উইলিয়ম রাদিচের সাক্ষাৎকার
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : কামাল রাহমান
ড. উইলিয়ম রাদিচের জন্ম ১৯৫১ সালে, লন্ডনে এবং প্রয়াত হন গত ১০ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে নর্থ ইংল্যান্ডে।তিনি ছিলেন একজন কবি, লেখক এবং অনুবাদক। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল এবং আফ্রিকান স্টাডিজের বাংলা ভাষার একজন সিনিয়র প্রভাষক। তাঁর গবেষণা ছিল মূলত বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়েই। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মাইকেল মধুসূদন দত্তের বেশ কয়েকটি রচনা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন।
রাদিচে দুটো ক্যারিয়ার গড়েছেন একসঙ্গে। কবি হিসেবে একটি এবং অন্যটি রবীন্দ্রনাথ তথা বাংলা ভাষার একজন বিশেষজ্ঞ-প-িতের! তাঁর মৌলিক ও সম্পাদিত গ্রন্থসংখ্যা ত্রিশ ছাড়িয়েছে। তাঁর নির্বাচিত ‘রবীন্দ্রনাথের কবিতা’ ও ‘রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প’ অনুবাদ সঙ্কলন দুটি পেঙ্গুইন বুকস থেকে প্রকাশিত হয়ে অনেকবার পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। জার্মান ভাষা থেকেও অনুবাদ করেন তিনি। ব্রিটেন, ভারত, বাংলাদেশ, উত্তর আমেরিকা, জার্মানি ও ইউরোপের অন্যান্য দেশে কবিতা ও সাহিত্য বিষয়ে অসংখ্য বক্তৃতা দিয়েছেন। বিশ্বভারতীতে ভিজিটিংপ্রফেসর হিসেবে কাজ করেছেন। প্রকৃত অর্থেই তিনি একজন রবীন্দ্র-বিশারদ। ১৯৮৭-তে মাইকেল মধুসূদন দত্তের উপর থিসিস করে অক্সফোর্ড থেকে ডি. ফিল ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ১৯৮৮ থেকে ইউনির্ভাসিটি অব লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল এ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ (SOAS)-এ বাংলার শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। ভাষা ও সাহিত্যে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য ২০০৭-এ আসাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে অনারারি ডি.লিট এবং একই বছর বাংলা একাডেমি থেকে অনারারি ফেলোশিপ দেয়া হয় তাঁকে। ২০০৯-এ কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইন্সটিটিউট হতে ‘রবীন্দ্র তত্ত্বাচার্য’ উপাধি লাভ করেন। বিবিসি ওয়ানের সকালের অনুষ্ঠান Pause of Thoughts সঙ্গে যুক্ত ছিলেন দীর্ঘদিন।
১৯৯৮ সালে ড. উইলিয়ম রাদিচে চট্টগ্রামে এসেছিলেন। অনেক ব্যস্ততার মাঝেও এ সাক্ষাৎকারটি দিয়েছিলেন তিনি। চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত সাহিত্যের ছোটকাগজ ‘১৪০০’ (সংখ্যা ৬, এপ্রিল ১৯৯৮)-এ সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছিল। এটি এখনো অনেক প্রাসঙ্গিক ও উপভোগ্য।
কামাল রাহমান: একটু অতীতচারণ করি উইলিয়ম। সাতাশির এপ্রিলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন, বাংলা একাডেমি আপনার ‘চারটি বক্তৃতা’ গ্রন্থে সঙ্কলিত করেছে ওগুলো। আপনি বলেছিলেন ওখানে, আন্তরিকভাবে ‘জীবনদেবতা’ ধারণাটি উপলব্ধি করতে পারেন আপনি, আরেকটু বিস্তৃত করবেন ওটাকে?
উইলিয়ম রাদিচে: রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতা ধারণাটির মধ্যে ব্যাপকতা রয়েছে। এটার বিস্তৃতি বিশাল। প্রকৃতির শক্তি ও কবির শক্তির মধ্যে ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। প্রকৃতিকে নির্ভর করে বেড়ে ওঠে কবির শক্তি। জীবন হচ্ছে আধার। একজন কবি প্রকৃতির শক্তির খুব বড় ধারক। কম্পিউটারের ভেতরও এক ধরনের জীবন দেয়া আছে। বিদ্যুৎ পরিচালিত। আদেশ পেলে কম্পিউটার অনেক কিছু করে। কিন্তু সে নিজে কিছু উদ্ভাবন করতে পারে না। তার ভেতর যেমন প্রোগ্রাম ঢোকানো হয়, সেভাবে সে কাজ করে। সে কি কবিতা লিখতে পারে?
কামাল: রুশরা নাকি কম্পিউটারকে কবিতা লেখা শেখাচ্ছিল?
উইলিয়ম: কম্পিউটার তো মানুষের মতো খেলতে পারে না। সে নিজে থেকে চিন্তা করতে পারে না। তাকে হয়তো একটা নিয়ন্ত্রিত জীবন দেয়া হয়েছে। অসংবেদনশীল, অনুভূতিহীন। কোনো খেলার প্রতিপক্ষ হতে পারে না সে।
কামাল: কাস্পারোভ তো কম্পিউটারের কাছে হেরে গেছে।
উইলিয়ম: তা হেরেছে। চেস প্লেয়িং সীমিত ব্যাপার। মস্তিষ্ককে একভাবে চালানোর ব্যাপার, কিন্তু শিল্পে উদ্ভাবনী শক্তি দরকার। এই জীবনদেবতা শিল্পসৃষ্টিতে, কবিতা লেখায়, সব চেয়ে বড় ভূমিকা নেয়। অন্য ধরনের কাজে মানুষের সামগ্রিক ব্যবহার কতটুকু? ক্রিয়েশান ইজ এক্সটেন্ডেড টু অল স্ফেয়ার অব লাইফ, জীবনদেবতাই তো মানুষকে মানুষ বানিয়ে তোলে। না হলে পশুরও তো জীবন আছে। একটি খুব ভালো উক্তি ‘‘মানুষ হয়ে ওঠাই হচ্ছে এক ধরনের শিল্প’’। তা মানুষের ভেতর তার শৈল্পিক সত্তা তার সুকুমার দিকগুলোকে জাগরিত করে। এখানেই জীবনদেবতার মূল ভূমিকা। রবীন্দ্রনাথ এটাকে খুব উপলব্ধি করতেন। আমিও তাঁর কাছে শিখেছি এটা।
কামাল: সেখানে আপনি উল্লেখ করেছেন ‘‘আমার মৃত্যুর পর যদি কোনো সহৃদয় পাঠক খুঁজে বের করতে চান আমার কবিতা ও রবীন্দ্রনাথের কবিতার মধ্যে প্রধান সম্পর্ক কোথায় অথবা কোন ক্ষেত্রে আমি রবীন্দ্রনাথের কবিতা দ্বারা প্রভাবিত, হয়তো তাঁরা বলবেন আমিও জীবনদেবতার ইচ্ছার তাড়নায় লিখতাম।’’ আপনি কি এখনো ভাবেন যে জীবনদেবতার ইচ্ছার তাড়নায়ই এখনো সবকিছু করছেন?
উইলিয়ম: কোনো সন্দেহ নেই। আমার জীবনদেবতাই আমাকে দিয়ে এসব করিয়ে নিচ্ছে। প্রকৃতির শক্তি, যেটার সঙ্গে জীবনের সম্পর্ক, যেটা জৈবিক, আর কবির শক্তি, যেটা অনেকাংশে দৈবিকও, অবশ্য আমি কখনো বলব না ভালো কবিতা ভগবান থেকে আসে, কিংবা এটা দেব-প্রদত্ত। অর্থাৎ গড গিফটেড। কিন্তু এটার সঙ্গে একটা দৈবিক অনুভব কিংবা রহস্যের যোগসূত্র রয়েছে। এগুলোর সমন্বয়ে, অর্থাৎ জীবনদেবতার এই কন্সেপ্ট, হ্যাঁ, এটা এখনও আমার জীবনকে চালাচ্ছে।
কামাল: রবীন্দ্রনাথের মানসী থেকে বলাকা পর্যন্ত লেখা কবিতাগুলোকে সর্বোজ্জ্বল বলা হয়ে থাকে, বলাকা পর্বকেই সর্বশেষ পরিণত ও পরিপক্ব পর্ব বলে চিহ্নিত করা হয়েছে, আমরা কি ধরে নেব সে সময়টায় রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতা সবচেয়ে বেশি প্রাণোচ্ছল ছিল?
উইলিয়ম: রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতা কখনোই ¤্রয়িমান ছিল না। একটা ভালো কবিতা লেখার জন্য এক ধরনের শক্তি দরকার। একটা বীজ থেকে মহীরুহের জন্ম এক ধরনের রহস্যের মধ্যে, সেই রহস্য আবিষ্কারের নেশা মানুষের ভেতর থাকতে হবে। রবীন্দ্রনাথ সেই রহস্যের সূত্র সম্ভবত আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন। পরবর্তীতে তাঁর ভেতর হয়তো সেই উদগ্র নেশাটি কমে এসেছিল, প্রকৃতিগত কারণেই। প্রকৃতির শক্তি ও কবির শক্তির মধ্যে একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। একজন কবি প্রকৃতির শক্তিকে অন্বেষণ করেন। এটাকে খুব ভালোভাবে করতে চাইলে বা সক্ষম হলে সে প্রকৃতির শক্তি নিজের মধ্যে ধারণ করতে পারে। এটা রবীন্দ্রনাথের ধারণা, আমিও এটা বিশ্বাস করি। প্রকৃতিগত কারণেই একসময় বাঁধন শিথিল হয়, এবং ওটার বিলুপ্তিও ঘটে।
কামাল: তাই। বলাকা পরবর্তী, অর্থাৎ অন্তপর্বে (২৯-৪১) ‘পুনশ্চ’ থেকে ‘শ্যামলী’ পর্বটিকেই ধরি, এখানে দেখা যায় তিনি দৈনন্দিন জীবনের প্রাত্যহিকতাকে আঁকড়ে ধরছেন (শ্যামলীর ‘ছেলেটা’), বলাকা পর্বের যৌবন-মদমত্ততা নেই, বহু-বর্ণিল উচ্ছ্বাস থেকে এখানে কবির মোহমুক্তি ঘটল কি?
উইলিয়ম: না, মোহমুক্তি ঘটেনি। সৃষ্টিশীল একজন মানুষ আজীবন একটি বিষয়কেই আঁকড়ে ধরে থাকেন না। একজন শিল্পী সারা জীবন পরিবর্তনশীল প্রকৃতি থেকে গ্রহণ করেন। প্রকৃতিই সকল সৌন্দর্যের আধার। কিন্তু একটা মস্ত বিপদ, এক ধরনের... কী বলব, ইন সাম কাইন্ড অব ক্রিয়েটিভ পাওয়ার... যদি ওদের, ঐ যে, জীবনদেবতা ক্রিয়াশীল না থাকলে হয়তো কিছু করত না, এই পরিবর্তনগুলো সবার জীবনেই আসে, নতুন মোহে হয়তো কখনো আরো নতুন উদ্যমে জড়িয়ে পড়ে। রবীন্দ্রনাথের প্রধান উদ্দেশ্য, আমার যতটুকু মনে হয়, তিনি সারা জীবন বাস্তবিকতারই প্রকাশ ঘটাতে চেয়েছেন, রেসপন্স টু ন্যাচার তাঁর ছিল সাবলীল, তাঁর একটা কাব্যিক দিক, একটা গদ্যের দিক, এ দুটোর মধ্যেও কখনো বিরোধ ঘটেনি, ছিন্নপত্র গ্রন্থাকারে প্রকাশের আগে প্রবন্ধের একটা বই করেছিলেন তিনি, ওটির তিনটি অংশ ছিল, ‘জল’- অর্থাৎ তাঁর কল্পনা, ‘স্থল’- মানে বাস্তবতা, রিয়্যালিস্টিক, তারপর ‘ঘাট’- সেটি হচ্ছে যোগসূত্র। অর্থাৎ সবকিছুতেই তিনি ঘাটের বিষয়টিকে এনেছেন, মিলন, মিটিং অব ওয়েলথ এন্ড স্পিরিট, এটিকে তিনি গুরুত্ব দিতেন, তাঁর ভেতরে কখনো নিস্পৃহতা আসেনি।
কামাল: ‘জীবনদেবতার তাড়না’ আর ‘সৃষ্টিশীল কল্পনা’ এ দুয়ের মধ্যে যোগসূত্র কিংবা পার্থক্য কোথায়? ধরুন আপনার ভেতর জীবনদেবতার তাড়না রয়েছে, কিন্তু সৃষ্টিশীল কল্পনা ততটা জোরালো নয়, কিংবা উল্টোটি, ফলাফল কী দাঁড়ায়?
উইলিয়ম: পার্থক্য কোথায়, জীবনদেবতার তাড়নায় সে কল্পনা করে, সৃষ্টিশীল কল্পনা, আর কল্পনা যদি সৃষ্টিশীল না হয় জীবনদেবতার অস্তিত্ব কোথায়?
কামাল: আপনার মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথের কবিতার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক খোঁজার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন, এখানে জৈবিক অনুপস্থিতির প্রশ্নটি কেন এল? ধরে নিচ্ছি রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতা তাঁর জীবদ্দশায় তাঁকে তাড়িত করেছিল, কিন্তু সেই জীবনদেবতা কি তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে পরোক্ষে আমাদের সত্তার ভেতর এখনো সচল বা অস্তিত্বশীল নয়? তাঁর সৃষ্টি হয়তো থেমে গেছে, কিন্তু জীবনদেবতার কি অবলুপ্তি ঘটেছে?
উইলিয়ম: তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ এখনো আমাদের মধ্যে রয়েছেন।
কামাল: প্রতিভার সঙ্গে জীবনদেবতার সম্পর্ক কী?
উইলিয়ম: প্রতিভা না থাকলে জীবনদেবতার উপলব্ধি কিংবা উপস্থিতি টের পাওয়া মুস্কিল। দার্শনিক দিক থেকে আমি রবীন্দ্রনাথ দ্বারা খুব প্রভাবিত। রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণেই আমি তাঁর অনুবাদ করতে পারছি।
কামাল: তাঁকে নিজের ভেতর ধারণ করতে পারছেন, লালন করছেন...
উইলিয়ম: ঠিক তাই, আমি একটা ঘটনা বলি, ইন্টারেস্টিং, এ শতাব্দীর শুরুতে এফ এম আলেকজান্ডার নামে একজন গুণী ব্যক্তি ছিলেন আমাদের দেশে। তিনি শেক্সপীয়ার আবৃত্তি করতেন। উনি একবার ভাবনায় পড়েন তাঁর স্বরের গ-গোল নিয়ে। তিনি খুব ভাবলেন গলার ত্রুটি সারানোর জন্য এবং এই সূত্র ধরেই তিনি পৌঁছে গেলেন একটি সফল আবিষ্কারে। এখন সেটিকে আলেকজান্ডার টেকনিক বলা হয়। এটি হচ্ছে সমগ্র শরীরের বিজ্ঞানভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ। আমরা প্রায় সময়ই অযথা শরীরের বিভিন্ন অংশকে, বিভিন্ন পেশিকে ব্যবহার করি। অথচ এটি প্রয়োজনের অতিরিক্ত। তিনি ক্লাস নিতেন, ছাত্রদের ব্যাখ্যা করে বোঝাতেন কীভাবে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সুনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শরীরকে সুস্থ রাখা যায়। আর শারীরিক সুস্থতা না থাকলে মনের কাজ তো হতে পারে না। আমি আলেকজান্ডার টেকনিকটা শিখেছি। এখন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। আমার খুব মনে আছে, ঠিক আটাশ বছর বয়সে আমি মাইগ্রেনের ব্যথায় কাবু হয়ে পড়ি। এটি একটু অন্য ধরনের, এই জিনিসটি আজো ধরা যায়নি। এর সূত্র জানা নেই। আলেকজান্ডার টেকনিক ব্যবহার করে এখন ভালো আছি আমি। আগের মতো মনে করি না যে আমি অসুস্থ, ধরে নিয়েছি এটা আমার সমস্যা, এন্ড সামটাইম আই হ্যাভ টু ফেইস ইট।
কামাল: এন্ড সলভ ইট।
উইলিয়ম: ইয়েস, সলভ ইট। এটিকে মেনে নিয়েছি। গত দু’শ’ বছরের মধ্যে সবকিছু এত বদলে গেছে, আমরা প্রকৃতি প্রদত্ত ব্যপারগুলো ভুলে গেছি। ছোট ছেলেমেয়েকে লক্ষ্য করুন, স্বভাব-বশত ওরা অনেক কিছু প্রকৃতি থেকে শেখে।
কামাল: জাগতিক নিয়মেই জেনে যায়, বেসিক ইন্সটিঙ্কট।
উইলিয়ম: হ্যাঁ, এই নতুন যান্ত্রিক যাত্রার সঙ্গে মানুষ ন্যাচার্যাল কম্যান্ডগুলো ভুলে যাচ্ছে। আলেকজান্ডার বলেছিলেন, এই সব ক্ষমতা আমাদের মধ্যে ইন্সটিঙ্কটলি ছিল। এখন আবার চেষ্টা করে শিখতে হচ্ছে, তো আমাদের জীবনদেবতা এক্ষেত্রে আমাদের অস্তিত্বকে জাগাতে আবার আহ্বান জানায়, প্রকৃতিকে অনুসন্ধান করতে বলে...
কামাল: আপনার কবিতা নিয়ে কথা বলি এবার, আপনি বলেছিলেন আপনার জীবনদেবতা উপস্থিত রয়েছে ‘‘অড’’ কবিতাটিতে। আপনার এ কবিতাটির একাংশে দেখি-
Whose motionless facial loveliness discerned no
Merit or opprobrium
But only the eternal progress of self-correction
Towards equilibrium!
এই ‘সেল্ফ-কারেকশান’-এর সূত্র কোথায়? যেখানে আপনি শুরুতে বলেছেন মেয়েটি প্রকৃতির রিরংসা উন্মুক্ত করে, আমরা কি তাহলে ধরে নেব জীবনদেবতাকে অপেক্ষা করতে হয় প্রকৃতির রিরংসা উন্মোচনের জন্য?
উইলিয়ম: এখানে মেয়েটি প্রকৃতিরই অংশ, কোনো পার্থক্য নেই। ক্রিয়েটিভ এপ্রোচ অব লিভিং দেখানোর চেষ্টা আছে, ইন পার্সোন্যাল লেভেল, ইন কসমিক লেভেল, প্রগ্রেসিং টু সাম কাইন্ড অব গ্রেটার... বিশ্বাস এবং পৃথিবীর মধ্যে কন্ট্রাডিকশান, আওয়ার পার্সোন্যাল কন্টিনিউটি, অন দ্য আদার হ্যান্ড হরর, মিজারেবল পার্ট অব লাইফ... এই সকল কন্ট্রাডিকশান, ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে জীবন এক্ষেত্রে শেখে, আত্মশুদ্ধি ঘটে, এই এসব আর কি।
কামাল: চিত্রকর অথবা ঔপন্যাসিকের উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে আর্লের বিষয়টিকে চমৎকার বর্ণনা করেছেন-
Who can watch and record the things around them
Freely
And are not enslaved by a merciless endogeneity
†k‡l e‡j‡Qb-
In joy, he considers himself both musician and
Painter,
In depression, he considers himself to be neither.
এই বক্তব্যের সঙ্গে আপনার জীবনদেবতার পার্থক্য কোথায়? আমরা কি ধরে নেব আর্লের জীবনদেবতার সঙ্গে আপনার জীবনদেবতার মিল কিংবা প্রগাঢ় বন্ধুত্ব রয়েছে, অথবা বিপরীতটি?
উইলিয়ম: হ্যাঁ, এই কবিতাটিতে আমার নিজের কথা আছে, এটি বড় কবিতা, সবটুকু পড়তে হবে, না হয় আপনি বুঝবেন না, বুঝতে পারেননি, ঐ যে বলেছি টেকনিকের কথা, ক্রিয়েটিভ কন্ট্রোল ইন ক্রিয়েটিভ লাইফ, এবং অন্যত্র, সব জায়গায়, এটি ক্রিয়েশানে খুব সাহায্য করে। এখানে ধর্মের কোনো যোগ নেই। এটি মেডিক্যাল থেরাপি। পশুদের কিছু শিখতে হয় না, মানুষের শিখতে হয়। সেক্স ইন্সটিঙ্কট, ইউজ অব আওয়ার বডি, ন্যাচারাল কন্ট্রোল ইন দ্য ওয়ার্ল্ড... নিরোদ সি চৌধুরী ভালো বলেছেন, উই হ্যাভ লস্ট ন্যাচারাল কন্ট্রোল, যেটি এমনকি পশুরাও এখনো ভোলেনি।
কামাল: হুঁ... ইভেন দে মেইনটেইন দেয়ার মেটিং সীজন...
উইলিয়ম: ঠিক তাই, তবে নিরোদ বাবু খুব নৈরাশ্যবাদী। তাঁর ধারণা মানুষের কোনো ভবিষ্যত নেই।
কামাল: এটা কী করে হয়!
উইলিয়ম: আমি তো বিপরীত ধারণাই পোষণ করি, অনেক দূর এগিয়েছে মানুষ, আরো এগোবে।
কামাল: বুঝতে পারি আপনার জীবনদেবতা ঋদ্ধ হয়েছে রোম্যান্টিক ও ধ্রুপদী প্রভাবের সংমিশ্রণে, আমরা যেহেতু আপনার কবিতাকে ঘনিষ্ঠভাবে পেতে চাই, সেজন্যই আপনার জীবনদেবতার প্রতি এ অন্বেষণ। যাহোক, আপনার ‘টু মেডিটেশান’ কবিতায় লক্ষ্য করি ঐতিহাসিক ভদ্রমানুষটি কাব্যিক জগত থেকে ফিরে আসেন অভ্যেসের জগতে, যেগুলো তার পক্ষে ভেঙ্গে বেরোনো সম্ভব নয়, কিন্তু একজন কবি তো অনন্ত অনিশ্চিতের উদ্দেশ্যেও যাত্রা করতে পারেন, তার ফিরে না এলেও চলে, এখানে ঐতিহাসিকের প্রত্যাবর্তন কি রোম্যান্টিকতায় না ধ্রুপদী জগতে?
উইলিয়ম: ধ্রুপদী জগতে।
কামাল: রবীন্দ্রনাথের ‘ওগো আমার ভোরের চড়–ই পাখি’ কবিতা অনুবাদ করতে যেয়ে লিখেছিলেন- ‘আমার জীবনদেবতাও আমাকে এ ধরনের আনন্দময়, হাসি-খুশি কবিতা লিখতে শিখিয়ে দেবেন’ তা এখন কি এ রকম হাসি-খুশি কবিতা লিখছেন?
উইলিয়ম: মাঝেমধ্যে লিখছি।
কামাল: একটা শোনাবেন?
উইলিয়ম: এ রকম একটা কবিতা দ্য রিট্রিট বইটিতে আছে, আমার ছোট মেয়েটি সম্পর্কে। আমি প্রায় সব ধরনেরই লিখি। কোনো নির্দিষ্টতা নেই। ভবিষ্যতে স্যাটায়ার লিখতে চাচ্ছি।
কামাল: হিউমার বা...
উইলিয়ম: না, ঠিক রসিকতা বা এ ধরনের কিছু আমার হয় না।
কামাল: প্রসঙ্গান্তরে আসি, বাংলা কবিতার দু’শ’ বছরের বিবর্তন নিয়ে কাজ করছেন এখন, কিছু বলবেন এ নিয়ে?
উইলিয়ম: হ্যাঁ, দু’শ’ বছরের দু’শ’টি কবিতা নির্বাচনের ইচ্ছে আছে। এটি একটি শ্রমসাধ্য কাজ, চেষ্টা করছি, এটি হয়তো দু’ভাবেও হয়ে যেতে পারে। মূল বাংলা টেক্সটের সাথে গদ্য অনুবাদ করে দেয়া হবে, বাংলা যারা পড়তে জানে না তাদের জন্য, টীকা থাকবে, ভূমিকা থাকবে, এটি একাডেমিক কাজ হবে। পরে হয়তো একটি পেঙ্গুইন বা অন্য কোনো সংস্করণ হবে। পুনর্নিবাচনও হতে পারে। একাডেমিক কাজটি দু’তিন বছরের মধ্যে হয়ে যাবে। এটির প্রতিক্রিয়া, সমালোচনা, পরামর্শ ইত্যাদি হয়তো পাওয়া যাবে। তখন আরেকবার ভাবা যাবে।
কামাল: নিঃসন্দেহে এটি একটি ব্যাপক কাজ। কবিতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে কি পন্থা নিয়েছেন?
উইলিয়ম: বড় কবি নির্বাচনে তেমন সমস্যা হয়নি। তাছাড়া একটি প্রশ্নপত্র পাঠিয়েছিলাম আপনাদের অনেকের কাছে। ভালোই জবাব পেয়েছি। অনেকেরই মতামত আছে এবং খুব কমন কিছু কবির উল্লেখ প্রায় সবার উত্তরেই আছে। তারপর এরূপ একটি সঙ্কলনে রবীন্দ্রনাথের কটি কবিতা থাকতে পারে, এ প্রশ্নটির জবাবে গড় সংখ্যা পাওয়া গেছে ৩০টি, তারপর জীবনানন্দ ৮টি, নজরুল৭/৮টি, সুধীন ৬টি, এরকম দুই বাংলার প্রধান কবিদের নাম প্রায় সবাই একই রকম জানিয়েছেন। আমি সবার মতামত নিচ্ছি।
কামাল: আপনার পক্ষে নিরপেক্ষ হওয়া সম্ভব আশা করি। কিন্তু আপনার আওতায় দু’শ’ বছরকে কীভাবে ধারণ করছেন?
উইলিয়ম: বিভিন্নভাবে এটিকে দেখছি আমি। লাইব্রেরি থেকে অনেক সঙ্কলন পাচ্ছি। তারপর বিভিন্নজনের পাঠানো বইপত্র, বাজার থেকে কেনা, এসব বইপত্র, প্রবন্ধ প্রভৃতি কাজে আসছে। একটি বিষয় আমি খুঁজে দেখছি, কোনো কোনো সময়ে কিছু কবিতা জনপ্রিয় হয়েছে, এটির পেছনে কী আছে। এটি যদি উপলব্ধি করা যায়, বাঙালি চরিত্রটিও কিছুটা হয়তো ধরা যাবে। জনপ্রিয় কবিতাগুলোও বিবেচনায় আনা হচ্ছে।
কামাল: একটা বিষয় হয়তো লক্ষ্য রাখা যেতে পারে, অনেক সময় রাজনৈতিক কারণে অনেক কবিতা খুব জনপ্রিয় হয়েছে এখানে। কিন্তু সে তুলনায় কবিতাটির শিল্পমান ততটা নেই। এমনকি ঐ কবিরই তুলনামূলকভাবে অনেক ভালো কবিতা রয়েছে, যা পাঠক পায়নি। সেক্ষেত্রে তাঁর জনপ্রিয় কবিতাটি নির্বাচন করা হলে তাঁর শিল্পের প্রতি সুবিচার করা হবে কিনা? তাছাড়া জনপ্রিয়তা এদেশে এখনো শিল্প বিচারের মানদ- হয়ে ওঠেনি। শিল্পবোধ-সম্পন্ন মানুষের সংখ্যা খুব কম এখানে। কথাটি হয়তো অন্যত্রও প্রযোজ্য হতে পারে। জনপ্রিয়তা তো অনেক সময়ই খুব সাময়িক।
উইলিয়ম: তা ঠিক।
কামাল: প্রশ্নটি এ জন্য যে রবীন্দ্রনাথের পেঙ্গুইন সংস্করণ নিয়ে আমাদের একজন বড় কবি প্রশ্ন রেখেছিলেন। যেখানে আমাদের অনেকেরই কবিগুরুর সব কবিতা যথেষ্ট মনোযোগ দিয়ে এখনো পড়া হয়ে ওঠেনি, সেখানে আপনার জন্য এটি একটু বেশিই হয়ে যায় না? তো এই দু’শ’ বছরের বাংলা কবিতার শত শত গ্রন্থ ও অসংখ্য কবি নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিষয়টি কেমন দাঁড়াবে তা জানার আগ্রহ রইল আমাদের।
উইলিয়ম: নির্বাচন মোটামুটি হয়েছে। এখন মাইনর পোয়েট নির্বাচন করছি। অনেক নাম পেয়েছি এদেশে এসে। তারপর কলকাতায় যাব। কোনো কিছুই তো আর পূর্ণাঙ্গ নয়।
কামাল: যাদের নাম পেয়েছেন তাদের কবিতা পড়ে দেখতে হবে না? আপনি যখন বিষয়টি প্রস্তুত করছেন তখন এটি একটি আন্তর্জাতিক রূপ পাবে আশা করি। আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এটা। হায়াৎ মাহমুদের সম্পাদনায় ৫০ জন সোভিয়েত কবির কবিতা সঙ্কলন দেখেছি। এবং এর মধ্য দিয়ে রুশ কবিতার সামগ্রিকতা আস্বাদন করতে চেয়েছি আমরা। তেমনি আপনার এ সঙ্কলনের মধ্য দিয়েই তো বিশ্বের অন্য ভাষাভাষিগণ বাংলা কবিতাকে পেতে চাইবেন। এ ক্ষেত্রে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি জানা আমাদের জন্য অনেক মূল্যবান।
উইলিয়ম: বাংলা ভাষা ও এর কবিদের প্রতিনিধিত্ব করুক এটি, এ রকমই আমার ইচ্ছা। আপনাদের সবার সহযোগিতা, মতামত, এসব নিয়েই তো এটি। আমি না জানিয়ে কিছু করছি না। হয়তো এটির খসড়া আপনাকে বা অন্যদের, আপনাদের মতো কাউকে পাঠাব, আরো পরামর্শ নেব। আমার ভেতর দিয়ে আপনাদের সবার দৃষ্টিভঙ্গিই প্রতিফলিত হবে। কবিতা নির্বাচন করার সময় মিডিয়াম লেংথ-এর কবিতা রাখছি। আমার ধারণা খুব ছোট কবিতা সব সময় ভালো হয় না। এটি একটি সমস্যা। ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ খুব ভালো কবিতা। কিন্তু খুব কম কবির পক্ষেই সম্ভব এত ছোট পরিসরে এত কিছু বলা। আবার খুব বড় কবিতাও নেব না। আমি জানি নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক হবে। কিন্তু এটি তো কোনোভাবেই এড়ানো যাবে না, চূড়ান্তে আমার দৃষ্টির প্রতিফলন ঘটবে, স্বাভাবিকভাবেই।
কামাল: একটি লেখায় উল্লেখ করেছিলেন, ‘বিশ্ব লেখক’-এর আখ্যা পেতে হলে অন্যান্য আরো অনেক গুণের সঙ্গে অন্তত এই চারটি গুণ- ক্ল্যাসিক পরম্পরার পরিধি, বোধশক্তি, মানবিক সহানুভূতি এবং কৌতুকরসের উপস্থিতি থাকতে হবে। তা বাংলাদেশের বর্তমান লেখকদের মধ্যে কারো রচনায় কি এসব গুণের সমাবেশ দেখতে পান?
উইলিয়ম: অনেকের ভেতরেই আছে। ভালো পরিমাণেই আছে। কিন্তু এগুলো তেমন প্রচার পাচ্ছে না। শুধু বই নয়, মিডিয়াতে আসা উচিত অনেক কিছুই। কবিতার উপস্থাপনে পরিবর্তন দরকার। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাচ্ছে। এখন পার্ফর্মিং আর্টের জোয়ার। টিভিতে আসতে হবে। এটি একটি খুব জোরালো মাধ্যম, ডিলান টমাসের বিষয়টি দেখুন, একটি অনুষ্ঠান হল, পরপরই ওর বইয়ের বিক্রি বেড়ে যায়। টিভির ক্ষমতা খুব বেশি। মানুষকে জাগাতে পারে। লোকজন এখনো ক্ল্যাসিক উপন্যাস পড়ছে। কিন্তু ভালো টিভি সিরিয়্যাল নেই। হলে দেখার লোক আছে। হচ্ছে না, এদিকটায় এগিয়ে আসতে হবে।
কামাল: অর্থাৎ গতিশীল হতে হবে। কোনো কিছু নির্মাণের পর নির্মাতার কাজ শেষ হচ্ছে না। উপস্থাপনও তাকেই করতে হবে!
উইলিয়ম: অনেকটা তাই। ইমোশনের পার্থক্য, তারতম্য কমে যাচ্ছে। ইন টার্মস অব মরালিটি, শিক্ষিতের মধ্যে তফাৎ থাকছে না। গ্লোবালাইজেশানের ফলে এলাকা ভিত্তিক বিশেষজ্ঞের হার দ্রুত নেমে যাচ্ছে। এখন সবাই প্রায় সবকিছু নিয়ে স্টাডি করতে পারে।
কামাল: অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে হলেও।
উইলিয়ম: হ্যাঁ, এগুলোর একটি পজিটিভ দিক আছে। ডায়ানা মারা গেলে ব্রিটিশদের প্রতিক্রিয়ায় অনেকে বলেছে যে ব্রিটিশরা আরো ইমোশন্যাল হয়ে যাচ্ছে।
কামাল: কারণটা কী?
উইলিয়ম: ঠিক কেন হচ্ছে বলতে, শিল্পে অনেক দিন ধরে ইন্টেলেকচুয়্যাল বিষয়টি চেপে ছিল। এখন আবার ইমোশন চলে আসছে।
কামাল: এই আবেগের তাড়নায় বাঙালিরা পিছিয়ে রয়েছে, আর আপনারা ইমোশনের পজিটিভ দিক নিয়ে আনন্দিত হচ্ছেন!
উইলিয়ম: হ্যাঁ, ব্রিটিশরা মনে হয় কখনোই অতটা ইমোশন্যাল হবে না। আমি অল্প বয়সে বিয়ে করেছি। দীর্ঘ বিবাহিত জীবন যাপন করছি। আজকাল লোকে একটি বিয়ে থেকে খুব বেশি চায়। ফলে অনেক কিছুই অপূর্ণ থেকে যায়। এটি ডেসট্রাক্টিভ, বিয়ে ভেঙ্গে যায়, বাচ্চাদের কষ্ট হয়। বিবাহবিচ্ছেদ সম্পর্কে এখন বেশ চিন্তাভাবনা হচ্ছে আমাদের সমাজে। চেষ্টা করা হচ্ছে সমস্যাটি থেকে বেরিয়ে আসতে। সো উই আর গোয়িং থ্রু দিস। আশা করি আমরা সফল হব। আমাদের বিষয়গুলো টিকে থাকবে।
কামাল: হ্যাঁ, আমরাও তাই আশা করি। অতীতে তো মনে হয় এ সমস্যাটা এত প্রকট ছিল না। এটার উদ্ভব কখন?
উইলিয়ম: সিক্সটিজের জেনারশনেই বেশি বিয়ে ভাঙ্গা শুরু হয়।
কামাল: তাহলে এখন এই বিয়েভাঙ্গা দম্পতিদের সন্তানেরাই বোধ হয় বিয়ে টিকিয়ে রাখার জন্য সোচ্চার হচ্ছে। কারণ কি, প্রতিক্রিয়াটি ওদের উপর বেশি কুফল বয়ে এনেছিল বলে কি?
উইলিয়ম: ঠিক তাই। তবে লোকের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনটি লক্ষ্যণীয়। মানুষেরা আরো বেশি করে সমাজমনষ্ক হচ্ছে। লন্ডনের টেগোর সেন্টার থেকে ‘ডাকঘর’ নাটকটি অভিনীত হলে দর্শক উপচে পড়ে। আসলে মানুষ পূর্ণতা পেতে চায়। তিনটি দিক: মোর্যাল, আর্ট ও রিজন। এই তিনটির সুষম বিন্যাস মানুষকে পূর্ণতার দিকে পরিচালিত করতে পারে। রবীন্দ্রনাথে পূর্ণতা খুঁজতে গেলে আমরা পাই: এক-র্যাশন্যাল, দুই-স্ট্রং মোর্যাল, এবং তিন-রিজন। আমিও এই তিনটির প্রতি নিবেদিত।
কামাল: বিজ্ঞান সম্পর্কে আপনার আগ্রহ কেমন?
উইলিয়ম: বিজ্ঞান সম্পর্কে আগ্রহ রয়েছে। স্টিফেন হকিং পড়ি, ভালো লাগে।
কামাল: সাইন্স ফিকশন?
উইলিয়ম: না, ওটি পড়ি না বোধ হয়।
কামাল: কবিতার পাঠক কমে যাওয়ার কারণ কী?
উইলিয়ম: একটি কারণ মনে হয় কবিতা খুব খারাপ হয়ে গেছে। মানে, ভালো খারাপের মাত্রা মানা হচ্ছে না। বুঝতে পারলেন কি, কী বোঝাতে চাইছি?
কামাল: মনে হয়, কিছুটা। আচ্ছা ধরুন, কোনো কারণে বাংলা সাহিত্যের প্রচুর অনুবাদ শুরু হলো, বিশ্বসাহিত্যের আসরে এটি কি কোনো প্রভাব ফেলতে সক্ষম হবে?
উইলিয়ম: একই ব্যাপার। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের অনুবাদ পাঁচবার রিপ্রিন্ট করতে হয়েছে। খুব ভালো কবিতা, গল্প ও নাটকের ক্ষেত্রেও এড্যাপ্টেশন জরুরি। রবীন্দ্রনাথের অনেক গুণ, বিভিন্ন উপাদান থাকে, অনেক ডাইমেনশান আছে তাঁর। তাঁর রচনা থেকে সিনেমা, টিভি নাটক, অপেরা, স্টেজ পার্ফমেন্স, কত কী করা যায়, অনুবাদের মাধ্যমে। একটা জিনিস দরকার, অনূদিত হওয়ার জন্য এই সকল গুণ থাকতে হবে। ব্রিটেনে উনি একদিন বলেছিলেন, আই হোপ মাই ওয়ার্কস উইল বি ইউজফুল। এটি গুরুত্বপূর্ণ। আমিও তাই মনে করি।
কামাল: হ্যাঁ, আপনার কাজ যদি অনেকের প্রয়োজন মেটাতে না পারে, মনের চিন্তার খোরাক না যোগাতে পারে, তাহলে সেটি কেউ গ্রহণ করবে কেন?
উইলিয়ম: ঠিক তাই। যেটা নিয়ে ওরা নিজেরা কাজ করতে পারবে, সেটা গ্রহণ করবে। সেজন্য এড্যাপ্টেশান দরকার। শেক্সপিয়রের পাঠক বেশি কেন? আরেকটা দিক, বেশিরভাগ সময় দেখা গেছে, অন্য একটা সোর্স থেকে নেয়া বিষয়গুলো খুব জনপ্রিয় হয়েছে। লোকের ভালো লেগেছে। আমি রবীন্দ্রনাথের দেবতার গ্রাস থেকে অপেরা করেছি। খুব পপুলার হয়েছে ওটি। পরম ভিরা গ্রুপ, খুব নাম করা ওরা, লন্ডন ও মিউনিখে অনুষ্ঠান করেছে। এ বছর স্কটল্যান্ডে করছে। খুব সফল হচ্ছে। আরো অনেক অপেরা, স্টেজ পার্ফমেন্স করতে হবে। এই ধরনের এড্যাপ্টেশান জরুরি। ভালো কাজের প্রভাব সব সময়ই ভালো, এটি আছে।
কামাল: শ্রদ্ধাভরে আপনাকে স্মরণে রেখে শেষ প্রশ্নটি করছি, ধরে নিন একটু ব্যতিক্রম... বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ কি বাঙালিদেরই করতে হবে?
উইলিয়ম: আসলে ভালো সাহিত্য-অনুবাদক খুব কম। যে-কোনো দেশে। আমার মা অনুবাদক ছিলেন। ল্যাটিন, গ্রিক প-িত, পেঙ্গুইন ক্ল্যাসিক্স-এর সম্পাদক ছিলেন বিশ বছর। উনি বলতেন, নিজের মাতৃভাষা থেকে যারা অনুবাদ করতে পারে অন্য একটি বিদেশি ভাষায়, তাদের সংখ্যা এত কম যে তিনি মাত্র দু’জনকে শনাক্ত করতে পেরেছিলেন। একজন কন্নড়/তামিল ভাষার এ কে রামানুজন এবং দ্বিতীয়জন প্রোফেসর ইউসা, হিরোশিমা বিশ্ববিদ্যালয়ের। ভারতবর্ষে অনেকেই ভালো ইংরেজি জানেন। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, সাহিত্য অনুবাদ তেমন করতে পারেন না। সত্যজিৎ বাবু খুব ভালো ইংরেজি জানতেন। কিন্তু অনুবাদ একেবারেই পারতেন না। ব্যতিক্রম হয়তো থাকতে পারে। বলব না একেবারে অসম্ভব। কিন্তু আমার সন্দেহ আছে। আসলে ওরা এখনো করতে পারেনি। কিছু অনুবাদ দেখেছি, মূল বাংলা রচনায় অনেক খুঁটিনাটি আছে, খুব সংবদ্ধ, ভালো, কিন্তু ইংরেজি অনুবাদে ওসব বোঝাতে যেয়ে বেশি বাক্য ব্যবহার করা হয়েছে। এতে বিষয়টির গুরুত্ব থাকে না।
কামাল: তা ঠিক, বাংলা ভালোভাবে শিখেছেন এমন একজন বিদেশি হয়তো তার ভাষায় এটিকে অন্যরূপে হলেও উৎকর্ষতা সহ ফুটিয়ে তুলতেন... রবীন্দ্রনাথের অনুবাদ শুরুতে তো নিজেই করেছিলেন।
উইলিয়ম: হ্যাঁ, এ জন্য উনি পরে দুঃখও করেছিলেন।
কামাল: আচ্ছা, অনেক হয়েছে, এখানে থেমে যাই আমরা। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা, ড. রাদিচে।
উইলিয়ম: হ্যাঁ, ধন্যবাদ আপনাকেও।
উইলিয়ম রাদিচের সাক্ষাৎকার
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : কামাল রাহমান
বৃহস্পতিবার, ০২ জানুয়ারী ২০২৫
ড. উইলিয়ম রাদিচের জন্ম ১৯৫১ সালে, লন্ডনে এবং প্রয়াত হন গত ১০ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে নর্থ ইংল্যান্ডে।তিনি ছিলেন একজন কবি, লেখক এবং অনুবাদক। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল এবং আফ্রিকান স্টাডিজের বাংলা ভাষার একজন সিনিয়র প্রভাষক। তাঁর গবেষণা ছিল মূলত বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়েই। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মাইকেল মধুসূদন দত্তের বেশ কয়েকটি রচনা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন।
রাদিচে দুটো ক্যারিয়ার গড়েছেন একসঙ্গে। কবি হিসেবে একটি এবং অন্যটি রবীন্দ্রনাথ তথা বাংলা ভাষার একজন বিশেষজ্ঞ-প-িতের! তাঁর মৌলিক ও সম্পাদিত গ্রন্থসংখ্যা ত্রিশ ছাড়িয়েছে। তাঁর নির্বাচিত ‘রবীন্দ্রনাথের কবিতা’ ও ‘রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প’ অনুবাদ সঙ্কলন দুটি পেঙ্গুইন বুকস থেকে প্রকাশিত হয়ে অনেকবার পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। জার্মান ভাষা থেকেও অনুবাদ করেন তিনি। ব্রিটেন, ভারত, বাংলাদেশ, উত্তর আমেরিকা, জার্মানি ও ইউরোপের অন্যান্য দেশে কবিতা ও সাহিত্য বিষয়ে অসংখ্য বক্তৃতা দিয়েছেন। বিশ্বভারতীতে ভিজিটিংপ্রফেসর হিসেবে কাজ করেছেন। প্রকৃত অর্থেই তিনি একজন রবীন্দ্র-বিশারদ। ১৯৮৭-তে মাইকেল মধুসূদন দত্তের উপর থিসিস করে অক্সফোর্ড থেকে ডি. ফিল ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ১৯৮৮ থেকে ইউনির্ভাসিটি অব লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল এ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ (SOAS)-এ বাংলার শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। ভাষা ও সাহিত্যে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য ২০০৭-এ আসাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে অনারারি ডি.লিট এবং একই বছর বাংলা একাডেমি থেকে অনারারি ফেলোশিপ দেয়া হয় তাঁকে। ২০০৯-এ কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইন্সটিটিউট হতে ‘রবীন্দ্র তত্ত্বাচার্য’ উপাধি লাভ করেন। বিবিসি ওয়ানের সকালের অনুষ্ঠান Pause of Thoughts সঙ্গে যুক্ত ছিলেন দীর্ঘদিন।
১৯৯৮ সালে ড. উইলিয়ম রাদিচে চট্টগ্রামে এসেছিলেন। অনেক ব্যস্ততার মাঝেও এ সাক্ষাৎকারটি দিয়েছিলেন তিনি। চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত সাহিত্যের ছোটকাগজ ‘১৪০০’ (সংখ্যা ৬, এপ্রিল ১৯৯৮)-এ সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছিল। এটি এখনো অনেক প্রাসঙ্গিক ও উপভোগ্য।
কামাল রাহমান: একটু অতীতচারণ করি উইলিয়ম। সাতাশির এপ্রিলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন, বাংলা একাডেমি আপনার ‘চারটি বক্তৃতা’ গ্রন্থে সঙ্কলিত করেছে ওগুলো। আপনি বলেছিলেন ওখানে, আন্তরিকভাবে ‘জীবনদেবতা’ ধারণাটি উপলব্ধি করতে পারেন আপনি, আরেকটু বিস্তৃত করবেন ওটাকে?
উইলিয়ম রাদিচে: রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতা ধারণাটির মধ্যে ব্যাপকতা রয়েছে। এটার বিস্তৃতি বিশাল। প্রকৃতির শক্তি ও কবির শক্তির মধ্যে ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। প্রকৃতিকে নির্ভর করে বেড়ে ওঠে কবির শক্তি। জীবন হচ্ছে আধার। একজন কবি প্রকৃতির শক্তির খুব বড় ধারক। কম্পিউটারের ভেতরও এক ধরনের জীবন দেয়া আছে। বিদ্যুৎ পরিচালিত। আদেশ পেলে কম্পিউটার অনেক কিছু করে। কিন্তু সে নিজে কিছু উদ্ভাবন করতে পারে না। তার ভেতর যেমন প্রোগ্রাম ঢোকানো হয়, সেভাবে সে কাজ করে। সে কি কবিতা লিখতে পারে?
কামাল: রুশরা নাকি কম্পিউটারকে কবিতা লেখা শেখাচ্ছিল?
উইলিয়ম: কম্পিউটার তো মানুষের মতো খেলতে পারে না। সে নিজে থেকে চিন্তা করতে পারে না। তাকে হয়তো একটা নিয়ন্ত্রিত জীবন দেয়া হয়েছে। অসংবেদনশীল, অনুভূতিহীন। কোনো খেলার প্রতিপক্ষ হতে পারে না সে।
কামাল: কাস্পারোভ তো কম্পিউটারের কাছে হেরে গেছে।
উইলিয়ম: তা হেরেছে। চেস প্লেয়িং সীমিত ব্যাপার। মস্তিষ্ককে একভাবে চালানোর ব্যাপার, কিন্তু শিল্পে উদ্ভাবনী শক্তি দরকার। এই জীবনদেবতা শিল্পসৃষ্টিতে, কবিতা লেখায়, সব চেয়ে বড় ভূমিকা নেয়। অন্য ধরনের কাজে মানুষের সামগ্রিক ব্যবহার কতটুকু? ক্রিয়েশান ইজ এক্সটেন্ডেড টু অল স্ফেয়ার অব লাইফ, জীবনদেবতাই তো মানুষকে মানুষ বানিয়ে তোলে। না হলে পশুরও তো জীবন আছে। একটি খুব ভালো উক্তি ‘‘মানুষ হয়ে ওঠাই হচ্ছে এক ধরনের শিল্প’’। তা মানুষের ভেতর তার শৈল্পিক সত্তা তার সুকুমার দিকগুলোকে জাগরিত করে। এখানেই জীবনদেবতার মূল ভূমিকা। রবীন্দ্রনাথ এটাকে খুব উপলব্ধি করতেন। আমিও তাঁর কাছে শিখেছি এটা।
কামাল: সেখানে আপনি উল্লেখ করেছেন ‘‘আমার মৃত্যুর পর যদি কোনো সহৃদয় পাঠক খুঁজে বের করতে চান আমার কবিতা ও রবীন্দ্রনাথের কবিতার মধ্যে প্রধান সম্পর্ক কোথায় অথবা কোন ক্ষেত্রে আমি রবীন্দ্রনাথের কবিতা দ্বারা প্রভাবিত, হয়তো তাঁরা বলবেন আমিও জীবনদেবতার ইচ্ছার তাড়নায় লিখতাম।’’ আপনি কি এখনো ভাবেন যে জীবনদেবতার ইচ্ছার তাড়নায়ই এখনো সবকিছু করছেন?
উইলিয়ম: কোনো সন্দেহ নেই। আমার জীবনদেবতাই আমাকে দিয়ে এসব করিয়ে নিচ্ছে। প্রকৃতির শক্তি, যেটার সঙ্গে জীবনের সম্পর্ক, যেটা জৈবিক, আর কবির শক্তি, যেটা অনেকাংশে দৈবিকও, অবশ্য আমি কখনো বলব না ভালো কবিতা ভগবান থেকে আসে, কিংবা এটা দেব-প্রদত্ত। অর্থাৎ গড গিফটেড। কিন্তু এটার সঙ্গে একটা দৈবিক অনুভব কিংবা রহস্যের যোগসূত্র রয়েছে। এগুলোর সমন্বয়ে, অর্থাৎ জীবনদেবতার এই কন্সেপ্ট, হ্যাঁ, এটা এখনও আমার জীবনকে চালাচ্ছে।
কামাল: রবীন্দ্রনাথের মানসী থেকে বলাকা পর্যন্ত লেখা কবিতাগুলোকে সর্বোজ্জ্বল বলা হয়ে থাকে, বলাকা পর্বকেই সর্বশেষ পরিণত ও পরিপক্ব পর্ব বলে চিহ্নিত করা হয়েছে, আমরা কি ধরে নেব সে সময়টায় রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতা সবচেয়ে বেশি প্রাণোচ্ছল ছিল?
উইলিয়ম: রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতা কখনোই ¤্রয়িমান ছিল না। একটা ভালো কবিতা লেখার জন্য এক ধরনের শক্তি দরকার। একটা বীজ থেকে মহীরুহের জন্ম এক ধরনের রহস্যের মধ্যে, সেই রহস্য আবিষ্কারের নেশা মানুষের ভেতর থাকতে হবে। রবীন্দ্রনাথ সেই রহস্যের সূত্র সম্ভবত আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন। পরবর্তীতে তাঁর ভেতর হয়তো সেই উদগ্র নেশাটি কমে এসেছিল, প্রকৃতিগত কারণেই। প্রকৃতির শক্তি ও কবির শক্তির মধ্যে একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। একজন কবি প্রকৃতির শক্তিকে অন্বেষণ করেন। এটাকে খুব ভালোভাবে করতে চাইলে বা সক্ষম হলে সে প্রকৃতির শক্তি নিজের মধ্যে ধারণ করতে পারে। এটা রবীন্দ্রনাথের ধারণা, আমিও এটা বিশ্বাস করি। প্রকৃতিগত কারণেই একসময় বাঁধন শিথিল হয়, এবং ওটার বিলুপ্তিও ঘটে।
কামাল: তাই। বলাকা পরবর্তী, অর্থাৎ অন্তপর্বে (২৯-৪১) ‘পুনশ্চ’ থেকে ‘শ্যামলী’ পর্বটিকেই ধরি, এখানে দেখা যায় তিনি দৈনন্দিন জীবনের প্রাত্যহিকতাকে আঁকড়ে ধরছেন (শ্যামলীর ‘ছেলেটা’), বলাকা পর্বের যৌবন-মদমত্ততা নেই, বহু-বর্ণিল উচ্ছ্বাস থেকে এখানে কবির মোহমুক্তি ঘটল কি?
উইলিয়ম: না, মোহমুক্তি ঘটেনি। সৃষ্টিশীল একজন মানুষ আজীবন একটি বিষয়কেই আঁকড়ে ধরে থাকেন না। একজন শিল্পী সারা জীবন পরিবর্তনশীল প্রকৃতি থেকে গ্রহণ করেন। প্রকৃতিই সকল সৌন্দর্যের আধার। কিন্তু একটা মস্ত বিপদ, এক ধরনের... কী বলব, ইন সাম কাইন্ড অব ক্রিয়েটিভ পাওয়ার... যদি ওদের, ঐ যে, জীবনদেবতা ক্রিয়াশীল না থাকলে হয়তো কিছু করত না, এই পরিবর্তনগুলো সবার জীবনেই আসে, নতুন মোহে হয়তো কখনো আরো নতুন উদ্যমে জড়িয়ে পড়ে। রবীন্দ্রনাথের প্রধান উদ্দেশ্য, আমার যতটুকু মনে হয়, তিনি সারা জীবন বাস্তবিকতারই প্রকাশ ঘটাতে চেয়েছেন, রেসপন্স টু ন্যাচার তাঁর ছিল সাবলীল, তাঁর একটা কাব্যিক দিক, একটা গদ্যের দিক, এ দুটোর মধ্যেও কখনো বিরোধ ঘটেনি, ছিন্নপত্র গ্রন্থাকারে প্রকাশের আগে প্রবন্ধের একটা বই করেছিলেন তিনি, ওটির তিনটি অংশ ছিল, ‘জল’- অর্থাৎ তাঁর কল্পনা, ‘স্থল’- মানে বাস্তবতা, রিয়্যালিস্টিক, তারপর ‘ঘাট’- সেটি হচ্ছে যোগসূত্র। অর্থাৎ সবকিছুতেই তিনি ঘাটের বিষয়টিকে এনেছেন, মিলন, মিটিং অব ওয়েলথ এন্ড স্পিরিট, এটিকে তিনি গুরুত্ব দিতেন, তাঁর ভেতরে কখনো নিস্পৃহতা আসেনি।
কামাল: ‘জীবনদেবতার তাড়না’ আর ‘সৃষ্টিশীল কল্পনা’ এ দুয়ের মধ্যে যোগসূত্র কিংবা পার্থক্য কোথায়? ধরুন আপনার ভেতর জীবনদেবতার তাড়না রয়েছে, কিন্তু সৃষ্টিশীল কল্পনা ততটা জোরালো নয়, কিংবা উল্টোটি, ফলাফল কী দাঁড়ায়?
উইলিয়ম: পার্থক্য কোথায়, জীবনদেবতার তাড়নায় সে কল্পনা করে, সৃষ্টিশীল কল্পনা, আর কল্পনা যদি সৃষ্টিশীল না হয় জীবনদেবতার অস্তিত্ব কোথায়?
কামাল: আপনার মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথের কবিতার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক খোঁজার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন, এখানে জৈবিক অনুপস্থিতির প্রশ্নটি কেন এল? ধরে নিচ্ছি রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতা তাঁর জীবদ্দশায় তাঁকে তাড়িত করেছিল, কিন্তু সেই জীবনদেবতা কি তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে পরোক্ষে আমাদের সত্তার ভেতর এখনো সচল বা অস্তিত্বশীল নয়? তাঁর সৃষ্টি হয়তো থেমে গেছে, কিন্তু জীবনদেবতার কি অবলুপ্তি ঘটেছে?
উইলিয়ম: তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ এখনো আমাদের মধ্যে রয়েছেন।
কামাল: প্রতিভার সঙ্গে জীবনদেবতার সম্পর্ক কী?
উইলিয়ম: প্রতিভা না থাকলে জীবনদেবতার উপলব্ধি কিংবা উপস্থিতি টের পাওয়া মুস্কিল। দার্শনিক দিক থেকে আমি রবীন্দ্রনাথ দ্বারা খুব প্রভাবিত। রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণেই আমি তাঁর অনুবাদ করতে পারছি।
কামাল: তাঁকে নিজের ভেতর ধারণ করতে পারছেন, লালন করছেন...
উইলিয়ম: ঠিক তাই, আমি একটা ঘটনা বলি, ইন্টারেস্টিং, এ শতাব্দীর শুরুতে এফ এম আলেকজান্ডার নামে একজন গুণী ব্যক্তি ছিলেন আমাদের দেশে। তিনি শেক্সপীয়ার আবৃত্তি করতেন। উনি একবার ভাবনায় পড়েন তাঁর স্বরের গ-গোল নিয়ে। তিনি খুব ভাবলেন গলার ত্রুটি সারানোর জন্য এবং এই সূত্র ধরেই তিনি পৌঁছে গেলেন একটি সফল আবিষ্কারে। এখন সেটিকে আলেকজান্ডার টেকনিক বলা হয়। এটি হচ্ছে সমগ্র শরীরের বিজ্ঞানভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ। আমরা প্রায় সময়ই অযথা শরীরের বিভিন্ন অংশকে, বিভিন্ন পেশিকে ব্যবহার করি। অথচ এটি প্রয়োজনের অতিরিক্ত। তিনি ক্লাস নিতেন, ছাত্রদের ব্যাখ্যা করে বোঝাতেন কীভাবে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সুনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শরীরকে সুস্থ রাখা যায়। আর শারীরিক সুস্থতা না থাকলে মনের কাজ তো হতে পারে না। আমি আলেকজান্ডার টেকনিকটা শিখেছি। এখন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। আমার খুব মনে আছে, ঠিক আটাশ বছর বয়সে আমি মাইগ্রেনের ব্যথায় কাবু হয়ে পড়ি। এটি একটু অন্য ধরনের, এই জিনিসটি আজো ধরা যায়নি। এর সূত্র জানা নেই। আলেকজান্ডার টেকনিক ব্যবহার করে এখন ভালো আছি আমি। আগের মতো মনে করি না যে আমি অসুস্থ, ধরে নিয়েছি এটা আমার সমস্যা, এন্ড সামটাইম আই হ্যাভ টু ফেইস ইট।
কামাল: এন্ড সলভ ইট।
উইলিয়ম: ইয়েস, সলভ ইট। এটিকে মেনে নিয়েছি। গত দু’শ’ বছরের মধ্যে সবকিছু এত বদলে গেছে, আমরা প্রকৃতি প্রদত্ত ব্যপারগুলো ভুলে গেছি। ছোট ছেলেমেয়েকে লক্ষ্য করুন, স্বভাব-বশত ওরা অনেক কিছু প্রকৃতি থেকে শেখে।
কামাল: জাগতিক নিয়মেই জেনে যায়, বেসিক ইন্সটিঙ্কট।
উইলিয়ম: হ্যাঁ, এই নতুন যান্ত্রিক যাত্রার সঙ্গে মানুষ ন্যাচার্যাল কম্যান্ডগুলো ভুলে যাচ্ছে। আলেকজান্ডার বলেছিলেন, এই সব ক্ষমতা আমাদের মধ্যে ইন্সটিঙ্কটলি ছিল। এখন আবার চেষ্টা করে শিখতে হচ্ছে, তো আমাদের জীবনদেবতা এক্ষেত্রে আমাদের অস্তিত্বকে জাগাতে আবার আহ্বান জানায়, প্রকৃতিকে অনুসন্ধান করতে বলে...
কামাল: আপনার কবিতা নিয়ে কথা বলি এবার, আপনি বলেছিলেন আপনার জীবনদেবতা উপস্থিত রয়েছে ‘‘অড’’ কবিতাটিতে। আপনার এ কবিতাটির একাংশে দেখি-
Whose motionless facial loveliness discerned no
Merit or opprobrium
But only the eternal progress of self-correction
Towards equilibrium!
এই ‘সেল্ফ-কারেকশান’-এর সূত্র কোথায়? যেখানে আপনি শুরুতে বলেছেন মেয়েটি প্রকৃতির রিরংসা উন্মুক্ত করে, আমরা কি তাহলে ধরে নেব জীবনদেবতাকে অপেক্ষা করতে হয় প্রকৃতির রিরংসা উন্মোচনের জন্য?
উইলিয়ম: এখানে মেয়েটি প্রকৃতিরই অংশ, কোনো পার্থক্য নেই। ক্রিয়েটিভ এপ্রোচ অব লিভিং দেখানোর চেষ্টা আছে, ইন পার্সোন্যাল লেভেল, ইন কসমিক লেভেল, প্রগ্রেসিং টু সাম কাইন্ড অব গ্রেটার... বিশ্বাস এবং পৃথিবীর মধ্যে কন্ট্রাডিকশান, আওয়ার পার্সোন্যাল কন্টিনিউটি, অন দ্য আদার হ্যান্ড হরর, মিজারেবল পার্ট অব লাইফ... এই সকল কন্ট্রাডিকশান, ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে জীবন এক্ষেত্রে শেখে, আত্মশুদ্ধি ঘটে, এই এসব আর কি।
কামাল: চিত্রকর অথবা ঔপন্যাসিকের উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে আর্লের বিষয়টিকে চমৎকার বর্ণনা করেছেন-
Who can watch and record the things around them
Freely
And are not enslaved by a merciless endogeneity
†k‡l e‡j‡Qb-
In joy, he considers himself both musician and
Painter,
In depression, he considers himself to be neither.
এই বক্তব্যের সঙ্গে আপনার জীবনদেবতার পার্থক্য কোথায়? আমরা কি ধরে নেব আর্লের জীবনদেবতার সঙ্গে আপনার জীবনদেবতার মিল কিংবা প্রগাঢ় বন্ধুত্ব রয়েছে, অথবা বিপরীতটি?
উইলিয়ম: হ্যাঁ, এই কবিতাটিতে আমার নিজের কথা আছে, এটি বড় কবিতা, সবটুকু পড়তে হবে, না হয় আপনি বুঝবেন না, বুঝতে পারেননি, ঐ যে বলেছি টেকনিকের কথা, ক্রিয়েটিভ কন্ট্রোল ইন ক্রিয়েটিভ লাইফ, এবং অন্যত্র, সব জায়গায়, এটি ক্রিয়েশানে খুব সাহায্য করে। এখানে ধর্মের কোনো যোগ নেই। এটি মেডিক্যাল থেরাপি। পশুদের কিছু শিখতে হয় না, মানুষের শিখতে হয়। সেক্স ইন্সটিঙ্কট, ইউজ অব আওয়ার বডি, ন্যাচারাল কন্ট্রোল ইন দ্য ওয়ার্ল্ড... নিরোদ সি চৌধুরী ভালো বলেছেন, উই হ্যাভ লস্ট ন্যাচারাল কন্ট্রোল, যেটি এমনকি পশুরাও এখনো ভোলেনি।
কামাল: হুঁ... ইভেন দে মেইনটেইন দেয়ার মেটিং সীজন...
উইলিয়ম: ঠিক তাই, তবে নিরোদ বাবু খুব নৈরাশ্যবাদী। তাঁর ধারণা মানুষের কোনো ভবিষ্যত নেই।
কামাল: এটা কী করে হয়!
উইলিয়ম: আমি তো বিপরীত ধারণাই পোষণ করি, অনেক দূর এগিয়েছে মানুষ, আরো এগোবে।
কামাল: বুঝতে পারি আপনার জীবনদেবতা ঋদ্ধ হয়েছে রোম্যান্টিক ও ধ্রুপদী প্রভাবের সংমিশ্রণে, আমরা যেহেতু আপনার কবিতাকে ঘনিষ্ঠভাবে পেতে চাই, সেজন্যই আপনার জীবনদেবতার প্রতি এ অন্বেষণ। যাহোক, আপনার ‘টু মেডিটেশান’ কবিতায় লক্ষ্য করি ঐতিহাসিক ভদ্রমানুষটি কাব্যিক জগত থেকে ফিরে আসেন অভ্যেসের জগতে, যেগুলো তার পক্ষে ভেঙ্গে বেরোনো সম্ভব নয়, কিন্তু একজন কবি তো অনন্ত অনিশ্চিতের উদ্দেশ্যেও যাত্রা করতে পারেন, তার ফিরে না এলেও চলে, এখানে ঐতিহাসিকের প্রত্যাবর্তন কি রোম্যান্টিকতায় না ধ্রুপদী জগতে?
উইলিয়ম: ধ্রুপদী জগতে।
কামাল: রবীন্দ্রনাথের ‘ওগো আমার ভোরের চড়–ই পাখি’ কবিতা অনুবাদ করতে যেয়ে লিখেছিলেন- ‘আমার জীবনদেবতাও আমাকে এ ধরনের আনন্দময়, হাসি-খুশি কবিতা লিখতে শিখিয়ে দেবেন’ তা এখন কি এ রকম হাসি-খুশি কবিতা লিখছেন?
উইলিয়ম: মাঝেমধ্যে লিখছি।
কামাল: একটা শোনাবেন?
উইলিয়ম: এ রকম একটা কবিতা দ্য রিট্রিট বইটিতে আছে, আমার ছোট মেয়েটি সম্পর্কে। আমি প্রায় সব ধরনেরই লিখি। কোনো নির্দিষ্টতা নেই। ভবিষ্যতে স্যাটায়ার লিখতে চাচ্ছি।
কামাল: হিউমার বা...
উইলিয়ম: না, ঠিক রসিকতা বা এ ধরনের কিছু আমার হয় না।
কামাল: প্রসঙ্গান্তরে আসি, বাংলা কবিতার দু’শ’ বছরের বিবর্তন নিয়ে কাজ করছেন এখন, কিছু বলবেন এ নিয়ে?
উইলিয়ম: হ্যাঁ, দু’শ’ বছরের দু’শ’টি কবিতা নির্বাচনের ইচ্ছে আছে। এটি একটি শ্রমসাধ্য কাজ, চেষ্টা করছি, এটি হয়তো দু’ভাবেও হয়ে যেতে পারে। মূল বাংলা টেক্সটের সাথে গদ্য অনুবাদ করে দেয়া হবে, বাংলা যারা পড়তে জানে না তাদের জন্য, টীকা থাকবে, ভূমিকা থাকবে, এটি একাডেমিক কাজ হবে। পরে হয়তো একটি পেঙ্গুইন বা অন্য কোনো সংস্করণ হবে। পুনর্নিবাচনও হতে পারে। একাডেমিক কাজটি দু’তিন বছরের মধ্যে হয়ে যাবে। এটির প্রতিক্রিয়া, সমালোচনা, পরামর্শ ইত্যাদি হয়তো পাওয়া যাবে। তখন আরেকবার ভাবা যাবে।
কামাল: নিঃসন্দেহে এটি একটি ব্যাপক কাজ। কবিতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে কি পন্থা নিয়েছেন?
উইলিয়ম: বড় কবি নির্বাচনে তেমন সমস্যা হয়নি। তাছাড়া একটি প্রশ্নপত্র পাঠিয়েছিলাম আপনাদের অনেকের কাছে। ভালোই জবাব পেয়েছি। অনেকেরই মতামত আছে এবং খুব কমন কিছু কবির উল্লেখ প্রায় সবার উত্তরেই আছে। তারপর এরূপ একটি সঙ্কলনে রবীন্দ্রনাথের কটি কবিতা থাকতে পারে, এ প্রশ্নটির জবাবে গড় সংখ্যা পাওয়া গেছে ৩০টি, তারপর জীবনানন্দ ৮টি, নজরুল৭/৮টি, সুধীন ৬টি, এরকম দুই বাংলার প্রধান কবিদের নাম প্রায় সবাই একই রকম জানিয়েছেন। আমি সবার মতামত নিচ্ছি।
কামাল: আপনার পক্ষে নিরপেক্ষ হওয়া সম্ভব আশা করি। কিন্তু আপনার আওতায় দু’শ’ বছরকে কীভাবে ধারণ করছেন?
উইলিয়ম: বিভিন্নভাবে এটিকে দেখছি আমি। লাইব্রেরি থেকে অনেক সঙ্কলন পাচ্ছি। তারপর বিভিন্নজনের পাঠানো বইপত্র, বাজার থেকে কেনা, এসব বইপত্র, প্রবন্ধ প্রভৃতি কাজে আসছে। একটি বিষয় আমি খুঁজে দেখছি, কোনো কোনো সময়ে কিছু কবিতা জনপ্রিয় হয়েছে, এটির পেছনে কী আছে। এটি যদি উপলব্ধি করা যায়, বাঙালি চরিত্রটিও কিছুটা হয়তো ধরা যাবে। জনপ্রিয় কবিতাগুলোও বিবেচনায় আনা হচ্ছে।
কামাল: একটা বিষয় হয়তো লক্ষ্য রাখা যেতে পারে, অনেক সময় রাজনৈতিক কারণে অনেক কবিতা খুব জনপ্রিয় হয়েছে এখানে। কিন্তু সে তুলনায় কবিতাটির শিল্পমান ততটা নেই। এমনকি ঐ কবিরই তুলনামূলকভাবে অনেক ভালো কবিতা রয়েছে, যা পাঠক পায়নি। সেক্ষেত্রে তাঁর জনপ্রিয় কবিতাটি নির্বাচন করা হলে তাঁর শিল্পের প্রতি সুবিচার করা হবে কিনা? তাছাড়া জনপ্রিয়তা এদেশে এখনো শিল্প বিচারের মানদ- হয়ে ওঠেনি। শিল্পবোধ-সম্পন্ন মানুষের সংখ্যা খুব কম এখানে। কথাটি হয়তো অন্যত্রও প্রযোজ্য হতে পারে। জনপ্রিয়তা তো অনেক সময়ই খুব সাময়িক।
উইলিয়ম: তা ঠিক।
কামাল: প্রশ্নটি এ জন্য যে রবীন্দ্রনাথের পেঙ্গুইন সংস্করণ নিয়ে আমাদের একজন বড় কবি প্রশ্ন রেখেছিলেন। যেখানে আমাদের অনেকেরই কবিগুরুর সব কবিতা যথেষ্ট মনোযোগ দিয়ে এখনো পড়া হয়ে ওঠেনি, সেখানে আপনার জন্য এটি একটু বেশিই হয়ে যায় না? তো এই দু’শ’ বছরের বাংলা কবিতার শত শত গ্রন্থ ও অসংখ্য কবি নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিষয়টি কেমন দাঁড়াবে তা জানার আগ্রহ রইল আমাদের।
উইলিয়ম: নির্বাচন মোটামুটি হয়েছে। এখন মাইনর পোয়েট নির্বাচন করছি। অনেক নাম পেয়েছি এদেশে এসে। তারপর কলকাতায় যাব। কোনো কিছুই তো আর পূর্ণাঙ্গ নয়।
কামাল: যাদের নাম পেয়েছেন তাদের কবিতা পড়ে দেখতে হবে না? আপনি যখন বিষয়টি প্রস্তুত করছেন তখন এটি একটি আন্তর্জাতিক রূপ পাবে আশা করি। আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এটা। হায়াৎ মাহমুদের সম্পাদনায় ৫০ জন সোভিয়েত কবির কবিতা সঙ্কলন দেখেছি। এবং এর মধ্য দিয়ে রুশ কবিতার সামগ্রিকতা আস্বাদন করতে চেয়েছি আমরা। তেমনি আপনার এ সঙ্কলনের মধ্য দিয়েই তো বিশ্বের অন্য ভাষাভাষিগণ বাংলা কবিতাকে পেতে চাইবেন। এ ক্ষেত্রে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি জানা আমাদের জন্য অনেক মূল্যবান।
উইলিয়ম: বাংলা ভাষা ও এর কবিদের প্রতিনিধিত্ব করুক এটি, এ রকমই আমার ইচ্ছা। আপনাদের সবার সহযোগিতা, মতামত, এসব নিয়েই তো এটি। আমি না জানিয়ে কিছু করছি না। হয়তো এটির খসড়া আপনাকে বা অন্যদের, আপনাদের মতো কাউকে পাঠাব, আরো পরামর্শ নেব। আমার ভেতর দিয়ে আপনাদের সবার দৃষ্টিভঙ্গিই প্রতিফলিত হবে। কবিতা নির্বাচন করার সময় মিডিয়াম লেংথ-এর কবিতা রাখছি। আমার ধারণা খুব ছোট কবিতা সব সময় ভালো হয় না। এটি একটি সমস্যা। ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ খুব ভালো কবিতা। কিন্তু খুব কম কবির পক্ষেই সম্ভব এত ছোট পরিসরে এত কিছু বলা। আবার খুব বড় কবিতাও নেব না। আমি জানি নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক হবে। কিন্তু এটি তো কোনোভাবেই এড়ানো যাবে না, চূড়ান্তে আমার দৃষ্টির প্রতিফলন ঘটবে, স্বাভাবিকভাবেই।
কামাল: একটি লেখায় উল্লেখ করেছিলেন, ‘বিশ্ব লেখক’-এর আখ্যা পেতে হলে অন্যান্য আরো অনেক গুণের সঙ্গে অন্তত এই চারটি গুণ- ক্ল্যাসিক পরম্পরার পরিধি, বোধশক্তি, মানবিক সহানুভূতি এবং কৌতুকরসের উপস্থিতি থাকতে হবে। তা বাংলাদেশের বর্তমান লেখকদের মধ্যে কারো রচনায় কি এসব গুণের সমাবেশ দেখতে পান?
উইলিয়ম: অনেকের ভেতরেই আছে। ভালো পরিমাণেই আছে। কিন্তু এগুলো তেমন প্রচার পাচ্ছে না। শুধু বই নয়, মিডিয়াতে আসা উচিত অনেক কিছুই। কবিতার উপস্থাপনে পরিবর্তন দরকার। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাচ্ছে। এখন পার্ফর্মিং আর্টের জোয়ার। টিভিতে আসতে হবে। এটি একটি খুব জোরালো মাধ্যম, ডিলান টমাসের বিষয়টি দেখুন, একটি অনুষ্ঠান হল, পরপরই ওর বইয়ের বিক্রি বেড়ে যায়। টিভির ক্ষমতা খুব বেশি। মানুষকে জাগাতে পারে। লোকজন এখনো ক্ল্যাসিক উপন্যাস পড়ছে। কিন্তু ভালো টিভি সিরিয়্যাল নেই। হলে দেখার লোক আছে। হচ্ছে না, এদিকটায় এগিয়ে আসতে হবে।
কামাল: অর্থাৎ গতিশীল হতে হবে। কোনো কিছু নির্মাণের পর নির্মাতার কাজ শেষ হচ্ছে না। উপস্থাপনও তাকেই করতে হবে!
উইলিয়ম: অনেকটা তাই। ইমোশনের পার্থক্য, তারতম্য কমে যাচ্ছে। ইন টার্মস অব মরালিটি, শিক্ষিতের মধ্যে তফাৎ থাকছে না। গ্লোবালাইজেশানের ফলে এলাকা ভিত্তিক বিশেষজ্ঞের হার দ্রুত নেমে যাচ্ছে। এখন সবাই প্রায় সবকিছু নিয়ে স্টাডি করতে পারে।
কামাল: অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে হলেও।
উইলিয়ম: হ্যাঁ, এগুলোর একটি পজিটিভ দিক আছে। ডায়ানা মারা গেলে ব্রিটিশদের প্রতিক্রিয়ায় অনেকে বলেছে যে ব্রিটিশরা আরো ইমোশন্যাল হয়ে যাচ্ছে।
কামাল: কারণটা কী?
উইলিয়ম: ঠিক কেন হচ্ছে বলতে, শিল্পে অনেক দিন ধরে ইন্টেলেকচুয়্যাল বিষয়টি চেপে ছিল। এখন আবার ইমোশন চলে আসছে।
কামাল: এই আবেগের তাড়নায় বাঙালিরা পিছিয়ে রয়েছে, আর আপনারা ইমোশনের পজিটিভ দিক নিয়ে আনন্দিত হচ্ছেন!
উইলিয়ম: হ্যাঁ, ব্রিটিশরা মনে হয় কখনোই অতটা ইমোশন্যাল হবে না। আমি অল্প বয়সে বিয়ে করেছি। দীর্ঘ বিবাহিত জীবন যাপন করছি। আজকাল লোকে একটি বিয়ে থেকে খুব বেশি চায়। ফলে অনেক কিছুই অপূর্ণ থেকে যায়। এটি ডেসট্রাক্টিভ, বিয়ে ভেঙ্গে যায়, বাচ্চাদের কষ্ট হয়। বিবাহবিচ্ছেদ সম্পর্কে এখন বেশ চিন্তাভাবনা হচ্ছে আমাদের সমাজে। চেষ্টা করা হচ্ছে সমস্যাটি থেকে বেরিয়ে আসতে। সো উই আর গোয়িং থ্রু দিস। আশা করি আমরা সফল হব। আমাদের বিষয়গুলো টিকে থাকবে।
কামাল: হ্যাঁ, আমরাও তাই আশা করি। অতীতে তো মনে হয় এ সমস্যাটা এত প্রকট ছিল না। এটার উদ্ভব কখন?
উইলিয়ম: সিক্সটিজের জেনারশনেই বেশি বিয়ে ভাঙ্গা শুরু হয়।
কামাল: তাহলে এখন এই বিয়েভাঙ্গা দম্পতিদের সন্তানেরাই বোধ হয় বিয়ে টিকিয়ে রাখার জন্য সোচ্চার হচ্ছে। কারণ কি, প্রতিক্রিয়াটি ওদের উপর বেশি কুফল বয়ে এনেছিল বলে কি?
উইলিয়ম: ঠিক তাই। তবে লোকের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনটি লক্ষ্যণীয়। মানুষেরা আরো বেশি করে সমাজমনষ্ক হচ্ছে। লন্ডনের টেগোর সেন্টার থেকে ‘ডাকঘর’ নাটকটি অভিনীত হলে দর্শক উপচে পড়ে। আসলে মানুষ পূর্ণতা পেতে চায়। তিনটি দিক: মোর্যাল, আর্ট ও রিজন। এই তিনটির সুষম বিন্যাস মানুষকে পূর্ণতার দিকে পরিচালিত করতে পারে। রবীন্দ্রনাথে পূর্ণতা খুঁজতে গেলে আমরা পাই: এক-র্যাশন্যাল, দুই-স্ট্রং মোর্যাল, এবং তিন-রিজন। আমিও এই তিনটির প্রতি নিবেদিত।
কামাল: বিজ্ঞান সম্পর্কে আপনার আগ্রহ কেমন?
উইলিয়ম: বিজ্ঞান সম্পর্কে আগ্রহ রয়েছে। স্টিফেন হকিং পড়ি, ভালো লাগে।
কামাল: সাইন্স ফিকশন?
উইলিয়ম: না, ওটি পড়ি না বোধ হয়।
কামাল: কবিতার পাঠক কমে যাওয়ার কারণ কী?
উইলিয়ম: একটি কারণ মনে হয় কবিতা খুব খারাপ হয়ে গেছে। মানে, ভালো খারাপের মাত্রা মানা হচ্ছে না। বুঝতে পারলেন কি, কী বোঝাতে চাইছি?
কামাল: মনে হয়, কিছুটা। আচ্ছা ধরুন, কোনো কারণে বাংলা সাহিত্যের প্রচুর অনুবাদ শুরু হলো, বিশ্বসাহিত্যের আসরে এটি কি কোনো প্রভাব ফেলতে সক্ষম হবে?
উইলিয়ম: একই ব্যাপার। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের অনুবাদ পাঁচবার রিপ্রিন্ট করতে হয়েছে। খুব ভালো কবিতা, গল্প ও নাটকের ক্ষেত্রেও এড্যাপ্টেশন জরুরি। রবীন্দ্রনাথের অনেক গুণ, বিভিন্ন উপাদান থাকে, অনেক ডাইমেনশান আছে তাঁর। তাঁর রচনা থেকে সিনেমা, টিভি নাটক, অপেরা, স্টেজ পার্ফমেন্স, কত কী করা যায়, অনুবাদের মাধ্যমে। একটা জিনিস দরকার, অনূদিত হওয়ার জন্য এই সকল গুণ থাকতে হবে। ব্রিটেনে উনি একদিন বলেছিলেন, আই হোপ মাই ওয়ার্কস উইল বি ইউজফুল। এটি গুরুত্বপূর্ণ। আমিও তাই মনে করি।
কামাল: হ্যাঁ, আপনার কাজ যদি অনেকের প্রয়োজন মেটাতে না পারে, মনের চিন্তার খোরাক না যোগাতে পারে, তাহলে সেটি কেউ গ্রহণ করবে কেন?
উইলিয়ম: ঠিক তাই। যেটা নিয়ে ওরা নিজেরা কাজ করতে পারবে, সেটা গ্রহণ করবে। সেজন্য এড্যাপ্টেশান দরকার। শেক্সপিয়রের পাঠক বেশি কেন? আরেকটা দিক, বেশিরভাগ সময় দেখা গেছে, অন্য একটা সোর্স থেকে নেয়া বিষয়গুলো খুব জনপ্রিয় হয়েছে। লোকের ভালো লেগেছে। আমি রবীন্দ্রনাথের দেবতার গ্রাস থেকে অপেরা করেছি। খুব পপুলার হয়েছে ওটি। পরম ভিরা গ্রুপ, খুব নাম করা ওরা, লন্ডন ও মিউনিখে অনুষ্ঠান করেছে। এ বছর স্কটল্যান্ডে করছে। খুব সফল হচ্ছে। আরো অনেক অপেরা, স্টেজ পার্ফমেন্স করতে হবে। এই ধরনের এড্যাপ্টেশান জরুরি। ভালো কাজের প্রভাব সব সময়ই ভালো, এটি আছে।
কামাল: শ্রদ্ধাভরে আপনাকে স্মরণে রেখে শেষ প্রশ্নটি করছি, ধরে নিন একটু ব্যতিক্রম... বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ কি বাঙালিদেরই করতে হবে?
উইলিয়ম: আসলে ভালো সাহিত্য-অনুবাদক খুব কম। যে-কোনো দেশে। আমার মা অনুবাদক ছিলেন। ল্যাটিন, গ্রিক প-িত, পেঙ্গুইন ক্ল্যাসিক্স-এর সম্পাদক ছিলেন বিশ বছর। উনি বলতেন, নিজের মাতৃভাষা থেকে যারা অনুবাদ করতে পারে অন্য একটি বিদেশি ভাষায়, তাদের সংখ্যা এত কম যে তিনি মাত্র দু’জনকে শনাক্ত করতে পেরেছিলেন। একজন কন্নড়/তামিল ভাষার এ কে রামানুজন এবং দ্বিতীয়জন প্রোফেসর ইউসা, হিরোশিমা বিশ্ববিদ্যালয়ের। ভারতবর্ষে অনেকেই ভালো ইংরেজি জানেন। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, সাহিত্য অনুবাদ তেমন করতে পারেন না। সত্যজিৎ বাবু খুব ভালো ইংরেজি জানতেন। কিন্তু অনুবাদ একেবারেই পারতেন না। ব্যতিক্রম হয়তো থাকতে পারে। বলব না একেবারে অসম্ভব। কিন্তু আমার সন্দেহ আছে। আসলে ওরা এখনো করতে পারেনি। কিছু অনুবাদ দেখেছি, মূল বাংলা রচনায় অনেক খুঁটিনাটি আছে, খুব সংবদ্ধ, ভালো, কিন্তু ইংরেজি অনুবাদে ওসব বোঝাতে যেয়ে বেশি বাক্য ব্যবহার করা হয়েছে। এতে বিষয়টির গুরুত্ব থাকে না।
কামাল: তা ঠিক, বাংলা ভালোভাবে শিখেছেন এমন একজন বিদেশি হয়তো তার ভাষায় এটিকে অন্যরূপে হলেও উৎকর্ষতা সহ ফুটিয়ে তুলতেন... রবীন্দ্রনাথের অনুবাদ শুরুতে তো নিজেই করেছিলেন।
উইলিয়ম: হ্যাঁ, এ জন্য উনি পরে দুঃখও করেছিলেন।
কামাল: আচ্ছা, অনেক হয়েছে, এখানে থেমে যাই আমরা। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা, ড. রাদিচে।
উইলিয়ম: হ্যাঁ, ধন্যবাদ আপনাকেও।