alt

সাময়িকী

সেদিন দু’দ- এই বাংলার তীর

গৌতম গুহ রায়

: বৃহস্পতিবার, ০২ জানুয়ারী ২০২৫

>চলে যাব, সেদিন মরণ এসে অন্ধকারে আমার শরীর
ভিক্ষা করে লয়ে যাবে,- সেদিন দু’দ- এই বাংলার তীর-
এই নীল বাংলার তীরে শুয়ে একা একা কী ভাবিব, হায়,-

একটি পথ দুর্ঘটনা বা পূর্বঘোষিত মৃত্যুর প্রস্তুতি

শরীর খুব অসুস্থ, কদিন ধরেই তেতে ছিলো অভব্য প্রতিবেশী ভাড়াটিয়ার কারণে। প্রতিদিনের মতোই ১৪ অক্টোবর বিকালে তিনি হাঁটতে বের হলেন। একা জীবনানন্দ। যখন বেরুচ্ছিলেন স্ত্রী লাবণ্যদেবী তাঁকে বেরুতে নিষেধ করলেন, শরীর অসুস্থ ছিলো কয়েক দিন ধরেই। লাবণ্যদেবীর কথায় তাঁর নিষেধ না শুনেই জল দিয়ে মাথা ধুয়ে একাই বেরিয়ে যান। ফেরার সময় বাড়ির কাছের লেক মার্কেট থেকে দুটো ডাব কিনে নেন।

হাঁটতে হাঁটতে জীবনানন্দ রাসবিহারী এভিনিউ ও ল্যান্সডাউন রোডের সংযোগ স্থলের প্রায় কাছাকাছি এসে গেছেন, তিনি আসছিলেন রাসবিহারী এভিন্যু-র দক্ষিণ দিকের ফুটপাথ ধরে, সংযোগ স্থলে এসে ফুটপাথ থেকে নেমে রাস্ত া অতিক্রম করার জন্য পথে নামলেন। রাস্ত ার এই অংশটা বেশ চওড়া, ট্রাম যাতায়াতের জন্য রাস্তার মাঝখানে দুটো ট্রাম লাইন পাতা। ট্রাম লাইনের জমিটা ঘাসে সবুজ। তিনি ফুটপাথ থাকে নেমে মোটর, বাস, ট্যাক্সি প্রভৃতির জন্য পিচ রাস্ত ার অংশ অতিক্রম করে ট্রাম লাইনের কাছে এলেন, মনটা কিছুটা চঞ্চল ছিলোই, ভাবলেন ট্রাম আসার আগেই লাইন পার হয়ে যেতে পারবেন, এর আগে তো একটা স্টপেজ আছেই, এই সব ভাবতে ভাবতে কিছুটা অন্যমনষ্ক হয়েই ট্রাম লাইন পার হতে লাগলেন।

তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে, অন্ধকার অল্প অল্প করে জমছে। ট্রামটা আসছিলো, আগের স্টপেজে লোক ওঠা-নামার না থাকায় না থেমে জোরের সাথেই চলে এলো, ছুটন্ত ট্রামটি জোরের সাথেই এসে ধাক্কা দিলো কবিকে, জীবনানন্দ আর ট্রাম লাইন পার হতে পারলেন না। সংগে সংগে আহত ও অচৈতন্য হয়ে ট্রাম লাইনের সেই সবুজের উপর ছিটকে পরলেন, ট্রামের ক্যাচারের ভিতরে দেহটা ঢুকে গেলো। রাসবিহারী এভিনিউ ও ল্যান্সডাউন রোডের সংযোগস্থলের দক্ষিণে একটা জলখাবারের দোকান ছিলো, নাম ছিলো “জলখাবার”। মালিক চুনীলাল দে পরে সেখানে “সেলি কাফে” নামে রেস্টুরেন্ট খোলেন। জীবনানন্দের দুর্ঘটনার সময় এই চুনীবাবু শুধু প্রত্যক্ষদর্শীই ছিলেন না, তিনি ছুটে গিয়ে অনেক সাহায্যও করেছিলেন। সেই চুনীবাবুর কথায়, “একটু পরেই হঠাৎ ট্রামের একটা শব্দ, বালিগঞ্জমুখো একটা ট্রাম কাকে যেন চাপা দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গেই পথচারীদের অনেকেই এসে গেলেন। গিয়ে দেখেন একজন লোক অচৈতন্য হয়ে ট্রামের ক্যাচারের মধ্যে পড়ে আছেন। ট্রাম দাঁড়িয়ে আছে। ট্রামের ড্রাইভার দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই ভিড়ের মাঝে গা ঢাকা দিয়ে সরে পড়েছে। যাই হোক, আমি তখনি ট্রামের তলায় ঢুকে আস্তে আস্তে তাকে বের করলাম। সমবেত জনতার দু’একজনের কথা কানে আসছিল, ট্রাম লাইনের ঘাসের উপর দিয়ে এই ভদ্রলোক আনমনে আসছিলেন। ট্রাম ড্রাইভার হর্ন দিয়েছিল, দু’একজন চিৎকার করলেও ভদ্রলোক কিসের চিন্তায় এমন বিভোর ছিলেন যে কিছুই তাঁর কানে যায়নি। যখন তাঁকে বেরকরা হলো, তখন তিনি অজ্ঞান। দু-তিনজনে মিলে জ্ঞ্ানহীন জীবনানন্দকে ট্যাক্সিতে তোলা হলো, শম্ভূনাথ প-িত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো।

চুনীবাবু তাঁকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে রেখে এলেন, সাধারণ রুগির মতোই পড়ে রইলেন জীবনানন্দ দাশ। পড়ে আত্মীয়স্বজন অন্য বিভাগে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও তাঁর শরীরের অবস্থার কারণে তা সম্ভব হয়নি আর। ট্রামের ধাক্কায় জীবনানন্দের বুকের কয়েকটা হাড়, কাঁধের হাড় এবং পায়ের হাড় ভেঙ্গে গিয়েছিলো। বিধান রায় তাকে দেখতে গিয়ে জানিয়ে দেন যে, তাঁর আর বাচার আশা নেই, যতদিন থাকেন একটু শান্তিতে রাখবেন। শম্ভুনাথ হাসপাতেলেই যখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন কবি, ১৪ অক্টোবর রাত ৮টায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, ২২শে অক্টোবর রাত ১১টা ৩৫মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। গোটা জীবন অশান্তি ও অতৃপ্তির যন্ত্রণার এইভাবেই পরিসমাপ্তি ঘটলো। সবুজ ঘাস তার প্রিয় ছিলো, অন্তিম আঘাতেও তিনি ছিটকে পড়েছিলেন সেই সবুজ ঘাসেই।

আশা স্বপ্নের ছাইভষ্ম

১৯৫১-র ২৮শে মে ১৮৩ ল্যান্সডাউন রোডের বাড়ি থেকে উত্তর বাংলার জলপাইগুড়ি শহরের তরুণ লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক সুরজ্তি দাশগুপ্তকে চিঠিতে লিখেছিলেন যে, একবার ঘুরে আসতে ইচ্ছে করে, সভাসমিতি ইত্যাদি সবকিছুর হাত সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে তোমাদের মতো দুএকজনের সাহায্যে হিমালয়, চা-বাগান ইত্যাদি দেখে আসার লোভ জেগেছে মনে। পঞ্চাশোর্ধ কবির আরো অনেক ইচ্ছার মতই এই ইচ্ছাও পূর্ণ হয়নি। আত্মদহনে ছটফট করতে থাকে এই মানুষটা। তাঁর যাবতীয় অনিচ্ছা অতৃপ্তির সঙ্গে সহবাস করতে করতেই ইচ্ছাগুলোকে হারিয়ে ফেলছিলেন। এই হারানোর যন্ত্রাণাগুলোকে চেপে রেখে ব্যক্তিজীবনে আপোসকামী হয়ে যেন নিজেকেই কুরেকুরে খাচ্ছিলেন তিনি। সেই চিঠিতে জীবনানন্দ লেখেন “এখুনি ঝিলের পারে ঘাসের ওপরে আকাশের মুখোমুখি নিজেকে ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। নদী, ঝিল, পাহাড়, বন, আকাশ- কোনো নিরালা জায়গা থেকে এসবের নিকটসম্পর্কে আসতে ভাল লাগে আমার। বসে থাকতে পারা যায় যদি এদের মধ্যে, কিংবা হেঁটে বেড়াতে পারা যায় সারাদিন, তা হলেই আমাদের সময় একটা বিশেষ দিক দিয়ে (আমার মনে হয়) সবচেয়ে ভালো কাটে।” নির্জনতা ও বিষণœতা আক্রান্ত জীবনানন্দের, প্রকৃতি ও মানবতার ছায়া-আচ্ছন্ন জীবনানন্দের ভালোলাগাগুলোর ছোট ছোট টুকরোগুলো এমনই ছিলো। ঝিলের পাশে ঘাসের ওপরে আকাশের মুখোমুখি নিজেকে ছড়িয়ে দিতে চাওয়া কবির ভালোবাসার ইচ্ছেগুলোও ছিলো ভেসে বেরানো মেঘের মতো, শুভ্র ও খ-খ-, নিঃস্বার্থ ও উচ্চাশামুক্ত। এইসব ভালো লাগার জল ভরা সতেজ বাতাস সজীব রেখেছিলো “শুদ্ধতম” কবি জীবনানন্দকে। এইসব ভালো লাগার ইচ্ছের অধিকাংশই ইচ্ছেপূরণের আনন্দে উত্তীর্ণ হয়নি, এই অতৃপ্তির যন্ত্রণার দহনেই দগ্ধ হয়েছেন তিনি নীরবে।

জীবনানন্দের ৫৫ বছরের জীবনে ১৯১৯-এ “ব্রহ্মবাসী” পত্রিকায় প্রকাশিত (বৈশাখ ১৩২৬) “বর্ষা আবাহন” কবিতা থেকে শুরু ধরলে কবিজীবন মাত্র ৩৪ বছরের, প্রকৃত বিচারে যদিও কবি জীবনানন্দের আয়ুষ্কাল আরো কম। এই কবি প্রধানত ছোটকাগজের লেখক। ভূমেন্দ্র গুহর ভাষায়, “জীবনানন্দ আজীবন ছোটো কাগজের দাবি মেনে চলেছেন, এবং মানতে ভালোবেসেছেন, যদিও বড়ো কাগজে যথোপযুক্ত মর্যাদা সহকারে লেখা বের হোক, তাও তার কাম্য ছিলো। এই কারণেই যখন প্রান্তবাংলার জলপাইগুড়ির এক লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক লিখলেন, আধুনি সাহিত্য, বিশেষত, আধুনিক বাংলা কবিতা সম্বন্ধে উত্তরবঙ্গের মানুষদের জন্য একটা পত্রিকা প্রকাশ করতে চাই। আপনার একটা কবিতা চাই। জীবনানন্দের পর্যায়ের কবি এর উত্তরে কত অনায়াসে “শিরিষের ডালপালা লেগে আছে বিকালের মেঘে” মম্ফঃস্বলের নাম না জানা, না দেখা, সাক্ষাৎপরিচয়হীন সদ্য কৈশোর অতিক্রান্ত ছাত্রদের পত্রিকায় প্রকাশের জন্য পাঠিয়ে দেন। এর মধ্যে তাঁর চরিত্রের “আরো এক বিপন্ন বিষ্ময়” প্রকাশ পায়, যার অস্তি ত্ব অর্থ, কীর্তি ও সচ্ছলতার অতীত। জীবনানন্দকে জলপাইগুড়ি আসার আমন্ত্রণ করা হয়েছিলো “জলার্ক”-এর তরুণদের পক্ষ থেকে। ১৯৫২-র ২০ জানুয়ারি জীবনানন্দ সুরজিত দাশগুপ্তকে এক চিঠিতে লেখেন, “জলপাইগুড়ির ওদিককার অঞ্চল, পাহাড়, নদী, জংগল বেশ দেখবার মতো, ঘুরবার মতো, ঘুরে বেড়াবার মতো, আমার খুব ইচ্ছা করে, জল্পাইগুড়ির দিকে একবার যাব ভাবছি।” কিন্তু কবির এই ইচ্ছা অপূর্ণই থেকে যার। ১৯৫২তে লেখেন- “আমার এখন জলপাইগুড়ি যাবার কোনো সম্ভাবনা নেই। যেতে পারলে অবশ্য আনন্দিত হতাম।”

অসুস্থতা, বেকারত্ব, পারিবারিক অশান্তিতে বিপর্যস্ত কবি যেন সেসময় তাঁর ভালো লাগার জগত থেকে ক্রমশ ছিটকে যাচ্ছেন। এমনকি, কবিতাও লিখতে পারছেন না এই সময়। কবি কায়সুল হককে লেখা এই সময়ের একটি চিঠিতে তিনি একথা লিখেছিলেন। ১৯৫২ সালের ২৬ জুন তিনি জানালেন, “নানা কারণে মন এত চিন্তিত আছে, শরীরও এত অ্সুস্থ যে অনেকদিন থেকেই কিছু লিখতে পারছি না।” আলোচ্য এই চিঠিগুলো জীবনানন্দ লিখেছিলেন ১৯৫১-৫২, যখন তাঁর অন্তরাত্মা চাইছিলো জলপাইগুড়ির মতো কোনো সবুজ নির্জনতা। যেখানে তিনি আশ্রয় নিতে চাইছিলেন। তখন চারপাশ তাঁর কাছে রূঢ় হয়ে উঠছিলো। রূঢ় বাস্ত বের মুখোমুখি অসহায় অবস্থা তাঁর। প্রতিটি ইচ্ছা ও কামনার মৃত্যু পরখ করছেন প্রতিদিন। ১৯৫০-এর ২ সেপ্টেম্বর তিনি খড়্গপুর কলেজে অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন, সদ্য প্রতিষ্ঠিত কলেজে নামমাত্র মাইনে পেতেন। স্ত্রী লাবণ্য ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজে বি.টি. পড়তে গুরু করেছেন এসময়। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি “এলকাইনা” রোগে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৯৫১-র জানুয়ারি, স্ত্রীর অসুস্থতার খবরে কলকাতা আসেন কবি। লাবণ্যদেবী সুস্থ হচ্ছেন না দেখে ছুটির সময় বাড়ানোর আবেদন করেন কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে, কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ ২৫ ফেব্রুয়ারি তাঁকে বরখাস্থ করে দেয়। এসময় সহকর্মী পুলিন বিহারীকে কবি লেখেন, “বড়ই বিপদের ভেতর আছি। খড়্গপুর কলেজে থেকে ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে তিনশত টাকা পেয়েছিলাম। ফেব্রুয়ারি মাসে যে কাজ করেছিলাম, সে পাওনা আজ পর্যন্ত পাইনি। অন্তত পূর্বের মাইনে না পেলে এই দুর্দিনে কিছুতেই টিকে থাকতে পারবো না।”

এ সময় চরম বেকারত্বের। তাঁর কাঁধেই সংসারের ভার। বাড়ি নিয়ে পরিবার নিয়ে তাঁর শত দুশ্চিন্তা। খড়গপুরের কলেজের সাড়ে পাঁচ মাসের মেয়াদি চাকরি চলে যাওয়ার পর সর্ম্পূর্ণ বেকারত্ব তাঁকে অসহায় অবস্থায় ঠেলে দেয়। শুরু হয় আবার চাকরির খোঁজ। ১৯৫৯ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির রিসার্চ এসিস্ট্যান্টের জন্য দরখাস্ত করেন কবি। প্রার্থী হন চারুচন্দ্র কলেজে অধ্যাপনার জন্য। এসব ছেড়ে একসময় ব্যবসায় নামার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন তিতিবিরক্ত, হতাশ জীবননন্দ। এ সময় তাঁর সবচেয়ে বড় সম্পদ আত্মবিশ্বাসেও ফাটল ধরেছিলো। অধ্যাপনার বা পড়ানোর কাজ খুব একটা পছন্দের ছিলো না, তবুও হন্যে হয়ে খুঁজেছেন। ভাইবউ নলীনী চক্রবর্তীকে তিনি অধ্যাপনা সম্পর্কে লিখেছিলেন। “অধ্যাপনা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সে সবের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আপনি যা লিখেছেন ঠিকই। তবে অধ্যাপনা জিনিসটা কোনো দিনই আমার ভাল লাগেনি। যে সব জিনিস যাদের কাছে যেমনভাবে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে- তাতে আমার বিশেষ আস্থা নেই। এই কাজে মন তেমন লাগে না, তবুও সময় বিশেষে অন্য কোনো কোনো প্রেরণার চেয়ে বেশি জাগে তা স্বীকার করি।” প্রভাতকুমার দাস এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, “শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করেও, সন্তুষ্ট ছিলেন না, সম্ভবত নিশ্চিন্ত কোনো শিক্ষকতা কোনো দিন পাননি। একটা কাজের খোঁজে হন্যে হয়ে উঠেছিলেন, চিঠি লিখেছিলেন শিক্ষকতা/অধ্যাপনা চাকরির খোঁজের জন্য হরপ্রসাদ মিত্র, নরেশ গুহ কিংবা অনিল বিশ্বাসকে। হরপ্রসাদ মিত্রকে লিখেছিলেন : “অমৃতবাজার পত্রিকায় দেখা গেছে, কলকাতার কয়েকটি প্রথম শ্রেণীর কলেজে ইংরাজি শিক্ষক নেওয়া হবে। কিন্তু কলেজের নামের পরিবর্তে পোস্ট বক্স নম্বর ব্যবহৃত বলে বুঝতে পারছি না স্কটিশচার্চ অথবা সিটি কলেজের প্রয়োজনে এই বিজ্ঞাপন।”

আর্থিক প্রয়োজনে জীবনানন্দ একসময় সিনেমার গান লেখবার কথাও ভেবেছিলেন। বন্ধু কবি অরবিন্দ গুহের কাছে একবার জানতে চেয়েছিলেন- সিনেমার গান লিখলে নাকি টাকা পাওয়া যায়? তুমি কিছু জানো এবিষয়ে? অরবিন্দ বাবু তখন এ বিষয়ে প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে যোগাযোগের কথা বলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর প্রেমেন্দ্র মিত্রের কাছে বিষয়টি তুলতে পারেননি কবি। এর পর অরবিন্দ বাবু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের কথা বলেন। সিনেমার ডিরেক্টর শৈলজানন্দ বাবু জীবনানন্দের কাছের-মানুষ ছিলেন। কিন্তু এক্ষেত্রেও পূর্বের মতই কবি আর বিষয়টি তুলতে পারেন নি। কারণটি বেশ মজা করে অরবিন্দবাবুকে তিনি বলেছিলেন : এরপর সকৌতুক ভংগিতে তিনি বলেন, “যদি শৈলজা আমার জন্য কোথাও একটা ব্যবস্থা করে দেয় তাহলেও আমি কেমন করে লিখব, ‘রাঁধে-এ-এ-এ, ঝাঁপ দিলি তুঁই মরণ যমুনায়’।”

এই কথোপকথনের কিছুদিনের মধ্যেই সেই মহা দুর্ঘটনা, ১৪ অক্টোবর। এমনই একদিন আড্ডাছলে জীবনানন্দ অরবিন্দ গুহকে বলেছিলেন : “আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না। আমি মানুষের নীতিবোধে বিশ্বাস করি।”

এই বিশ্বাসের প্রতিফলন ছিলো জীবনানন্দের জীবন ও সাহিত্যে, কবিতায় ও কথায়। চূড়ান্ত বিপন্নতার মাঝেও তিনি এই বিশ্বাস ধরে রেখেছিলেন। গোটা জীবন যে আর্থিক অনিশ্চয়তা তাকে তাড়া করে বেরিয়েছে তাই তার প্রধান বিপন্নতা ছিলো।

মুর্শিদাবাদের সরকারি আমলা অনিল বিশ্বাসকে লেখা তাঁর চিঠির মধ্যেও কবির বিপন্নতা ধরা পড়ে : “বর্তমানে অত্যন্ত অসুবিধায় আছি, কাজ খুঁজছি। কলকাতায় একটা সাধারণ কাজও পাওয়া যাচ্ছে না। জংগীপুর কলেজে একজন ইংরেজি শিক্ষক নেওয়ার বিজ্ঞাপন দিয়েছে, আমার বর্তমান অবস্থা এমন যে কোনো রকম কাজ করতে আমি কোনোরকম দ্বিধা করবো না।” অথচ, আমরা জানি তিনি কলকাতাকে আঁকড়ে ধরেই থাকতে চেয়েছিলেন, বুদ্ধদেব বসুকে লিখেছিলেন : “কলকাতার অলিগলি মানুষের শ্বাস রোধ করে বটে, কিন্তু কলকাতার ব্যবহারিক জীবনে প্রান্তরের মতো মুক্তি পাওয়া যায়; এখন যখন জীবনে কর্মবহুলতার ঢের প্রয়োজন, কলকাতার এই স্বচ্ছন্দ পটভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা চলে না আর।” এখানে উল্লেখ করতে হয় নলিনী চক্রবর্তীকে লেখা তাঁর উক্তি : “বরাবরই আমার জীবিকা নিয়ে কলকাতায় থাকার ইচ্ছে।” সাম্প্রতিক উদ্ঘাটিত তাঁর ডায়েরিতে লেখা কথাগুলো জীবনানন্দের এই চাওয়া-পাওয়ার সংঘাত, অপছন্দের চেহারাটা চিনতে সাহায্য করবে-

9.8.31 Very often... I think that instead of frittering away my energy. I ought to just do that for wh I Hand & in wh I escel of delight & wh is my true vocation. Literature (press & publication) through s profession or cslling wh nourishes it as I city coll or non Beng Jobs never will...

-Have I ever paid a single pice to coll street window or various other begaers?

-The leper`s child & various other infants with duress appeal & reflections infinite on them.

-on “বসে থাকা”- বেকার কখনও বসে থাকে না। they stand & run & throb & palpitute it is only I well-placed who have I etrenal charm of the easy chair or cushions, so for & bels for them.

ডাইরিতে এমন কথাটুকরো তিনি লিখেছিলেন খড়্গপুরের কলেজের চাকরি হারানোর অনেকদিন আগেই। ১৯৫১-তে যে দুর্বিসহ আর্থিক চাপ তাঁর উপর নেমে আসে তাতে একসময় বিপন্ন জীবনানন্দ জনৈক পরিচিতের সঙ্গে ব্যবসায় নামার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন, যদিও তা শেষ পর্যন্ত ভেঙ্গে যায়। খাঁ খাঁ বেকার সংসারের চাপে জীবনানন্দ প্রত্যহ খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনের কলাম থেকে বিভিন্ন কাজের খোঁজ নিয়ে আবেদন করতে থাকেন। তাঁর এরকম অসহয় জীবনের, অর্থাৎ কর্মহীন পর্বে একবার পরিচিতদের পরামর্শে দেখা করতে গিয়েছিলেন রাইটার্স রেভিনিউ বোর্ডের সদ্য আউসিএস সত্যেন ব্যানার্জীর সঙ্গে। দেখা করতে গিয়ে রীতিমতো অসুস্থ হয়ে পড়েন, রাইটার্স বিল্ডিংয়েই অবনীমোহন কুশারীর ঘরে তিনি অচৈতন্য হয়ে পড়েছিলেন।

কিন্তু কোথাও চাকরি জোটেনি ইংরেজি সাহিত্যে এম. এ, সে সময়ের এই কবি যুবকের। অন্তর্মুখী স্বভাবের জন্য ব্যবসাও করতে পারেননি। পরের বছর চাকরি পেলেন তাঁর স্ত্রী লাবণ্য। এ সময়ই চার মাসের জন্য চাকরি পান জীবনানন্দ, ১৯৫২-র নভেম্বর থেকে ১৯৫৩-র ফেব্রুয়ারি, বরিশাল কলেজে শিক্ষকতার। কিন্তু এখানেও থাকা হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই যখন তাঁর মন শিরীষের ছায়ায়, ঝিলের হাঁসেদের সংগে ডুব দিতে চেয়েছে, তখন দারিদ্র ডুবে যাওয়া ব্যক্তিমান্ষু জীবনানন্দকে দুঃস্বপ্নের মধ্যে থাকতে হয়েছে, অপূর্ণ অতৃপ্ত বাসনাকে সঙ্গী করে। “নারীর হৃদয় প্রেম-শিশু গৃহ নয় সবখানি” এক অসহ্য যন্ত্রণাকে সঙ্গী করে “সবুজ পল্লবিত জারুলের ঐশ্বর্য, হেলিওট্রোপ রঙের ফুল, মেহেদিপাতার বনে স্বপ্নাতুর ঝি ঝি, ছাতিমের গাঙ শালিকের জীবনোচ্ছ্বাস কৃষ্ণচূড়ার অজস্র কুঁড়ি, চারদিককার সফল প্রচুর জীবনের কালীদহ, কলরব কিছুই আমাকে সাহায্য করতে পারে না।” (জামরুলতলা) এ সময়ের যন্ত্রণাদগ্ধ কবির আরো অণুরণন চিহ্ন : এ যুগে কোথাও কোনো আলো, কোনো কান্তিকর আলো চোখের সম্মুখে নেই যাত্রীর/ নেই তো নিঃসৃত অন্ধকার মায়ার মতো।

এই সময়কালে তিনি এতটাই বিপন্ন ছিলেন যে কবিতাও লিখে উঠতে পারছিলেন না। এ সময়ের একটা ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। সুরজিত দাশগুপ্ত একবার জলার্কের জন্য বুদ্ধদেব বসুর কাছে লেখা চাইতে গেলে তিনি প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত লেখার জন্য পৃথক দর উল্লেখ করেছিলেন। সুরজিত বাবু এ কথা জীবনানন্দকে জানিয়ে তাঁর কোন দর আছে কিনা জানতে চাইলে জীবনানন্দ লেখেন, “একটি কবিতার জন্য সম্মানমূল্য আমি সাধারণত ২৫/৩০ টাকা থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত পাই, তোমরা ২০ টাকা দাও। আমি সময় করে ভালভাবে নতুন কবিতা লিখে পাঠাই।” লেখার জন্য সময় ও সাধনা দরকার, গদ্যের চেয়ে কবিতার বেশি। ২রা নভেম্বর ১৯৫১তে তিনি এই চিঠিটি লেখেন।

পূর্ববাংলার প্রকৃতি ছিলো তাঁর চেতনার গভীরে শেকড় গেড়ে। এর বীজ শৈশবেই রোপণ করা হয়েছিলো। ভাই অশোকানন্দের ভষায় : প্রকৃতির সৌন্দর্যে মগ্নচিত্ত সেই কিশোর আপনার পরিবেশকে বর্ণে, সুগন্ধে অপরূপ করে তুলবার সাধনায় ব্রতি হয়েছিলেন। উঁচু ক্লাসে পড়ার সময় কলকাতার এক নার্সারি থেকে ফুলের চারা আনিয়েছিলেন, নিজের ঘরের ঠিক সামনে কিছুটা জমি ঘিরে ফুলের বাগান তৈরি করেছিলেন। জুঁই, চাঁপা, গন্ধরাজ, চামেলি, কাঠালচাঁপা, নীলজবা, হাস্নুহেনা আর আশ্চর্য সুন্দর সব গোলাপ; তাছাড়া, কৃষ্ণচূড়ার নার্সারির ক্যাটালগে নাম ছিলো পন্সিয়ানা রিজিয়া।... পন্সিয়ানা রিজিয়া গাছ বড় হয়ে গ্রীষ্মকালে অজ¯্র রক্তিম পুষ্পতে ভরে যেত, মনে হতো যেন লাল আগুন জ্বলছে। এই গাছটি দাদার অতি প্রিয় ছিল। অনেক সময় চেয়ার পেতে এই গাছট তলায় বসে লিখতেন। “আমার কামনা কি জান? বোইচি, ময়নাকাটা, বাবলা, ফণীমনসা। বন অপরাজিতার পাশ দিয়ে এক একটা সাদা ধুলোমাখা ভারী শুদ্ধ আঁকাবাঁকা গ্রামের পথ থাকে, তারই পাশে এক একটা প্রান্তরের অপরিসীম নিশ্বাসের বিস্ত ারের সবুজ ঘাস আছে সেখানে। তাদের ভেতর শষ্যপোকা আছে। দিয়ালি পোকা আছে, গঙ্গা ফড়িং আছে, কাঁচ পোকা আছে, সুদর্শন উড়িয়া আসে। হলুদ, কমলা, জর্দানীল রঙের প্রজাপতি কাশফুলের ভেতর সমস্ত দুপুর ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়ায়, কোথাও হয়ত কতগুলো পলাশ, অর্জুন গাছ, উলু জঙ্গল, মাছ রাঙ্গার দাঙ্গার শিরশিরানি, এমনি এক জায়গায়, ঘাসের নরম গাছের কাছে, প্রান্তরের একটেরে বনের দেখা আস্বাদ যেখানে অনেকদিন হইতে ছায়া রচনা করিয়া বাঁচিয়া আছেন। রাত্রিদিন শালিক, বুলবুলি, কোকিল ও কাককে আশ্রয় দিতে আসিতেন, সেইখানে খড়ের একখানা ঘর তুলিয়া পড়ি, লিখি, চুরুট ফুঁকি কাটাইয়া দেই-” (সঙ্গ: নিঃসঙ্গ ৪২৪ পৃষ্ঠা)। জীবনানন্দের বেশিরভাগ কবিতা, পরবর্তীতে প্রকাশিত গদ্যসমূহে, ভীষণভাবে উপস্থিত নিসর্গ। এ বিষয়ে বুদ্ধদেব বসুর বহু-চর্চিত উক্তি : “তাঁর সমস্ত কবিতাই কোনো না কোনো অর্থে প্রকৃতির কবিতা।” নিসর্গ এবং প্রকৃতির রকমফের আছে। তাঁর কবিতা আলোচনা প্রসঙ্গে উল্লেখসহ পবিত্র সরকার লিখেছেন: তাঁর নগর-নিসর্গের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় যুদ্ধ বিধ্বস্ত নষ্ট ও দরিদ্র সময়, ফলে এই নিসর্গ তাঁর অনুভবে স্বস্তি বা উজ্জীবন নিয়ে আসে না। জীবনানন্দকে পরিভ্রমণ করতেই হয়, ওই নাগরিকতার বাইরে ওই সময়ের অতিক্রান্তির ওপারে কোনো অনন্ত অতীত ভবিষ্যতে, তাঁর ভূগোল ও ইতিহাস মিলিতভাবে পরস্পরকে আকীর্ণ বিস্ত ারিত করে তবেই তাঁর নিজস্ব নিসর্গকে আবিষ্কার করে।”

“আমার ইচ্ছা করে এই ঘাসের ঘ্রাণ হরিৎ মদের মতো

গেলাসে গেলাসে পান করি

এই ঘাসের শরীর ছানি-চোখে চোখ ঘষি,

ঘাসের পাখনায় আমার পলক

ঘাসের ভিতরে ঘাস হয়ে জন্মাই কোনো এক নিবিড় ঘাস-মাতার

শরীরের সুস্বাদ অন্ধকার থেকে নেমে”

জীবনানন্দের প্রকৃতিলালিত কবিমন উত্তপ্ত সমকাল প্ররোচিত করেছিলো ভিন্ন ধরনের নির্মাণে। সময়কালের নিবিড় অনুভব প্রজ্ঞা থেকে কবি বোঝার চেষ্টা করেছেন চারপাশের মানুষকে, সভ্যতা, জীবন, জগত সময়কে। সালাহউদ্দিন আইয়ুবের ভাষায়, “তিনি দেখেছিলেন পৃথিবীর মানুষীর রূপ স্থূল হাতে ব্যবহৃত হয়ে হয়ে কীভাবে শুয়োরের মাংস হয়ে যায়, অন্ধকার সমস্ত অট্টহাসির ভিতর একটি বিরাট তিমির মৃতদেহ নিয়ে কীভাবে স্ফিত হয়ে ওঠে, কীভাবে ঊর্বশীর শরীর ডাইনির মাংসের মতন বাদুড়ের খাদ্য হয়ে যায়; উন্নত পৃথিবীর একপিঠে তিনি দেখেছেন স্পন্দন, সংঘর্ষ, গতি উদ্যম, চিন্তার কাজ, অন্যপিঠে শত শত শূকরের চিৎকার, শত শত শূকরীর প্রসব বেদনার আড়ম্বড়ের মতো ভয়াবহ আরতি।” মুমুর্ষূ পৃথবীর সূর্যাস্ত কে তাঁর মনে হয়েছিলো বেহেড আত্মার মতো। “মূর্খ” ও “রূপসীর ভয়াবহ সঙ্গম” এই রকম একটি বাক্যে বর্তমান সভ্যতার একটি মৌলিক অন্তর্বিরোধ তিনি তুলে ধরতে চেয়েছিলেন, তাঁর আশঙ্কা ছিলো-

“কবি তুমি ক্রমে ক্রমে হিম হয়ে পড়িতেছ বলে / সুন্দর যেতেছে মরে ধীরে ধীরে / শান্তি আর থাকিবে না।” অথবা “বেলা অবেলা কালবেলা”য় “নিসর্গের কাছ থেকে স্বচ্ছ জল পেয়ে/ তবু নদী মানুষের / মূঢ় রক্তে ভরে যায়; সন্দিগ্ধ হয়ে প্রশ্ন করে, নদী / নির্ঝরের থেকে নেমে এসেছ কি? মানুষের হৃদয়ের থেকে?” তাই তিনি দেখেন অধিকাংশ সৃষ্টিই তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের রসদ সমৃদ্ধ, নিজস্ব যন্ত্রণার জটিল জীবনের আলো আধারিকে আশ্রয় করেই ভাবনাগুলি প্রকাশ পায়। ফলে তার মননে থাকে আত্মগত উচ্চারণ। নিছক আত্মগত উচ্চারণেই থেমে থাকা নয়, তাঁর কথাসাহিত্যের অধিকাংশই আত্মজৈবনিক বলেও মনে হয়। ইতিপূর্বে কিছু চিঠির উল্লেখ করেছি, এমনি ১৯৫৭’র জ্যৈষ্ঠ মাসে কবি লেখেন- “বেশ ঠেকে পড়েছি, সে জন্য বিরক্ত করতে হলো আপনাকে। এখুনি পাঁচশ টাকার দরকার, দয়া করে ব্যবস্থা করুন। এই সঙ্গে পাঁচটি কবিতা পাঠাচ্ছি। পরে প্রবন্ধ ইত্যাদি (এখন কিছু লেখা নেই) পাঠাবো। আমার একটা উপন্যাস (আমার নিজের নামে নয়, ছদ্মনামে) পূর্বাশায়, কিন্তু টাকা এক্ষুনি চাই- আমাদের মত দু-চারিজন বিপদগ্রস্ত সাহিত্যিকের এরকম দাবি গ্রাহ্য করবার মতো বিচার বিবেচনা অনেকদিন থেকে আপনারা দেখিয়ে আসছেন- সেজন্য গভীর ধন্যবাদ। লেখা দিয়ে আপনার সব টাকা শোধ করে দেব, না হয় ক্যাশে। ক্যাশে শোধ করতে গেলে ছ-সাত মাস তার বেশি নয়, দেরী হতে পারে।” এক সময় তিনি, এই অবস্থায় পড়বার অনেক আগে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তকে লিখেছিলেন “চারদিকে বে-দরদীর ভিড়। আমার যে কটি সমানধর্মা আছি, একটা নিরেট অচ্ছেদ্য মিলন-সূত্র দিয়ে আমাদের গ্রথিত করে রাখতে চাই। আমাদের তেমন পয়সা-কড়ি নেই বলে জীবনে “creative comforts” জিনিসটা হয়তো চিরদিন আমাদের এড়িয়ে যাবে।” বিভিন্ন জায়গায় কাজের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরেছেন, বছরের পর বছর অনিশ্চিত জীবন যাপন করতে হয়েছে তাঁকে। খবরের কাগজের দপ্তরে কাজও করেছেন। স্বরাজ-এ প্রায় বেতনহীন অবস্থায় কয়েক মাস কাজ করেছেন, রবিবারের সাময়িকী দেখতেন। এই কাগজের চাকরি ছাড়ার পরেই তীব্র আর্থিক দুরবস্থায় পড়ে বাধ্য হন উপন্যাস লিখতে, রোজগারের জন্য, স্বাভাবিকভাবেই অনেকাংশে তা তাই হয়ে উঠে আত্মজৈবনিক। নিজস্ব যন্ত্রণা-জটিল জীবনের আলো-আধার অনুসৃত সৃজনের পেছনে থেকেছে তার আত্মগত উচ্চারণ।

জীবনানন্দের মৃত্যুর পর “জলপাইহাটি” তাঁর বৃহত্তম গ্রন্থ। পূর্ববংগের এক কল্পিত জনপদ “জলপাইহাটি। উপন্যাসের পা-ুলিপির প্রথম পাতায় জীবনানন্দের নিজের দেওয়া তারিখ ৮/৪/৪৪, শেষ পাতায় ৯/৫/৪৮। পূর্বপাকিস্তান ছেড়ে আসার পর কলকাতায়; ১৮৩, ল্যান্সডাউন রোডের বাড়িতে বসেই লেখা। মফস্বলের ছবি জীবনানন্দের অন্তরের গভীর থেকে গভীরতর উৎসে ছিলো, তার ভাবনাগত প্রতিক্রিয়া দেখলে তা অনুভব করা যায় : কলকাতার চেয়ে মফস্বলের প্রকৃতি, লোকেদের ভালো লাগে তার। সেই সব মানুষদেরও ভালো লাগে “মফঃস্বলের গ্রামপ্রান্তর থেকে উপচে পড়ে যে সব মানুষ কার্তিকের বিকেলের রোদে, চোতবোশেখের শেষ রাতের ফটিক জলের মতো জোৎস্নায়। এসব মানুষ সব ঋতুতে সবসময়ই ভালো।” অথবা “কি অপরাধ হতো জলপাইহাটিতে ছোট আশা, সাদাম্টাা কাজ, খাঁটি শান্তি, বৃহৎ মমতার ভেতরে পড়ে থেকে একদিন পৃথিবী থেকে অণুর মত রেণুর মতো একটুখানি আশা মুছে ফেলে সময়ের নিরবিচ্ছিন্ন গতি-অগতি সাগরের অচেতনায় হারিয়ে গেলে?” দেশবিভাগজনিত বিষাদ, ব্যক্তি মানুষের নিঃসঙ্গতার বিপন্নতাকে ভিত্তি করে লেখা এই উপন্যাসটি সম্পর্কে কথাকার অমর মিত্র লিখেছেন : তিনি ১৯৪৮-এর খ-িত বাংলা, স্বাধীন ভারতবর্ষ, কলকাতা শহর নিয়ে পৃথিবীর কথা বলতে চাইছেন তো বলার জন্য, ওই সব যুক্তির ধার ধারেননি। যুক্তি হয়তো কাহিনীকে শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করায়। আবার যুক্তিহীনতা যে পরে যুক্তির সমগ্রতা হয়ে দাঁড়ায় তা “জলপাইহাটি” পড়তে পড়তে টের পাওয়া যায়। ১৯৪৮-এর ৮ এপ্রিল থেকে ওই সালের ৯ মে- একমাসে ৫১৭ পাতার উপন্যাস লিখে ফেললেন! হিসাবে প্রায় একলক্ষ তিরিশ হাজারের মতো শব্দ। কীভাবে সম্ভব হয়েছিলো ভাবতে গিয়ে ঠাঁই পাই না। কখনো সন্দেহ জাগে সন তারিখ নিয়ে, আবার কখনো মনে হয়, এ যেন গভীর এক নিস্ত ব্ধতায় ডুবে গিয়ে লেখা। এমন এক তাড়না ছিলো তাঁর ভেতর যা না লিখে পারছিলেন না। উপন্যাস লিখব বলে যেন লেখেননি জলপাইহাটি, এ যেন জোৎস্নাতাড়িত হয়ে লেখা-।

বিংশ শতাব্দীর সূচনা পর্বের স্বপ্ন দেখা জগৎ স্বপ্ন দেখান জগৎ, ক্রমশ শতাব্দীর বয়স হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্টাচ্ছিলো। প্রকৃতির রূপ রস-এ নিমজ্জিত কবিও এই যন্ত্রণার বিবর্তন টের পেয়েছেন। যুদ্ধ, মন্বন্তর, দাংগা, কালোবাজারী, বেকারত্ব, সমাজ ও রাষ্ট্রকে অস্থির করে তুলেছিলো, পরাধীনতার বেদনা ও স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা এই সময়ের সর্বোচ্চ আলোড়ন। “শতাব্দীর এই রাক্ষসী বেলায় আর বাস্ত বের রক্ততটে জীবনানন্দের আগমন। যার কাছে বাংলার লক্ষ গ্রাম “নিরাশায় আলোকহীনতায় ডুবে নিস্ত ব্ধ নিস্তে জ”। জীবনানন্দ যে যন্ত্রণায় তাড়িত হয়েছিলেন তা কি শুধু বাইরের জগতের, নাকি তাঁর অভ্যন্তরের, খবর কে রাখে?

ছবি

বিকল্প জীবন

সাময়িকী কবিতা

ছবি

হার না মানা নারী জীবনের উপাখ্যান

ছবি

কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা

ছবি

‘যে-কোনো দেশে ভাল সাহিত্য-অনুবাদক খুব কম’

ছবি

দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড-এর কবি এলিয়ট

ছবি

আর এক সুন্দর সকালবেলায়

ছবি

আবার নরকুম্ভির ও মডার্নিজম

ছবি

আত্মজীবনীর আত্মপ্রকাশ প্রসঙ্গে

ছবি

আসাদের অঙ্ক

ছবি

র্যাঁবোর কবিতায় প্রতীকী জীবনের ছায়া

ছবি

ভাষা সংস্কৃতি সাক্ষরতা

ছবি

হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতার আভিজাত্য

ছবি

চেশোয়া মিওশ-এর কবিতা

ছবি

সিলভিয়া প্লাথের মৃত্যু, নিঃসঙ্গতা ও আত্মবিনাশ

ছবি

সমসাময়িক মার্কিনি ‘সহস্রাব্দের কণ্ঠস্বর’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

অন্য নিরিখে দেখা

ছবি

হেলাল হাফিজের চলে যাওয়া

ছবি

হেলাল হাফিজের কবিতা

ছবি

কেন এত পাঠকপ্রিয় হেলাল হাফিজ

ছবি

নারী শিক্ষাবিদ : বেগম রোকেয়া

ছবি

বাসার তাসাউফ

ছবি

‘জগদ্দল’-এর শক্তি ও সমরেশ বসু

ছবি

রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

ছবি

রুবেন দারিও-র কবিতা

‘অঘ্রানের অনুভূতিমালা’

ছবি

কবিতা পড়া, কবিতা লেখা

ছবি

‘ধুলোয় সব মলিন’, পাঠকের কথা

ছবি

মহত্ত্বর কবি সিকদার আমিনুল হক

ছবি

রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

ছবি

কয়েকটি অনুগল্প

সাময়িকী কবিতা

ছবি

যেভাবে লেখা হলো ‘শিকিবু’

ছবি

জাঁ জোসেফ রাবেয়ারিভেলোর কবিতা

ছবি

সিকদার আমিনুল হকের গদ্য

tab

সাময়িকী

সেদিন দু’দ- এই বাংলার তীর

গৌতম গুহ রায়

বৃহস্পতিবার, ০২ জানুয়ারী ২০২৫

>চলে যাব, সেদিন মরণ এসে অন্ধকারে আমার শরীর
ভিক্ষা করে লয়ে যাবে,- সেদিন দু’দ- এই বাংলার তীর-
এই নীল বাংলার তীরে শুয়ে একা একা কী ভাবিব, হায়,-

একটি পথ দুর্ঘটনা বা পূর্বঘোষিত মৃত্যুর প্রস্তুতি

শরীর খুব অসুস্থ, কদিন ধরেই তেতে ছিলো অভব্য প্রতিবেশী ভাড়াটিয়ার কারণে। প্রতিদিনের মতোই ১৪ অক্টোবর বিকালে তিনি হাঁটতে বের হলেন। একা জীবনানন্দ। যখন বেরুচ্ছিলেন স্ত্রী লাবণ্যদেবী তাঁকে বেরুতে নিষেধ করলেন, শরীর অসুস্থ ছিলো কয়েক দিন ধরেই। লাবণ্যদেবীর কথায় তাঁর নিষেধ না শুনেই জল দিয়ে মাথা ধুয়ে একাই বেরিয়ে যান। ফেরার সময় বাড়ির কাছের লেক মার্কেট থেকে দুটো ডাব কিনে নেন।

হাঁটতে হাঁটতে জীবনানন্দ রাসবিহারী এভিনিউ ও ল্যান্সডাউন রোডের সংযোগ স্থলের প্রায় কাছাকাছি এসে গেছেন, তিনি আসছিলেন রাসবিহারী এভিন্যু-র দক্ষিণ দিকের ফুটপাথ ধরে, সংযোগ স্থলে এসে ফুটপাথ থেকে নেমে রাস্ত া অতিক্রম করার জন্য পথে নামলেন। রাস্ত ার এই অংশটা বেশ চওড়া, ট্রাম যাতায়াতের জন্য রাস্তার মাঝখানে দুটো ট্রাম লাইন পাতা। ট্রাম লাইনের জমিটা ঘাসে সবুজ। তিনি ফুটপাথ থাকে নেমে মোটর, বাস, ট্যাক্সি প্রভৃতির জন্য পিচ রাস্ত ার অংশ অতিক্রম করে ট্রাম লাইনের কাছে এলেন, মনটা কিছুটা চঞ্চল ছিলোই, ভাবলেন ট্রাম আসার আগেই লাইন পার হয়ে যেতে পারবেন, এর আগে তো একটা স্টপেজ আছেই, এই সব ভাবতে ভাবতে কিছুটা অন্যমনষ্ক হয়েই ট্রাম লাইন পার হতে লাগলেন।

তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে, অন্ধকার অল্প অল্প করে জমছে। ট্রামটা আসছিলো, আগের স্টপেজে লোক ওঠা-নামার না থাকায় না থেমে জোরের সাথেই চলে এলো, ছুটন্ত ট্রামটি জোরের সাথেই এসে ধাক্কা দিলো কবিকে, জীবনানন্দ আর ট্রাম লাইন পার হতে পারলেন না। সংগে সংগে আহত ও অচৈতন্য হয়ে ট্রাম লাইনের সেই সবুজের উপর ছিটকে পরলেন, ট্রামের ক্যাচারের ভিতরে দেহটা ঢুকে গেলো। রাসবিহারী এভিনিউ ও ল্যান্সডাউন রোডের সংযোগস্থলের দক্ষিণে একটা জলখাবারের দোকান ছিলো, নাম ছিলো “জলখাবার”। মালিক চুনীলাল দে পরে সেখানে “সেলি কাফে” নামে রেস্টুরেন্ট খোলেন। জীবনানন্দের দুর্ঘটনার সময় এই চুনীবাবু শুধু প্রত্যক্ষদর্শীই ছিলেন না, তিনি ছুটে গিয়ে অনেক সাহায্যও করেছিলেন। সেই চুনীবাবুর কথায়, “একটু পরেই হঠাৎ ট্রামের একটা শব্দ, বালিগঞ্জমুখো একটা ট্রাম কাকে যেন চাপা দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গেই পথচারীদের অনেকেই এসে গেলেন। গিয়ে দেখেন একজন লোক অচৈতন্য হয়ে ট্রামের ক্যাচারের মধ্যে পড়ে আছেন। ট্রাম দাঁড়িয়ে আছে। ট্রামের ড্রাইভার দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই ভিড়ের মাঝে গা ঢাকা দিয়ে সরে পড়েছে। যাই হোক, আমি তখনি ট্রামের তলায় ঢুকে আস্তে আস্তে তাকে বের করলাম। সমবেত জনতার দু’একজনের কথা কানে আসছিল, ট্রাম লাইনের ঘাসের উপর দিয়ে এই ভদ্রলোক আনমনে আসছিলেন। ট্রাম ড্রাইভার হর্ন দিয়েছিল, দু’একজন চিৎকার করলেও ভদ্রলোক কিসের চিন্তায় এমন বিভোর ছিলেন যে কিছুই তাঁর কানে যায়নি। যখন তাঁকে বেরকরা হলো, তখন তিনি অজ্ঞান। দু-তিনজনে মিলে জ্ঞ্ানহীন জীবনানন্দকে ট্যাক্সিতে তোলা হলো, শম্ভূনাথ প-িত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো।

চুনীবাবু তাঁকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে রেখে এলেন, সাধারণ রুগির মতোই পড়ে রইলেন জীবনানন্দ দাশ। পড়ে আত্মীয়স্বজন অন্য বিভাগে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও তাঁর শরীরের অবস্থার কারণে তা সম্ভব হয়নি আর। ট্রামের ধাক্কায় জীবনানন্দের বুকের কয়েকটা হাড়, কাঁধের হাড় এবং পায়ের হাড় ভেঙ্গে গিয়েছিলো। বিধান রায় তাকে দেখতে গিয়ে জানিয়ে দেন যে, তাঁর আর বাচার আশা নেই, যতদিন থাকেন একটু শান্তিতে রাখবেন। শম্ভুনাথ হাসপাতেলেই যখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন কবি, ১৪ অক্টোবর রাত ৮টায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, ২২শে অক্টোবর রাত ১১টা ৩৫মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। গোটা জীবন অশান্তি ও অতৃপ্তির যন্ত্রণার এইভাবেই পরিসমাপ্তি ঘটলো। সবুজ ঘাস তার প্রিয় ছিলো, অন্তিম আঘাতেও তিনি ছিটকে পড়েছিলেন সেই সবুজ ঘাসেই।

আশা স্বপ্নের ছাইভষ্ম

১৯৫১-র ২৮শে মে ১৮৩ ল্যান্সডাউন রোডের বাড়ি থেকে উত্তর বাংলার জলপাইগুড়ি শহরের তরুণ লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক সুরজ্তি দাশগুপ্তকে চিঠিতে লিখেছিলেন যে, একবার ঘুরে আসতে ইচ্ছে করে, সভাসমিতি ইত্যাদি সবকিছুর হাত সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে তোমাদের মতো দুএকজনের সাহায্যে হিমালয়, চা-বাগান ইত্যাদি দেখে আসার লোভ জেগেছে মনে। পঞ্চাশোর্ধ কবির আরো অনেক ইচ্ছার মতই এই ইচ্ছাও পূর্ণ হয়নি। আত্মদহনে ছটফট করতে থাকে এই মানুষটা। তাঁর যাবতীয় অনিচ্ছা অতৃপ্তির সঙ্গে সহবাস করতে করতেই ইচ্ছাগুলোকে হারিয়ে ফেলছিলেন। এই হারানোর যন্ত্রাণাগুলোকে চেপে রেখে ব্যক্তিজীবনে আপোসকামী হয়ে যেন নিজেকেই কুরেকুরে খাচ্ছিলেন তিনি। সেই চিঠিতে জীবনানন্দ লেখেন “এখুনি ঝিলের পারে ঘাসের ওপরে আকাশের মুখোমুখি নিজেকে ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। নদী, ঝিল, পাহাড়, বন, আকাশ- কোনো নিরালা জায়গা থেকে এসবের নিকটসম্পর্কে আসতে ভাল লাগে আমার। বসে থাকতে পারা যায় যদি এদের মধ্যে, কিংবা হেঁটে বেড়াতে পারা যায় সারাদিন, তা হলেই আমাদের সময় একটা বিশেষ দিক দিয়ে (আমার মনে হয়) সবচেয়ে ভালো কাটে।” নির্জনতা ও বিষণœতা আক্রান্ত জীবনানন্দের, প্রকৃতি ও মানবতার ছায়া-আচ্ছন্ন জীবনানন্দের ভালোলাগাগুলোর ছোট ছোট টুকরোগুলো এমনই ছিলো। ঝিলের পাশে ঘাসের ওপরে আকাশের মুখোমুখি নিজেকে ছড়িয়ে দিতে চাওয়া কবির ভালোবাসার ইচ্ছেগুলোও ছিলো ভেসে বেরানো মেঘের মতো, শুভ্র ও খ-খ-, নিঃস্বার্থ ও উচ্চাশামুক্ত। এইসব ভালো লাগার জল ভরা সতেজ বাতাস সজীব রেখেছিলো “শুদ্ধতম” কবি জীবনানন্দকে। এইসব ভালো লাগার ইচ্ছের অধিকাংশই ইচ্ছেপূরণের আনন্দে উত্তীর্ণ হয়নি, এই অতৃপ্তির যন্ত্রণার দহনেই দগ্ধ হয়েছেন তিনি নীরবে।

জীবনানন্দের ৫৫ বছরের জীবনে ১৯১৯-এ “ব্রহ্মবাসী” পত্রিকায় প্রকাশিত (বৈশাখ ১৩২৬) “বর্ষা আবাহন” কবিতা থেকে শুরু ধরলে কবিজীবন মাত্র ৩৪ বছরের, প্রকৃত বিচারে যদিও কবি জীবনানন্দের আয়ুষ্কাল আরো কম। এই কবি প্রধানত ছোটকাগজের লেখক। ভূমেন্দ্র গুহর ভাষায়, “জীবনানন্দ আজীবন ছোটো কাগজের দাবি মেনে চলেছেন, এবং মানতে ভালোবেসেছেন, যদিও বড়ো কাগজে যথোপযুক্ত মর্যাদা সহকারে লেখা বের হোক, তাও তার কাম্য ছিলো। এই কারণেই যখন প্রান্তবাংলার জলপাইগুড়ির এক লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক লিখলেন, আধুনি সাহিত্য, বিশেষত, আধুনিক বাংলা কবিতা সম্বন্ধে উত্তরবঙ্গের মানুষদের জন্য একটা পত্রিকা প্রকাশ করতে চাই। আপনার একটা কবিতা চাই। জীবনানন্দের পর্যায়ের কবি এর উত্তরে কত অনায়াসে “শিরিষের ডালপালা লেগে আছে বিকালের মেঘে” মম্ফঃস্বলের নাম না জানা, না দেখা, সাক্ষাৎপরিচয়হীন সদ্য কৈশোর অতিক্রান্ত ছাত্রদের পত্রিকায় প্রকাশের জন্য পাঠিয়ে দেন। এর মধ্যে তাঁর চরিত্রের “আরো এক বিপন্ন বিষ্ময়” প্রকাশ পায়, যার অস্তি ত্ব অর্থ, কীর্তি ও সচ্ছলতার অতীত। জীবনানন্দকে জলপাইগুড়ি আসার আমন্ত্রণ করা হয়েছিলো “জলার্ক”-এর তরুণদের পক্ষ থেকে। ১৯৫২-র ২০ জানুয়ারি জীবনানন্দ সুরজিত দাশগুপ্তকে এক চিঠিতে লেখেন, “জলপাইগুড়ির ওদিককার অঞ্চল, পাহাড়, নদী, জংগল বেশ দেখবার মতো, ঘুরবার মতো, ঘুরে বেড়াবার মতো, আমার খুব ইচ্ছা করে, জল্পাইগুড়ির দিকে একবার যাব ভাবছি।” কিন্তু কবির এই ইচ্ছা অপূর্ণই থেকে যার। ১৯৫২তে লেখেন- “আমার এখন জলপাইগুড়ি যাবার কোনো সম্ভাবনা নেই। যেতে পারলে অবশ্য আনন্দিত হতাম।”

অসুস্থতা, বেকারত্ব, পারিবারিক অশান্তিতে বিপর্যস্ত কবি যেন সেসময় তাঁর ভালো লাগার জগত থেকে ক্রমশ ছিটকে যাচ্ছেন। এমনকি, কবিতাও লিখতে পারছেন না এই সময়। কবি কায়সুল হককে লেখা এই সময়ের একটি চিঠিতে তিনি একথা লিখেছিলেন। ১৯৫২ সালের ২৬ জুন তিনি জানালেন, “নানা কারণে মন এত চিন্তিত আছে, শরীরও এত অ্সুস্থ যে অনেকদিন থেকেই কিছু লিখতে পারছি না।” আলোচ্য এই চিঠিগুলো জীবনানন্দ লিখেছিলেন ১৯৫১-৫২, যখন তাঁর অন্তরাত্মা চাইছিলো জলপাইগুড়ির মতো কোনো সবুজ নির্জনতা। যেখানে তিনি আশ্রয় নিতে চাইছিলেন। তখন চারপাশ তাঁর কাছে রূঢ় হয়ে উঠছিলো। রূঢ় বাস্ত বের মুখোমুখি অসহায় অবস্থা তাঁর। প্রতিটি ইচ্ছা ও কামনার মৃত্যু পরখ করছেন প্রতিদিন। ১৯৫০-এর ২ সেপ্টেম্বর তিনি খড়্গপুর কলেজে অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন, সদ্য প্রতিষ্ঠিত কলেজে নামমাত্র মাইনে পেতেন। স্ত্রী লাবণ্য ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজে বি.টি. পড়তে গুরু করেছেন এসময়। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি “এলকাইনা” রোগে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৯৫১-র জানুয়ারি, স্ত্রীর অসুস্থতার খবরে কলকাতা আসেন কবি। লাবণ্যদেবী সুস্থ হচ্ছেন না দেখে ছুটির সময় বাড়ানোর আবেদন করেন কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে, কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ ২৫ ফেব্রুয়ারি তাঁকে বরখাস্থ করে দেয়। এসময় সহকর্মী পুলিন বিহারীকে কবি লেখেন, “বড়ই বিপদের ভেতর আছি। খড়্গপুর কলেজে থেকে ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে তিনশত টাকা পেয়েছিলাম। ফেব্রুয়ারি মাসে যে কাজ করেছিলাম, সে পাওনা আজ পর্যন্ত পাইনি। অন্তত পূর্বের মাইনে না পেলে এই দুর্দিনে কিছুতেই টিকে থাকতে পারবো না।”

এ সময় চরম বেকারত্বের। তাঁর কাঁধেই সংসারের ভার। বাড়ি নিয়ে পরিবার নিয়ে তাঁর শত দুশ্চিন্তা। খড়গপুরের কলেজের সাড়ে পাঁচ মাসের মেয়াদি চাকরি চলে যাওয়ার পর সর্ম্পূর্ণ বেকারত্ব তাঁকে অসহায় অবস্থায় ঠেলে দেয়। শুরু হয় আবার চাকরির খোঁজ। ১৯৫৯ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির রিসার্চ এসিস্ট্যান্টের জন্য দরখাস্ত করেন কবি। প্রার্থী হন চারুচন্দ্র কলেজে অধ্যাপনার জন্য। এসব ছেড়ে একসময় ব্যবসায় নামার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন তিতিবিরক্ত, হতাশ জীবননন্দ। এ সময় তাঁর সবচেয়ে বড় সম্পদ আত্মবিশ্বাসেও ফাটল ধরেছিলো। অধ্যাপনার বা পড়ানোর কাজ খুব একটা পছন্দের ছিলো না, তবুও হন্যে হয়ে খুঁজেছেন। ভাইবউ নলীনী চক্রবর্তীকে তিনি অধ্যাপনা সম্পর্কে লিখেছিলেন। “অধ্যাপনা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সে সবের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আপনি যা লিখেছেন ঠিকই। তবে অধ্যাপনা জিনিসটা কোনো দিনই আমার ভাল লাগেনি। যে সব জিনিস যাদের কাছে যেমনভাবে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে- তাতে আমার বিশেষ আস্থা নেই। এই কাজে মন তেমন লাগে না, তবুও সময় বিশেষে অন্য কোনো কোনো প্রেরণার চেয়ে বেশি জাগে তা স্বীকার করি।” প্রভাতকুমার দাস এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, “শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করেও, সন্তুষ্ট ছিলেন না, সম্ভবত নিশ্চিন্ত কোনো শিক্ষকতা কোনো দিন পাননি। একটা কাজের খোঁজে হন্যে হয়ে উঠেছিলেন, চিঠি লিখেছিলেন শিক্ষকতা/অধ্যাপনা চাকরির খোঁজের জন্য হরপ্রসাদ মিত্র, নরেশ গুহ কিংবা অনিল বিশ্বাসকে। হরপ্রসাদ মিত্রকে লিখেছিলেন : “অমৃতবাজার পত্রিকায় দেখা গেছে, কলকাতার কয়েকটি প্রথম শ্রেণীর কলেজে ইংরাজি শিক্ষক নেওয়া হবে। কিন্তু কলেজের নামের পরিবর্তে পোস্ট বক্স নম্বর ব্যবহৃত বলে বুঝতে পারছি না স্কটিশচার্চ অথবা সিটি কলেজের প্রয়োজনে এই বিজ্ঞাপন।”

আর্থিক প্রয়োজনে জীবনানন্দ একসময় সিনেমার গান লেখবার কথাও ভেবেছিলেন। বন্ধু কবি অরবিন্দ গুহের কাছে একবার জানতে চেয়েছিলেন- সিনেমার গান লিখলে নাকি টাকা পাওয়া যায়? তুমি কিছু জানো এবিষয়ে? অরবিন্দ বাবু তখন এ বিষয়ে প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে যোগাযোগের কথা বলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর প্রেমেন্দ্র মিত্রের কাছে বিষয়টি তুলতে পারেননি কবি। এর পর অরবিন্দ বাবু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের কথা বলেন। সিনেমার ডিরেক্টর শৈলজানন্দ বাবু জীবনানন্দের কাছের-মানুষ ছিলেন। কিন্তু এক্ষেত্রেও পূর্বের মতই কবি আর বিষয়টি তুলতে পারেন নি। কারণটি বেশ মজা করে অরবিন্দবাবুকে তিনি বলেছিলেন : এরপর সকৌতুক ভংগিতে তিনি বলেন, “যদি শৈলজা আমার জন্য কোথাও একটা ব্যবস্থা করে দেয় তাহলেও আমি কেমন করে লিখব, ‘রাঁধে-এ-এ-এ, ঝাঁপ দিলি তুঁই মরণ যমুনায়’।”

এই কথোপকথনের কিছুদিনের মধ্যেই সেই মহা দুর্ঘটনা, ১৪ অক্টোবর। এমনই একদিন আড্ডাছলে জীবনানন্দ অরবিন্দ গুহকে বলেছিলেন : “আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না। আমি মানুষের নীতিবোধে বিশ্বাস করি।”

এই বিশ্বাসের প্রতিফলন ছিলো জীবনানন্দের জীবন ও সাহিত্যে, কবিতায় ও কথায়। চূড়ান্ত বিপন্নতার মাঝেও তিনি এই বিশ্বাস ধরে রেখেছিলেন। গোটা জীবন যে আর্থিক অনিশ্চয়তা তাকে তাড়া করে বেরিয়েছে তাই তার প্রধান বিপন্নতা ছিলো।

মুর্শিদাবাদের সরকারি আমলা অনিল বিশ্বাসকে লেখা তাঁর চিঠির মধ্যেও কবির বিপন্নতা ধরা পড়ে : “বর্তমানে অত্যন্ত অসুবিধায় আছি, কাজ খুঁজছি। কলকাতায় একটা সাধারণ কাজও পাওয়া যাচ্ছে না। জংগীপুর কলেজে একজন ইংরেজি শিক্ষক নেওয়ার বিজ্ঞাপন দিয়েছে, আমার বর্তমান অবস্থা এমন যে কোনো রকম কাজ করতে আমি কোনোরকম দ্বিধা করবো না।” অথচ, আমরা জানি তিনি কলকাতাকে আঁকড়ে ধরেই থাকতে চেয়েছিলেন, বুদ্ধদেব বসুকে লিখেছিলেন : “কলকাতার অলিগলি মানুষের শ্বাস রোধ করে বটে, কিন্তু কলকাতার ব্যবহারিক জীবনে প্রান্তরের মতো মুক্তি পাওয়া যায়; এখন যখন জীবনে কর্মবহুলতার ঢের প্রয়োজন, কলকাতার এই স্বচ্ছন্দ পটভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা চলে না আর।” এখানে উল্লেখ করতে হয় নলিনী চক্রবর্তীকে লেখা তাঁর উক্তি : “বরাবরই আমার জীবিকা নিয়ে কলকাতায় থাকার ইচ্ছে।” সাম্প্রতিক উদ্ঘাটিত তাঁর ডায়েরিতে লেখা কথাগুলো জীবনানন্দের এই চাওয়া-পাওয়ার সংঘাত, অপছন্দের চেহারাটা চিনতে সাহায্য করবে-

9.8.31 Very often... I think that instead of frittering away my energy. I ought to just do that for wh I Hand & in wh I escel of delight & wh is my true vocation. Literature (press & publication) through s profession or cslling wh nourishes it as I city coll or non Beng Jobs never will...

-Have I ever paid a single pice to coll street window or various other begaers?

-The leper`s child & various other infants with duress appeal & reflections infinite on them.

-on “বসে থাকা”- বেকার কখনও বসে থাকে না। they stand & run & throb & palpitute it is only I well-placed who have I etrenal charm of the easy chair or cushions, so for & bels for them.

ডাইরিতে এমন কথাটুকরো তিনি লিখেছিলেন খড়্গপুরের কলেজের চাকরি হারানোর অনেকদিন আগেই। ১৯৫১-তে যে দুর্বিসহ আর্থিক চাপ তাঁর উপর নেমে আসে তাতে একসময় বিপন্ন জীবনানন্দ জনৈক পরিচিতের সঙ্গে ব্যবসায় নামার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন, যদিও তা শেষ পর্যন্ত ভেঙ্গে যায়। খাঁ খাঁ বেকার সংসারের চাপে জীবনানন্দ প্রত্যহ খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনের কলাম থেকে বিভিন্ন কাজের খোঁজ নিয়ে আবেদন করতে থাকেন। তাঁর এরকম অসহয় জীবনের, অর্থাৎ কর্মহীন পর্বে একবার পরিচিতদের পরামর্শে দেখা করতে গিয়েছিলেন রাইটার্স রেভিনিউ বোর্ডের সদ্য আউসিএস সত্যেন ব্যানার্জীর সঙ্গে। দেখা করতে গিয়ে রীতিমতো অসুস্থ হয়ে পড়েন, রাইটার্স বিল্ডিংয়েই অবনীমোহন কুশারীর ঘরে তিনি অচৈতন্য হয়ে পড়েছিলেন।

কিন্তু কোথাও চাকরি জোটেনি ইংরেজি সাহিত্যে এম. এ, সে সময়ের এই কবি যুবকের। অন্তর্মুখী স্বভাবের জন্য ব্যবসাও করতে পারেননি। পরের বছর চাকরি পেলেন তাঁর স্ত্রী লাবণ্য। এ সময়ই চার মাসের জন্য চাকরি পান জীবনানন্দ, ১৯৫২-র নভেম্বর থেকে ১৯৫৩-র ফেব্রুয়ারি, বরিশাল কলেজে শিক্ষকতার। কিন্তু এখানেও থাকা হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই যখন তাঁর মন শিরীষের ছায়ায়, ঝিলের হাঁসেদের সংগে ডুব দিতে চেয়েছে, তখন দারিদ্র ডুবে যাওয়া ব্যক্তিমান্ষু জীবনানন্দকে দুঃস্বপ্নের মধ্যে থাকতে হয়েছে, অপূর্ণ অতৃপ্ত বাসনাকে সঙ্গী করে। “নারীর হৃদয় প্রেম-শিশু গৃহ নয় সবখানি” এক অসহ্য যন্ত্রণাকে সঙ্গী করে “সবুজ পল্লবিত জারুলের ঐশ্বর্য, হেলিওট্রোপ রঙের ফুল, মেহেদিপাতার বনে স্বপ্নাতুর ঝি ঝি, ছাতিমের গাঙ শালিকের জীবনোচ্ছ্বাস কৃষ্ণচূড়ার অজস্র কুঁড়ি, চারদিককার সফল প্রচুর জীবনের কালীদহ, কলরব কিছুই আমাকে সাহায্য করতে পারে না।” (জামরুলতলা) এ সময়ের যন্ত্রণাদগ্ধ কবির আরো অণুরণন চিহ্ন : এ যুগে কোথাও কোনো আলো, কোনো কান্তিকর আলো চোখের সম্মুখে নেই যাত্রীর/ নেই তো নিঃসৃত অন্ধকার মায়ার মতো।

এই সময়কালে তিনি এতটাই বিপন্ন ছিলেন যে কবিতাও লিখে উঠতে পারছিলেন না। এ সময়ের একটা ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। সুরজিত দাশগুপ্ত একবার জলার্কের জন্য বুদ্ধদেব বসুর কাছে লেখা চাইতে গেলে তিনি প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত লেখার জন্য পৃথক দর উল্লেখ করেছিলেন। সুরজিত বাবু এ কথা জীবনানন্দকে জানিয়ে তাঁর কোন দর আছে কিনা জানতে চাইলে জীবনানন্দ লেখেন, “একটি কবিতার জন্য সম্মানমূল্য আমি সাধারণত ২৫/৩০ টাকা থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত পাই, তোমরা ২০ টাকা দাও। আমি সময় করে ভালভাবে নতুন কবিতা লিখে পাঠাই।” লেখার জন্য সময় ও সাধনা দরকার, গদ্যের চেয়ে কবিতার বেশি। ২রা নভেম্বর ১৯৫১তে তিনি এই চিঠিটি লেখেন।

পূর্ববাংলার প্রকৃতি ছিলো তাঁর চেতনার গভীরে শেকড় গেড়ে। এর বীজ শৈশবেই রোপণ করা হয়েছিলো। ভাই অশোকানন্দের ভষায় : প্রকৃতির সৌন্দর্যে মগ্নচিত্ত সেই কিশোর আপনার পরিবেশকে বর্ণে, সুগন্ধে অপরূপ করে তুলবার সাধনায় ব্রতি হয়েছিলেন। উঁচু ক্লাসে পড়ার সময় কলকাতার এক নার্সারি থেকে ফুলের চারা আনিয়েছিলেন, নিজের ঘরের ঠিক সামনে কিছুটা জমি ঘিরে ফুলের বাগান তৈরি করেছিলেন। জুঁই, চাঁপা, গন্ধরাজ, চামেলি, কাঠালচাঁপা, নীলজবা, হাস্নুহেনা আর আশ্চর্য সুন্দর সব গোলাপ; তাছাড়া, কৃষ্ণচূড়ার নার্সারির ক্যাটালগে নাম ছিলো পন্সিয়ানা রিজিয়া।... পন্সিয়ানা রিজিয়া গাছ বড় হয়ে গ্রীষ্মকালে অজ¯্র রক্তিম পুষ্পতে ভরে যেত, মনে হতো যেন লাল আগুন জ্বলছে। এই গাছটি দাদার অতি প্রিয় ছিল। অনেক সময় চেয়ার পেতে এই গাছট তলায় বসে লিখতেন। “আমার কামনা কি জান? বোইচি, ময়নাকাটা, বাবলা, ফণীমনসা। বন অপরাজিতার পাশ দিয়ে এক একটা সাদা ধুলোমাখা ভারী শুদ্ধ আঁকাবাঁকা গ্রামের পথ থাকে, তারই পাশে এক একটা প্রান্তরের অপরিসীম নিশ্বাসের বিস্ত ারের সবুজ ঘাস আছে সেখানে। তাদের ভেতর শষ্যপোকা আছে। দিয়ালি পোকা আছে, গঙ্গা ফড়িং আছে, কাঁচ পোকা আছে, সুদর্শন উড়িয়া আসে। হলুদ, কমলা, জর্দানীল রঙের প্রজাপতি কাশফুলের ভেতর সমস্ত দুপুর ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়ায়, কোথাও হয়ত কতগুলো পলাশ, অর্জুন গাছ, উলু জঙ্গল, মাছ রাঙ্গার দাঙ্গার শিরশিরানি, এমনি এক জায়গায়, ঘাসের নরম গাছের কাছে, প্রান্তরের একটেরে বনের দেখা আস্বাদ যেখানে অনেকদিন হইতে ছায়া রচনা করিয়া বাঁচিয়া আছেন। রাত্রিদিন শালিক, বুলবুলি, কোকিল ও কাককে আশ্রয় দিতে আসিতেন, সেইখানে খড়ের একখানা ঘর তুলিয়া পড়ি, লিখি, চুরুট ফুঁকি কাটাইয়া দেই-” (সঙ্গ: নিঃসঙ্গ ৪২৪ পৃষ্ঠা)। জীবনানন্দের বেশিরভাগ কবিতা, পরবর্তীতে প্রকাশিত গদ্যসমূহে, ভীষণভাবে উপস্থিত নিসর্গ। এ বিষয়ে বুদ্ধদেব বসুর বহু-চর্চিত উক্তি : “তাঁর সমস্ত কবিতাই কোনো না কোনো অর্থে প্রকৃতির কবিতা।” নিসর্গ এবং প্রকৃতির রকমফের আছে। তাঁর কবিতা আলোচনা প্রসঙ্গে উল্লেখসহ পবিত্র সরকার লিখেছেন: তাঁর নগর-নিসর্গের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় যুদ্ধ বিধ্বস্ত নষ্ট ও দরিদ্র সময়, ফলে এই নিসর্গ তাঁর অনুভবে স্বস্তি বা উজ্জীবন নিয়ে আসে না। জীবনানন্দকে পরিভ্রমণ করতেই হয়, ওই নাগরিকতার বাইরে ওই সময়ের অতিক্রান্তির ওপারে কোনো অনন্ত অতীত ভবিষ্যতে, তাঁর ভূগোল ও ইতিহাস মিলিতভাবে পরস্পরকে আকীর্ণ বিস্ত ারিত করে তবেই তাঁর নিজস্ব নিসর্গকে আবিষ্কার করে।”

“আমার ইচ্ছা করে এই ঘাসের ঘ্রাণ হরিৎ মদের মতো

গেলাসে গেলাসে পান করি

এই ঘাসের শরীর ছানি-চোখে চোখ ঘষি,

ঘাসের পাখনায় আমার পলক

ঘাসের ভিতরে ঘাস হয়ে জন্মাই কোনো এক নিবিড় ঘাস-মাতার

শরীরের সুস্বাদ অন্ধকার থেকে নেমে”

জীবনানন্দের প্রকৃতিলালিত কবিমন উত্তপ্ত সমকাল প্ররোচিত করেছিলো ভিন্ন ধরনের নির্মাণে। সময়কালের নিবিড় অনুভব প্রজ্ঞা থেকে কবি বোঝার চেষ্টা করেছেন চারপাশের মানুষকে, সভ্যতা, জীবন, জগত সময়কে। সালাহউদ্দিন আইয়ুবের ভাষায়, “তিনি দেখেছিলেন পৃথিবীর মানুষীর রূপ স্থূল হাতে ব্যবহৃত হয়ে হয়ে কীভাবে শুয়োরের মাংস হয়ে যায়, অন্ধকার সমস্ত অট্টহাসির ভিতর একটি বিরাট তিমির মৃতদেহ নিয়ে কীভাবে স্ফিত হয়ে ওঠে, কীভাবে ঊর্বশীর শরীর ডাইনির মাংসের মতন বাদুড়ের খাদ্য হয়ে যায়; উন্নত পৃথিবীর একপিঠে তিনি দেখেছেন স্পন্দন, সংঘর্ষ, গতি উদ্যম, চিন্তার কাজ, অন্যপিঠে শত শত শূকরের চিৎকার, শত শত শূকরীর প্রসব বেদনার আড়ম্বড়ের মতো ভয়াবহ আরতি।” মুমুর্ষূ পৃথবীর সূর্যাস্ত কে তাঁর মনে হয়েছিলো বেহেড আত্মার মতো। “মূর্খ” ও “রূপসীর ভয়াবহ সঙ্গম” এই রকম একটি বাক্যে বর্তমান সভ্যতার একটি মৌলিক অন্তর্বিরোধ তিনি তুলে ধরতে চেয়েছিলেন, তাঁর আশঙ্কা ছিলো-

“কবি তুমি ক্রমে ক্রমে হিম হয়ে পড়িতেছ বলে / সুন্দর যেতেছে মরে ধীরে ধীরে / শান্তি আর থাকিবে না।” অথবা “বেলা অবেলা কালবেলা”য় “নিসর্গের কাছ থেকে স্বচ্ছ জল পেয়ে/ তবু নদী মানুষের / মূঢ় রক্তে ভরে যায়; সন্দিগ্ধ হয়ে প্রশ্ন করে, নদী / নির্ঝরের থেকে নেমে এসেছ কি? মানুষের হৃদয়ের থেকে?” তাই তিনি দেখেন অধিকাংশ সৃষ্টিই তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের রসদ সমৃদ্ধ, নিজস্ব যন্ত্রণার জটিল জীবনের আলো আধারিকে আশ্রয় করেই ভাবনাগুলি প্রকাশ পায়। ফলে তার মননে থাকে আত্মগত উচ্চারণ। নিছক আত্মগত উচ্চারণেই থেমে থাকা নয়, তাঁর কথাসাহিত্যের অধিকাংশই আত্মজৈবনিক বলেও মনে হয়। ইতিপূর্বে কিছু চিঠির উল্লেখ করেছি, এমনি ১৯৫৭’র জ্যৈষ্ঠ মাসে কবি লেখেন- “বেশ ঠেকে পড়েছি, সে জন্য বিরক্ত করতে হলো আপনাকে। এখুনি পাঁচশ টাকার দরকার, দয়া করে ব্যবস্থা করুন। এই সঙ্গে পাঁচটি কবিতা পাঠাচ্ছি। পরে প্রবন্ধ ইত্যাদি (এখন কিছু লেখা নেই) পাঠাবো। আমার একটা উপন্যাস (আমার নিজের নামে নয়, ছদ্মনামে) পূর্বাশায়, কিন্তু টাকা এক্ষুনি চাই- আমাদের মত দু-চারিজন বিপদগ্রস্ত সাহিত্যিকের এরকম দাবি গ্রাহ্য করবার মতো বিচার বিবেচনা অনেকদিন থেকে আপনারা দেখিয়ে আসছেন- সেজন্য গভীর ধন্যবাদ। লেখা দিয়ে আপনার সব টাকা শোধ করে দেব, না হয় ক্যাশে। ক্যাশে শোধ করতে গেলে ছ-সাত মাস তার বেশি নয়, দেরী হতে পারে।” এক সময় তিনি, এই অবস্থায় পড়বার অনেক আগে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তকে লিখেছিলেন “চারদিকে বে-দরদীর ভিড়। আমার যে কটি সমানধর্মা আছি, একটা নিরেট অচ্ছেদ্য মিলন-সূত্র দিয়ে আমাদের গ্রথিত করে রাখতে চাই। আমাদের তেমন পয়সা-কড়ি নেই বলে জীবনে “creative comforts” জিনিসটা হয়তো চিরদিন আমাদের এড়িয়ে যাবে।” বিভিন্ন জায়গায় কাজের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরেছেন, বছরের পর বছর অনিশ্চিত জীবন যাপন করতে হয়েছে তাঁকে। খবরের কাগজের দপ্তরে কাজও করেছেন। স্বরাজ-এ প্রায় বেতনহীন অবস্থায় কয়েক মাস কাজ করেছেন, রবিবারের সাময়িকী দেখতেন। এই কাগজের চাকরি ছাড়ার পরেই তীব্র আর্থিক দুরবস্থায় পড়ে বাধ্য হন উপন্যাস লিখতে, রোজগারের জন্য, স্বাভাবিকভাবেই অনেকাংশে তা তাই হয়ে উঠে আত্মজৈবনিক। নিজস্ব যন্ত্রণা-জটিল জীবনের আলো-আধার অনুসৃত সৃজনের পেছনে থেকেছে তার আত্মগত উচ্চারণ।

জীবনানন্দের মৃত্যুর পর “জলপাইহাটি” তাঁর বৃহত্তম গ্রন্থ। পূর্ববংগের এক কল্পিত জনপদ “জলপাইহাটি। উপন্যাসের পা-ুলিপির প্রথম পাতায় জীবনানন্দের নিজের দেওয়া তারিখ ৮/৪/৪৪, শেষ পাতায় ৯/৫/৪৮। পূর্বপাকিস্তান ছেড়ে আসার পর কলকাতায়; ১৮৩, ল্যান্সডাউন রোডের বাড়িতে বসেই লেখা। মফস্বলের ছবি জীবনানন্দের অন্তরের গভীর থেকে গভীরতর উৎসে ছিলো, তার ভাবনাগত প্রতিক্রিয়া দেখলে তা অনুভব করা যায় : কলকাতার চেয়ে মফস্বলের প্রকৃতি, লোকেদের ভালো লাগে তার। সেই সব মানুষদেরও ভালো লাগে “মফঃস্বলের গ্রামপ্রান্তর থেকে উপচে পড়ে যে সব মানুষ কার্তিকের বিকেলের রোদে, চোতবোশেখের শেষ রাতের ফটিক জলের মতো জোৎস্নায়। এসব মানুষ সব ঋতুতে সবসময়ই ভালো।” অথবা “কি অপরাধ হতো জলপাইহাটিতে ছোট আশা, সাদাম্টাা কাজ, খাঁটি শান্তি, বৃহৎ মমতার ভেতরে পড়ে থেকে একদিন পৃথিবী থেকে অণুর মত রেণুর মতো একটুখানি আশা মুছে ফেলে সময়ের নিরবিচ্ছিন্ন গতি-অগতি সাগরের অচেতনায় হারিয়ে গেলে?” দেশবিভাগজনিত বিষাদ, ব্যক্তি মানুষের নিঃসঙ্গতার বিপন্নতাকে ভিত্তি করে লেখা এই উপন্যাসটি সম্পর্কে কথাকার অমর মিত্র লিখেছেন : তিনি ১৯৪৮-এর খ-িত বাংলা, স্বাধীন ভারতবর্ষ, কলকাতা শহর নিয়ে পৃথিবীর কথা বলতে চাইছেন তো বলার জন্য, ওই সব যুক্তির ধার ধারেননি। যুক্তি হয়তো কাহিনীকে শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করায়। আবার যুক্তিহীনতা যে পরে যুক্তির সমগ্রতা হয়ে দাঁড়ায় তা “জলপাইহাটি” পড়তে পড়তে টের পাওয়া যায়। ১৯৪৮-এর ৮ এপ্রিল থেকে ওই সালের ৯ মে- একমাসে ৫১৭ পাতার উপন্যাস লিখে ফেললেন! হিসাবে প্রায় একলক্ষ তিরিশ হাজারের মতো শব্দ। কীভাবে সম্ভব হয়েছিলো ভাবতে গিয়ে ঠাঁই পাই না। কখনো সন্দেহ জাগে সন তারিখ নিয়ে, আবার কখনো মনে হয়, এ যেন গভীর এক নিস্ত ব্ধতায় ডুবে গিয়ে লেখা। এমন এক তাড়না ছিলো তাঁর ভেতর যা না লিখে পারছিলেন না। উপন্যাস লিখব বলে যেন লেখেননি জলপাইহাটি, এ যেন জোৎস্নাতাড়িত হয়ে লেখা-।

বিংশ শতাব্দীর সূচনা পর্বের স্বপ্ন দেখা জগৎ স্বপ্ন দেখান জগৎ, ক্রমশ শতাব্দীর বয়স হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্টাচ্ছিলো। প্রকৃতির রূপ রস-এ নিমজ্জিত কবিও এই যন্ত্রণার বিবর্তন টের পেয়েছেন। যুদ্ধ, মন্বন্তর, দাংগা, কালোবাজারী, বেকারত্ব, সমাজ ও রাষ্ট্রকে অস্থির করে তুলেছিলো, পরাধীনতার বেদনা ও স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা এই সময়ের সর্বোচ্চ আলোড়ন। “শতাব্দীর এই রাক্ষসী বেলায় আর বাস্ত বের রক্ততটে জীবনানন্দের আগমন। যার কাছে বাংলার লক্ষ গ্রাম “নিরাশায় আলোকহীনতায় ডুবে নিস্ত ব্ধ নিস্তে জ”। জীবনানন্দ যে যন্ত্রণায় তাড়িত হয়েছিলেন তা কি শুধু বাইরের জগতের, নাকি তাঁর অভ্যন্তরের, খবর কে রাখে?

back to top