alt

সাময়িকী

নাগিব মাহফুজের নির্বাচিত ১০ স্বপ্ন

ভূমিকা ও অনুবাদ : ফজল হাসান

: বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

আত্মজীবনীমূলক খুদে গল্প

ভূমিকা
নোবেল বিজয়ী মিশরীয় কথাসাহিত্যিক নাগিব মাহফুজ সুদীর্ঘ সত্তর বছরের সাহিত্যিক জীবনে ৩৫টি উপন্যাস (যেগুলোর বিষয়বস্তুর পরিসীমা বিস্তর, যেমন প্রাচীন মিশরীয় ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনা, চরিত্র এবং পৌরাণিক কাহিনী থেকে শুরু করে আধুনিক মিশরের সমসাময়িক জীবন, বিশেষ করে কায়রোর সামাজিক বাস্তবতা), প্রায় ৩৫০টি ছোটোগল্প (১৬টি গল্প গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত), পাঁচটি নাটক এবং ২৫টি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য রচনা করেন। তিনি আরব বিশ্বের প্রথম সাহিত্যিক, যিনি ১৯৮৮ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

অন্ধ মিশরীয় ধর্মীয় নেতা ওমর আবদেল-রহমানের নির্দেশে এক ইসলামপন্থী জঙ্গি ১৯৯৪ সালের ১৪ অক্টোবর সুইচব্লেড দিয়ে নাগিব মাহফুজের গলায় ও ঘাড়ে আঘাত করে। সেই অতর্কিত আক্রমণ, যা তাঁর ডান হাত এবং হাতকে নিয়ন্ত্রণ করে এমন সব স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল, তাঁকে চার বছরেরও বেশি সময় ধরে লেখা থেকে বিরত রেখেছিল। তিনি শুধু সেই দুঃস্বপ্নের অপরাধ থেকে বেঁচে যাননি, বরং তিনি ২০০৬ সালের ৩০ আগস্ট ৯৪ বছর বয়সে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন তৈাঁর স্বপ্নের কথা বলার জন্য। সেসব স্বপ্ন তিনি অবিরামভাবে নিজের হাতে এবং ডিকটেশনের মাধ্যমে লিপিবদ্ধ করেন, যা প্রথমে কায়রোর দৈনিক খবরের কাগজে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় এবং পরে আত্মজীবনীমূলক দুটি আলাদা গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে: দ্য ড্রিমস (২০০০) এবং ড্রিমস অব ডিপারচার (২০০৪)। গ্রন্থ দুটি আরবি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন রেমন্ড স্টক। পরবর্তীতে (২০০৯ সালে) অনুবাদক গ্রন্থ দুটি একত্র করে দ্য ড্রিমস্ ইনক্লুডিং ড্রিমস্ অব ডিপারচার শিরোনামে প্রকাশ করেন। এই সম্মিলিত গ্রন্থে সব মিলিয়ে ২১২টি স্বপ্ন রয়েছে। দ্য ড্রিমস অংশে রয়েছে ১০৪টি স্বপ্ন এবং ড্রিমস্ অব ডিপারচার অংশে রয়েছে ১০৮টি স্বপ্ন। এই স্বপ্নগুলো বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে, যেমন অতি ক্ষুদ্র ছোটোগল্প, ন্যানোনোভেলা, ভিগনেট (চরিত্রচিত্র) এবং স্কেচ (নকশা)। উল্লেখ্য, স্বপ্নগুলোর কোনো শিরোনাম নেই, তবে ক্রমিক সংখ্যা দিয়ে সাজানো হয়েছে।

দ্য ড্রিমস্ ইনক্লুডিং ড্রিমস্ অব ডিপারচার গ্রন্থের সবগুলো গল্পে লেখক স্বপ্নের সঙ্গে তাঁর রাত্রিকালীন চিন্তা ও চেতনার সম্পর্ক স্থাপন করেছেন, যেখানে স্বপ্নের বুনট একটি মাত্র আবেগকে, যেমন লজ্জা, আশা, ভয় ও ভালবাসা, ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। স্বপ্নগুলো লেখকের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তাঁর জীবনকে গৌরব ও উদ্বেগ, আনন্দ এবং অতৃপ্তি দিয়ে পূর্ণ করেছে। তবে লেখক কেবল আবেগ বর্ণনা করেননি, বরং তিনি ছোটো পরিসরে কাজ করে পাঠককে স্বপ্নদ্রষ্টার বাস্তবতা ভাগ করে নিতে এবং কোমল অনুভূতিকে অনুভব করতে বাধ্য করেছেন। বলা হয়, গ্রন্থ দুটিতে লেখক তাঁর গল্প লেখার কলাকৌশল ও শিল্পকে গল্পের সবচেয়েপ্রয়োজনীয়স্তরে পৌঁছে দিয়েছেন এবং একই সঙ্গে তিনি অস্বাভাবিক সংক্ষিপ্ত আকারে মহাকাব্যিক গল্প বলার অতুলনীয়ক্ষমতা প্রদর্শন করেছেন। যদিও প্রচলিত অর্থে কোনো গল্পেই আখ্যান (প্লট) নেই, কিন্তু সবগুলো লেখাই সমৃদ্ধ এবং আকর্ষণীয় সংক্ষিপ্ত চরিত্রচিত্র বা বর্ণনা, যা কাব্যিক, সুন্দর এবং প্রায়শই পরাবাস্তব। এ কথা সত্যি যে, কিছু স্বপ্ন বিস্তৃত দৃশ্যকল্প, কিছু ভ্রমণ সম্পর্কিত, কিছু পরিবার সম্পর্কে, কিছু স্বপ্ন মৃতদের ফিরিয়ে এনেছে এবং অনেক স্বপ্ন প্রেম সম্পর্কে। তবে অনেক স্বপ্নই দুঃস্বপ্নের কাছাকাছি নিয়ে যায়।

দ্য ড্রিমস্ ইনক্লুডিং ড্রিমস্ অব ডিপারচার গ্রন্থ থেকে বাছাই করা বৈচিত্র্যময় দশটি খুদে গল্প (দ্য ড্রিমস থেকে ছয়টি এবং ড্রিমস্ অব ডিপারচার থেকে চারটি) প্রকাশিত হলো।

স্বপ্ন ১০
আমাদের বন্ধুত্ব এবং একই সঙ্গে বেড়ে ওঠার স্মৃতি আমাদের সবাইকে এখানে এনে হাজির করেছে। এই সরু গলিতে বড় হওয়ার সুবাদে গলির সঙ্গে আমাদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। রাতের অন্ধকার যখন আমাদের মধ্যে নেমে আসত, তখন সমবেত হয়ে আনন্দ-ফুর্তি করা, হাসি-ঠাট্টার কাছে নিজেদের আত্মসমর্পণ করা এবং একে অপরকে ছড়ার ভঙ্গিতে কৌতুক বলার প্রতিযোগিতা করা ছাড়া আমাদের আর কোনো কাজ ছিল না।

আবছা অন্ধকারে একটু একটু করে ভূতে পরিণত হওয়ার পরপরই আমরা আমাদের বুদ্ধিদীপ্ত হাস্য-কৌতুক একজন অন্যজনের সঙ্গে আদান-প্রদান করতাম। আমরা প্রত্যেকেই আমাদের কণ্ঠস্বর চিনতাম এবং আমাদের মজাদার প্রতিযোগিতার রস আস্বাদন করার সময় থামতাম না। আমাদের হাসির শব্দ চারপাশের চার দেয়ালে গিয়ে প্রতিধ্বনিত হতো এবং যারা ঘুমিয়ে থাকতেন, তাদের জাগিয়ে তুলত। আমরা একে অপরের কাছাকাছি আসার সঙ্গে সঙ্গে গলিটি বিনা প্রতিবাদে পরাজয় মেনে নিত। তখন আমাদের ঘিরে থাকা অন্ধকার মিলিয়ে যেতে ব্যর্থ হতো। এ-সমস্ত ঘটনা ঘটার সময় আমরা যেমন ছিলাম, তেমনই থাকতাম, যতক্ষণ না বিভ্রান্তি আমাদের আনন্দকে বাধা দিত এবং আমরা ভাবতে শুরু করতাম যে, আমরা আমাদের আনন্দঘন সন্ধ্যাটি অন্য কোথাও শেষ করতে পারি কিনা- সম্ভবত কোনো চত্বরে কিংবা কোনো প্রধান সড়কের পাশে।

আমাদের মধ্যে একজন ফারাও রাণীর গল্প বলত, যে রাণী তার স্বামীকে হত্যা করে পুরোহিতদের উপর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন। তিনি পুরোহিতদের এক জায়গায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন- যেখানে আমরা এখন আনন্দ করছি- তখন সেখানে পানির স্রোত এসে তাদের পরাস্ত করেছিল। অভূতপূর্ব শক্তিতে যখন আকাশ আমাদের সামনে খুলে গিয়েছিল, তখনো বন্ধুটি তার গল্প বলা শেষ করতে পারেনি। তুমুল ঝড়ের সঙ্গে বজ্রপাত আমাদের স্থবির করে দিয়েছিল, যতক্ষণ না বৃষ্টির পানি আমাদের পা ঢেকে গিয়েছিল এবং আমাদের গরু বাছুরগুলো হামাগুড়ি দিচ্ছিল। একসময় সবাই অনুভব করি যে, আমরা রাতের আঁধারে বৃষ্টির অথই পানিতে ডুবে যাচ্ছি। তখন আমরা সব কৌতুক আর হাসির কথা ভুলে যাই।

আমাদের কোনো আশা-ভরসা নেই- যদি না আমরা মহাশূন্যে উড়াল দেই।

স্বপ্ন ১৪
আমি নীল নদের সবুজ তীর ঘেঁষে হেঁটে যাচ্ছিলাম। চাঁদ আর নীল নদের জলরাশির মধ্যে গোপন কথোপকথন চলতে থাকায় রাত্রি স্যাঁতসেঁতে হয়ে উঠেছিল এবং জলরাশির উপর উজ্জ্বল আলোকরশ্মি ঢেউ খেলছিল। আমার আত্মা আব্বাসিয়ার গন্ধে ঘুরে বেড়াচ্ছিল এবং প্রেম-ভালোবাসা আর জুঁই ফুলের ঘ্রাণে ছিল পরিপূর্ণ।

আমাকে মাঝেমধ্যে যে প্রশ্নটি তাড়া করে বেড়াচ্ছিল, তা নিয়ে আমি বিতর্ক শুরু করি- কেন তিনি মারা যাওয়ার পর স্বপ্নের মাঝে একবারও আমার কাছে আসেননি, অন্তত এটা নিশ্চিত করার জন্য যে, আমার জীবনে তিনি ছিলেন বাস্তব, নিছক কৈশোরের কল্পনা নয় সত্যি কি তাঁর ছবি আসলেই আমার মনে গেঁথে গেছে তারপর অন্ধকার রাস্তার দিক থেকে ভেসে আসা গানের সুরের সঙ্গে ভূতের আবির্ভাব ঘটে এবং তারা যেদিকে যাচ্ছিল, সেই দিকের প্রথম বাতির আলোয় তাদের রূপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমি বিস্মিত হয়ে দেখলাম, পিতলের বাদ্যযন্ত্রটি আমার কাছে অপরিচিত ছিল না- আমি আমার যৌবনে প্রায়শই শুনেছি, কারণ বাদ্যযন্ত্রটি অন্ত্যেষ্টি যাত্রার সময় বাজানো হতো, যা আমার প্রায় মুখস্থ ছিল।

তবে সত্যিকারের আনন্দের দৈব মিল ছিল সংগীতশিল্পীদের পেছনে আমার প্রয়াত প্রিয়তমার হাঁটার দৃশ্য: যা অবশ্যই তাঁর লাবণ্যময় চেহারা, তাঁর পদক্ষেপ এবং তাঁর পরিমার্জিত মুখের সঙ্গে মিলে গিয়েছিল। অবশেষে তিনি আমার সঙ্গে দেখা করে আমাকে আশীর্বাদ করেছিলেন। অন্ত্যেষ্টি যাত্রা থেকে বেরিয়ে তিনি আমার সামনে দাঁড়িয়েপ্রমাণ করেন যে, জীবনের সব কিছুই বৃথা যায়নি। নিঃশ্বাস বন্ধ করে আমি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আমার প্রাণের সমস্ত শক্তি দিয়ে তাঁর দিকে ছুটে যাই এবং মনে মনে বললাম যে, এই সেই সুবর্ণ সুযোগ- আমার হৃদয়ের প্রিয়তমাকে স্পর্শ করার- যা আর কখনো আসবে না।

তাঁর দিকে এক পা এগিয়ে গিয়ে আমি তাকে কোলে তুলে নিই- তারপরই কিছু একটা ভাঙার খসখস আওয়াজ শুনতে পেলাম। তাঁর পোশাকটি যেন ফাঁকা জায়গা ঢেকে রেখেছিল- এবং আমি তা আবিষ্কার করার সঙ্গে সঙ্গেই আশ্চর্য মাথাটি মাটিতে পড়ে এবং ক্রমশ গড়িয়ে নদীতে পড়ে যায়। ঢেউ ‘নীল নদের গোলাপ’-এর মতো তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়- আর আমাকে অনন্ত দুঃখের মাঝে ফেলে রাখে।

স্বপ্ন ২৭
সমুদ্র পাড়ি দেওয়া এক জাহাজে সারিবদ্ধভাবে ছিল নানান বর্ণের এবং বিভিন্ন ভাষার মানুষ। আমরা আশা করছিলাম যে, বাতাস অত্যন্ত দ্রুত গতিতে এসে আঘাত করবে এবং যখন ঘটনা ঘটেছিল, তখন উত্তাল তরঙ্গের আড়ালে দিগন্ত অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। আমি ভয় পেয়েছি: প্রত্যেক মানুষই আতঙ্কিত হয়েছিল। গহীন সমুদ্রে নিজেকে একা মনে হয়েছিল। আমার অভ্যন্তরের ভয় আমাকে বলেছিল যে, সবদিক থেকে তেড়ে আসা বিপদ থেকে বাঁচার কোনো পথখোলা নেই- যদি না ঘটনাটি সত্যিই শুধু কোনো দুঃস্বপ্ন হয়- যা আমার জ্বরের ঘোরে বিছানায় জেগে থাকার জন্য এলোমেলো হয়ে যায়।

বাতাস ক্রমশ হিংস্র হতে থাকে এবং ঢেউয়ের প্রচ- ধাক্কায় নৌকাটি এদিক-ওদিক দুলতে শুরু করে। হঠাৎ তাকিয়ে দেখি আমার সামনেই আমার অঙ্কের শিক্ষক হামজা এফেন্দি বেতের লাঠি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন আমি আমার বাড়ির কাজ করেছি কিনা। যদি আমি তা না করতাম, তাহলে তিনি আমার হাতের আঙুলের গিরায় দশবার আঘাত করতেন- যার জন্য গিরার মনে হতো যে, বেতের লাঠির বদলে গরম লোহা দিয়ে তাকে আঘাত করেছে। সেই দিনগুলোর স্মৃতি মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার ঘৃণা বাড়তে থাকে।

আমি তাঁর ঘাড় চেপে ধরতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ভয় পাচ্ছিলাম যে, কোনো ধরনের নড়াচড়া আমার মৃত্যুর কারণ হতে পারে। তাই গলা শুকিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও আমি আমার অপমানের কথা না বলে বরং গিলে ফেলি। আমি আমার প্রিয়তমাকে দেখে বিভ্রান্ত দর্শকদের মধ্য দিয়ে আমার পথ তৈরি করে তাঁর দিকে ছুটে যাই। কিন্তু তিনি আমাকে চিনতে না পেরে বিরক্তি প্রকাশ করেন এবং মুখ ফিরিয়ে নেন। তারপর তিনি দৌড়ে নৌকার কিনারায় গিয়ে ঝড়-তুফানের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন- আমি ভেবেছি তিনি আমাকে মুক্তির পথ দেখাচ্ছেন। তাই আমি হোঁচট খেয়ে নৌকার পাশ দিয়ে ছুটে যাচ্ছিলাম, কিন্তু বৃদ্ধ গণিতের শিক্ষক তাঁর বাঁশের লাঠি উঁচিয়ে আমার পথ আগলে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

স্বপ্ন ৪০
সন্ধ্যার দিকে আমি গায়ে কোট আর গলায় স্কার্ফ জড়িয়ে বাসায় ফিরছিলাম। সেই সময় এক যুবক এবং অসাধারণ সুন্দরী ও দুঃখী এক মেয়ে আমাকে অতিক্রম করে চলে যাচ্ছিল। তারা আমার কাছে চাঁদা চেয়েছিল। তাই আমি কিছু খুচরা পয়সার জন্য আমার পকেটে হাত ঢুকাই। কোনো খুচরা পয়সা না পেয়ে আমি পাঁচ পাউন্ডের একটা নোট বের করি এবং ছেলেটিকে নিকটস্থ কিয়স্কে গিয়ে আমার জন্য চকোলেট কিনে আনতে বলি এবং যা অবশিষ্ট থাকে, সে যেন তা নিজের কাছে রেখে দেয়।

ছেলেটি আমার দৃষ্টির সীমানা পেরিয়ে না যেতেই মেয়েটি কাঁদতে শুরু করে এবং কান্নার মাঝেই স্বীকার করে বলল যে, তার ভাই তার সঙ্গে অত্যন্ত কঠোর আচরণ করেছে, এমনকি তাকে খারাপ কাজ করতে বাধ্য করেছে এবং প্রতিদিন সে আরও বেশি বিপথগামী ও খারাপ হয়ে উঠছে। মেয়েটি সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে যে, তিনি যেন তাকে তার অগ্নিপরীক্ষা থেকে উদ্ধার করেন।

আমি আবেগাপ্লুত ও বিব্রত বোধ করি, কিন্তু পরে বুঝতে পারলাম যে, ছেলেটি আর ফিরে আসবে না। আমি আরও বুঝতে পারি যে, আমি ভীষণ বোকা এবং অপরিচিত ছেলেটির উপর আস্থা রেখেছি। আমি ভাবছিলাম যে, আমার পরিবার কীভাবে আমাকে ভালো স্বভাব ও বেপরোয়া জীবনযাপনের জন্য অভিযুক্ত করবে। এসব ভাবনা-চিন্তার পরেও আমি ছেলেটির বোনকে তার কাছে রেখে যাইনি, বরং আমার পরিবারের সঙ্গে তার নতুন জীবন শুরু করার জন্য তাকে আমার বাড়িতে নিয়ে যাই। তার অবস্থার এতটাই উন্নতি হয়েছিল যে, তাকে আমাদের চাকরের চেয়ে বরং আমাদেরই পরিবারের একজন বলে মনে হয়েছে।

তারপর একদিন একজন পুলিশ আসে। পুলিশের সঙ্গে মেয়েটির ভাই ছিল। বোনকে দেখামাত্র সে ধরে ফেলে। আমি জানতে পারি যে, আমাকে থানায় যেতে হবে- যেখানে আমার বিরুদ্ধে মেয়েটিকে ধর্ষণ করার এবং তাকে আমার বাড়িতে রাখার অভিযোগ আনা হবে। আমি হতবাক হয়ে মেয়েটিকে কথা বলতে বললাম। মেয়েটি কাঁদছিল এবং আমাকে এমন অপরাধের জন্য অভিযুক্ত করে, যা আমি কখনো কল্পনা করতে পারিনি। আমার চোখের সামনে পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যায় এবং সরকারিপ্রতিবেদনে প্রতিটি বিষয় উল্লেখ করা হয়।

আমার বিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও আমার অবস্থানের বিপদ আমাকে এড়িয়ে যেতে দেয়নি।

স্বপ্ন ৮০
আমরা পুরনো আমলের একটা ঘরে সমবেত হয়েছি: আমার মা, আমার চার বোন এবং আমি। দরজা বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা অতীতের সময় এবং আমাদের পরিচিত লোকজন সম্পর্কে অভিযোগ শুরু করি।

আমার মা শঙ্কিত হয়ে আমার দিকে ফিরে তাকান এবং শপথ করে বলেন যে, তিনি যা কিছু করেছেন কিংবা বলেছেন, তা মায়ের বিশুদ্ধতম ভালোবাসা থেকেই হয়েছে।

যাহোক, মায়ের কথা শেষ হওয়ার পরপরই আওয়াজ ওঠে, ‘তাই যদি সত্যি হয়, তাহলে ঘটনা আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন’

ধমকের সুরে মা জবাবে বললেন, ‘তোমাদেরও নিজেদের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। তবে আমাকে বলার চেষ্টা করো না যে, সবই পূর্বে লিখিত এবং আদেশ।’

স্বপ্ন ৮৪
স্বপ্নে দেখি আমি ভালোবাসার সড়কে দাঁড়িয়ে আছি, যেমনটা আমি আমার আশাবাদী তরুণ বয়সে বলতাম। স্বপ্নে দেখি বিশাল বাড়ি এবং প্রস্ফুটিত ফুলবাগানের মাঝে সুগন্ধি হাওয়ায় আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি। কিন্তু কোথায় আমার আরাধনার প্রাসাদ ছিল কোনো হদিশ ছাড়াই হারিয়ে গেছে এবং ফাঁকা জায়গাটি দখল করেছে মসজিদ, যার আকৃতি রাজকীয়, দারুণ কারুকাজ এবং রয়েছে সবচেয়ে উঁচু ও সবার থেকে সুন্দর মিনার। আমি রীতিমতো হতবাক। আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার সময় মুয়াজ্জিন সূর্যাস্তের নামাজের আজান শুরু করেন। আমি আর দেরি না করে মসজিদে যাই এবং মুসল্লিদের সঙ্গে নামাজ আদায় করি। নামাজ শেষ হলে আমি এমনভাবে আস্তে আস্তে এগোতে থাকি, যেন বেরিয়ে যেতে আমার ইচ্ছে করছে না। তাই বেরিয়ে যাওয়ার সময় দরজার কাছে আমিই ছিলাম শেষ ব্যক্তি। সেখানে আমি আবিষ্কার করি যে, আমার জুতা হারিয়ে গেছে এবং পরে আমাকে নিজের পথ নিজেই খুঁজে বের করতে হয়েছিল।

স্বপ্ন ১০৫
আমাদের মহল্লার সব পুরুষ আবদুহ চাচার সেলুনে তাদের ক্ষৌর কাজ সেরে নেয়- কাউন্টারের পেছনে বসা নাছোরবান্দা মহিলা তাদের টেনে নিয়ে যায়। আমরা সবাই আর্থিকভাবে নিজেদের উন্নত করতে চাই, তাই নিজেদের সুন্দর দেখানোর জন্য প্রতিদিন সকালে আমাদের দাড়ি ছাঁটাই করতে হয়।

আমি একদিন রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম। দিনটি ছিল পরিষ্কার এবং সুন্দর। সেই সময় আবদুহ চাচার দোকানের সুন্দরী আমার কাছাকাছি আসে। আমাকে ঘুরতে হয় এবং তার দিকে তাকাতে হয়। হঠাৎ তিনি আমার দিকে তার জিভ বের করেন- তারপর, ঠিক তত তাড়াতাড়ি, তার মুখটি মোটা কাঠের টুকরোতে রূপান্তরিত হয়ে যায়।

আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার কাছ থেকে পালিয়ে যাই। যাওয়ার সময় আমার ঠোঁটের ফাঁকে প্রচ- হাসির ঢেউ খেলে যায়। যেদিক থেকে সুন্দরী এসেছিল, আমি সেদিকে উঁকি মেরে দেখতে পেলাম সুন্দরী তার মালিকের বাহু বন্দি হয়ে আনন্দ আর উল্লাসে মগ্ন রয়েছে।

স্বপ্ন ১৫৮
মন্ত্রী মহোদয় আমাকে প্রদর্শনীর প্রস্তুতির জন্য মন্ত্রণালয়ের চারুকলার গুদামঘরের পরিদর্শনের দায়িত্ব অর্পণ করেন। ধুলাবালি পরিষ্কার করতে এবং কীটপতঙ্গ মারার জন্য আমার সঙ্গে ছিল একদল সাহায্যকারী। আমরা কাপড়ে মোড়ানো একটি বড় চিত্রকর্ম চোরা চোখে পর্যবেক্ষণ করি।

একসময় মোড়ানো কাপড় টেনে খুলে ফেলি এবং সেখানে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসা সা’দ জগলুলের প্রতিকৃতি। তিনি বেতের লাঠির মাথায় হাত রেখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। যেই নেতার দেশপ্রেমের পাঠশালায় আমি বড় হয়েছি, সেই নেতার অবহেলা দেখে আমার কাছে মনে হয়েছিল ছবিটা জীবন্ত। তাঁর চোখ পিটপিট করছে এবং তিনি তাকিয়ে আছেন। একসময় তাঁর হাত হাঁটার লাঠির উপর স্থির হয়ে যায় এবং তিনি এক অতুলনীয় মহিমায় জ্বলজ্বল করতে থাকেন।

এক মুহূর্তেই সেখানে পাশার প্রজন্মের লোকদের ভিড় দেখা যায়। সবাই তাকে অভিবাদন জানাতে এবং তারা যেসব নিপীড়ন সহ্য করেছে, তার অভিযোগ করতে সেখানে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রীর কাজের হুকুম ভুলে যাই, যার জন্য গুদামঘরে এসেছি।

তার পরিবর্তে আমি তাদের শ্রদ্ধা জানাতে আসা বৃহত্তম দলের সঙ্গে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াই- যে দলের নেতা মুস্তাফা আল-নাহাস।

স্বপ্ন ১৮৮
আমি শাইখ জাকারিয়া আহমদের সঙ্গে পাহাড়ের দিকে হাঁটছিলাম। পাহাড়টি প্রস্ফুটিত ফুলে ঢাকা ছিল। বাগানের মাঝে উম্মে কুলসুম শিল্পকলার লোকদের এক প্রতিনিধি দলের সঙ্গে দাঁড়িয়েছিলেন। সেই দলে ছিলেন আল-হামুলি, উসমান, আল-মানিয়ালাবি, আবদুল হাই হিলমি, সাইয়্যেদ দারবিশ, মুহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব, মুনিরা আল-মাহদিয়া, ফাতিয়া আহমদ এবং লায়লা মুরাদের মতো স্বনামধন্য সঙ্গীত শিল্পীরা।

উম্মে কুলসুম গান গেয়েছেন:

ভোরের আলো ফোটার আগেই গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম আমি।

তিনি একের পর এক গান পরিবেশন করেন, যতক্ষণ না পর্যন্ত আমাদের মধ্যে উদ্বিগ্নতা বেড়ে ওঠে। তারপর আওয়াজ ক্রমশ ফিকে হতে থাকে এবং একসময় পুরোপুরি থেমে যায়।

পরবর্তীতে সঙ্গীত পরিবেশন করেন মুনিরা আল-মাহদিয়া:

যে রাতে তুমি এসেছিলে

মুনতাজার কাছে,

আমরা সবে মাত্র আসন গ্রহণ করেছি,

আমাদের হাতে পেয়ালা,

কবে, আহা!

সেই দিন এসে গেল।

মুনিরা আল-মাহদিয়ার পরে গান পরিবেশন করেন সাইয়্যেদ দারবিশ:

প্রতি বছর একবার আমাকে দেখে যেও, চিরকালের জন্য কাউকে ত্যাগ করা ভুল!

তাঁর গান শেষ হলে শাইখ জাকারিয়া শুরু করেন:

পুরনো ঘনিষ্ঠ হয় সুন্দর অতীত থেকে, যদি তুমি ফিরে আসতে পারো।

আর আমি তাদের সবার উদ্দেশ্যে সুরা ফাতিহা পাঠ করি।

স্বপ্ন ১৯৫
আমি ছোট্ট টেবিলটি ভালো এবং সুস্বাদু খাবার দিয়ে সাজিয়েছি। একসময় দরজার ঘণ্টা বেজে ওঠে। আমি দরজা খুলি এবং আমার বান্ধবী ঘরে ঢুকে সোফায় গা এলিয়ে দেন। তিনি বসার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর মাথা কুশনের উপর ঝুঁকে পড়ে এবং তাঁর হাত দুটি যেন অবশ হয়ে যায়। আমি তাঁর গালে আলতো করে চাটি মারি এবং তাঁর কব্জিতে আঙুল চেপে নাড়ির স্পন্দন অনুভব করি।

‘হে সৃষ্টিকর্তা!’ আমি ভয় আর আতঙ্কে কাঁদতে শুরু করি। ‘তিনি মারা গেছেন!’

ইতোমধ্যে আমি অপরাধ এবং দুর্নাম-কেলেঙ্কারির ভূত দেখতে পেয়েছি। তাই আমি তাঁকে নিজের হাতে ধরে রান্নাঘরে নিয়ে যাই এবং তাঁকে জানালা গলিয়ে বাইরে ফেলে দেই। জানালার মুখ ছিল ভবনের সিঁড়ির দিকে। তারপর আমি সেখানে দাঁড়িয়ে থাকি, আমার মাথা থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত কাঁপতে থাকে।

সকালের পরিপূর্ণ আলোয় আমাকে কয়েকজন ভাড়াটিয়ার সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় এবং সেখানে আমাদের বাড়িওয়ালাও ছিলেন, যিনি আমাদের সঙ্গে সেই মহিলার বিষয়ে কথা বলছিলেন। মহিলাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

‘তিনি মারা গেছেন’, আমি বললাম।

‘না’, জবাবে বাড়িওয়ালা বললেন: ‘ডাক্তার আমাকে বলেছেন, আশা আছে যে মহিলাকে বাঁচানো যাবে এবং আইনজীবী তার সঙ্গে কথা বলার জন্য সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করছেন।’

অপরাধ এবং দুর্নাম-কেলেঙ্কারির ভূত আবারও আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

ছবি

সম্পত্তি বিতর্ক: কেন পদত্যাগ করতে হলো টিউলিপ সিদ্দিককে

ছবি

রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা ফেব্রুয়ারিতে

ছবি

মধুসূদনের সাহিত্যে নৈরাশ্যবাদ

ছবি

বিদূষী নবনীতা বনাম মানুষ নবনীতা

ছবি

দুটি অণুগল্প

ছবি

উপমা-চিত্রে দ্যোতনার সঞ্চারণ

সাময়িকী কবিতা

ছবি

প্রয়োজনে ডাক দিও

ছবি

মাকারিও

ছবি

আমার সহযাত্রী

ছবি

একটি ভাঙ্গা থালা

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের কবিতা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

বাদশা আকবর

ছবি

নগুগি ওয়া থিয়াঙ্গ’ও প্রতিরোধ এবং পুনর্জাগরণের প্রতীক নগুগি ওয়া থিয়াঙ্গ’ও

ছবি

সাহিত্যের ভবিষ্যৎ

ছবি

হৃদয় প্রক্ষালক কবি বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

ছবি

বহুবাচনিকতা ও শিল্পের নন্দন

ছবি

সেদিন দু’দ- এই বাংলার তীর

ছবি

বিকল্প জীবন

সাময়িকী কবিতা

ছবি

হার না মানা নারী জীবনের উপাখ্যান

ছবি

কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা

ছবি

‘যে-কোনো দেশে ভাল সাহিত্য-অনুবাদক খুব কম’

ছবি

দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড-এর কবি এলিয়ট

ছবি

আর এক সুন্দর সকালবেলায়

ছবি

আবার নরকুম্ভির ও মডার্নিজম

ছবি

আত্মজীবনীর আত্মপ্রকাশ প্রসঙ্গে

ছবি

আসাদের অঙ্ক

ছবি

র্যাঁবোর কবিতায় প্রতীকী জীবনের ছায়া

ছবি

ভাষা সংস্কৃতি সাক্ষরতা

ছবি

হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতার আভিজাত্য

ছবি

চেশোয়া মিওশ-এর কবিতা

ছবি

সিলভিয়া প্লাথের মৃত্যু, নিঃসঙ্গতা ও আত্মবিনাশ

ছবি

সমসাময়িক মার্কিনি ‘সহস্রাব্দের কণ্ঠস্বর’

সাময়িকী কবিতা

tab

সাময়িকী

নাগিব মাহফুজের নির্বাচিত ১০ স্বপ্ন

ভূমিকা ও অনুবাদ : ফজল হাসান

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫

আত্মজীবনীমূলক খুদে গল্প

ভূমিকা
নোবেল বিজয়ী মিশরীয় কথাসাহিত্যিক নাগিব মাহফুজ সুদীর্ঘ সত্তর বছরের সাহিত্যিক জীবনে ৩৫টি উপন্যাস (যেগুলোর বিষয়বস্তুর পরিসীমা বিস্তর, যেমন প্রাচীন মিশরীয় ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনা, চরিত্র এবং পৌরাণিক কাহিনী থেকে শুরু করে আধুনিক মিশরের সমসাময়িক জীবন, বিশেষ করে কায়রোর সামাজিক বাস্তবতা), প্রায় ৩৫০টি ছোটোগল্প (১৬টি গল্প গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত), পাঁচটি নাটক এবং ২৫টি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য রচনা করেন। তিনি আরব বিশ্বের প্রথম সাহিত্যিক, যিনি ১৯৮৮ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

অন্ধ মিশরীয় ধর্মীয় নেতা ওমর আবদেল-রহমানের নির্দেশে এক ইসলামপন্থী জঙ্গি ১৯৯৪ সালের ১৪ অক্টোবর সুইচব্লেড দিয়ে নাগিব মাহফুজের গলায় ও ঘাড়ে আঘাত করে। সেই অতর্কিত আক্রমণ, যা তাঁর ডান হাত এবং হাতকে নিয়ন্ত্রণ করে এমন সব স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল, তাঁকে চার বছরেরও বেশি সময় ধরে লেখা থেকে বিরত রেখেছিল। তিনি শুধু সেই দুঃস্বপ্নের অপরাধ থেকে বেঁচে যাননি, বরং তিনি ২০০৬ সালের ৩০ আগস্ট ৯৪ বছর বয়সে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন তৈাঁর স্বপ্নের কথা বলার জন্য। সেসব স্বপ্ন তিনি অবিরামভাবে নিজের হাতে এবং ডিকটেশনের মাধ্যমে লিপিবদ্ধ করেন, যা প্রথমে কায়রোর দৈনিক খবরের কাগজে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় এবং পরে আত্মজীবনীমূলক দুটি আলাদা গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে: দ্য ড্রিমস (২০০০) এবং ড্রিমস অব ডিপারচার (২০০৪)। গ্রন্থ দুটি আরবি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন রেমন্ড স্টক। পরবর্তীতে (২০০৯ সালে) অনুবাদক গ্রন্থ দুটি একত্র করে দ্য ড্রিমস্ ইনক্লুডিং ড্রিমস্ অব ডিপারচার শিরোনামে প্রকাশ করেন। এই সম্মিলিত গ্রন্থে সব মিলিয়ে ২১২টি স্বপ্ন রয়েছে। দ্য ড্রিমস অংশে রয়েছে ১০৪টি স্বপ্ন এবং ড্রিমস্ অব ডিপারচার অংশে রয়েছে ১০৮টি স্বপ্ন। এই স্বপ্নগুলো বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে, যেমন অতি ক্ষুদ্র ছোটোগল্প, ন্যানোনোভেলা, ভিগনেট (চরিত্রচিত্র) এবং স্কেচ (নকশা)। উল্লেখ্য, স্বপ্নগুলোর কোনো শিরোনাম নেই, তবে ক্রমিক সংখ্যা দিয়ে সাজানো হয়েছে।

দ্য ড্রিমস্ ইনক্লুডিং ড্রিমস্ অব ডিপারচার গ্রন্থের সবগুলো গল্পে লেখক স্বপ্নের সঙ্গে তাঁর রাত্রিকালীন চিন্তা ও চেতনার সম্পর্ক স্থাপন করেছেন, যেখানে স্বপ্নের বুনট একটি মাত্র আবেগকে, যেমন লজ্জা, আশা, ভয় ও ভালবাসা, ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। স্বপ্নগুলো লেখকের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তাঁর জীবনকে গৌরব ও উদ্বেগ, আনন্দ এবং অতৃপ্তি দিয়ে পূর্ণ করেছে। তবে লেখক কেবল আবেগ বর্ণনা করেননি, বরং তিনি ছোটো পরিসরে কাজ করে পাঠককে স্বপ্নদ্রষ্টার বাস্তবতা ভাগ করে নিতে এবং কোমল অনুভূতিকে অনুভব করতে বাধ্য করেছেন। বলা হয়, গ্রন্থ দুটিতে লেখক তাঁর গল্প লেখার কলাকৌশল ও শিল্পকে গল্পের সবচেয়েপ্রয়োজনীয়স্তরে পৌঁছে দিয়েছেন এবং একই সঙ্গে তিনি অস্বাভাবিক সংক্ষিপ্ত আকারে মহাকাব্যিক গল্প বলার অতুলনীয়ক্ষমতা প্রদর্শন করেছেন। যদিও প্রচলিত অর্থে কোনো গল্পেই আখ্যান (প্লট) নেই, কিন্তু সবগুলো লেখাই সমৃদ্ধ এবং আকর্ষণীয় সংক্ষিপ্ত চরিত্রচিত্র বা বর্ণনা, যা কাব্যিক, সুন্দর এবং প্রায়শই পরাবাস্তব। এ কথা সত্যি যে, কিছু স্বপ্ন বিস্তৃত দৃশ্যকল্প, কিছু ভ্রমণ সম্পর্কিত, কিছু পরিবার সম্পর্কে, কিছু স্বপ্ন মৃতদের ফিরিয়ে এনেছে এবং অনেক স্বপ্ন প্রেম সম্পর্কে। তবে অনেক স্বপ্নই দুঃস্বপ্নের কাছাকাছি নিয়ে যায়।

দ্য ড্রিমস্ ইনক্লুডিং ড্রিমস্ অব ডিপারচার গ্রন্থ থেকে বাছাই করা বৈচিত্র্যময় দশটি খুদে গল্প (দ্য ড্রিমস থেকে ছয়টি এবং ড্রিমস্ অব ডিপারচার থেকে চারটি) প্রকাশিত হলো।

স্বপ্ন ১০
আমাদের বন্ধুত্ব এবং একই সঙ্গে বেড়ে ওঠার স্মৃতি আমাদের সবাইকে এখানে এনে হাজির করেছে। এই সরু গলিতে বড় হওয়ার সুবাদে গলির সঙ্গে আমাদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। রাতের অন্ধকার যখন আমাদের মধ্যে নেমে আসত, তখন সমবেত হয়ে আনন্দ-ফুর্তি করা, হাসি-ঠাট্টার কাছে নিজেদের আত্মসমর্পণ করা এবং একে অপরকে ছড়ার ভঙ্গিতে কৌতুক বলার প্রতিযোগিতা করা ছাড়া আমাদের আর কোনো কাজ ছিল না।

আবছা অন্ধকারে একটু একটু করে ভূতে পরিণত হওয়ার পরপরই আমরা আমাদের বুদ্ধিদীপ্ত হাস্য-কৌতুক একজন অন্যজনের সঙ্গে আদান-প্রদান করতাম। আমরা প্রত্যেকেই আমাদের কণ্ঠস্বর চিনতাম এবং আমাদের মজাদার প্রতিযোগিতার রস আস্বাদন করার সময় থামতাম না। আমাদের হাসির শব্দ চারপাশের চার দেয়ালে গিয়ে প্রতিধ্বনিত হতো এবং যারা ঘুমিয়ে থাকতেন, তাদের জাগিয়ে তুলত। আমরা একে অপরের কাছাকাছি আসার সঙ্গে সঙ্গে গলিটি বিনা প্রতিবাদে পরাজয় মেনে নিত। তখন আমাদের ঘিরে থাকা অন্ধকার মিলিয়ে যেতে ব্যর্থ হতো। এ-সমস্ত ঘটনা ঘটার সময় আমরা যেমন ছিলাম, তেমনই থাকতাম, যতক্ষণ না বিভ্রান্তি আমাদের আনন্দকে বাধা দিত এবং আমরা ভাবতে শুরু করতাম যে, আমরা আমাদের আনন্দঘন সন্ধ্যাটি অন্য কোথাও শেষ করতে পারি কিনা- সম্ভবত কোনো চত্বরে কিংবা কোনো প্রধান সড়কের পাশে।

আমাদের মধ্যে একজন ফারাও রাণীর গল্প বলত, যে রাণী তার স্বামীকে হত্যা করে পুরোহিতদের উপর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন। তিনি পুরোহিতদের এক জায়গায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন- যেখানে আমরা এখন আনন্দ করছি- তখন সেখানে পানির স্রোত এসে তাদের পরাস্ত করেছিল। অভূতপূর্ব শক্তিতে যখন আকাশ আমাদের সামনে খুলে গিয়েছিল, তখনো বন্ধুটি তার গল্প বলা শেষ করতে পারেনি। তুমুল ঝড়ের সঙ্গে বজ্রপাত আমাদের স্থবির করে দিয়েছিল, যতক্ষণ না বৃষ্টির পানি আমাদের পা ঢেকে গিয়েছিল এবং আমাদের গরু বাছুরগুলো হামাগুড়ি দিচ্ছিল। একসময় সবাই অনুভব করি যে, আমরা রাতের আঁধারে বৃষ্টির অথই পানিতে ডুবে যাচ্ছি। তখন আমরা সব কৌতুক আর হাসির কথা ভুলে যাই।

আমাদের কোনো আশা-ভরসা নেই- যদি না আমরা মহাশূন্যে উড়াল দেই।

স্বপ্ন ১৪
আমি নীল নদের সবুজ তীর ঘেঁষে হেঁটে যাচ্ছিলাম। চাঁদ আর নীল নদের জলরাশির মধ্যে গোপন কথোপকথন চলতে থাকায় রাত্রি স্যাঁতসেঁতে হয়ে উঠেছিল এবং জলরাশির উপর উজ্জ্বল আলোকরশ্মি ঢেউ খেলছিল। আমার আত্মা আব্বাসিয়ার গন্ধে ঘুরে বেড়াচ্ছিল এবং প্রেম-ভালোবাসা আর জুঁই ফুলের ঘ্রাণে ছিল পরিপূর্ণ।

আমাকে মাঝেমধ্যে যে প্রশ্নটি তাড়া করে বেড়াচ্ছিল, তা নিয়ে আমি বিতর্ক শুরু করি- কেন তিনি মারা যাওয়ার পর স্বপ্নের মাঝে একবারও আমার কাছে আসেননি, অন্তত এটা নিশ্চিত করার জন্য যে, আমার জীবনে তিনি ছিলেন বাস্তব, নিছক কৈশোরের কল্পনা নয় সত্যি কি তাঁর ছবি আসলেই আমার মনে গেঁথে গেছে তারপর অন্ধকার রাস্তার দিক থেকে ভেসে আসা গানের সুরের সঙ্গে ভূতের আবির্ভাব ঘটে এবং তারা যেদিকে যাচ্ছিল, সেই দিকের প্রথম বাতির আলোয় তাদের রূপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমি বিস্মিত হয়ে দেখলাম, পিতলের বাদ্যযন্ত্রটি আমার কাছে অপরিচিত ছিল না- আমি আমার যৌবনে প্রায়শই শুনেছি, কারণ বাদ্যযন্ত্রটি অন্ত্যেষ্টি যাত্রার সময় বাজানো হতো, যা আমার প্রায় মুখস্থ ছিল।

তবে সত্যিকারের আনন্দের দৈব মিল ছিল সংগীতশিল্পীদের পেছনে আমার প্রয়াত প্রিয়তমার হাঁটার দৃশ্য: যা অবশ্যই তাঁর লাবণ্যময় চেহারা, তাঁর পদক্ষেপ এবং তাঁর পরিমার্জিত মুখের সঙ্গে মিলে গিয়েছিল। অবশেষে তিনি আমার সঙ্গে দেখা করে আমাকে আশীর্বাদ করেছিলেন। অন্ত্যেষ্টি যাত্রা থেকে বেরিয়ে তিনি আমার সামনে দাঁড়িয়েপ্রমাণ করেন যে, জীবনের সব কিছুই বৃথা যায়নি। নিঃশ্বাস বন্ধ করে আমি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আমার প্রাণের সমস্ত শক্তি দিয়ে তাঁর দিকে ছুটে যাই এবং মনে মনে বললাম যে, এই সেই সুবর্ণ সুযোগ- আমার হৃদয়ের প্রিয়তমাকে স্পর্শ করার- যা আর কখনো আসবে না।

তাঁর দিকে এক পা এগিয়ে গিয়ে আমি তাকে কোলে তুলে নিই- তারপরই কিছু একটা ভাঙার খসখস আওয়াজ শুনতে পেলাম। তাঁর পোশাকটি যেন ফাঁকা জায়গা ঢেকে রেখেছিল- এবং আমি তা আবিষ্কার করার সঙ্গে সঙ্গেই আশ্চর্য মাথাটি মাটিতে পড়ে এবং ক্রমশ গড়িয়ে নদীতে পড়ে যায়। ঢেউ ‘নীল নদের গোলাপ’-এর মতো তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়- আর আমাকে অনন্ত দুঃখের মাঝে ফেলে রাখে।

স্বপ্ন ২৭
সমুদ্র পাড়ি দেওয়া এক জাহাজে সারিবদ্ধভাবে ছিল নানান বর্ণের এবং বিভিন্ন ভাষার মানুষ। আমরা আশা করছিলাম যে, বাতাস অত্যন্ত দ্রুত গতিতে এসে আঘাত করবে এবং যখন ঘটনা ঘটেছিল, তখন উত্তাল তরঙ্গের আড়ালে দিগন্ত অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। আমি ভয় পেয়েছি: প্রত্যেক মানুষই আতঙ্কিত হয়েছিল। গহীন সমুদ্রে নিজেকে একা মনে হয়েছিল। আমার অভ্যন্তরের ভয় আমাকে বলেছিল যে, সবদিক থেকে তেড়ে আসা বিপদ থেকে বাঁচার কোনো পথখোলা নেই- যদি না ঘটনাটি সত্যিই শুধু কোনো দুঃস্বপ্ন হয়- যা আমার জ্বরের ঘোরে বিছানায় জেগে থাকার জন্য এলোমেলো হয়ে যায়।

বাতাস ক্রমশ হিংস্র হতে থাকে এবং ঢেউয়ের প্রচ- ধাক্কায় নৌকাটি এদিক-ওদিক দুলতে শুরু করে। হঠাৎ তাকিয়ে দেখি আমার সামনেই আমার অঙ্কের শিক্ষক হামজা এফেন্দি বেতের লাঠি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন আমি আমার বাড়ির কাজ করেছি কিনা। যদি আমি তা না করতাম, তাহলে তিনি আমার হাতের আঙুলের গিরায় দশবার আঘাত করতেন- যার জন্য গিরার মনে হতো যে, বেতের লাঠির বদলে গরম লোহা দিয়ে তাকে আঘাত করেছে। সেই দিনগুলোর স্মৃতি মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার ঘৃণা বাড়তে থাকে।

আমি তাঁর ঘাড় চেপে ধরতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ভয় পাচ্ছিলাম যে, কোনো ধরনের নড়াচড়া আমার মৃত্যুর কারণ হতে পারে। তাই গলা শুকিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও আমি আমার অপমানের কথা না বলে বরং গিলে ফেলি। আমি আমার প্রিয়তমাকে দেখে বিভ্রান্ত দর্শকদের মধ্য দিয়ে আমার পথ তৈরি করে তাঁর দিকে ছুটে যাই। কিন্তু তিনি আমাকে চিনতে না পেরে বিরক্তি প্রকাশ করেন এবং মুখ ফিরিয়ে নেন। তারপর তিনি দৌড়ে নৌকার কিনারায় গিয়ে ঝড়-তুফানের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন- আমি ভেবেছি তিনি আমাকে মুক্তির পথ দেখাচ্ছেন। তাই আমি হোঁচট খেয়ে নৌকার পাশ দিয়ে ছুটে যাচ্ছিলাম, কিন্তু বৃদ্ধ গণিতের শিক্ষক তাঁর বাঁশের লাঠি উঁচিয়ে আমার পথ আগলে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

স্বপ্ন ৪০
সন্ধ্যার দিকে আমি গায়ে কোট আর গলায় স্কার্ফ জড়িয়ে বাসায় ফিরছিলাম। সেই সময় এক যুবক এবং অসাধারণ সুন্দরী ও দুঃখী এক মেয়ে আমাকে অতিক্রম করে চলে যাচ্ছিল। তারা আমার কাছে চাঁদা চেয়েছিল। তাই আমি কিছু খুচরা পয়সার জন্য আমার পকেটে হাত ঢুকাই। কোনো খুচরা পয়সা না পেয়ে আমি পাঁচ পাউন্ডের একটা নোট বের করি এবং ছেলেটিকে নিকটস্থ কিয়স্কে গিয়ে আমার জন্য চকোলেট কিনে আনতে বলি এবং যা অবশিষ্ট থাকে, সে যেন তা নিজের কাছে রেখে দেয়।

ছেলেটি আমার দৃষ্টির সীমানা পেরিয়ে না যেতেই মেয়েটি কাঁদতে শুরু করে এবং কান্নার মাঝেই স্বীকার করে বলল যে, তার ভাই তার সঙ্গে অত্যন্ত কঠোর আচরণ করেছে, এমনকি তাকে খারাপ কাজ করতে বাধ্য করেছে এবং প্রতিদিন সে আরও বেশি বিপথগামী ও খারাপ হয়ে উঠছে। মেয়েটি সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে যে, তিনি যেন তাকে তার অগ্নিপরীক্ষা থেকে উদ্ধার করেন।

আমি আবেগাপ্লুত ও বিব্রত বোধ করি, কিন্তু পরে বুঝতে পারলাম যে, ছেলেটি আর ফিরে আসবে না। আমি আরও বুঝতে পারি যে, আমি ভীষণ বোকা এবং অপরিচিত ছেলেটির উপর আস্থা রেখেছি। আমি ভাবছিলাম যে, আমার পরিবার কীভাবে আমাকে ভালো স্বভাব ও বেপরোয়া জীবনযাপনের জন্য অভিযুক্ত করবে। এসব ভাবনা-চিন্তার পরেও আমি ছেলেটির বোনকে তার কাছে রেখে যাইনি, বরং আমার পরিবারের সঙ্গে তার নতুন জীবন শুরু করার জন্য তাকে আমার বাড়িতে নিয়ে যাই। তার অবস্থার এতটাই উন্নতি হয়েছিল যে, তাকে আমাদের চাকরের চেয়ে বরং আমাদেরই পরিবারের একজন বলে মনে হয়েছে।

তারপর একদিন একজন পুলিশ আসে। পুলিশের সঙ্গে মেয়েটির ভাই ছিল। বোনকে দেখামাত্র সে ধরে ফেলে। আমি জানতে পারি যে, আমাকে থানায় যেতে হবে- যেখানে আমার বিরুদ্ধে মেয়েটিকে ধর্ষণ করার এবং তাকে আমার বাড়িতে রাখার অভিযোগ আনা হবে। আমি হতবাক হয়ে মেয়েটিকে কথা বলতে বললাম। মেয়েটি কাঁদছিল এবং আমাকে এমন অপরাধের জন্য অভিযুক্ত করে, যা আমি কখনো কল্পনা করতে পারিনি। আমার চোখের সামনে পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যায় এবং সরকারিপ্রতিবেদনে প্রতিটি বিষয় উল্লেখ করা হয়।

আমার বিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও আমার অবস্থানের বিপদ আমাকে এড়িয়ে যেতে দেয়নি।

স্বপ্ন ৮০
আমরা পুরনো আমলের একটা ঘরে সমবেত হয়েছি: আমার মা, আমার চার বোন এবং আমি। দরজা বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা অতীতের সময় এবং আমাদের পরিচিত লোকজন সম্পর্কে অভিযোগ শুরু করি।

আমার মা শঙ্কিত হয়ে আমার দিকে ফিরে তাকান এবং শপথ করে বলেন যে, তিনি যা কিছু করেছেন কিংবা বলেছেন, তা মায়ের বিশুদ্ধতম ভালোবাসা থেকেই হয়েছে।

যাহোক, মায়ের কথা শেষ হওয়ার পরপরই আওয়াজ ওঠে, ‘তাই যদি সত্যি হয়, তাহলে ঘটনা আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন’

ধমকের সুরে মা জবাবে বললেন, ‘তোমাদেরও নিজেদের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। তবে আমাকে বলার চেষ্টা করো না যে, সবই পূর্বে লিখিত এবং আদেশ।’

স্বপ্ন ৮৪
স্বপ্নে দেখি আমি ভালোবাসার সড়কে দাঁড়িয়ে আছি, যেমনটা আমি আমার আশাবাদী তরুণ বয়সে বলতাম। স্বপ্নে দেখি বিশাল বাড়ি এবং প্রস্ফুটিত ফুলবাগানের মাঝে সুগন্ধি হাওয়ায় আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি। কিন্তু কোথায় আমার আরাধনার প্রাসাদ ছিল কোনো হদিশ ছাড়াই হারিয়ে গেছে এবং ফাঁকা জায়গাটি দখল করেছে মসজিদ, যার আকৃতি রাজকীয়, দারুণ কারুকাজ এবং রয়েছে সবচেয়ে উঁচু ও সবার থেকে সুন্দর মিনার। আমি রীতিমতো হতবাক। আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার সময় মুয়াজ্জিন সূর্যাস্তের নামাজের আজান শুরু করেন। আমি আর দেরি না করে মসজিদে যাই এবং মুসল্লিদের সঙ্গে নামাজ আদায় করি। নামাজ শেষ হলে আমি এমনভাবে আস্তে আস্তে এগোতে থাকি, যেন বেরিয়ে যেতে আমার ইচ্ছে করছে না। তাই বেরিয়ে যাওয়ার সময় দরজার কাছে আমিই ছিলাম শেষ ব্যক্তি। সেখানে আমি আবিষ্কার করি যে, আমার জুতা হারিয়ে গেছে এবং পরে আমাকে নিজের পথ নিজেই খুঁজে বের করতে হয়েছিল।

স্বপ্ন ১০৫
আমাদের মহল্লার সব পুরুষ আবদুহ চাচার সেলুনে তাদের ক্ষৌর কাজ সেরে নেয়- কাউন্টারের পেছনে বসা নাছোরবান্দা মহিলা তাদের টেনে নিয়ে যায়। আমরা সবাই আর্থিকভাবে নিজেদের উন্নত করতে চাই, তাই নিজেদের সুন্দর দেখানোর জন্য প্রতিদিন সকালে আমাদের দাড়ি ছাঁটাই করতে হয়।

আমি একদিন রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম। দিনটি ছিল পরিষ্কার এবং সুন্দর। সেই সময় আবদুহ চাচার দোকানের সুন্দরী আমার কাছাকাছি আসে। আমাকে ঘুরতে হয় এবং তার দিকে তাকাতে হয়। হঠাৎ তিনি আমার দিকে তার জিভ বের করেন- তারপর, ঠিক তত তাড়াতাড়ি, তার মুখটি মোটা কাঠের টুকরোতে রূপান্তরিত হয়ে যায়।

আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার কাছ থেকে পালিয়ে যাই। যাওয়ার সময় আমার ঠোঁটের ফাঁকে প্রচ- হাসির ঢেউ খেলে যায়। যেদিক থেকে সুন্দরী এসেছিল, আমি সেদিকে উঁকি মেরে দেখতে পেলাম সুন্দরী তার মালিকের বাহু বন্দি হয়ে আনন্দ আর উল্লাসে মগ্ন রয়েছে।

স্বপ্ন ১৫৮
মন্ত্রী মহোদয় আমাকে প্রদর্শনীর প্রস্তুতির জন্য মন্ত্রণালয়ের চারুকলার গুদামঘরের পরিদর্শনের দায়িত্ব অর্পণ করেন। ধুলাবালি পরিষ্কার করতে এবং কীটপতঙ্গ মারার জন্য আমার সঙ্গে ছিল একদল সাহায্যকারী। আমরা কাপড়ে মোড়ানো একটি বড় চিত্রকর্ম চোরা চোখে পর্যবেক্ষণ করি।

একসময় মোড়ানো কাপড় টেনে খুলে ফেলি এবং সেখানে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসা সা’দ জগলুলের প্রতিকৃতি। তিনি বেতের লাঠির মাথায় হাত রেখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। যেই নেতার দেশপ্রেমের পাঠশালায় আমি বড় হয়েছি, সেই নেতার অবহেলা দেখে আমার কাছে মনে হয়েছিল ছবিটা জীবন্ত। তাঁর চোখ পিটপিট করছে এবং তিনি তাকিয়ে আছেন। একসময় তাঁর হাত হাঁটার লাঠির উপর স্থির হয়ে যায় এবং তিনি এক অতুলনীয় মহিমায় জ্বলজ্বল করতে থাকেন।

এক মুহূর্তেই সেখানে পাশার প্রজন্মের লোকদের ভিড় দেখা যায়। সবাই তাকে অভিবাদন জানাতে এবং তারা যেসব নিপীড়ন সহ্য করেছে, তার অভিযোগ করতে সেখানে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রীর কাজের হুকুম ভুলে যাই, যার জন্য গুদামঘরে এসেছি।

তার পরিবর্তে আমি তাদের শ্রদ্ধা জানাতে আসা বৃহত্তম দলের সঙ্গে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াই- যে দলের নেতা মুস্তাফা আল-নাহাস।

স্বপ্ন ১৮৮
আমি শাইখ জাকারিয়া আহমদের সঙ্গে পাহাড়ের দিকে হাঁটছিলাম। পাহাড়টি প্রস্ফুটিত ফুলে ঢাকা ছিল। বাগানের মাঝে উম্মে কুলসুম শিল্পকলার লোকদের এক প্রতিনিধি দলের সঙ্গে দাঁড়িয়েছিলেন। সেই দলে ছিলেন আল-হামুলি, উসমান, আল-মানিয়ালাবি, আবদুল হাই হিলমি, সাইয়্যেদ দারবিশ, মুহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব, মুনিরা আল-মাহদিয়া, ফাতিয়া আহমদ এবং লায়লা মুরাদের মতো স্বনামধন্য সঙ্গীত শিল্পীরা।

উম্মে কুলসুম গান গেয়েছেন:

ভোরের আলো ফোটার আগেই গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম আমি।

তিনি একের পর এক গান পরিবেশন করেন, যতক্ষণ না পর্যন্ত আমাদের মধ্যে উদ্বিগ্নতা বেড়ে ওঠে। তারপর আওয়াজ ক্রমশ ফিকে হতে থাকে এবং একসময় পুরোপুরি থেমে যায়।

পরবর্তীতে সঙ্গীত পরিবেশন করেন মুনিরা আল-মাহদিয়া:

যে রাতে তুমি এসেছিলে

মুনতাজার কাছে,

আমরা সবে মাত্র আসন গ্রহণ করেছি,

আমাদের হাতে পেয়ালা,

কবে, আহা!

সেই দিন এসে গেল।

মুনিরা আল-মাহদিয়ার পরে গান পরিবেশন করেন সাইয়্যেদ দারবিশ:

প্রতি বছর একবার আমাকে দেখে যেও, চিরকালের জন্য কাউকে ত্যাগ করা ভুল!

তাঁর গান শেষ হলে শাইখ জাকারিয়া শুরু করেন:

পুরনো ঘনিষ্ঠ হয় সুন্দর অতীত থেকে, যদি তুমি ফিরে আসতে পারো।

আর আমি তাদের সবার উদ্দেশ্যে সুরা ফাতিহা পাঠ করি।

স্বপ্ন ১৯৫
আমি ছোট্ট টেবিলটি ভালো এবং সুস্বাদু খাবার দিয়ে সাজিয়েছি। একসময় দরজার ঘণ্টা বেজে ওঠে। আমি দরজা খুলি এবং আমার বান্ধবী ঘরে ঢুকে সোফায় গা এলিয়ে দেন। তিনি বসার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর মাথা কুশনের উপর ঝুঁকে পড়ে এবং তাঁর হাত দুটি যেন অবশ হয়ে যায়। আমি তাঁর গালে আলতো করে চাটি মারি এবং তাঁর কব্জিতে আঙুল চেপে নাড়ির স্পন্দন অনুভব করি।

‘হে সৃষ্টিকর্তা!’ আমি ভয় আর আতঙ্কে কাঁদতে শুরু করি। ‘তিনি মারা গেছেন!’

ইতোমধ্যে আমি অপরাধ এবং দুর্নাম-কেলেঙ্কারির ভূত দেখতে পেয়েছি। তাই আমি তাঁকে নিজের হাতে ধরে রান্নাঘরে নিয়ে যাই এবং তাঁকে জানালা গলিয়ে বাইরে ফেলে দেই। জানালার মুখ ছিল ভবনের সিঁড়ির দিকে। তারপর আমি সেখানে দাঁড়িয়ে থাকি, আমার মাথা থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত কাঁপতে থাকে।

সকালের পরিপূর্ণ আলোয় আমাকে কয়েকজন ভাড়াটিয়ার সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় এবং সেখানে আমাদের বাড়িওয়ালাও ছিলেন, যিনি আমাদের সঙ্গে সেই মহিলার বিষয়ে কথা বলছিলেন। মহিলাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

‘তিনি মারা গেছেন’, আমি বললাম।

‘না’, জবাবে বাড়িওয়ালা বললেন: ‘ডাক্তার আমাকে বলেছেন, আশা আছে যে মহিলাকে বাঁচানো যাবে এবং আইনজীবী তার সঙ্গে কথা বলার জন্য সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করছেন।’

অপরাধ এবং দুর্নাম-কেলেঙ্কারির ভূত আবারও আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

back to top