বেলাল চৌধুরী
শিল্পের সঙ্গে বর্ণের ঘনিষ্ঠ সংযোগ চিরকালীন। যাঁরা ছবি আঁকেন তাঁরা তুলি দিয়ে রঙ ধরান ক্যানভাসে, কিন্তু কবিরা রঙ ধরান শব্দের মাধ্যমে- ‘রঙ’-এর প্রতীকী উদ্যামের ভিতর। তাই চিরকালীন বর্ণ সচেতনতা কবিদের কাব্যকে সমৃদ্ধ করেছে। সাধারণভাবে রবীন্দ্রনাথকেই যদি ধরা যায় তাহলে দেখা যাবে ‘পুনশ্চ’ কাব্যের পাতায় পাতায় রঙ তুলির টান, রঙের আলপনা। সেখানে রঙ ছিটিয়েছেন হোলি উৎসবের মতন। যেমন ধরণীর এক কোণে একটু বাসা অন্বেষী কবির আকাক্সক্ষা ধরা পড়েছে। “আমার পাটল রঙের গাই গরুটি/আর মেশিল রঙের বাছুর/ময়ূরাক্ষী নদীর ধারে।/ঘরের মেঝেতে ফিকে নীল রঙের জাজিম পাতা/খয়েরি রঙের ফুল-কাটা।/দেয়াল বাসন্তী রঙের।/তাতে ঘন কালো রেখার পাড়।” (বাসা, পুনশ্চ, রবীন্দ্রনাথ) ভিনসেন্ট ভ্যানগঘও তাঁর নিজের আঁকা শোবার ঘরের বর্ণনা দিয়েছিলেন এইভাবে- “এবার স্রেফ আবার শোবার ঘর, তবে এবার সব রঙই কাজ করবে... আভাস দেবে বিশ্রামের এবং ঘুমের। এক কথায় ছবির দিকে তাকালেই মগজটা বা কল্পনাটা বিশ্রাম পাবে। দেওয়ালগুলি ফিকে বেশনে। মেঝেটা লাল টালির, খাটের আর দেওয়ালগুলির কাঠের রঙ টাটকা মাখনের মতো হলদে, চাদর আর বালিশ খুব হালকা সবুজ। মুখ ধোবার টেবিলটা কমলা রঙ-এর মুখ ধোবার পাত্রটা নীল। দরজাগুলি লাইম্যাক রঙের। ...ছবিতে কোনও সাদা নেই। ফ্রেম হবে সাদা।”
কাব্য বা কবিতায় রঙ-এর অন্বেষণ মিড ভিক্টোরিয়ান কালসীমার অন্তর্বর্তী প্রি-র্যাফালাইট কবিদের কথা প্রসঙ্গক্রমে স্মরণ করা যায়, যেখানে অভিনব রঙের প্রভাব ঘটেছিল বিশ্ব প্রকৃতিকে আবেগের মধ্যদিয়ে অনুপুঙ্খ দেখার তৃষ্ণায়।
চলমান কবিতা সময়ের মাঝে এমন একটি সন্ধিক্ষণ থাকে যেখানে কবিতার রহস্যময়তা, প্রেমের প্রকাশ ভিন্ন এক পরিধি রচনা করে। জীবনের সংযত বোধ ও বেদনা বিরহ ও শোকঘন অন্বিষ্টচেতনা সব বিচার বুদ্ধিকে জারিত করে। আমরা এমন এক যুবসন্ধিক্ষণের মধ্য দিয়ে চালিত হই যেখানে আপন অভীষ্ট এক বিরল অনুচেতনা তৈরি করে। এই অনুচেতনার সাক্ষী শুধু পারিপার্শ্বিক টানাপড়েন আবার কখনও বিরাট ও বিচিত্র সরলীকরণ। মেধা ও প্রজ্ঞার কাছে যে সময়ে বা কালে নিমজ্জিত থাকা যাক সেই সময় ও কালকে সম্ভবত সারা জীবনেও চিনে ওঠা যায় না অথবা শনাক্ত করা যায় না। একদিকে ছিন্ন জীবনের চেতনা আবার অনুভূতির বিরহী দশা- এইসব মিলিয়ে আমরা এমন এক সন্ধিক্ষণে উপস্থিত হই যেখানে কবিতা শুশ্রƒষার মতো কাজ করে। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর এমনই এক সন্ধিক্ষণের মধ্যদিয়ে এগিয়েছেন যেখানে প্রগতি ধারার আধুনিকীকরণের এক জীবন্ত ছবি আমাদের মানসপটে উদ্ভাসিত হয়। এর মধ্যেও সাহস মানবদরদি উদারতার স্পর্শ পাওয়া যায়।
বোরহান শুধুমাত্র কবিতাই নয়, কথাসাহিত্য, প্রবন্ধ, গবেষণা, নৃবিজ্ঞান, সম্পাদনা, শিল্প সমালোচনা, তরজমা প্রভৃৃৃতি ক্ষেত্রে বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। এর মধ্যে আছে কাব্যগ্রন্থ আসবাবহীন ঘর, এখন যেও না, একটু পরে বৃষ্টি হবে, গল্পগ্রন্থ মু-ুহীন মহারাজ। প্রবন্ধ গ্রন্থের মধ্যে মাইকেলের জাগরণ ও অন্যান্য, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিদ্রোহ- সাহিত্য ও রাজনীতিতে, আধুনিকতা এবং উত্তর আধুনিকতার অভিজ্ঞতা (প্রবন্ধ গবেষণা) জয়নুল আবেদিনের জিজ্ঞাসা, দেশজ আধুনিকতা; সুলতানের কাজ (শিল্প সমালোচনা) সম্রাট জাহাঙ্গীরের আত্মজীবনী (তরজমা) এরকম নানাবিধ কাজ।
বহুকাল আগে যখন প্রথম বোরহানের গল্প পড়ে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলাম যে তার ঘোর আজও কাটেনি। সম্পূর্ণ গ্রামীণ পটভূমিকায় রচিত সে গল্পটির কথা আজও ভুলতে পারিনি। পরে অবশ্য বোরহান সময়ের দাবিতে নিজের লেখালেখি নিয়ে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। একসময় তার চিঠি লেখার ভঙ্গিতে একান্ত ব্যক্তিগত কথোপকথনের ঢংটি আমার বেশ ভালো লেগেছিল। পাশাপাশি তাঁর কবিতা আপাত নরম ও নিরীহ হলেও মাঝে মাঝে প্রতিবাদও ঝলসে উঠেছে। এক সংবেদনশীল মনের আত্মান্বেষণ। আসলে শৈলী বৈচিত্র্য বা শুধু ভাষার কথা নয়, ভাবপটও বটে। কেননা একজন লেখকের চাওয়া পাওয়া মানসিক চিন্তা-চেতনা, তত্ত্বজ্ঞান জগৎ দর্শনের পাশে তাঁর অনুভূতির উজ্জ্বল উদ্ধারকর্মই লেখকের শৈলী। এজন্য চাই বিশাল কালখ-। প্রসারিত কাব্যভূমি আর কলমবিদ্ধ অনেক অনেক শব্দরাশি। বোরহানের মতো কবিকে কোনো বিশেষণের অভিধায় বাঁধতে চাই না। কেননা কবিকে তা আংশিক চেনায়। ফলে বিশেষণ পাল্টাতে হয় বারবার। এই বদলানো ঢং প্রমাণ করে কবিকে কোনো বিশেষ কোটরে বন্দি করা যাচ্ছে না। অথচ আত্মার আরাম, বুদ্ধির শান্তির জন্য অন্য সব সময় তাই করে যাওয়া হয়।
আমার সমস্ত ভাবনাগুলি শেষ পর্যন্ত বন্দি হয়ে যায়
এক আদিম প্রণয়ধ্বনির মতো সমুদ্রের দিকে অগ্রসর হয়,
সমুদ্রের অর্থ সমুদ্র
যেখানে কোনো আশা নেই কেউ পৌঁছয় না
বোরহান অন্তিমে তাই বলতে পারেন সারাদেশ বিষাধ সিন্ধুতে ডুবে আছে।
বেলাল চৌধুরী
বৃহস্পতিবার, ০৯ জানুয়ারী ২০২৫
শিল্পের সঙ্গে বর্ণের ঘনিষ্ঠ সংযোগ চিরকালীন। যাঁরা ছবি আঁকেন তাঁরা তুলি দিয়ে রঙ ধরান ক্যানভাসে, কিন্তু কবিরা রঙ ধরান শব্দের মাধ্যমে- ‘রঙ’-এর প্রতীকী উদ্যামের ভিতর। তাই চিরকালীন বর্ণ সচেতনতা কবিদের কাব্যকে সমৃদ্ধ করেছে। সাধারণভাবে রবীন্দ্রনাথকেই যদি ধরা যায় তাহলে দেখা যাবে ‘পুনশ্চ’ কাব্যের পাতায় পাতায় রঙ তুলির টান, রঙের আলপনা। সেখানে রঙ ছিটিয়েছেন হোলি উৎসবের মতন। যেমন ধরণীর এক কোণে একটু বাসা অন্বেষী কবির আকাক্সক্ষা ধরা পড়েছে। “আমার পাটল রঙের গাই গরুটি/আর মেশিল রঙের বাছুর/ময়ূরাক্ষী নদীর ধারে।/ঘরের মেঝেতে ফিকে নীল রঙের জাজিম পাতা/খয়েরি রঙের ফুল-কাটা।/দেয়াল বাসন্তী রঙের।/তাতে ঘন কালো রেখার পাড়।” (বাসা, পুনশ্চ, রবীন্দ্রনাথ) ভিনসেন্ট ভ্যানগঘও তাঁর নিজের আঁকা শোবার ঘরের বর্ণনা দিয়েছিলেন এইভাবে- “এবার স্রেফ আবার শোবার ঘর, তবে এবার সব রঙই কাজ করবে... আভাস দেবে বিশ্রামের এবং ঘুমের। এক কথায় ছবির দিকে তাকালেই মগজটা বা কল্পনাটা বিশ্রাম পাবে। দেওয়ালগুলি ফিকে বেশনে। মেঝেটা লাল টালির, খাটের আর দেওয়ালগুলির কাঠের রঙ টাটকা মাখনের মতো হলদে, চাদর আর বালিশ খুব হালকা সবুজ। মুখ ধোবার টেবিলটা কমলা রঙ-এর মুখ ধোবার পাত্রটা নীল। দরজাগুলি লাইম্যাক রঙের। ...ছবিতে কোনও সাদা নেই। ফ্রেম হবে সাদা।”
কাব্য বা কবিতায় রঙ-এর অন্বেষণ মিড ভিক্টোরিয়ান কালসীমার অন্তর্বর্তী প্রি-র্যাফালাইট কবিদের কথা প্রসঙ্গক্রমে স্মরণ করা যায়, যেখানে অভিনব রঙের প্রভাব ঘটেছিল বিশ্ব প্রকৃতিকে আবেগের মধ্যদিয়ে অনুপুঙ্খ দেখার তৃষ্ণায়।
চলমান কবিতা সময়ের মাঝে এমন একটি সন্ধিক্ষণ থাকে যেখানে কবিতার রহস্যময়তা, প্রেমের প্রকাশ ভিন্ন এক পরিধি রচনা করে। জীবনের সংযত বোধ ও বেদনা বিরহ ও শোকঘন অন্বিষ্টচেতনা সব বিচার বুদ্ধিকে জারিত করে। আমরা এমন এক যুবসন্ধিক্ষণের মধ্য দিয়ে চালিত হই যেখানে আপন অভীষ্ট এক বিরল অনুচেতনা তৈরি করে। এই অনুচেতনার সাক্ষী শুধু পারিপার্শ্বিক টানাপড়েন আবার কখনও বিরাট ও বিচিত্র সরলীকরণ। মেধা ও প্রজ্ঞার কাছে যে সময়ে বা কালে নিমজ্জিত থাকা যাক সেই সময় ও কালকে সম্ভবত সারা জীবনেও চিনে ওঠা যায় না অথবা শনাক্ত করা যায় না। একদিকে ছিন্ন জীবনের চেতনা আবার অনুভূতির বিরহী দশা- এইসব মিলিয়ে আমরা এমন এক সন্ধিক্ষণে উপস্থিত হই যেখানে কবিতা শুশ্রƒষার মতো কাজ করে। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর এমনই এক সন্ধিক্ষণের মধ্যদিয়ে এগিয়েছেন যেখানে প্রগতি ধারার আধুনিকীকরণের এক জীবন্ত ছবি আমাদের মানসপটে উদ্ভাসিত হয়। এর মধ্যেও সাহস মানবদরদি উদারতার স্পর্শ পাওয়া যায়।
বোরহান শুধুমাত্র কবিতাই নয়, কথাসাহিত্য, প্রবন্ধ, গবেষণা, নৃবিজ্ঞান, সম্পাদনা, শিল্প সমালোচনা, তরজমা প্রভৃৃৃতি ক্ষেত্রে বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। এর মধ্যে আছে কাব্যগ্রন্থ আসবাবহীন ঘর, এখন যেও না, একটু পরে বৃষ্টি হবে, গল্পগ্রন্থ মু-ুহীন মহারাজ। প্রবন্ধ গ্রন্থের মধ্যে মাইকেলের জাগরণ ও অন্যান্য, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিদ্রোহ- সাহিত্য ও রাজনীতিতে, আধুনিকতা এবং উত্তর আধুনিকতার অভিজ্ঞতা (প্রবন্ধ গবেষণা) জয়নুল আবেদিনের জিজ্ঞাসা, দেশজ আধুনিকতা; সুলতানের কাজ (শিল্প সমালোচনা) সম্রাট জাহাঙ্গীরের আত্মজীবনী (তরজমা) এরকম নানাবিধ কাজ।
বহুকাল আগে যখন প্রথম বোরহানের গল্প পড়ে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলাম যে তার ঘোর আজও কাটেনি। সম্পূর্ণ গ্রামীণ পটভূমিকায় রচিত সে গল্পটির কথা আজও ভুলতে পারিনি। পরে অবশ্য বোরহান সময়ের দাবিতে নিজের লেখালেখি নিয়ে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। একসময় তার চিঠি লেখার ভঙ্গিতে একান্ত ব্যক্তিগত কথোপকথনের ঢংটি আমার বেশ ভালো লেগেছিল। পাশাপাশি তাঁর কবিতা আপাত নরম ও নিরীহ হলেও মাঝে মাঝে প্রতিবাদও ঝলসে উঠেছে। এক সংবেদনশীল মনের আত্মান্বেষণ। আসলে শৈলী বৈচিত্র্য বা শুধু ভাষার কথা নয়, ভাবপটও বটে। কেননা একজন লেখকের চাওয়া পাওয়া মানসিক চিন্তা-চেতনা, তত্ত্বজ্ঞান জগৎ দর্শনের পাশে তাঁর অনুভূতির উজ্জ্বল উদ্ধারকর্মই লেখকের শৈলী। এজন্য চাই বিশাল কালখ-। প্রসারিত কাব্যভূমি আর কলমবিদ্ধ অনেক অনেক শব্দরাশি। বোরহানের মতো কবিকে কোনো বিশেষণের অভিধায় বাঁধতে চাই না। কেননা কবিকে তা আংশিক চেনায়। ফলে বিশেষণ পাল্টাতে হয় বারবার। এই বদলানো ঢং প্রমাণ করে কবিকে কোনো বিশেষ কোটরে বন্দি করা যাচ্ছে না। অথচ আত্মার আরাম, বুদ্ধির শান্তির জন্য অন্য সব সময় তাই করে যাওয়া হয়।
আমার সমস্ত ভাবনাগুলি শেষ পর্যন্ত বন্দি হয়ে যায়
এক আদিম প্রণয়ধ্বনির মতো সমুদ্রের দিকে অগ্রসর হয়,
সমুদ্রের অর্থ সমুদ্র
যেখানে কোনো আশা নেই কেউ পৌঁছয় না
বোরহান অন্তিমে তাই বলতে পারেন সারাদেশ বিষাধ সিন্ধুতে ডুবে আছে।