alt

সাময়িকী

দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড-এর কবি এলিয়ট

মামুন মুস্তাফা

: বৃহস্পতিবার, ০২ জানুয়ারী ২০২৫

টি. এস. এলিয়ট / জন্ম: ২৬ সেপ্টেম্বর ১৮৮৮; মৃত্যু: ০৪ জানুয়ারি ১৯৬৫

ইংরেজ কবি টি. এস. এলিয়টের প্রথম কবিতা প্রকাশিত হলো ১৯১৫ সালে পাউন্ডের ক্যাথলিক অ্যান্থলজিতে এবং তাঁর প্রথম কাব্য-সংকলন প্রকাশ পায় ১৯১৭ সালে। বিংশ শতাব্দীর সাহিত্যের ইতিহাসে এ দুটি বিষয় যুগান্তকারী ঘটনা। কেননা ডেকাডেন্টদের মতো কিংবা ইয়েট্স-এর মতো এলিয়ট জীবন থেকে পলায়ন করলেন না বরং বর্তমানের মুখোমুখি দাঁড়ালেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা তখন আগ্রাসী রূপ লাভ না করলেও, সমাজে অবিশ্বাস যে দানা বাঁধছে, শতাব্দী-সংক্রান্তির অস্থিরতা, পুঁজিবাদের উত্থান, নানামুখী রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য এলিয়টের কবিতায় অবলীলায় স্থান করে নেয়। ফলে আবেগ ও অনুভূতির বিপরীতে এ-সবের ভিতরে মানুষের নিরাসক্ত ও নৈর্ব্যক্তিক দিক এলিয়টের কবিতায় ধরা পড়লো। এই প্রথম শহরের ও আধুনিক যন্ত্রযুগের রূপ ইংরেজি কাব্যে ফুটে উঠলো। আধুনিক শহরের মানুষ যে একান্তভাবে নিঃসঙ্গ সেই চরম সত্যটিকে এলিয়ট ধাতব কঠিন মূর্ত চিত্রকল্পের ভিতরে আবিষ্কার করেন। বোদলেয়ার আমাদেরকে শহুরে চিত্রকল্পের ব্যবহারে মোহিত করেছেন। কিন্তু এলিয়ট তাকে নিয়ে গেলেন মানুষের যাপিত জীবনের অন্দরমহলেÑ কানাগলিতে বেড়াল, এক রাত্রির সস্তায় হোটেল, তার মাংস রান্নার গন্ধÑ এসব নিয়ে যে শহর, তা এবার সাহিত্যের বিষয় হয়ে উঠলো।

বিষয়বস্তুর অভিনবত্ব এবং যুগ সম্বন্ধে এলিয়টের কঠিন শ্লেষ ভিন্ন এ-যুগের কবিতায় আরো কয়েকটি নতুন লক্ষণ দেখা যায়, যেমনÑ অসম্বন্ধতা, পরস্পরবিরোধী রসের অবতারণা, কাব্যে নাটকীয় সংলাপের ভঙ্গি প্রয়োগ, গদ্যগন্ধী শব্দের ব্যবহার, চমকপ্রদ উদ্ধৃতি ইত্যাদি। মালার্মের ব্যক্তিগত প্রতীক ব্যবহারের পরিবর্তে এলিয়টের প্রতীক অনেক বেশি নৈর্ব্যক্তিক। মূলত লাফর্গ-এর মতো প্রতীকী কবি ও ডান-এর প্রভাব এলিয়টের কবিতায় লক্ষণীয়। আর এ-সবের মাধ্যমেই বিশ্বব্যাপী আধুনিক কবিতার খোলনলচে তাই পাল্টে গেলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে সৃষ্ট মহা অর্থনৈতিক মন্দা, বেকারত্ব, মানুষে মানুষে অবিশ্বাস, অসহায়ত্বকে পুঁজি করে যখন এলিয়ট রচনা করলেন ১৯২২ সালে দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড বা ‘পোড়ো জমি’। ১৯১৪ সালে ভিক্টোরীয় যুগের টলমল প্রাসাদ একেবারে ধূলিসাৎ হলো। ১৯২২ সালে দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড কাব্যে এলিয়ট সেই সার্বিক ধবংসস্তূপের চিত্র আঁকলেন। দান্তের স্বর্গযাত্রার পথে নরকে প্রবেশের মতো কবি এলিয়টও নতুন বিশ্বাসে উজ্জীবিত হয়ে সার্বিক মানবতাকে পুনর্জাগরণের আশা নিয়ে ‘পোড়োজমি’তে প্রবেশ করলেন।

বিশ শতকের যুদ্ধোত্তর যুগে ব্যক্তি ও সমাজকে ঘিরে যে অবক্ষয়, বিনষ্টি, সংঘাত ও বিপর্যয়, সেখানেও অস্তিত্ববাদী দর্শন প্রধান হয়ে উঠেছে বিধায় বিশ্বসাহিত্যে এই তত্ত্বের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। ফলে অস্তিত্ববাদকে ঘিরে সময় রাজনীতি ও সমাজনীতির জটিলতা প্রকাশ পেয়েছে পাশ্চাত্য কবিদের রচনায়। আর এক্ষেত্রে টিএস এলিয়টের কবিতায় অস্তিত্ববাদী চেতনার নিরিখে শূন্যতা হাতাশা নিঃসঙ্গতার শিল্পবোধই প্রধানত রূপায়িত হতে দেখি। সময় ও সমাজ বাস্তবতায় ব্যক্তি ও সমাজের বহির্বাস্তব ব্যবচ্ছেদ আধুনিক কবিদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি বলে তার কাছে মনোগহনের পরিচয় গ্রহণই শুধু নয় সেই সঙ্গে মনোগহনের ব্যবচ্ছেদও কাম্য, কাম্য চেতন থেকে অচেতন অন্তর্লোকের রহস্য সন্ধান, তার প্রকৃতি সম্পর্কে পূর্ণজ্ঞান অর্জন। আর এসবই প্রতিভাত হয়েছে দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ডের কাব্যপটভূমিতে।

আধুনিক সমাজ ও জীবন ব্যবস্থায় যে নৈরাশ্য, অবক্ষয়, নিঃসঙ্গতা আবার এসবের ভিতরে যে উর্বরতা, নিরাময়তার জন্য আকাক্সক্ষাÑ এই বিষয়গুলো দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড-এ বর্ণনা করতে গিয়ে কবি টিএস এলিয়ট পুরাণ ও মিথের ব্যবহারে অনেক উদ্ধৃতি দিয়েছেন, অনেক কবির কবিতার নাম-ধাম, বিষয়প্রকরণকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই মিস ওয়েস্টন বর্ণিত গ্রেল উপকথার মূল প্রতিপাদ্য অমিত অত্যাচারে ধীবররাজের পুরুষত্বহানি এবং এর ফলে তার রাজ্যে যে অনুর্বরতার অভিশাপ নামে, সে বিষয়টি এলিয়ট তার দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড কাব্যে উর্বরতার রহস্য আবিষ্কারের অনুঘটক হিসেবে দেখিয়েছে বটে, কিন্তু পশ্চাতে সমাজের আধ্যাত্মিক অবক্ষয় বোঝাবার জন্য কবি এটি ব্যবহার করেছেন। এ কাব্যের শেষে যদিও আমরা বারংবার বর্ষণের উল্লেখ দেখতে পাই, কিন্তু তাকে নামতে দেখি না। বুদ্ধবচন, অগস্টাইনের উক্তি এবং উপনিষদের মন্ত্রে শুধু একটা আশার আভাস আমরা পাই। হয়তো অহংকে উৎসর্গ করলে বর্ষণ নামবে, ‘পোড়োজমি’তে ফলবে আধ্যাত্মিক সঙ্গতির সোনালি ফসল।

দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড-এর বিশেষত্ব এখানেইÑ একটি ভাল চলচ্চিত্র যেমন দৃষ্ট চিত্রকল্প ও শ্র“ত চিত্রকল্পের মিলন ঘটায়, কাব্য ও চিত্রের মেলবন্ধন করে, এলিয়টও এই কবিতায় তাই করেছেন। আধুনিক নাগরিক জীবনের বিচিত্র অভিঘাত বর্ণনায় একটি ধর্মচক্র, বোদলেয়ার বা ট্যাসিটাস থেকে উদ্ধৃতি, শহুরে টাইপিস্টের প্রণয়লীলার কিছু আভাস, ধুলোমাখা লন্ডনের সড়কপথের কিছু বিবরণ, বিশ শতকের খ-, ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত জীবন কয়েকটি ছড়ানো চিত্রকল্পে উদ্ভাসিত হয়েছে এই কাব্যে। বিশ শতকের ক্লান্তিকর যাপিত জীবনের নানা অনুষঙ্গে ঠাঁই করে নিয়েছে স্মৃতি ও বর্ণনা, চেতন ও অবচেতন, বর্তমান ও অতীত; আর এসবের মধ্যে অবিরত ও অতি দ্রুত চলেছে যাতায়াত।

দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড কেন এত বিখ্যাত? কবিতার আধুনিকতায় তার বিশেষত্ব কি শুধুই শহুরে আধুনিক জীবনের নিরাসক্তি, নৈর্ব্যক্তিকতা আর নিঃসঙ্গতার ভিতরে? বিজ্ঞান মানুষকে নানা বিষয়ে জ্ঞানের ভা-ারী করেছে বটে, কিন্তু প্রজ্ঞা দেয়নি। তাকে উপলব্ধি করে দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড-এ কবি এলিয়ট বিশ শতকের মানুষের দিনলিপির ভিতরে আবিষ্কার করেন আত্মজীবনী, প্রতœতত্ত্ব, পুরাণ ও ধর্মের কোলাজ। ফলে নৃতত্ত্ব ও ঐতিহ্যকে স্বীকার করে এলিয়ট ‘পোড়ো জমি’তে দেখতে পান প্রকৃতির জন্ম, মৃত্যু ও পুনর্জন্মের ছন্দ। তবে এলিয়টের কাছে ঐতিহ্য মানে পূর্বসূরিদের অন্ধ অনুসরণ নয়, এর অর্থ ঐতিহাসিক চেতনার উপলব্ধি। ফলে দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড-এর চরিত্রে কেবল সমসাময়িক যুগেরই আবেদন নেই, রয়েছে সৃষ্টির আদি হতে বর্তমান সময় পর্যন্ত যুগ-চেতনা।

তবে আধুনিক কবিতার বিষয় ও প্রকরণগত পরীক্ষা-নিরীক্ষায় স্ববিরোধিতাও লক্ষ করা যায়। নৈর্ব্যক্তিকতার পাশাপাশি স্বাতন্ত্র্যবাদিতার অন্তর্মুখীনতাও ক্রমশ প্রধান হয়ে ওঠে। মূলত বিশ শতকের ধনবাদী সংকটের ফলে সমাজ ও সংস্কৃতিতে এর প্রভাব পরিস্ফুটিত হয়। আর তাই এ-পর্বের কাব্যবোধে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নৈরাজ্যের পটভূমিতে হতাশার উপস্থিতি অšে¦ষার পর অšে¦ষায় সজলভূমি আবিষ্কারে ব্যর্থ হয়। কোথাও কোনো প্রত্যাশার অবশিষ্ট কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় না। সুতরাং এ-সময়পর্বের কবিতার অবশেষ পরিণাম দুটি ধারায় বিবিক্ত হতে দেখি;- এক, এজরা পাউন্ডের কবিতার শৈল্পিক নেতীবাদে এবং দুই, এলিয়টের ধর্মীয় শান্তিবাদের কবিতার ভেতরে।

কার্যত আধুনিক বিশ্বনাগরিক তার জাতিগত ও পরিবারগত ঐতিহ্য অর্থাৎ মূলের সঙ্গে যোগ হারিয়েছে, সে কোনো রাষ্ট্রিক ও আধ্যাত্মিক কর্তৃত্ব মানতে প্রস্তুত নয়। তাই বারবার নিজেরই কামনা-বাসনার ক্লেদাক্ত নাগপাশে সে জড়িয়ে পড়ে। সেই নিরাসক্ত গ্লানিকর জীবনের ভারসাম্য রক্ষায় পূর্বসূরির পৌনঃপুনিক উল্লেখে এলিয়ট এক বিশ্বাসহীন ছন্নছাড়ার উগ্র ব্যক্তিত্ববাদী জীবনের পরিণাম বর্ণনা করেছেন তার ‘পোড়ো জমি’তে। মূলত তৎকালীন ইউরোপের বিশেষত ইংল্যান্ডের নেতিবাচক জীবনব্যবস্থা, অবক্ষয়িত সমাজের দীনতা ফুটে উঠেছে দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড কাব্যে। পরবর্তীকালে সমগ্র বিশ্বের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে তার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই। সুতরাং বিশ্ব সাহিত্যের কবিতায় দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড-এর ভাষা, প্রতীক, চিত্রকল্প এবং একই সঙ্গে এর প্রেক্ষিত সার্বজনীন হয়ে উঠলো। আর এখান থেকেই কবি টিএস এলিয়ট বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসে বিকল্প ও ব্যতিক্রমী চিন্তাভাবনায় আধুনিক কবিতার পথ নির্মাণে সক্ষম হলেন।

এ কথা সত্য যে কাল নিত্যপরিবর্তনশীল। কিন্তু শত পরিবর্তনশীলতার মাঝেও থাকে শৃঙ্খলা ও ছন্দ, যার মধ্যে সমস্ত বিপরীতই সঙ্গতি লাভ করে থাকে। আর এলিয়ট যে সঙ্গতিতে উপনীত হয়েছেন তার প্রতি আধুনিক পদার্থবিদ্যা, উত্তর-ফ্রয়েডীয় মনোবিদ্যা এবং মিস্টিসিজ্ম সকলেই ইঙ্গিত করছে। এলিয়ট একে কাব্যরূপ দিয়েছিলেন বলেই তিনি এ-যুগের মহাকবি। বলা আবশ্যক ইংরেজি কবিতার বিবর্তনে এলিয়টের এই ভূমিকা একাধারে অনস্বীকার্য ও গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সমাজ ও সময়ের অবক্ষয়িত মূল্যবোধ, নৈরাশ্য, একাকিত্ব, যন্ত্রণা, অস্তিত্বহীনতা এবং সম্ভবনাহীন সম্মুখযাত্রার ইঙ্গিতের মধ্যেই দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড-এর বিশেষত্ব।

সহায়ক গ্রন্থ :

১. আহমদ রফিক, ‘কবিতা, আধুনিকতা ও বাংলাদেশের কবিতা’ ২০০১

২. রফিকউল্লাহ খান, ‘বাংলাদেশের কবিতা সমবায়ী স্বতন্ত্রস্বর’ ২০০২

৩. দীপ্তি ত্রিপাঠী, ‘আধুনিক বাংলা কাব্য পরিচয়’ ২০০৭

ছবি

সেদিন দু’দ- এই বাংলার তীর

ছবি

বিকল্প জীবন

সাময়িকী কবিতা

ছবি

হার না মানা নারী জীবনের উপাখ্যান

ছবি

কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা

ছবি

‘যে-কোনো দেশে ভাল সাহিত্য-অনুবাদক খুব কম’

ছবি

আর এক সুন্দর সকালবেলায়

ছবি

আবার নরকুম্ভির ও মডার্নিজম

ছবি

আত্মজীবনীর আত্মপ্রকাশ প্রসঙ্গে

ছবি

আসাদের অঙ্ক

ছবি

র্যাঁবোর কবিতায় প্রতীকী জীবনের ছায়া

ছবি

ভাষা সংস্কৃতি সাক্ষরতা

ছবি

হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতার আভিজাত্য

ছবি

চেশোয়া মিওশ-এর কবিতা

ছবি

সিলভিয়া প্লাথের মৃত্যু, নিঃসঙ্গতা ও আত্মবিনাশ

ছবি

সমসাময়িক মার্কিনি ‘সহস্রাব্দের কণ্ঠস্বর’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

অন্য নিরিখে দেখা

ছবি

হেলাল হাফিজের চলে যাওয়া

ছবি

হেলাল হাফিজের কবিতা

ছবি

কেন এত পাঠকপ্রিয় হেলাল হাফিজ

ছবি

নারী শিক্ষাবিদ : বেগম রোকেয়া

ছবি

বাসার তাসাউফ

ছবি

‘জগদ্দল’-এর শক্তি ও সমরেশ বসু

ছবি

রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

ছবি

রুবেন দারিও-র কবিতা

‘অঘ্রানের অনুভূতিমালা’

ছবি

কবিতা পড়া, কবিতা লেখা

ছবি

‘ধুলোয় সব মলিন’, পাঠকের কথা

ছবি

মহত্ত্বর কবি সিকদার আমিনুল হক

ছবি

রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

ছবি

কয়েকটি অনুগল্প

সাময়িকী কবিতা

ছবি

যেভাবে লেখা হলো ‘শিকিবু’

ছবি

জাঁ জোসেফ রাবেয়ারিভেলোর কবিতা

ছবি

সিকদার আমিনুল হকের গদ্য

tab

সাময়িকী

দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড-এর কবি এলিয়ট

মামুন মুস্তাফা

টি. এস. এলিয়ট / জন্ম: ২৬ সেপ্টেম্বর ১৮৮৮; মৃত্যু: ০৪ জানুয়ারি ১৯৬৫

বৃহস্পতিবার, ০২ জানুয়ারী ২০২৫

ইংরেজ কবি টি. এস. এলিয়টের প্রথম কবিতা প্রকাশিত হলো ১৯১৫ সালে পাউন্ডের ক্যাথলিক অ্যান্থলজিতে এবং তাঁর প্রথম কাব্য-সংকলন প্রকাশ পায় ১৯১৭ সালে। বিংশ শতাব্দীর সাহিত্যের ইতিহাসে এ দুটি বিষয় যুগান্তকারী ঘটনা। কেননা ডেকাডেন্টদের মতো কিংবা ইয়েট্স-এর মতো এলিয়ট জীবন থেকে পলায়ন করলেন না বরং বর্তমানের মুখোমুখি দাঁড়ালেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা তখন আগ্রাসী রূপ লাভ না করলেও, সমাজে অবিশ্বাস যে দানা বাঁধছে, শতাব্দী-সংক্রান্তির অস্থিরতা, পুঁজিবাদের উত্থান, নানামুখী রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য এলিয়টের কবিতায় অবলীলায় স্থান করে নেয়। ফলে আবেগ ও অনুভূতির বিপরীতে এ-সবের ভিতরে মানুষের নিরাসক্ত ও নৈর্ব্যক্তিক দিক এলিয়টের কবিতায় ধরা পড়লো। এই প্রথম শহরের ও আধুনিক যন্ত্রযুগের রূপ ইংরেজি কাব্যে ফুটে উঠলো। আধুনিক শহরের মানুষ যে একান্তভাবে নিঃসঙ্গ সেই চরম সত্যটিকে এলিয়ট ধাতব কঠিন মূর্ত চিত্রকল্পের ভিতরে আবিষ্কার করেন। বোদলেয়ার আমাদেরকে শহুরে চিত্রকল্পের ব্যবহারে মোহিত করেছেন। কিন্তু এলিয়ট তাকে নিয়ে গেলেন মানুষের যাপিত জীবনের অন্দরমহলেÑ কানাগলিতে বেড়াল, এক রাত্রির সস্তায় হোটেল, তার মাংস রান্নার গন্ধÑ এসব নিয়ে যে শহর, তা এবার সাহিত্যের বিষয় হয়ে উঠলো।

বিষয়বস্তুর অভিনবত্ব এবং যুগ সম্বন্ধে এলিয়টের কঠিন শ্লেষ ভিন্ন এ-যুগের কবিতায় আরো কয়েকটি নতুন লক্ষণ দেখা যায়, যেমনÑ অসম্বন্ধতা, পরস্পরবিরোধী রসের অবতারণা, কাব্যে নাটকীয় সংলাপের ভঙ্গি প্রয়োগ, গদ্যগন্ধী শব্দের ব্যবহার, চমকপ্রদ উদ্ধৃতি ইত্যাদি। মালার্মের ব্যক্তিগত প্রতীক ব্যবহারের পরিবর্তে এলিয়টের প্রতীক অনেক বেশি নৈর্ব্যক্তিক। মূলত লাফর্গ-এর মতো প্রতীকী কবি ও ডান-এর প্রভাব এলিয়টের কবিতায় লক্ষণীয়। আর এ-সবের মাধ্যমেই বিশ্বব্যাপী আধুনিক কবিতার খোলনলচে তাই পাল্টে গেলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে সৃষ্ট মহা অর্থনৈতিক মন্দা, বেকারত্ব, মানুষে মানুষে অবিশ্বাস, অসহায়ত্বকে পুঁজি করে যখন এলিয়ট রচনা করলেন ১৯২২ সালে দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড বা ‘পোড়ো জমি’। ১৯১৪ সালে ভিক্টোরীয় যুগের টলমল প্রাসাদ একেবারে ধূলিসাৎ হলো। ১৯২২ সালে দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড কাব্যে এলিয়ট সেই সার্বিক ধবংসস্তূপের চিত্র আঁকলেন। দান্তের স্বর্গযাত্রার পথে নরকে প্রবেশের মতো কবি এলিয়টও নতুন বিশ্বাসে উজ্জীবিত হয়ে সার্বিক মানবতাকে পুনর্জাগরণের আশা নিয়ে ‘পোড়োজমি’তে প্রবেশ করলেন।

বিশ শতকের যুদ্ধোত্তর যুগে ব্যক্তি ও সমাজকে ঘিরে যে অবক্ষয়, বিনষ্টি, সংঘাত ও বিপর্যয়, সেখানেও অস্তিত্ববাদী দর্শন প্রধান হয়ে উঠেছে বিধায় বিশ্বসাহিত্যে এই তত্ত্বের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। ফলে অস্তিত্ববাদকে ঘিরে সময় রাজনীতি ও সমাজনীতির জটিলতা প্রকাশ পেয়েছে পাশ্চাত্য কবিদের রচনায়। আর এক্ষেত্রে টিএস এলিয়টের কবিতায় অস্তিত্ববাদী চেতনার নিরিখে শূন্যতা হাতাশা নিঃসঙ্গতার শিল্পবোধই প্রধানত রূপায়িত হতে দেখি। সময় ও সমাজ বাস্তবতায় ব্যক্তি ও সমাজের বহির্বাস্তব ব্যবচ্ছেদ আধুনিক কবিদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি বলে তার কাছে মনোগহনের পরিচয় গ্রহণই শুধু নয় সেই সঙ্গে মনোগহনের ব্যবচ্ছেদও কাম্য, কাম্য চেতন থেকে অচেতন অন্তর্লোকের রহস্য সন্ধান, তার প্রকৃতি সম্পর্কে পূর্ণজ্ঞান অর্জন। আর এসবই প্রতিভাত হয়েছে দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ডের কাব্যপটভূমিতে।

আধুনিক সমাজ ও জীবন ব্যবস্থায় যে নৈরাশ্য, অবক্ষয়, নিঃসঙ্গতা আবার এসবের ভিতরে যে উর্বরতা, নিরাময়তার জন্য আকাক্সক্ষাÑ এই বিষয়গুলো দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড-এ বর্ণনা করতে গিয়ে কবি টিএস এলিয়ট পুরাণ ও মিথের ব্যবহারে অনেক উদ্ধৃতি দিয়েছেন, অনেক কবির কবিতার নাম-ধাম, বিষয়প্রকরণকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই মিস ওয়েস্টন বর্ণিত গ্রেল উপকথার মূল প্রতিপাদ্য অমিত অত্যাচারে ধীবররাজের পুরুষত্বহানি এবং এর ফলে তার রাজ্যে যে অনুর্বরতার অভিশাপ নামে, সে বিষয়টি এলিয়ট তার দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড কাব্যে উর্বরতার রহস্য আবিষ্কারের অনুঘটক হিসেবে দেখিয়েছে বটে, কিন্তু পশ্চাতে সমাজের আধ্যাত্মিক অবক্ষয় বোঝাবার জন্য কবি এটি ব্যবহার করেছেন। এ কাব্যের শেষে যদিও আমরা বারংবার বর্ষণের উল্লেখ দেখতে পাই, কিন্তু তাকে নামতে দেখি না। বুদ্ধবচন, অগস্টাইনের উক্তি এবং উপনিষদের মন্ত্রে শুধু একটা আশার আভাস আমরা পাই। হয়তো অহংকে উৎসর্গ করলে বর্ষণ নামবে, ‘পোড়োজমি’তে ফলবে আধ্যাত্মিক সঙ্গতির সোনালি ফসল।

দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড-এর বিশেষত্ব এখানেইÑ একটি ভাল চলচ্চিত্র যেমন দৃষ্ট চিত্রকল্প ও শ্র“ত চিত্রকল্পের মিলন ঘটায়, কাব্য ও চিত্রের মেলবন্ধন করে, এলিয়টও এই কবিতায় তাই করেছেন। আধুনিক নাগরিক জীবনের বিচিত্র অভিঘাত বর্ণনায় একটি ধর্মচক্র, বোদলেয়ার বা ট্যাসিটাস থেকে উদ্ধৃতি, শহুরে টাইপিস্টের প্রণয়লীলার কিছু আভাস, ধুলোমাখা লন্ডনের সড়কপথের কিছু বিবরণ, বিশ শতকের খ-, ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত জীবন কয়েকটি ছড়ানো চিত্রকল্পে উদ্ভাসিত হয়েছে এই কাব্যে। বিশ শতকের ক্লান্তিকর যাপিত জীবনের নানা অনুষঙ্গে ঠাঁই করে নিয়েছে স্মৃতি ও বর্ণনা, চেতন ও অবচেতন, বর্তমান ও অতীত; আর এসবের মধ্যে অবিরত ও অতি দ্রুত চলেছে যাতায়াত।

দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড কেন এত বিখ্যাত? কবিতার আধুনিকতায় তার বিশেষত্ব কি শুধুই শহুরে আধুনিক জীবনের নিরাসক্তি, নৈর্ব্যক্তিকতা আর নিঃসঙ্গতার ভিতরে? বিজ্ঞান মানুষকে নানা বিষয়ে জ্ঞানের ভা-ারী করেছে বটে, কিন্তু প্রজ্ঞা দেয়নি। তাকে উপলব্ধি করে দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড-এ কবি এলিয়ট বিশ শতকের মানুষের দিনলিপির ভিতরে আবিষ্কার করেন আত্মজীবনী, প্রতœতত্ত্ব, পুরাণ ও ধর্মের কোলাজ। ফলে নৃতত্ত্ব ও ঐতিহ্যকে স্বীকার করে এলিয়ট ‘পোড়ো জমি’তে দেখতে পান প্রকৃতির জন্ম, মৃত্যু ও পুনর্জন্মের ছন্দ। তবে এলিয়টের কাছে ঐতিহ্য মানে পূর্বসূরিদের অন্ধ অনুসরণ নয়, এর অর্থ ঐতিহাসিক চেতনার উপলব্ধি। ফলে দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড-এর চরিত্রে কেবল সমসাময়িক যুগেরই আবেদন নেই, রয়েছে সৃষ্টির আদি হতে বর্তমান সময় পর্যন্ত যুগ-চেতনা।

তবে আধুনিক কবিতার বিষয় ও প্রকরণগত পরীক্ষা-নিরীক্ষায় স্ববিরোধিতাও লক্ষ করা যায়। নৈর্ব্যক্তিকতার পাশাপাশি স্বাতন্ত্র্যবাদিতার অন্তর্মুখীনতাও ক্রমশ প্রধান হয়ে ওঠে। মূলত বিশ শতকের ধনবাদী সংকটের ফলে সমাজ ও সংস্কৃতিতে এর প্রভাব পরিস্ফুটিত হয়। আর তাই এ-পর্বের কাব্যবোধে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নৈরাজ্যের পটভূমিতে হতাশার উপস্থিতি অšে¦ষার পর অšে¦ষায় সজলভূমি আবিষ্কারে ব্যর্থ হয়। কোথাও কোনো প্রত্যাশার অবশিষ্ট কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় না। সুতরাং এ-সময়পর্বের কবিতার অবশেষ পরিণাম দুটি ধারায় বিবিক্ত হতে দেখি;- এক, এজরা পাউন্ডের কবিতার শৈল্পিক নেতীবাদে এবং দুই, এলিয়টের ধর্মীয় শান্তিবাদের কবিতার ভেতরে।

কার্যত আধুনিক বিশ্বনাগরিক তার জাতিগত ও পরিবারগত ঐতিহ্য অর্থাৎ মূলের সঙ্গে যোগ হারিয়েছে, সে কোনো রাষ্ট্রিক ও আধ্যাত্মিক কর্তৃত্ব মানতে প্রস্তুত নয়। তাই বারবার নিজেরই কামনা-বাসনার ক্লেদাক্ত নাগপাশে সে জড়িয়ে পড়ে। সেই নিরাসক্ত গ্লানিকর জীবনের ভারসাম্য রক্ষায় পূর্বসূরির পৌনঃপুনিক উল্লেখে এলিয়ট এক বিশ্বাসহীন ছন্নছাড়ার উগ্র ব্যক্তিত্ববাদী জীবনের পরিণাম বর্ণনা করেছেন তার ‘পোড়ো জমি’তে। মূলত তৎকালীন ইউরোপের বিশেষত ইংল্যান্ডের নেতিবাচক জীবনব্যবস্থা, অবক্ষয়িত সমাজের দীনতা ফুটে উঠেছে দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড কাব্যে। পরবর্তীকালে সমগ্র বিশ্বের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে তার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই। সুতরাং বিশ্ব সাহিত্যের কবিতায় দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড-এর ভাষা, প্রতীক, চিত্রকল্প এবং একই সঙ্গে এর প্রেক্ষিত সার্বজনীন হয়ে উঠলো। আর এখান থেকেই কবি টিএস এলিয়ট বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসে বিকল্প ও ব্যতিক্রমী চিন্তাভাবনায় আধুনিক কবিতার পথ নির্মাণে সক্ষম হলেন।

এ কথা সত্য যে কাল নিত্যপরিবর্তনশীল। কিন্তু শত পরিবর্তনশীলতার মাঝেও থাকে শৃঙ্খলা ও ছন্দ, যার মধ্যে সমস্ত বিপরীতই সঙ্গতি লাভ করে থাকে। আর এলিয়ট যে সঙ্গতিতে উপনীত হয়েছেন তার প্রতি আধুনিক পদার্থবিদ্যা, উত্তর-ফ্রয়েডীয় মনোবিদ্যা এবং মিস্টিসিজ্ম সকলেই ইঙ্গিত করছে। এলিয়ট একে কাব্যরূপ দিয়েছিলেন বলেই তিনি এ-যুগের মহাকবি। বলা আবশ্যক ইংরেজি কবিতার বিবর্তনে এলিয়টের এই ভূমিকা একাধারে অনস্বীকার্য ও গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সমাজ ও সময়ের অবক্ষয়িত মূল্যবোধ, নৈরাশ্য, একাকিত্ব, যন্ত্রণা, অস্তিত্বহীনতা এবং সম্ভবনাহীন সম্মুখযাত্রার ইঙ্গিতের মধ্যেই দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড-এর বিশেষত্ব।

সহায়ক গ্রন্থ :

১. আহমদ রফিক, ‘কবিতা, আধুনিকতা ও বাংলাদেশের কবিতা’ ২০০১

২. রফিকউল্লাহ খান, ‘বাংলাদেশের কবিতা সমবায়ী স্বতন্ত্রস্বর’ ২০০২

৩. দীপ্তি ত্রিপাঠী, ‘আধুনিক বাংলা কাব্য পরিচয়’ ২০০৭

back to top