মহসীন হাবিব
কত মানুষ! নানা বয়সের মানুষ। কলেজের বিশাল মাঠ ভরে গেছে। স্টেজের সামনে বাঁশ দিয়ে মাঠ দুই ভাগ করা হয়েছে। একপাশে পুরুষ, আরেক পাশে মেয়েরা। মঞ্চে চেয়ার টেবিল পেতে রাখা, টবিলের উপর ফুলের তোড়া। পেছনে কাপড়ের ব্যানারে বড় করে লেখা ‘বিশাল জনসমাবেশ’। তার নিচেই নীল কালিতে লেখা, ‘প্রধান অতিথি: আদনান হোসেন খান’, বিশেষ অতিথি আজমল হোসেন মোল্লা। সবার মধ্যে একটা নতুন উদ্দীপনা। উৎসবের ভাব।
শতশত মানুষের মধ্যে ফুলি দাঁড়িয়ে আছে পাপড়ি আপার কাছেই। মহিলা নেত্রী পাপড়ি আপা ২৯ জন বিভিন্ন বয়সের নারী নিয়ে এসেছেন। রাখাল যেমন একসঙ্গে অনেকগুলো গরু চড়াতে নেয়। সবাইকে ৫শ’ টাকা করে দেওয়া হয়েছে সমাবেশে আসার জন্য। এই বাজারে ৫শ’ টাকা, খারাপ কী! টাকা দেওয়ার সময় পাপড়ি আপা বলছেন, ‘তোরা কেউ কিন্তু মিটিং শেষ না হওয়া পর্যন্ত মাঠ ছাইড়া যাবি না। কাছাকাছি থাকবি। চইলা গেলে চুলের মুঠি ধইরা হাজার টাকা আদায় করবো! মিটিঙের পর বিরিয়ানির প্যাকেট আছে। সবাই নিয়া যাবি।’
অন্য সবার সঙ্গে ফুলিও মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়েছে। তখন থেকেই সে পাপড়ি আফার কাছাকাছি আছে। পাপড়ি আফা হারামি মহিলা, না দেখলে ঠিকই হাজার টাকা আদায় করবে। এখন তার অনেক ক্ষমতা। খালি আদায় করবে না, বিপদে ফেইলা দিবে।
অবশ্য ফুলির মিটিঙ ছেড়ে যাওয়ারও ইচ্ছা নাই। বরং ভালোই লাগছে। নদীর হালকা ঢেউয়ের মতো ফুলির মনে একটা চাপা ঢেউ আছে। অনেক দিন পর আদনান ভাইরে কাছ থেকে দেখা যাবে। বহুকাল ঘর ছাড়া। এখন নেতা হয়ে ফিরছেন।
ফুলি পাপড়ি আফার সাথে সাথেই ঘুরতে থাকল। পাপড়ি একসময় লক্ষ্য করে বলল, ‘এই ফুলি, আমার গায়ের সঙ্গে লাইগা আছিস ক্যান!
ফুলি একটু প্রতিবাদের সুরে বলল, ‘কই যাবো, আপনেই তো কইলেন কোথাও না যাইতে!’
পাপড়ি আফা রাগ হয়ে ফিসফিস করে বললেন, ‘তোর কাম তো এখন গ্রাম সার্ভিস! এদিক ওদিক ঘুইরা দ্যাখ খইদ্দার পাস নাকি! যা, ডাকলে আসপি!
ফুলি নীরবে একটু দূরে সরে গিয়ে দাঁড়ালো। মঞ্চের সামনেই দাঁড়িয়ে থাকল। এখান থিকা আদনান ভাইরে ভালো দেখা যাবে। হয়তো আদনান ভাইও ফুলিরে দেখবে। আচ্ছা, আদনান ভাই কি ভুইলা গ্যাছে সেই সব কথা! ফুলির দিকে চোখ পড়লে তার কী সব কথা মনে পড়বে? কে জানে! সিনেমার দৃশ্যের মতো ফুলির মন পেছনে চলে গেল। তখন সে ছোট মানুষ, আদনান ভাইদের বাড়িতে কাজ করে। কত আর, তোরো/চৌদ্দ বছর বয়স। উনি কী যেন পাস কইরা আইছে। তার আব্বা আশরাফ খালুজান আর খালাম্মা খুবই খুশি। ফুলির কাজের পরিমাণও বাইড়া গেল। আদনান ভাইর জামাকাপড় ধোয়া, খাওয়ার পানি, চা বিস্কুট নিয়ে দেওয়া, দাড়ি কামানোর পানি আগায় দেওয়া সব দৌড়ে দৌড় করে। আদনান ভাইয়ের কিছু দরকার হইলেই খালাম্মা জোরে ডাক দেন ফুলি, এই ফুলি! সামনে গেলে আদনান ভাই মিষ্টি কইরা হাসে, নানা কথা জিগায়। হাসতে হাসতে কয়, তোর মা কেমুন আছে, তুই স্কুলে পড়বি? এসব কথা ফুলির খুব ভালো লাগে। কেউ কুনোদিন এমন কথায় জিগায় নাই। তোরো/চৌদ্দ বছরের দোলার কাছে মনে হয় আদনান ভাই এ বাড়ির মেজবান। সে মন দিয়ে যতœ করতে চায়।
চার-পাঁচদিন পরেই আদনান ভাই একদিন আদর করল গায়ে হাত দিয়া। তখন কি আর ফুলি এত কিছু বুঝে! একদিন আদনান ভাই বুকে হাত দিয়া চাপ দিল। বছরখানেক ধরে ফুইলা ওঠা বুকে আদনান ভাই চাপ দিল ক্যান তা সে বোঝে নাই। সে চুপ কইরা দাঁড়ায় ছিল। এখন তার মনে পড়ে খালুজানও খুব ভয়ে ভয়ে কয়েকবার খুব কায়দা করে তার বুকে হাত দিছে। কিন্তু বেশিদূর আগায় নাই।
কিন্তু ঘটনাটা ঘটছিল মাস খানেকের মধ্যেই। বাসায় খালাম্মা খালুজান কেউ নাই। আদনান ভাই টাইনা প্যান্ট খুইলা ফেলাইল। ফুলি ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকল। আদনান ভাই রীতিমতো হাতে পায়ে ধইরা অুনরোধ করতে থাকল। ফুলি কিছুই বোঝে না। কিন্তু খুব কষ্ট হইছিল তার! খুব কষ্ট দিছিল আদনান ভাই। পরে অবশ্য সইয়া গেছিল। সত্যি কথা, পরে আদনান ভাই শইলে যখন মুখ দিতো, তখন ভাল্লাগতো!
কিন্তু দোযখ নাইমা আইছিল ৬-৭ মাস পরই। ফুলি নিজের শরীরে বিরাট পরিবর্তন দেখল।পেট ফুলে যেতে থাকল। বিষয়টা খালাম্মাও বুঝে গেল। আহা! চুলের মুঠি ধরে কী মারল! মারে আর নিজে কান্দে, মারে আর কান্দে! ঠাস ঠাস কইরা পেটের উপর কয়েকটা লাত্থি দিছিল খালাম্মা। এখন ফুলি বোঝে, পেট নষ্ট করার জন্য খালাম্মা ওইভাবে লাত্থি মারছিল!
খালাম্মা ওইদিনই মারে ডাইকা আনল। ঘর আটকাইয়া মা’র সাথে ফিসফিস করে কী যেন কইল, অনেকক্ষণ। তারপর মা বাহির হইয়া আসল। খালাম্মা আর মা মিলা রাত্রেই নিয়া গেল মমতা নার্সের বাড়িতে। আহা! সেই কথা মনে পড়লে এখনো ফুলির বুকের ভেতর চিন চিন কইরা ব্যথা করে। কী যে কষ্ট, কী যে ব্যাথা হইছিল!
রাতেই মা বাড়িতে নিয়া আসল। কয়েক দিন কী যে অসুস্থ! অবশ্য খালাম্মা মা’র হাতে দশ হাজার টাকা দিছিল। মা চুপ হইয়া গেছিল।
ফুলির চিন্তায় বাধা পড়ল। অতিথিরা সব চলে এসেছে। এলাকার মাস্তান নয়ন ভাই অনেকদিন বাড়ি ছিল না। ফুলি দেখল, এখন মাইকের ঘোষণার দায়িত্ব তার। নয়ন ভাই বলল, ‘এখন মঞ্চে আসন গ্রহণ করবেন আমাদের প্রিয় নেতা, সকলের ভরসার স্থান, আমাদের এলাকার গর্ব, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আদনান হোসেন খান। মাঠ ভরা পুরুষ, মহিলারা মাইকের সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্লোগান দিতে থাকল, ‘তোমার ভাই আমার ভাই- আদনান ভাই আদনান ভাই’ / ‘গরিব দুখির বন্ধু কে- আদনান ভাই আদনান ভাই!’ সবাই হাত তুলে চিৎকার দিয়ে বলছে, আদনান ভাই আদনান ভাই! ফুলিও সবার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলল- ‘আদনান ভাই! আদনান ভাই!’
আদনান ভাইয়ের চোখে কালো চশমা। পরনে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি। সবার উদ্দেশে হাত নাড়লেন। জনগণ আরো জোরে ম্লোগান দিতে থাকল। এবার ফুলির মনে হলো তার দিকেও তাকালেন, চোখে চশমা বোঝা যায় না। সেও হাত তুলে বলল, ম্লোগানের সাথে তাল মিলিয়ে বলল, ‘আদনান ভাই, আদনান ভাই!’ মাইকের ঘোষক এবং আদনান ভাই দুইজনই হাত তুলে সবাইকে থামতে বলল।
নয়ন ভাই আবার বলল, এখন আসন গ্রহণ করবেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, জনদরদী নেতা, এলাকার সভাপতি, আমাদের সবার প্রিয় আজমল হোসেন মোল্লা। আজমল হোসেনের নাম ধরেও স্লোগান হলো। ফুলি এবারও সবার সঙ্গে উঁচু গলায় মোল্লার স্লোগান দিল। আরো তিনজন মঞ্চে উঠল। তাদের ফুলি বিশেষ চেনে না। তবে মোল্লারে সে চেনে। কী ছিল মোল্লার, কিছুই তো ছিল না। এখন সে হঠাৎ কইরা স্টেজে নেতা! মোল্লার দিকে তাকিয়ে তার মনে পড়ল অনেক কথা।
কী ভাবতেছিস!
ফুলি তাকিয়ে দেখল রোজি আসছে, কীরে তুই?
রোজি ফিস ফিস করে বলল, পাপড়ি আসতে কইছে, না আইসা উপায় আছে?
টাকা দিছে তোরে?
রোজি ঠোঁট উল্টে বলল, ৫শ’ টাকা। বাকিডা ও চুরি করছে। আমাগো মাথা পিছু দল থিকা ১ হাজার টাকা দিছে, আমি শুনছি।
কিডা কইল তোরে?
রোজি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, ওই দ্যাখ নয়ন। গত মাসে আমার সাথে থাকছে। এমনিতে নয়ন ভালো আছে, টাকাপয়সা দেয়।
হ, নয়ন পয়সা দেয়। কিন্তু ওই বুুইড়া আজমইল্যা একটা খাচ্চর। আট নয় বছর আগে তারে পুলিশ খুঁজতেছিল। আমাগো ভাঙা ঘরে আইসা পলাইল। তারপর মারে হাতে কয়ডা টাকা দিয়া বাইরে পাঠাইল। আমারে জাঁপটায় ধইরা কু প্রস্তাব দেয়। আমি কই, কী কন কাকা? সে কয় তুই তো পেশাদার, আমারে দিলে অসুবিধা কী, টাকা দিবানি। সেই টাকা এহনো পাই। দেয় নাই। এহন বুড়া হইছে, ভান ধরছে।
রোজি খিক করে হেসে বলল, বুইড়া হইছে! ওর আবার যৌবন গজাইছে নতুন কইরা! কয়েক দিন আগে আমারে নিয়া গেছিল।
মঞ্চের নেতারা উঁচু স্বরে ভাষণ দিচ্ছে। ’৭১ সাল, ’৭৫ সাল এসব কী কী যেন বলছে। রোজি আর ফুলির সেদিকে খেয়াল নাই। মাইকের কারণে ওদের আলাপ আর কেউ শুনতে পাচ্ছে না।
ওই রোজি, মঞ্চে আর তিন জনরে চিনিস?
রোজি তীক্ষè চোখে তাকিয়ে বলল, একটারে চিনি, শাহাবুদ্দিন। ওই যে চেক জামা গায়ে। মাইনসে ডাকে ডাইল শাবু। ফেনসিডিল ছাড়া কিচ্ছু বুঝে না। ট্যামটেমি নাই। লুইচ্চামি করে না, আগে করতো। আমারে অনেক দিন আগে একবার নিছিল। কিন্তুক টাকা দিছিল!
ফুলি কপালে দুঃশ্চিন্তার ভাঁজ নিয়ে বলল, কেমনে চলবো রে রোজি, বয়স হইয়া যাইতেছে। আগের সেই কদর নাই। তোর আর আমার কাছে এই গিরামের থাকে নাই কিডা, ক?
রোজি তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ঠোঁট বাকিয়ে বলল, সবাই থাকছে, ঘরে নতুন বউ থুইয়াও থাকছে, হিহিহি!
তারপর একটু সিরিয়াস হয়ে বলল, ফুলি রে, এখন তোর আর আমার টাইম না। ভদ্দর মাইয়াগো টাইম! ওরাও আমাগো মতো রাস্তায় নাইমা গ্যাছে। এই যে পাপড়ি আফা, সে তো এখন আদনান ভাইরে ধরার তালে আছে!
কোনো এক অভিমান থেকে যেন ফুলির মুখ দিয়ে বের হয়ে আসল, ধরুক গা!
মিটিং শেষ হয়ে গেল। ফুলি আর রোজি দুই প্যাকেট বিরিয়ানি পেয়েছে। হাতে করে রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকল।
ফুলি।
ক।
মিটিঙের মধ্যে আজমল মোল্লা কী কইল শুনছিস?
কী কইল?
কইল, এলাকায় কিছু নষ্ট মেয়েলোক আছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। সমাজটারে নাকি কী এক পথে নিতে হবে!
ফুলি খিক করে হেসে বলল, ও কী কী করছে মাইনসের কাছে কইয়া দিব! ওরসব কিছু মাইনসে জানবে! তখন বুঝবে!
রোজি একটা নিঃশ^াস ছেড়ে বলল, সেই সুযোগ পাবি নারে ফুলি! ওরা সবাই ন্যাংটা। তোরে আমারে ডরায় না।
ফুলি ক্ষুব্ধ স্বরে বলল, দ্যাখ, অত মাইনসের মইধ্যে পাপড়ি আমারে কয় তুই তো গ্রাম সার্ভিস! অয় কী?
সব কামেরই উঁচু নিচু আছে রে। দ্যাখস না, এক উকিল আমাগো পয়সা দিতে পারে না, আরেক উকিল দুবাই-লন্ডন যায়! পাপড়ির কথা তো সবাই জানে না, তাই তার দাম বেশি। একটা খরিদ্দার ধরলেই কাম ফতে!
আমরা জানায় দিব যে পাপড়িও একটা পেশাদার!
তিন মাস চলে গেল। একদিন সকালবেলা ফুলি বের হয়েছে মুড়ি কিনতে। রাস্তায় দেখা হলো তিন চারজন ছেলের সঙ্গে। সবাইকে ফুলি চেনে না। তবে ওরা যে স্কুল কলেজে পড়ে তা বোঝা যায়। একজন বলল, এই চল, তোমারে পাপড়ি আপা যেতে বলছেন।
আচ্ছা, আমি বিকালে দেখা করবানি।
না! এখন যাইতে কইছে।
আমি তো খাই নাই এখনো কিছু।
পরে খাবি!
যেতেই হলো। স্কুলের ছোট্ট মাঠটায় ভিড়। অনেকের হাতে লাঠি। পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে ভিড়ের মাঝখানে ঠেলে দিল কে যেন। ফুলির বুক কেঁপে উঠল! রোজি পা ছড়িয়ে বসে আছে! তার মুখে রক্ত, ব্যথায় মুখ কুঁচকে আছে। ঠিক এই সময় প্রথম ফুলির ঘাড়ের উপর কে যেন গায়ের জোরে একটা বাড়ি দিল! ফুলি ওরে মা বলে বসে বড়ল। সঙ্গে সঙ্গে বেশ কয়েকজন কিল ঘুসি লাথি দিতে শুরু করল।
কেন মারছে, কী অপরাধ কিছুই জানে না ফুলি। কিছুক্ষণ পর বোঝা গেল। নুতন নতুন লোক ভিড়ে যোগ দিচ্ছে। জানতে চাচ্ছে কী কেস! কী ঘটনা! কেউ কেউ উত্তর দিচ্ছে, মাদক ব্যবসায়ী, ইয়াবা ব্যবসায়ী!
পিঠে, পায়ে প্রচ- ব্যথা করছে। তলপেটে একটা লাথি লেগেছে, কেমন যেন পেটের মধ্যে ভয়ানক ব্যথা লাগছে। বমি করতে ইচ্ছা করছে। রোজি অনেক কষ্টে মুখ তুলে বলল, ইয়াবা কী রে ফুলি!
কিছুক্ষণ পর পুলিশ আসল। মহিলা পুলিশও আছে। তারা টেনে তুলে গাড়িতে তুলল। থানায় নিয়ে গেল। সেখান থেকে কোর্টে। কালো পোশাক পরা অনেকগুলো লোক চিৎকার করে বলতে থাকল, ইয়াবা ব্যাবসায়ী! ইয়াবা ব্যবসায়ী, স্যার! জামিন নাই! জামিন নাই!
ফুলি ও রোজি এখন কারাগারে। কবে বের হবে কেউ জানে না!
মহসীন হাবিব
বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫
কত মানুষ! নানা বয়সের মানুষ। কলেজের বিশাল মাঠ ভরে গেছে। স্টেজের সামনে বাঁশ দিয়ে মাঠ দুই ভাগ করা হয়েছে। একপাশে পুরুষ, আরেক পাশে মেয়েরা। মঞ্চে চেয়ার টেবিল পেতে রাখা, টবিলের উপর ফুলের তোড়া। পেছনে কাপড়ের ব্যানারে বড় করে লেখা ‘বিশাল জনসমাবেশ’। তার নিচেই নীল কালিতে লেখা, ‘প্রধান অতিথি: আদনান হোসেন খান’, বিশেষ অতিথি আজমল হোসেন মোল্লা। সবার মধ্যে একটা নতুন উদ্দীপনা। উৎসবের ভাব।
শতশত মানুষের মধ্যে ফুলি দাঁড়িয়ে আছে পাপড়ি আপার কাছেই। মহিলা নেত্রী পাপড়ি আপা ২৯ জন বিভিন্ন বয়সের নারী নিয়ে এসেছেন। রাখাল যেমন একসঙ্গে অনেকগুলো গরু চড়াতে নেয়। সবাইকে ৫শ’ টাকা করে দেওয়া হয়েছে সমাবেশে আসার জন্য। এই বাজারে ৫শ’ টাকা, খারাপ কী! টাকা দেওয়ার সময় পাপড়ি আপা বলছেন, ‘তোরা কেউ কিন্তু মিটিং শেষ না হওয়া পর্যন্ত মাঠ ছাইড়া যাবি না। কাছাকাছি থাকবি। চইলা গেলে চুলের মুঠি ধইরা হাজার টাকা আদায় করবো! মিটিঙের পর বিরিয়ানির প্যাকেট আছে। সবাই নিয়া যাবি।’
অন্য সবার সঙ্গে ফুলিও মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়েছে। তখন থেকেই সে পাপড়ি আফার কাছাকাছি আছে। পাপড়ি আফা হারামি মহিলা, না দেখলে ঠিকই হাজার টাকা আদায় করবে। এখন তার অনেক ক্ষমতা। খালি আদায় করবে না, বিপদে ফেইলা দিবে।
অবশ্য ফুলির মিটিঙ ছেড়ে যাওয়ারও ইচ্ছা নাই। বরং ভালোই লাগছে। নদীর হালকা ঢেউয়ের মতো ফুলির মনে একটা চাপা ঢেউ আছে। অনেক দিন পর আদনান ভাইরে কাছ থেকে দেখা যাবে। বহুকাল ঘর ছাড়া। এখন নেতা হয়ে ফিরছেন।
ফুলি পাপড়ি আফার সাথে সাথেই ঘুরতে থাকল। পাপড়ি একসময় লক্ষ্য করে বলল, ‘এই ফুলি, আমার গায়ের সঙ্গে লাইগা আছিস ক্যান!
ফুলি একটু প্রতিবাদের সুরে বলল, ‘কই যাবো, আপনেই তো কইলেন কোথাও না যাইতে!’
পাপড়ি আফা রাগ হয়ে ফিসফিস করে বললেন, ‘তোর কাম তো এখন গ্রাম সার্ভিস! এদিক ওদিক ঘুইরা দ্যাখ খইদ্দার পাস নাকি! যা, ডাকলে আসপি!
ফুলি নীরবে একটু দূরে সরে গিয়ে দাঁড়ালো। মঞ্চের সামনেই দাঁড়িয়ে থাকল। এখান থিকা আদনান ভাইরে ভালো দেখা যাবে। হয়তো আদনান ভাইও ফুলিরে দেখবে। আচ্ছা, আদনান ভাই কি ভুইলা গ্যাছে সেই সব কথা! ফুলির দিকে চোখ পড়লে তার কী সব কথা মনে পড়বে? কে জানে! সিনেমার দৃশ্যের মতো ফুলির মন পেছনে চলে গেল। তখন সে ছোট মানুষ, আদনান ভাইদের বাড়িতে কাজ করে। কত আর, তোরো/চৌদ্দ বছর বয়স। উনি কী যেন পাস কইরা আইছে। তার আব্বা আশরাফ খালুজান আর খালাম্মা খুবই খুশি। ফুলির কাজের পরিমাণও বাইড়া গেল। আদনান ভাইর জামাকাপড় ধোয়া, খাওয়ার পানি, চা বিস্কুট নিয়ে দেওয়া, দাড়ি কামানোর পানি আগায় দেওয়া সব দৌড়ে দৌড় করে। আদনান ভাইয়ের কিছু দরকার হইলেই খালাম্মা জোরে ডাক দেন ফুলি, এই ফুলি! সামনে গেলে আদনান ভাই মিষ্টি কইরা হাসে, নানা কথা জিগায়। হাসতে হাসতে কয়, তোর মা কেমুন আছে, তুই স্কুলে পড়বি? এসব কথা ফুলির খুব ভালো লাগে। কেউ কুনোদিন এমন কথায় জিগায় নাই। তোরো/চৌদ্দ বছরের দোলার কাছে মনে হয় আদনান ভাই এ বাড়ির মেজবান। সে মন দিয়ে যতœ করতে চায়।
চার-পাঁচদিন পরেই আদনান ভাই একদিন আদর করল গায়ে হাত দিয়া। তখন কি আর ফুলি এত কিছু বুঝে! একদিন আদনান ভাই বুকে হাত দিয়া চাপ দিল। বছরখানেক ধরে ফুইলা ওঠা বুকে আদনান ভাই চাপ দিল ক্যান তা সে বোঝে নাই। সে চুপ কইরা দাঁড়ায় ছিল। এখন তার মনে পড়ে খালুজানও খুব ভয়ে ভয়ে কয়েকবার খুব কায়দা করে তার বুকে হাত দিছে। কিন্তু বেশিদূর আগায় নাই।
কিন্তু ঘটনাটা ঘটছিল মাস খানেকের মধ্যেই। বাসায় খালাম্মা খালুজান কেউ নাই। আদনান ভাই টাইনা প্যান্ট খুইলা ফেলাইল। ফুলি ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকল। আদনান ভাই রীতিমতো হাতে পায়ে ধইরা অুনরোধ করতে থাকল। ফুলি কিছুই বোঝে না। কিন্তু খুব কষ্ট হইছিল তার! খুব কষ্ট দিছিল আদনান ভাই। পরে অবশ্য সইয়া গেছিল। সত্যি কথা, পরে আদনান ভাই শইলে যখন মুখ দিতো, তখন ভাল্লাগতো!
কিন্তু দোযখ নাইমা আইছিল ৬-৭ মাস পরই। ফুলি নিজের শরীরে বিরাট পরিবর্তন দেখল।পেট ফুলে যেতে থাকল। বিষয়টা খালাম্মাও বুঝে গেল। আহা! চুলের মুঠি ধরে কী মারল! মারে আর নিজে কান্দে, মারে আর কান্দে! ঠাস ঠাস কইরা পেটের উপর কয়েকটা লাত্থি দিছিল খালাম্মা। এখন ফুলি বোঝে, পেট নষ্ট করার জন্য খালাম্মা ওইভাবে লাত্থি মারছিল!
খালাম্মা ওইদিনই মারে ডাইকা আনল। ঘর আটকাইয়া মা’র সাথে ফিসফিস করে কী যেন কইল, অনেকক্ষণ। তারপর মা বাহির হইয়া আসল। খালাম্মা আর মা মিলা রাত্রেই নিয়া গেল মমতা নার্সের বাড়িতে। আহা! সেই কথা মনে পড়লে এখনো ফুলির বুকের ভেতর চিন চিন কইরা ব্যথা করে। কী যে কষ্ট, কী যে ব্যাথা হইছিল!
রাতেই মা বাড়িতে নিয়া আসল। কয়েক দিন কী যে অসুস্থ! অবশ্য খালাম্মা মা’র হাতে দশ হাজার টাকা দিছিল। মা চুপ হইয়া গেছিল।
ফুলির চিন্তায় বাধা পড়ল। অতিথিরা সব চলে এসেছে। এলাকার মাস্তান নয়ন ভাই অনেকদিন বাড়ি ছিল না। ফুলি দেখল, এখন মাইকের ঘোষণার দায়িত্ব তার। নয়ন ভাই বলল, ‘এখন মঞ্চে আসন গ্রহণ করবেন আমাদের প্রিয় নেতা, সকলের ভরসার স্থান, আমাদের এলাকার গর্ব, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আদনান হোসেন খান। মাঠ ভরা পুরুষ, মহিলারা মাইকের সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্লোগান দিতে থাকল, ‘তোমার ভাই আমার ভাই- আদনান ভাই আদনান ভাই’ / ‘গরিব দুখির বন্ধু কে- আদনান ভাই আদনান ভাই!’ সবাই হাত তুলে চিৎকার দিয়ে বলছে, আদনান ভাই আদনান ভাই! ফুলিও সবার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলল- ‘আদনান ভাই! আদনান ভাই!’
আদনান ভাইয়ের চোখে কালো চশমা। পরনে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি। সবার উদ্দেশে হাত নাড়লেন। জনগণ আরো জোরে ম্লোগান দিতে থাকল। এবার ফুলির মনে হলো তার দিকেও তাকালেন, চোখে চশমা বোঝা যায় না। সেও হাত তুলে বলল, ম্লোগানের সাথে তাল মিলিয়ে বলল, ‘আদনান ভাই, আদনান ভাই!’ মাইকের ঘোষক এবং আদনান ভাই দুইজনই হাত তুলে সবাইকে থামতে বলল।
নয়ন ভাই আবার বলল, এখন আসন গ্রহণ করবেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, জনদরদী নেতা, এলাকার সভাপতি, আমাদের সবার প্রিয় আজমল হোসেন মোল্লা। আজমল হোসেনের নাম ধরেও স্লোগান হলো। ফুলি এবারও সবার সঙ্গে উঁচু গলায় মোল্লার স্লোগান দিল। আরো তিনজন মঞ্চে উঠল। তাদের ফুলি বিশেষ চেনে না। তবে মোল্লারে সে চেনে। কী ছিল মোল্লার, কিছুই তো ছিল না। এখন সে হঠাৎ কইরা স্টেজে নেতা! মোল্লার দিকে তাকিয়ে তার মনে পড়ল অনেক কথা।
কী ভাবতেছিস!
ফুলি তাকিয়ে দেখল রোজি আসছে, কীরে তুই?
রোজি ফিস ফিস করে বলল, পাপড়ি আসতে কইছে, না আইসা উপায় আছে?
টাকা দিছে তোরে?
রোজি ঠোঁট উল্টে বলল, ৫শ’ টাকা। বাকিডা ও চুরি করছে। আমাগো মাথা পিছু দল থিকা ১ হাজার টাকা দিছে, আমি শুনছি।
কিডা কইল তোরে?
রোজি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, ওই দ্যাখ নয়ন। গত মাসে আমার সাথে থাকছে। এমনিতে নয়ন ভালো আছে, টাকাপয়সা দেয়।
হ, নয়ন পয়সা দেয়। কিন্তু ওই বুুইড়া আজমইল্যা একটা খাচ্চর। আট নয় বছর আগে তারে পুলিশ খুঁজতেছিল। আমাগো ভাঙা ঘরে আইসা পলাইল। তারপর মারে হাতে কয়ডা টাকা দিয়া বাইরে পাঠাইল। আমারে জাঁপটায় ধইরা কু প্রস্তাব দেয়। আমি কই, কী কন কাকা? সে কয় তুই তো পেশাদার, আমারে দিলে অসুবিধা কী, টাকা দিবানি। সেই টাকা এহনো পাই। দেয় নাই। এহন বুড়া হইছে, ভান ধরছে।
রোজি খিক করে হেসে বলল, বুইড়া হইছে! ওর আবার যৌবন গজাইছে নতুন কইরা! কয়েক দিন আগে আমারে নিয়া গেছিল।
মঞ্চের নেতারা উঁচু স্বরে ভাষণ দিচ্ছে। ’৭১ সাল, ’৭৫ সাল এসব কী কী যেন বলছে। রোজি আর ফুলির সেদিকে খেয়াল নাই। মাইকের কারণে ওদের আলাপ আর কেউ শুনতে পাচ্ছে না।
ওই রোজি, মঞ্চে আর তিন জনরে চিনিস?
রোজি তীক্ষè চোখে তাকিয়ে বলল, একটারে চিনি, শাহাবুদ্দিন। ওই যে চেক জামা গায়ে। মাইনসে ডাকে ডাইল শাবু। ফেনসিডিল ছাড়া কিচ্ছু বুঝে না। ট্যামটেমি নাই। লুইচ্চামি করে না, আগে করতো। আমারে অনেক দিন আগে একবার নিছিল। কিন্তুক টাকা দিছিল!
ফুলি কপালে দুঃশ্চিন্তার ভাঁজ নিয়ে বলল, কেমনে চলবো রে রোজি, বয়স হইয়া যাইতেছে। আগের সেই কদর নাই। তোর আর আমার কাছে এই গিরামের থাকে নাই কিডা, ক?
রোজি তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ঠোঁট বাকিয়ে বলল, সবাই থাকছে, ঘরে নতুন বউ থুইয়াও থাকছে, হিহিহি!
তারপর একটু সিরিয়াস হয়ে বলল, ফুলি রে, এখন তোর আর আমার টাইম না। ভদ্দর মাইয়াগো টাইম! ওরাও আমাগো মতো রাস্তায় নাইমা গ্যাছে। এই যে পাপড়ি আফা, সে তো এখন আদনান ভাইরে ধরার তালে আছে!
কোনো এক অভিমান থেকে যেন ফুলির মুখ দিয়ে বের হয়ে আসল, ধরুক গা!
মিটিং শেষ হয়ে গেল। ফুলি আর রোজি দুই প্যাকেট বিরিয়ানি পেয়েছে। হাতে করে রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকল।
ফুলি।
ক।
মিটিঙের মধ্যে আজমল মোল্লা কী কইল শুনছিস?
কী কইল?
কইল, এলাকায় কিছু নষ্ট মেয়েলোক আছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। সমাজটারে নাকি কী এক পথে নিতে হবে!
ফুলি খিক করে হেসে বলল, ও কী কী করছে মাইনসের কাছে কইয়া দিব! ওরসব কিছু মাইনসে জানবে! তখন বুঝবে!
রোজি একটা নিঃশ^াস ছেড়ে বলল, সেই সুযোগ পাবি নারে ফুলি! ওরা সবাই ন্যাংটা। তোরে আমারে ডরায় না।
ফুলি ক্ষুব্ধ স্বরে বলল, দ্যাখ, অত মাইনসের মইধ্যে পাপড়ি আমারে কয় তুই তো গ্রাম সার্ভিস! অয় কী?
সব কামেরই উঁচু নিচু আছে রে। দ্যাখস না, এক উকিল আমাগো পয়সা দিতে পারে না, আরেক উকিল দুবাই-লন্ডন যায়! পাপড়ির কথা তো সবাই জানে না, তাই তার দাম বেশি। একটা খরিদ্দার ধরলেই কাম ফতে!
আমরা জানায় দিব যে পাপড়িও একটা পেশাদার!
তিন মাস চলে গেল। একদিন সকালবেলা ফুলি বের হয়েছে মুড়ি কিনতে। রাস্তায় দেখা হলো তিন চারজন ছেলের সঙ্গে। সবাইকে ফুলি চেনে না। তবে ওরা যে স্কুল কলেজে পড়ে তা বোঝা যায়। একজন বলল, এই চল, তোমারে পাপড়ি আপা যেতে বলছেন।
আচ্ছা, আমি বিকালে দেখা করবানি।
না! এখন যাইতে কইছে।
আমি তো খাই নাই এখনো কিছু।
পরে খাবি!
যেতেই হলো। স্কুলের ছোট্ট মাঠটায় ভিড়। অনেকের হাতে লাঠি। পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে ভিড়ের মাঝখানে ঠেলে দিল কে যেন। ফুলির বুক কেঁপে উঠল! রোজি পা ছড়িয়ে বসে আছে! তার মুখে রক্ত, ব্যথায় মুখ কুঁচকে আছে। ঠিক এই সময় প্রথম ফুলির ঘাড়ের উপর কে যেন গায়ের জোরে একটা বাড়ি দিল! ফুলি ওরে মা বলে বসে বড়ল। সঙ্গে সঙ্গে বেশ কয়েকজন কিল ঘুসি লাথি দিতে শুরু করল।
কেন মারছে, কী অপরাধ কিছুই জানে না ফুলি। কিছুক্ষণ পর বোঝা গেল। নুতন নতুন লোক ভিড়ে যোগ দিচ্ছে। জানতে চাচ্ছে কী কেস! কী ঘটনা! কেউ কেউ উত্তর দিচ্ছে, মাদক ব্যবসায়ী, ইয়াবা ব্যবসায়ী!
পিঠে, পায়ে প্রচ- ব্যথা করছে। তলপেটে একটা লাথি লেগেছে, কেমন যেন পেটের মধ্যে ভয়ানক ব্যথা লাগছে। বমি করতে ইচ্ছা করছে। রোজি অনেক কষ্টে মুখ তুলে বলল, ইয়াবা কী রে ফুলি!
কিছুক্ষণ পর পুলিশ আসল। মহিলা পুলিশও আছে। তারা টেনে তুলে গাড়িতে তুলল। থানায় নিয়ে গেল। সেখান থেকে কোর্টে। কালো পোশাক পরা অনেকগুলো লোক চিৎকার করে বলতে থাকল, ইয়াবা ব্যাবসায়ী! ইয়াবা ব্যবসায়ী, স্যার! জামিন নাই! জামিন নাই!
ফুলি ও রোজি এখন কারাগারে। কবে বের হবে কেউ জানে না!