alt

সাময়িকী

সা দ কা মা লী র গ ল্প

নিজস্বতার অনন্য প্রমাণ

মিলন আশরাফ

: বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫

কথা সাহিত্যিক সাদ কামালী

A world of images, capable of symbolizing the fertility of artist’s vision and of expressing his creative joy.

উইলিয়াম ফকনারের মতে, ‘লিখবার জন্য চাই অভিজ্ঞতা, দেখবার ক্ষমতা এবং কল্পনা।’ সাদ কামালীর গল্পের ক্ষেত্রে বিষয়গুলো সরাসরি সম্পৃক্ত। তার প্রমাণ রাঁচী গ্রন্থনিকেতন থেকে বের হওয়া গল্প সংকলন সাদ কামালীর ‘প্রিয় গল্পগুলো’। গত দু’দশক ধরে গল্পকার যেসব গল্প লিখেছেন তার মধ্য থেকে তাঁর পছন্দের তালিকায় এই বইয়ে রেখেছেন ২৬টি গল্প। নিজস্ব রচনাশৈলী আর গভীর অন্তর্দৃষ্টির ক্ষমতাবলে তিনি পাঠকের মনে স্বতন্ত্র একটি অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন ইতোমধ্যেই। ‘অবশেষে নিঃশব্দ অন্তিমে’র (১৯৯২) গল্পগ্রন্থ নিয়েই কথাসাহিত্যের ভুবনে তাঁর পদার্পণ। লেখকের ‘গল্পের গল্প অথবা গল্পবোধের আত্মজৈবনিক পাঠ’ থেকে আমরা জানতে পারি, অবশেষে নিঃশব্দ অন্তিমে গল্পটি তাঁর দ্বিতীয় প্রকাশিত গল্প। এটি তাঁর নিজের সম্পাদিত ‘আবহমান ভাঙ্গা’য় প্রকাশিত হয়। সেই সময়ে অনেকে গল্পটা সম্পর্কে মতামত দেন, ‘চলচ্চিত্র বোধ ও চলচ্চিত্রের ভাষার প্রভাব লক্ষণীয়।’ সেইজন্যেই সচেতন পাঠক মাত্রই উক্ত গল্পটা পড়ার সময় মনে পড়ে যেতে পারে প্যাট্রিক সুসকাইন্ড রচিত পারফিউম (দ্য স্টোরি অব এ মার্ডারার) উপন্যাসটির কথা। এটি ২০০৬-এ চলচ্চিত্রের রূপদান করা হয়। ওখানে আমরা দেখতে পাই, নায়ক গন্ধ শুঁকে শুঁকে প্রত্যেকটা জিনিস আলাদা করার চেষ্টায় রত ঠিক অনুরূপ ‘অবশেষে নিঃশব্দ অন্তিমে’র প্রধান চরিত্র সাগর খেলে শব্দ নিয়ে। গল্পের শুরুতে গল্পকার প্রধান চরিত্রের পরিচয় করিয়ে দেন এভাবে, ‘সাগর বরাবর অন্তর্মুখী নিঃসঙ্গতা প্রিয়। স্বপ্নময় উদাসীন এবং বিষণœ।’ তার এই উদাসীনতা ও বিষণœতাকে পুঁজি করে সাদ কামালী চরিত্রের মগজের ভেতর পুরে দেন প্রখর শ্রবণশক্তি, শব্দ চিহ্নিত করা এবং চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়ে বিস্মিত করার ক্ষমতা। সঙ্গে সঙ্গে প্রাণ পেয়ে প্রধান চরিত্র সাগর বলে ওঠে, ‘সবকিছুর নিজস্ব শব্দ আছে এবং ভিন্ন ভিন্ন শব্দ সৃষ্টি হয়ে স্বতন্ত্র অর্থ প্রকাশ করে। শব্দ বিষয় ও দৃশ্যকে গভীর ব্যঞ্জনায় আরো বিস্তৃত করতে পারে।’ এরপর সাদ কামালী ভাত খাওয়ার আওয়াজকে টেনে এনে সাগরকে দিয়ে শ্রেণিবৈষম্যের সূক্ষ্মপাঠ আমাদের মস্তিষ্কে গেঁথে দিয়ে বলেন, ‘বিত্তহীনদের খাওয়ার আওয়াজ প্রায়ই জান্তব ধরনের, আর উচ্চবিত্তদের আওয়াজে থাকে তুচ্ছতা।’ প্রকৃতির চরিত্ররাও মিশে যায় গল্পে। কাক ও দোয়েলকে নিয়ে এসে শব্দের বিভাজনে মেতে ওঠে সাগর। এরপর একে একে পানির শব্দ, আগুনের শব্দ, ফ্লোরে পয়সা পড়ার শব্দ, শুকনো পাতার উপর দিয়ে হাঁটার শব্দ, কাগজের শব্দ, নতুন টাকার শব্দ সবই চিনিয়ে দেন তিনি। কিন্তু মানুষ পোড়ার শব্দ নিয়ে পরীক্ষা করার কথা যখন আমরা শুনি তখন ভয়ে কুঁকড়ে সাগরের কথায় কান পাতি, ‘মানুষ পুড়তে পুড়তে যে শব্দ হয় তার থেকে কাঠ অন্যরকম শব্দ করে পোড়ে, তোমরা বুঝতে পারছো না?’ না আমাদের দম বন্ধ হয়ে যায় কানে আঙুল চেপে শব্দ করেই যেন বলে ফেলি ‘না’। অবশেষে নিঃশব্দ অন্তিমে গল্পটা পড়তে গিয়ে পাঠকদের হয়ত ২০১২-তে নির্মিত জাতীয় পুরস্কার জয়ী কৌশিক গাঙ্গুলীর ‘শব্দ’ সিনেমার কথাটাও আসতে পারে ঘুরেফিরে। দুটো গল্পই ‘শব্দ’ কেন্দ্রিক। তবে এখানে বলা রাখা ভালো সাদ কামালী’র গল্পটা বেরিয়েছিল ১৯৯১ আর ‘শব্দ’ সিনেমা ২০১২। সাদ কামালীর এই প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘অবশেষে নিঃশব্দ অন্তিমে’র কথা বলতে যেয়ে প্রাবন্ধিক অধ্যাপক সৌভিক রেজা একটি প্রবন্ধ ‘সাদ কামালীর গল্প : একজন পাঠকের দৃষ্টিতে’ লেখেন, “নিঃশব্দতার গল্প বলেন সাদ কামালী, এবং সেইটি নিঃশব্দেই কখনো কখনো। মানবীয় চেতনার মধ্যে দিয়ে যে-কাহিনী তিনি বয়ন করেন, তাকে নিঃশব্দ ছাড়া আর কী-ই-বা বলতে পারি। আর এ-ও তো আমাদের অনেকেরই জানা যে শব্দময়তার চাইতেও কখনো-কখনো নৈঃশব্দ্যের ব্যঞ্জনা এবং তাৎপর্য অনেক বেশি।” (প্রতিপদ, মার্চ ২০০৬)

সাদ কামালী প্রথম থেকেই গল্পের চেনা রাস্তা পাশ কাটিয়ে স্বতন্ত্র ভাষা নির্মাণের দক্ষতায় আমাদের নিয়ে গিয়েছেন ভিন্ন পথে। সেই পথ তাঁর নিজেরই তৈরি। কথাসাহিত্যের প্রবাদ পুরুষ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সাদ কামালীর প্রথম গল্পগ্রন্থ পড়ে বলেছিলেন, ‘... সুখ উপভোগ করার মতলবে তিনি শিল্পচর্চায় নিয়োজিত হননি, সুখ তাঁর লক্ষ্য নয়। প্রতিটি কদমের স্পন্দন থেকে বোঝা যায় যে তাঁর প্রস্তুতি রয়েছে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার।’ তাঁর কথা আজ সত্য হয়েছে পাঠক মাত্রই এখন তা অনুমেয়। প্রাবন্ধিক অধ্যাপক সৌভিক রেজা তার প্রবন্ধ‘সাদ কামালীর গল্প : একজন পাঠকের দৃষ্টিতে’ লেখেন, “সাদ কামালীরগল্পের শরীর থেকে জমজমাট কাহিনী ধীরে ধীরে বিদায় নেয়ার পরিবর্তে চরিত্রের অন্তর্লীন অনুভূতির সারাৎসার গল্পের সারা দেহে জড়িয়ে থাকে। ফলে, সাদ কামালীর এইসব গল্প হয়ে ওঠে চরিত্রেরই এক ধরনের স্বগত-কথন। মাঝে মাঝে এই স্বগত-কথন পাঠকেরও নিজস্ব ভাষা বলে মনে হয়। তার সঙ্গে যুক্ত হয় লেখকের নিজস্ব অনুভব। সব মিলিয়ে গল্পগুলো হয়ে দাঁড়ায় ‘বাতাসের সাথে বৃক্ষের ফিসফাস’। প্রকৃতপক্ষে, এইভাবে সাদ কামালীর স্বাতন্ত্রিকতা অভিব্যক্ত হতে থাকে। (প্রতিপদ, ২০০৬)

দুই দশকে একে একে বিচিত্র বিষয়ের ওপর নয়টি গল্পগ্রন্থ (অবশেষে নিঃশব্ধ অন্তিমে, অভিব্যক্তিবাদী গল্প, উপকথার আপেল, তেলাপোকার জার্নাল, জন্মে জন্মে যাত্রা, জিয়াফত, সাদা রক্ত এবং মুক্তিযুদ্ধের গল্প) উপহার দিয়েছেন তিনি আমাদের; পরীক্ষামূলক গল্প এমনকি গল্পপ্রবন্ধ-এর মতো নিরীক্ষামূলক প্রবন্ধগ্রন্থউপহার দিয়েছেন। জীবনের লুক্কায়িত সত্যকে চোখে আঙুল দিয়ে আমাদেরকে দেখিয়ে দেখিয়ে তাঁর গল্পের ভুবনে প্রবেশ করান। চোখ ডলতে ডলতে সেই গল্পের ভুবনে গিয়ে হাবুডুবু খেতে থাকি আমরা। মুক্তির পথ খোঁজার জন্য ছটফট করি। চিন্তার মগজকে তিনি শিরীষ কাগজ দিয়ে এমনভাবে কষে ঘষা মারেন মৃত্যু অবধি সেই জ্বালা থেকে মুক্তির কোনো পথ পায় না চিন্তাশীল পাঠক। ভূরিভূরি পাঠক সৃষ্টির নামে তথাকথিত যে জনপ্রিয়তার ধারা চলে আসছে, দুই দশক ধরে তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এক প্রকারের যুদ্ধই ঘোষণা করেছেন তিনি। বাংলাদেশের এক কবি তাঁর ফেসবুক স্টাটাসে যথার্থই লিখেছিলেন, ‘সাদ কামালী’র গল্প মানেই দু’নলা বন্দুক।’ সাদ কামালী সেই গল্পের কারিগর যিনি ছেনি হাতুড়ি দিয়ে জীবনের বাস্তবতাকে নিখুঁতভাবে গড়ে তোলেন। আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখি ‘জিয়াফত’ গল্পের ভেতরে তিনি কীভাবে মৃত কন্যার শরীরের মাংস কেটে তারই সন্তানদের সামনে পরিবেশন করছেন। অন্যখানে ‘জন্মে জন্মে যাত্রা’ গল্পের শুরু হয় উপনিষদের একটি শ্লোকের মাধ্যমে। শ্লোকের মূল বিষয় ‘আমিই বাস্তবিক, আমিই এই সবাকার কারণ; আমা হইতেই আমি সৃষ্টি নির্গত করিয়াছি।’ গল্পে গল্পে সাদ কামালী আমাদেরকে দার্শনিক এক তত্ত্বে আগ্রহী করে তোলেন। তিনি বলেন, একই জীবনের মধ্যে বহুজীবন মানুষ ধারণ করে। মানুষের শুধু খোলসটা পাল্টায় ভেতরটা থাকে একই। এ যেন এক জীবন থেকে অন্য জীবনে যাত্রা। প্রধান চরিত্র আলীনূরের মুখে বসিয়ে দিচ্ছেন জন্মতত্ত্বের এক গভীর সত্য। ‘...আমারে আমি জন্ম দিছি, তুই তোরে জন্ম দিছোস, এইটাই জন্মের আসল কথা।’ আলীনূর কণ্ঠে সুর বসিয়ে বলে,

‘বুঝলি না মর্ম কথা

জীবন নাট্যের রূপ-ব্যথা

অনেক কষ্টের গোলা ঘরে

মাঝে মধ্যে ডাকাত ডাকরে’

গল্পের এরকম দার্শনিক তত্ত্বে সাধারণ পাঠকরা হোঁচট খেলেও জিত হয় সচেতন পাঠকের। আলীনূররা একাধিকবার জন্ম নেয়, খোলস পাল্টায়। গল্পে আরো যুক্ত হয় জীবনযুদ্ধে হেরে যাওয়া, পোড় খাওয়া, মুখোশপরা মানুষের লালসার শিকার মফস্বলের যৌনকর্মী আলো, মায়া, ছায়া, আলেয়া। তাদের সঙ্গে সংক্রমিত হয়ে পাঠকরাও যেন বুঁদ হয়ে শোনে গোয়ালন্দ ঘাটের পতিত মানুষের জীবনের গল্প। চান্দু বয়াতি ও আলীনূরের বাহাসের মাধ্যমে গল্পকার আমাদেরকে নিয়ে যায় শরীয়ত ও মারেফাতের গভীর দর্শনে। আলীনূর গানে এবং কথার ফাঁদ ও জীবন দিয়ে উপনিষদের শ্লোক আমাদের সামনে মূর্ত করে তুলে ধরে।

গরিবের প্রধান শত্রু ক্ষুধা। গল্পকার বলেন, ‘মানুষের প্রবৃত্তিগুলির মধ্যে ক্ষুধা প্রবৃত্তি মানুষকে বিপর্যস্ত করে ফেলে বেশি।’ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চান্দু বয়াতি জলপান ছাড়া আর কিছুই মুখে তোলে না। তার বিশ্বাস আহারখাদ্যের চাপের প্রাণ মরে যায়। গল্পকারের ভাষায়, ‘তার সামনে সাদা ফুলের মতো ভাত, ধোঁয়া ওড়া চা, মাছ মাংসের কতকিছু দেখা যায় কিন্তু তার লোভ হয় না। তার বউমা সালে পাত থেকে ভাত তুলে রাখে কিন্তু সে ভাত মুখে তোলে না সে।’ এটা তো গেলো ‘ক্ষুধা’ গল্পের মোটা দাগের কথা। চান্দু বয়াতির বয়ান-

গাঙের জলে সকল ভাসে

ভাসারে তোর মন

একই দিশায় যা যা চলে

কী আনন্দেরই জেবন

জলের ওপর নাও চলে

পালে লাগে বাতাস

খুদা তিষ্ণা দেনা ফেলে

হবেরে সংসার সুখের বাস।

এবার আমরা যদি ফোকাসটা অন্যদিকে সরাই তাহলে দেখতে পাবো লেখক অন্য আর এক ক্ষুধার ইঙ্গিত দিচ্ছেন। গল্পের ভেতরে ঢুকে আমরা শুনতে পাই আলেয়ার কণ্ঠ। কেন আলেয়া হাত ছুঁয়ে মাপ চাইতে গিয়ে তার ঠোঁট এবং হাতের আঙুল ভীষণ কেঁপে উঠেছিল? আলেয়ার জবানে আরো একটা বাক্য আমাদেরকে ভাবনার জগতে নিয়ে যায়, ‘মাঝে মাঝে আইসেন, আপনেরে দেখলে মনে শান্তি লাগে।’ এ যেন মানিকে’র সেই কুসুম যে শশীর সামনে গিয়ে নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, ‘আপনার কাছে দাঁড়ালে আমার শরীর এমন করে কেন ছোটোবাবু?’ উত্তরে ছোটোবাবু বলিয়াছিলেন, ‘শরীর, শরীর তোমার মন নেই কুসুম।’ কিন্তু আমাদের আলোচনার গল্পে বয়াতিছোটোবাবুর মতো স্কুলের পাস করা নয়, সে জুতসই কোনো উত্তর দিতে পারেনি। যার ফলে তার আচরণে কেমন একটানিষ্ঠুরতা ঢুকে পড়ে। এই নিষ্ঠুরতা আলেয়াকে দমাতে চেয়েছিল। ঠিক তখনই গল্পকার আমাদের একটা সংশয় বাক্য শুনিয়ে দেন, ‘আলেয়া কি জানে না তার শরীর তখন ভয়াবহ ক্ষুধায় পুড়ছে?’ কিন্তু পাঠকের কাছে বিষয়টা নিয়ে আর কোনো সংশয় থাকে না। আমরা বুঝে ফেলি তিনি দৈনিক আহারের পাশাপাশি কোন্ দিকে দৃষ্টি ফেরাতে বলছেন।

এই ভোগবাদী সমাজে ভোগের নেশায় ব্যতিব্যস্ত মানুষ থেকে শুরু করে প্রাণি পর্যন্ত। গল্পের শেষে এসে আমরা টের পাই, ফোঁস ফোঁস শব্দে ফণা তুলে গর্ত থেকে একটা সাপ সকল অধিকার নিয়ে এগিয়ে আসছে তার ক্ষুধা নিবারণ করতে। বয়াতিকে দেখে প্রথমে সে ভাবে, এটা হয়ত বড় মাপের ব্যাঙ। কিন্তু দুটি শুকনো চিমসে পা দেখে সাপের ভুল ভাঙে। তাকে প্রতিদ্বন্দ্বি ভাবতে শুরু করে সাপটা। ফণাটা আরো ফোলায়। কিন্তু বয়াতির কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে শুকনো মৃতপ্রায় কাঠ ভেবে ফণা নামিয়ে নদীর দিকে চলে যায়। কী জানি সাপটা হয়ত তাকে করুণা দেখায়। বয়াতি হিংস্রভাবে সাপের ছুটে যাওয়া দেখে। কোথাও না কোথাও সাপটা তার ভোগের বস্তু পাবে। আহত চোখে বয়াতি সেটা দেখে আর ভাবে, অবাঞ্চিত এই আমি ক্ষুধা নিবারণে কোথায় যাবো?

‘বাহাস’ গল্পে বাউল বা ফকিরি জীবনের ভেতর বাড়ির উঠোনের খবর জানান দেন গল্পকার। বাউল সংসারের ভেতরের দ্বন্দ্বকে দক্ষ হাতে নিপুণ শিল্পীর মতো এঁকেছেন তিনি। ‘বয়াতির নিজস্ব আখ্যান’ এই ঘরোয়ানার আরেকটি গল্প। গল্পকার এই গল্পে বয়াতির বয়ানে শোনান উল্টো এক ভাবের কথা। বয়াতি বলে, ‘সত্যকে ভজন করো না, যা সত্য ভাবো তা সত্য নয়, সত্য সাপের মাথার মণি।’ নুরু বয়াতি আরো জানায়, ‘ত্যাগ নয়, ভোগই ধর্ম, ভোগের ধর্ম বিসর্জন দিও না।’ পাঠকরা এখানে এসে বেশ ঘোরে পড়ে যায়, চিরকালীন ত্যাগই ধর্ম কথাটির বিপরীতে অবস্থান নেওয়া কী চাট্টিখানি কথা। এধরনের বিপরীত স্রোতে লড়াই করতে আহ্বান জানান সাদ কামালী।

সুফিবাদ বা ফকিরী সাধনা আমাদের শাশ্বত জীবনধারায় শত বাধার মুখেও বহমান। শারিয়াপন্থী, মতলববাজ ধর্মাধিকারী সঙ্ঘ, খোলাবাজার, পুঁজি আর প্রযুক্তির সুলভ সমাগম সুফি ঘরানার সার্বজনীন বিশ্বাসের চর্চায় আঘাত করেও নির্মূল করতে পারেনি। অন্যদিকে, শিল্প জিজ্ঞাসার আধুনিকতম অন্বেষণে মানবিক মৌলধারা, হারিয়ে যাওয়া জীবনের সরল সৌন্দর্য পুনঃআবিষ্কার উত্তর-আধুনিক শিল্প-প্রয়াসে প্রবল হয়ে ওঠে। এই ধারাবাহিকতায় আমাদের শিল্প-সাহিত্যও আলোড়িত, গল্পকার খোঁজ করেন শাশ্বত জীবনের গভীর আনন্দ, ফকিরী সাধনার রহস্যঘেরা বাতেনি জগত, ফকিরী জীবন। সাদ কামালীর গল্প “যখন নিঃশব্দ শব্দরে খাবে”-র চরিত্র কবি যশোপ্রাথী তরুণ আলাল ম-ল ফকিরী সাধনার শব্দ বৈভবে ও আধ্যাত্মিক রসে মজে, তথাকথিত আধুনিক কবিতা রচনার বদলে ফকিরী গীত কবিতা রচনা ও সাধনায় মশগুল “খুঁজে দেখ খুঁজে নেও গোপন ভারার / খোসা ভেঙে জিবে তোলো আনন্দ পসার।” আলাল ম-ল সে আনন্দের মোকামে এখনো পৌঁছল না, খোসা খসিয়ে আমূল সাফিনা হয়ে পড়ল না অনেক কিছুই। রহস্যঘেরা বাতেনি জগতের যে সাধনা সে তো আনন্দেরই পথ। সেই আনন্দ আর অহঙ্কারের গোমরে যুগ যুগ ধরে ফকিরী শব্দে বাক্যে আলো-আঁধারির চাদর বোনা। চাদরের হিসাব করা সুতারফাঁসে পানি নিংড়ে পড়ে মাছের আস্তরূপ ঝলসে উঠবে চাঁদের জোছনায়। মাছবস্তুর রূপ ও স্বরূপ, জোছনা, পানি আর চাদরের গুণ ধরিয়ে দিবে মুর্শিদ, কর মুর্শিদের ভজনা।

‘অনূঢ়া আখ্যান’ গল্পে পৌরাণিক কাহিনিকে চমৎকারভাবে কাজে লাগিয়ে, কাব্যময় ভাষায় একজন অনূঢ়া বৃদ্ধার সন্ধ্যার মুহূর্তে অপরূপ অম্বার ছবির সংক্রামে শরীরে সেই ষোল বছরের যৌবন ফিরে পাওয়ার গল্প শোনান গল্পকার। এই গল্পটা নিয়ে তারসমসাময়িক গল্পকার সুশান্ত মজুমদার লেখেন, ‘যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে মানুষের অবদমিত কামনা-বাসনাকে রূপ দিয়েছেন ‘অনূঢ়া আখ্যান’ গল্পে। মিথের ব্যবহার, মনস্তত্তের বিশ্লেষণ, পরিপ্রেক্ষিত মিলিয়ে ‘অনূঢ়া আখ্যান’ একটি উত্তম গল্প।’। ‘অনূঢ়া আখ্যান’ গল্পে পৌঢ় বয়সে এসে চিরকুমারী অম্বা নিজের শরীর-বিষয়ে যেন হঠাৎ করেই সচেতন হয়ে ওঠে। সে তখন স্বমৈথুনে রোমাঞ্চিত, খানিকটা বিচলিতও বটে। মাঝে-মাঝেই সে স্মৃতি-রোমন্থনে বিবশ এবং স্বগত-কথনেও : ‘সুখের নাগর আমি দূরে ঠেলিনি, তুমিই পিতার পৈতা ছিলে বুকে জড়িয়ে; কায়স্থের মেয়েকে বিয়ে করার কথা দিয়েছিলে, পণ অঙ্কের হিসাবও মিলে গিয়েছিল, ঠিক তারিখে সানাই বেজে উঠল, অনেক রঙ উড়িয়ে সাজল বিয়ের বাড়ি, সারাদিন উপোস থেকে সাজলাম কনের সাজে, তখন খবর এলো বরযাত্রী আসছে না; কায়স্থের সাথে ব্রাহ্মণের এ বিয়ে হবে না। তোমার বাবা সমাজে অবাঞ্ছিত হওয়ার ভয়ে পালাল। লগ্নভ্রষ্টা আমি চিরকালের অম্বা হয়ে রইলাম।’

মুক্তিযুদ্ধের গল্প ‘ডান হাতের শক্তি ও শিহরন’। গল্পের শুরুতে আমরা দেখি নির্বাহী পরিচালক আশফাক খানের একটার পর একটা উপদেশ শুনতে শুনতে হিসাব কর্মকর্তা জামাল চৌধুরীর ডান হাতের আঙুলে শিরশির অনুভূত হয়, গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। চোখ বন্ধ করে তিনি এরকম অনুভূতিতে বেশ ভয় পেয়ে যান। সাবান দিয়ে ধুয়েও অনুভূতিটা কিছুতেই যায় না। সংকটের শুরুটা এখান থেকেই। এরপর একের পর এক আশ্চর্যরকম কাজ করতে থাকেন তিনি। ম্যাক্সির রড এমনভাবে ধরে রাখেন সেখানে দাগ পড়ে যায়। পাশে বসা অন্য যাত্রী ভয় পেয়ে যায়। জামাল চৌধুরীর তখন মনে হয় রড চেপে না ধরে লোকটির মাথা চেপে ধরলে তিনি নিশ্চিত, তার মাথার খুলি গুঁড়া হয়ে মগজে সেঁধিয়ে যেতো। একের পর এক এরকম গা শিরশির করা ঘটনা বর্ণনা করেন সাদ কামালী। বাড়িতে এসে জামাল চৌধুরী এসব গল্প করেন স্ত্রীর সঙ্গে। কিন্তু তার স্ত্রীর একথা শোনার কোনো আগ্রহ নেই। গল্পের আর একটু এগিয়ে নিয়ে গিয়ে আমাদেরকে এক ভয়ংকর ঘটনার মুখোমুখি দাঁড় করান গল্পকার। ইস্কাটন প্লাজায় কফি শপে বসে জামাল চৌধুরী ও সায়মা কফি ও প্যাটিস খাচ্ছিল। পাশের টেবিলে হাতে বল নিয়ে খেলছিল এক বালক। একসময় বলটি জামাল চৌধুরীর কাছে এলে এটা তুলে দিতে গিয়েই ঘটে বিপত্তি। মাথায় আদর করতে গিয়ে তাঁর ডান হাত শিরশির করে ওঠে। পাঁচ আঙুল দিয়ে করতলে নিয়ে ছেলেটির মাথার মাঝখানে গায়ের শক্তিতে চেপে ধরে। এভাবে একের পর এক চমকের মধ্য দিয়ে গল্পটি এগোতে থাকে। জামাল চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী, মুক্তিযোদ্ধা ভাই এবং একাত্তরের দালাল নির্বাহী পরিচালক আশফাক খানকে নিয়ে তিনি এমন একটি গল্প ফাঁদেন- যা পাঠকের মস্তিকে চিনচিনে ব্যথা ধরিয়ে দেয়। শেষ হয় একটা শ্বাসরুদ্ধ অবস্থার মধ্য দিয়ে, সায়মা অন্তঃসত্তা, এমন সময় লেখকের বর্ণনায়, ‘কী কারণে মিলিটারির দল আশফাক খানের ঘরে বসে একটু সময় নিয়ে জামাল চৌধুরীর ঘরে ঢোকে, চৌকির তলে না দেখেই সেমি-মিশিনগানের নল ঘুরিয়ে অনবরত ট্রিগার চেপে যায়, বিছানা বালিশে বেয়োনেট দিয়ে খোঁচায়, উঠানে উঁকি দিয়ে দরোজা খোলা ভাঙ্গা খড়ির ঘর দেখে। খুব বেশি হলে পঁচিশ হাত দূর।’ গল্পের চরিত্রের মতো আমাদেরও যেন হাসফাস লেগে যায়। এরপর কী ঘটে, কী ঘটে?তখন সায়মা নিজেই নিজের মুখে হাত চেপে ধরে ব্যথার কাতরধ্বনি রোধ করে, শক্ত করে চেপে ধরে, দম বন্ধ হবার মতো অবস্থা। অসহ্য যন্ত্রণার স্রোতে রক্ত বেরিয়ে আসে, রক্তের সঙ্গে আরও ময়লা বিজলা বিজলা কিছু। বাচ্চার মাথার চাঁদির অনেকটা এসে গেছে। জামাল চৌধুরী কামালের দিকে তাকিয়ে মরিয়া হয়ে বাচ্চার মাথা চেপে ধরে, আর একটু ভিতরে থাক বাবা, আর একটু। মায়ের গর্ভ থেকে মাথা বের করেই তো বিস্মিত ভয়ার্ত শিশু চিৎকার করে উঠবে। এই চিৎকার ঠেকাতেই জামাল চৌধুরী সায়মার দুই পা ফাঁক করে নিজের শক্ত চওড়া হাত দিয়ে বাচ্চার মাথা চেপে ধরে। গায়ের শক্তিতে ঠেসে আবার মায়ের জরায়ুতে ঢুকিয়ে দিতে চায়। বাবা আর একটু অপেক্ষা কর। জামাল চৌধুরীর মতো সায়মাও নিজের মুখ চেপে ধরে রেখে প্রসব যন্ত্রণার সকল কাতরধ্বনি বন্ধ করে রাখে।

প্রচলিত প্রেমের বাইরে গিয়ে তিনি এক অন্য প্রেমের গল্প শুনিয়েছেন ‘প্রেম’ নামক গল্পে। গল্পকার উপায় ঠাকুর সেজে ছেলেটি ও মেয়েটি সম্বোধনে একটি প্রেমের গল্প শোনান আমাদের। কুমার নদের উত্তর পাড়ে চ-ীদাসদি গ্রামে উপায় ঠাকুরের আস্তানা। সেখানে বসেই তিনি ভক্তদের প্রেমের তত্ত্ব কথা শোনান। গল্পে গল্পে তিনি আমাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেন, ছেলেটি ও মেয়েটির সঙ্গে। আমরা অবাক বিস্ময়ে এগোতে থাকি। গল্পের শেষে এসে গল্পকার এমন একটি টুইস্ট ঘটান যেটা তুল্য হতে পারে একমাত্র বিশ্বসাহিত্যের টুইস্ট মাস্টার রোয়াল ডালর সঙ্গে। প্রেমকে আত্মিক ফ্রেমে নিয়ে এসে গল্পকার এমন একটি খবর শোনান, যেটা পড়ে হতবাক হয়ে যায় আমরা। সাদ কামালীর বর্ণনায়, ‘একসময় ঘর থেকে বের হয়ে নিচু খেজুর গাছের ডাল থেকে শক্ত দু’টি কাঁটা এন নিজের দুই চোখের ভিতর আমূল বসিয়ে দেয় ছেলেটা। ভয়াবহ যন্ত্রণা আর রক্তপাতের ভিতরও বলে, বাইরের চোখ আমার দরকার নাই, এই চোখে আর কাউকে দেখতে চাই না। আমার প্রেম রূপ ভিতরে খোদাই হয়ে গেছে।’ একদিন পর মেয়েটি এই খবর পেয়ে, সে আত্মহুতির পথ খুঁজে নেয়। একরাতে চিঠি লিখে রাতের শেষ প্রহরে দুই হারিকেনের সব কেরোসিন চুলে শরীরে শাড়িতে মাখে। দিয়াশলাই হাতে নেয়। ছেলেটি খবর পেয়ে দ্রুত সেখানে গিয়ে মেয়েটির শেষ চিঠি পায় সেখানে সে লিখেছে, ‘অন্য কোনো ছায়ার ভয়ে তোমার বাইরের চোখ দু’টি নষ্ট করে দিয়েছ। আমার এই মন গান দেহ তো প্রেমে সমর্পণ করেছি, প্রেম ছাড়া কেউ এর দখল পাবে না। চিঠির শেষে ছেলেটির গাওয়া গানের দুই লাইন, রূপের স্বরূপ আসমানে ভাসে/আমার স্বরূপ দেখ হৃদয়ে হাসে।’ প্রেমকে উপজীব্য করে দর্শনের আতশ কাচ দিয়ে ডিটেইলিংয়ের যে কাজ তিনি করেছেন তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। (আগামী সংখ্যায় শেষ অংশ)

সাময়িকী কবিতা

ছবি

মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য মানবতারই জয়গান

ছবি

বইতরণী সাহিত্য পুরস্কার পেলেন শুক্লা গাঙ্গুলী

ছবি

‘শব্দঘর’ আহমদ রফিক সংখ্যা ও তাঁকে সম্মাননা প্রদান

ছবি

ঈশ্বরের সত্য দর্শন

ছবি

মঞ্চে প্রবেশ

ছবি

আমি মাকারিও নই

ছবি

মৃতজন গল্প রচনা করে

ছবি

সম্পত্তি বিতর্ক: কেন পদত্যাগ করতে হলো টিউলিপ সিদ্দিককে

ছবি

রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা ফেব্রুয়ারিতে

ছবি

মধুসূদনের সাহিত্যে নৈরাশ্যবাদ

ছবি

বিদূষী নবনীতা বনাম মানুষ নবনীতা

ছবি

দুটি অণুগল্প

ছবি

উপমা-চিত্রে দ্যোতনার সঞ্চারণ

সাময়িকী কবিতা

ছবি

প্রয়োজনে ডাক দিও

ছবি

মাকারিও

ছবি

আমার সহযাত্রী

ছবি

নাগিব মাহফুজের নির্বাচিত ১০ স্বপ্ন

ছবি

একটি ভাঙ্গা থালা

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের কবিতা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

বাদশা আকবর

ছবি

নগুগি ওয়া থিয়াঙ্গ’ও প্রতিরোধ এবং পুনর্জাগরণের প্রতীক নগুগি ওয়া থিয়াঙ্গ’ও

ছবি

সাহিত্যের ভবিষ্যৎ

ছবি

হৃদয় প্রক্ষালক কবি বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

ছবি

বহুবাচনিকতা ও শিল্পের নন্দন

ছবি

সেদিন দু’দ- এই বাংলার তীর

ছবি

বিকল্প জীবন

সাময়িকী কবিতা

ছবি

হার না মানা নারী জীবনের উপাখ্যান

ছবি

কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা

ছবি

‘যে-কোনো দেশে ভাল সাহিত্য-অনুবাদক খুব কম’

ছবি

দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড-এর কবি এলিয়ট

ছবি

আর এক সুন্দর সকালবেলায়

ছবি

আবার নরকুম্ভির ও মডার্নিজম

tab

সাময়িকী

সা দ কা মা লী র গ ল্প

নিজস্বতার অনন্য প্রমাণ

মিলন আশরাফ

কথা সাহিত্যিক সাদ কামালী

বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫

A world of images, capable of symbolizing the fertility of artist’s vision and of expressing his creative joy.

উইলিয়াম ফকনারের মতে, ‘লিখবার জন্য চাই অভিজ্ঞতা, দেখবার ক্ষমতা এবং কল্পনা।’ সাদ কামালীর গল্পের ক্ষেত্রে বিষয়গুলো সরাসরি সম্পৃক্ত। তার প্রমাণ রাঁচী গ্রন্থনিকেতন থেকে বের হওয়া গল্প সংকলন সাদ কামালীর ‘প্রিয় গল্পগুলো’। গত দু’দশক ধরে গল্পকার যেসব গল্প লিখেছেন তার মধ্য থেকে তাঁর পছন্দের তালিকায় এই বইয়ে রেখেছেন ২৬টি গল্প। নিজস্ব রচনাশৈলী আর গভীর অন্তর্দৃষ্টির ক্ষমতাবলে তিনি পাঠকের মনে স্বতন্ত্র একটি অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন ইতোমধ্যেই। ‘অবশেষে নিঃশব্দ অন্তিমে’র (১৯৯২) গল্পগ্রন্থ নিয়েই কথাসাহিত্যের ভুবনে তাঁর পদার্পণ। লেখকের ‘গল্পের গল্প অথবা গল্পবোধের আত্মজৈবনিক পাঠ’ থেকে আমরা জানতে পারি, অবশেষে নিঃশব্দ অন্তিমে গল্পটি তাঁর দ্বিতীয় প্রকাশিত গল্প। এটি তাঁর নিজের সম্পাদিত ‘আবহমান ভাঙ্গা’য় প্রকাশিত হয়। সেই সময়ে অনেকে গল্পটা সম্পর্কে মতামত দেন, ‘চলচ্চিত্র বোধ ও চলচ্চিত্রের ভাষার প্রভাব লক্ষণীয়।’ সেইজন্যেই সচেতন পাঠক মাত্রই উক্ত গল্পটা পড়ার সময় মনে পড়ে যেতে পারে প্যাট্রিক সুসকাইন্ড রচিত পারফিউম (দ্য স্টোরি অব এ মার্ডারার) উপন্যাসটির কথা। এটি ২০০৬-এ চলচ্চিত্রের রূপদান করা হয়। ওখানে আমরা দেখতে পাই, নায়ক গন্ধ শুঁকে শুঁকে প্রত্যেকটা জিনিস আলাদা করার চেষ্টায় রত ঠিক অনুরূপ ‘অবশেষে নিঃশব্দ অন্তিমে’র প্রধান চরিত্র সাগর খেলে শব্দ নিয়ে। গল্পের শুরুতে গল্পকার প্রধান চরিত্রের পরিচয় করিয়ে দেন এভাবে, ‘সাগর বরাবর অন্তর্মুখী নিঃসঙ্গতা প্রিয়। স্বপ্নময় উদাসীন এবং বিষণœ।’ তার এই উদাসীনতা ও বিষণœতাকে পুঁজি করে সাদ কামালী চরিত্রের মগজের ভেতর পুরে দেন প্রখর শ্রবণশক্তি, শব্দ চিহ্নিত করা এবং চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়ে বিস্মিত করার ক্ষমতা। সঙ্গে সঙ্গে প্রাণ পেয়ে প্রধান চরিত্র সাগর বলে ওঠে, ‘সবকিছুর নিজস্ব শব্দ আছে এবং ভিন্ন ভিন্ন শব্দ সৃষ্টি হয়ে স্বতন্ত্র অর্থ প্রকাশ করে। শব্দ বিষয় ও দৃশ্যকে গভীর ব্যঞ্জনায় আরো বিস্তৃত করতে পারে।’ এরপর সাদ কামালী ভাত খাওয়ার আওয়াজকে টেনে এনে সাগরকে দিয়ে শ্রেণিবৈষম্যের সূক্ষ্মপাঠ আমাদের মস্তিষ্কে গেঁথে দিয়ে বলেন, ‘বিত্তহীনদের খাওয়ার আওয়াজ প্রায়ই জান্তব ধরনের, আর উচ্চবিত্তদের আওয়াজে থাকে তুচ্ছতা।’ প্রকৃতির চরিত্ররাও মিশে যায় গল্পে। কাক ও দোয়েলকে নিয়ে এসে শব্দের বিভাজনে মেতে ওঠে সাগর। এরপর একে একে পানির শব্দ, আগুনের শব্দ, ফ্লোরে পয়সা পড়ার শব্দ, শুকনো পাতার উপর দিয়ে হাঁটার শব্দ, কাগজের শব্দ, নতুন টাকার শব্দ সবই চিনিয়ে দেন তিনি। কিন্তু মানুষ পোড়ার শব্দ নিয়ে পরীক্ষা করার কথা যখন আমরা শুনি তখন ভয়ে কুঁকড়ে সাগরের কথায় কান পাতি, ‘মানুষ পুড়তে পুড়তে যে শব্দ হয় তার থেকে কাঠ অন্যরকম শব্দ করে পোড়ে, তোমরা বুঝতে পারছো না?’ না আমাদের দম বন্ধ হয়ে যায় কানে আঙুল চেপে শব্দ করেই যেন বলে ফেলি ‘না’। অবশেষে নিঃশব্দ অন্তিমে গল্পটা পড়তে গিয়ে পাঠকদের হয়ত ২০১২-তে নির্মিত জাতীয় পুরস্কার জয়ী কৌশিক গাঙ্গুলীর ‘শব্দ’ সিনেমার কথাটাও আসতে পারে ঘুরেফিরে। দুটো গল্পই ‘শব্দ’ কেন্দ্রিক। তবে এখানে বলা রাখা ভালো সাদ কামালী’র গল্পটা বেরিয়েছিল ১৯৯১ আর ‘শব্দ’ সিনেমা ২০১২। সাদ কামালীর এই প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘অবশেষে নিঃশব্দ অন্তিমে’র কথা বলতে যেয়ে প্রাবন্ধিক অধ্যাপক সৌভিক রেজা একটি প্রবন্ধ ‘সাদ কামালীর গল্প : একজন পাঠকের দৃষ্টিতে’ লেখেন, “নিঃশব্দতার গল্প বলেন সাদ কামালী, এবং সেইটি নিঃশব্দেই কখনো কখনো। মানবীয় চেতনার মধ্যে দিয়ে যে-কাহিনী তিনি বয়ন করেন, তাকে নিঃশব্দ ছাড়া আর কী-ই-বা বলতে পারি। আর এ-ও তো আমাদের অনেকেরই জানা যে শব্দময়তার চাইতেও কখনো-কখনো নৈঃশব্দ্যের ব্যঞ্জনা এবং তাৎপর্য অনেক বেশি।” (প্রতিপদ, মার্চ ২০০৬)

সাদ কামালী প্রথম থেকেই গল্পের চেনা রাস্তা পাশ কাটিয়ে স্বতন্ত্র ভাষা নির্মাণের দক্ষতায় আমাদের নিয়ে গিয়েছেন ভিন্ন পথে। সেই পথ তাঁর নিজেরই তৈরি। কথাসাহিত্যের প্রবাদ পুরুষ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সাদ কামালীর প্রথম গল্পগ্রন্থ পড়ে বলেছিলেন, ‘... সুখ উপভোগ করার মতলবে তিনি শিল্পচর্চায় নিয়োজিত হননি, সুখ তাঁর লক্ষ্য নয়। প্রতিটি কদমের স্পন্দন থেকে বোঝা যায় যে তাঁর প্রস্তুতি রয়েছে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার।’ তাঁর কথা আজ সত্য হয়েছে পাঠক মাত্রই এখন তা অনুমেয়। প্রাবন্ধিক অধ্যাপক সৌভিক রেজা তার প্রবন্ধ‘সাদ কামালীর গল্প : একজন পাঠকের দৃষ্টিতে’ লেখেন, “সাদ কামালীরগল্পের শরীর থেকে জমজমাট কাহিনী ধীরে ধীরে বিদায় নেয়ার পরিবর্তে চরিত্রের অন্তর্লীন অনুভূতির সারাৎসার গল্পের সারা দেহে জড়িয়ে থাকে। ফলে, সাদ কামালীর এইসব গল্প হয়ে ওঠে চরিত্রেরই এক ধরনের স্বগত-কথন। মাঝে মাঝে এই স্বগত-কথন পাঠকেরও নিজস্ব ভাষা বলে মনে হয়। তার সঙ্গে যুক্ত হয় লেখকের নিজস্ব অনুভব। সব মিলিয়ে গল্পগুলো হয়ে দাঁড়ায় ‘বাতাসের সাথে বৃক্ষের ফিসফাস’। প্রকৃতপক্ষে, এইভাবে সাদ কামালীর স্বাতন্ত্রিকতা অভিব্যক্ত হতে থাকে। (প্রতিপদ, ২০০৬)

দুই দশকে একে একে বিচিত্র বিষয়ের ওপর নয়টি গল্পগ্রন্থ (অবশেষে নিঃশব্ধ অন্তিমে, অভিব্যক্তিবাদী গল্প, উপকথার আপেল, তেলাপোকার জার্নাল, জন্মে জন্মে যাত্রা, জিয়াফত, সাদা রক্ত এবং মুক্তিযুদ্ধের গল্প) উপহার দিয়েছেন তিনি আমাদের; পরীক্ষামূলক গল্প এমনকি গল্পপ্রবন্ধ-এর মতো নিরীক্ষামূলক প্রবন্ধগ্রন্থউপহার দিয়েছেন। জীবনের লুক্কায়িত সত্যকে চোখে আঙুল দিয়ে আমাদেরকে দেখিয়ে দেখিয়ে তাঁর গল্পের ভুবনে প্রবেশ করান। চোখ ডলতে ডলতে সেই গল্পের ভুবনে গিয়ে হাবুডুবু খেতে থাকি আমরা। মুক্তির পথ খোঁজার জন্য ছটফট করি। চিন্তার মগজকে তিনি শিরীষ কাগজ দিয়ে এমনভাবে কষে ঘষা মারেন মৃত্যু অবধি সেই জ্বালা থেকে মুক্তির কোনো পথ পায় না চিন্তাশীল পাঠক। ভূরিভূরি পাঠক সৃষ্টির নামে তথাকথিত যে জনপ্রিয়তার ধারা চলে আসছে, দুই দশক ধরে তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এক প্রকারের যুদ্ধই ঘোষণা করেছেন তিনি। বাংলাদেশের এক কবি তাঁর ফেসবুক স্টাটাসে যথার্থই লিখেছিলেন, ‘সাদ কামালী’র গল্প মানেই দু’নলা বন্দুক।’ সাদ কামালী সেই গল্পের কারিগর যিনি ছেনি হাতুড়ি দিয়ে জীবনের বাস্তবতাকে নিখুঁতভাবে গড়ে তোলেন। আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখি ‘জিয়াফত’ গল্পের ভেতরে তিনি কীভাবে মৃত কন্যার শরীরের মাংস কেটে তারই সন্তানদের সামনে পরিবেশন করছেন। অন্যখানে ‘জন্মে জন্মে যাত্রা’ গল্পের শুরু হয় উপনিষদের একটি শ্লোকের মাধ্যমে। শ্লোকের মূল বিষয় ‘আমিই বাস্তবিক, আমিই এই সবাকার কারণ; আমা হইতেই আমি সৃষ্টি নির্গত করিয়াছি।’ গল্পে গল্পে সাদ কামালী আমাদেরকে দার্শনিক এক তত্ত্বে আগ্রহী করে তোলেন। তিনি বলেন, একই জীবনের মধ্যে বহুজীবন মানুষ ধারণ করে। মানুষের শুধু খোলসটা পাল্টায় ভেতরটা থাকে একই। এ যেন এক জীবন থেকে অন্য জীবনে যাত্রা। প্রধান চরিত্র আলীনূরের মুখে বসিয়ে দিচ্ছেন জন্মতত্ত্বের এক গভীর সত্য। ‘...আমারে আমি জন্ম দিছি, তুই তোরে জন্ম দিছোস, এইটাই জন্মের আসল কথা।’ আলীনূর কণ্ঠে সুর বসিয়ে বলে,

‘বুঝলি না মর্ম কথা

জীবন নাট্যের রূপ-ব্যথা

অনেক কষ্টের গোলা ঘরে

মাঝে মধ্যে ডাকাত ডাকরে’

গল্পের এরকম দার্শনিক তত্ত্বে সাধারণ পাঠকরা হোঁচট খেলেও জিত হয় সচেতন পাঠকের। আলীনূররা একাধিকবার জন্ম নেয়, খোলস পাল্টায়। গল্পে আরো যুক্ত হয় জীবনযুদ্ধে হেরে যাওয়া, পোড় খাওয়া, মুখোশপরা মানুষের লালসার শিকার মফস্বলের যৌনকর্মী আলো, মায়া, ছায়া, আলেয়া। তাদের সঙ্গে সংক্রমিত হয়ে পাঠকরাও যেন বুঁদ হয়ে শোনে গোয়ালন্দ ঘাটের পতিত মানুষের জীবনের গল্প। চান্দু বয়াতি ও আলীনূরের বাহাসের মাধ্যমে গল্পকার আমাদেরকে নিয়ে যায় শরীয়ত ও মারেফাতের গভীর দর্শনে। আলীনূর গানে এবং কথার ফাঁদ ও জীবন দিয়ে উপনিষদের শ্লোক আমাদের সামনে মূর্ত করে তুলে ধরে।

গরিবের প্রধান শত্রু ক্ষুধা। গল্পকার বলেন, ‘মানুষের প্রবৃত্তিগুলির মধ্যে ক্ষুধা প্রবৃত্তি মানুষকে বিপর্যস্ত করে ফেলে বেশি।’ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চান্দু বয়াতি জলপান ছাড়া আর কিছুই মুখে তোলে না। তার বিশ্বাস আহারখাদ্যের চাপের প্রাণ মরে যায়। গল্পকারের ভাষায়, ‘তার সামনে সাদা ফুলের মতো ভাত, ধোঁয়া ওড়া চা, মাছ মাংসের কতকিছু দেখা যায় কিন্তু তার লোভ হয় না। তার বউমা সালে পাত থেকে ভাত তুলে রাখে কিন্তু সে ভাত মুখে তোলে না সে।’ এটা তো গেলো ‘ক্ষুধা’ গল্পের মোটা দাগের কথা। চান্দু বয়াতির বয়ান-

গাঙের জলে সকল ভাসে

ভাসারে তোর মন

একই দিশায় যা যা চলে

কী আনন্দেরই জেবন

জলের ওপর নাও চলে

পালে লাগে বাতাস

খুদা তিষ্ণা দেনা ফেলে

হবেরে সংসার সুখের বাস।

এবার আমরা যদি ফোকাসটা অন্যদিকে সরাই তাহলে দেখতে পাবো লেখক অন্য আর এক ক্ষুধার ইঙ্গিত দিচ্ছেন। গল্পের ভেতরে ঢুকে আমরা শুনতে পাই আলেয়ার কণ্ঠ। কেন আলেয়া হাত ছুঁয়ে মাপ চাইতে গিয়ে তার ঠোঁট এবং হাতের আঙুল ভীষণ কেঁপে উঠেছিল? আলেয়ার জবানে আরো একটা বাক্য আমাদেরকে ভাবনার জগতে নিয়ে যায়, ‘মাঝে মাঝে আইসেন, আপনেরে দেখলে মনে শান্তি লাগে।’ এ যেন মানিকে’র সেই কুসুম যে শশীর সামনে গিয়ে নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, ‘আপনার কাছে দাঁড়ালে আমার শরীর এমন করে কেন ছোটোবাবু?’ উত্তরে ছোটোবাবু বলিয়াছিলেন, ‘শরীর, শরীর তোমার মন নেই কুসুম।’ কিন্তু আমাদের আলোচনার গল্পে বয়াতিছোটোবাবুর মতো স্কুলের পাস করা নয়, সে জুতসই কোনো উত্তর দিতে পারেনি। যার ফলে তার আচরণে কেমন একটানিষ্ঠুরতা ঢুকে পড়ে। এই নিষ্ঠুরতা আলেয়াকে দমাতে চেয়েছিল। ঠিক তখনই গল্পকার আমাদের একটা সংশয় বাক্য শুনিয়ে দেন, ‘আলেয়া কি জানে না তার শরীর তখন ভয়াবহ ক্ষুধায় পুড়ছে?’ কিন্তু পাঠকের কাছে বিষয়টা নিয়ে আর কোনো সংশয় থাকে না। আমরা বুঝে ফেলি তিনি দৈনিক আহারের পাশাপাশি কোন্ দিকে দৃষ্টি ফেরাতে বলছেন।

এই ভোগবাদী সমাজে ভোগের নেশায় ব্যতিব্যস্ত মানুষ থেকে শুরু করে প্রাণি পর্যন্ত। গল্পের শেষে এসে আমরা টের পাই, ফোঁস ফোঁস শব্দে ফণা তুলে গর্ত থেকে একটা সাপ সকল অধিকার নিয়ে এগিয়ে আসছে তার ক্ষুধা নিবারণ করতে। বয়াতিকে দেখে প্রথমে সে ভাবে, এটা হয়ত বড় মাপের ব্যাঙ। কিন্তু দুটি শুকনো চিমসে পা দেখে সাপের ভুল ভাঙে। তাকে প্রতিদ্বন্দ্বি ভাবতে শুরু করে সাপটা। ফণাটা আরো ফোলায়। কিন্তু বয়াতির কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে শুকনো মৃতপ্রায় কাঠ ভেবে ফণা নামিয়ে নদীর দিকে চলে যায়। কী জানি সাপটা হয়ত তাকে করুণা দেখায়। বয়াতি হিংস্রভাবে সাপের ছুটে যাওয়া দেখে। কোথাও না কোথাও সাপটা তার ভোগের বস্তু পাবে। আহত চোখে বয়াতি সেটা দেখে আর ভাবে, অবাঞ্চিত এই আমি ক্ষুধা নিবারণে কোথায় যাবো?

‘বাহাস’ গল্পে বাউল বা ফকিরি জীবনের ভেতর বাড়ির উঠোনের খবর জানান দেন গল্পকার। বাউল সংসারের ভেতরের দ্বন্দ্বকে দক্ষ হাতে নিপুণ শিল্পীর মতো এঁকেছেন তিনি। ‘বয়াতির নিজস্ব আখ্যান’ এই ঘরোয়ানার আরেকটি গল্প। গল্পকার এই গল্পে বয়াতির বয়ানে শোনান উল্টো এক ভাবের কথা। বয়াতি বলে, ‘সত্যকে ভজন করো না, যা সত্য ভাবো তা সত্য নয়, সত্য সাপের মাথার মণি।’ নুরু বয়াতি আরো জানায়, ‘ত্যাগ নয়, ভোগই ধর্ম, ভোগের ধর্ম বিসর্জন দিও না।’ পাঠকরা এখানে এসে বেশ ঘোরে পড়ে যায়, চিরকালীন ত্যাগই ধর্ম কথাটির বিপরীতে অবস্থান নেওয়া কী চাট্টিখানি কথা। এধরনের বিপরীত স্রোতে লড়াই করতে আহ্বান জানান সাদ কামালী।

সুফিবাদ বা ফকিরী সাধনা আমাদের শাশ্বত জীবনধারায় শত বাধার মুখেও বহমান। শারিয়াপন্থী, মতলববাজ ধর্মাধিকারী সঙ্ঘ, খোলাবাজার, পুঁজি আর প্রযুক্তির সুলভ সমাগম সুফি ঘরানার সার্বজনীন বিশ্বাসের চর্চায় আঘাত করেও নির্মূল করতে পারেনি। অন্যদিকে, শিল্প জিজ্ঞাসার আধুনিকতম অন্বেষণে মানবিক মৌলধারা, হারিয়ে যাওয়া জীবনের সরল সৌন্দর্য পুনঃআবিষ্কার উত্তর-আধুনিক শিল্প-প্রয়াসে প্রবল হয়ে ওঠে। এই ধারাবাহিকতায় আমাদের শিল্প-সাহিত্যও আলোড়িত, গল্পকার খোঁজ করেন শাশ্বত জীবনের গভীর আনন্দ, ফকিরী সাধনার রহস্যঘেরা বাতেনি জগত, ফকিরী জীবন। সাদ কামালীর গল্প “যখন নিঃশব্দ শব্দরে খাবে”-র চরিত্র কবি যশোপ্রাথী তরুণ আলাল ম-ল ফকিরী সাধনার শব্দ বৈভবে ও আধ্যাত্মিক রসে মজে, তথাকথিত আধুনিক কবিতা রচনার বদলে ফকিরী গীত কবিতা রচনা ও সাধনায় মশগুল “খুঁজে দেখ খুঁজে নেও গোপন ভারার / খোসা ভেঙে জিবে তোলো আনন্দ পসার।” আলাল ম-ল সে আনন্দের মোকামে এখনো পৌঁছল না, খোসা খসিয়ে আমূল সাফিনা হয়ে পড়ল না অনেক কিছুই। রহস্যঘেরা বাতেনি জগতের যে সাধনা সে তো আনন্দেরই পথ। সেই আনন্দ আর অহঙ্কারের গোমরে যুগ যুগ ধরে ফকিরী শব্দে বাক্যে আলো-আঁধারির চাদর বোনা। চাদরের হিসাব করা সুতারফাঁসে পানি নিংড়ে পড়ে মাছের আস্তরূপ ঝলসে উঠবে চাঁদের জোছনায়। মাছবস্তুর রূপ ও স্বরূপ, জোছনা, পানি আর চাদরের গুণ ধরিয়ে দিবে মুর্শিদ, কর মুর্শিদের ভজনা।

‘অনূঢ়া আখ্যান’ গল্পে পৌরাণিক কাহিনিকে চমৎকারভাবে কাজে লাগিয়ে, কাব্যময় ভাষায় একজন অনূঢ়া বৃদ্ধার সন্ধ্যার মুহূর্তে অপরূপ অম্বার ছবির সংক্রামে শরীরে সেই ষোল বছরের যৌবন ফিরে পাওয়ার গল্প শোনান গল্পকার। এই গল্পটা নিয়ে তারসমসাময়িক গল্পকার সুশান্ত মজুমদার লেখেন, ‘যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে মানুষের অবদমিত কামনা-বাসনাকে রূপ দিয়েছেন ‘অনূঢ়া আখ্যান’ গল্পে। মিথের ব্যবহার, মনস্তত্তের বিশ্লেষণ, পরিপ্রেক্ষিত মিলিয়ে ‘অনূঢ়া আখ্যান’ একটি উত্তম গল্প।’। ‘অনূঢ়া আখ্যান’ গল্পে পৌঢ় বয়সে এসে চিরকুমারী অম্বা নিজের শরীর-বিষয়ে যেন হঠাৎ করেই সচেতন হয়ে ওঠে। সে তখন স্বমৈথুনে রোমাঞ্চিত, খানিকটা বিচলিতও বটে। মাঝে-মাঝেই সে স্মৃতি-রোমন্থনে বিবশ এবং স্বগত-কথনেও : ‘সুখের নাগর আমি দূরে ঠেলিনি, তুমিই পিতার পৈতা ছিলে বুকে জড়িয়ে; কায়স্থের মেয়েকে বিয়ে করার কথা দিয়েছিলে, পণ অঙ্কের হিসাবও মিলে গিয়েছিল, ঠিক তারিখে সানাই বেজে উঠল, অনেক রঙ উড়িয়ে সাজল বিয়ের বাড়ি, সারাদিন উপোস থেকে সাজলাম কনের সাজে, তখন খবর এলো বরযাত্রী আসছে না; কায়স্থের সাথে ব্রাহ্মণের এ বিয়ে হবে না। তোমার বাবা সমাজে অবাঞ্ছিত হওয়ার ভয়ে পালাল। লগ্নভ্রষ্টা আমি চিরকালের অম্বা হয়ে রইলাম।’

মুক্তিযুদ্ধের গল্প ‘ডান হাতের শক্তি ও শিহরন’। গল্পের শুরুতে আমরা দেখি নির্বাহী পরিচালক আশফাক খানের একটার পর একটা উপদেশ শুনতে শুনতে হিসাব কর্মকর্তা জামাল চৌধুরীর ডান হাতের আঙুলে শিরশির অনুভূত হয়, গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। চোখ বন্ধ করে তিনি এরকম অনুভূতিতে বেশ ভয় পেয়ে যান। সাবান দিয়ে ধুয়েও অনুভূতিটা কিছুতেই যায় না। সংকটের শুরুটা এখান থেকেই। এরপর একের পর এক আশ্চর্যরকম কাজ করতে থাকেন তিনি। ম্যাক্সির রড এমনভাবে ধরে রাখেন সেখানে দাগ পড়ে যায়। পাশে বসা অন্য যাত্রী ভয় পেয়ে যায়। জামাল চৌধুরীর তখন মনে হয় রড চেপে না ধরে লোকটির মাথা চেপে ধরলে তিনি নিশ্চিত, তার মাথার খুলি গুঁড়া হয়ে মগজে সেঁধিয়ে যেতো। একের পর এক এরকম গা শিরশির করা ঘটনা বর্ণনা করেন সাদ কামালী। বাড়িতে এসে জামাল চৌধুরী এসব গল্প করেন স্ত্রীর সঙ্গে। কিন্তু তার স্ত্রীর একথা শোনার কোনো আগ্রহ নেই। গল্পের আর একটু এগিয়ে নিয়ে গিয়ে আমাদেরকে এক ভয়ংকর ঘটনার মুখোমুখি দাঁড় করান গল্পকার। ইস্কাটন প্লাজায় কফি শপে বসে জামাল চৌধুরী ও সায়মা কফি ও প্যাটিস খাচ্ছিল। পাশের টেবিলে হাতে বল নিয়ে খেলছিল এক বালক। একসময় বলটি জামাল চৌধুরীর কাছে এলে এটা তুলে দিতে গিয়েই ঘটে বিপত্তি। মাথায় আদর করতে গিয়ে তাঁর ডান হাত শিরশির করে ওঠে। পাঁচ আঙুল দিয়ে করতলে নিয়ে ছেলেটির মাথার মাঝখানে গায়ের শক্তিতে চেপে ধরে। এভাবে একের পর এক চমকের মধ্য দিয়ে গল্পটি এগোতে থাকে। জামাল চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী, মুক্তিযোদ্ধা ভাই এবং একাত্তরের দালাল নির্বাহী পরিচালক আশফাক খানকে নিয়ে তিনি এমন একটি গল্প ফাঁদেন- যা পাঠকের মস্তিকে চিনচিনে ব্যথা ধরিয়ে দেয়। শেষ হয় একটা শ্বাসরুদ্ধ অবস্থার মধ্য দিয়ে, সায়মা অন্তঃসত্তা, এমন সময় লেখকের বর্ণনায়, ‘কী কারণে মিলিটারির দল আশফাক খানের ঘরে বসে একটু সময় নিয়ে জামাল চৌধুরীর ঘরে ঢোকে, চৌকির তলে না দেখেই সেমি-মিশিনগানের নল ঘুরিয়ে অনবরত ট্রিগার চেপে যায়, বিছানা বালিশে বেয়োনেট দিয়ে খোঁচায়, উঠানে উঁকি দিয়ে দরোজা খোলা ভাঙ্গা খড়ির ঘর দেখে। খুব বেশি হলে পঁচিশ হাত দূর।’ গল্পের চরিত্রের মতো আমাদেরও যেন হাসফাস লেগে যায়। এরপর কী ঘটে, কী ঘটে?তখন সায়মা নিজেই নিজের মুখে হাত চেপে ধরে ব্যথার কাতরধ্বনি রোধ করে, শক্ত করে চেপে ধরে, দম বন্ধ হবার মতো অবস্থা। অসহ্য যন্ত্রণার স্রোতে রক্ত বেরিয়ে আসে, রক্তের সঙ্গে আরও ময়লা বিজলা বিজলা কিছু। বাচ্চার মাথার চাঁদির অনেকটা এসে গেছে। জামাল চৌধুরী কামালের দিকে তাকিয়ে মরিয়া হয়ে বাচ্চার মাথা চেপে ধরে, আর একটু ভিতরে থাক বাবা, আর একটু। মায়ের গর্ভ থেকে মাথা বের করেই তো বিস্মিত ভয়ার্ত শিশু চিৎকার করে উঠবে। এই চিৎকার ঠেকাতেই জামাল চৌধুরী সায়মার দুই পা ফাঁক করে নিজের শক্ত চওড়া হাত দিয়ে বাচ্চার মাথা চেপে ধরে। গায়ের শক্তিতে ঠেসে আবার মায়ের জরায়ুতে ঢুকিয়ে দিতে চায়। বাবা আর একটু অপেক্ষা কর। জামাল চৌধুরীর মতো সায়মাও নিজের মুখ চেপে ধরে রেখে প্রসব যন্ত্রণার সকল কাতরধ্বনি বন্ধ করে রাখে।

প্রচলিত প্রেমের বাইরে গিয়ে তিনি এক অন্য প্রেমের গল্প শুনিয়েছেন ‘প্রেম’ নামক গল্পে। গল্পকার উপায় ঠাকুর সেজে ছেলেটি ও মেয়েটি সম্বোধনে একটি প্রেমের গল্প শোনান আমাদের। কুমার নদের উত্তর পাড়ে চ-ীদাসদি গ্রামে উপায় ঠাকুরের আস্তানা। সেখানে বসেই তিনি ভক্তদের প্রেমের তত্ত্ব কথা শোনান। গল্পে গল্পে তিনি আমাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেন, ছেলেটি ও মেয়েটির সঙ্গে। আমরা অবাক বিস্ময়ে এগোতে থাকি। গল্পের শেষে এসে গল্পকার এমন একটি টুইস্ট ঘটান যেটা তুল্য হতে পারে একমাত্র বিশ্বসাহিত্যের টুইস্ট মাস্টার রোয়াল ডালর সঙ্গে। প্রেমকে আত্মিক ফ্রেমে নিয়ে এসে গল্পকার এমন একটি খবর শোনান, যেটা পড়ে হতবাক হয়ে যায় আমরা। সাদ কামালীর বর্ণনায়, ‘একসময় ঘর থেকে বের হয়ে নিচু খেজুর গাছের ডাল থেকে শক্ত দু’টি কাঁটা এন নিজের দুই চোখের ভিতর আমূল বসিয়ে দেয় ছেলেটা। ভয়াবহ যন্ত্রণা আর রক্তপাতের ভিতরও বলে, বাইরের চোখ আমার দরকার নাই, এই চোখে আর কাউকে দেখতে চাই না। আমার প্রেম রূপ ভিতরে খোদাই হয়ে গেছে।’ একদিন পর মেয়েটি এই খবর পেয়ে, সে আত্মহুতির পথ খুঁজে নেয়। একরাতে চিঠি লিখে রাতের শেষ প্রহরে দুই হারিকেনের সব কেরোসিন চুলে শরীরে শাড়িতে মাখে। দিয়াশলাই হাতে নেয়। ছেলেটি খবর পেয়ে দ্রুত সেখানে গিয়ে মেয়েটির শেষ চিঠি পায় সেখানে সে লিখেছে, ‘অন্য কোনো ছায়ার ভয়ে তোমার বাইরের চোখ দু’টি নষ্ট করে দিয়েছ। আমার এই মন গান দেহ তো প্রেমে সমর্পণ করেছি, প্রেম ছাড়া কেউ এর দখল পাবে না। চিঠির শেষে ছেলেটির গাওয়া গানের দুই লাইন, রূপের স্বরূপ আসমানে ভাসে/আমার স্বরূপ দেখ হৃদয়ে হাসে।’ প্রেমকে উপজীব্য করে দর্শনের আতশ কাচ দিয়ে ডিটেইলিংয়ের যে কাজ তিনি করেছেন তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। (আগামী সংখ্যায় শেষ অংশ)

back to top