alt

সাময়িকী

মোহিত কামালের কার্তিকে বসন্ত

হার না মানা নারী জীবনের উপাখ্যান

আব্দুল বারী

: বৃহস্পতিবার, ০২ জানুয়ারী ২০২৫

মোহিত কামাল / জন্ম : ২ জানুয়ারি ১৯৬০

আজ মোহিত কামালের ৬৫তম জন্মদিন। শুভেচ্ছা

ক্ষমতা আর রাজনীতির আশ্রয়ে সমাজে বেড়ে চলেছে দুর্বৃত্তদের দৌরাত্ম্য। মাস্তানি আর কদর্য ভাষা জীবনকে করে তুলছে দুর্বিসহ। আর এসব দুর্বৃত্তদের সহজ নিশানা স্কুল-কলেজগামী কিশোরী। এই বয়স থেকে শুরু করে যে কোনও বয়সের নারীকেই ইভটিজিংয়ের শিকার হয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। তাদের টোন টিটকারি আর অশ্লীল অঙ্গভঙ্গিতে পথে হাঁটা দায়। সমাজ যখন ভরে উঠছে দুর্বৃত্তে তখন পথ দেখাবে কে? মুক্তির পথ কোথায়? পথ কেউ দেখায় না। পথ করে নিতে হয়। আর এই পথ করে নেওয়াটা সহজ কাজ নয়। তবে একেবারে অসাধ্যও নয়। সত্য এবং ন্যায় একটা শক্তি। এই শক্তি ধারণ করতে পারলে অপশক্তি দূর হবেই। কথাসাহিত্যিক মোহিত কামাল কার্তিকে বসন্ত উপন্যাসে চন্দার মধ্য দিয়ে যেন এই সমস্যা থেকে মুক্তির পথ দেখিয়েছেন।

এ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র চন্দা জীবন অভিজ্ঞতায় পূর্ণ নয়। নিতান্তই কিশোরী। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। তবে এই স্বল্প জীবনেই বুঝে গেছে বাঁচতে গেলে প্রতিবাদ করা দরকার। প্রতিবাদ না করলে জীবনের পথে এগিয়ে যাওয়া দুষ্কর। কঠিন মাটিকে চিরে দিতে হয়। ফলায় ফলায় তাকে ফালাফালা করতে হয়। তার মধ্যে বীজ ছড়াতে হয়। তবেই ফসল ফলে। মাটি এমনি এমনি ফসল দেয় না। জীবনও তাই। সমাজও। কঠিনকে চিরে ফেড়ে দিতে হবে। সামনে দাঁড়াতে হবে। তবেই সম্মান নিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচা যাবে। প্রকৃত বাঁচার স্বাদ পাওয়া যাবে। কিশোরী চন্দাকে ছোট বয়সেই মাটি আর দরিদ্রতা তাকে এ শিক্ষা দিয়েছে। নরক আলির মুখোমুখি দাঁড়াতে তাই তার ভয় লাগেনি।

উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্বে লেখক উপন্যাসের মূল সুরটি বেঁধে দিয়েছেন। উপন্যাসের মূল বক্তব্য কী হতে চলেছে তার ইঙ্গিত দিয়েছেন: ‘স্কুলে আসার পথে কয়েকজন বখাটে পথ আগলে দাঁড়িয়েছিল। কথা বলার চেষ্টা করেছিল। দাঁড়ায়নি সে। ক্ষুব্ধ চোখে একবার মাথা তুলে তাকিয়ে ছিল তাদের চোখের দিকে। চোখ থেকে জল নয় ছুটে বেরিয়েছিল আগুন-শিখা। আগুন-নদীর স্রোতের মতো দেহের মধ্যে তৈরি হয়েছিল উত্তপ্ত জলধারা। আগুন থেকে জল, জল থেকে নদী। খরস্রোতা তরঙ্গ তুলে মাথা উঁচিয়ে চলে এসেছে চন্দা। ...তীব্র ইচ্ছা পড়াশোনা করবে সে। কলেজে যাবে। ভার্সিটিতে যাবে।’

এ ইচ্ছা শুধু চন্দারই তা নয়, তার সহপাঠী সকলেরই ইচ্ছা। তারা আরও অনেক পড়াশোনা করতে চায়। কিন্তু তাদের এই বিদ্যার্জনের পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায় পাড়ার বখাটে ছেলেরা। এদের ভয়ে ভীত হয়ে মা-বাবারা অল্প বয়সেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয়। তাছাড়া গ্রামের মেয়ে, কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। একটু বয়স হলেই কিশোরী লাবণ্য হারিয়ে যায়। তাই এই বয়সেই মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হয়। এই দুই সমস্যার সঙ্গে লড়াই শুরু হয় চন্দা ও তার সহপাঠীদের। তারা কখনওই বখাটেদের কাছে মাথা নিচু করবে না। বাল্যবিবাহেও রাজি হবে না। আর এই কাজে সংঘবদ্ধ হতে সাহায্য করে স্কুলের বাংলা বিষয়ের শিক্ষিকা কোহিনুর বেগম। দীর্ঘদিন নানাভাবে কাছের মানুষ, সহকর্মীদের কাছ থেকে বাজে মন্তব্য, বাজে অঙ্গভঙ্গির বিপক্ষে এ চরিত্রে প্রতিবাদী সত্তা গড়ে উঠেছিল। কোহিনুর বেগমের নির্দেশনায় তারা গড়ে তোলে ‘মনপুর বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ সংঘ’। তাদের জোরাল প্রতিবাদ শুরু হয় সহপাঠী ঋতুর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর। ঋতুর বিয়ে তারা আটকাতে পারেনি। কিন্তু এ থেকেই তারা শিক্ষা নেয় আর যেন কারও বাল্যবিবাহ না হয়। সংঘবদ্ধতার কথা জেলা, উপজেলার বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলে মনপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মামুনুর রশিদ সাহেব এবং পুলিশ প্রশাসন পাশে এসে দাঁড়ায়।

মনপুর উপজেলার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোস্তান হামজার পুত্র নরক আলি এদের সংঘবদ্ধতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। তাদের দৌরাত্মের দিন শেষ হয়ে আসছে ভেবে আরও বেপরোয়া মনোভাব দেখায়। চন্দার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার বদনাম দেয়। চন্দাদের সংঘবদ্ধতা ভাঙতে চায়। চন্দার নামে রটায়, সে নাকি তিন মাসের পোয়াতি। এই কথায় জ্বলে উঠে চন্দা। পায়ের স্যান্ডেল হাতে নিয়ে রুখে দাঁড়ায়। চন্দার এই তেজ দেখে সাময়িকভাবে সরে যায় নরক আলি। কাহিনি অন্যদিকে মোড় নেয়।

চন্দার নামে এই অপবাদ রশিদের সহ্য না। মনপুর বালক বিদ্যালয়ের ভালো ছাত্র রশিদ ভালো ফুটবলও খেলতে পারতো। কিন্তু দুর্ঘটনায় বাবা মারা যাওয়ায় স্কুল ছেড়ে দিয়ে সংসারের হাল ধরতে বাধ্য হয়। মা ও দুই বোন নিয়ে তার সংসার। সেও প্রতিবাদী যুবক। চন্দাদের বাড়িতে সে কামলা খাটে। চন্দা রশিদকে মনে মনে পছন্দ করে। রশিদও হয়তো গোপনে তার প্রতি ভালোবাসা জমিয়ে রাখে। তাই নরক আলির এই কুৎসায় রশিদ ক্ষেপে উঠে তার একটি চোখ উপড়ে নেয়। জেল-হাজতে যায় রশিদ। শুরু হয় একদিকে নরক আলির মতো বখাটেদের হাত থেকে সমাজের কিশোরী মেয়েদের রক্ষা করা, অন্যদিকে জেল-হাজত থেকে রশিদকে মুক্ত করার সংগ্রাম। এই দুই লড়াইয়ে চন্দার পাশে থাকে সহপাঠী উর্বশী, আবিদা, তৃণা, আনিকা। সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় স্বয়ং ইউএনও সাহেবও। তাদের এই কর্মকা- জাতীয় সংবাদপত্রে প্রচারিত হলে পুলিশ প্রশাসনও পাশে শক্তি হয়ে দাঁড়ায়। সকলের সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টায় জরিনার বাল্যবিয়ে আটকে যায়। জরিনার মধ্যে এক অসীম প্রাণশক্তি জেগে ওঠে। সকালে নিশ্চিত বিয়ে হবে জেনে ভোর রাতে বাড়ি থেকে পালিয়ে দূরের এক থানায় আশ্রয় নেয়। তার এই সাহস ও প্রতিবাদের মূলে আছে চন্দাদের সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা ও যুক্তিপূর্ণ কথাবার্তা। একসময় রশিদের বয়সের প্রমাণপত্র জোগাড় করে প্রশাসনের হাতে জমা দেয়। কিশোর আইনে তার বিচারের ব্যবস্থা হয়। রশিদের মায়েরও চালকলে চাকরির ব্যবস্থা হয়ে যায়।

কার্তিকের চষা মাটিতে চন্দা ও রশিদ যে বীজ বুনে দেয়, তাই বসন্তের রঙে ফুটে ওঠে। কিশোরী মনে একদিকে ভালোবাসা অন্যদিকে প্রতিবাদ। সুস্থভাবে বাঁচার আকুতি আর তীব্র ভালোবাসা চন্দাকে করে তোলে অকুতোভয়। নারী মানে অবলা, দুর্বল এ মিথ ভেঙে দিয়েছেন লেখক। অন্যায়ের বিরূদ্ধে সংঘবদ্ধ প্রতিবাদই প্রতিরোধ। উপন্যাসে যেন এ সত্যই ধ্বনিত হয়েছে। শুধু কার্তিকে বসন্ত উপন্যাসেই নয় কথাসাহিত্যিক মোহিত কামাল তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসে নারী মুক্তির কথা ঘোষণা করেছেন। সুস্মিতার বাড়ি ফেরা উপন্যাসে শেষ পর্যন্ত ধ্বংসের মুখ থেকে সুস্মিতা ফিরে এসেছে জীবনের পথে। এ উপন্যাস উত্তরণের উপন্যাস। চেনা বন্ধু অচেনা পথ উপন্যাসে সাইবার ক্রাইম কিভাবে জীবনকে তছনছ করে দেয় সে কথাই লিপিবদ্ধ হয়েছে। অহনা উপন্যাসে অহনা বিভিন্ন প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। চোরাগলি উপন্যাসের ইথা জীবনের ধ্বংসের কাছে হার মানেনি। পাথর পরান উপন্যাসের মনি চরিত্রের মধ্যদিয়ে সংগ্রামী নারীর জয় ঘোষিত হয়েছে। কার্তিকে বসন্ত উপন্যাসের চন্দা চরিত্রেও সেই সংগ্রামী সত্তার বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়। প্রাণবন্ত, জীবন্ত ও বিশ্বাসযোগ্য চরিত্র নির্মাণে, চরিত্রের মনোজগতের রহস্য উন্মোচনে লেখকের দক্ষতা অনস্বীকার্য। বর্তমান যুবসমাজ কীভাবে মোবাইল ফোন ব্যবহার করে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, কীভাবে সাইবার আক্রমণ নারী জীবনকে ধ্বংস করে দিচ্ছে, কিভাবে ড্রাগ যুবসমাজের অধঃপতন ডেকে আনছে, মানব পাচারকারী আদম ব্যবসায়ীরা কীভাবে নারীদেরকে জীবনের শেষতম অন্ধকার গলিতে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, তাদের জীবনকে নরকে পরিণত করছে, এসব কথা তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসে উচ্চারিত হয়েছে। সমাজ সচেতন কথাসাহিত্যক মোহিত কামালের উপন্যাস পাঠক হৃদস্পর্শী এবং কালের গ-ি অতিক্রম করে অনাগত কালের পাঠকের অন্তঃদৃষ্টিকেও শাণিত করবে বলেই বিশ্বাস রাখা যায়। এতোসব কাজ ও সৃজনের মধ্য আপনি অবিচল আমাদের চিরতরুণ মোহিত কামাল এগিয়ে চলুন, এগিয়ে থাকুন, আপনার সাফল্য কামনা করি

ছবি

সেদিন দু’দ- এই বাংলার তীর

ছবি

বিকল্প জীবন

সাময়িকী কবিতা

ছবি

কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা

ছবি

‘যে-কোনো দেশে ভাল সাহিত্য-অনুবাদক খুব কম’

ছবি

দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড-এর কবি এলিয়ট

ছবি

আর এক সুন্দর সকালবেলায়

ছবি

আবার নরকুম্ভির ও মডার্নিজম

ছবি

আত্মজীবনীর আত্মপ্রকাশ প্রসঙ্গে

ছবি

আসাদের অঙ্ক

ছবি

র্যাঁবোর কবিতায় প্রতীকী জীবনের ছায়া

ছবি

ভাষা সংস্কৃতি সাক্ষরতা

ছবি

হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতার আভিজাত্য

ছবি

চেশোয়া মিওশ-এর কবিতা

ছবি

সিলভিয়া প্লাথের মৃত্যু, নিঃসঙ্গতা ও আত্মবিনাশ

ছবি

সমসাময়িক মার্কিনি ‘সহস্রাব্দের কণ্ঠস্বর’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

অন্য নিরিখে দেখা

ছবি

হেলাল হাফিজের চলে যাওয়া

ছবি

হেলাল হাফিজের কবিতা

ছবি

কেন এত পাঠকপ্রিয় হেলাল হাফিজ

ছবি

নারী শিক্ষাবিদ : বেগম রোকেয়া

ছবি

বাসার তাসাউফ

ছবি

‘জগদ্দল’-এর শক্তি ও সমরেশ বসু

ছবি

রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

ছবি

রুবেন দারিও-র কবিতা

‘অঘ্রানের অনুভূতিমালা’

ছবি

কবিতা পড়া, কবিতা লেখা

ছবি

‘ধুলোয় সব মলিন’, পাঠকের কথা

ছবি

মহত্ত্বর কবি সিকদার আমিনুল হক

ছবি

রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

ছবি

কয়েকটি অনুগল্প

সাময়িকী কবিতা

ছবি

যেভাবে লেখা হলো ‘শিকিবু’

ছবি

জাঁ জোসেফ রাবেয়ারিভেলোর কবিতা

ছবি

সিকদার আমিনুল হকের গদ্য

tab

সাময়িকী

মোহিত কামালের কার্তিকে বসন্ত

হার না মানা নারী জীবনের উপাখ্যান

আব্দুল বারী

মোহিত কামাল / জন্ম : ২ জানুয়ারি ১৯৬০

বৃহস্পতিবার, ০২ জানুয়ারী ২০২৫

আজ মোহিত কামালের ৬৫তম জন্মদিন। শুভেচ্ছা

ক্ষমতা আর রাজনীতির আশ্রয়ে সমাজে বেড়ে চলেছে দুর্বৃত্তদের দৌরাত্ম্য। মাস্তানি আর কদর্য ভাষা জীবনকে করে তুলছে দুর্বিসহ। আর এসব দুর্বৃত্তদের সহজ নিশানা স্কুল-কলেজগামী কিশোরী। এই বয়স থেকে শুরু করে যে কোনও বয়সের নারীকেই ইভটিজিংয়ের শিকার হয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। তাদের টোন টিটকারি আর অশ্লীল অঙ্গভঙ্গিতে পথে হাঁটা দায়। সমাজ যখন ভরে উঠছে দুর্বৃত্তে তখন পথ দেখাবে কে? মুক্তির পথ কোথায়? পথ কেউ দেখায় না। পথ করে নিতে হয়। আর এই পথ করে নেওয়াটা সহজ কাজ নয়। তবে একেবারে অসাধ্যও নয়। সত্য এবং ন্যায় একটা শক্তি। এই শক্তি ধারণ করতে পারলে অপশক্তি দূর হবেই। কথাসাহিত্যিক মোহিত কামাল কার্তিকে বসন্ত উপন্যাসে চন্দার মধ্য দিয়ে যেন এই সমস্যা থেকে মুক্তির পথ দেখিয়েছেন।

এ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র চন্দা জীবন অভিজ্ঞতায় পূর্ণ নয়। নিতান্তই কিশোরী। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। তবে এই স্বল্প জীবনেই বুঝে গেছে বাঁচতে গেলে প্রতিবাদ করা দরকার। প্রতিবাদ না করলে জীবনের পথে এগিয়ে যাওয়া দুষ্কর। কঠিন মাটিকে চিরে দিতে হয়। ফলায় ফলায় তাকে ফালাফালা করতে হয়। তার মধ্যে বীজ ছড়াতে হয়। তবেই ফসল ফলে। মাটি এমনি এমনি ফসল দেয় না। জীবনও তাই। সমাজও। কঠিনকে চিরে ফেড়ে দিতে হবে। সামনে দাঁড়াতে হবে। তবেই সম্মান নিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচা যাবে। প্রকৃত বাঁচার স্বাদ পাওয়া যাবে। কিশোরী চন্দাকে ছোট বয়সেই মাটি আর দরিদ্রতা তাকে এ শিক্ষা দিয়েছে। নরক আলির মুখোমুখি দাঁড়াতে তাই তার ভয় লাগেনি।

উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্বে লেখক উপন্যাসের মূল সুরটি বেঁধে দিয়েছেন। উপন্যাসের মূল বক্তব্য কী হতে চলেছে তার ইঙ্গিত দিয়েছেন: ‘স্কুলে আসার পথে কয়েকজন বখাটে পথ আগলে দাঁড়িয়েছিল। কথা বলার চেষ্টা করেছিল। দাঁড়ায়নি সে। ক্ষুব্ধ চোখে একবার মাথা তুলে তাকিয়ে ছিল তাদের চোখের দিকে। চোখ থেকে জল নয় ছুটে বেরিয়েছিল আগুন-শিখা। আগুন-নদীর স্রোতের মতো দেহের মধ্যে তৈরি হয়েছিল উত্তপ্ত জলধারা। আগুন থেকে জল, জল থেকে নদী। খরস্রোতা তরঙ্গ তুলে মাথা উঁচিয়ে চলে এসেছে চন্দা। ...তীব্র ইচ্ছা পড়াশোনা করবে সে। কলেজে যাবে। ভার্সিটিতে যাবে।’

এ ইচ্ছা শুধু চন্দারই তা নয়, তার সহপাঠী সকলেরই ইচ্ছা। তারা আরও অনেক পড়াশোনা করতে চায়। কিন্তু তাদের এই বিদ্যার্জনের পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায় পাড়ার বখাটে ছেলেরা। এদের ভয়ে ভীত হয়ে মা-বাবারা অল্প বয়সেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয়। তাছাড়া গ্রামের মেয়ে, কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। একটু বয়স হলেই কিশোরী লাবণ্য হারিয়ে যায়। তাই এই বয়সেই মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হয়। এই দুই সমস্যার সঙ্গে লড়াই শুরু হয় চন্দা ও তার সহপাঠীদের। তারা কখনওই বখাটেদের কাছে মাথা নিচু করবে না। বাল্যবিবাহেও রাজি হবে না। আর এই কাজে সংঘবদ্ধ হতে সাহায্য করে স্কুলের বাংলা বিষয়ের শিক্ষিকা কোহিনুর বেগম। দীর্ঘদিন নানাভাবে কাছের মানুষ, সহকর্মীদের কাছ থেকে বাজে মন্তব্য, বাজে অঙ্গভঙ্গির বিপক্ষে এ চরিত্রে প্রতিবাদী সত্তা গড়ে উঠেছিল। কোহিনুর বেগমের নির্দেশনায় তারা গড়ে তোলে ‘মনপুর বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ সংঘ’। তাদের জোরাল প্রতিবাদ শুরু হয় সহপাঠী ঋতুর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর। ঋতুর বিয়ে তারা আটকাতে পারেনি। কিন্তু এ থেকেই তারা শিক্ষা নেয় আর যেন কারও বাল্যবিবাহ না হয়। সংঘবদ্ধতার কথা জেলা, উপজেলার বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলে মনপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মামুনুর রশিদ সাহেব এবং পুলিশ প্রশাসন পাশে এসে দাঁড়ায়।

মনপুর উপজেলার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোস্তান হামজার পুত্র নরক আলি এদের সংঘবদ্ধতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। তাদের দৌরাত্মের দিন শেষ হয়ে আসছে ভেবে আরও বেপরোয়া মনোভাব দেখায়। চন্দার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার বদনাম দেয়। চন্দাদের সংঘবদ্ধতা ভাঙতে চায়। চন্দার নামে রটায়, সে নাকি তিন মাসের পোয়াতি। এই কথায় জ্বলে উঠে চন্দা। পায়ের স্যান্ডেল হাতে নিয়ে রুখে দাঁড়ায়। চন্দার এই তেজ দেখে সাময়িকভাবে সরে যায় নরক আলি। কাহিনি অন্যদিকে মোড় নেয়।

চন্দার নামে এই অপবাদ রশিদের সহ্য না। মনপুর বালক বিদ্যালয়ের ভালো ছাত্র রশিদ ভালো ফুটবলও খেলতে পারতো। কিন্তু দুর্ঘটনায় বাবা মারা যাওয়ায় স্কুল ছেড়ে দিয়ে সংসারের হাল ধরতে বাধ্য হয়। মা ও দুই বোন নিয়ে তার সংসার। সেও প্রতিবাদী যুবক। চন্দাদের বাড়িতে সে কামলা খাটে। চন্দা রশিদকে মনে মনে পছন্দ করে। রশিদও হয়তো গোপনে তার প্রতি ভালোবাসা জমিয়ে রাখে। তাই নরক আলির এই কুৎসায় রশিদ ক্ষেপে উঠে তার একটি চোখ উপড়ে নেয়। জেল-হাজতে যায় রশিদ। শুরু হয় একদিকে নরক আলির মতো বখাটেদের হাত থেকে সমাজের কিশোরী মেয়েদের রক্ষা করা, অন্যদিকে জেল-হাজত থেকে রশিদকে মুক্ত করার সংগ্রাম। এই দুই লড়াইয়ে চন্দার পাশে থাকে সহপাঠী উর্বশী, আবিদা, তৃণা, আনিকা। সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় স্বয়ং ইউএনও সাহেবও। তাদের এই কর্মকা- জাতীয় সংবাদপত্রে প্রচারিত হলে পুলিশ প্রশাসনও পাশে শক্তি হয়ে দাঁড়ায়। সকলের সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টায় জরিনার বাল্যবিয়ে আটকে যায়। জরিনার মধ্যে এক অসীম প্রাণশক্তি জেগে ওঠে। সকালে নিশ্চিত বিয়ে হবে জেনে ভোর রাতে বাড়ি থেকে পালিয়ে দূরের এক থানায় আশ্রয় নেয়। তার এই সাহস ও প্রতিবাদের মূলে আছে চন্দাদের সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা ও যুক্তিপূর্ণ কথাবার্তা। একসময় রশিদের বয়সের প্রমাণপত্র জোগাড় করে প্রশাসনের হাতে জমা দেয়। কিশোর আইনে তার বিচারের ব্যবস্থা হয়। রশিদের মায়েরও চালকলে চাকরির ব্যবস্থা হয়ে যায়।

কার্তিকের চষা মাটিতে চন্দা ও রশিদ যে বীজ বুনে দেয়, তাই বসন্তের রঙে ফুটে ওঠে। কিশোরী মনে একদিকে ভালোবাসা অন্যদিকে প্রতিবাদ। সুস্থভাবে বাঁচার আকুতি আর তীব্র ভালোবাসা চন্দাকে করে তোলে অকুতোভয়। নারী মানে অবলা, দুর্বল এ মিথ ভেঙে দিয়েছেন লেখক। অন্যায়ের বিরূদ্ধে সংঘবদ্ধ প্রতিবাদই প্রতিরোধ। উপন্যাসে যেন এ সত্যই ধ্বনিত হয়েছে। শুধু কার্তিকে বসন্ত উপন্যাসেই নয় কথাসাহিত্যিক মোহিত কামাল তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসে নারী মুক্তির কথা ঘোষণা করেছেন। সুস্মিতার বাড়ি ফেরা উপন্যাসে শেষ পর্যন্ত ধ্বংসের মুখ থেকে সুস্মিতা ফিরে এসেছে জীবনের পথে। এ উপন্যাস উত্তরণের উপন্যাস। চেনা বন্ধু অচেনা পথ উপন্যাসে সাইবার ক্রাইম কিভাবে জীবনকে তছনছ করে দেয় সে কথাই লিপিবদ্ধ হয়েছে। অহনা উপন্যাসে অহনা বিভিন্ন প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। চোরাগলি উপন্যাসের ইথা জীবনের ধ্বংসের কাছে হার মানেনি। পাথর পরান উপন্যাসের মনি চরিত্রের মধ্যদিয়ে সংগ্রামী নারীর জয় ঘোষিত হয়েছে। কার্তিকে বসন্ত উপন্যাসের চন্দা চরিত্রেও সেই সংগ্রামী সত্তার বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়। প্রাণবন্ত, জীবন্ত ও বিশ্বাসযোগ্য চরিত্র নির্মাণে, চরিত্রের মনোজগতের রহস্য উন্মোচনে লেখকের দক্ষতা অনস্বীকার্য। বর্তমান যুবসমাজ কীভাবে মোবাইল ফোন ব্যবহার করে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, কীভাবে সাইবার আক্রমণ নারী জীবনকে ধ্বংস করে দিচ্ছে, কিভাবে ড্রাগ যুবসমাজের অধঃপতন ডেকে আনছে, মানব পাচারকারী আদম ব্যবসায়ীরা কীভাবে নারীদেরকে জীবনের শেষতম অন্ধকার গলিতে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, তাদের জীবনকে নরকে পরিণত করছে, এসব কথা তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসে উচ্চারিত হয়েছে। সমাজ সচেতন কথাসাহিত্যক মোহিত কামালের উপন্যাস পাঠক হৃদস্পর্শী এবং কালের গ-ি অতিক্রম করে অনাগত কালের পাঠকের অন্তঃদৃষ্টিকেও শাণিত করবে বলেই বিশ্বাস রাখা যায়। এতোসব কাজ ও সৃজনের মধ্য আপনি অবিচল আমাদের চিরতরুণ মোহিত কামাল এগিয়ে চলুন, এগিয়ে থাকুন, আপনার সাফল্য কামনা করি

back to top