alt

সাময়িকী

বিদূষী নবনীতা বনাম মানুষ নবনীতা

গৌতম রায়

: বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫

নবনীতা দেবসেন

সাতচল্লিশ সালের পনেরই আগস্টের সকাল।হিন্দুস্তান পার্কে ‘ভালো বাসা’র ঠিক সামনে পালিত হচ্ছে সদ্য পাওয়া স্বাধীনতা। ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’ গাইছেন কলিম শরাফী।সামনের সারিতে বসে আছেন কবি নরেন্দ্র দেব, রাধারাণী দেবী আর তাঁদের শিশুকন্যা নবনীতা (১৩ ই জানুয়ারি, ১৯৩৮-৭ ই নভেম্বর, ২০১৯)। তিনজনের চোখেই তখন, ‘চোখের জলের লাগলো জোয়ার।’

সেই নবনীতারই ব্যক্তি জীবনের সব থেকে কঠিন সময়ে, প্রবাসে, তাঁকে শক্তি দিয়েছিল কলিম শরাফীর কণ্ঠে রবীন্দ্র গান, ‘বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি, বারে বারে হেলিস নে ভাই।’ বিলেতে অমর্ত্য-নবনীতার সংসারে একটা ছোট্ট রেকর্ড প্লেয়ার আর কলিম শরাফীর একটা ৪৫ আর পি এম স্পিডের ইপি রেকর্ড, তা ছিল নবনীতার সেদিন ধ্বস্ত মনে, ‘সমস্ত ক্ষতের মুখে পলি।’

নবনীতার অনেক পরিচয়।অধ্যাপিক নবনীতা, লেখিক নবনীতা, কবি নবনীতা, বিদূষী নবনীতা- তাঁর সব পরিচয়কে ছাপিয়ে যায়, ‘মানুষ নবনীতা’ পরিচয়টি। গত শতকের মধ্যযুগে প্রায় দুই বাংলারই বাঙালি নারীদের কাছে নবনীতা হয়ে উঠেছিলেন অন্যতম সেরা আইকন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পরিম-লকে অতিক্রম করে একজন বাঙালি মেয়ে কী করে আন্তর্জাতিক হয়ে উঠতে পারেন, তেমন নামের তালিকা করলে, সেই তালিকার শুরুর দিকেই থাকবে নবনীতার নাম।

মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে সুফিয়া কামালের যেমন ঐতিহাসিক ভূমিকা এবং অবদান, এপার বাংলায়প্রায় সেই রকমই ভূমিকা হলো, নবনীতার।সুফিয়া কামালের সঙ্গে তাঁর ফারাক হলো- সুফিয়া কামাল কখনো প্রথাগত শিক্ষার সুযোগের মধ্যে দিয়ে নিজের জীবনকে পরিচালিত করতে পারেননি; আবার নবনীতা প্রথাগত শিক্ষার ভিতর দিয়ে নিজের জীবনকে পরিচালিত করেও সুফিয়ার মতো সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করবার সুযোগ পাননি মূলত পেশাগত চাপের কারণে। কিন্তু পেশাগত ব্যস্ততাকে বজায় রেখেও যেভাবে গত শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে একদম এই শতকের শুরুর সময় পর্যন্ত বাঙালি নারীর মধ্যে পেশা জীবন ঘিরে সমস্ত রকমের হীনম্মন্যতা কাটিয়ে, নারীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার শিক্ষা নবনীতা দিয়ে গিয়েছেন, তা যেন তুলনা করতে পারা যায় রবীন্দ্রনাথের, ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসের ‘লাবণ্য’ চরিত্রের সঙ্গে।

বিদূষী নবনীতা কখনো মধ্যবিত্ত বাঙালির সামাজিক প্রেক্ষাপটের বাইরে নিজের জীবনকে উপস্থাপিত করবার চেষ্টা করেননি। সেই কারণে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বহু আভিজাত্য, বনেদিয়ানা, বিত্তবান সমাজ সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েও, শেষ দিন পর্যন্ত তিনি কিন্তু থেকে গেছিলেন এক চিরন্তন বাঙালি নারী। তাঁর সাজ পোশাক, মেলামেশা, বিশেষ করে সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের প্রতি তাঁর যে ভালোবাসা এবং নিজের সমস্ত রকমের আর্থিক বিষয়গুলিও সমাজের এই পিছিয়ে পড়া লোকেদের জন্য উজার করে দেওয়া- তাঁর এই যে মানসিকতা, তাঁর খুব চেনাজানা বৃত্তের বাইরে বেশিরভাগ মানুষ জানতে পারেননি। সেটি কিন্তু ছিল বিদূষী নবনীতার থেকে, মানুষ নবনীতার সবথেকে বড় বৈশিষ্ট্য।

নবনীতা খুব একটা কৌশলী ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। যাঁকে বিশ্বাস করতেন, তাঁকে সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করতেন। তাই মনের কথা মন খুলেই তাঁর সঙ্গে আলোচনা করতেন। তাঁর আলাপ আলোচনা, আড্ডা কোনও কিছুতেই খুব একটা মারপ্যাঁচ, কথার জাগুলারি এগুলো ছিল না। কোনও পত্রিকা গোষ্ঠী তাঁর লেখা না নিলে তা নিয়ে তাঁর অভিমান, সেটাও তিনি খুব অকপটে তাঁর কাছের মানুষদের বলতেন। আবার কারো লেখা বা কারো যাপনচিত্র- এগুলিতে আনন্দ পেলে,খুশি হলে, নির্দ্বিধায় নিজের সেই ভালোলাগা সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে তাঁর মধ্যে কখনো এতোটুকু কার্পণ্য ছিল না।

নবনীতা তাঁর গোটা জীবনে যে সমস্ত উপন্যাস, ছোটগল্প, শিশু সাহিত্য,কবিতা,ভ্রমণকাহিনী, প্রবন্ধ ইত্যাদি রচনা করেছিলেন, সেগুলির মধ্যে গুরু গম্ভীর বিষয়কেও তিনি এত সহজে, নানা ধরনের মজার অভিব্যক্তির মধ্যে দিয়ে উপস্থিত করেছেন, যাতে বিষয়ের গাম্ভীর্য বজায় থেকেও, একটা অদ্ভুত সহজ সরল প্রাণবন্ত মূর্ছনা, তাঁর সেই সমস্ত লেখার মধ্যে দিয়েপ্রতিফলিত হয়েছে।নবনীতা কখনো কঠিন কঠিন শব্দের সংযুক্তিকরণের মধ্যে দিয়ে নিজের সৃষ্টিকে একটা আঁতলামোর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না। আবার বিষয়বস্তুকে বোঝানোর জন্য এত সহজ প্রাণবন্ত শব্দাবলি ব্যবহার করতেন, যা এক কথায় ছিল সত্যিই একটা বিরল প্রতিভার পরিচায়ক।

একবার দুই ভারতীয় রাজনীতিকে পরিচয় দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি বলেছিলেন- ইন্টেলেকচুয়াল স্টুপিড আর একজনের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছিলেন, ইললিটারেড স্টুপিড।

এমনটাই ছিল তাঁর শ্লেষাত্মক রসিকতার আঙ্গিক। নবনীতা কখনো কঠিন কথা,কঠিন করে বলতেন না।তাঁর স্বভাবসুলভ উইটি সেন্সের সঙ্গে বিষয়ের ঘনঘটা কে তিনি যেভাবে মেলে ধরতে পারতেন, তাঁর সমসাময়িক কালে এপার বাংলার বিদূষী নারীদের মধ্যে এমন প্রতিভা খুব কম মানুষের মধ্যেই ছিল। নবনীতা কোনোদিন কলহপ্রবণ ছিলেন না।তাই বলে কোনও অন্যায় দেখলে, চুপ করে তাকে মেনে নেওয়া , এটাও তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ ছিল।কিন্তু এই নিজের স্বভাবে পরিচয় দিতে গিয়ে সাহিত্য সংস্কৃতি বা সমাজবিক্ষার ক্ষেত্রে কখনো রণরঙ্গিনী ভাবে নিজেকে মেলে ধরা- সে পথ দিয়ে তিনি কখনো হাঁটেননি।

স্বভাবসুলভ স্থিতি মন মানসিকতা এবং একটু দ্রুত উচ্চারণে কথা বলার নিজস্ব আঙ্গিকের মধ্যে দিয়ে তিনি নিজের সমস্ত ধরনের অভিব্যক্তিকে প্রকাশ করতে কখনো সংকোচ বোধ করতেন না। প্রত্যক্ষভাবে কখনো রাজনীতির অঙ্গনে তিনি পা রাখেন নি, বা রাজনৈতিক বিষয়াবলি সম্পর্কেও খুব একটা মতামত প্রকাশ্যে জ্ঞাপন করেননি। তা বলে সমাজের ভালো মন্দ, তা নিয়ে কখনো তাঁকে চুপ করে থাকতে দেখা যায়নি। সমাজের ভালো-মন্দ নিয়ে সোচ্চার হওয়ার ফলশ্রুতি হিসেবে কোনও ধরনের সামাজিক অভিক্ষার, অভিঘাতের রাজনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাতের সম্মুখীন হতে হবে কিনা- এসব নিয়ে ভাবা, এটা ছিল নবনীতার স্বভাববিরুদ্ধ একটা ব্যাপার।

যেটাকে তিনি ন্যায় বলে মনে করতেন, তার স্বপক্ষে তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিমায় দৃঢ় মতামত দিতে তিনি কখনো দ্বিধাবোধ করেননি আবার যাকে তিনি অন্যায় বলে মনে করতেন, তাঁর নিজস্ব অভিরুচির মধ্যেই, সেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে তিনি কখনো দ্বিধা করেননি। কোনও ব্যক্তি কোনও রাজনৈতিক দল বা কোনও সামাজিক গোষ্ঠী, এঁরা কেউ কখনো নবনীতাকে তাঁদের নিজের স্বার্থসিদ্ধির তাগিদে ব্যবহার করতে সক্ষম হননি। কেউ কখনো নবনীতাকে দিয়ে নিজেদের স্বার্থ পূরণ হতে পারে এমন কোনও বক্তব্য, যার সঙ্গে ব্যক্তি নবনীতা হয়তো সহমত নন, তেমন একটা অক্ষরও বলিয়ে নিতে সক্ষম হননি।

নবনীতার সমসাময়িক কালে এপার বাংলায় সাহিত্য, সংস্কৃতি, অধ্যাপনা সমস্ত দুনিয়াতেই বহু নারী ছিলেন যাঁরা নিজের নিজের ক্ষেত্রে বিশেষ রকমের কৃতিত্বের অধিকারী ছিলেন। কিন্তু এঁদের মধ্যে একটা বড় অংশ কখনো না কখনো, কোনও না কোনওভাবে দলীয় রাজনীতি বা সমাজ সম্পৃক্ত কোনও গোষ্ঠী স্বার্থজনিত বিষয়, তার মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রেখে, কোনো না কোনো পর্যায়ে বিতর্কিত হয়েছেন।নবনীতা কিন্তু কখনো কোনোদিন এভাবে নিজের বিবেকের বাইরে গিয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। আবার গোটা সমাজ তাঁর বিপক্ষে চলে যাবে, এটা অনুভব করেও যেটা বলা উচিত, নির্দ্বিধার সেই কথাটি বলেছেন। এক্ষেত্রে এপার বাংলায়, স্বাধীনতা উত্তরকালে, নবনীতা দেবসেনের সঙ্গে স্বমহিমায় এক বন্ধনীতে উচ্চারিত হওয়া নারী হিসেবে নির্দ্বিধায় সম্ভবত কেবলমাত্র উচ্চারিত হতে পারে গৌরী আইয়ুবের নামটিই।

ছবি

সম্পত্তি বিতর্ক: কেন পদত্যাগ করতে হলো টিউলিপ সিদ্দিককে

ছবি

রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা ফেব্রুয়ারিতে

ছবি

মধুসূদনের সাহিত্যে নৈরাশ্যবাদ

ছবি

দুটি অণুগল্প

ছবি

উপমা-চিত্রে দ্যোতনার সঞ্চারণ

সাময়িকী কবিতা

ছবি

প্রয়োজনে ডাক দিও

ছবি

মাকারিও

ছবি

আমার সহযাত্রী

ছবি

নাগিব মাহফুজের নির্বাচিত ১০ স্বপ্ন

ছবি

একটি ভাঙ্গা থালা

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের কবিতা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

বাদশা আকবর

ছবি

নগুগি ওয়া থিয়াঙ্গ’ও প্রতিরোধ এবং পুনর্জাগরণের প্রতীক নগুগি ওয়া থিয়াঙ্গ’ও

ছবি

সাহিত্যের ভবিষ্যৎ

ছবি

হৃদয় প্রক্ষালক কবি বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

ছবি

বহুবাচনিকতা ও শিল্পের নন্দন

ছবি

সেদিন দু’দ- এই বাংলার তীর

ছবি

বিকল্প জীবন

সাময়িকী কবিতা

ছবি

হার না মানা নারী জীবনের উপাখ্যান

ছবি

কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা

ছবি

‘যে-কোনো দেশে ভাল সাহিত্য-অনুবাদক খুব কম’

ছবি

দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড-এর কবি এলিয়ট

ছবি

আর এক সুন্দর সকালবেলায়

ছবি

আবার নরকুম্ভির ও মডার্নিজম

ছবি

আত্মজীবনীর আত্মপ্রকাশ প্রসঙ্গে

ছবি

আসাদের অঙ্ক

ছবি

র্যাঁবোর কবিতায় প্রতীকী জীবনের ছায়া

ছবি

ভাষা সংস্কৃতি সাক্ষরতা

ছবি

হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতার আভিজাত্য

ছবি

চেশোয়া মিওশ-এর কবিতা

ছবি

সিলভিয়া প্লাথের মৃত্যু, নিঃসঙ্গতা ও আত্মবিনাশ

ছবি

সমসাময়িক মার্কিনি ‘সহস্রাব্দের কণ্ঠস্বর’

সাময়িকী কবিতা

tab

সাময়িকী

বিদূষী নবনীতা বনাম মানুষ নবনীতা

গৌতম রায়

নবনীতা দেবসেন

বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫

সাতচল্লিশ সালের পনেরই আগস্টের সকাল।হিন্দুস্তান পার্কে ‘ভালো বাসা’র ঠিক সামনে পালিত হচ্ছে সদ্য পাওয়া স্বাধীনতা। ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’ গাইছেন কলিম শরাফী।সামনের সারিতে বসে আছেন কবি নরেন্দ্র দেব, রাধারাণী দেবী আর তাঁদের শিশুকন্যা নবনীতা (১৩ ই জানুয়ারি, ১৯৩৮-৭ ই নভেম্বর, ২০১৯)। তিনজনের চোখেই তখন, ‘চোখের জলের লাগলো জোয়ার।’

সেই নবনীতারই ব্যক্তি জীবনের সব থেকে কঠিন সময়ে, প্রবাসে, তাঁকে শক্তি দিয়েছিল কলিম শরাফীর কণ্ঠে রবীন্দ্র গান, ‘বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি, বারে বারে হেলিস নে ভাই।’ বিলেতে অমর্ত্য-নবনীতার সংসারে একটা ছোট্ট রেকর্ড প্লেয়ার আর কলিম শরাফীর একটা ৪৫ আর পি এম স্পিডের ইপি রেকর্ড, তা ছিল নবনীতার সেদিন ধ্বস্ত মনে, ‘সমস্ত ক্ষতের মুখে পলি।’

নবনীতার অনেক পরিচয়।অধ্যাপিক নবনীতা, লেখিক নবনীতা, কবি নবনীতা, বিদূষী নবনীতা- তাঁর সব পরিচয়কে ছাপিয়ে যায়, ‘মানুষ নবনীতা’ পরিচয়টি। গত শতকের মধ্যযুগে প্রায় দুই বাংলারই বাঙালি নারীদের কাছে নবনীতা হয়ে উঠেছিলেন অন্যতম সেরা আইকন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পরিম-লকে অতিক্রম করে একজন বাঙালি মেয়ে কী করে আন্তর্জাতিক হয়ে উঠতে পারেন, তেমন নামের তালিকা করলে, সেই তালিকার শুরুর দিকেই থাকবে নবনীতার নাম।

মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে সুফিয়া কামালের যেমন ঐতিহাসিক ভূমিকা এবং অবদান, এপার বাংলায়প্রায় সেই রকমই ভূমিকা হলো, নবনীতার।সুফিয়া কামালের সঙ্গে তাঁর ফারাক হলো- সুফিয়া কামাল কখনো প্রথাগত শিক্ষার সুযোগের মধ্যে দিয়ে নিজের জীবনকে পরিচালিত করতে পারেননি; আবার নবনীতা প্রথাগত শিক্ষার ভিতর দিয়ে নিজের জীবনকে পরিচালিত করেও সুফিয়ার মতো সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করবার সুযোগ পাননি মূলত পেশাগত চাপের কারণে। কিন্তু পেশাগত ব্যস্ততাকে বজায় রেখেও যেভাবে গত শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে একদম এই শতকের শুরুর সময় পর্যন্ত বাঙালি নারীর মধ্যে পেশা জীবন ঘিরে সমস্ত রকমের হীনম্মন্যতা কাটিয়ে, নারীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার শিক্ষা নবনীতা দিয়ে গিয়েছেন, তা যেন তুলনা করতে পারা যায় রবীন্দ্রনাথের, ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসের ‘লাবণ্য’ চরিত্রের সঙ্গে।

বিদূষী নবনীতা কখনো মধ্যবিত্ত বাঙালির সামাজিক প্রেক্ষাপটের বাইরে নিজের জীবনকে উপস্থাপিত করবার চেষ্টা করেননি। সেই কারণে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বহু আভিজাত্য, বনেদিয়ানা, বিত্তবান সমাজ সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েও, শেষ দিন পর্যন্ত তিনি কিন্তু থেকে গেছিলেন এক চিরন্তন বাঙালি নারী। তাঁর সাজ পোশাক, মেলামেশা, বিশেষ করে সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের প্রতি তাঁর যে ভালোবাসা এবং নিজের সমস্ত রকমের আর্থিক বিষয়গুলিও সমাজের এই পিছিয়ে পড়া লোকেদের জন্য উজার করে দেওয়া- তাঁর এই যে মানসিকতা, তাঁর খুব চেনাজানা বৃত্তের বাইরে বেশিরভাগ মানুষ জানতে পারেননি। সেটি কিন্তু ছিল বিদূষী নবনীতার থেকে, মানুষ নবনীতার সবথেকে বড় বৈশিষ্ট্য।

নবনীতা খুব একটা কৌশলী ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। যাঁকে বিশ্বাস করতেন, তাঁকে সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করতেন। তাই মনের কথা মন খুলেই তাঁর সঙ্গে আলোচনা করতেন। তাঁর আলাপ আলোচনা, আড্ডা কোনও কিছুতেই খুব একটা মারপ্যাঁচ, কথার জাগুলারি এগুলো ছিল না। কোনও পত্রিকা গোষ্ঠী তাঁর লেখা না নিলে তা নিয়ে তাঁর অভিমান, সেটাও তিনি খুব অকপটে তাঁর কাছের মানুষদের বলতেন। আবার কারো লেখা বা কারো যাপনচিত্র- এগুলিতে আনন্দ পেলে,খুশি হলে, নির্দ্বিধায় নিজের সেই ভালোলাগা সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে তাঁর মধ্যে কখনো এতোটুকু কার্পণ্য ছিল না।

নবনীতা তাঁর গোটা জীবনে যে সমস্ত উপন্যাস, ছোটগল্প, শিশু সাহিত্য,কবিতা,ভ্রমণকাহিনী, প্রবন্ধ ইত্যাদি রচনা করেছিলেন, সেগুলির মধ্যে গুরু গম্ভীর বিষয়কেও তিনি এত সহজে, নানা ধরনের মজার অভিব্যক্তির মধ্যে দিয়ে উপস্থিত করেছেন, যাতে বিষয়ের গাম্ভীর্য বজায় থেকেও, একটা অদ্ভুত সহজ সরল প্রাণবন্ত মূর্ছনা, তাঁর সেই সমস্ত লেখার মধ্যে দিয়েপ্রতিফলিত হয়েছে।নবনীতা কখনো কঠিন কঠিন শব্দের সংযুক্তিকরণের মধ্যে দিয়ে নিজের সৃষ্টিকে একটা আঁতলামোর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না। আবার বিষয়বস্তুকে বোঝানোর জন্য এত সহজ প্রাণবন্ত শব্দাবলি ব্যবহার করতেন, যা এক কথায় ছিল সত্যিই একটা বিরল প্রতিভার পরিচায়ক।

একবার দুই ভারতীয় রাজনীতিকে পরিচয় দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি বলেছিলেন- ইন্টেলেকচুয়াল স্টুপিড আর একজনের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছিলেন, ইললিটারেড স্টুপিড।

এমনটাই ছিল তাঁর শ্লেষাত্মক রসিকতার আঙ্গিক। নবনীতা কখনো কঠিন কথা,কঠিন করে বলতেন না।তাঁর স্বভাবসুলভ উইটি সেন্সের সঙ্গে বিষয়ের ঘনঘটা কে তিনি যেভাবে মেলে ধরতে পারতেন, তাঁর সমসাময়িক কালে এপার বাংলার বিদূষী নারীদের মধ্যে এমন প্রতিভা খুব কম মানুষের মধ্যেই ছিল। নবনীতা কোনোদিন কলহপ্রবণ ছিলেন না।তাই বলে কোনও অন্যায় দেখলে, চুপ করে তাকে মেনে নেওয়া , এটাও তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ ছিল।কিন্তু এই নিজের স্বভাবে পরিচয় দিতে গিয়ে সাহিত্য সংস্কৃতি বা সমাজবিক্ষার ক্ষেত্রে কখনো রণরঙ্গিনী ভাবে নিজেকে মেলে ধরা- সে পথ দিয়ে তিনি কখনো হাঁটেননি।

স্বভাবসুলভ স্থিতি মন মানসিকতা এবং একটু দ্রুত উচ্চারণে কথা বলার নিজস্ব আঙ্গিকের মধ্যে দিয়ে তিনি নিজের সমস্ত ধরনের অভিব্যক্তিকে প্রকাশ করতে কখনো সংকোচ বোধ করতেন না। প্রত্যক্ষভাবে কখনো রাজনীতির অঙ্গনে তিনি পা রাখেন নি, বা রাজনৈতিক বিষয়াবলি সম্পর্কেও খুব একটা মতামত প্রকাশ্যে জ্ঞাপন করেননি। তা বলে সমাজের ভালো মন্দ, তা নিয়ে কখনো তাঁকে চুপ করে থাকতে দেখা যায়নি। সমাজের ভালো-মন্দ নিয়ে সোচ্চার হওয়ার ফলশ্রুতি হিসেবে কোনও ধরনের সামাজিক অভিক্ষার, অভিঘাতের রাজনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাতের সম্মুখীন হতে হবে কিনা- এসব নিয়ে ভাবা, এটা ছিল নবনীতার স্বভাববিরুদ্ধ একটা ব্যাপার।

যেটাকে তিনি ন্যায় বলে মনে করতেন, তার স্বপক্ষে তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিমায় দৃঢ় মতামত দিতে তিনি কখনো দ্বিধাবোধ করেননি আবার যাকে তিনি অন্যায় বলে মনে করতেন, তাঁর নিজস্ব অভিরুচির মধ্যেই, সেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে তিনি কখনো দ্বিধা করেননি। কোনও ব্যক্তি কোনও রাজনৈতিক দল বা কোনও সামাজিক গোষ্ঠী, এঁরা কেউ কখনো নবনীতাকে তাঁদের নিজের স্বার্থসিদ্ধির তাগিদে ব্যবহার করতে সক্ষম হননি। কেউ কখনো নবনীতাকে দিয়ে নিজেদের স্বার্থ পূরণ হতে পারে এমন কোনও বক্তব্য, যার সঙ্গে ব্যক্তি নবনীতা হয়তো সহমত নন, তেমন একটা অক্ষরও বলিয়ে নিতে সক্ষম হননি।

নবনীতার সমসাময়িক কালে এপার বাংলায় সাহিত্য, সংস্কৃতি, অধ্যাপনা সমস্ত দুনিয়াতেই বহু নারী ছিলেন যাঁরা নিজের নিজের ক্ষেত্রে বিশেষ রকমের কৃতিত্বের অধিকারী ছিলেন। কিন্তু এঁদের মধ্যে একটা বড় অংশ কখনো না কখনো, কোনও না কোনওভাবে দলীয় রাজনীতি বা সমাজ সম্পৃক্ত কোনও গোষ্ঠী স্বার্থজনিত বিষয়, তার মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রেখে, কোনো না কোনো পর্যায়ে বিতর্কিত হয়েছেন।নবনীতা কিন্তু কখনো কোনোদিন এভাবে নিজের বিবেকের বাইরে গিয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। আবার গোটা সমাজ তাঁর বিপক্ষে চলে যাবে, এটা অনুভব করেও যেটা বলা উচিত, নির্দ্বিধার সেই কথাটি বলেছেন। এক্ষেত্রে এপার বাংলায়, স্বাধীনতা উত্তরকালে, নবনীতা দেবসেনের সঙ্গে স্বমহিমায় এক বন্ধনীতে উচ্চারিত হওয়া নারী হিসেবে নির্দ্বিধায় সম্ভবত কেবলমাত্র উচ্চারিত হতে পারে গৌরী আইয়ুবের নামটিই।

back to top