alt

সাময়িকী

বাদশা আকবর

মনজুর শামস

: বৃহস্পতিবার, ০৯ জানুয়ারী ২০২৫

ঝম্ঝমিয়ে আর কানে তালা লাগানো সিটি বাজিয়ে ট্রেনটি চলে যেতেই বস্তির ঝুপড়িতে কাঁথা দিয়ে পুঁটলি বানিয়ে রাখা আকবর বাদশাকে জড়ি কোলে তুলে নিলো। ট্রেনটি চলে যাওয়ার অপেক্ষাতেই ছিল সে। ঝুপড়ির ঝাঁপ খুলে চলে এলো রেললাইনের ওপরে। খুব কাছ দিয়েই চলে গেছে রেললাইনটা। সকালের সূর্যটা সবে তেজ ছড়াতে শুরু করেছে। ছেলেকে রোদ খাওয়াতে সে সোজা চলে এলো রেললাইনটার ওপরে। সাতদিন বয়সের ছেলের মুখটা কাঁথার পুঁটলি থেকে বের করে রোদ লাগাতে লাগাতে রেলরাইনের ওপরে আনমনে বসে পড়ল জড়ি। বসতেই ছ্যাঁকা খেল। ট্রেন চলে গেছে এক মিনিটও হয়নি। অগত্যা সূর্যের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই আকবর বাদশাকে রোদ খাওয়াতে থাকল সে।

ছেলের নাম আকবর বাদশা রেখেছে আলা। জড়ির ভ্যান ড্রাইভার স্বামী। নামটা আলাউদ্দিন হলেও এ তল্লাটে তাকে কেউ পুরো নামে ডাকে না। বস্তি থেকে একটু দূরেই বড় রাস্তায় ফার্নিচারের দোকানগুলোর কাঠের আসবাবপত্র ডেলিভারির কাজ করে তমিজ আলি। অন্য মালপত্রও বয়। তার মোট সাতটি রিকশা-ভ্যান। এগুলোরই একটা চালায় আলা। সকাল থেকে কোনো কোনো দিন মাঝরাত পর্যন্ত। বউটাকেও বাধ্য হয়ে আপাতত কাজ ছেড়ে দিতে হয়েছে। কয়েকটা বাসায় ঠিকে ঝিয়ের কাজ করতো। পোয়াতি হওয়ার মাস সাতেক পর সেসব কাজে তাকে আর যেতে দেয়নি আলা। যতোটা না জড়ির কথা ভেবে, তারও বেশি নিজের সন্তানের কথা ভেবে। প্রথমবার মা হতে চলেছে জড়ি। আলা তার সব কষ্টের শেষ দেখতে চাইছে সন্তানের মাঝে। কল্পনার ফানুস ওড়াতে শুরু করেছে মনে মনে। সারা জাহানের বাদশা হয়ে আসছে যেন তার সন্তান। তাই মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল মেয়ে হলে নাম রাখবে বিবি হানিফা আর ছেলে হলে বাদশা আকবর। জড়ির ছেলে হওয়ার খবর পেয়ে জোরে জোরে প্যাডাল ঘুরিয়ে বস্তিতে ফিরে ছেলেকে কোলে নিয়ে খুশিতে চরকির মতো এক চক্কর দিয়ে আশপাশের সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে জড়িকে সে বলেছিল,

‘এহন থাইক্যা আমার এই সুনার টুকরার নাম বাদশা আকবর, বুঝলি জড়ি। বেবাক মাইনষেরে কইয়া দিস- আমার পুলার নাম বাদশা আকবর। খবরদার কেওই য্যান্ খালি বাদশা বা আকবর কইয়া না ডাকে। হ¹লরে কইয়া দিবি- আমার পুলারে পুরা নামে ডাকুন লাগব। পুরা নামে ডাকবার না পারলে আমার পুলারে কারো ডাকুনের কাম নাই!’

শুনে জড়ি ফিক্ করে হেসে উঠেছিল বলে সেদিন কী ঝাড়িটাই না দিয়েছিল তাকে আলা! আকবর বাদশার মুখে রোদ লাগায় সে ট্যাঁ-আঁ-আঁ করে কেঁদে উঠতেই জড়ির সেই ক্ষণটি মনে পড়ে গেল এবং খলবলিয়ে হেসে উঠল। কিন্তু মুখে আঁচল চেপে ধরতে হলো পিছন থেকে হালিমার ঠাট্টা শুনে-

‘কী রে জড়ি, কার কতা মুনে কইরা অম্বায় একলা একলা হাসবার লাগছাস? মুনে অয় খুব মজার কতা মুনে পইড়া গেছে!’

‘হ, মজার কতাই। আইচ্ছা তুই ক ছেন্ হালিমা, এই দুন্যিয়ায় সব চাইতে ত্যাজের বাদশার নাম কী?’

‘ক্যা, রূপবান বাদশা!’

‘আরে ধুর! ওইডা তো অইলো যাত্রা-সিনেমার বাদশা, আসল বাদশা নি? এই দুইন্যার সব চাইতে ত্যাজের বাদশা অইতাছে বাদশা আকবর!’

বলে আবারও খলবলিয়ে হেসে ওঠে জড়ি। এ সময় বস্তি থেকে হাসি আর জবাকে আসতে দেখে নালিশের সুরে হালিমা তাদের দিকে মুখ বাড়িয়ে বলে-

‘হাসি বু দেখছাও, দেখছাস জবা, জড়ি ক্যাম্বায় হেইসুম থাইক্যা হাসতাছে!’

‘এম্বায় এম্বায় কি আর কেওই হাসে? লিশ্চয় হাসুনের কিছু ঘটছে! কী রে জড়ি, আলা ভাইর সুহাগের কতা মুনে পড়ছে নি?’

বলে হাসিও রেললাইনের ওপরে এসে কাঁথার পুঁটলি থেকে তার মেয়ের মুখটি বের করে রোদে মেলে ধরে। ওরা চারজনই নিজেদের নবজাতক শিশুকে রোজ রোদ খাওয়াতে আনে এই রেললাইনে। ঠিক এই সময়ে। জড়ি আর জবা ঠিকে ঝিয়ের কাজ করে; হালিমা আর হাসি বাসাবাড়ির ময়লা ফেলার কাজ করে হিরন মিয়ার দলে। ওদের ভেতর জড়ির সন্তানের বয়স সবচেয়ে কম। আর সেজন্য বাকি তিনজনই এই রোদ পোহানোর পুরো সময়টুকুতে তাকে জ্ঞান দিতে থাকে। হালিমার বোধহয় জবার কথা খুব একটা মনে ধরল না। সে তাই জবার কথার পিঠে বলে উঠল-

‘না রে জবা। ওর বিষয়ডা কইলাম আমার কাছে ভালা ঠেকতাছে না। দ্যাখ, ওরে আবার জিনে ধরছে নি!’

‘তওবা, তওবা, তওবা! তোর কি এই আকতা-কুকথা মুহে আটকায় না। হাসি বু, তুমিই কও, এই কাঁচা পুয়াতিরে নিয়া ইমুন অলুক্ষইন্যা কতা কওয়া কি ঠিক?’

‘ওই হালিমা, তোর কি আক্কেল-বুদ্ধি কুনু কালেই অইবো না! জবা ঠিকই কইছে। এইসুম উল্টাপুল্টা কতা কউন ঠিক না। যুদি...’

হাসি তার মুখের কথা শেষ করতে পারল না। হঠাৎ করেই বস্তি থেকে খুব হৈচৈয়ের শব্দ ভেসে এলো। প্রথমে সবাই খুব ভড়কে গেলেও পরক্ষণেই নিজেদের সামলে নিল। এই বস্তিতে এ ধরনের গ-গোল খুবই সাধারণ ঘটনা। সকাল-বিকেল নানা কারণে ঝগড়াঝাঁটি, মারামারি লেগেই থাকে। এ ধরনের হট্টগোল তাই জড়িদের গা-সওয়া ব্যাপার। কিন্তু জড়ির নাম ধরে তারস্বরে চিৎকার করে ডাকাডাকি শোনা যেতেই ছ্যাঁৎ করে উঠল জড়ির মনের ভেতর। অজানা আশঙ্কায় ওদের চারজনেরই সকালের রোদেও মুখের সামনে নেমে এলো ঘুটঘুটে অন্ধকার। চারজনই পাথরের মতো জমে গিয়েছিল, কিন্তু জড়ি আর বসে থাকতে পারল না। বাদশা আকবরকে বুকে চেপে ধরে দৌড়তে থাকল সে বস্তির দিকে আর চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে বলতে থাকল-

‘ওই, কী অইছে রে! এই যে রে আমি, আসতাছি, আসতাছি।’

চারজনের কেউই আর বসে থাকতে পারল না। জড়ির পিছে পিছে বাকিরাও ছুটল বস্তির দিকে। জড়িকে ছুটে আসতে দেখে ভিড় করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হা-হুতাশ করতে থাকা সবাই সরে গিয়ে পথ করে দিল। নিজেদের ঝুপড়ির সামনে গিয়ে একটি খাটিয়ায় আলার ক্ষত-বিক্ষত লাশ দেখে তীক্ষè আর্তচিৎকারে জড়ি তার বুকের ওপর আছড়ে পড়ল। কেউ একজন জড়ির কোল থেকে ভয়ে চিৎকার করতে থাকা শিশুটিকে নিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকল। সবার আহাজারি আর কথাবার্তা থেকে জানা গেল, প্রচ- গতির একটি ট্রাক আলার ভ্যানটিকে দুমড়ে-মুচড়ে আলাকে পিষে দিয়ে চোখের নিমেষে হাওয়া হয়ে গেছে।

মাসখানেক খুব কেঁদেছিল জড়ি। এরপর যতোই দিন যেতে থাকল তার প্রতি বস্তির সবার দরদও ততো কমে আসতে থাকল। আশপাশের ঝুপড়ি থেকে তার জন্য খাবার আসাও কমতে থাকল। এরপর একদিন বাদশা আকবরকে কোলে নিয়েই কাজে যেতে শুরু করল সে। আলার অকাল মৃত্যুতে আক্ষেপ করতে করতে বস্তিতে জড়িকে শুনিয়ে শুনিয়ে আলার প্রশংসা-বয়ান কমে কমে এক সময় একেবারেই থিতিয়ে এলো। এদিকে জড়ির প্রতি সবার সহানুভূতি কমতে থাকলেও একজনের কিন্তু উল্টো বাড়তেই থাকল। জড়ির পাশের ঝুপড়ির রাবেয়া বুবুর দেবর জয়নাল ছিল আলার ইয়ার দোস্ত। আলার মৃত্যুর পর জড়ির খোঁজ-খবর, যতœ-আত্তি সে-ই সবচেয়ে বেশি করছে। কমলাপুর রেলস্টেশনে মোট বওয়ার কাজে ঢিলা দিয়ে জড়ি আর তার ছেলের পেছনেই সে এখন বেশি সময় কাটাতে লাগল। দেবরের মনের কথা আঁচ করতে পেরে মাস ছয়েক পর অবশেষে রাবেয়া জড়িকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে তাদের বিয়ে দিয়ে দিলেন। জড়িও একটা অবলম্বন খুঁজে পেল।

বছরখানেক সুখে-দুখে মোটামুটি ভালোই কাটল। কিন্তু এরপর জড়ির সংসারে এমন এক বিপদ দেখা দিল, যা এই বস্তির কেউ কোনোদিন দেখেনি। শোনেওনি। শুধু এই বস্তিতে কেন, অন্য কোথাও কেউ কখনো এমন বিপদের মুখে পড়েছে বলে আশপাশের কেউ কখনো শোনেনি। ধীরে ধীরে জড়ির ছেলে বাদশা আকবরের মাথাটা সারা দেহের তুলনায় বড় হতে থাকল। এবং জড়ির সমস্ত সুখ-কল্পনায় ছাই ঢেলে দিতে দিতে ছেলেটার মাথা বড় হতেই থাকল। জয়নাল একে ওকে ধরে ঢাকার প্রায় সব ডাক্তার দেখিয়েও অদ্ভুত এই রোগের কোনো কূল-কিনারা করতে পারল না। বস্তিতে জড়ির সবচেয়ে বড় ভরসা তার রাবেয়া বুবু কবিরাজদের দোরে দোরে ঘুরেও এর কোনো হিল্লে করতে না পেরে বাদশা আকবরকে নিয়ে পির-ফকিরের দরগায় দরগায় ঘুরতে লাগল। তাতেও কিছু হলো না।

এদিকে সবার অজান্তে ব্যাপারটা খুব উপভোগ করছিল বস্তির দক্ষিণদিকের একেবারে শেষ ঝুপড়িটার ওমেদ মোল্লা। ঢাকার সবচেয়ে বড় ভিখিরি সিন্ডিকেটের দালাল সে। ভিখিরি জোগাড় করে সিন্ডিকেটের দখলে থাকা জায়গায় বসিয়ে দিয়ে সিন্ডিকেট থেকে দালালির টাকায় সংসার চালায় সে। মাঝে মাঝেই সে গিয়ে জড়িকে ভিক্ষে করার লোভনীয় প্রস্তাব দিয়ে আসছিল এবং জড়ির মুখ ঝামটা খেয়ে সটকে পড়তে হচ্ছিল। অন্যদিকে কোনোভাবেই এ বিপদ থেকে উদ্ধার হতে না পেরে হতাশার অতল সাগরে হাবুডুবু খেতে থাকা জড়ির সমস্যা কেবল বাড়তেই লাগল।

বছর তিনেক জড়ি আর বাদশা আকবরকে নিয়ে খুব দৌড়-ঝাঁপ করার পর জয়নালও এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়ল। দিন দিনই ঢিলে হতে থাকল জড়ির প্রতি তার ভালবাসার টান। অবস্থা এমন দাঁড়াল- বাদশা আকবরকে দেখলেই তার পিত্তি জ¦লে যেতো। শেষতক একদিন সে জড়ি আর বাদশা আকবরকে ফেলে পালিয়ে গেল।

এর পর থেকে ওমেদ মোল্লার আনাগোনা আরো বেড়ে গেল। অবশেষে একদিন দু চোখে চরম অনিশ্চয়তার অন্ধকার দেখতে থাকা জড়ি ওমেদ মোল্লার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল। এমন একটা মওকা পেয়ে হাতে চাঁদ পেয়ে গেল ওমেদ। তার দৃঢ় বিশ^াস, অচিরেই সারা ঢাকার ভিখিরিকুলের বাদশা বনে যাবে জড়ির বাদশা আকবর। একদিন সকালে সে জড়িকে শ্যামলী শিশুমেলার ফুট ওভারব্রিজে তাদের দখলে থাকা জায়গায় বাদশা আকবরকে কোলে দিয়ে বসিয়ে দিল। কয়েক দিনের ভেতরেই ওমেদের ধারণা সত্য প্রমাণিত হলো।

ওমেদ মোল্লা সবচেয়ে বড় দাওটা মারল শব-ই বরাতের রাতে। শব-ই বরাতের রাতকে সামনে রেখে আজিমপুর গোরস্তানের সামনের রাস্তায় ভিখিরি বসানোর গোপন ডাকে বাদশা আকবরের জন্য জায়গা বরাদ্দ বাবদ ১৫ হাজার টাকা বাগিয়ে নিল সে। সেদিন সন্ধ্যার অনেক আগেই নির্দিষ্ট জায়গায় জড়িকে নিয়ে বসিয়ে দিয়ে বাদশা আকবরের কপালে চটাস করে একটি চুমু খেয়ে সটকে পড়তে পড়তে সে বলে গেল-

‘এক শ বছর আয়ু পাক তোর ছাওয়াল জড়ি। সারা দুন্যিয়ার বেবাক ভিক্ষানির স¤্রাট আমাগো এই বাদশা আকবর।’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

কানাগলি

ছবি

পার্ল এস বাক-এর কবিতা

ছবি

হোসে এচেগারাই স্প্যানিশ আলোকবর্তিকা

ছবি

নববীণায় বাজে নতুনের জয়গান

ছবি

রবীন্দ্রনাথের ‘করুণা’ ঘিরে কিছু কথা

ছবি

গীতাঞ্জলির ইতিবৃত্ত ও বেদনাহত রবীন্দ্রনাথ

ছবি

রবীন্দ্রনাথ, শিলাইদহ ও ‘ছিন্নপত্র’

ছবি

নিউ নেদারল্যান্ডস: জার্র্সি এবং লেনাপি জনগোষ্ঠী

সাময়িকী কবিতা

ছবি

বকুলীর সেইরাত

ছবি

আকাশের প্রান্ত

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

মুখ

ছবি

বাংলাদেশের প্রথম নির্বাসিত কবি

ছবি

অগ্রজ দাউদ হায়দারের মহাপ্রয়াণ

ছবি

নারী যখন পাঠক নারী যখন লেখক

সাময়িকী কবিতা

মিত্র

ছবি

মৃত্যুর মৃদু উত্তাপ : পথের শেষ কোথায়

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

বেলাল চৌধুরীর কবিতা

ছবি

পাঠের আগ্রহ থাকলে বইয়ের অভাব হয় না

ছবি

রবীন্দ্রগানে শঙ্খ ঘোষের মন

ছবি

ফার্স্ট টিউসডে’স : আমার প্রথম মঙ্গলবার সন্ধ্যার গন্তব্য

ছবি

আজ লাবণ্যর বিয়ে

ছবি

সংস্কৃতির পরম্পরা, অভিঘাত-অভিজ্ঞান ইতিহাস বিচার-বিশ্লেষণ

ছবি

তুষার গায়েন-এর কবিতা

ছবি

লোরকার দেশে

ফিলিস্তিনের তিনটি কবিতা

ছবি

এক বিস্ময় প্রতিভা

ছবি

দিওয়ান-ই-মাখফি : জেব-উন-নিশা

ছবি

বৈচিত্র্যে ভরা ‘যদিও উত্তরমেঘ’

ছবি

রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাইয়ের কথা

ছবি

মোহ কাঠের নৌকা : জীবন-সংগ্রামের এক বাস্তব প্রতিচ্ছবি

tab

সাময়িকী

বাদশা আকবর

মনজুর শামস

বৃহস্পতিবার, ০৯ জানুয়ারী ২০২৫

ঝম্ঝমিয়ে আর কানে তালা লাগানো সিটি বাজিয়ে ট্রেনটি চলে যেতেই বস্তির ঝুপড়িতে কাঁথা দিয়ে পুঁটলি বানিয়ে রাখা আকবর বাদশাকে জড়ি কোলে তুলে নিলো। ট্রেনটি চলে যাওয়ার অপেক্ষাতেই ছিল সে। ঝুপড়ির ঝাঁপ খুলে চলে এলো রেললাইনের ওপরে। খুব কাছ দিয়েই চলে গেছে রেললাইনটা। সকালের সূর্যটা সবে তেজ ছড়াতে শুরু করেছে। ছেলেকে রোদ খাওয়াতে সে সোজা চলে এলো রেললাইনটার ওপরে। সাতদিন বয়সের ছেলের মুখটা কাঁথার পুঁটলি থেকে বের করে রোদ লাগাতে লাগাতে রেলরাইনের ওপরে আনমনে বসে পড়ল জড়ি। বসতেই ছ্যাঁকা খেল। ট্রেন চলে গেছে এক মিনিটও হয়নি। অগত্যা সূর্যের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই আকবর বাদশাকে রোদ খাওয়াতে থাকল সে।

ছেলের নাম আকবর বাদশা রেখেছে আলা। জড়ির ভ্যান ড্রাইভার স্বামী। নামটা আলাউদ্দিন হলেও এ তল্লাটে তাকে কেউ পুরো নামে ডাকে না। বস্তি থেকে একটু দূরেই বড় রাস্তায় ফার্নিচারের দোকানগুলোর কাঠের আসবাবপত্র ডেলিভারির কাজ করে তমিজ আলি। অন্য মালপত্রও বয়। তার মোট সাতটি রিকশা-ভ্যান। এগুলোরই একটা চালায় আলা। সকাল থেকে কোনো কোনো দিন মাঝরাত পর্যন্ত। বউটাকেও বাধ্য হয়ে আপাতত কাজ ছেড়ে দিতে হয়েছে। কয়েকটা বাসায় ঠিকে ঝিয়ের কাজ করতো। পোয়াতি হওয়ার মাস সাতেক পর সেসব কাজে তাকে আর যেতে দেয়নি আলা। যতোটা না জড়ির কথা ভেবে, তারও বেশি নিজের সন্তানের কথা ভেবে। প্রথমবার মা হতে চলেছে জড়ি। আলা তার সব কষ্টের শেষ দেখতে চাইছে সন্তানের মাঝে। কল্পনার ফানুস ওড়াতে শুরু করেছে মনে মনে। সারা জাহানের বাদশা হয়ে আসছে যেন তার সন্তান। তাই মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল মেয়ে হলে নাম রাখবে বিবি হানিফা আর ছেলে হলে বাদশা আকবর। জড়ির ছেলে হওয়ার খবর পেয়ে জোরে জোরে প্যাডাল ঘুরিয়ে বস্তিতে ফিরে ছেলেকে কোলে নিয়ে খুশিতে চরকির মতো এক চক্কর দিয়ে আশপাশের সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে জড়িকে সে বলেছিল,

‘এহন থাইক্যা আমার এই সুনার টুকরার নাম বাদশা আকবর, বুঝলি জড়ি। বেবাক মাইনষেরে কইয়া দিস- আমার পুলার নাম বাদশা আকবর। খবরদার কেওই য্যান্ খালি বাদশা বা আকবর কইয়া না ডাকে। হ¹লরে কইয়া দিবি- আমার পুলারে পুরা নামে ডাকুন লাগব। পুরা নামে ডাকবার না পারলে আমার পুলারে কারো ডাকুনের কাম নাই!’

শুনে জড়ি ফিক্ করে হেসে উঠেছিল বলে সেদিন কী ঝাড়িটাই না দিয়েছিল তাকে আলা! আকবর বাদশার মুখে রোদ লাগায় সে ট্যাঁ-আঁ-আঁ করে কেঁদে উঠতেই জড়ির সেই ক্ষণটি মনে পড়ে গেল এবং খলবলিয়ে হেসে উঠল। কিন্তু মুখে আঁচল চেপে ধরতে হলো পিছন থেকে হালিমার ঠাট্টা শুনে-

‘কী রে জড়ি, কার কতা মুনে কইরা অম্বায় একলা একলা হাসবার লাগছাস? মুনে অয় খুব মজার কতা মুনে পইড়া গেছে!’

‘হ, মজার কতাই। আইচ্ছা তুই ক ছেন্ হালিমা, এই দুন্যিয়ায় সব চাইতে ত্যাজের বাদশার নাম কী?’

‘ক্যা, রূপবান বাদশা!’

‘আরে ধুর! ওইডা তো অইলো যাত্রা-সিনেমার বাদশা, আসল বাদশা নি? এই দুইন্যার সব চাইতে ত্যাজের বাদশা অইতাছে বাদশা আকবর!’

বলে আবারও খলবলিয়ে হেসে ওঠে জড়ি। এ সময় বস্তি থেকে হাসি আর জবাকে আসতে দেখে নালিশের সুরে হালিমা তাদের দিকে মুখ বাড়িয়ে বলে-

‘হাসি বু দেখছাও, দেখছাস জবা, জড়ি ক্যাম্বায় হেইসুম থাইক্যা হাসতাছে!’

‘এম্বায় এম্বায় কি আর কেওই হাসে? লিশ্চয় হাসুনের কিছু ঘটছে! কী রে জড়ি, আলা ভাইর সুহাগের কতা মুনে পড়ছে নি?’

বলে হাসিও রেললাইনের ওপরে এসে কাঁথার পুঁটলি থেকে তার মেয়ের মুখটি বের করে রোদে মেলে ধরে। ওরা চারজনই নিজেদের নবজাতক শিশুকে রোজ রোদ খাওয়াতে আনে এই রেললাইনে। ঠিক এই সময়ে। জড়ি আর জবা ঠিকে ঝিয়ের কাজ করে; হালিমা আর হাসি বাসাবাড়ির ময়লা ফেলার কাজ করে হিরন মিয়ার দলে। ওদের ভেতর জড়ির সন্তানের বয়স সবচেয়ে কম। আর সেজন্য বাকি তিনজনই এই রোদ পোহানোর পুরো সময়টুকুতে তাকে জ্ঞান দিতে থাকে। হালিমার বোধহয় জবার কথা খুব একটা মনে ধরল না। সে তাই জবার কথার পিঠে বলে উঠল-

‘না রে জবা। ওর বিষয়ডা কইলাম আমার কাছে ভালা ঠেকতাছে না। দ্যাখ, ওরে আবার জিনে ধরছে নি!’

‘তওবা, তওবা, তওবা! তোর কি এই আকতা-কুকথা মুহে আটকায় না। হাসি বু, তুমিই কও, এই কাঁচা পুয়াতিরে নিয়া ইমুন অলুক্ষইন্যা কতা কওয়া কি ঠিক?’

‘ওই হালিমা, তোর কি আক্কেল-বুদ্ধি কুনু কালেই অইবো না! জবা ঠিকই কইছে। এইসুম উল্টাপুল্টা কতা কউন ঠিক না। যুদি...’

হাসি তার মুখের কথা শেষ করতে পারল না। হঠাৎ করেই বস্তি থেকে খুব হৈচৈয়ের শব্দ ভেসে এলো। প্রথমে সবাই খুব ভড়কে গেলেও পরক্ষণেই নিজেদের সামলে নিল। এই বস্তিতে এ ধরনের গ-গোল খুবই সাধারণ ঘটনা। সকাল-বিকেল নানা কারণে ঝগড়াঝাঁটি, মারামারি লেগেই থাকে। এ ধরনের হট্টগোল তাই জড়িদের গা-সওয়া ব্যাপার। কিন্তু জড়ির নাম ধরে তারস্বরে চিৎকার করে ডাকাডাকি শোনা যেতেই ছ্যাঁৎ করে উঠল জড়ির মনের ভেতর। অজানা আশঙ্কায় ওদের চারজনেরই সকালের রোদেও মুখের সামনে নেমে এলো ঘুটঘুটে অন্ধকার। চারজনই পাথরের মতো জমে গিয়েছিল, কিন্তু জড়ি আর বসে থাকতে পারল না। বাদশা আকবরকে বুকে চেপে ধরে দৌড়তে থাকল সে বস্তির দিকে আর চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে বলতে থাকল-

‘ওই, কী অইছে রে! এই যে রে আমি, আসতাছি, আসতাছি।’

চারজনের কেউই আর বসে থাকতে পারল না। জড়ির পিছে পিছে বাকিরাও ছুটল বস্তির দিকে। জড়িকে ছুটে আসতে দেখে ভিড় করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হা-হুতাশ করতে থাকা সবাই সরে গিয়ে পথ করে দিল। নিজেদের ঝুপড়ির সামনে গিয়ে একটি খাটিয়ায় আলার ক্ষত-বিক্ষত লাশ দেখে তীক্ষè আর্তচিৎকারে জড়ি তার বুকের ওপর আছড়ে পড়ল। কেউ একজন জড়ির কোল থেকে ভয়ে চিৎকার করতে থাকা শিশুটিকে নিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকল। সবার আহাজারি আর কথাবার্তা থেকে জানা গেল, প্রচ- গতির একটি ট্রাক আলার ভ্যানটিকে দুমড়ে-মুচড়ে আলাকে পিষে দিয়ে চোখের নিমেষে হাওয়া হয়ে গেছে।

মাসখানেক খুব কেঁদেছিল জড়ি। এরপর যতোই দিন যেতে থাকল তার প্রতি বস্তির সবার দরদও ততো কমে আসতে থাকল। আশপাশের ঝুপড়ি থেকে তার জন্য খাবার আসাও কমতে থাকল। এরপর একদিন বাদশা আকবরকে কোলে নিয়েই কাজে যেতে শুরু করল সে। আলার অকাল মৃত্যুতে আক্ষেপ করতে করতে বস্তিতে জড়িকে শুনিয়ে শুনিয়ে আলার প্রশংসা-বয়ান কমে কমে এক সময় একেবারেই থিতিয়ে এলো। এদিকে জড়ির প্রতি সবার সহানুভূতি কমতে থাকলেও একজনের কিন্তু উল্টো বাড়তেই থাকল। জড়ির পাশের ঝুপড়ির রাবেয়া বুবুর দেবর জয়নাল ছিল আলার ইয়ার দোস্ত। আলার মৃত্যুর পর জড়ির খোঁজ-খবর, যতœ-আত্তি সে-ই সবচেয়ে বেশি করছে। কমলাপুর রেলস্টেশনে মোট বওয়ার কাজে ঢিলা দিয়ে জড়ি আর তার ছেলের পেছনেই সে এখন বেশি সময় কাটাতে লাগল। দেবরের মনের কথা আঁচ করতে পেরে মাস ছয়েক পর অবশেষে রাবেয়া জড়িকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে তাদের বিয়ে দিয়ে দিলেন। জড়িও একটা অবলম্বন খুঁজে পেল।

বছরখানেক সুখে-দুখে মোটামুটি ভালোই কাটল। কিন্তু এরপর জড়ির সংসারে এমন এক বিপদ দেখা দিল, যা এই বস্তির কেউ কোনোদিন দেখেনি। শোনেওনি। শুধু এই বস্তিতে কেন, অন্য কোথাও কেউ কখনো এমন বিপদের মুখে পড়েছে বলে আশপাশের কেউ কখনো শোনেনি। ধীরে ধীরে জড়ির ছেলে বাদশা আকবরের মাথাটা সারা দেহের তুলনায় বড় হতে থাকল। এবং জড়ির সমস্ত সুখ-কল্পনায় ছাই ঢেলে দিতে দিতে ছেলেটার মাথা বড় হতেই থাকল। জয়নাল একে ওকে ধরে ঢাকার প্রায় সব ডাক্তার দেখিয়েও অদ্ভুত এই রোগের কোনো কূল-কিনারা করতে পারল না। বস্তিতে জড়ির সবচেয়ে বড় ভরসা তার রাবেয়া বুবু কবিরাজদের দোরে দোরে ঘুরেও এর কোনো হিল্লে করতে না পেরে বাদশা আকবরকে নিয়ে পির-ফকিরের দরগায় দরগায় ঘুরতে লাগল। তাতেও কিছু হলো না।

এদিকে সবার অজান্তে ব্যাপারটা খুব উপভোগ করছিল বস্তির দক্ষিণদিকের একেবারে শেষ ঝুপড়িটার ওমেদ মোল্লা। ঢাকার সবচেয়ে বড় ভিখিরি সিন্ডিকেটের দালাল সে। ভিখিরি জোগাড় করে সিন্ডিকেটের দখলে থাকা জায়গায় বসিয়ে দিয়ে সিন্ডিকেট থেকে দালালির টাকায় সংসার চালায় সে। মাঝে মাঝেই সে গিয়ে জড়িকে ভিক্ষে করার লোভনীয় প্রস্তাব দিয়ে আসছিল এবং জড়ির মুখ ঝামটা খেয়ে সটকে পড়তে হচ্ছিল। অন্যদিকে কোনোভাবেই এ বিপদ থেকে উদ্ধার হতে না পেরে হতাশার অতল সাগরে হাবুডুবু খেতে থাকা জড়ির সমস্যা কেবল বাড়তেই লাগল।

বছর তিনেক জড়ি আর বাদশা আকবরকে নিয়ে খুব দৌড়-ঝাঁপ করার পর জয়নালও এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়ল। দিন দিনই ঢিলে হতে থাকল জড়ির প্রতি তার ভালবাসার টান। অবস্থা এমন দাঁড়াল- বাদশা আকবরকে দেখলেই তার পিত্তি জ¦লে যেতো। শেষতক একদিন সে জড়ি আর বাদশা আকবরকে ফেলে পালিয়ে গেল।

এর পর থেকে ওমেদ মোল্লার আনাগোনা আরো বেড়ে গেল। অবশেষে একদিন দু চোখে চরম অনিশ্চয়তার অন্ধকার দেখতে থাকা জড়ি ওমেদ মোল্লার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল। এমন একটা মওকা পেয়ে হাতে চাঁদ পেয়ে গেল ওমেদ। তার দৃঢ় বিশ^াস, অচিরেই সারা ঢাকার ভিখিরিকুলের বাদশা বনে যাবে জড়ির বাদশা আকবর। একদিন সকালে সে জড়িকে শ্যামলী শিশুমেলার ফুট ওভারব্রিজে তাদের দখলে থাকা জায়গায় বাদশা আকবরকে কোলে দিয়ে বসিয়ে দিল। কয়েক দিনের ভেতরেই ওমেদের ধারণা সত্য প্রমাণিত হলো।

ওমেদ মোল্লা সবচেয়ে বড় দাওটা মারল শব-ই বরাতের রাতে। শব-ই বরাতের রাতকে সামনে রেখে আজিমপুর গোরস্তানের সামনের রাস্তায় ভিখিরি বসানোর গোপন ডাকে বাদশা আকবরের জন্য জায়গা বরাদ্দ বাবদ ১৫ হাজার টাকা বাগিয়ে নিল সে। সেদিন সন্ধ্যার অনেক আগেই নির্দিষ্ট জায়গায় জড়িকে নিয়ে বসিয়ে দিয়ে বাদশা আকবরের কপালে চটাস করে একটি চুমু খেয়ে সটকে পড়তে পড়তে সে বলে গেল-

‘এক শ বছর আয়ু পাক তোর ছাওয়াল জড়ি। সারা দুন্যিয়ার বেবাক ভিক্ষানির স¤্রাট আমাগো এই বাদশা আকবর।’

back to top