আনিসুজ জামান
[‘মাকারিও’ হুয়ান রুলফোর অত্যন্তপ্রশংসিত গল্পের একটি। আমার নিজেরও অত্যন্ত প্রিয় গল্প। এতোটাই প্রিয় যে আমি অনুবাদ না করে থাকতে পারিনি। অনুবাদ মানে আরেক অর্থে নিজের ভাষায় লেখা। এই কারণে নিজের প্রিয় কোনো টেক্সটকে অনুবাদ করার মধ্যে অন্যর রকম আনন্দ আছে। সেই আনন্দ আমি পেয়েছিও। এখন প্রশ্ন হলো, এরপরও এই গল্পটির আরেকটি রূপ লেখার দুঃসাহস আমি কেনো দেখালাম? সেটির প্রয়োজন আদৌ ছিল কিনা।
আমি বলবো, এই গল্প আমি নিজে থেকে লিখিনি। গল্পের নামচরিত্র মাকারিও আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে। গল্পটি পড়ার পর থেকে আমি যেখানেই যাই মাকারিওকে দেখতে পাই, একজন মাকারিও না, অনেক মাকারিও ঘুরেফিরে আমার সামনে আসে। মনে হয় ওদের গল্প তো শেষ হয়ে যায়নি। একটা ঘটনার মধ্যে ওদের জীবন ঘুরপাক খাচ্ছে, এই আবর্তনই ওদের নিয়তি। আমি তাই অন্য আরেকজন মাকারিও গল্পটা লিখতে চাইলাম। প্রতিপাঠে যেমন একই গল্প ভিন্নভিন্নরূপে ধরা দেয়, তেমনটি একই মাকারিও জীবনও নতুন নতুন গল্পে নতুন কিছু উপলব্ধি যোগ করে। আমার কাছে কখনো কখনো মনে হয় পুরো সমাজটাই মাকারিও। আমি এই কারণে দেখতে চেয়েছি, রুলফোর সেই মাকারিও আজকে কেমন আছে, কেমন থাকবে আগামীর মাকারিও। এর মধ্য দিয়ে আমাদের সমাজের সঙ্গে রুলফোর সেই সমাজের তফাৎটাও পরিষ্কার হয়ে ওঠে। মাকারিও কি আগের মতোই আছে নাকি আরো শোচনীয় অবস্থার মধ্যে পড়েছে? এই প্রশ্নটার উত্তর খোঁজার জন্য আরেকটা গল্প লেখার প্রয়োজন ছিল, কারো জন্য না হলেও অন্তত আমার নিজের জন্য। -লেখক]
- হারামজাদী বিড়াল।
খালার চিৎকার শুনে দৌড়ে গিয়েছিলাম কিন্তু বিড়ালটাকে দেখতে পাইনি।
আমি মাকারিও নই; তবে লোকে মাকারিও বলে ডাকে। হেসুসের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের দিনই খালু নামটা রেখেছিল। আমি নালার পাশে বসে একটা চ্যালা দিয়ে ব্যাঙ মারছিলাম। চ্যালাটা পিরুল গাছের, কোনো কাজে লাগে না, এমনকি ঠিকমত জ্বলেও না, তাই ওটাই বেছে নিয়েছি যাতে রিতা কেড়ে না নেয়। রিতা আমার সৎ মা। ব্যাঙ মারা পছন্দ করে না, মুরগি ছাড়া কোনো কিছুই না। আমি না করলে নিজেই করে নেয়; মুরগির গলা ধরে উঁচু করে বাতাসে জোরে দু’তিনটি পল্টানি দিলেই মরাত। তারপর ছুরি দিয়ে কেটে নিলেই হলো। মুরগি খেতে দারুণ, ব্যাঙও নাকি মজার, মুরগির মতোই স্বাদ, আমি কোনোদিন খাইনি, শুনেছি। রুবেল বলেছিল। আমি ব্যাঙ মেরে শুঁটকি দিই। গন্ধটা ভালো লাগে। সাপ, ব্যাঙ, টিকটিকি, ইগুয়ানা এই তো; মুরগির মাংস খুব একটা ভাগ্যে জোটে না। সৎ ভাই পাবলোই বেশি পায়। ও টেবিলে বসে খেতে পারে, আমি পারি না। থুথু ছিটাই বলে আমাকে সবার সঙ্গে টেবিলে বসতে দেওয়া হয় না। সকলের খাওয়া শেষ হলে আমি ঠিক রাত সাড়ে আটটায় বাড়িতে গেলে রিতা খেতে দেয়। কোনো কোনো রাতে হারামজাদা পাবলো বেশি খেয়ে নিলে আমার ভাগে কম পড়ে। পেটে খিধে নিয়ে ঘুমাতে ভালো লাগে না। পেটে আমার সব সময় ক্ষুধা থাকে। খাবার দিলে আমি সব করতে পারি, কিন্তু কেউ আমাকে কোনো কাজ দেয় না। পাশের বাড়ির জেঠি আগে বাগান ছাপ করতে দিত, কিন্তু একবার ফুলগাছসহ সব উপড়ে ফেলেছিলাম। কী করব! হাতে গোলাপকাঁটা ফুটে রক্ত ঝরলে রাগ উঠে গিয়েছিল। আমার রাগ হয় খুব বেশি, ঘনঘন। রিতা বলে রাগ ওঠা পাপ। রাগ উঠলে আরও বেশি থুথু ছোটে, মুখে আটকে রাখতে পারি না, হাতের কাছে যা পাই তাই ধ্বংস করি, সব মেরে ফেলি। আমাকে তখন বারান্দার খুঁটির সাথে বেঁধে রাখা হয়। হাত নিশপিশ করে, মাথায় যন্ত্রণা হয়। খুঁটিতে মাথা কুটতে কুটতে আর কিছু মনে থাকে না।
ঘুম থেকে উঠলে বাতাস বয়, ঝিরিঝিরি।
আমি কোনো প্রাণি মারি না, শুধুই মানুষ, খারাপ মানুষ। আগের জন্মে পাপ করে ওরা সাপ, ব্যাঙ আর গিরগিটি হয়ে জন্মেছে। আমি মেরে ফেললে ভাল মানুষ হয়ে জন্মাবে, আমার খালা বলেছে, তেরেসা খালা। খালা তেরেসা অনেক ভালো মানুষ, অনেকদিন ওকে দেখিনি। বলেছে জীব হত্যা মহাপাপ। মহাপাপ করার ইচ্ছে আমার একটুও নেই। ছোটখাটো পাপের সংখ্যা এত বেশি যে, তাতেই আমার দোজখ নিশ্চিত। তার ওপর মহাপাপ, না কিছুতেই না!
আচ্ছা খালার চেহারা এখন কেমন হয়েছে? আগের মতোই কি হালকা পাতলা নাকি মোটা হয়ে গেছে? বুকটা কি একই রকমের নাকি চুপসে গেছে? থাকেন উত্তরে, অনেক দূরে। খালার কাজ নাই, তাই এদিকে বেড়াতে আসেন না। কালেভদ্রে খালু আসেন, গত বছর ওর কাজ হয়েছে। খালুও আমাকে দেখতে পারে না, আগে পারত, ওদের ছেলেটা মরে যাওয়ার আগে। মরার পর আমাকে অপয়া বলেন। দোষ নাকি আমারই!
খালু আমার স্কুলের পয়সা দিত, বিশেষ স্কুল। সকলে মিলে আমরা ৩৭জন ছিলাম। সকলেই বিশেষ, কেউ অংকে ভাল, কেউ ভূগোলে, কেউ আঁকাআঁকিতে। আমি অংকে ভাল, ৩৭৩-এর সঙ্গে ৪৫১ গুণ দিলে ১৬৮,২২৩ হয়। আমার ভাবার দরকার পড়ে না, নম্বরগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ক্লাসের অন্যান্য ছাত্রের মতো আমি অত খারাপ নই। ওদের অনেকেরই মাথা খারাপ, কেউ সারাক্ষণ কথা বলে, কেউ শুধু হাঁ করে তাকিয়ে থাকে, কেউ খালি মারামারির ছুতো খুঁজে। আমি শুধু থুথুটাকে বাগে আনতে পারি না। এই আমার দোষ। থুথু ছেটালে পাপ হয়, সকলে বলে। গির্জার পাদ্রিও।
মা মারা যাবার পর অনেকগুলো বছর তেরেসার কাছে কাটিয়েছি, ওর বুকের দুধ খেয়েছি, ভারি মিষ্টি দুধ। বাবা তখনও রিতাকে ঘরে আনেনি। রিতা আসলো, খালাও উত্তরে খালুর কাছে চলে গেল। অনেক বছর কেঁদেছি, গাছপালা বাগান তছনছ করেছি। ঠিক তখনই মিনি এসেছিল। নালাটার ¯্রােতে ভেসে যাচ্ছিল। আগের রাতের বৃষ্টির তোড়ে ¯্রােত ছিল খুব। দেখতে পেয়ে ছোঁ মেরে তুলে নিয়েছিলাম। ওর গা ঢাকা ছিল ট্রাকের পোড়া ডিজেল দিয়ে। নালা দিয়ে পানির সঙ্গে ভেসে আসে পোড়া ডিজেল, ওপরের কারখানা এবং ট্রাকের ওয়ার্কশপ থেকে ওরা ফ্যালে। আমি মিনিকে বাথরুমে ধুয়ে নিলে রিতা আমাকে তক্তাপেটা করেছিল। আমি শুধু ওকে আরও থুথু ছিটিয়েছিলাম।
তখনও ওর নাম মিনি দিইনি, পরে একদিন দুপুরে চুপে চুপে ড্রয়িংরুমে ঢুকে টিভি দেখছিলাম পাবলোর সঙ্গে আর বিড়ালটার নাম রেখেছিলাম মিনি। মাঝে মাঝে পাবলো খুব ভাল হয়ে যায়, আমাকে ওর সঙ্গে টিভি দেখতে দেয়, রিতাকে বলে দেয় না। তবে ওর মোবাইলটা ছুঁতেও দেয় না। ক্লাসের অনেকেরই মোবাইল ছিল। আমি দিনে বাড়িতে থাকি না, থাকি পাহাড়ের কোলে বড় জাঙ্ক গাড়ির মাঠে। হাজার হাজার পুরনো বাতিল গাড়ি ওখানে। বাস থেকে শুরু করে সব ধরনের মরা বাতিল গাড়ির জঙ্গল। মোটামুটি সবগুলোর পার্টস খুলে নেওয়া হয়েছে, পড়ে রয়েছে শূন্য খাপরা। গাড়ির ফাঁকে ফাঁকে লম্বাগাছ ও ঘাসের কারণে দূর থেকে খুব একটা বোঝা যায় না। সব মিলে চৌদ্দজনে মিলে জায়গাটা পাহারা দেয়। বেড়ার ওপাশে নিজেদের লোক ছাড়া কাউকে ঢুকতে দেয় না। তবে আমাকে কিছুই বলে না, উল্টো মাঝে মাঝে চেখে দেখতে মিষ্টি একটা ওষুধ দেয়। ওষুধটা ওরা ওখানেই বানায়। দারুণ মজা, একবার খেলে অনেকক্ষণ চোখে বায়োস্কপ দেখা যায়, পড়ে লম্বা একটা ঘুম দিই। মিনি আমার সঙ্গে ঘুমায়। আমার খাবার থেকে ওকে সবসময় ভাগ দেই। রিতা পছন্দ করে না, বলে খাবার অপচয় পাপ। মিনি খেলেও সেটা অপচয়। ধরে পেটায়। আমি এরপর থেকে সাবধান হয়ে গেছি, লুকিয়ে গোয়ালঘরে নিয়ে দিই। আমি ওখানেই রাত কাটাই, গাভি দুটোর সঙ্গে। ওগুলোও খুব ভাল, লাথি দেয় না। একবার মিনি হারিয়ে গিয়েছিল। তিনদিন কিছু খাইনি। পরে নিজে নিজেই যে ট্রাকে করে গিয়েছিল সেটাতে করেই ফিরে এসেছিল। আচ্ছা, মিনির কি পাপ হয় না? এই যে আমাকে এত কষ্ট দিল!
রিতা পেটালে কাউকে বলি না, বাবাকেও না। বাবাকে বললে, ‘এই অবুঝ ছেলেটাকে এত কষ্ট দাও কেন’ ছাড়া আর কিছু বলে না। তারপর থেকে আমার তিনদিন খাওয়া বন্ধ। তখন পাবলোই ভরসা, একটু আধটু চুরি করে এনে দিত। তাছাড়া, এখন আমি আর কাঁদি না, কারো জন্যই না। তবে প্রচুর পাপ করি। ব্যাঙ মারার পাপ, গালকাটা চাতোর বোতল বিলির পাপ, ওরা কাউকে মেরে ফেলে পোসোলে বানালে তাতে নাড়া দেওয়ার পাপ, বেআব্রু মেয়ে দেখার পাপ, স্বমেহনের পাপ, পাপ আর পাপ, প্রতি পদেপদে। তবে তাতে তেমন কোনো সমস্যা হবে না। আমি ঠিকই মাফ পেয়ে যাব। গির্জার ছোট পাদ্রি আমাকে সাহায্য করেন, পাপ মুছে দেন। উনি বলেন আমাকে শোধনাগারে থাকতে হবে না। শোধনাগার আকাশটা নাকি পৃথিবী থেকেও কষ্টকর, তবে নরকের মতো অতটা নয়। বড় পাদ্রি আমাকে পছন্দ করেন না, মুখে মাস্ক লাগিয়ে যেতে বলেন, কিন্তু একটুতেই মাস্ক ভিজে যায়, আমি খুলে ফেললে গির্জা থেকে বের করে দেন। আমার কাছ থেকে স্বীকারোক্তি নেন না। তবে ছোট পাদ্রি নেন, অবশ্যই বড় পাদ্রিকে লুকিয়ে। ভোর রাতের দিকে আমি গির্জার পেছন দিয়ে সরু একটা সিঁড়ি বেয়ে ওর ঘরে চলে যাই। প্রায় ঘণ্টা ঘরের কাছে। ওখান থেকে সারাটা গ্রাম, রাতের আকাশ খুব সুন্দর দেখা যায়। মাকেও দেখতে পাই, শোধনাগারে থাকে। আমি মরে গেলে মার সঙ্গে দেখা হবে, স্বর্গে। ততদিনে ওর পাপ শোধন হয়ে গিয়েছে। এমনটিই নাকি হবে, পাদ্রি দানি বলেছেন। তিনিই আমাকে মাকে চিনিয়ে দিয়েছেন। অন্যান্য লোকজনের থেকে মা আরও স্পষ্ট, ওর নাতি এত পাপ ছিল না।
পাদ্রি দানির কাছে যেতে শুরু করেছি আরও অনেক আগে থেকে। একদিন গির্জার বাইরে প্রতিষ্ঠাতা পাদ্রিদের পাঁচ মু-ুর কাছে কাঁদছিলাম। সকলে তখন বড় পাদ্রির মাস্-এ।
-এই কাঁদছিস ক্যান, জিজ্ঞেস করেছিলেন।
-আমাকে, মাস্-এ ঢুকতে দেয় না, স্বীকারোক্তি নেয় না... গড়গড় করে বলতে শুরু করেছিলাম।
-মুখ ঘুরা, এত থুথু ছেটাস ক্যান, বমি আসে, মাস্-এ ঢুকবি ক্যান?
-আমার যে অনেক পাপ, মরার পর সোজা দোজখ, হাবিয়া দোজখ।
-আচ্ছা, রাত্রে গির্জার পেছনের আবর্জনার দরজায় আসবি, দেখি তোর জন্য কী করা যায়।
দানি খুব ভাল, ওর দয়ার শরীর, সকলকে স্বর্গে নিতে চায়, অন্তত যে কজনকে পারা যায়। সকলকে স্বর্গে নিলে তো নরকে নেওয়ার মতো কাউকে ঈশ্বর পাবেন না, এত কষ্ট করে নরক বানানো বৃথা যাবে, তাই দু-এক জনকে নরকের জন্য রেখে যেতে হবে বৈকি। তিনি বলেন।
সেই তখন থেকেই শুরু হয়েছিল। দানির রুমের দরজা আধ খোলা থাকে। ভেতরে ঢুকলে গামলা ভরা ঠা-া জলে ছোট্ট একটা তোয়ালে ডুবিয়ে আমার মুখ শোধন করেন, তারপর হাতের নখ থেকে শুরু করে সারা শরীর। আমার কাম উত্তেজনা হয়। উনি খুব যতœ করে পরিষ্কার করে দ্যান। তারপর মেঝেতে বড় একটা কম্বল পেতে উপুড় করে শুইয়ে পাপমোচন করেন। তখন রুমাল দিয়ে আমার মুখটা বেঁধে নিতে ভোলেন না। প্রথম দিকে ভীষণ কষ্ট হতো, রক্তও পড়েছে। এখন আর হয় না, খারাপও লাগে না। বরং উনি আমাকে ধরলে মজা লাগে।
গত পরশু খালা এসেছে, ওর কাগজ হয়ে গেছে। আমাকে দেখতে আমাদের বাড়ি উঠেছে। বুকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছে। আমি ওর স্পর্শ চেয়েছিলাম, কিছু বলেনি, শুধুই হেসেছিল। তবে মিনিকে দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল। মেকুর একদম সহ্য করতে পারে না, ভয়ে কাঁপে। ছোটবেলায় নাকি একবার ও ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখে একটি হুলো বিড়াল বুকের ওপর বসে ওর দিকে পিটপিট করে তাকিয়ে আছে। চিৎকার করে ফিট হয়ে গিয়েছিল। আমি মিনিকে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম। খালার জন্য আমি সব পারি। কিন্তু রাতের বেলা মিনি খালার বিছানায় উঠেছে, খালা চিৎকার করেছে। আমি মিনিকে ডেকে তারকাঁটার তার দিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছি খালার জানালার সামনে। খালার জন্য আমি সব পারি।
রাতে খালার স্পর্শ নিবো, ভারি মোহনীয় স্পর্শ...
(দ্রষ্টব্য: গত ১৬ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার ‘সংবাদ সাময়িকী’তে শাহাব আহমেদের অনুবাদে হুয়ান রুলফোর মাকারিও গল্পটি প্রকাশিত হয়।)
আনিসুজ জামান
বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫
[‘মাকারিও’ হুয়ান রুলফোর অত্যন্তপ্রশংসিত গল্পের একটি। আমার নিজেরও অত্যন্ত প্রিয় গল্প। এতোটাই প্রিয় যে আমি অনুবাদ না করে থাকতে পারিনি। অনুবাদ মানে আরেক অর্থে নিজের ভাষায় লেখা। এই কারণে নিজের প্রিয় কোনো টেক্সটকে অনুবাদ করার মধ্যে অন্যর রকম আনন্দ আছে। সেই আনন্দ আমি পেয়েছিও। এখন প্রশ্ন হলো, এরপরও এই গল্পটির আরেকটি রূপ লেখার দুঃসাহস আমি কেনো দেখালাম? সেটির প্রয়োজন আদৌ ছিল কিনা।
আমি বলবো, এই গল্প আমি নিজে থেকে লিখিনি। গল্পের নামচরিত্র মাকারিও আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে। গল্পটি পড়ার পর থেকে আমি যেখানেই যাই মাকারিওকে দেখতে পাই, একজন মাকারিও না, অনেক মাকারিও ঘুরেফিরে আমার সামনে আসে। মনে হয় ওদের গল্প তো শেষ হয়ে যায়নি। একটা ঘটনার মধ্যে ওদের জীবন ঘুরপাক খাচ্ছে, এই আবর্তনই ওদের নিয়তি। আমি তাই অন্য আরেকজন মাকারিও গল্পটা লিখতে চাইলাম। প্রতিপাঠে যেমন একই গল্প ভিন্নভিন্নরূপে ধরা দেয়, তেমনটি একই মাকারিও জীবনও নতুন নতুন গল্পে নতুন কিছু উপলব্ধি যোগ করে। আমার কাছে কখনো কখনো মনে হয় পুরো সমাজটাই মাকারিও। আমি এই কারণে দেখতে চেয়েছি, রুলফোর সেই মাকারিও আজকে কেমন আছে, কেমন থাকবে আগামীর মাকারিও। এর মধ্য দিয়ে আমাদের সমাজের সঙ্গে রুলফোর সেই সমাজের তফাৎটাও পরিষ্কার হয়ে ওঠে। মাকারিও কি আগের মতোই আছে নাকি আরো শোচনীয় অবস্থার মধ্যে পড়েছে? এই প্রশ্নটার উত্তর খোঁজার জন্য আরেকটা গল্প লেখার প্রয়োজন ছিল, কারো জন্য না হলেও অন্তত আমার নিজের জন্য। -লেখক]
- হারামজাদী বিড়াল।
খালার চিৎকার শুনে দৌড়ে গিয়েছিলাম কিন্তু বিড়ালটাকে দেখতে পাইনি।
আমি মাকারিও নই; তবে লোকে মাকারিও বলে ডাকে। হেসুসের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের দিনই খালু নামটা রেখেছিল। আমি নালার পাশে বসে একটা চ্যালা দিয়ে ব্যাঙ মারছিলাম। চ্যালাটা পিরুল গাছের, কোনো কাজে লাগে না, এমনকি ঠিকমত জ্বলেও না, তাই ওটাই বেছে নিয়েছি যাতে রিতা কেড়ে না নেয়। রিতা আমার সৎ মা। ব্যাঙ মারা পছন্দ করে না, মুরগি ছাড়া কোনো কিছুই না। আমি না করলে নিজেই করে নেয়; মুরগির গলা ধরে উঁচু করে বাতাসে জোরে দু’তিনটি পল্টানি দিলেই মরাত। তারপর ছুরি দিয়ে কেটে নিলেই হলো। মুরগি খেতে দারুণ, ব্যাঙও নাকি মজার, মুরগির মতোই স্বাদ, আমি কোনোদিন খাইনি, শুনেছি। রুবেল বলেছিল। আমি ব্যাঙ মেরে শুঁটকি দিই। গন্ধটা ভালো লাগে। সাপ, ব্যাঙ, টিকটিকি, ইগুয়ানা এই তো; মুরগির মাংস খুব একটা ভাগ্যে জোটে না। সৎ ভাই পাবলোই বেশি পায়। ও টেবিলে বসে খেতে পারে, আমি পারি না। থুথু ছিটাই বলে আমাকে সবার সঙ্গে টেবিলে বসতে দেওয়া হয় না। সকলের খাওয়া শেষ হলে আমি ঠিক রাত সাড়ে আটটায় বাড়িতে গেলে রিতা খেতে দেয়। কোনো কোনো রাতে হারামজাদা পাবলো বেশি খেয়ে নিলে আমার ভাগে কম পড়ে। পেটে খিধে নিয়ে ঘুমাতে ভালো লাগে না। পেটে আমার সব সময় ক্ষুধা থাকে। খাবার দিলে আমি সব করতে পারি, কিন্তু কেউ আমাকে কোনো কাজ দেয় না। পাশের বাড়ির জেঠি আগে বাগান ছাপ করতে দিত, কিন্তু একবার ফুলগাছসহ সব উপড়ে ফেলেছিলাম। কী করব! হাতে গোলাপকাঁটা ফুটে রক্ত ঝরলে রাগ উঠে গিয়েছিল। আমার রাগ হয় খুব বেশি, ঘনঘন। রিতা বলে রাগ ওঠা পাপ। রাগ উঠলে আরও বেশি থুথু ছোটে, মুখে আটকে রাখতে পারি না, হাতের কাছে যা পাই তাই ধ্বংস করি, সব মেরে ফেলি। আমাকে তখন বারান্দার খুঁটির সাথে বেঁধে রাখা হয়। হাত নিশপিশ করে, মাথায় যন্ত্রণা হয়। খুঁটিতে মাথা কুটতে কুটতে আর কিছু মনে থাকে না।
ঘুম থেকে উঠলে বাতাস বয়, ঝিরিঝিরি।
আমি কোনো প্রাণি মারি না, শুধুই মানুষ, খারাপ মানুষ। আগের জন্মে পাপ করে ওরা সাপ, ব্যাঙ আর গিরগিটি হয়ে জন্মেছে। আমি মেরে ফেললে ভাল মানুষ হয়ে জন্মাবে, আমার খালা বলেছে, তেরেসা খালা। খালা তেরেসা অনেক ভালো মানুষ, অনেকদিন ওকে দেখিনি। বলেছে জীব হত্যা মহাপাপ। মহাপাপ করার ইচ্ছে আমার একটুও নেই। ছোটখাটো পাপের সংখ্যা এত বেশি যে, তাতেই আমার দোজখ নিশ্চিত। তার ওপর মহাপাপ, না কিছুতেই না!
আচ্ছা খালার চেহারা এখন কেমন হয়েছে? আগের মতোই কি হালকা পাতলা নাকি মোটা হয়ে গেছে? বুকটা কি একই রকমের নাকি চুপসে গেছে? থাকেন উত্তরে, অনেক দূরে। খালার কাজ নাই, তাই এদিকে বেড়াতে আসেন না। কালেভদ্রে খালু আসেন, গত বছর ওর কাজ হয়েছে। খালুও আমাকে দেখতে পারে না, আগে পারত, ওদের ছেলেটা মরে যাওয়ার আগে। মরার পর আমাকে অপয়া বলেন। দোষ নাকি আমারই!
খালু আমার স্কুলের পয়সা দিত, বিশেষ স্কুল। সকলে মিলে আমরা ৩৭জন ছিলাম। সকলেই বিশেষ, কেউ অংকে ভাল, কেউ ভূগোলে, কেউ আঁকাআঁকিতে। আমি অংকে ভাল, ৩৭৩-এর সঙ্গে ৪৫১ গুণ দিলে ১৬৮,২২৩ হয়। আমার ভাবার দরকার পড়ে না, নম্বরগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ক্লাসের অন্যান্য ছাত্রের মতো আমি অত খারাপ নই। ওদের অনেকেরই মাথা খারাপ, কেউ সারাক্ষণ কথা বলে, কেউ শুধু হাঁ করে তাকিয়ে থাকে, কেউ খালি মারামারির ছুতো খুঁজে। আমি শুধু থুথুটাকে বাগে আনতে পারি না। এই আমার দোষ। থুথু ছেটালে পাপ হয়, সকলে বলে। গির্জার পাদ্রিও।
মা মারা যাবার পর অনেকগুলো বছর তেরেসার কাছে কাটিয়েছি, ওর বুকের দুধ খেয়েছি, ভারি মিষ্টি দুধ। বাবা তখনও রিতাকে ঘরে আনেনি। রিতা আসলো, খালাও উত্তরে খালুর কাছে চলে গেল। অনেক বছর কেঁদেছি, গাছপালা বাগান তছনছ করেছি। ঠিক তখনই মিনি এসেছিল। নালাটার ¯্রােতে ভেসে যাচ্ছিল। আগের রাতের বৃষ্টির তোড়ে ¯্রােত ছিল খুব। দেখতে পেয়ে ছোঁ মেরে তুলে নিয়েছিলাম। ওর গা ঢাকা ছিল ট্রাকের পোড়া ডিজেল দিয়ে। নালা দিয়ে পানির সঙ্গে ভেসে আসে পোড়া ডিজেল, ওপরের কারখানা এবং ট্রাকের ওয়ার্কশপ থেকে ওরা ফ্যালে। আমি মিনিকে বাথরুমে ধুয়ে নিলে রিতা আমাকে তক্তাপেটা করেছিল। আমি শুধু ওকে আরও থুথু ছিটিয়েছিলাম।
তখনও ওর নাম মিনি দিইনি, পরে একদিন দুপুরে চুপে চুপে ড্রয়িংরুমে ঢুকে টিভি দেখছিলাম পাবলোর সঙ্গে আর বিড়ালটার নাম রেখেছিলাম মিনি। মাঝে মাঝে পাবলো খুব ভাল হয়ে যায়, আমাকে ওর সঙ্গে টিভি দেখতে দেয়, রিতাকে বলে দেয় না। তবে ওর মোবাইলটা ছুঁতেও দেয় না। ক্লাসের অনেকেরই মোবাইল ছিল। আমি দিনে বাড়িতে থাকি না, থাকি পাহাড়ের কোলে বড় জাঙ্ক গাড়ির মাঠে। হাজার হাজার পুরনো বাতিল গাড়ি ওখানে। বাস থেকে শুরু করে সব ধরনের মরা বাতিল গাড়ির জঙ্গল। মোটামুটি সবগুলোর পার্টস খুলে নেওয়া হয়েছে, পড়ে রয়েছে শূন্য খাপরা। গাড়ির ফাঁকে ফাঁকে লম্বাগাছ ও ঘাসের কারণে দূর থেকে খুব একটা বোঝা যায় না। সব মিলে চৌদ্দজনে মিলে জায়গাটা পাহারা দেয়। বেড়ার ওপাশে নিজেদের লোক ছাড়া কাউকে ঢুকতে দেয় না। তবে আমাকে কিছুই বলে না, উল্টো মাঝে মাঝে চেখে দেখতে মিষ্টি একটা ওষুধ দেয়। ওষুধটা ওরা ওখানেই বানায়। দারুণ মজা, একবার খেলে অনেকক্ষণ চোখে বায়োস্কপ দেখা যায়, পড়ে লম্বা একটা ঘুম দিই। মিনি আমার সঙ্গে ঘুমায়। আমার খাবার থেকে ওকে সবসময় ভাগ দেই। রিতা পছন্দ করে না, বলে খাবার অপচয় পাপ। মিনি খেলেও সেটা অপচয়। ধরে পেটায়। আমি এরপর থেকে সাবধান হয়ে গেছি, লুকিয়ে গোয়ালঘরে নিয়ে দিই। আমি ওখানেই রাত কাটাই, গাভি দুটোর সঙ্গে। ওগুলোও খুব ভাল, লাথি দেয় না। একবার মিনি হারিয়ে গিয়েছিল। তিনদিন কিছু খাইনি। পরে নিজে নিজেই যে ট্রাকে করে গিয়েছিল সেটাতে করেই ফিরে এসেছিল। আচ্ছা, মিনির কি পাপ হয় না? এই যে আমাকে এত কষ্ট দিল!
রিতা পেটালে কাউকে বলি না, বাবাকেও না। বাবাকে বললে, ‘এই অবুঝ ছেলেটাকে এত কষ্ট দাও কেন’ ছাড়া আর কিছু বলে না। তারপর থেকে আমার তিনদিন খাওয়া বন্ধ। তখন পাবলোই ভরসা, একটু আধটু চুরি করে এনে দিত। তাছাড়া, এখন আমি আর কাঁদি না, কারো জন্যই না। তবে প্রচুর পাপ করি। ব্যাঙ মারার পাপ, গালকাটা চাতোর বোতল বিলির পাপ, ওরা কাউকে মেরে ফেলে পোসোলে বানালে তাতে নাড়া দেওয়ার পাপ, বেআব্রু মেয়ে দেখার পাপ, স্বমেহনের পাপ, পাপ আর পাপ, প্রতি পদেপদে। তবে তাতে তেমন কোনো সমস্যা হবে না। আমি ঠিকই মাফ পেয়ে যাব। গির্জার ছোট পাদ্রি আমাকে সাহায্য করেন, পাপ মুছে দেন। উনি বলেন আমাকে শোধনাগারে থাকতে হবে না। শোধনাগার আকাশটা নাকি পৃথিবী থেকেও কষ্টকর, তবে নরকের মতো অতটা নয়। বড় পাদ্রি আমাকে পছন্দ করেন না, মুখে মাস্ক লাগিয়ে যেতে বলেন, কিন্তু একটুতেই মাস্ক ভিজে যায়, আমি খুলে ফেললে গির্জা থেকে বের করে দেন। আমার কাছ থেকে স্বীকারোক্তি নেন না। তবে ছোট পাদ্রি নেন, অবশ্যই বড় পাদ্রিকে লুকিয়ে। ভোর রাতের দিকে আমি গির্জার পেছন দিয়ে সরু একটা সিঁড়ি বেয়ে ওর ঘরে চলে যাই। প্রায় ঘণ্টা ঘরের কাছে। ওখান থেকে সারাটা গ্রাম, রাতের আকাশ খুব সুন্দর দেখা যায়। মাকেও দেখতে পাই, শোধনাগারে থাকে। আমি মরে গেলে মার সঙ্গে দেখা হবে, স্বর্গে। ততদিনে ওর পাপ শোধন হয়ে গিয়েছে। এমনটিই নাকি হবে, পাদ্রি দানি বলেছেন। তিনিই আমাকে মাকে চিনিয়ে দিয়েছেন। অন্যান্য লোকজনের থেকে মা আরও স্পষ্ট, ওর নাতি এত পাপ ছিল না।
পাদ্রি দানির কাছে যেতে শুরু করেছি আরও অনেক আগে থেকে। একদিন গির্জার বাইরে প্রতিষ্ঠাতা পাদ্রিদের পাঁচ মু-ুর কাছে কাঁদছিলাম। সকলে তখন বড় পাদ্রির মাস্-এ।
-এই কাঁদছিস ক্যান, জিজ্ঞেস করেছিলেন।
-আমাকে, মাস্-এ ঢুকতে দেয় না, স্বীকারোক্তি নেয় না... গড়গড় করে বলতে শুরু করেছিলাম।
-মুখ ঘুরা, এত থুথু ছেটাস ক্যান, বমি আসে, মাস্-এ ঢুকবি ক্যান?
-আমার যে অনেক পাপ, মরার পর সোজা দোজখ, হাবিয়া দোজখ।
-আচ্ছা, রাত্রে গির্জার পেছনের আবর্জনার দরজায় আসবি, দেখি তোর জন্য কী করা যায়।
দানি খুব ভাল, ওর দয়ার শরীর, সকলকে স্বর্গে নিতে চায়, অন্তত যে কজনকে পারা যায়। সকলকে স্বর্গে নিলে তো নরকে নেওয়ার মতো কাউকে ঈশ্বর পাবেন না, এত কষ্ট করে নরক বানানো বৃথা যাবে, তাই দু-এক জনকে নরকের জন্য রেখে যেতে হবে বৈকি। তিনি বলেন।
সেই তখন থেকেই শুরু হয়েছিল। দানির রুমের দরজা আধ খোলা থাকে। ভেতরে ঢুকলে গামলা ভরা ঠা-া জলে ছোট্ট একটা তোয়ালে ডুবিয়ে আমার মুখ শোধন করেন, তারপর হাতের নখ থেকে শুরু করে সারা শরীর। আমার কাম উত্তেজনা হয়। উনি খুব যতœ করে পরিষ্কার করে দ্যান। তারপর মেঝেতে বড় একটা কম্বল পেতে উপুড় করে শুইয়ে পাপমোচন করেন। তখন রুমাল দিয়ে আমার মুখটা বেঁধে নিতে ভোলেন না। প্রথম দিকে ভীষণ কষ্ট হতো, রক্তও পড়েছে। এখন আর হয় না, খারাপও লাগে না। বরং উনি আমাকে ধরলে মজা লাগে।
গত পরশু খালা এসেছে, ওর কাগজ হয়ে গেছে। আমাকে দেখতে আমাদের বাড়ি উঠেছে। বুকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছে। আমি ওর স্পর্শ চেয়েছিলাম, কিছু বলেনি, শুধুই হেসেছিল। তবে মিনিকে দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল। মেকুর একদম সহ্য করতে পারে না, ভয়ে কাঁপে। ছোটবেলায় নাকি একবার ও ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখে একটি হুলো বিড়াল বুকের ওপর বসে ওর দিকে পিটপিট করে তাকিয়ে আছে। চিৎকার করে ফিট হয়ে গিয়েছিল। আমি মিনিকে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম। খালার জন্য আমি সব পারি। কিন্তু রাতের বেলা মিনি খালার বিছানায় উঠেছে, খালা চিৎকার করেছে। আমি মিনিকে ডেকে তারকাঁটার তার দিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছি খালার জানালার সামনে। খালার জন্য আমি সব পারি।
রাতে খালার স্পর্শ নিবো, ভারি মোহনীয় স্পর্শ...
(দ্রষ্টব্য: গত ১৬ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার ‘সংবাদ সাময়িকী’তে শাহাব আহমেদের অনুবাদে হুয়ান রুলফোর মাকারিও গল্পটি প্রকাশিত হয়।)