বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের কবিতা
মাহফুজ আল-হোসেন
৯০তম জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি
আজ ৯ জানুয়ারি ২০২৫, বিশিষ্ট কবি, কথাসাহিত্যিক, শিল্প সমালোচক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজচিন্তক, নৃবিজ্ঞানী, লোকবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার অধ্যাপক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের ৯০তম জন্মদিন। তাঁকে নিয়ে আজ বৃহস্পতিবার নিয়মিত ‘সংবাদ সাময়িকী’র বিশেষ আয়োজন
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, সাহিত্য সমালোচক, শিল্প ও চিত্র সমালোচক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজচিন্তক, নৃবিজ্ঞানী, লোকবিজ্ঞানী, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার, শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক। দেশবরেণ্য লেখক ও জনচিন্তক হিসেবে তাঁর এতসব পরিচয়ের মধ্যে তিনি যে আধুনিক বাংলা কবিতার একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি সে বিষয়টি বোধকরি প্রায়শই আমরা বিস্মৃত হই। এ বিস্মরণের জন্য তিনি নিজেও কিছুটা দায়ী কিনা সে প্রশ্নও উঠতে পারে। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়কবিতা প্রকাশিত হওয়ার মধ্য দিয়েযাঁর কাব্য জীবনের সূচনা, ১৯৫০ সালে প্রকাশিত ‘নতুন কবিতা’ কাব্য সংকলনের সর্বকনিষ্ঠ কবি হিসেবে যিনি কিনা বোদ্ধামহলের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হন (এ সংকলনের অন্য কবিরা ছিলেন পঞ্চাশের অন্যতম কবি শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান ও আলাউদ্দিন আল আজাদ), দীর্ঘ ছয় দশক ধরে সংবাদপত্রের সাহিত্যের পাতা ও সাময়িকীতে প্রকাশিত যাঁর অজ¯্র অগ্রন্থিত কবিতা মুক্তিসংগ্রামের আগে ও পরে পাঠকচিত্তকে আন্দোলিত করেছে, আফসোসের বিষয়হলো সেই প্রকাশবিমুখ ঋদ্ধিমান কবির প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয়১৯৯৩ সালে ৫৭ বছর বয়সে। পশ্চিম পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন-নির্যাতনের বৈরী পরিবেশের মধ্যে মেধা ও মননে ক্রমশ বেড়েউঠৈছেন তরুণ বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। ভাষা আন্দোলন এবং ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাঙালির আত্মপরিচয়ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের যে ধারাবাহিক সংগ্রাম সে মরণপণ সংগ্রামে তাঁর ক্ষুরধার কলম শাণিত হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। শুধু তাই নয়,এ ঐতিহাসিক কালপর্বে তিনি বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের সম্মুখ সারিতে থেকে শহরকেন্দ্রিক শিক্ষিত অথচ বিভ্রান্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে আলোকবর্তী করতে সদাতৎপর থেকেছেন। মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী সময়েসামরিক শাসন, মৌলবাদ, গণতন্ত্রহীনতা, অপশাসন, মানবাধিকার লংঘন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-এর মতো গুরুগম্ভীর ও স্পর্শকাতর বিষয়েসাহসিকতার সাথে অবিরাম লিখে গেছেন এই মুক্তচিন্তক। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেয়ায়গবেষণামূলক প্রবন্ধ রচনা এবং একাডেমিক লেখালেখিতে অনেক বেশি সময়দিতে হয়েছে তাঁকে। সৃজনশীলতার মধ্যগগণে থাকা অবস্থায়শিক্ষকতা ও গবেষণার জন্য মাঝে মাঝে বিদেশে গমন এবং দীর্ঘ সময়ধরে বিদেশে অবস্থান তাঁর চলমান লেখালেখির রাশ টেনে ধরলেও ঐ সময়ের বহুশাস্ত্রীয়নিবিড়পাঠ এবং আন্তর্জাতিকতার বোধ তাঁর পরবর্তীকালের রচনাকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছে। কথাসাহিত্য বিশেষ করে ছোটগল্প ও উপন্যাস, সংস্কৃতি, রাষ্ট্রচিন্তা, সাহিত্য ও শিল্পকর্মের সমালোচনা ও নন্দনতত্ত্ব, আধুনিকতা ও উত্তরাধুনিকতা ইত্যাদি যে বিষয়নিয়েই তিনি লিখেছেন সব বিষয়েই তাঁর মুন্সিয়ানা, দক্ষতা, পা-িত্য ও নিজস্ব মৌলিক চিন্তার ছাপ তিনি রাখতে সক্ষম হয়েছেন। সব মিলে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায়একশো হলেও এদের মধ্য কবিতার বইয়ের সংখ্যা নগণ্যই বলতে হবে। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা একটি কাব্যসংকলনসহ সম্ভবত ১২টি। খুঁজে পাওয়া গেছে এমন সাতটি কাব্যগ্রন্থ নিয়ে ৮৩ বছর বয়সে প্রকাশিত হয়েছে তার প্রথম কবিতা কাব্যসংগ্রহ; সংকলনভুক্ত গ্রন্থগুলো- আমাদের মুখ (১৯৯৩), পুরানো বৃক্ষের ডালপালা (১৯৯৪), আসবাবহীন ঘর (২০০৫), তোমার পছন্দের নীল শার্ট পরে (২০০৬ ), এলুয়ার যেমন ভাবতেন (২০০৭), হেমন্তের দিকে মুখ করে (২০১৪), অন্ধকারের শিল্প (২০১৫)। কবিতা সংগ্রহটি প্রকাশিত হয় ২০১৭ সালে।
কবি শামসুর রাহমান বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আমাদের মুখ’ প্রসঙ্গে বলতে গিয়েকবি হিসেবে তাঁর মূল্যায়ন করেছেন এভাবে : “তাঁর কবিতা সকলের কবিতা থেকে আলাদা এবং তাঁর কবিতায়তাঁর নিজের উপস্থিতি বিদ্যমান।” সেই ভিন্নতা আর উপস্থিতিকে কবি অনিবার্য করে তুলেছেন অস্থির বিশ্বপরিস্থিতিতে মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যেও নির্ভার ব্যক্তিগত জৈবিক যাপনচিত্রের তিমিরবিনাশী পঙ্ক্তিমালায়-
তোমার ট্রেন সকাল দশটায়
তুমি যাবে
তোমার বন্ধুর ভাইকে দেখতে
ইসরাইলি বোমায় তার এক পা
উড়ে গেছে
তোমার স্তন আমার মুখের দিকে
তোমার চুল আমার মুখের পাশে
আমি ঠেকিয়ে রাখি
সর্বনাশের শেষটা
(সর্বনাশের শেষটা: আমাদের মুখ)
আর সব মহৎ কাব্যনির্মাতার মতোই কবি বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর স্বকাল কিংবা আত্তীকৃত স্বীয়চিন্তনবলয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেন না। কবিতায়তিনি পুনরাবৃত্ত অতীতের যন্ত্রণাবিদ্ধ ইতিহাস বিবৃত করেন পুরোনো বৃক্ষের ডালপালার সাঙ্কেতিক প্রশ্রয়ে। প্রতীকায়নে নিজের সাথে সংযুক্ত করেন বাতাস, পাখি, পাথর এবং ‘তুমি’-কে। আবার এই যে ‘তুমি’ সে শুধুমাত্র কবির জীবনসঙ্গী, মানসপ্রিয়া কিংবা দয়িতা নন। এই সম্প্রসারিত ‘তুমি’ হচ্ছে সর্বকালের পাঠক এবং স্বস্তি, প্রশ্রয়, যন্ত্রণা, ভালোবাসা ও মুক্তির নানা অনুষঙ্গ শৈল্পিক সম্পর্কে যুক্ত হতে থাকে সেই তুমির সাথে। এভাবেই কবি এবং পাঠকের সাথে বহুবাচনিক নান্দনিক সংলাপের মধ্য দিয়ে তৈরি হয়কালনিরপেক্ষ কবিতা:
বার্চগুলি মাঠের মধ্যে স্বাভাবিক
সে-স্বাভাবিকতায়
তুমি এলে,
কিছু বাতাস এলো
পাখির ডানা থেকে,
তুমি স্বাভাবিক
বার্চগুলির মতো পাখিটার মতো।
বার্চগুলি শিকড় ছড়িয়ে দিলো
তোমার দুপায়ে,
পাখিটা ডানা উড়িয়ে দিলো
তোমার দু’হাতের গঠনে,
তুমি উড়ে গিয়েও
স্থির হয়ে গেলে,
অদ্ভুত পৃথিবীটায় তুমি ভালোবাসার
পাথর কুড়িয়ে এনেছ,
তুমি পাথর গড়িয়ে দিলে
গুঁড়িয়ে গেলো
বার্চগাছ পাখি আমার হৃদয়,
স্বাভাবিকতাকে তুমি এভাবে
সম্পূর্ণ করে দিলে।
যেন হাজার হাজার ইতিহাসের
যন্ত্রণা
শান্তভাবে কেউ বলে গেলো।
(হাজার হাজার ইতিহাসের : পুরানো বৃক্ষের ডালপালা)
এই যে বহুবাচনিকতার শৈল্পিক কৌশল সেটি তিনি আত্মস্থ করেছেন এলুয়ারের কাছ থেকে। র্যাবোঁ, বোদলেয়ার, অ্যাপোলিনেয়ার-এর অনুবর্তী ফরাসি পরাবাস্তববাদী ঘরানার ভালোবাসার কবি পল এলুয়ার (১৮৯৫-১৯৫২)-এর ভাবশিষ্য ছিলেন বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। এলুয়ারের বিশ্বখ্যাত লিবার্টি কবিতায়তাঁর প্রেমিককণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে ভালোবাসার একান্ত আর্তি ‘পঠিত সব পৃষ্ঠায় আমি তোমার নাম লিখি,/না পড়া সব সাদা পৃষ্ঠায় আমি তোমার নাম লিখি’। কবি বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর এ কালজয়ী পঙ্ক্তিমালার ¯্রষ্টার প্রতি অনুরক্ত হয়েতাঁর একটি কাব্যগ্রন্থের নাম দিয়েছেন ‘এলুয়ার যেমন ভাবতেন’। সমাজমনস্ক রাষ্ট্রচিন্তক কবি এ কাব্যগ্রন্থে এলুয়ারের মতোই প্রেমিকের ভূমিকায়অবতীর্ণ। প্রণয়ীর কাছে একদিকে তিনি বিশুদ্ধ ব্যক্তিগত প্রেম নিবেদন করছেন আবার অপর দিকে সেই অনুষঙ্গে সমাজ-রাষ্ট্রের নীতিভ্রষ্টতা ও অনাচার, নাগরিকদের অসহায়ত্বের কথা এবং সর্বোপরি ভালোবাসার অবিনাশী শক্তির কথা ব্যক্ত করছেন আশ্চর্য ঋজুতায়। যে কবিতাটি দিয়েকাব্যগ্রন্থের নামকরণ করা হয়েছে তা থেকে প্রাসঙ্গিক অংশ এখানে উদ্ধৃত করছি:
আমি স্বপ্নের রক্ত আর রক্তের কান্না
পার হয়ে তোমার কাছে পৌঁছব একদিন,
আমার ভালোবাসা
অনাথ অবোধ,
তাকে কে ঠেকাবে বলো
... ... ...
স্বপ্নের সীমানায় আমি যেতেই থাকি
কান্না আর রক্ত আর কান্না পেরিয়ে পেরিয়ে
শিকলের করতালি বাজিয়ে
আমি তোমার দিকে যাই, আমার প্রেম
আমার ভালোবাসা
অনাথ অবোধ,
র্যাব নামিয়েও ভালোবাসা গ্রেফতার করা যায় না
... ... ...
সব থেকেই জীবন বড়
জানি জীবন
অনাথ অবোধ,
তবু জীবনকে ঠেকানো যায় না র্যাব নামিয়ে।
(এলুয়ার যেমন ভাবতেন)
অকুতোভয় কবি তেজোদীপ্ত প্রত্যয়ী উচ্চারণে অধিকারহীনতা, রাজনৈতিক ভ্রষ্টাচার ও নির্যাতনের নান্দনিক প্রতিবাদ গড়ে তোলেন তাঁর আলোড়ন সৃষ্টিকারী কাব্যগ্রন্থ ‘তোমার পছন্দের নীল শার্ট পরে’-এর বিভিন্ন কবিতায়। এসবের দৃষ্টান্ততুলে ধরছি এ বইয়ের দুটি পৃথক কবিতার অংশবিশেষ উদ্ধৃত করে:
অন্ধকার হয়েআসছে
আমি তোমার পছন্দের নীল শার্ট পরে অন্ধকার দেখছি
আমি এসব নিয়েএকটা বই লিখব
তারা বেঁচে, যারা আগে বেঁচেছে, যাঁরা এখনো বেঁচে আছে
তাদের থেঁৎলানো শরীরটা চেনে কেবল
মার চোখ, স্ত্রীর চোখ, বোনের চোখ, ভাইয়ের চোখ
তাদের ভালোবাসার কথা লিখবো
(আমি এসব নিয়েএকটা বই লিখবো )
তুমি যখন হাসো তোমার হাসি আর তোমাকে ভালোবাসি
গতকাল আমরা এক বিবৃতি দিয়েছি
মানবিক ও সিভিল অধিকার দাবি করে
এটা একটা টার্নিং পয়েন্ট
অধিকার না থাকলে ভালোবাসা চারদিকে ছড়ায়না
(তুমি চোখ বন্ধ করে)
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অগ্রপথিক সাম্যবাদী এই কবি এক ঘোর অমানিশার কালপর্বে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতকচক্র আর তাদের সমর্থকদের আস্ফালনে হতাশ না হয়ে হতবিহ্বল সাধারণ মানুষকে আশাবাদের বাণী শোনান সোশ্যালিস্ট ন্যারেটিভে:
নির্যাতন-শিবিরে যারা আমাদের সার করে দাঁড় করিয়েছে
তারাই এখন হর্তাকর্তা বিধাতা
তারা লেখাপড়া জানে না তারা এখন উচ্চশিক্ষার বয়ান দেয়
ধর্মের বেহালা বগলে নিয়েতারা এখন জিকির করে।
আমি তবু ভুলে যাই না সবুজ বছরগুলোর কথা
জ্যোৎস্না রাতে মৃত কমরেডরা ফিরে আসে
একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করি আর মার্চ করে করে
ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাই
দেখি স্পষ্ট ভবিষ্যত টান টান আর উদ্যত হয়ে আছে
(মেঘ ভাঙা আলোয় স্পষ্ট দেখি)
দুই.
এটি সুবিদিত যে, শিল্পকলার নন্দনতাত্ত্বিক ইতিহাস সাহিত্যের সমান্তরালে বিকশিত হয়েছে। একে অপরের কাছ থেকে গ্রহণ বর্জনের মধ্য দিয়ে সৃষ্টিশীল উভয় মাধ্যমই পরিপুষ্টি লাভ করেছে। একজন সাহিত্য¯্রষ্টাকে শিল্পের অন্যান্য মাধ্যম যেমন- চিত্রকলা, ভাস্কর্য, সঙ্গীত, নৃত্যকলা, অভিনয়ইত্যাদি থেকে সৌন্দর্যের পাঠ নিতে হয়। আমরা সবাই জানি, আমাদের দেশে শিল্প সমালোচনার অন্যতম পথিকৃৎ বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। এটি একাডেমিক বিষয় হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিন যাবত পাঠদান করেছিলেন তিনি। শিল্পকলা বিষয়েতাঁর বেশ কয়েকটি মূল্যবান গ্রন্থ রয়েছে, যেমন: কনটেম্পরারি পেইনটার্স- বাংলাদেশ (১৯৭৪), চিত্রশিল্প : বাংলাদেশ (১৯৭৪), বাংলাদেশের লোকশিল্প (১৯৮২), শিল্পকলার ইতিহাস (১৯৮৫), কামরুল হাসান (১৯৯৪, ১৯৯৭), জয়নুল আবেদিনের জিজ্ঞাসা (১৯৯৬), দেশজ আধুনিকতা: সুলতানের কাজ (১৯৯৯) , দ্য কোয়েস্ট অব জয়নুল আবেদিন (২০০০) এবং শিল্পীর চোখ (২০০৬)। তিনি দেশের একজন শীর্ষ স্থানীয় শিল্প সংগ্রাহক ছিলেন এবং তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে দেশ-বিদেশের প্রথিতযশা শিল্পীদের মহামূল্যবান শিল্পকর্ম, এলবাম ও স্যুভেনির ছিল। তিনি ভ্রমণসুবাদে সারাবিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ আর্ট মিউজিয়াম ও গ্যালারি ঘুরে বিশ্বখ্যাত শিল্পীদের চিত্রকর্ম এবং গুরুত্বপূর্ণ ভাস্কর্য ও শৈল্পিক স্থাপনা অবলোকন করেছেন। শিল্পকলা, শিল্পকলার ইতিহাসবিষয়ক ব্যাপক অধ্যয়ন এবং মহৎ শিল্পকর্ম অবলোকনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং অনেক প্রথিতযশা শিল্পীর সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে তিনি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ঈর্ষণীয় পা-িত্য অর্জন করেছিলেন। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর শিল্পকলার নন্দনতত্ত্ব এবং এতদসংশ্লিষ্ট নানা অনুষঙ্গ তাঁর সাহিত্যে প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন, বিশেষত কবিতায়। তিনি তাঁর কবিতায় চারুকলার স্টাইলে সিমেট্রি, স্পেস, ব্রাশ স্ট্রোকস্, ড্রয়িং, কম্পোজিশন, রং-এর ব্যবহার ও ফিগার ব্যবহার করেছেন একজন মাস্টার আর্টিস্টের মতোই। এ প্রসঙ্গে তাঁর লেখা একটি কবিতার অংশবিশেষ এখানে উদ্ধৃত করছি:
চিন্তার ছাইয়ের জন্য সিমেট্রি দরকার
আমি তার নীরব স্বাক্ষী।
দুর্দান্ত বাতাস যখন আকাশ ছেয়েআসে
আমি তার ছাই উড়তে দেখি
আর সিমেট্রিটা কাঁপতে কাঁপতে
প্রাচীনকালের হোমেজ হয়েওঠে
আমি নীরবে নতি স্বীকার করি বাতাসের স্টাইলের কাছে।
বাতাস নতুন স্পেস তৈরি করে একটা ল্যান্ডস্কেপের ভিতর
চিন্তার ছাই দুমুঠির মধ্যে ভরে নিয়ে।
(চিন্তার ছাইয়ের জন্য, অগ্রন্থিত/ শালুক ২৩, ২০১৮)
বিশ্ববিখ্যাত শিল্পী মার্ক শাগাল-এর আদি শৈলীর (নেইভ আর্ট) প্রতীকায়িত বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘দ্য ব্লু বার্ড’-এর পাখিটি বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের কবিতায়ঢুকে গিয়েছে শৈল্পিক অনুষঙ্গে:
একটি পাখি তার গান নিয়ে
আমার পিছু পিছু হাঁটছে,
গলায় স্কার্ফ আর জ্যাকেট পরে আমি হাঁটছি,
নদী কাঁপিয়ে ভেসে আসছে হাসি
বাতাস খোঁজাখুঁজি শুরু করেছে,
একটা পাখি তার গান নিয়ে
আমাকে ঘিরে ধরেছে,
স্কার্ফটা তুমি কিনে দিয়েছ
জ্যাকেটটা তোমার উপহার,
পাখিটা শাগাল আমাকে দিয়েছেন,
তোমার ভালোবাসা গায়ে জড়িয়ে
আমি পাখিটার পিছনে হেঁটে চলেছি,
তুমি কি প্যারিসে, সিরাকিউসে?
টোকিওতে? স্কুটগার্টে?
নাকি ঢাকায়?
স্কার্ফের মতো পাখিটা গলায় জড়িয়ে
আমি হাঁটছি রাস্তা থেকে রাস্তায়।
(একটি পাখি তার গান নিয়ে, এলুয়ার যেমন ভাবতেন)
‘অন্ধকারের শিল্প’ (২০১৫) তিনি রচনা করেছেন বিশ্বখ্যাত ফরাসি চিত্রশিল্পী রামব্রান্ডটের সিগনেচার টেকনিক আলো-আঁধারির রংয়ের খেলা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। কাব্যগ্রন্থের শিরোনামভুক্ত মূল কবিতার অংশ থেকে উদ্ধৃত করছি:
সূর্যাস্ত জাহাজে করে সকল আলো তুলে নিয়ে যায়
আমি রামব্রান্ডটের মতো অন্ধকারের বিপরীত
খুঁজতে খুঁজতে জাহাজের পিছন পিছন যাই
রামব্রান্ডট অন্ধকারের শিল্প করেছেন
আর আমি
ভালোবাসাকে অন্ধকারের শিল্প করেছি
(অন্ধকারের শিল্প)
ঋদ্ধিমান কবি শুধুমাত্র চিত্রকলার নন্দনতাত্ত্বিক প্রয়োগের মধ্যে তাঁর শিল্পসৌকর্যম-িত কবিতাকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। জ্যাজ মিউজিকের সাঙ্গীতিক আয়োজনে একজন শিল্পী কীভাবে শব্দকে থেঁৎলে দিচ্ছেন এবং সেখান থেকে ফুঁপিয়েফুঁপিয়ে বের হওয়া ঘূর্ণায়মান শব্দ কীভাবে দূরগামী কান্নাধ্বনিতে রূপান্তরিত হচ্ছে সেটি অদ্ভুতভাবে উঠে এসেছে একটি কবিতায়-
যেন পাবের মধ্যে জ্যাজ
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে শব্দ ঘুরছে
গলির মধ্যে শব্দ কাঁদতে কাঁদতে
কোথায় চলে যায়,
সেই হচ্ছে দূর
যেদিকে আমরা হাত বাড়িয়ে রাখি,
গলার মধ্যে তোমার নাম কাঁদতে কাঁদতে
কোথায় চলে যায়,
মধ্যরাত্রে স্বপ্নের আদর দিয়ে-ও
তুমি কান্না থামাতে পারো না,
আমার হাতে তুমি হাত রেখে
শব্দের রোদন শুনছ
আমাদের পরিচিত ছ’ফুট লম্বা গায়কটি
কাঁদতে কাঁদতে নাচের মধ্যে
শব্দটিকে থেঁৎলে দিচ্ছে,
সেই থেঁৎলানি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে শব্দ হচ্ছে
তোমার হাত আমার নামকে ডাকছে।
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে শব্দ ঘুরছে
গলার মধ্যে শব্দ কাঁদতে কাঁদতে
কোথায় চলে যায়,
সেই হচ্ছে দূর
যেদিকে আমরা তাকিয়ে থাকি।
আমাদের চোখ রোদন হয়ে যায়
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে শব্দ
কোথায় চলে যায়।
(তোমার হাত : পুরানো বৃক্ষের ডালপালা)
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর তাঁর কবিতায়অত্যন্ত সার্থকভাবে শিল্পকলার নন্দনতত্ত্বের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন যা কেবলমাত্র একজন মহান শিল্প স্রষ্টার পক্ষেই সম্ভব। বাংলা ভাষার আধুনিক কবিদের রচনায়এই ধরনের শিল্পবোধের দৃষ্টান্ত আর আছে কিনা আমার জানা নেই।
তিন.
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের কাব্যভাষা অত্যন্ত গতিময়, সরল, কমিউনিকেটিভ ও অধুনাবাদী। সময়ের পরিক্রমায় তাঁর কবিতার ভাষা উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়েছে। পরিণত বয়সের একজন কবি সমসাময়িক তরুণদের সাথে নান্দনিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়ে সর্বসাম্প্রতিক দৈনন্দিন কথামালায় যেভাবে প্রজ্ঞাময় পাঠকপ্রিয় ঋজু কাব্যভাষা নির্মাণ করেছেন তা সত্যিই তুলনারহিত। এই জ্ঞানতাপস কবি একাধারে স্রষ্টা ও ভবিষ্যত দ্রষ্টা। তাঁর প্রেরণা সঞ্চারী পঙ্ক্তিমালা সকল জাতীয় দুর্যোগ ও ঘোর কৃষ্ণকালে যেমন সবাইকে ?সাহস যুগিয়েছে, তেমনি অনাগত দিনেও অনন্ত প্রেরণার উৎস হয়েথাকবে। বাংলা সাহিত্য-শিক্ষা-সংস্কৃতি ও চিন্তনের দিকপাল এই সদ্যপ্রয়াত মহীরুহের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর কবিতার একটি স্তবক উদ্ধৃত করেই শেষ করছি:
‘জ্ঞান বিশ্বাসঘাতকতা করে না। জ্ঞান তিমির হনন করে।’
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের কবিতা
মাহফুজ আল-হোসেন
বৃহস্পতিবার, ০৯ জানুয়ারী ২০২৫
৯০তম জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি
আজ ৯ জানুয়ারি ২০২৫, বিশিষ্ট কবি, কথাসাহিত্যিক, শিল্প সমালোচক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজচিন্তক, নৃবিজ্ঞানী, লোকবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার অধ্যাপক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের ৯০তম জন্মদিন। তাঁকে নিয়ে আজ বৃহস্পতিবার নিয়মিত ‘সংবাদ সাময়িকী’র বিশেষ আয়োজন
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, সাহিত্য সমালোচক, শিল্প ও চিত্র সমালোচক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজচিন্তক, নৃবিজ্ঞানী, লোকবিজ্ঞানী, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার, শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক। দেশবরেণ্য লেখক ও জনচিন্তক হিসেবে তাঁর এতসব পরিচয়ের মধ্যে তিনি যে আধুনিক বাংলা কবিতার একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি সে বিষয়টি বোধকরি প্রায়শই আমরা বিস্মৃত হই। এ বিস্মরণের জন্য তিনি নিজেও কিছুটা দায়ী কিনা সে প্রশ্নও উঠতে পারে। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়কবিতা প্রকাশিত হওয়ার মধ্য দিয়েযাঁর কাব্য জীবনের সূচনা, ১৯৫০ সালে প্রকাশিত ‘নতুন কবিতা’ কাব্য সংকলনের সর্বকনিষ্ঠ কবি হিসেবে যিনি কিনা বোদ্ধামহলের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হন (এ সংকলনের অন্য কবিরা ছিলেন পঞ্চাশের অন্যতম কবি শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান ও আলাউদ্দিন আল আজাদ), দীর্ঘ ছয় দশক ধরে সংবাদপত্রের সাহিত্যের পাতা ও সাময়িকীতে প্রকাশিত যাঁর অজ¯্র অগ্রন্থিত কবিতা মুক্তিসংগ্রামের আগে ও পরে পাঠকচিত্তকে আন্দোলিত করেছে, আফসোসের বিষয়হলো সেই প্রকাশবিমুখ ঋদ্ধিমান কবির প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয়১৯৯৩ সালে ৫৭ বছর বয়সে। পশ্চিম পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন-নির্যাতনের বৈরী পরিবেশের মধ্যে মেধা ও মননে ক্রমশ বেড়েউঠৈছেন তরুণ বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। ভাষা আন্দোলন এবং ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাঙালির আত্মপরিচয়ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের যে ধারাবাহিক সংগ্রাম সে মরণপণ সংগ্রামে তাঁর ক্ষুরধার কলম শাণিত হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। শুধু তাই নয়,এ ঐতিহাসিক কালপর্বে তিনি বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের সম্মুখ সারিতে থেকে শহরকেন্দ্রিক শিক্ষিত অথচ বিভ্রান্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে আলোকবর্তী করতে সদাতৎপর থেকেছেন। মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী সময়েসামরিক শাসন, মৌলবাদ, গণতন্ত্রহীনতা, অপশাসন, মানবাধিকার লংঘন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-এর মতো গুরুগম্ভীর ও স্পর্শকাতর বিষয়েসাহসিকতার সাথে অবিরাম লিখে গেছেন এই মুক্তচিন্তক। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেয়ায়গবেষণামূলক প্রবন্ধ রচনা এবং একাডেমিক লেখালেখিতে অনেক বেশি সময়দিতে হয়েছে তাঁকে। সৃজনশীলতার মধ্যগগণে থাকা অবস্থায়শিক্ষকতা ও গবেষণার জন্য মাঝে মাঝে বিদেশে গমন এবং দীর্ঘ সময়ধরে বিদেশে অবস্থান তাঁর চলমান লেখালেখির রাশ টেনে ধরলেও ঐ সময়ের বহুশাস্ত্রীয়নিবিড়পাঠ এবং আন্তর্জাতিকতার বোধ তাঁর পরবর্তীকালের রচনাকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছে। কথাসাহিত্য বিশেষ করে ছোটগল্প ও উপন্যাস, সংস্কৃতি, রাষ্ট্রচিন্তা, সাহিত্য ও শিল্পকর্মের সমালোচনা ও নন্দনতত্ত্ব, আধুনিকতা ও উত্তরাধুনিকতা ইত্যাদি যে বিষয়নিয়েই তিনি লিখেছেন সব বিষয়েই তাঁর মুন্সিয়ানা, দক্ষতা, পা-িত্য ও নিজস্ব মৌলিক চিন্তার ছাপ তিনি রাখতে সক্ষম হয়েছেন। সব মিলে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায়একশো হলেও এদের মধ্য কবিতার বইয়ের সংখ্যা নগণ্যই বলতে হবে। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা একটি কাব্যসংকলনসহ সম্ভবত ১২টি। খুঁজে পাওয়া গেছে এমন সাতটি কাব্যগ্রন্থ নিয়ে ৮৩ বছর বয়সে প্রকাশিত হয়েছে তার প্রথম কবিতা কাব্যসংগ্রহ; সংকলনভুক্ত গ্রন্থগুলো- আমাদের মুখ (১৯৯৩), পুরানো বৃক্ষের ডালপালা (১৯৯৪), আসবাবহীন ঘর (২০০৫), তোমার পছন্দের নীল শার্ট পরে (২০০৬ ), এলুয়ার যেমন ভাবতেন (২০০৭), হেমন্তের দিকে মুখ করে (২০১৪), অন্ধকারের শিল্প (২০১৫)। কবিতা সংগ্রহটি প্রকাশিত হয় ২০১৭ সালে।
কবি শামসুর রাহমান বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আমাদের মুখ’ প্রসঙ্গে বলতে গিয়েকবি হিসেবে তাঁর মূল্যায়ন করেছেন এভাবে : “তাঁর কবিতা সকলের কবিতা থেকে আলাদা এবং তাঁর কবিতায়তাঁর নিজের উপস্থিতি বিদ্যমান।” সেই ভিন্নতা আর উপস্থিতিকে কবি অনিবার্য করে তুলেছেন অস্থির বিশ্বপরিস্থিতিতে মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যেও নির্ভার ব্যক্তিগত জৈবিক যাপনচিত্রের তিমিরবিনাশী পঙ্ক্তিমালায়-
তোমার ট্রেন সকাল দশটায়
তুমি যাবে
তোমার বন্ধুর ভাইকে দেখতে
ইসরাইলি বোমায় তার এক পা
উড়ে গেছে
তোমার স্তন আমার মুখের দিকে
তোমার চুল আমার মুখের পাশে
আমি ঠেকিয়ে রাখি
সর্বনাশের শেষটা
(সর্বনাশের শেষটা: আমাদের মুখ)
আর সব মহৎ কাব্যনির্মাতার মতোই কবি বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর স্বকাল কিংবা আত্তীকৃত স্বীয়চিন্তনবলয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেন না। কবিতায়তিনি পুনরাবৃত্ত অতীতের যন্ত্রণাবিদ্ধ ইতিহাস বিবৃত করেন পুরোনো বৃক্ষের ডালপালার সাঙ্কেতিক প্রশ্রয়ে। প্রতীকায়নে নিজের সাথে সংযুক্ত করেন বাতাস, পাখি, পাথর এবং ‘তুমি’-কে। আবার এই যে ‘তুমি’ সে শুধুমাত্র কবির জীবনসঙ্গী, মানসপ্রিয়া কিংবা দয়িতা নন। এই সম্প্রসারিত ‘তুমি’ হচ্ছে সর্বকালের পাঠক এবং স্বস্তি, প্রশ্রয়, যন্ত্রণা, ভালোবাসা ও মুক্তির নানা অনুষঙ্গ শৈল্পিক সম্পর্কে যুক্ত হতে থাকে সেই তুমির সাথে। এভাবেই কবি এবং পাঠকের সাথে বহুবাচনিক নান্দনিক সংলাপের মধ্য দিয়ে তৈরি হয়কালনিরপেক্ষ কবিতা:
বার্চগুলি মাঠের মধ্যে স্বাভাবিক
সে-স্বাভাবিকতায়
তুমি এলে,
কিছু বাতাস এলো
পাখির ডানা থেকে,
তুমি স্বাভাবিক
বার্চগুলির মতো পাখিটার মতো।
বার্চগুলি শিকড় ছড়িয়ে দিলো
তোমার দুপায়ে,
পাখিটা ডানা উড়িয়ে দিলো
তোমার দু’হাতের গঠনে,
তুমি উড়ে গিয়েও
স্থির হয়ে গেলে,
অদ্ভুত পৃথিবীটায় তুমি ভালোবাসার
পাথর কুড়িয়ে এনেছ,
তুমি পাথর গড়িয়ে দিলে
গুঁড়িয়ে গেলো
বার্চগাছ পাখি আমার হৃদয়,
স্বাভাবিকতাকে তুমি এভাবে
সম্পূর্ণ করে দিলে।
যেন হাজার হাজার ইতিহাসের
যন্ত্রণা
শান্তভাবে কেউ বলে গেলো।
(হাজার হাজার ইতিহাসের : পুরানো বৃক্ষের ডালপালা)
এই যে বহুবাচনিকতার শৈল্পিক কৌশল সেটি তিনি আত্মস্থ করেছেন এলুয়ারের কাছ থেকে। র্যাবোঁ, বোদলেয়ার, অ্যাপোলিনেয়ার-এর অনুবর্তী ফরাসি পরাবাস্তববাদী ঘরানার ভালোবাসার কবি পল এলুয়ার (১৮৯৫-১৯৫২)-এর ভাবশিষ্য ছিলেন বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। এলুয়ারের বিশ্বখ্যাত লিবার্টি কবিতায়তাঁর প্রেমিককণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে ভালোবাসার একান্ত আর্তি ‘পঠিত সব পৃষ্ঠায় আমি তোমার নাম লিখি,/না পড়া সব সাদা পৃষ্ঠায় আমি তোমার নাম লিখি’। কবি বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর এ কালজয়ী পঙ্ক্তিমালার ¯্রষ্টার প্রতি অনুরক্ত হয়েতাঁর একটি কাব্যগ্রন্থের নাম দিয়েছেন ‘এলুয়ার যেমন ভাবতেন’। সমাজমনস্ক রাষ্ট্রচিন্তক কবি এ কাব্যগ্রন্থে এলুয়ারের মতোই প্রেমিকের ভূমিকায়অবতীর্ণ। প্রণয়ীর কাছে একদিকে তিনি বিশুদ্ধ ব্যক্তিগত প্রেম নিবেদন করছেন আবার অপর দিকে সেই অনুষঙ্গে সমাজ-রাষ্ট্রের নীতিভ্রষ্টতা ও অনাচার, নাগরিকদের অসহায়ত্বের কথা এবং সর্বোপরি ভালোবাসার অবিনাশী শক্তির কথা ব্যক্ত করছেন আশ্চর্য ঋজুতায়। যে কবিতাটি দিয়েকাব্যগ্রন্থের নামকরণ করা হয়েছে তা থেকে প্রাসঙ্গিক অংশ এখানে উদ্ধৃত করছি:
আমি স্বপ্নের রক্ত আর রক্তের কান্না
পার হয়ে তোমার কাছে পৌঁছব একদিন,
আমার ভালোবাসা
অনাথ অবোধ,
তাকে কে ঠেকাবে বলো
... ... ...
স্বপ্নের সীমানায় আমি যেতেই থাকি
কান্না আর রক্ত আর কান্না পেরিয়ে পেরিয়ে
শিকলের করতালি বাজিয়ে
আমি তোমার দিকে যাই, আমার প্রেম
আমার ভালোবাসা
অনাথ অবোধ,
র্যাব নামিয়েও ভালোবাসা গ্রেফতার করা যায় না
... ... ...
সব থেকেই জীবন বড়
জানি জীবন
অনাথ অবোধ,
তবু জীবনকে ঠেকানো যায় না র্যাব নামিয়ে।
(এলুয়ার যেমন ভাবতেন)
অকুতোভয় কবি তেজোদীপ্ত প্রত্যয়ী উচ্চারণে অধিকারহীনতা, রাজনৈতিক ভ্রষ্টাচার ও নির্যাতনের নান্দনিক প্রতিবাদ গড়ে তোলেন তাঁর আলোড়ন সৃষ্টিকারী কাব্যগ্রন্থ ‘তোমার পছন্দের নীল শার্ট পরে’-এর বিভিন্ন কবিতায়। এসবের দৃষ্টান্ততুলে ধরছি এ বইয়ের দুটি পৃথক কবিতার অংশবিশেষ উদ্ধৃত করে:
অন্ধকার হয়েআসছে
আমি তোমার পছন্দের নীল শার্ট পরে অন্ধকার দেখছি
আমি এসব নিয়েএকটা বই লিখব
তারা বেঁচে, যারা আগে বেঁচেছে, যাঁরা এখনো বেঁচে আছে
তাদের থেঁৎলানো শরীরটা চেনে কেবল
মার চোখ, স্ত্রীর চোখ, বোনের চোখ, ভাইয়ের চোখ
তাদের ভালোবাসার কথা লিখবো
(আমি এসব নিয়েএকটা বই লিখবো )
তুমি যখন হাসো তোমার হাসি আর তোমাকে ভালোবাসি
গতকাল আমরা এক বিবৃতি দিয়েছি
মানবিক ও সিভিল অধিকার দাবি করে
এটা একটা টার্নিং পয়েন্ট
অধিকার না থাকলে ভালোবাসা চারদিকে ছড়ায়না
(তুমি চোখ বন্ধ করে)
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অগ্রপথিক সাম্যবাদী এই কবি এক ঘোর অমানিশার কালপর্বে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতকচক্র আর তাদের সমর্থকদের আস্ফালনে হতাশ না হয়ে হতবিহ্বল সাধারণ মানুষকে আশাবাদের বাণী শোনান সোশ্যালিস্ট ন্যারেটিভে:
নির্যাতন-শিবিরে যারা আমাদের সার করে দাঁড় করিয়েছে
তারাই এখন হর্তাকর্তা বিধাতা
তারা লেখাপড়া জানে না তারা এখন উচ্চশিক্ষার বয়ান দেয়
ধর্মের বেহালা বগলে নিয়েতারা এখন জিকির করে।
আমি তবু ভুলে যাই না সবুজ বছরগুলোর কথা
জ্যোৎস্না রাতে মৃত কমরেডরা ফিরে আসে
একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করি আর মার্চ করে করে
ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাই
দেখি স্পষ্ট ভবিষ্যত টান টান আর উদ্যত হয়ে আছে
(মেঘ ভাঙা আলোয় স্পষ্ট দেখি)
দুই.
এটি সুবিদিত যে, শিল্পকলার নন্দনতাত্ত্বিক ইতিহাস সাহিত্যের সমান্তরালে বিকশিত হয়েছে। একে অপরের কাছ থেকে গ্রহণ বর্জনের মধ্য দিয়ে সৃষ্টিশীল উভয় মাধ্যমই পরিপুষ্টি লাভ করেছে। একজন সাহিত্য¯্রষ্টাকে শিল্পের অন্যান্য মাধ্যম যেমন- চিত্রকলা, ভাস্কর্য, সঙ্গীত, নৃত্যকলা, অভিনয়ইত্যাদি থেকে সৌন্দর্যের পাঠ নিতে হয়। আমরা সবাই জানি, আমাদের দেশে শিল্প সমালোচনার অন্যতম পথিকৃৎ বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। এটি একাডেমিক বিষয় হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিন যাবত পাঠদান করেছিলেন তিনি। শিল্পকলা বিষয়েতাঁর বেশ কয়েকটি মূল্যবান গ্রন্থ রয়েছে, যেমন: কনটেম্পরারি পেইনটার্স- বাংলাদেশ (১৯৭৪), চিত্রশিল্প : বাংলাদেশ (১৯৭৪), বাংলাদেশের লোকশিল্প (১৯৮২), শিল্পকলার ইতিহাস (১৯৮৫), কামরুল হাসান (১৯৯৪, ১৯৯৭), জয়নুল আবেদিনের জিজ্ঞাসা (১৯৯৬), দেশজ আধুনিকতা: সুলতানের কাজ (১৯৯৯) , দ্য কোয়েস্ট অব জয়নুল আবেদিন (২০০০) এবং শিল্পীর চোখ (২০০৬)। তিনি দেশের একজন শীর্ষ স্থানীয় শিল্প সংগ্রাহক ছিলেন এবং তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে দেশ-বিদেশের প্রথিতযশা শিল্পীদের মহামূল্যবান শিল্পকর্ম, এলবাম ও স্যুভেনির ছিল। তিনি ভ্রমণসুবাদে সারাবিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ আর্ট মিউজিয়াম ও গ্যালারি ঘুরে বিশ্বখ্যাত শিল্পীদের চিত্রকর্ম এবং গুরুত্বপূর্ণ ভাস্কর্য ও শৈল্পিক স্থাপনা অবলোকন করেছেন। শিল্পকলা, শিল্পকলার ইতিহাসবিষয়ক ব্যাপক অধ্যয়ন এবং মহৎ শিল্পকর্ম অবলোকনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং অনেক প্রথিতযশা শিল্পীর সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে তিনি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ঈর্ষণীয় পা-িত্য অর্জন করেছিলেন। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর শিল্পকলার নন্দনতত্ত্ব এবং এতদসংশ্লিষ্ট নানা অনুষঙ্গ তাঁর সাহিত্যে প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন, বিশেষত কবিতায়। তিনি তাঁর কবিতায় চারুকলার স্টাইলে সিমেট্রি, স্পেস, ব্রাশ স্ট্রোকস্, ড্রয়িং, কম্পোজিশন, রং-এর ব্যবহার ও ফিগার ব্যবহার করেছেন একজন মাস্টার আর্টিস্টের মতোই। এ প্রসঙ্গে তাঁর লেখা একটি কবিতার অংশবিশেষ এখানে উদ্ধৃত করছি:
চিন্তার ছাইয়ের জন্য সিমেট্রি দরকার
আমি তার নীরব স্বাক্ষী।
দুর্দান্ত বাতাস যখন আকাশ ছেয়েআসে
আমি তার ছাই উড়তে দেখি
আর সিমেট্রিটা কাঁপতে কাঁপতে
প্রাচীনকালের হোমেজ হয়েওঠে
আমি নীরবে নতি স্বীকার করি বাতাসের স্টাইলের কাছে।
বাতাস নতুন স্পেস তৈরি করে একটা ল্যান্ডস্কেপের ভিতর
চিন্তার ছাই দুমুঠির মধ্যে ভরে নিয়ে।
(চিন্তার ছাইয়ের জন্য, অগ্রন্থিত/ শালুক ২৩, ২০১৮)
বিশ্ববিখ্যাত শিল্পী মার্ক শাগাল-এর আদি শৈলীর (নেইভ আর্ট) প্রতীকায়িত বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘দ্য ব্লু বার্ড’-এর পাখিটি বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের কবিতায়ঢুকে গিয়েছে শৈল্পিক অনুষঙ্গে:
একটি পাখি তার গান নিয়ে
আমার পিছু পিছু হাঁটছে,
গলায় স্কার্ফ আর জ্যাকেট পরে আমি হাঁটছি,
নদী কাঁপিয়ে ভেসে আসছে হাসি
বাতাস খোঁজাখুঁজি শুরু করেছে,
একটা পাখি তার গান নিয়ে
আমাকে ঘিরে ধরেছে,
স্কার্ফটা তুমি কিনে দিয়েছ
জ্যাকেটটা তোমার উপহার,
পাখিটা শাগাল আমাকে দিয়েছেন,
তোমার ভালোবাসা গায়ে জড়িয়ে
আমি পাখিটার পিছনে হেঁটে চলেছি,
তুমি কি প্যারিসে, সিরাকিউসে?
টোকিওতে? স্কুটগার্টে?
নাকি ঢাকায়?
স্কার্ফের মতো পাখিটা গলায় জড়িয়ে
আমি হাঁটছি রাস্তা থেকে রাস্তায়।
(একটি পাখি তার গান নিয়ে, এলুয়ার যেমন ভাবতেন)
‘অন্ধকারের শিল্প’ (২০১৫) তিনি রচনা করেছেন বিশ্বখ্যাত ফরাসি চিত্রশিল্পী রামব্রান্ডটের সিগনেচার টেকনিক আলো-আঁধারির রংয়ের খেলা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। কাব্যগ্রন্থের শিরোনামভুক্ত মূল কবিতার অংশ থেকে উদ্ধৃত করছি:
সূর্যাস্ত জাহাজে করে সকল আলো তুলে নিয়ে যায়
আমি রামব্রান্ডটের মতো অন্ধকারের বিপরীত
খুঁজতে খুঁজতে জাহাজের পিছন পিছন যাই
রামব্রান্ডট অন্ধকারের শিল্প করেছেন
আর আমি
ভালোবাসাকে অন্ধকারের শিল্প করেছি
(অন্ধকারের শিল্প)
ঋদ্ধিমান কবি শুধুমাত্র চিত্রকলার নন্দনতাত্ত্বিক প্রয়োগের মধ্যে তাঁর শিল্পসৌকর্যম-িত কবিতাকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। জ্যাজ মিউজিকের সাঙ্গীতিক আয়োজনে একজন শিল্পী কীভাবে শব্দকে থেঁৎলে দিচ্ছেন এবং সেখান থেকে ফুঁপিয়েফুঁপিয়ে বের হওয়া ঘূর্ণায়মান শব্দ কীভাবে দূরগামী কান্নাধ্বনিতে রূপান্তরিত হচ্ছে সেটি অদ্ভুতভাবে উঠে এসেছে একটি কবিতায়-
যেন পাবের মধ্যে জ্যাজ
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে শব্দ ঘুরছে
গলির মধ্যে শব্দ কাঁদতে কাঁদতে
কোথায় চলে যায়,
সেই হচ্ছে দূর
যেদিকে আমরা হাত বাড়িয়ে রাখি,
গলার মধ্যে তোমার নাম কাঁদতে কাঁদতে
কোথায় চলে যায়,
মধ্যরাত্রে স্বপ্নের আদর দিয়ে-ও
তুমি কান্না থামাতে পারো না,
আমার হাতে তুমি হাত রেখে
শব্দের রোদন শুনছ
আমাদের পরিচিত ছ’ফুট লম্বা গায়কটি
কাঁদতে কাঁদতে নাচের মধ্যে
শব্দটিকে থেঁৎলে দিচ্ছে,
সেই থেঁৎলানি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে শব্দ হচ্ছে
তোমার হাত আমার নামকে ডাকছে।
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে শব্দ ঘুরছে
গলার মধ্যে শব্দ কাঁদতে কাঁদতে
কোথায় চলে যায়,
সেই হচ্ছে দূর
যেদিকে আমরা তাকিয়ে থাকি।
আমাদের চোখ রোদন হয়ে যায়
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে শব্দ
কোথায় চলে যায়।
(তোমার হাত : পুরানো বৃক্ষের ডালপালা)
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর তাঁর কবিতায়অত্যন্ত সার্থকভাবে শিল্পকলার নন্দনতত্ত্বের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন যা কেবলমাত্র একজন মহান শিল্প স্রষ্টার পক্ষেই সম্ভব। বাংলা ভাষার আধুনিক কবিদের রচনায়এই ধরনের শিল্পবোধের দৃষ্টান্ত আর আছে কিনা আমার জানা নেই।
তিন.
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের কাব্যভাষা অত্যন্ত গতিময়, সরল, কমিউনিকেটিভ ও অধুনাবাদী। সময়ের পরিক্রমায় তাঁর কবিতার ভাষা উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়েছে। পরিণত বয়সের একজন কবি সমসাময়িক তরুণদের সাথে নান্দনিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়ে সর্বসাম্প্রতিক দৈনন্দিন কথামালায় যেভাবে প্রজ্ঞাময় পাঠকপ্রিয় ঋজু কাব্যভাষা নির্মাণ করেছেন তা সত্যিই তুলনারহিত। এই জ্ঞানতাপস কবি একাধারে স্রষ্টা ও ভবিষ্যত দ্রষ্টা। তাঁর প্রেরণা সঞ্চারী পঙ্ক্তিমালা সকল জাতীয় দুর্যোগ ও ঘোর কৃষ্ণকালে যেমন সবাইকে ?সাহস যুগিয়েছে, তেমনি অনাগত দিনেও অনন্ত প্রেরণার উৎস হয়েথাকবে। বাংলা সাহিত্য-শিক্ষা-সংস্কৃতি ও চিন্তনের দিকপাল এই সদ্যপ্রয়াত মহীরুহের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর কবিতার একটি স্তবক উদ্ধৃত করেই শেষ করছি:
‘জ্ঞান বিশ্বাসঘাতকতা করে না। জ্ঞান তিমির হনন করে।’