পলি শাহীনা
গতকাল ছিলো একটি স্বর্গীয় দিন। গতকালের সৌন্দর্যের তুলনা হয় না। সূর্যের এলানো হাসি, বাতাসের উল্লাস, পাখির গান, ফুলের রঙ প্রকৃতির শরীরে ছোপ ছোপ আল্পনা এঁকে দেয়। আজকের দিনটি স্যাঁতসেঁতে, গুমোট আবহাওয়া, সকালে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হলো। গতকালের মুখরতার জন্য মনটা আজ দুঃখী হয়ে ওঠে। কথায় বলে, যায় দিন ভালো, আসলেই তাই। যত সুখ, আনন্দ যেন গতকাল কিংবা গত দিনগুলোতেই ছিল, আজ শুধু প্রাণ নিয়ে টিকে থাকার যুদ্ধ। আগামীকাল জীবন কেমন হবে আজ না জানলেও একটা অমোঘ টান আছে জীবনের প্রতি, সেই টানেই তো সকল উদ্বেগ লুকিয়ে ছুটে চলছি। বয়স যত বাড়ছে একা থাকতে তত ভয় করছে। দিন রাতের চক্রের মতো চোখের পলকে ক্রমাগত বয়স বেড়েই চলছে। তাইতো সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বাসায় একাকী না থেকে বেরিয়ে পড়েছি। আজকাল অজানা পথ, অচেনা মুখের সঙ্গে নিরিবিলি হাঁটতে ভালো লাগে। চেনা পথ, চেনা মুখ বিশেষ টানে না বললেই চলে।
দুপুরের সূর্য ততক্ষণে হেলে পড়েছে। বাসা থেকে চল্লিশ মিনিটের পথ দুই ঘণ্টায় পেরিয়ে ম্যানহাটনের ফরটি সেকেন্ড টাইমস স্কয়ারে ই ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি। ছুটির দিনে বাস-ট্রেনের অনিয়মিত চলাচলের কথা মাথায় না রেখে বের হওয়ায় এখন নিজের উপর রাগ হচ্ছে। বয়সের সঙ্গে বোধহয় মানুষের ভাবনাচিন্তা করার ক্ষমতাও ক্রমশ লোপ পায়, আমিতো আর নিয়মের বাইরে নয়। ই ট্রেনের অপেক্ষায় ধৈর্যের বাঁধ যখন একেবারে তলানিতে ঠিক তখনই এক বন্ধুর ফোন আসে। দুই বন্ধুতে কুশলাদি বিনিময় শেষে ট্রেনের দুরবস্থা নিয়ে কিছু সময় গল্প হলো। আমার বন্ধু সংখ্যা খুব কম হলেও ওরা ভালো মনের মানুষ, এটি ভেবে মন ফুরফুরে হয়ে ওঠে।
পাতাল ট্রেনের প্লাটফর্ম অপেক্ষমাণ মানুষে থইথই করছে। আমার কপাল থেকে ঘাম চিবুক চুঁইয়ে নামছে। অন্য কোনদিকে দৃকপাত না করে আত্মমগ্ন হয়ে ই ট্রেনের পথ চেয়ে আছি। এ, এফ ট্রেন এলেও আমার কাঙ্খিত ই ট্রেন আর আসে না। ‘আপনি বাঙালী?’প্রশ্নবোধক চিহ্ন রেখে এমন সময় একজন নারী এসে হাসিমুখে আমার সামনে দাঁড়ায়। অকপটে স্বীকার করি, আমি বাঙালিকিনা পরিচয়টি দেয়ার আগেই আমার বুকে লাবডুব লাবডুব শব্দ শুরু হয়। পাঁচ আগস্ট সরকার পতনের পর এক বাঙালি আরেক বাঙালিকে সোশাল মিডিয়াসহ চারপাশে যেভাবে আক্রমণ করছে, হুমকি দিচ্ছে, মন পছন্দে স্বৈরাচারের দোসর ট্যাগ দিয়ে নামের তালিকা তৈরি করছে, ভেবেই শিউরে উঠি। এই বিদেশ বিভুঁইয়ে কোনো বাঙালি এখন কার বন্ধু, কার যে শত্রু, বুঝি না। যাদেরকে একসঙ্গে প্রাণ খুলে হাসতে, আড্ডা দিতে, বেড়াতে দেখেছি, তাদেরকেই দেখছি এখন একে অন্যের প্রতি দুর্ব্যবহার, অসম্মান করছে। বাঙালি স্বভাবগতভাবেই আবেগপ্রবণ, অল্পতেই কাউকে হিরো কিংবা ভিলেন বানিয়ে দেয়। যখন কাউকে ভালো বলে তাকে চোখ বন্ধ করে ফেরেশতা বানিয়ে দেয়, তার তখন সব ভালো। আবার যখন কাউকে খারাপ বানানো হয় তাকে একদম বিপর্যস্ত করে তোলে, তখন তার সব খারাপ। কোনো মানুষ ফেরেশতা নয়, ভালোমন্দ মিলিয়েই তো মানুষ। ভালো কাজের প্রশংসা হবে, মন্দ কাজের যৌক্তিক সমালোচনা হবে, সেটা স্বাভাবিক, কিন্তু সেটার একটা সীমা থাকা দরকার। অতি সমালোচনা, অতি প্রশংসা কোনটাই মঙ্গল বয়ে আনে না। সকল আচরণে একটা পরিমিতিবোধ থাকা প্রয়োজন, আবেগপ্রবণ বাঙালি এটি বুঝেও অবুঝের মতো ভান করে। তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে হা হয়ে ব্যক্তিগত বাঙালিভাবনার শিশি খুলে লাল-নীল-কালো-ধূসর রঙের ভাবনায় আমি আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি।
তোমার নাম নিশিতা শারমিন?
আশ্চর্য তো! কীভাবে আমার নাম জানেন?
পত্রিকায় তোমার লেখা পড়েছি, ছবির সঙ্গে মিলিয়ে এতক্ষণে নিশ্চিত হলাম।
চলতি পথে অচেনা কেউ আগে লেখক হিসেবে চিনলে, কথা বলতে চাইলে খুশি হতাম, কিন্তু এই বছর, ২০২৪ সাল, লেখক পরিচয়ে তার সামনে কেমন কুঁজো হয়ে পড়ি। আপনমনে বিড়বিড় করি, কী বিপদে পড়লাম! প্রবাদ আছে, যার মনে যা ফাল দিয়া ওঠে তা। ভিতর থেকে কে যেনো বলে উঠলো, তিনি প্রস্তুত তোমার তালিকা তৈরির জন্য। তার মুখের দিকে ডাঙায় তোলা মাছের মতো হা করে তাকিয়ে ভাবছি, তিনি আমাকে কোন তালিকায় ফেলবেন, কী জানি!
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর বেশিরভাগ চেনা লেখক বন্ধুরা কেমন যেনো অচেনা হয়ে উঠেছে। এক লেখক অপর লেখকের প্রতি এতই অরুচিকর মন্তব্য করছে, দেখে বোধবুদ্ধি অবশ হয়ে আসে। ক্ষেত্রবিশেষ দেখেছি, রাজনৈতিক দলাদলি থেকে লেখকরা ব্যক্তিগত দলাদলিতে জড়িয়ে পড়েছে। এইতো, ক’দিন আগে যে লেখক বন্ধুদের দেখেছি একই টেবিলে বসে খেতে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে, একের হাতের স্পর্শ অপরের হাতে লেগে আছে, তারাই এখন একে অপরের প্রতি অরুচিকর মন্তব্য করছে অবলীলায়। আশার কথা হলো, সকলে একরকম নয়, ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। অভ্যাসের বশে প্রতিদিন ফেসবুকে ঢুকি আর লেখক বন্ধুদের বালির বাঁধের মতো সম্পর্ক ভেঙে যেতে দেখে বিমর্ষ হয়ে পড়ি।
লেখকরা সৃষ্টিশীল, ভেবেছি সৃষ্টিশীল মানুষ প্রবল অনুভবসম্পন্ন, সংবেদনশীল, নিরপেক্ষ, দূরদৃষ্টি সম্পন্ন, আবেগপ্রবণ বিধায় তারা মানুষের দুঃখ, দুর্দশায় দয়ালু হবে, কিন্তু সদ্য ঘটে যাওয়া এই গণআন্দোলনের পর আমার ভাবনা বদলে যায়। লেখকে লেখকে এতো অবিশ্বাস আর ঘৃণা, এই দূরত্ব ঘুচবে? হিংসা করে, বদনাম করে, সরকারি দল করে, বিরোধী দল করে যে পরিস্থিতি তৈরি করেছে লেখকরা, এই পথ থেকে তারা বের হতে পারবে তো? জানি না। এই অসময়ে একে অপরের গায়ে ইচ্ছেমতো তকমা না পরিয়ে যদি হাত বাড়িয়ে বলতো, এইতো বন্ধু আছি তোমার পাশে, চলো একতাবদ্ধ হয়ে আমরা ভালো থাকি, দেশকে ভালোবাসার, ভালো রাখার স্বপ্ন দেখি, কাজ করি, কতো ভালো হতো। নানাবিধ ভাবনায় ডুবে মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছে। বুকের ভেতর গাঢ় ব্যথা হয় নাকি রাগ হয়, অনুমান করতে পারি না। সেই যা হোক, প্রার্থনা করি দেশে শান্তি আসুক, সহিংসতা বন্ধ হোক।
ইতোমধ্যে, আমরা ই ট্রেনে, ভদ্রমহিলা সিটে বসে আমি তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকি। আমার মধ্যে বিবিধ ভাবনা মস্তিষ্কের ঝুল পড়া চিলেকোঠায় মাকড়সার জাল বুনছে, ট্রেনের জনারণ্যে থেকেও আমি নেই, তখন তিনি আমার হাত ধরে পাশে বসিয়ে দেন। কণ্ঠে মাধুরী মিশিয়ে বলেন, ‘তুমি বি শুধুই লেখো, কথা বলো না?’ বলার চেয়ে শুনতে ভালোবাসি, শুনছি আপনাকে। আমার উত্তর শুনে তিনি হেসে বললেন, ‘এই যে তোমার বন্ধুর সাথে কিছুক্ষণ আগে খলবল কথা বললে!’
এবার আমি কাকের মতো চোখ বুঁজে নিজের জগতে ডুবে যাই। কীভাবে বোঝাই তাকে আমার সীমাবদ্ধতার কথা। ছোটবেলা থেকে আমার একটা অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হলো, সৌজন্যতাবশত সবার সঙ্গে ঠিকঠাক মিশতে পারি না, কথা বলতেও পারি না। যার সঙ্গে ধীরে ধীরে মিশি, কথা বলি তার কানের কাছে ঠিকই খই ফোটাই। এজন্য ছোটবেলায়, বড়বেলায় অসামাজিক উপাধিসহ অনেক ভর্ৎসনাও পেয়েছি। স্কুলে পড়াকালীন প্রশ্নের উত্তর ঠোঁটস্থ করেও সহপাঠীদের সামনে দাঁড়িয়ে শিক্ষকের কাছে উত্তর দিতে পারিনি। এখনও পারি না, অনেক প্রস্তুতি নিয়েও লোকসমক্ষে নিজের ভাবনাগুলো ভালোভাবে প্রকাশ করতে পারি না। গুছিয়ে মোটামুটি লিখতে পারলেও বলতে গেলে তোঁতলাতে থাকি, নয়ত মাথা এমনভাবে চক্কর দেয় যেনো আমি শূন্যে দিকনির্দেশনা বিহীন উড়তে থাকি। ফলশ্রুতিতে, আলোচ্য বিষয় হতে ছিটকে পড়ি। বিষয়টিকে রোগ ভেবে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, এ কোনো রোগ নয়, আমি একদম ঠিক আছি। সব মানুষ আলাদা। আমি এরকমই, কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না, এবং এই ‘ভিন্ন আমাকে’ নিয়ে আমি আনন্দে বাঁচি। কে কী বললো কী এসে যায়, সুস্থ শরীরে আমার বেঁচে থাকাটাই জরুরি।
পাখি যেমন খড়কুটো দিয়ে ঘর বানায় তেমন গোটা পৃথিবী কুড়িয়ে কাচিয়ে মনে মনে সপক্ষে যুক্তি সাজাতে সাজাতে ই ট্রেন এসে থামে ফরেস্ট হিলে। গন্তব্য আমার নির্জনতম কফিশপ, যেখানে একান্তে আমি মধুরতম সময় কাটাই। তার থেকে বিদায় নিতে গিয়ে জানলাম তার বাড়িও এখানে। ট্রেনের দরজা বন্ধ হওয়ার আগেই বাঘের মতো লাফিয়ে আমরা প্লাটফর্মে নেমে পড়ি। পাশাপাশি সিঁড়ি ভেঙে পাতাল ট্রেন স্টেশন ছেড়ে রাস্তায় উঠে আসি।
মনে হয়, তার পাশে বড় রাস্তা ধরে হাঁটতে আমার ভালো লাগছে। সুন্দর কথায় পাথর গলে যায়, বুঝতে পারি। পথে তেমন কোনো পথিক নেই। মাথার উপর সাদা মেঘ উড়ছে, আমার পাশে বাচ্চার মতো সহজ সরল মিশুক মানুষটি অনর্গল কথা বলছে। ‘এটা আমার বাড়ি, তুমি চাইলে উঠোনে আমার ফুলবাগান, সব্জি বাগান দেখতে পারো’ বলে তার হাঁটা, কথা দুটোই থেমে যায়। তিনি বাড়ির গেট খোলেন, আমি খুব সন্তর্পণে তার পেছনে গিয়ে দাঁড়াই, তাকে অনুসরণ করি। বাড়ির সামনে চৌকোণাকৃতির বড় উঠোনে যেন রংধনুর সব রঙ ছড়িয়ে আছে। শীতল বাতাস বইছে, বাতাসের শরীরে কতো কতো ঘ্রাণ। আমার চোখ আটকে যায় দুই হাত দূরে সবুজ ঘাসের উপর শুয়ে থাকা হলুদ-বেগুনী রঙের ঘুড়িটার উপরে। ঘুড়িটাও অপলক আমার দিকে চেয়ে আছে, ইশারায় কাছে ডাকে। কাছে গিয়ে আমি তার গায়ে হাত বুলাতেই ও পাখির পালকের মতো নড়ে উঠলো, আমার হাত চেপে ধরলো। তিনি পেছন হতে বলেন, ‘ঘুড়িটা উড়তে চায় দিগন্তে।’ তার কথা শুনে আমার ভেতরে একটা হাহাকার আইটাই করে ওঠে। ছোটবেলায় দিগন্তে কত রঙ-বেরঙের ঘুড়ি উড়িয়েছি। কোনো ঘুড়ি উড়তে উড়তে হারিয়ে গেছে, আমি অপেক্ষায় থেকেছি, ওরা ফিরে আসে নি। আমি ঝুঁকে ঘুড়িটার বুকে নাক ছোঁয়াই, বিচিত্র সব গন্ধ পাই, ধানক্ষেতের গন্ধ, কাদাজলের গন্ধ, নৌকার ছইয়ের গন্ধ, গোধূলির গন্ধ, বাঁশবন, কামিনী ঝোপের গন্ধসহ বাবা-মায়ের লেপ-তোশকের গন্ধে বিভোর হয়ে পড়ি।
সূর্যাস্তের শেষ উজ্জ্বল আলো এসে খেলছে আমার মুখে, তার বাড়ির উঠোনে। বাগানের বাঁ পাশে কুমড়ো ফুল, গাঁদা ফুলসহ হরেক রঙের ফুল হাসছে। আমি ওদের পাশে গিয়ে একা একা গান গাই, আমার সঙ্গে গলা মিলায় ভ্রমর, পাখিরা। আমি যেনো চেটেপুটে আনন্দ খাচ্ছি। আমার মন ভরে ওঠে আলোয় আলোয়। আমি যেনো শরতের কাশবনে দুলছি, স্বপ্নে দূর অতীতের শৈশবে হারিয়ে গেছি। যে জন্মে আমি উদ্দেশ্যহীন আদাড়েপাদাড়ে আকাশের নীল রঙ গায়ে মেখে অথই সবুজে ঘুরে বেড়াতাম, রান্নাবাটি খেলতাম, পাতার বাঁশি বাজাতাম। পুঁই মাচায় চোখ পড়তেই কয়েকটা বিচি ছিঁড়লাম, ঠোঁট রাঙিয়ে নিলাম আলগোছে। তার বাগানে যেনো নক্ষত্র ছড়িয়ে আছে, তাদের মুখ থেকে অরুণকিরণ চকচকে আলো এসে পড়ছে আমার মুখে।
বাহ, চমৎকার! মুখের উপর হতে চুল সরাও তো।
তার কথায় সম্বিৎ ফিরে পাই। তিনি বললেন, ‘তোমার অনেকগুলো ছবি তুলেছি।’ তার মোবাইলে ছবিগুলো দেখতে দেখতে ভাবছি, আমি এখানে কী করছি? কেনো এলাম? একে কী বলে? টান? মায়া? অভ্যাস? কিছুটা সময় ধরে তার সাথে পথ চলতে গিয়ে তিনি কী আমার অভ্যাস হয়ে উঠেছে, তার প্রতি মায়া জন্মেছে, ঠিক মানুষের গৎবাঁধা সংসারের মতো?
বিকেলের সোনা রঙ খেলছে। তিনি চা পানের আমন্ত্রণ জানালে অন্দর-বাড়ি যাবো কিনা ভেবে প্রথমে কাচুমাচু করলেও পরে পেটের ক্ষুধার দাউ দাউ গর্জনে রাজি হয়ে যাই। ঘরে প্রবেশ করতে করতে ভাবি, তিনি কি কোনো যাদুকর? তার মধ্যে কি কোনো অলৌকিক শক্তি আছে? স্বল্প সময়ের জানাশোনায় কেমন নির্দ্বিধায় আমি তাকে অনুসরণ করেই চলছি।
বসার ঘরে ঢুকতেই চোখে পড়ে বিরাট ক্যানভাস, চুলে দুই বেণী দুলিয়ে পায়ের বুড়ো আঙুলে মাটিতে দাগ কাটছে একটি মেয়ে, ওর মুখে নরম আলো এসে পড়েছে। ক্যানভাস হতে চোখ সরিয়ে যেদিকে তাকাই দেখি বই আর বই। শীতলপাটি পাতা মেঝেতে সারিবদ্ধভাবে কিছু বই উপুড় করা, কিছু খোলা। বহুবছর বাদে কোনো ঘরে বইয়ের এমন উৎসব দেখছি। কী যে ভালো লাগছে, বুক কাঁপছে শিহরনে। চা পান করতে করতে জিজ্ঞেস করলাম, বাসায় কেউ নেই? উত্তরে তিনি বললেন,
‘চারজন ছিলাম প্রথমে, এরপর তিনজন, এখন শুধু আমি আছি। আমার স্বামী মারা গেছে দুই বছর চার মাস আগে। ছেলেমেয়ে নিজেদের চাকরি, সংসার নিয়ে ব্যস্ত অন্য শহরে। দুই চোখে গ্লুকমা, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, তীব্র রক্তশূন্যতা, খারাপ কোলেস্টেরলের আক্রমণে শরীর শক্তিহীন হয়ে এলে টের পাই আমার হাতের মুঠোয় নির্ভরতার একটা হাতও নেই। আমার কেউ নেই কোথায়ও। একাকীত্ব, ক্লান্তি, অবসাদ, শূন্যতা যখন মরে যাবার সহজ পদ্ধতিগুলো আমাকে শিখিয়ে দেয়, বেঁচে থাকার সকল মাধুর্য ফুরিয়ে আসে, তখন অকাল মৃত্যুর সকল কূটাভাস উড়িয়ে দেয় আমার সামাজিক কাজ, বই পড়া, বাগান করা, গান শোনা, ছবি আঁকা। মানুষ ছাড়াও জীবন অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে, প্রিয় নিশিতা। বেশ ভালো আছি নিয়ম বাঁধা জীবনের বাইরে, আনন্দেই বেঁচে আছি। কাছের মানুষ চোখের পলকে যেমন অচেনা হয়ে ওঠে, একইভাবে দূরের মানুষও চোখের পলকে আপন হয়ে ওঠে, যা তোমার সঙ্গে আমার হয়েছে। এটাই জীবন, এবং এই উপলব্ধি আমার একাকী বেঁচে থাকার শক্তি। কাছের মানুষের প্রহারে নিষ্প্রাণ আমি এখন প্রাণ ফিরে পাই দূরের মানুষে। কখন মানুষ নির্বাক গাছ হয়ে যায়, আমি জানি। তোমার শব্দহীন শব্দের তরঙ্গে আমি ঠিক শুনেছি তোমার কথা। একদা আমিও স্বল্পভাষী ছিলাম, হুটহাট মিশতে পারতাম না, শেষ জীবনে এখন যেচে কথা বলি। আনন্দে বাঁচো, নিজের ভরসা নিজে হয়ে ওঠো। ধন্যবাদ, আমার দিনটি আরো সুন্দর করে দেয়ার জন্য।’
কথা কম বলা আমার মুখ দিয়ে এবারও তেমন কোনো শব্দ বের না হলেও শরীরে একটা ঝাঁকুনি অনুভব করি। তার সাথে আজকের এই ভ্রমণে স্বভাবসুলভ শ্রোতা হয়েই রইলাম। তিনি বুঝিয়ে দিলেন আমাকে, একাকীত্বে কোনো ভয় নেই, একা থাকাটা কোনো দুর্বলতা নয়, বরং একা থাকতে পারাটা একটা যোগ্যতা। তার এই একা থাকার সৌন্দর্য উপভোগ করতে, এবং উঠোন বাগান ও অন্দর-ঘরে বারবার ফিরে আসব বলে মনে মনে আমার আরও বহু শরৎ বাঁচতে ইচ্ছে করে। আমার মধ্যে আশ্চর্য প্রাণসঞ্চার হয়।
পলি শাহীনা
বৃহস্পতিবার, ০২ জানুয়ারী ২০২৫
গতকাল ছিলো একটি স্বর্গীয় দিন। গতকালের সৌন্দর্যের তুলনা হয় না। সূর্যের এলানো হাসি, বাতাসের উল্লাস, পাখির গান, ফুলের রঙ প্রকৃতির শরীরে ছোপ ছোপ আল্পনা এঁকে দেয়। আজকের দিনটি স্যাঁতসেঁতে, গুমোট আবহাওয়া, সকালে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হলো। গতকালের মুখরতার জন্য মনটা আজ দুঃখী হয়ে ওঠে। কথায় বলে, যায় দিন ভালো, আসলেই তাই। যত সুখ, আনন্দ যেন গতকাল কিংবা গত দিনগুলোতেই ছিল, আজ শুধু প্রাণ নিয়ে টিকে থাকার যুদ্ধ। আগামীকাল জীবন কেমন হবে আজ না জানলেও একটা অমোঘ টান আছে জীবনের প্রতি, সেই টানেই তো সকল উদ্বেগ লুকিয়ে ছুটে চলছি। বয়স যত বাড়ছে একা থাকতে তত ভয় করছে। দিন রাতের চক্রের মতো চোখের পলকে ক্রমাগত বয়স বেড়েই চলছে। তাইতো সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বাসায় একাকী না থেকে বেরিয়ে পড়েছি। আজকাল অজানা পথ, অচেনা মুখের সঙ্গে নিরিবিলি হাঁটতে ভালো লাগে। চেনা পথ, চেনা মুখ বিশেষ টানে না বললেই চলে।
দুপুরের সূর্য ততক্ষণে হেলে পড়েছে। বাসা থেকে চল্লিশ মিনিটের পথ দুই ঘণ্টায় পেরিয়ে ম্যানহাটনের ফরটি সেকেন্ড টাইমস স্কয়ারে ই ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি। ছুটির দিনে বাস-ট্রেনের অনিয়মিত চলাচলের কথা মাথায় না রেখে বের হওয়ায় এখন নিজের উপর রাগ হচ্ছে। বয়সের সঙ্গে বোধহয় মানুষের ভাবনাচিন্তা করার ক্ষমতাও ক্রমশ লোপ পায়, আমিতো আর নিয়মের বাইরে নয়। ই ট্রেনের অপেক্ষায় ধৈর্যের বাঁধ যখন একেবারে তলানিতে ঠিক তখনই এক বন্ধুর ফোন আসে। দুই বন্ধুতে কুশলাদি বিনিময় শেষে ট্রেনের দুরবস্থা নিয়ে কিছু সময় গল্প হলো। আমার বন্ধু সংখ্যা খুব কম হলেও ওরা ভালো মনের মানুষ, এটি ভেবে মন ফুরফুরে হয়ে ওঠে।
পাতাল ট্রেনের প্লাটফর্ম অপেক্ষমাণ মানুষে থইথই করছে। আমার কপাল থেকে ঘাম চিবুক চুঁইয়ে নামছে। অন্য কোনদিকে দৃকপাত না করে আত্মমগ্ন হয়ে ই ট্রেনের পথ চেয়ে আছি। এ, এফ ট্রেন এলেও আমার কাঙ্খিত ই ট্রেন আর আসে না। ‘আপনি বাঙালী?’প্রশ্নবোধক চিহ্ন রেখে এমন সময় একজন নারী এসে হাসিমুখে আমার সামনে দাঁড়ায়। অকপটে স্বীকার করি, আমি বাঙালিকিনা পরিচয়টি দেয়ার আগেই আমার বুকে লাবডুব লাবডুব শব্দ শুরু হয়। পাঁচ আগস্ট সরকার পতনের পর এক বাঙালি আরেক বাঙালিকে সোশাল মিডিয়াসহ চারপাশে যেভাবে আক্রমণ করছে, হুমকি দিচ্ছে, মন পছন্দে স্বৈরাচারের দোসর ট্যাগ দিয়ে নামের তালিকা তৈরি করছে, ভেবেই শিউরে উঠি। এই বিদেশ বিভুঁইয়ে কোনো বাঙালি এখন কার বন্ধু, কার যে শত্রু, বুঝি না। যাদেরকে একসঙ্গে প্রাণ খুলে হাসতে, আড্ডা দিতে, বেড়াতে দেখেছি, তাদেরকেই দেখছি এখন একে অন্যের প্রতি দুর্ব্যবহার, অসম্মান করছে। বাঙালি স্বভাবগতভাবেই আবেগপ্রবণ, অল্পতেই কাউকে হিরো কিংবা ভিলেন বানিয়ে দেয়। যখন কাউকে ভালো বলে তাকে চোখ বন্ধ করে ফেরেশতা বানিয়ে দেয়, তার তখন সব ভালো। আবার যখন কাউকে খারাপ বানানো হয় তাকে একদম বিপর্যস্ত করে তোলে, তখন তার সব খারাপ। কোনো মানুষ ফেরেশতা নয়, ভালোমন্দ মিলিয়েই তো মানুষ। ভালো কাজের প্রশংসা হবে, মন্দ কাজের যৌক্তিক সমালোচনা হবে, সেটা স্বাভাবিক, কিন্তু সেটার একটা সীমা থাকা দরকার। অতি সমালোচনা, অতি প্রশংসা কোনটাই মঙ্গল বয়ে আনে না। সকল আচরণে একটা পরিমিতিবোধ থাকা প্রয়োজন, আবেগপ্রবণ বাঙালি এটি বুঝেও অবুঝের মতো ভান করে। তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে হা হয়ে ব্যক্তিগত বাঙালিভাবনার শিশি খুলে লাল-নীল-কালো-ধূসর রঙের ভাবনায় আমি আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি।
তোমার নাম নিশিতা শারমিন?
আশ্চর্য তো! কীভাবে আমার নাম জানেন?
পত্রিকায় তোমার লেখা পড়েছি, ছবির সঙ্গে মিলিয়ে এতক্ষণে নিশ্চিত হলাম।
চলতি পথে অচেনা কেউ আগে লেখক হিসেবে চিনলে, কথা বলতে চাইলে খুশি হতাম, কিন্তু এই বছর, ২০২৪ সাল, লেখক পরিচয়ে তার সামনে কেমন কুঁজো হয়ে পড়ি। আপনমনে বিড়বিড় করি, কী বিপদে পড়লাম! প্রবাদ আছে, যার মনে যা ফাল দিয়া ওঠে তা। ভিতর থেকে কে যেনো বলে উঠলো, তিনি প্রস্তুত তোমার তালিকা তৈরির জন্য। তার মুখের দিকে ডাঙায় তোলা মাছের মতো হা করে তাকিয়ে ভাবছি, তিনি আমাকে কোন তালিকায় ফেলবেন, কী জানি!
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর বেশিরভাগ চেনা লেখক বন্ধুরা কেমন যেনো অচেনা হয়ে উঠেছে। এক লেখক অপর লেখকের প্রতি এতই অরুচিকর মন্তব্য করছে, দেখে বোধবুদ্ধি অবশ হয়ে আসে। ক্ষেত্রবিশেষ দেখেছি, রাজনৈতিক দলাদলি থেকে লেখকরা ব্যক্তিগত দলাদলিতে জড়িয়ে পড়েছে। এইতো, ক’দিন আগে যে লেখক বন্ধুদের দেখেছি একই টেবিলে বসে খেতে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে, একের হাতের স্পর্শ অপরের হাতে লেগে আছে, তারাই এখন একে অপরের প্রতি অরুচিকর মন্তব্য করছে অবলীলায়। আশার কথা হলো, সকলে একরকম নয়, ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। অভ্যাসের বশে প্রতিদিন ফেসবুকে ঢুকি আর লেখক বন্ধুদের বালির বাঁধের মতো সম্পর্ক ভেঙে যেতে দেখে বিমর্ষ হয়ে পড়ি।
লেখকরা সৃষ্টিশীল, ভেবেছি সৃষ্টিশীল মানুষ প্রবল অনুভবসম্পন্ন, সংবেদনশীল, নিরপেক্ষ, দূরদৃষ্টি সম্পন্ন, আবেগপ্রবণ বিধায় তারা মানুষের দুঃখ, দুর্দশায় দয়ালু হবে, কিন্তু সদ্য ঘটে যাওয়া এই গণআন্দোলনের পর আমার ভাবনা বদলে যায়। লেখকে লেখকে এতো অবিশ্বাস আর ঘৃণা, এই দূরত্ব ঘুচবে? হিংসা করে, বদনাম করে, সরকারি দল করে, বিরোধী দল করে যে পরিস্থিতি তৈরি করেছে লেখকরা, এই পথ থেকে তারা বের হতে পারবে তো? জানি না। এই অসময়ে একে অপরের গায়ে ইচ্ছেমতো তকমা না পরিয়ে যদি হাত বাড়িয়ে বলতো, এইতো বন্ধু আছি তোমার পাশে, চলো একতাবদ্ধ হয়ে আমরা ভালো থাকি, দেশকে ভালোবাসার, ভালো রাখার স্বপ্ন দেখি, কাজ করি, কতো ভালো হতো। নানাবিধ ভাবনায় ডুবে মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছে। বুকের ভেতর গাঢ় ব্যথা হয় নাকি রাগ হয়, অনুমান করতে পারি না। সেই যা হোক, প্রার্থনা করি দেশে শান্তি আসুক, সহিংসতা বন্ধ হোক।
ইতোমধ্যে, আমরা ই ট্রেনে, ভদ্রমহিলা সিটে বসে আমি তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকি। আমার মধ্যে বিবিধ ভাবনা মস্তিষ্কের ঝুল পড়া চিলেকোঠায় মাকড়সার জাল বুনছে, ট্রেনের জনারণ্যে থেকেও আমি নেই, তখন তিনি আমার হাত ধরে পাশে বসিয়ে দেন। কণ্ঠে মাধুরী মিশিয়ে বলেন, ‘তুমি বি শুধুই লেখো, কথা বলো না?’ বলার চেয়ে শুনতে ভালোবাসি, শুনছি আপনাকে। আমার উত্তর শুনে তিনি হেসে বললেন, ‘এই যে তোমার বন্ধুর সাথে কিছুক্ষণ আগে খলবল কথা বললে!’
এবার আমি কাকের মতো চোখ বুঁজে নিজের জগতে ডুবে যাই। কীভাবে বোঝাই তাকে আমার সীমাবদ্ধতার কথা। ছোটবেলা থেকে আমার একটা অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হলো, সৌজন্যতাবশত সবার সঙ্গে ঠিকঠাক মিশতে পারি না, কথা বলতেও পারি না। যার সঙ্গে ধীরে ধীরে মিশি, কথা বলি তার কানের কাছে ঠিকই খই ফোটাই। এজন্য ছোটবেলায়, বড়বেলায় অসামাজিক উপাধিসহ অনেক ভর্ৎসনাও পেয়েছি। স্কুলে পড়াকালীন প্রশ্নের উত্তর ঠোঁটস্থ করেও সহপাঠীদের সামনে দাঁড়িয়ে শিক্ষকের কাছে উত্তর দিতে পারিনি। এখনও পারি না, অনেক প্রস্তুতি নিয়েও লোকসমক্ষে নিজের ভাবনাগুলো ভালোভাবে প্রকাশ করতে পারি না। গুছিয়ে মোটামুটি লিখতে পারলেও বলতে গেলে তোঁতলাতে থাকি, নয়ত মাথা এমনভাবে চক্কর দেয় যেনো আমি শূন্যে দিকনির্দেশনা বিহীন উড়তে থাকি। ফলশ্রুতিতে, আলোচ্য বিষয় হতে ছিটকে পড়ি। বিষয়টিকে রোগ ভেবে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, এ কোনো রোগ নয়, আমি একদম ঠিক আছি। সব মানুষ আলাদা। আমি এরকমই, কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না, এবং এই ‘ভিন্ন আমাকে’ নিয়ে আমি আনন্দে বাঁচি। কে কী বললো কী এসে যায়, সুস্থ শরীরে আমার বেঁচে থাকাটাই জরুরি।
পাখি যেমন খড়কুটো দিয়ে ঘর বানায় তেমন গোটা পৃথিবী কুড়িয়ে কাচিয়ে মনে মনে সপক্ষে যুক্তি সাজাতে সাজাতে ই ট্রেন এসে থামে ফরেস্ট হিলে। গন্তব্য আমার নির্জনতম কফিশপ, যেখানে একান্তে আমি মধুরতম সময় কাটাই। তার থেকে বিদায় নিতে গিয়ে জানলাম তার বাড়িও এখানে। ট্রেনের দরজা বন্ধ হওয়ার আগেই বাঘের মতো লাফিয়ে আমরা প্লাটফর্মে নেমে পড়ি। পাশাপাশি সিঁড়ি ভেঙে পাতাল ট্রেন স্টেশন ছেড়ে রাস্তায় উঠে আসি।
মনে হয়, তার পাশে বড় রাস্তা ধরে হাঁটতে আমার ভালো লাগছে। সুন্দর কথায় পাথর গলে যায়, বুঝতে পারি। পথে তেমন কোনো পথিক নেই। মাথার উপর সাদা মেঘ উড়ছে, আমার পাশে বাচ্চার মতো সহজ সরল মিশুক মানুষটি অনর্গল কথা বলছে। ‘এটা আমার বাড়ি, তুমি চাইলে উঠোনে আমার ফুলবাগান, সব্জি বাগান দেখতে পারো’ বলে তার হাঁটা, কথা দুটোই থেমে যায়। তিনি বাড়ির গেট খোলেন, আমি খুব সন্তর্পণে তার পেছনে গিয়ে দাঁড়াই, তাকে অনুসরণ করি। বাড়ির সামনে চৌকোণাকৃতির বড় উঠোনে যেন রংধনুর সব রঙ ছড়িয়ে আছে। শীতল বাতাস বইছে, বাতাসের শরীরে কতো কতো ঘ্রাণ। আমার চোখ আটকে যায় দুই হাত দূরে সবুজ ঘাসের উপর শুয়ে থাকা হলুদ-বেগুনী রঙের ঘুড়িটার উপরে। ঘুড়িটাও অপলক আমার দিকে চেয়ে আছে, ইশারায় কাছে ডাকে। কাছে গিয়ে আমি তার গায়ে হাত বুলাতেই ও পাখির পালকের মতো নড়ে উঠলো, আমার হাত চেপে ধরলো। তিনি পেছন হতে বলেন, ‘ঘুড়িটা উড়তে চায় দিগন্তে।’ তার কথা শুনে আমার ভেতরে একটা হাহাকার আইটাই করে ওঠে। ছোটবেলায় দিগন্তে কত রঙ-বেরঙের ঘুড়ি উড়িয়েছি। কোনো ঘুড়ি উড়তে উড়তে হারিয়ে গেছে, আমি অপেক্ষায় থেকেছি, ওরা ফিরে আসে নি। আমি ঝুঁকে ঘুড়িটার বুকে নাক ছোঁয়াই, বিচিত্র সব গন্ধ পাই, ধানক্ষেতের গন্ধ, কাদাজলের গন্ধ, নৌকার ছইয়ের গন্ধ, গোধূলির গন্ধ, বাঁশবন, কামিনী ঝোপের গন্ধসহ বাবা-মায়ের লেপ-তোশকের গন্ধে বিভোর হয়ে পড়ি।
সূর্যাস্তের শেষ উজ্জ্বল আলো এসে খেলছে আমার মুখে, তার বাড়ির উঠোনে। বাগানের বাঁ পাশে কুমড়ো ফুল, গাঁদা ফুলসহ হরেক রঙের ফুল হাসছে। আমি ওদের পাশে গিয়ে একা একা গান গাই, আমার সঙ্গে গলা মিলায় ভ্রমর, পাখিরা। আমি যেনো চেটেপুটে আনন্দ খাচ্ছি। আমার মন ভরে ওঠে আলোয় আলোয়। আমি যেনো শরতের কাশবনে দুলছি, স্বপ্নে দূর অতীতের শৈশবে হারিয়ে গেছি। যে জন্মে আমি উদ্দেশ্যহীন আদাড়েপাদাড়ে আকাশের নীল রঙ গায়ে মেখে অথই সবুজে ঘুরে বেড়াতাম, রান্নাবাটি খেলতাম, পাতার বাঁশি বাজাতাম। পুঁই মাচায় চোখ পড়তেই কয়েকটা বিচি ছিঁড়লাম, ঠোঁট রাঙিয়ে নিলাম আলগোছে। তার বাগানে যেনো নক্ষত্র ছড়িয়ে আছে, তাদের মুখ থেকে অরুণকিরণ চকচকে আলো এসে পড়ছে আমার মুখে।
বাহ, চমৎকার! মুখের উপর হতে চুল সরাও তো।
তার কথায় সম্বিৎ ফিরে পাই। তিনি বললেন, ‘তোমার অনেকগুলো ছবি তুলেছি।’ তার মোবাইলে ছবিগুলো দেখতে দেখতে ভাবছি, আমি এখানে কী করছি? কেনো এলাম? একে কী বলে? টান? মায়া? অভ্যাস? কিছুটা সময় ধরে তার সাথে পথ চলতে গিয়ে তিনি কী আমার অভ্যাস হয়ে উঠেছে, তার প্রতি মায়া জন্মেছে, ঠিক মানুষের গৎবাঁধা সংসারের মতো?
বিকেলের সোনা রঙ খেলছে। তিনি চা পানের আমন্ত্রণ জানালে অন্দর-বাড়ি যাবো কিনা ভেবে প্রথমে কাচুমাচু করলেও পরে পেটের ক্ষুধার দাউ দাউ গর্জনে রাজি হয়ে যাই। ঘরে প্রবেশ করতে করতে ভাবি, তিনি কি কোনো যাদুকর? তার মধ্যে কি কোনো অলৌকিক শক্তি আছে? স্বল্প সময়ের জানাশোনায় কেমন নির্দ্বিধায় আমি তাকে অনুসরণ করেই চলছি।
বসার ঘরে ঢুকতেই চোখে পড়ে বিরাট ক্যানভাস, চুলে দুই বেণী দুলিয়ে পায়ের বুড়ো আঙুলে মাটিতে দাগ কাটছে একটি মেয়ে, ওর মুখে নরম আলো এসে পড়েছে। ক্যানভাস হতে চোখ সরিয়ে যেদিকে তাকাই দেখি বই আর বই। শীতলপাটি পাতা মেঝেতে সারিবদ্ধভাবে কিছু বই উপুড় করা, কিছু খোলা। বহুবছর বাদে কোনো ঘরে বইয়ের এমন উৎসব দেখছি। কী যে ভালো লাগছে, বুক কাঁপছে শিহরনে। চা পান করতে করতে জিজ্ঞেস করলাম, বাসায় কেউ নেই? উত্তরে তিনি বললেন,
‘চারজন ছিলাম প্রথমে, এরপর তিনজন, এখন শুধু আমি আছি। আমার স্বামী মারা গেছে দুই বছর চার মাস আগে। ছেলেমেয়ে নিজেদের চাকরি, সংসার নিয়ে ব্যস্ত অন্য শহরে। দুই চোখে গ্লুকমা, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, তীব্র রক্তশূন্যতা, খারাপ কোলেস্টেরলের আক্রমণে শরীর শক্তিহীন হয়ে এলে টের পাই আমার হাতের মুঠোয় নির্ভরতার একটা হাতও নেই। আমার কেউ নেই কোথায়ও। একাকীত্ব, ক্লান্তি, অবসাদ, শূন্যতা যখন মরে যাবার সহজ পদ্ধতিগুলো আমাকে শিখিয়ে দেয়, বেঁচে থাকার সকল মাধুর্য ফুরিয়ে আসে, তখন অকাল মৃত্যুর সকল কূটাভাস উড়িয়ে দেয় আমার সামাজিক কাজ, বই পড়া, বাগান করা, গান শোনা, ছবি আঁকা। মানুষ ছাড়াও জীবন অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে, প্রিয় নিশিতা। বেশ ভালো আছি নিয়ম বাঁধা জীবনের বাইরে, আনন্দেই বেঁচে আছি। কাছের মানুষ চোখের পলকে যেমন অচেনা হয়ে ওঠে, একইভাবে দূরের মানুষও চোখের পলকে আপন হয়ে ওঠে, যা তোমার সঙ্গে আমার হয়েছে। এটাই জীবন, এবং এই উপলব্ধি আমার একাকী বেঁচে থাকার শক্তি। কাছের মানুষের প্রহারে নিষ্প্রাণ আমি এখন প্রাণ ফিরে পাই দূরের মানুষে। কখন মানুষ নির্বাক গাছ হয়ে যায়, আমি জানি। তোমার শব্দহীন শব্দের তরঙ্গে আমি ঠিক শুনেছি তোমার কথা। একদা আমিও স্বল্পভাষী ছিলাম, হুটহাট মিশতে পারতাম না, শেষ জীবনে এখন যেচে কথা বলি। আনন্দে বাঁচো, নিজের ভরসা নিজে হয়ে ওঠো। ধন্যবাদ, আমার দিনটি আরো সুন্দর করে দেয়ার জন্য।’
কথা কম বলা আমার মুখ দিয়ে এবারও তেমন কোনো শব্দ বের না হলেও শরীরে একটা ঝাঁকুনি অনুভব করি। তার সাথে আজকের এই ভ্রমণে স্বভাবসুলভ শ্রোতা হয়েই রইলাম। তিনি বুঝিয়ে দিলেন আমাকে, একাকীত্বে কোনো ভয় নেই, একা থাকাটা কোনো দুর্বলতা নয়, বরং একা থাকতে পারাটা একটা যোগ্যতা। তার এই একা থাকার সৌন্দর্য উপভোগ করতে, এবং উঠোন বাগান ও অন্দর-ঘরে বারবার ফিরে আসব বলে মনে মনে আমার আরও বহু শরৎ বাঁচতে ইচ্ছে করে। আমার মধ্যে আশ্চর্য প্রাণসঞ্চার হয়।