জোবায়ের মিলন
কবিতার ভেতর কি জীবন দেখা যায় কিংবা যাপনের উপায়-উপাদান সকল সময় না, কোনো কোনো সময় কোনো কবিতার মধ্যমণিমায় এঁকেবেঁকে থাকে অথবা ভেসে থাকে প্রাত্যহিক জীবন ও যাপনের দুর্দান্ত অণুকণাগুলো, যার পরিক্রমা পেরিয়ে যেতে যেতে দেখা যায় কাব্যময়তার অভ্যন্তরে অমিয় এক সুর খেলা করছে শিশু-সারল্যের তুলতুলে পুতুলের মতো কিংবা জীবন্ত প্রাণের অনশ^র স্বরের মতো। আর সে স্বর যখন একক নিস্বন ভেদ করে অনেক নিস্বনে পৌঁছায় তখনই তা আর আমাদের সচরাচরতায় থাকে না, হয়ে যায়- বাঙ্ময় ভাষা; কবিতা যা ধারণ করতেই আরাধনা করে কত কত বছরের ’পর। তারপরও কি কবিতা সবার হাতে ধরা দেয়, সবার হাতের কবিতা কি হয়ে ওঠে কবিতা এখানেই কবি জীবনানন্দ দাশের উক্তি সত্য হয়ে ওঠে, ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।’
তরুণ কবি সঞ্জয় দেওয়ানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জলের ক্যালিগ্রাফি’ পাঠ করার সুযোগ হলো। পাঠে তরুণকে তরুণ মনে হলো না, মনে হলো চিরতরুণ। প্রথম কাব্যগ্রন্থটি প্রথম কাব্যগ্রন্থ মনে হলো না, মনে হলো- অনেক দিনের চষা পথ ধরে চলতে থাকা চাষা। পিতার অথবা পিতামহের হালের পেছন পেছন ছুটতে থাকা তীক্ষè খেয়ালি; যার পঙ্ক্তিতে সময়ই প্রধান। সেই প্রধানে উপমার উপস্থাপন তাকে অন্য অনেক থেকে চিনতে বাধ্য করেছে, টেনে রাখতে বাধ্য করেছে তার কবিতার আঙিনায়। মিথ এসে উজিয়ে পড়ছে কখনো কখনো, তবে বর্তমানকে পেরিয়ে নয়, মিথলজিক শব্দের ব্যবহারে। যেখানে সরলতা এক ভাস্কর্য: ‘মেনেস-এর সময় থেকে দিগভ্রান্ত আমি / কাকে যেন খুঁজি হিরন্ময় নক্ষত্রের কোলে।/ কোথায় খুঁজিনি তাঁকে- গিজার পিরামিড থেকে নীলনদ উপত্যকা কিংবা গঙ্গার কিনারা। / অশ^মেধের যজ্ঞে হয় আমরই পতন- নবসৃষ্টির গালভরা বুলির বর্ণমালায়।/ কেন বারবার পোড়াও, ক্ষতবিক্ষত করো, করো রক্তাক্ত।/ আদিগন্ত নক্ষত্রের কোলে ঘুমায় কেচুয়া নারী/ জন্মান্ধ আমি তাঁর সাথেই মিলি পরম শীৎকারে/ শত পুত্রের ব্যর্থ পিতা হই কালান্তরে।’ (জন্মান্ধের আখ্যান)।
প্রেম-কাম, দ্বেষ-বিদ্বেষ, সাধুতা-হিং¯্রতার স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যজুড়ে যে মানব অবয়ব, যে জীবনপ্রণালী- সে সব বাঁকজুড়ে কবির চুলচেরা বিচরণ প্রত্যক্ষ করায়, ধাবমান পৃথিবীর ধাবমানতায় কবির সচেতন বিচরণের কথা। অন্তরদৃষ্টি দিয়ে প্রতিটি পথে প্রহরীর মতো সজাগ থাকার কথা। কবিও যেন বিপরীত লিঙ্গের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অবগাহনে নাও না ভাসিয়ে পারেন না। তিনিও কখনো কখনো অলৌকিক স্তর থেকে নেমে আসেন মাটির মিম্বরে, মিশে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করেন চির বাঞ্ছার বাহ্যিক বাহতায়, ‘অকৃত্রিম ঢেউ রোজ আছড়ে পড়ে/ নরম বুকের ভঙ্গুর পাড়ে।/ আমাকে ডুবিয়ে দাও- তোমার ফুলে ওঠা সুউচ্চ তরঙ্গে/ আমাকে ভাসিয়ে দাও- তোমার গুপ্ত উষ্ণ প্রসবণ ধারায়।/ গাঙ্গেয় বদ্বীপে পলিমাটির কোমল বিছানায়- রোজ বেড়ে উঠি আমি/ তোমার পেলব আঘাতে শিহরিত হই, আজন্ম কেঁপে উঠি।’ (একদিন পরাশর)।
বিচ্যুতির বিভাবরি কবিকে আজন্মই খ-িত করে, করে চিন্তিত, বিমর্ষিত। তাকে প্রাণিত করে গর্জে উঠতে। শব্দের বারুদে সভ্যতার চিমুনি ভাঙ্গচুরে করে সহায়তা- কবি সঞ্জয় দেওয়ানও ব্যতিক্রম নন, যদিও ব্যতিক্রম তার ধারায়, তার বর্ণনায়, তার পরিবেশনায়- তার চিত্রকল্পের অঙ্কনে, গণিতের গভীরে, ‘কালের নামতায় হারিয়ে যায় প্রেম-অপ্রেম, মোহ, কাম। / আমাদের প্রেমগীত খোদিত আছে ভীমবেটকার গুহাচিত্রে; / ইলোরার গিরিগাত্রে;/ অজন্তার দেয়ালচিত্রে; কামকাতর শিলালিপিতে।/ সময়ের মরুঝড়ে ডুবে যায় যুবতী চাঁদ, ডুবে যায় দ্বারকা নগর কলসমুদ্রে / নিভে যায় আদি প্রেম কুরুক্ষেত্রে। / আমাদের চুম্বন লেগে আছে নর্মদা তীরে, বিন্ধ্যপর্বতে, তক্ষশীলায়, হরপ্পায়। / সময়ের কফিনে জিইয়ে রাখি গার্হস্থ্য প্রেম / অনাগত ফসিলে মুদ্রণ করি কালের অবয়ব।
মোট ৫৬টি কবিতা নিয়ে রচিত ‘জলের ক্যালিগ্রাফি’ প্রতিটি কবিতাতেই উজান ঢলের বাঁশি। প্রতিটি কবিতাতেই চলমানতার প্রতিচ্ছবি আঁকা সুযোগ্য শব্দের প্রতীকী ইশারায়। বোধগম্যতায় কয়েকটি কবিতা টনক নাড়িয়ে দেয়, কয়েকটি কবিতা প্রতীকী ভারে যেন ভারি হয়ে উঠেছে। দু-একটি কবিতায় ক্রিয়া পদের ঈষৎ ভুল প্রয়োগ চোখে পড়ে। কিন্তু ভাবাবেগের প্রয়োগে তেমন খটকা তৈরি না করলেও প্রতিশ্রুতিশীলতার প্রশ্নে নিশ্চয়ই কবি তা পরের উদ্যোগে বিশেষ খেয়াল রাখবেন। খেয়াল রাখবেন আমি/তুমির অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার থেকে যতটা সম্ভব বের হয়ে আসার চেষ্টায় কিন্তু নিজের গরিমা ভেঙ্গে নয়। সর্বপরি বলা যায়- রসে, ভাবগাম্ভীর্যে ‘জলের ক্যালিগ্রাফি’ যে কবির প্রথম প্রয়াস তা যেমন একেবারেই ধরা পড়ে না, ভবিষ্যতেও আশা করি তা ধরা পড়বে না বরং উত্তরোত্তর নিজেকে টপকিয়ে কবি পরের স্তরে পৌঁছবেন, পাঠককে অনন্য কিছু কবিতা পাঠের সুযোগ করে দিয়ে। বইটি ডিসেম্বর-২৪-এ প্রকাশিত হয়েছে অভিযান পাবলিকেশন্স থেকে। প্রচ্ছদ করেছেন, রাজিব দত্ত। মূল্য ২০০ টাকা।
জলের ক্যালিগ্রাফি (কবিতা)। সঞ্জয় দেওয়ান। প্রচ্ছদ: রাজিব দত্ত। প্রকাশনি: অভিজান। মূল্য: ২০০ টাকা।
জোবায়ের মিলন
বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫
কবিতার ভেতর কি জীবন দেখা যায় কিংবা যাপনের উপায়-উপাদান সকল সময় না, কোনো কোনো সময় কোনো কবিতার মধ্যমণিমায় এঁকেবেঁকে থাকে অথবা ভেসে থাকে প্রাত্যহিক জীবন ও যাপনের দুর্দান্ত অণুকণাগুলো, যার পরিক্রমা পেরিয়ে যেতে যেতে দেখা যায় কাব্যময়তার অভ্যন্তরে অমিয় এক সুর খেলা করছে শিশু-সারল্যের তুলতুলে পুতুলের মতো কিংবা জীবন্ত প্রাণের অনশ^র স্বরের মতো। আর সে স্বর যখন একক নিস্বন ভেদ করে অনেক নিস্বনে পৌঁছায় তখনই তা আর আমাদের সচরাচরতায় থাকে না, হয়ে যায়- বাঙ্ময় ভাষা; কবিতা যা ধারণ করতেই আরাধনা করে কত কত বছরের ’পর। তারপরও কি কবিতা সবার হাতে ধরা দেয়, সবার হাতের কবিতা কি হয়ে ওঠে কবিতা এখানেই কবি জীবনানন্দ দাশের উক্তি সত্য হয়ে ওঠে, ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।’
তরুণ কবি সঞ্জয় দেওয়ানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জলের ক্যালিগ্রাফি’ পাঠ করার সুযোগ হলো। পাঠে তরুণকে তরুণ মনে হলো না, মনে হলো চিরতরুণ। প্রথম কাব্যগ্রন্থটি প্রথম কাব্যগ্রন্থ মনে হলো না, মনে হলো- অনেক দিনের চষা পথ ধরে চলতে থাকা চাষা। পিতার অথবা পিতামহের হালের পেছন পেছন ছুটতে থাকা তীক্ষè খেয়ালি; যার পঙ্ক্তিতে সময়ই প্রধান। সেই প্রধানে উপমার উপস্থাপন তাকে অন্য অনেক থেকে চিনতে বাধ্য করেছে, টেনে রাখতে বাধ্য করেছে তার কবিতার আঙিনায়। মিথ এসে উজিয়ে পড়ছে কখনো কখনো, তবে বর্তমানকে পেরিয়ে নয়, মিথলজিক শব্দের ব্যবহারে। যেখানে সরলতা এক ভাস্কর্য: ‘মেনেস-এর সময় থেকে দিগভ্রান্ত আমি / কাকে যেন খুঁজি হিরন্ময় নক্ষত্রের কোলে।/ কোথায় খুঁজিনি তাঁকে- গিজার পিরামিড থেকে নীলনদ উপত্যকা কিংবা গঙ্গার কিনারা। / অশ^মেধের যজ্ঞে হয় আমরই পতন- নবসৃষ্টির গালভরা বুলির বর্ণমালায়।/ কেন বারবার পোড়াও, ক্ষতবিক্ষত করো, করো রক্তাক্ত।/ আদিগন্ত নক্ষত্রের কোলে ঘুমায় কেচুয়া নারী/ জন্মান্ধ আমি তাঁর সাথেই মিলি পরম শীৎকারে/ শত পুত্রের ব্যর্থ পিতা হই কালান্তরে।’ (জন্মান্ধের আখ্যান)।
প্রেম-কাম, দ্বেষ-বিদ্বেষ, সাধুতা-হিং¯্রতার স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যজুড়ে যে মানব অবয়ব, যে জীবনপ্রণালী- সে সব বাঁকজুড়ে কবির চুলচেরা বিচরণ প্রত্যক্ষ করায়, ধাবমান পৃথিবীর ধাবমানতায় কবির সচেতন বিচরণের কথা। অন্তরদৃষ্টি দিয়ে প্রতিটি পথে প্রহরীর মতো সজাগ থাকার কথা। কবিও যেন বিপরীত লিঙ্গের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অবগাহনে নাও না ভাসিয়ে পারেন না। তিনিও কখনো কখনো অলৌকিক স্তর থেকে নেমে আসেন মাটির মিম্বরে, মিশে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করেন চির বাঞ্ছার বাহ্যিক বাহতায়, ‘অকৃত্রিম ঢেউ রোজ আছড়ে পড়ে/ নরম বুকের ভঙ্গুর পাড়ে।/ আমাকে ডুবিয়ে দাও- তোমার ফুলে ওঠা সুউচ্চ তরঙ্গে/ আমাকে ভাসিয়ে দাও- তোমার গুপ্ত উষ্ণ প্রসবণ ধারায়।/ গাঙ্গেয় বদ্বীপে পলিমাটির কোমল বিছানায়- রোজ বেড়ে উঠি আমি/ তোমার পেলব আঘাতে শিহরিত হই, আজন্ম কেঁপে উঠি।’ (একদিন পরাশর)।
বিচ্যুতির বিভাবরি কবিকে আজন্মই খ-িত করে, করে চিন্তিত, বিমর্ষিত। তাকে প্রাণিত করে গর্জে উঠতে। শব্দের বারুদে সভ্যতার চিমুনি ভাঙ্গচুরে করে সহায়তা- কবি সঞ্জয় দেওয়ানও ব্যতিক্রম নন, যদিও ব্যতিক্রম তার ধারায়, তার বর্ণনায়, তার পরিবেশনায়- তার চিত্রকল্পের অঙ্কনে, গণিতের গভীরে, ‘কালের নামতায় হারিয়ে যায় প্রেম-অপ্রেম, মোহ, কাম। / আমাদের প্রেমগীত খোদিত আছে ভীমবেটকার গুহাচিত্রে; / ইলোরার গিরিগাত্রে;/ অজন্তার দেয়ালচিত্রে; কামকাতর শিলালিপিতে।/ সময়ের মরুঝড়ে ডুবে যায় যুবতী চাঁদ, ডুবে যায় দ্বারকা নগর কলসমুদ্রে / নিভে যায় আদি প্রেম কুরুক্ষেত্রে। / আমাদের চুম্বন লেগে আছে নর্মদা তীরে, বিন্ধ্যপর্বতে, তক্ষশীলায়, হরপ্পায়। / সময়ের কফিনে জিইয়ে রাখি গার্হস্থ্য প্রেম / অনাগত ফসিলে মুদ্রণ করি কালের অবয়ব।
মোট ৫৬টি কবিতা নিয়ে রচিত ‘জলের ক্যালিগ্রাফি’ প্রতিটি কবিতাতেই উজান ঢলের বাঁশি। প্রতিটি কবিতাতেই চলমানতার প্রতিচ্ছবি আঁকা সুযোগ্য শব্দের প্রতীকী ইশারায়। বোধগম্যতায় কয়েকটি কবিতা টনক নাড়িয়ে দেয়, কয়েকটি কবিতা প্রতীকী ভারে যেন ভারি হয়ে উঠেছে। দু-একটি কবিতায় ক্রিয়া পদের ঈষৎ ভুল প্রয়োগ চোখে পড়ে। কিন্তু ভাবাবেগের প্রয়োগে তেমন খটকা তৈরি না করলেও প্রতিশ্রুতিশীলতার প্রশ্নে নিশ্চয়ই কবি তা পরের উদ্যোগে বিশেষ খেয়াল রাখবেন। খেয়াল রাখবেন আমি/তুমির অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার থেকে যতটা সম্ভব বের হয়ে আসার চেষ্টায় কিন্তু নিজের গরিমা ভেঙ্গে নয়। সর্বপরি বলা যায়- রসে, ভাবগাম্ভীর্যে ‘জলের ক্যালিগ্রাফি’ যে কবির প্রথম প্রয়াস তা যেমন একেবারেই ধরা পড়ে না, ভবিষ্যতেও আশা করি তা ধরা পড়বে না বরং উত্তরোত্তর নিজেকে টপকিয়ে কবি পরের স্তরে পৌঁছবেন, পাঠককে অনন্য কিছু কবিতা পাঠের সুযোগ করে দিয়ে। বইটি ডিসেম্বর-২৪-এ প্রকাশিত হয়েছে অভিযান পাবলিকেশন্স থেকে। প্রচ্ছদ করেছেন, রাজিব দত্ত। মূল্য ২০০ টাকা।
জলের ক্যালিগ্রাফি (কবিতা)। সঞ্জয় দেওয়ান। প্রচ্ছদ: রাজিব দত্ত। প্রকাশনি: অভিজান। মূল্য: ২০০ টাকা।