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষা ও মান উন্নয়নের উদ্দেশ্যে প্রেস কাউন্সিল আইন প্রণয়ন করেন। জাতির পিতার নেতৃত্বে গঠিত সরকারের আমলে প্রণীত এ আইনটি ১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৪ তারিখে গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়।

এবারে আমাদের সবারই সব কার্যক্রম মুজিববর্ষকে কেন্দ্র করে। তাই আমাদের ফিরে দেখতে হয় তার সংগ্রামী রাজনৈতিক জীবনের দিকে। যার পরতে পরতে রয়েছে তার গভীর ভালোবাসা বাঙালি জাতির প্রতি।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের পর পাকিস্তান ও ভারত এই দুই রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান নামে যে রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছিল, সেখানে/তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক অধিকার ছিল উপেক্ষিত। সেই সঙ্গে ছিল না স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার। শুরু থেকে এ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করে আসছিলেন বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তান দীর্ঘদিন সামরিক শাসনের অধীনে ছিল। যেখানে স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার ছিল নিয়ন্ত্রিত। তিনি এটি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন। তাই স্বাধীনতা লাভের পরপরই তিনি প্রেস কাউন্সিল গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এবং তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন।

১৯৪৭ সালের পর যে শাসন ব্যবস্থার অধীনে আমরা ছিলাম, তা ছিল স্বৈরাচারী। এ শাসন ব্যবস্থায় তৎকালীন গণমাধ্যম সম্পর্কিত আইনেও সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার ওপর সামরিক শাসক ও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের খড়গ নেমে আসে। ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান ‘প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন অর্ডিন্যান্স ১৯৬২’ জারি করেন। এ অর্ডিন্যান্সের ক্ষমতাবলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সংবাদপত্র বাজেয়াপ্তকরণ, সংবাদ সংস্থাকে বন্ধ এবং সাংবাদিকদের অধিকার হরণ করতে পারত। এই অর্ডিন্যান্স ব্যবহার করে আইয়ুব খান সংবাদপত্রের বেশির ভাগ অংশ জাতীয়করণ করাসহ দুটি বৃহৎ সংবাদ সংস্থাকে সরকার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। বেতার ও টেলিভিশনকেও সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়।

১৯৫৬ সালে পাকিস্তান ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের যে সংবিধান প্রণীত হয় সেখানে বাকস্বাধীনতা সম্পর্কিত একটি আলাদা অনুচ্ছেদ সন্নিবেশিত করা হয়। ১৯৫৬ সালের সংবিধানের অস্তিত্ব ৩ বছরেরও কম সময় থাকে। ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে এই সংবিধান স্থগিত করা হয়। ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান কর্তৃক সামরিক শাসনের অবসানের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণীত হয়। যদিও এ সংবিধানে বাক স্বাধীনতার প্রাথমিক ধারণার স্বীকৃতিকে অন্তর্ভুক্ত রাখলেও প্রকৃতপক্ষে একজন সামরিক শাসক কর্তৃক প্রণীত সংবিধানে আলাদাভাবে মৌলিক অধিকার সম্পর্কিত কোন অধ্যায় রাখা হয়নি।

১৯৬২ সালে প্রণীত প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন অর্ডিন্যান্স অত্যন্ত কঠোরভাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের প্রগতিশীল উন্নয়ন ব্যবস্থাকে খর্ব করা হয়। এ অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খান কর্তৃক জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে ক্ষমতা হস্তান্তর পর্যন্ত শাসন ব্যবস্থাকে প্রলম্বিত করে। ১৯৬৯ সালে জেনারেল ইয়াহিয়া আবারও সামরিক শাসন জারি করেন এবং ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন। পাকিস্তান সরকারে এ পদক্ষেপগুলোর বিরুদ্ধে বরাবরই প্রতিবাদ করে আসছিলেন বঙ্গবন্ধু।

১৯৭০ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে পড়ে তৎকালীন সরকার। আর তাই ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে গড়িমসি শুরু করে তারা। অনিবার্যভাবে শুরু হয় স্বাধীনতার প্রস্তুতি। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে, বিশেষ করে ৭ মার্চের ভাষণের পর, ২৫ মার্চের কালরাতে আক্রান্ত হওয়ার মুহূর্ত থেকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালিরা। ত্রিশ লাখ শহীদ, অগণিত মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা অর্জন করি এ স্বাধীনতা। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু সরকারের জন্য দেশ পুনর্গঠনের এক চ্যালেঞ্জ সামনে আসে। বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে শুরু হয় বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে উঁচু করার প্রচেষ্টা। এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু শেখ। মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষা ও মানোন্নয়নের উদ্দেশ্যে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল আইন প্রণয়ন করেন।

বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম এখন পুরোপুরি স্বাধীন। বর্তমান সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানা তৃতীয়বারের মতো দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। প্রতিবারই দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি সমাজের সর্বস্তরে ন্যায়বিচার, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, একটি গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণ করার উদ্যোগ নেন। এর মধ্যে অন্যতম সাংবাদিকদের জীবনমান উন্নয়ন। গণমাধ্যমকে পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদানে তিনি একনিষ্ঠ। তার বলিষ্ঠ নির্দেশনার প্রেক্ষিতে বর্তমানে এদেশের গণমাধ্যম শতভাগ স্বাধীনতা ভোগ করছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন মেয়াদে সংবাদপত্র ও অন্যান্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। সাংবাদিকদের কল্যাণে সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করেছে, সাংবাদিকদের জীবন-জীবিকার উন্নয়নের জন্য নবম ওয়েজবোর্ড গঠন ও গণমাধ্যমকর্মীদের পেশাগত নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। দেশের বিভিন্ন প্রেসক্লাবগুলোকে আধুনিকায়ন করে তোলার জন্য আর্থিক অনুদান দেয়া হচ্ছে। জাতীয় প্রেস ক্লাবে গড়ে তোলা হচ্ছে ৩১ তলা বিশিষ্ট বঙ্গবন্ধু মিডিয়া সেন্টার। যেখানে সাংবাদিকরা পাবে পেশাগত সবধরণের সুযোগ। সংবাপত্র ছাড়াও ৩৩টি টেলিভিশন, ১৬টি এফএম রেডিও, ১৭টি কমিউনিটি রেডিও, অসংখ্য অনলাইন সংবাদপত্র, অনলাইন নিউজ পোর্টাল তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। দেশের গণমাধ্যম এখন পূর্ণস্বাধীন। বর্তমান সরকার গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে পূর্বের তুলনায় অধিকতর শক্তিশালী ও গতিশীল করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

দেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা পেশাকে নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ, জবাবদিহিতামূলক করার লক্ষ্য নিয়ে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সুদৃঢ় করার প্রত্যয় নিয়ে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের পথ চলা শুরু হয় আজ থেকে ৪৬ বছর আগে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থাগুলোর পেশাগত মান সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে বর্তমান বিশ্বে প্রেস কাউন্সিলের ধারণা একটি নতুন সংযোজন। এর ভূমিকাও বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। পৃথিবীর উন্নত ও উন্নয়নশীল প্রায় প্রতিটি দেশেই অধুনা প্রেস কাউন্সিল বা ভিন্ন নামে অনুরূপ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।

মূলত সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সংরক্ষণ এবং স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার লক্ষ্যে ১৯১৬ সালে সুইডেন ‘প্রেস ফেয়ার কমিশন গঠনের মাধ্যমে একটি প্রেস কোর্ট অব অনার সর্বপ্রথম গঠন করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে গ্রেট ব্রিটেন, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, তুরস্ক এবং ক্রমান্বয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রেস কাউন্সিল গঠিত হয়েছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, শ্রীলংকা এবং নেপালেও প্রেস কাউন্সিল বিদ্যমান আছে।

বাংলাদেশের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থাগুলোর পেশাগত মানোন্নয়নে লক্ষ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে প্রেস কাউন্সিল গঠন করেন। প্রেস কাউন্সিল অ্যাক্ট ১৯৭৪ এর ২৩নং ধারার বিধান অনুযায়ী সরকার ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বরে প্রেস কাউন্সিল রুলস ১৯৮০ প্রণয়ন করে এবং একই অ্যাক্টের ২৪নং ধারা অনুযায়ী কাউন্সিল প্রেস কাউন্সিল রেগুলেশন ১৯৮০ প্রণয়ন করে।

প্রেস কাউন্সিল অ্যাক্ট ১৯৭৪ এর ৪নং ধারা অনুযায়ী মহামান্য রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের একজন কর্মরত অথবা অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে চেয়ারম্যান হিসেবে ৩ বছরের জন্য নিয়োগ দিয়ে থাকেন। প্রেস কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে সাংবাদিক সমিতি কর্তৃক মনোনীত ৩ জন, সংবাদপত্র মালিক সমিতি কর্তৃক মনোনীত ৩ জন, সংবাদপত্রের সম্পাদক সমিতি কর্তৃক মনোনীত ৩ জন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কর্তৃক মনোনীত ১ জন, বাংলা একাডেমি কর্তৃক মনোনীত ১ জন, বাংলাদেশ বার কাউন্সিল কর্তৃক মনোনীত ১ জন এবং বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ২ জন সম্মানিত সদস্যের সমন্বয়ে কাউন্সিল গঠিত হয়।

বর্তমান সময়ে প্রেস কাউন্সিলের কর্মপরিধি ও অর্জন

জুডিশিয়াল মামলা : প্রেস কাউন্সিল আইন ১৯৭৪ এর ১২নং ধারার বিধান অনুযায়ী কোনো সংবাদপত্র, সংবাদ সংস্থা বা সাংবাদিকতার মান বা জনসাধারণের রুচির বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করলে অথবা কোন সম্পাদক বা কর্মরত সাংবাদিক পেশাগত অসদাচরণ করলে সাংবাদিকতার আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে সেই সব সংবাদপত্র/সংবাদ সংস্থা/ সম্পাদক/সাংবাদিকের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিবর্গ প্রেস কাউন্সিল আইন ১৯৭৪ এর ১২ ধারার বিধান অনুযায়ী প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান সমীপে অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন। দায়েরকৃত অভিযোগের ওপর শুনানি শেষে প্রেস কাউন্সিল আইন ১৯৭৪ এর ১২নং ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে দোষী সাব্যস্ত হলে বিবাদীকে সতর্ক, ভর্ৎসনা ও তিরস্কার করে মামলার রায় প্রদান করা হয় এবং দ্রুত রায় সংশ্লিষ্ট পত্রিকায় প্রকাশ করার নির্দেশ প্রদান করা হয়। এ ব্যাপারে যে কোন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি প্রতিকারের জন্য প্রেস কাউন্সিলে অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলে মামলা নিষ্পত্তির হার অত্যন্ত সন্তোষজনক। এ যাবৎ জুডিশিয়াল মামলার নিষ্পত্তির হার শতকরা ৯৯ ভাগ।

আপিল মামলা : প্রিন্টিং প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স (ডিক্লারেশন অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন) অ্যাক্ট ১৯৭৩ এর সংশোধিত ও সংযোজিত (১৯৯১ সালের ৮নং আইন) ১অ এবং ২অ ধারা অনুযায়ী, প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান কর্তৃক মনোনীত একজন সদস্য এবং সরকারের যুগ্ম সচিব পর্যায়ের নিম্নে নহে এমন একজন কর্মকর্তার সমন্বয়ে প্রেস অ্যাপিলেট বোর্ড গঠিত হয়।

জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক কোনো সংবাদপত্রের ডিক্লারেশন বাতিল করা হলে সংশ্লিষ্ট সংবাদপত্রের ডিক্লারেশন বাতিলের ৬০ দিনের মধ্যে প্রেস অ্যাপিলেট বোর্ডের কাছে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আপিল করতে পারে।

নতুন কোনো সংবাদপত্রের ডিক্লারেশনের জন্য জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আবেদন করা হলে তা যদি ৬০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি না হয়, তাহলে ওই ৬০ দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পরে তদবিরুদ্ধে অথবা দ্রুত ডিক্লারেশন প্রদানের অস্বীকৃতির ৪৫ দিনের মধ্যে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি প্রেস অ্যাপিলেট বোর্ডের কাছে আপিল দায়ের করতে পারেন। এ যাবৎ আপিল মামলার নিষ্পত্তির হার শতকরা ৯৮ ভাগ।

বঙ্গবন্ধু কর্নার স্থাপন : জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী সমগ্র জাতি সোৎসাহে পালন করছে। বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল মুজিববর্ষের রঙে রঞ্জিত হয়ে দেশের প্রেসক্লাবগুলোতে বঙ্গবন্ধু কর্নার স্থাপনের নীতিমালা তৈরি করেছে। নীতিমালা অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু ও মহান মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত পুস্তক ও দলিলাদি বঙ্গবন্ধু কর্নারে সজ্জিত করা হবে। ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধুর জন্মভূমি গোপালগঞ্জে গিয়ে গোপালগঞ্জের প্রেসক্লাবে বঙ্গবন্ধু কর্নার স্থাপনের ঘোষণা প্রদান করেছি। ক্রমশ অন্য প্রেসক্লাবেও তা প্রদান করা হবে। প্রেসক্লাবগুলোতে বঙ্গবন্ধু কর্নার স্থাপনের নীতিমালা গ্রহণ করতে পেরে প্রেস কাউন্সিল গর্বিত অনুভব করছে।

সাংবাদিকদের ডাটাবেস তৈরি : সাংবাদিকদের ডাটাবেস তৈরির কাজ চলমান রয়েছে। কাজটি সম্পন্ন হলে প্রেস কাউন্সিল সাংবাদিকদের জন্য আইডি কার্ড প্রবর্তন করবে। এবিষয়ে কাউন্সিল একটি নীতিমালা প্রণয়ন করেছে।

সাংবাদিকদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা : বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল সাংবাদিকতার সাধারণ নীতিমালা এবং প্রেস কাউন্সিল প্রণীত আচরণবিধির আলোকে কাজ করে। সাংবাদিক সমাজের ব্যাপক অংশকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ ও অধিকতর সচেতন করার কাজটি করে থাকে এ প্রতিষ্ঠান। সেই সঙ্গে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভার আয়োজন করে যাচ্ছে নিয়মিত। ফলে একদিকে যেমন ঢাকার বাইরের সাংবাদিকরা আচরণবিধি ও সাংবাদিকতার নীতিমালা সম্পর্কে ধারণা লাভ করছেন, পাশাপাশি প্রতিটি প্রশিক্ষণ কর্মশালা ও মতবিনিময় সভায় জেলা প্রশাসক অথবা তার প্রতিনিধি এবং পুলিশ সুপার অথবা তার প্রতিনিধির উপস্থিতিতে সাংবাদিকতার স্থানীয় নানা সমস্যা খোলামেলা আলোচনা করে সমাধানের উপায় খুঁজে পাওয়ার প্রচেষ্টা নেয়া হচ্ছে। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যে দেশের অধিকাংশ জেলা শহরে এবং ঢাকায় প্রত্যেক বছর প্রশিক্ষণ কর্মশালায় গণমাধ্যম ছাড়াও যেকোনো জনগুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত করে আসছে। ২০১৯ সালে প্রেস কাউন্সিলের উদ্যোগে ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, চট্টগ্রাম, গোপালগঞ্জ জেলায় এবং খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলায় কর্মরত সাংবাদিকদের অংশগ্রহণে সাংবাদিকতার নীতিমালা, বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন ও তথ্য অধিকার আইন অবহিতকরণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত প্রশিক্ষণ কর্মশালাগুলোতে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের ৩৪৪ সাংবাদিক অংশগ্রহণ করেন।

এছাড়া বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের সঙ্গে ঢাকায় ২০টি সাংবাদিক সংগঠন এবং নেত্রকোনা, সাতক্ষীরা, গোপালগঞ্জ ও কুমিল্লা জেলাসহ কর্মরত সাংবাদিকদের নিয়ে প্রেস কাউন্সিল প্রণীত আচরণবিধি ও প্রেস কাউন্সিল আইন ১৯৭৪ বিষয়ে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত মতবিনিময় সভাগুলোয় বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের প্রায় ৩৮৩ সাংবাদিক অংশগ্রহণ করেন।

সাংবাদিকদের জন্য প্রেস কাউন্সিল পদক প্রবর্তন: বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে আরও সুনির্দিষ্ট ও দৃশ্যমান করার জন্য ২০১৮ সাল থেকে সাংবাদিকতায় প্রেস কাউন্সিল পদক, একজন সাংবাদিক ব্যক্তিত্বকে পদক প্রদানের উদ্যোগ নিয়েছে। গ্রামীণ সাংবাদিকতা, উন্নয়ন সাংবাদিকতা, নারী সাংবাদিক এবং আলোকচিত্র/ভিডিওচিত্র এ চার ক্যাটাগরিতে দেয়া হচ্ছে পদক। যে সংবাদপত্র ঐতিহ্যবাহী এবং দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে মানুষের পাশে থেকেছে সেই সাংবাদপত্রকে দেয়া হচ্ছে বিশেষ সম্মাননা। সংবাদপত্রে অসামান্য অবদানের জন্য একজন সাংবাদিককে দেয়া হচ্ছে আজীবন সম্মাননা। স্থানীয় সংবাদপত্রের ভূমিকার স্বীকৃতি প্রদানের জন্য আঞ্চলিক সংবাদপত্র ক্যাটাগরিতে আরও একটি সম্মাননা পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে। সংবাদমাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নকে সুদৃঢ় করার জন্য নারী সাংবাদিকদের জন্য পৃথকভাবে পদকের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল দিবস উদযাপন অনুষ্ঠানে এ পদক প্রদান করা হয়। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ২০১৮ ও ২০১৯ সালের পদক প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করে পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিকদের মধ্যে অ্যাওয়ার্ড প্রদান করেন।

আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি : বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল তার কর্মপ্রয়াসকে আন্তর্জাতিক বিশ্বে তুলে ধরার লক্ষ্যেও কাজ করে যাচ্ছে। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল ভারতের প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া ও প্রেস কাউন্সিল নেপালের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (গঙট) স্বাক্ষর করেছে এবং তা বাস্তবায়নের জন্য কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। শ্রীলংকা প্রেস কাউন্সিলের সংগেও আরেকটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। হচ্ছে। এছাড়া ওয়ার্ল্ড অ্যাসোসিয়েশন অব প্রেস কাউন্সিলসের (ডঅচঈ) নির্বাহী সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের কার্যক্রম বিশ্বের কাছে তুলে ধরছে। পাশাপাশি সার্কভুক্ত দেশের প্রেস কাউন্সিলের মধ্যে একটি জোট গঠনের প্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে।

এভাবেই ৪৬ বছর ধরে বঙ্গবন্ধু স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল বিভিন্ন কর্মপ্রয়াসের মধ্য দিয়ে দেশে সংবাদপত্র শিল্পের গুণগত উন্নয়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে চলেছে। আর বর্তমান সরকার বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক্ষেত্রে বাড়িয়ে দিয়েছেন সহযোগিতার হাত। আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ। তার সরকার সংবাদিকবান্ধব সরকার। নবম ওয়েজবোর্ড গঠন, সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন, দেশের প্রেসক্লাবের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ইত্যাদি কর্মকা-ের মধ্য দিয়ে বর্তমান সরকার তার সাংবাদিকবান্ধব ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছে। বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল একদিকে মানুষের মতপ্রকাশের মৌলিক অধিকারকে নিয়মনীতির মধ্য দিয়ে সমুন্নত রাখছে, নিরপেক্ষ বিচারিক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে বস্তুনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ তথ্যপ্রবাহকে গতিশীল রাখছে। অন্যদিকে বিভিন্ন দেশের সংগে সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমবিষয়ক বিভিন্ন সেমিনারে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের সাংবাদিকতা পেশার ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তোলার প্রয়াস অব্যাহত রেখেছে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে যখন দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রশিক্ষণ ও মতবিনিময় অনুষ্ঠানের আয়োজন হয় তখন আমরা নির্ধারিত কর্মসূচির বাইরে তুলে ধরি সরকারের সাফল্য চিত্র। সেই সঙ্গে এই সাফল্য ধরে রাখতে তুলে ধরি সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের দায়িত্বের কথা। অর্থাৎ উন্নয়নের সপক্ষে জনমত সৃষ্টিতেও আমরা কাজ করে যাচ্ছি। সাংবাদিকতা পেশার উন্নয়ন ও কল্যাণে নতুন উদ্যোগ নেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়েছে আমাদের পক্ষ থেকে। আমি জানাতে চাই, আমরা ইতোমধ্যে এ দুটি পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করেছি। বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলে কোনো দুর্নীতি নেই।

আমরা মুজিববর্ষকে কেন্দ্র করে সাংবাদিকদের কল্যাণে আমাদের যাবতীয় কর্ম প্রয়াস চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করছি।

[লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল]

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল : বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রূপরেখা

বিচারপতি মোহাম্মদ মমতাজ উদ্দিন আহমেদ

শুক্রবার, ১৪ আগস্ট ২০২০

http://thesangbad.net/images/2020/August/14Aug20/news/sangbad_bangla_1597416369.jpg

এবারে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল দিবস পালিত হচ্ছে মুজিববর্ষের মহাক্ষণে। এ মহান নেতার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের প্রধান পাথেয় ছিল তার গভীর দেশপ্রেম। মানুষের প্রতি ছিল তার অসীম ভালোবাসা। তিনি বাঙালি জাতিকে শুধু স্বপ্ন দেখিয়ে ক্ষান্ত হননি, এ দেশের জনমানুষের স্বপ্নকে তিনি বাস্তবে রূপদান করেছিলেন। তারই নেতৃত্বে ও আহ্বানে এ দেশের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল স্বাধীনতার লড়াইয়ে। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির প্রতি, তার অবদান ও আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে এবারে পালিত হচ্ছে প্রেস কাউন্সিল দিবস।

সংবাদপত্র হচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রের আয়না। সংবাদপত্রের মাধ্যমে জনগণকে শিক্ষাদান, মৌলিক অধিকার রক্ষা ও বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীকে কাজে উৎসাহিত করা এবং সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করা- এই ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্দেশ্য। কিন্তু তিনি তা দেখে যেতে পারেননি। তার সুযোগ্যকন্যা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বিশ্বনেতা এবং বাংলাদেশের গৌরব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে আজ তার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণে দেশের সব ক্ষেত্রে উন্নয়নসহ গণমাধ্যমের কাক্সিক্ষত উন্নয়ন হয়েছে। এ সাফল্যের অংশীদার দেশের সব সাংবাদিক ও গণমাধ্যম পেশার মানুষ।

বঙ্গবন্ধু বাঙ্গালি জাতির আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। পাশাপাশি তিনি একসময় যুক্ত ছিলেন সাংবাদিকতার সঙ্গে। এই পেশার সমস্যা, সংকট উত্তরণের প্রয়াস সম্পর্কে বিস্তারিত জানা ছিল তার। তাই স্বাধীনতা লাভের পর দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি এ পেশার উন্নয়নের প্রতি দৃষ্টি দেন। তিনি বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষা ও মান উন্নয়নের উদ্দেশ্যে প্রেস কাউন্সিল আইন প্রণয়ন করেন। জাতির পিতার নেতৃত্বে গঠিত সরকারের আমলে প্রণীত এ আইনটি ১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৪ তারিখে গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়।

এবারে আমাদের সবারই সব কার্যক্রম মুজিববর্ষকে কেন্দ্র করে। তাই আমাদের ফিরে দেখতে হয় তার সংগ্রামী রাজনৈতিক জীবনের দিকে। যার পরতে পরতে রয়েছে তার গভীর ভালোবাসা বাঙালি জাতির প্রতি।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের পর পাকিস্তান ও ভারত এই দুই রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান নামে যে রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছিল, সেখানে/তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক অধিকার ছিল উপেক্ষিত। সেই সঙ্গে ছিল না স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার। শুরু থেকে এ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করে আসছিলেন বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তান দীর্ঘদিন সামরিক শাসনের অধীনে ছিল। যেখানে স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার ছিল নিয়ন্ত্রিত। তিনি এটি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন। তাই স্বাধীনতা লাভের পরপরই তিনি প্রেস কাউন্সিল গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এবং তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন।

১৯৪৭ সালের পর যে শাসন ব্যবস্থার অধীনে আমরা ছিলাম, তা ছিল স্বৈরাচারী। এ শাসন ব্যবস্থায় তৎকালীন গণমাধ্যম সম্পর্কিত আইনেও সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার ওপর সামরিক শাসক ও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের খড়গ নেমে আসে। ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান ‘প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন অর্ডিন্যান্স ১৯৬২’ জারি করেন। এ অর্ডিন্যান্সের ক্ষমতাবলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সংবাদপত্র বাজেয়াপ্তকরণ, সংবাদ সংস্থাকে বন্ধ এবং সাংবাদিকদের অধিকার হরণ করতে পারত। এই অর্ডিন্যান্স ব্যবহার করে আইয়ুব খান সংবাদপত্রের বেশির ভাগ অংশ জাতীয়করণ করাসহ দুটি বৃহৎ সংবাদ সংস্থাকে সরকার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। বেতার ও টেলিভিশনকেও সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়।

১৯৫৬ সালে পাকিস্তান ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের যে সংবিধান প্রণীত হয় সেখানে বাকস্বাধীনতা সম্পর্কিত একটি আলাদা অনুচ্ছেদ সন্নিবেশিত করা হয়। ১৯৫৬ সালের সংবিধানের অস্তিত্ব ৩ বছরেরও কম সময় থাকে। ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে এই সংবিধান স্থগিত করা হয়। ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান কর্তৃক সামরিক শাসনের অবসানের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণীত হয়। যদিও এ সংবিধানে বাক স্বাধীনতার প্রাথমিক ধারণার স্বীকৃতিকে অন্তর্ভুক্ত রাখলেও প্রকৃতপক্ষে একজন সামরিক শাসক কর্তৃক প্রণীত সংবিধানে আলাদাভাবে মৌলিক অধিকার সম্পর্কিত কোন অধ্যায় রাখা হয়নি।

১৯৬২ সালে প্রণীত প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন অর্ডিন্যান্স অত্যন্ত কঠোরভাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের প্রগতিশীল উন্নয়ন ব্যবস্থাকে খর্ব করা হয়। এ অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খান কর্তৃক জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে ক্ষমতা হস্তান্তর পর্যন্ত শাসন ব্যবস্থাকে প্রলম্বিত করে। ১৯৬৯ সালে জেনারেল ইয়াহিয়া আবারও সামরিক শাসন জারি করেন এবং ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন। পাকিস্তান সরকারে এ পদক্ষেপগুলোর বিরুদ্ধে বরাবরই প্রতিবাদ করে আসছিলেন বঙ্গবন্ধু।

১৯৭০ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে পড়ে তৎকালীন সরকার। আর তাই ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে গড়িমসি শুরু করে তারা। অনিবার্যভাবে শুরু হয় স্বাধীনতার প্রস্তুতি। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে, বিশেষ করে ৭ মার্চের ভাষণের পর, ২৫ মার্চের কালরাতে আক্রান্ত হওয়ার মুহূর্ত থেকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালিরা। ত্রিশ লাখ শহীদ, অগণিত মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা অর্জন করি এ স্বাধীনতা। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু সরকারের জন্য দেশ পুনর্গঠনের এক চ্যালেঞ্জ সামনে আসে। বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে শুরু হয় বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে উঁচু করার প্রচেষ্টা। এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু শেখ। মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষা ও মানোন্নয়নের উদ্দেশ্যে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল আইন প্রণয়ন করেন।

বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম এখন পুরোপুরি স্বাধীন। বর্তমান সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানা তৃতীয়বারের মতো দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। প্রতিবারই দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি সমাজের সর্বস্তরে ন্যায়বিচার, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, একটি গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণ করার উদ্যোগ নেন। এর মধ্যে অন্যতম সাংবাদিকদের জীবনমান উন্নয়ন। গণমাধ্যমকে পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদানে তিনি একনিষ্ঠ। তার বলিষ্ঠ নির্দেশনার প্রেক্ষিতে বর্তমানে এদেশের গণমাধ্যম শতভাগ স্বাধীনতা ভোগ করছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন মেয়াদে সংবাদপত্র ও অন্যান্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। সাংবাদিকদের কল্যাণে সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করেছে, সাংবাদিকদের জীবন-জীবিকার উন্নয়নের জন্য নবম ওয়েজবোর্ড গঠন ও গণমাধ্যমকর্মীদের পেশাগত নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। দেশের বিভিন্ন প্রেসক্লাবগুলোকে আধুনিকায়ন করে তোলার জন্য আর্থিক অনুদান দেয়া হচ্ছে। জাতীয় প্রেস ক্লাবে গড়ে তোলা হচ্ছে ৩১ তলা বিশিষ্ট বঙ্গবন্ধু মিডিয়া সেন্টার। যেখানে সাংবাদিকরা পাবে পেশাগত সবধরণের সুযোগ। সংবাপত্র ছাড়াও ৩৩টি টেলিভিশন, ১৬টি এফএম রেডিও, ১৭টি কমিউনিটি রেডিও, অসংখ্য অনলাইন সংবাদপত্র, অনলাইন নিউজ পোর্টাল তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। দেশের গণমাধ্যম এখন পূর্ণস্বাধীন। বর্তমান সরকার গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে পূর্বের তুলনায় অধিকতর শক্তিশালী ও গতিশীল করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

দেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা পেশাকে নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ, জবাবদিহিতামূলক করার লক্ষ্য নিয়ে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সুদৃঢ় করার প্রত্যয় নিয়ে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের পথ চলা শুরু হয় আজ থেকে ৪৬ বছর আগে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থাগুলোর পেশাগত মান সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে বর্তমান বিশ্বে প্রেস কাউন্সিলের ধারণা একটি নতুন সংযোজন। এর ভূমিকাও বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। পৃথিবীর উন্নত ও উন্নয়নশীল প্রায় প্রতিটি দেশেই অধুনা প্রেস কাউন্সিল বা ভিন্ন নামে অনুরূপ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।

মূলত সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সংরক্ষণ এবং স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার লক্ষ্যে ১৯১৬ সালে সুইডেন ‘প্রেস ফেয়ার কমিশন গঠনের মাধ্যমে একটি প্রেস কোর্ট অব অনার সর্বপ্রথম গঠন করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে গ্রেট ব্রিটেন, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, তুরস্ক এবং ক্রমান্বয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রেস কাউন্সিল গঠিত হয়েছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, শ্রীলংকা এবং নেপালেও প্রেস কাউন্সিল বিদ্যমান আছে।

বাংলাদেশের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থাগুলোর পেশাগত মানোন্নয়নে লক্ষ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে প্রেস কাউন্সিল গঠন করেন। প্রেস কাউন্সিল অ্যাক্ট ১৯৭৪ এর ২৩নং ধারার বিধান অনুযায়ী সরকার ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বরে প্রেস কাউন্সিল রুলস ১৯৮০ প্রণয়ন করে এবং একই অ্যাক্টের ২৪নং ধারা অনুযায়ী কাউন্সিল প্রেস কাউন্সিল রেগুলেশন ১৯৮০ প্রণয়ন করে।

প্রেস কাউন্সিল অ্যাক্ট ১৯৭৪ এর ৪নং ধারা অনুযায়ী মহামান্য রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের একজন কর্মরত অথবা অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে চেয়ারম্যান হিসেবে ৩ বছরের জন্য নিয়োগ দিয়ে থাকেন। প্রেস কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে সাংবাদিক সমিতি কর্তৃক মনোনীত ৩ জন, সংবাদপত্র মালিক সমিতি কর্তৃক মনোনীত ৩ জন, সংবাদপত্রের সম্পাদক সমিতি কর্তৃক মনোনীত ৩ জন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কর্তৃক মনোনীত ১ জন, বাংলা একাডেমি কর্তৃক মনোনীত ১ জন, বাংলাদেশ বার কাউন্সিল কর্তৃক মনোনীত ১ জন এবং বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ২ জন সম্মানিত সদস্যের সমন্বয়ে কাউন্সিল গঠিত হয়।

বর্তমান সময়ে প্রেস কাউন্সিলের কর্মপরিধি ও অর্জন

জুডিশিয়াল মামলা : প্রেস কাউন্সিল আইন ১৯৭৪ এর ১২নং ধারার বিধান অনুযায়ী কোনো সংবাদপত্র, সংবাদ সংস্থা বা সাংবাদিকতার মান বা জনসাধারণের রুচির বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করলে অথবা কোন সম্পাদক বা কর্মরত সাংবাদিক পেশাগত অসদাচরণ করলে সাংবাদিকতার আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে সেই সব সংবাদপত্র/সংবাদ সংস্থা/ সম্পাদক/সাংবাদিকের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিবর্গ প্রেস কাউন্সিল আইন ১৯৭৪ এর ১২ ধারার বিধান অনুযায়ী প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান সমীপে অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন। দায়েরকৃত অভিযোগের ওপর শুনানি শেষে প্রেস কাউন্সিল আইন ১৯৭৪ এর ১২নং ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে দোষী সাব্যস্ত হলে বিবাদীকে সতর্ক, ভর্ৎসনা ও তিরস্কার করে মামলার রায় প্রদান করা হয় এবং দ্রুত রায় সংশ্লিষ্ট পত্রিকায় প্রকাশ করার নির্দেশ প্রদান করা হয়। এ ব্যাপারে যে কোন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি প্রতিকারের জন্য প্রেস কাউন্সিলে অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলে মামলা নিষ্পত্তির হার অত্যন্ত সন্তোষজনক। এ যাবৎ জুডিশিয়াল মামলার নিষ্পত্তির হার শতকরা ৯৯ ভাগ।

আপিল মামলা : প্রিন্টিং প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স (ডিক্লারেশন অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন) অ্যাক্ট ১৯৭৩ এর সংশোধিত ও সংযোজিত (১৯৯১ সালের ৮নং আইন) ১অ এবং ২অ ধারা অনুযায়ী, প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান কর্তৃক মনোনীত একজন সদস্য এবং সরকারের যুগ্ম সচিব পর্যায়ের নিম্নে নহে এমন একজন কর্মকর্তার সমন্বয়ে প্রেস অ্যাপিলেট বোর্ড গঠিত হয়।

জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক কোনো সংবাদপত্রের ডিক্লারেশন বাতিল করা হলে সংশ্লিষ্ট সংবাদপত্রের ডিক্লারেশন বাতিলের ৬০ দিনের মধ্যে প্রেস অ্যাপিলেট বোর্ডের কাছে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আপিল করতে পারে।

নতুন কোনো সংবাদপত্রের ডিক্লারেশনের জন্য জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আবেদন করা হলে তা যদি ৬০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি না হয়, তাহলে ওই ৬০ দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পরে তদবিরুদ্ধে অথবা দ্রুত ডিক্লারেশন প্রদানের অস্বীকৃতির ৪৫ দিনের মধ্যে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি প্রেস অ্যাপিলেট বোর্ডের কাছে আপিল দায়ের করতে পারেন। এ যাবৎ আপিল মামলার নিষ্পত্তির হার শতকরা ৯৮ ভাগ।

বঙ্গবন্ধু কর্নার স্থাপন : জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী সমগ্র জাতি সোৎসাহে পালন করছে। বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল মুজিববর্ষের রঙে রঞ্জিত হয়ে দেশের প্রেসক্লাবগুলোতে বঙ্গবন্ধু কর্নার স্থাপনের নীতিমালা তৈরি করেছে। নীতিমালা অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু ও মহান মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত পুস্তক ও দলিলাদি বঙ্গবন্ধু কর্নারে সজ্জিত করা হবে। ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধুর জন্মভূমি গোপালগঞ্জে গিয়ে গোপালগঞ্জের প্রেসক্লাবে বঙ্গবন্ধু কর্নার স্থাপনের ঘোষণা প্রদান করেছি। ক্রমশ অন্য প্রেসক্লাবেও তা প্রদান করা হবে। প্রেসক্লাবগুলোতে বঙ্গবন্ধু কর্নার স্থাপনের নীতিমালা গ্রহণ করতে পেরে প্রেস কাউন্সিল গর্বিত অনুভব করছে।

সাংবাদিকদের ডাটাবেস তৈরি : সাংবাদিকদের ডাটাবেস তৈরির কাজ চলমান রয়েছে। কাজটি সম্পন্ন হলে প্রেস কাউন্সিল সাংবাদিকদের জন্য আইডি কার্ড প্রবর্তন করবে। এবিষয়ে কাউন্সিল একটি নীতিমালা প্রণয়ন করেছে।

সাংবাদিকদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা : বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল সাংবাদিকতার সাধারণ নীতিমালা এবং প্রেস কাউন্সিল প্রণীত আচরণবিধির আলোকে কাজ করে। সাংবাদিক সমাজের ব্যাপক অংশকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ ও অধিকতর সচেতন করার কাজটি করে থাকে এ প্রতিষ্ঠান। সেই সঙ্গে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভার আয়োজন করে যাচ্ছে নিয়মিত। ফলে একদিকে যেমন ঢাকার বাইরের সাংবাদিকরা আচরণবিধি ও সাংবাদিকতার নীতিমালা সম্পর্কে ধারণা লাভ করছেন, পাশাপাশি প্রতিটি প্রশিক্ষণ কর্মশালা ও মতবিনিময় সভায় জেলা প্রশাসক অথবা তার প্রতিনিধি এবং পুলিশ সুপার অথবা তার প্রতিনিধির উপস্থিতিতে সাংবাদিকতার স্থানীয় নানা সমস্যা খোলামেলা আলোচনা করে সমাধানের উপায় খুঁজে পাওয়ার প্রচেষ্টা নেয়া হচ্ছে। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যে দেশের অধিকাংশ জেলা শহরে এবং ঢাকায় প্রত্যেক বছর প্রশিক্ষণ কর্মশালায় গণমাধ্যম ছাড়াও যেকোনো জনগুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত করে আসছে। ২০১৯ সালে প্রেস কাউন্সিলের উদ্যোগে ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, চট্টগ্রাম, গোপালগঞ্জ জেলায় এবং খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলায় কর্মরত সাংবাদিকদের অংশগ্রহণে সাংবাদিকতার নীতিমালা, বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন ও তথ্য অধিকার আইন অবহিতকরণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত প্রশিক্ষণ কর্মশালাগুলোতে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের ৩৪৪ সাংবাদিক অংশগ্রহণ করেন।

এছাড়া বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের সঙ্গে ঢাকায় ২০টি সাংবাদিক সংগঠন এবং নেত্রকোনা, সাতক্ষীরা, গোপালগঞ্জ ও কুমিল্লা জেলাসহ কর্মরত সাংবাদিকদের নিয়ে প্রেস কাউন্সিল প্রণীত আচরণবিধি ও প্রেস কাউন্সিল আইন ১৯৭৪ বিষয়ে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত মতবিনিময় সভাগুলোয় বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের প্রায় ৩৮৩ সাংবাদিক অংশগ্রহণ করেন।

সাংবাদিকদের জন্য প্রেস কাউন্সিল পদক প্রবর্তন: বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে আরও সুনির্দিষ্ট ও দৃশ্যমান করার জন্য ২০১৮ সাল থেকে সাংবাদিকতায় প্রেস কাউন্সিল পদক, একজন সাংবাদিক ব্যক্তিত্বকে পদক প্রদানের উদ্যোগ নিয়েছে। গ্রামীণ সাংবাদিকতা, উন্নয়ন সাংবাদিকতা, নারী সাংবাদিক এবং আলোকচিত্র/ভিডিওচিত্র এ চার ক্যাটাগরিতে দেয়া হচ্ছে পদক। যে সংবাদপত্র ঐতিহ্যবাহী এবং দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে মানুষের পাশে থেকেছে সেই সাংবাদপত্রকে দেয়া হচ্ছে বিশেষ সম্মাননা। সংবাদপত্রে অসামান্য অবদানের জন্য একজন সাংবাদিককে দেয়া হচ্ছে আজীবন সম্মাননা। স্থানীয় সংবাদপত্রের ভূমিকার স্বীকৃতি প্রদানের জন্য আঞ্চলিক সংবাদপত্র ক্যাটাগরিতে আরও একটি সম্মাননা পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে। সংবাদমাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নকে সুদৃঢ় করার জন্য নারী সাংবাদিকদের জন্য পৃথকভাবে পদকের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল দিবস উদযাপন অনুষ্ঠানে এ পদক প্রদান করা হয়। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ২০১৮ ও ২০১৯ সালের পদক প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করে পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিকদের মধ্যে অ্যাওয়ার্ড প্রদান করেন।

আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি : বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল তার কর্মপ্রয়াসকে আন্তর্জাতিক বিশ্বে তুলে ধরার লক্ষ্যেও কাজ করে যাচ্ছে। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল ভারতের প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া ও প্রেস কাউন্সিল নেপালের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (গঙট) স্বাক্ষর করেছে এবং তা বাস্তবায়নের জন্য কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। শ্রীলংকা প্রেস কাউন্সিলের সংগেও আরেকটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। হচ্ছে। এছাড়া ওয়ার্ল্ড অ্যাসোসিয়েশন অব প্রেস কাউন্সিলসের (ডঅচঈ) নির্বাহী সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের কার্যক্রম বিশ্বের কাছে তুলে ধরছে। পাশাপাশি সার্কভুক্ত দেশের প্রেস কাউন্সিলের মধ্যে একটি জোট গঠনের প্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে।

এভাবেই ৪৬ বছর ধরে বঙ্গবন্ধু স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল বিভিন্ন কর্মপ্রয়াসের মধ্য দিয়ে দেশে সংবাদপত্র শিল্পের গুণগত উন্নয়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে চলেছে। আর বর্তমান সরকার বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক্ষেত্রে বাড়িয়ে দিয়েছেন সহযোগিতার হাত। আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ। তার সরকার সংবাদিকবান্ধব সরকার। নবম ওয়েজবোর্ড গঠন, সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন, দেশের প্রেসক্লাবের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ইত্যাদি কর্মকা-ের মধ্য দিয়ে বর্তমান সরকার তার সাংবাদিকবান্ধব ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছে। বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল একদিকে মানুষের মতপ্রকাশের মৌলিক অধিকারকে নিয়মনীতির মধ্য দিয়ে সমুন্নত রাখছে, নিরপেক্ষ বিচারিক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে বস্তুনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ তথ্যপ্রবাহকে গতিশীল রাখছে। অন্যদিকে বিভিন্ন দেশের সংগে সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমবিষয়ক বিভিন্ন সেমিনারে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের সাংবাদিকতা পেশার ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তোলার প্রয়াস অব্যাহত রেখেছে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে যখন দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রশিক্ষণ ও মতবিনিময় অনুষ্ঠানের আয়োজন হয় তখন আমরা নির্ধারিত কর্মসূচির বাইরে তুলে ধরি সরকারের সাফল্য চিত্র। সেই সঙ্গে এই সাফল্য ধরে রাখতে তুলে ধরি সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের দায়িত্বের কথা। অর্থাৎ উন্নয়নের সপক্ষে জনমত সৃষ্টিতেও আমরা কাজ করে যাচ্ছি। সাংবাদিকতা পেশার উন্নয়ন ও কল্যাণে নতুন উদ্যোগ নেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়েছে আমাদের পক্ষ থেকে। আমি জানাতে চাই, আমরা ইতোমধ্যে এ দুটি পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করেছি। বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলে কোনো দুর্নীতি নেই।

আমরা মুজিববর্ষকে কেন্দ্র করে সাংবাদিকদের কল্যাণে আমাদের যাবতীয় কর্ম প্রয়াস চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করছি।

[লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল]

back to top