রাবেয়া খানম
কুসুমদাম-সজ্জিত, দীপাবলি তেজে
উজ্জ্বলিত নাট্যশালা সমরে আছিল
এ মোর সুন্দরী পুরী! কিন্তু একে একে
শুকাইছে ফুল এবে, নিভিছে দেউটি।
(প্রথম সর্গ, মেঘনাদবধ কাব্য)
এ এক পরাজিত রাজার ব্যর্থতার হাহাকার। যে রাক্ষস হয়েও মানুষ। ভি?লেন হয়েও নায়ক। ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ মাইকেল মধুসূদন দত্তের (১৮২৪-৭৩) দৃষ্টিভঙ্গি এক নতুন চেতনার আভাস দিয়েছেন। রাক্ষসরা এখানে রাক্ষসের রূপ ছিঁড়ে মানুষ হয়েছেন। প্রজাহিত রাজা, সন্তানের প্রতি ভালোবাসা, দেশপ্রেম, বীর-রাবণে এ বিবিধ মানবীয় গুণ প্রচল বিরুদ্ধ মধুকে মুগ্ধ করেছিল। ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ ১৮৬১ সালে দুই খণ্ডে নয়টি সর্গে প্রকাশিত হয়। প্রথম খ- ১ থেকে ৫ সর্গে জানুয়ারি মাসে এবং দ্বিতীয় খ- ৬ থেকে ৯ সর্গে আগস্ট মাসে প্রকাশিত হয়। মধুসূদন এটিকে ঠিক মহাকাব্য বলেননি, বলেছেন Epicling - ছোট মাপের মহাকাব্য। বীরবাহুর মৃত্যু সংবাদ থেকে শুরু করে মেঘনাদের হত্যা এবং প্রমীলার স্বামীর চিতারোহণ পর্যন্ত মোট তিন দিন ও দুই রাতের ঘটনা এখানে কথিত। রামায়ণ হতে মূল কাহিনী নেয়া হলেও রাবণ, মেঘনাদ, প্রমীলাকে অভিনবভাবে সৃষ্টির তাড়নায় কাহিনী ও চরিত্রের অদল বদল করে নিয়েছেন। যদিও এ কাব্যের পটভূমি চরিত্র সবই ধর্মকে আশ্রয় করে কিন্তু মধুসূদন তাঁদেরকে দাঁড়করিয়েছে মানবীয় আবেদনে। এই মহাকাব্যের কাহিনী বিন্যাস ও চরিত্র পরিকল্পনায় মধুসূদন বাম্লীকি ও কৃত্তিবাসের আদর্শকে সম্পূর্ণভাবে বাদ দিয়ে পাশ্চাত্য মহাকাব্যের আদর্শেই (বিশেষত হোমারের ‘ইলিয়াড’-এর আদর্শে) প্রণিত হয়েছিলেন। হোমার, মিল্টন, ভার্জিন, দান্তে, তাশো প্রভৃতি পাশ্চাত্য মহাকবিদের শিল্প ভাবনাই/দর্শনই তাঁকে আলো দেখিয়েছিল। মেঘনাদবধ কাব্যের যে ট্রাজিক পরিণাম তা গ্রিক ট্রাজেডিরই ছায়া অনুসৃত। এতে নির্মম ভাগ্যের অমোঘ লিখনই প্রধান হয়ে দেখা দেয়। দেবতা রামের পরিবর্তে রাক্ষস রাবণের দুঃখ ও নৈরাশ্য যন্ত্রণার প্রতি অধিক সহানুভূতি বোধ করেছেন। এবং তাঁকেই করেছেন নায়ক।এই কাব্যের ভাবের মতো ভাষার ক্ষেত্রেও তিনি অভিনবত্ব দেখিয়েছেন। অমিত্রাক্ষর ছন্দে ‘মেঘনাদবধ’ রচিত- যা বাংলা কাব্যে এক সার্থক যুগান্তকারী বিপ্লব।
বাংলার চিরাচরিত পয়ারের নির্দিষ্ট মাত্রা সংখ্যা বজায় রেখেই বিদেশি প্রভাবে অন্ত্যমিলহীনতা ও প্রবাহমানতা এনে এবং যতি স্থাপনের গতানুগতিক নিয়ম বাদ দিয়ে মধুসূদন বাংলা কাব্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দে জোর প্রতিষ্ঠা করেন।
মূলত ‘পদ্মাবতী’ নাটকেই প্রথম এর ক্ষীণ পরীক্ষামূলক প্রয়োগ তারপর ‘তিলোত্তমা সম্ভব’ কাব্যে এই ছন্দের ক্ষমতার ব্যবহার দেখান। সর্বোপরি ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ এই অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে বাংলা ছন্দের ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনয়ন করেন।
আধুনিক পাশ্চাত্য সাহিত্যে মানবতার নিজস্ব বোধ মধুসূদনের মনে এক নতুন সূর্যের আলো ছড়ায়। রাম-রাবণের সংগ্রামের মাঝে যুগচেতনানুসারে মানবিকতার পরিচয় তাঁকে অধিক নাড়া দিয়েছিল।
কাব্যের প্রথম দিকে প্রথম নারী চরিত্র হিসেবে আমরা পাই চিত্রাঙ্গদাকে। তিনি বীরবাহুর জননী। একটি মর্মস্পর্শী করুন ছবি। সন্তানকে হারিয়ে তাঁর হাহাকার-
“একটি রতন মোরে দিয়েছিল বিধি”
(প্রথম সর্গ)
এই চিত্রাঙ্গদা উপেক্ষিত স্ত্রী এবং অন্যায়ের প্রতি প্রতিবাদী স্বাধীন নারীর প্রতিচ্ছবি। একমাত্র পুত্রের মৃত্যুর কারণ হিসেবে স্বামীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে তিনি এতোটুকু দ্বিধাবোধ করেন না।
‘কে, কহ, এ কাল-অগ্নি জ্বালিয়াছে আজি
লঙ্কাপুরে হায়, নাথ, নিজ কর্ম্ম-ফলে,
মজালে রাক্ষসকুলে মজিলা আপনি।’
(প্রথম সর্গ)
স্বামীর প্রতি চিত্রাঙ্গদার এই অভিযোগ এই ক্ষাভে মানবীয় প্রকাশই বটে।
মন্দোদরী একন্তই বাঙালি নারী। বাঙালি মাতৃত্বের কোমল মহিমায় এক অপূর্ব সৃষ্টি। স্বামী-সন্তান-সংসার-ধর্মপালন নিয়ে তাঁর আত্মতৃপ্ত যাপন। কৃত্তিবাসের মন্দোদরী যেখানে পুত্রকে যুদ্ধবিরত রাখার জন্য পরম সুন্দরী নয় হাজার নারীর সেবার প্রলোভন দেখিয়েছিলেন সেখানে মাইকেল মন্দোদরীর মুখে আরোপ করলেন-
যাইবি রে যদি;
রাক্ষস-কুল-রক্ষণ বিরূপাক্ষ তোরে
রক্ষণ এ কাল রণে! এ ভিক্ষা করি
তাঁর পদ যুগে আমি।
(৫ম সর্গ)
খাঁটি বাঙালি মায়ের মতো ব্রত, উপবাস, প্রার্থনার মধ্যদিয়ে সেই বিপদ ঠেকানোর জন্য আত্ম নিগ্রহের কঠিন পথ বেছে নিয়েছেন। চিরন্তন মায়ের আকুলতাই এই চরম বিপদের বিশ্বস্ত আশ্রয়।
যুদ্ধ ক্ষেত্র হতে মেঘনাদের ফিরে আসতে দেরী প্রমীলা উৎকণ্ঠি হয়ে ওঠে। নিজেই যুদ্ধ সাজে লঙ্কাপুরীতে গিয়ে স্বামীর সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেন। এতে সখী বাসন্তী সংশয়িত, তাঁকে লঙ্কাপুরীতে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে কীনা এমন শঙ্কায় প্রমীলার উক্তি-
দানবনন্দিনী আমি রক্ষ:-কুল-বধু
রাবণ শ্বশুর মম, মেঘনাদ স্বামী
আমি কি ডরাই, সখি,ভিখারী রাঘবে
পশিব লঙ্কায় আজি নিজ ভুজ-বলে
দেখিবো কেমনে মোরে নিবারি নৃমণি
(৩য় সর্গ)
প্রমীলার এই তেজস্বিতায় দেখাযায়
সমসাময়িক বিদ্রোহী নারী ঝাঁসীর রাণী লক্ষীবাঈ এর প্রভাব। তিনি ছিলেন সিপাহী বিদ্রোহের নায়িকা। যা সংগঠিত হয়েছিলো “মেঘনাদবধ কাব্য” রচনার মাত্র চার বৎসর পূর্বে।
যোগীন্দ্রনাথ বসুর মতে,- “লক্ষ্মীবাঈয়ের বীরত্ব সমগ্র ভারতবাসীকে চমকিত করিয়াছিলো এবং যখন মধুসূদনের কল্পনায় প্রমীলার চিত্র প্রতিবিম্বিত হইতেছিল, তখনো লক্ষীবাঈ ভারতবাসীদিগের আলোচনার বিষয় ছিলেন।”
বাম্লীকির মানস প্রতিমা যদি হন সীতা, তবে মধুসূদনের মানস প্রতিমা প্রমীলা। রামায়ণের সীতা মানবী হয়েও দেবী। অপরদিকে মধুসূদনের হাতে সীতা দেবী হয়েও মানবী। এই মানবীয় স্পর্শের মায়াময় স্ফুরণই সীতা চরিত্রকে আমাদের কাছে নতুন করে আবেদনময়ী করে তুলেছে। এঁয়ো সীতার যে রূপ মধুসূদন আঁকলেন -
কৌটা খুলি, রক্ষোবধূ যতেœ দিলা ফোঁটা
সীমান্তে; সিন্দুর-বিন্দু শোভিত ললাটে,
গোধূলি-ললাটে আহা! তারা-রতœ যথা!
...আহা মরি, সুবর্ণ-দেউটি
তুলসীর মূলে যেন জ্বলিল, উজলি
দশ দিশ!
ধর্ম ত্যাগ করেছেন মধু কবি। তাই বলে বাঙালিত্ব ত্যাগ করেননি। তুলসীর “মূল ও সুবর্ণ দেউটি” চিত্রময়তায় তা স্পষ্ট। এই সীতা একান্তই বাঙালির ঘরের বধূ।
মধুসূদনের মানসপুত্র মেঘনাদ। মানুষ হিসেবে এবং বহুমুখী আবেদনের নিগড়ে মেঘনাদ মধুর মানস পুত্র। এই মেঘনাদ একদিকে যেমন বজ্র কঠোর বীর যোদ্ধা অপরদিকে তেমনি কুসুম-কোমল হৃদয়ের আদর্শ ভাই, আদর্শ স্বামী, আদর্শ সন্তান। মানবীয় পৌরুষের মাহত্ম্যই তাঁর চরিত্ররে অধিক উজ্জ্বল দিক। বীরবাহুর মৃত্যুর সংবাদে আত্মপীড়নে বিচলিত মেঘনাদ নিজেকে
“ছিঁড়িলা কুসুমদাম রোষে মহাবলী / মেঘনাদ;” (১ম সর্গ)
ভিতরে এই রুদ্র তেজ। কিন্তু বাইরে ধীর মস্তিষ্কের আচরণ ও আয়োজন। মেঘনাদের রথে ওঠার সময় স্ত্রী প্রমীলা অস্থির হয়ে পড়ে। তখন স্ত্রীর প্রেমের মর্যাদায় অত্যন্ত সচেতন আদর্শ স্বামীর মতোই তাঁর উচ্চারণ-
হাসি উত্তরীলা
মেঘনাদ, ইন্দ্রজিতে জিতি তুমি, সতী
বেঁধেছ যে দৃঢ় বাঁধে, কে পারে খুলিতে
সে বাঁধে
(১ম স্বর্গ)
আবার পঞ্চম স্বর্গে প্রমীলার নিদ্রাভঙ্গ দৃশ্যে-
প্রমিলার কর পদ্ম করপদ্মে ধরি
রথীন্দ্র, মধুর স্বরে, হায় রে, যেমতি
নলিনীর কানে অলি কহে গুঞ্জরিয়া
প্রেমের রহস্য কথা, কহিলা (আদরে
চুম্বি নিমীলিত আঁখি) ডাকিছে কূজনে
হৈমবতী ঊষা তুমি, রূপসী তোমারে
পাখি কুল! মিল প্রিয়ে কমল- লোচন
উঠ, চিরানন্দ মোর! সূর্যকান্ত মণি-
সম এ পরাণ, কান্তে; তুমি রবিচ্ছবি;-
তেজোহীন আমি তুমি মুদিলে নয়ন।”
(৫ম সর্গ)
এ এক চিরন্তন প্রেমিক পুরুষ। বীরত্বের আদর্শ রণক্ষেত্রে কিন্তু তাই বলে প্রেমিক স্বামীর আদর্শে কেন ত্রুটি থাকবে মূলত কবির প্রেম বুভুক্ষু হৃদয় মেঘনাদের মধ্য দিয়ে আকন্ঠ প্রেম সুধা পান করেছে। তা কেনা বুঝে
রাবনকে মধুসূদন উপস্থাপন করেছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। বন্ধু রাজনারায়ণ বসুকে (১৫ মে ১৮৬০) একটি চিঠিতে তিনি বলেছিলেন,...as a Jolly Christian youth, I don’t care a pin’s for head for Hinduism.I love the grand mythology of our ancestors it is full of poetry.I follow with an inventive head can manufacture the most beautiful things out of it.
স্ত্রী চিত্রাঙ্গদা এই যুদ্ধের জন্য দায়ী করেন রাবণকে। কিন্তু সীতাহরণে রাবণের কোন অশ্রদ্ধা বা কুৎসিত মনোভাব ছিল না। এ কেবলই ভগ্নি সুপর্ণখার অপমানের প্রতিশোধ কল্পে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার শক্তি পরাক্রম প্রদর্শন।
“হায় সুপর্ণখা,
কি কুক্ষণে দেখেছিলি, তুই রে অভাগী
কাল পঞ্চবটী বনে কালকূটে ভরা
এ ভূজগে (১ম সর্গ)
পুত্রহারা কাতর চিত্রাঙ্গদা কে সান্ত¡না দিতে গিয়ে রাবণ বলেন-
এক পুত্রশোকে তুমি আকুলা, ললনে,
শত পুত্রশোকে বুক আমার ফাটিছে,
দিবা নিশি। (১ম সর্গ)
এ এক প্রজাসচেতন রাজার হাহাকার। স্নেহশীলা পিতা রাবণ। বীর বাহুর মৃত্যুতে তাঁর মর্মদাহ
“হা পুত্র! হা বীরবাহু! বীরেন্দ্র কেশরী
কেমনে ধরিব প্রাণ তোমার বিহনে
(১ম সর্গ)
অতঃপর আবার-
“যে শয্যায় আজি তুমি শুয়েছ কুমার
প্রিয়তম, বীর-কুল-সাধ এ শয়নে
সদা! রিপুদলবলে দলিয়া সমরে,
জন্মভূমি-রক্ষাহেতু কে ডরে মরিতে
(১ম সর্গ)
বলে পুত্র কৃতিত্বে গৌরবোধও করেছেন পিতৃস্নেহের আপত্য গভীরতা প্রমূর্ত হয়ে উঠেছে মেঘনাদকে আশ্রয় করে। মেঘনাদের মৃত্যু সংবাদ শোনা মাত্র হতচেতন হয়ে পড়েন রাবণ। কিন্তু জ্ঞান ফেরার পর মুহূর্তেই প্রতিশোধ নিতে হয়ে উঠেছিলেন ভয়ংকর। মেঘনাদের মৃত্যু চিতার সামনে দাঁড়িয়ে রাবণের হৃদয় বিদায়ক হাহাকার-
“ছিল আশা, মেঘনাদ, মুদিব অন্তিমে
এ নয়নদ্বয়, আমি তোমার সম্মুখে-
সপি রাজ্য ভার, পুত্র, তোমায়, করিব
মহাযাত্রা। কিন্তু বিধি-বুঝিব কেমনে
তাঁর লীলা ভাঁড়াইলা সে সুখ আমারে!
ছিল আশা, রক্ষকুল রাজ-সিংহাসনে
জুড়াইব আঁখি, বৎস, দেখিয়া তোমারে,
বামে রক্ষঃকুললক্ষী রক্ষোরাণীরূপে
পুত্রবধূ। বৃথা আশা। পূর্ব্বজন্মফলে
হেরি তোমা দোঁহে আজি এ কাল-
আসনে!
কর্ব্বূর গৌরব রবি চির রাহু গ্রাসে!”
রাবণ চরিত্রের এই হাহাকারই মেঘনাদবধ কাব্যকে বীর রসের পরিবর্তে করুণ রসের প্রাধান্য দিয়েছে। মধুসূদনের মতে, “রাবণ চরিত্র, মাহাত্ম্য ও গৌরবময় আদর্শের প্রতীক। সমসাময়িক সময়ে রামের নৈতিক আদর্শ অপেক্ষা রাবণের দৈবের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা রক্ষা জন্য সংগ্রামের অধিকতর উপযোগিতা এবং প্রবল আবেদন আছে বলেই এ রাবণ রাক্ষস নয় একান্তই দেশপ্রেমিক মানবিক রাজা।”
লক্ষণ ও রাম চরিত্র ও দেবতার আবরণ ভেদ করে মানুষের কাতারে এসে দাঁড়িয়েছেন এবং তা অনেকটাই কাপুরুষোচিত। দুর্বল আত্মবিশ্বাস হেতু দৈব শক্তির সাহায্য আর পেছন হতে নিরাশ্রয় মেঘনাদকে বধ, কাপুরুষ মানুষেরই কাজ। ছোট ভাই লক্ষণকে হারানোর ভয়ে রাম স্ত্রী সীতাকে রক্ষা থেকেও পিছু হটতে চেয়েছিল। স্বামী মেঘনাদকে সাহায্যের জন্য স্ত্রী প্রমীলার যুদ্ধ সাজে আগমন, রাম কে শঙ্কিত করে তোলে। এই কাপুরষতা, এই দ্বিধা, এই শঙ্কা- এ সকল আচরণই দেব দেবীর পরিবর্তে চরিত্রগুলিকে মানুষচিত রূপ দান করেছে।
“মেঘনাদবধ কাব্যে” মধুসূদন ছন্দকে যেমন মুক্তি দিয়েছেন তেমনি দেবদেবী ও রাক্ষসের খোলস ভেঙ্গে চরিত্রগুলোকে মানবিক আবেদনে দাঁড় করিয়েছেন।
প্রথম জীবনে রবীন্দ্রনাথ মধুসূদনের “মেঘনাদবধ কাব্যে”র তীব্র সমালোচনা করলেও পরবর্তীকালে তাঁর ভুল বুঝতে পেরেছেন এবং তা স্বীকার করেছেন। করেছেন যর্থাথই সুন্দর একটি সমালোচনা। পরিণত রবীন্দ্রনাথের অভিমত “ইংরেজি ভাষায় ও সাহিত্যে মাইকেলের অধিকার ছিল প্রশস্ত, অনুরাগও ছিলো সুগভীর। সেই সঙ্গে গ্রীক, ল্যাটিন আয়ত্ত করে য়ুরোপী সাহিত্যের অমরাবতীতে তিনি আমন্ত্রিত হয়েছেন ও তৃপ্ত হয়েছেন সেখানকার অমৃত রস ভোগে।... মাতৃভাষায় তিনি এমন কাব্য আবাহন করলেন যে কাব্যে স্খলিতগতি প্রথম-পদ-চারণার ভীরু সতর্কতা নেই। এই কাব্যের বাহিরের গঠনে আছে বিদেশীয় আদর্শ। অন্তরে আছে কৃত্তিবাসী বাঙালীর কল্পনার সাহায্যে মিল্টন-হোমার প্রতিভার আতিথিসৎকার। এ আতিথ্যে অগৌরব নেই।
রাবেয়া খানম
বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫
কুসুমদাম-সজ্জিত, দীপাবলি তেজে
উজ্জ্বলিত নাট্যশালা সমরে আছিল
এ মোর সুন্দরী পুরী! কিন্তু একে একে
শুকাইছে ফুল এবে, নিভিছে দেউটি।
(প্রথম সর্গ, মেঘনাদবধ কাব্য)
এ এক পরাজিত রাজার ব্যর্থতার হাহাকার। যে রাক্ষস হয়েও মানুষ। ভি?লেন হয়েও নায়ক। ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ মাইকেল মধুসূদন দত্তের (১৮২৪-৭৩) দৃষ্টিভঙ্গি এক নতুন চেতনার আভাস দিয়েছেন। রাক্ষসরা এখানে রাক্ষসের রূপ ছিঁড়ে মানুষ হয়েছেন। প্রজাহিত রাজা, সন্তানের প্রতি ভালোবাসা, দেশপ্রেম, বীর-রাবণে এ বিবিধ মানবীয় গুণ প্রচল বিরুদ্ধ মধুকে মুগ্ধ করেছিল। ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ ১৮৬১ সালে দুই খণ্ডে নয়টি সর্গে প্রকাশিত হয়। প্রথম খ- ১ থেকে ৫ সর্গে জানুয়ারি মাসে এবং দ্বিতীয় খ- ৬ থেকে ৯ সর্গে আগস্ট মাসে প্রকাশিত হয়। মধুসূদন এটিকে ঠিক মহাকাব্য বলেননি, বলেছেন Epicling - ছোট মাপের মহাকাব্য। বীরবাহুর মৃত্যু সংবাদ থেকে শুরু করে মেঘনাদের হত্যা এবং প্রমীলার স্বামীর চিতারোহণ পর্যন্ত মোট তিন দিন ও দুই রাতের ঘটনা এখানে কথিত। রামায়ণ হতে মূল কাহিনী নেয়া হলেও রাবণ, মেঘনাদ, প্রমীলাকে অভিনবভাবে সৃষ্টির তাড়নায় কাহিনী ও চরিত্রের অদল বদল করে নিয়েছেন। যদিও এ কাব্যের পটভূমি চরিত্র সবই ধর্মকে আশ্রয় করে কিন্তু মধুসূদন তাঁদেরকে দাঁড়করিয়েছে মানবীয় আবেদনে। এই মহাকাব্যের কাহিনী বিন্যাস ও চরিত্র পরিকল্পনায় মধুসূদন বাম্লীকি ও কৃত্তিবাসের আদর্শকে সম্পূর্ণভাবে বাদ দিয়ে পাশ্চাত্য মহাকাব্যের আদর্শেই (বিশেষত হোমারের ‘ইলিয়াড’-এর আদর্শে) প্রণিত হয়েছিলেন। হোমার, মিল্টন, ভার্জিন, দান্তে, তাশো প্রভৃতি পাশ্চাত্য মহাকবিদের শিল্প ভাবনাই/দর্শনই তাঁকে আলো দেখিয়েছিল। মেঘনাদবধ কাব্যের যে ট্রাজিক পরিণাম তা গ্রিক ট্রাজেডিরই ছায়া অনুসৃত। এতে নির্মম ভাগ্যের অমোঘ লিখনই প্রধান হয়ে দেখা দেয়। দেবতা রামের পরিবর্তে রাক্ষস রাবণের দুঃখ ও নৈরাশ্য যন্ত্রণার প্রতি অধিক সহানুভূতি বোধ করেছেন। এবং তাঁকেই করেছেন নায়ক।এই কাব্যের ভাবের মতো ভাষার ক্ষেত্রেও তিনি অভিনবত্ব দেখিয়েছেন। অমিত্রাক্ষর ছন্দে ‘মেঘনাদবধ’ রচিত- যা বাংলা কাব্যে এক সার্থক যুগান্তকারী বিপ্লব।
বাংলার চিরাচরিত পয়ারের নির্দিষ্ট মাত্রা সংখ্যা বজায় রেখেই বিদেশি প্রভাবে অন্ত্যমিলহীনতা ও প্রবাহমানতা এনে এবং যতি স্থাপনের গতানুগতিক নিয়ম বাদ দিয়ে মধুসূদন বাংলা কাব্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দে জোর প্রতিষ্ঠা করেন।
মূলত ‘পদ্মাবতী’ নাটকেই প্রথম এর ক্ষীণ পরীক্ষামূলক প্রয়োগ তারপর ‘তিলোত্তমা সম্ভব’ কাব্যে এই ছন্দের ক্ষমতার ব্যবহার দেখান। সর্বোপরি ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ এই অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে বাংলা ছন্দের ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনয়ন করেন।
আধুনিক পাশ্চাত্য সাহিত্যে মানবতার নিজস্ব বোধ মধুসূদনের মনে এক নতুন সূর্যের আলো ছড়ায়। রাম-রাবণের সংগ্রামের মাঝে যুগচেতনানুসারে মানবিকতার পরিচয় তাঁকে অধিক নাড়া দিয়েছিল।
কাব্যের প্রথম দিকে প্রথম নারী চরিত্র হিসেবে আমরা পাই চিত্রাঙ্গদাকে। তিনি বীরবাহুর জননী। একটি মর্মস্পর্শী করুন ছবি। সন্তানকে হারিয়ে তাঁর হাহাকার-
“একটি রতন মোরে দিয়েছিল বিধি”
(প্রথম সর্গ)
এই চিত্রাঙ্গদা উপেক্ষিত স্ত্রী এবং অন্যায়ের প্রতি প্রতিবাদী স্বাধীন নারীর প্রতিচ্ছবি। একমাত্র পুত্রের মৃত্যুর কারণ হিসেবে স্বামীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে তিনি এতোটুকু দ্বিধাবোধ করেন না।
‘কে, কহ, এ কাল-অগ্নি জ্বালিয়াছে আজি
লঙ্কাপুরে হায়, নাথ, নিজ কর্ম্ম-ফলে,
মজালে রাক্ষসকুলে মজিলা আপনি।’
(প্রথম সর্গ)
স্বামীর প্রতি চিত্রাঙ্গদার এই অভিযোগ এই ক্ষাভে মানবীয় প্রকাশই বটে।
মন্দোদরী একন্তই বাঙালি নারী। বাঙালি মাতৃত্বের কোমল মহিমায় এক অপূর্ব সৃষ্টি। স্বামী-সন্তান-সংসার-ধর্মপালন নিয়ে তাঁর আত্মতৃপ্ত যাপন। কৃত্তিবাসের মন্দোদরী যেখানে পুত্রকে যুদ্ধবিরত রাখার জন্য পরম সুন্দরী নয় হাজার নারীর সেবার প্রলোভন দেখিয়েছিলেন সেখানে মাইকেল মন্দোদরীর মুখে আরোপ করলেন-
যাইবি রে যদি;
রাক্ষস-কুল-রক্ষণ বিরূপাক্ষ তোরে
রক্ষণ এ কাল রণে! এ ভিক্ষা করি
তাঁর পদ যুগে আমি।
(৫ম সর্গ)
খাঁটি বাঙালি মায়ের মতো ব্রত, উপবাস, প্রার্থনার মধ্যদিয়ে সেই বিপদ ঠেকানোর জন্য আত্ম নিগ্রহের কঠিন পথ বেছে নিয়েছেন। চিরন্তন মায়ের আকুলতাই এই চরম বিপদের বিশ্বস্ত আশ্রয়।
যুদ্ধ ক্ষেত্র হতে মেঘনাদের ফিরে আসতে দেরী প্রমীলা উৎকণ্ঠি হয়ে ওঠে। নিজেই যুদ্ধ সাজে লঙ্কাপুরীতে গিয়ে স্বামীর সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেন। এতে সখী বাসন্তী সংশয়িত, তাঁকে লঙ্কাপুরীতে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে কীনা এমন শঙ্কায় প্রমীলার উক্তি-
দানবনন্দিনী আমি রক্ষ:-কুল-বধু
রাবণ শ্বশুর মম, মেঘনাদ স্বামী
আমি কি ডরাই, সখি,ভিখারী রাঘবে
পশিব লঙ্কায় আজি নিজ ভুজ-বলে
দেখিবো কেমনে মোরে নিবারি নৃমণি
(৩য় সর্গ)
প্রমীলার এই তেজস্বিতায় দেখাযায়
সমসাময়িক বিদ্রোহী নারী ঝাঁসীর রাণী লক্ষীবাঈ এর প্রভাব। তিনি ছিলেন সিপাহী বিদ্রোহের নায়িকা। যা সংগঠিত হয়েছিলো “মেঘনাদবধ কাব্য” রচনার মাত্র চার বৎসর পূর্বে।
যোগীন্দ্রনাথ বসুর মতে,- “লক্ষ্মীবাঈয়ের বীরত্ব সমগ্র ভারতবাসীকে চমকিত করিয়াছিলো এবং যখন মধুসূদনের কল্পনায় প্রমীলার চিত্র প্রতিবিম্বিত হইতেছিল, তখনো লক্ষীবাঈ ভারতবাসীদিগের আলোচনার বিষয় ছিলেন।”
বাম্লীকির মানস প্রতিমা যদি হন সীতা, তবে মধুসূদনের মানস প্রতিমা প্রমীলা। রামায়ণের সীতা মানবী হয়েও দেবী। অপরদিকে মধুসূদনের হাতে সীতা দেবী হয়েও মানবী। এই মানবীয় স্পর্শের মায়াময় স্ফুরণই সীতা চরিত্রকে আমাদের কাছে নতুন করে আবেদনময়ী করে তুলেছে। এঁয়ো সীতার যে রূপ মধুসূদন আঁকলেন -
কৌটা খুলি, রক্ষোবধূ যতেœ দিলা ফোঁটা
সীমান্তে; সিন্দুর-বিন্দু শোভিত ললাটে,
গোধূলি-ললাটে আহা! তারা-রতœ যথা!
...আহা মরি, সুবর্ণ-দেউটি
তুলসীর মূলে যেন জ্বলিল, উজলি
দশ দিশ!
ধর্ম ত্যাগ করেছেন মধু কবি। তাই বলে বাঙালিত্ব ত্যাগ করেননি। তুলসীর “মূল ও সুবর্ণ দেউটি” চিত্রময়তায় তা স্পষ্ট। এই সীতা একান্তই বাঙালির ঘরের বধূ।
মধুসূদনের মানসপুত্র মেঘনাদ। মানুষ হিসেবে এবং বহুমুখী আবেদনের নিগড়ে মেঘনাদ মধুর মানস পুত্র। এই মেঘনাদ একদিকে যেমন বজ্র কঠোর বীর যোদ্ধা অপরদিকে তেমনি কুসুম-কোমল হৃদয়ের আদর্শ ভাই, আদর্শ স্বামী, আদর্শ সন্তান। মানবীয় পৌরুষের মাহত্ম্যই তাঁর চরিত্ররে অধিক উজ্জ্বল দিক। বীরবাহুর মৃত্যুর সংবাদে আত্মপীড়নে বিচলিত মেঘনাদ নিজেকে
“ছিঁড়িলা কুসুমদাম রোষে মহাবলী / মেঘনাদ;” (১ম সর্গ)
ভিতরে এই রুদ্র তেজ। কিন্তু বাইরে ধীর মস্তিষ্কের আচরণ ও আয়োজন। মেঘনাদের রথে ওঠার সময় স্ত্রী প্রমীলা অস্থির হয়ে পড়ে। তখন স্ত্রীর প্রেমের মর্যাদায় অত্যন্ত সচেতন আদর্শ স্বামীর মতোই তাঁর উচ্চারণ-
হাসি উত্তরীলা
মেঘনাদ, ইন্দ্রজিতে জিতি তুমি, সতী
বেঁধেছ যে দৃঢ় বাঁধে, কে পারে খুলিতে
সে বাঁধে
(১ম স্বর্গ)
আবার পঞ্চম স্বর্গে প্রমীলার নিদ্রাভঙ্গ দৃশ্যে-
প্রমিলার কর পদ্ম করপদ্মে ধরি
রথীন্দ্র, মধুর স্বরে, হায় রে, যেমতি
নলিনীর কানে অলি কহে গুঞ্জরিয়া
প্রেমের রহস্য কথা, কহিলা (আদরে
চুম্বি নিমীলিত আঁখি) ডাকিছে কূজনে
হৈমবতী ঊষা তুমি, রূপসী তোমারে
পাখি কুল! মিল প্রিয়ে কমল- লোচন
উঠ, চিরানন্দ মোর! সূর্যকান্ত মণি-
সম এ পরাণ, কান্তে; তুমি রবিচ্ছবি;-
তেজোহীন আমি তুমি মুদিলে নয়ন।”
(৫ম সর্গ)
এ এক চিরন্তন প্রেমিক পুরুষ। বীরত্বের আদর্শ রণক্ষেত্রে কিন্তু তাই বলে প্রেমিক স্বামীর আদর্শে কেন ত্রুটি থাকবে মূলত কবির প্রেম বুভুক্ষু হৃদয় মেঘনাদের মধ্য দিয়ে আকন্ঠ প্রেম সুধা পান করেছে। তা কেনা বুঝে
রাবনকে মধুসূদন উপস্থাপন করেছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। বন্ধু রাজনারায়ণ বসুকে (১৫ মে ১৮৬০) একটি চিঠিতে তিনি বলেছিলেন,...as a Jolly Christian youth, I don’t care a pin’s for head for Hinduism.I love the grand mythology of our ancestors it is full of poetry.I follow with an inventive head can manufacture the most beautiful things out of it.
স্ত্রী চিত্রাঙ্গদা এই যুদ্ধের জন্য দায়ী করেন রাবণকে। কিন্তু সীতাহরণে রাবণের কোন অশ্রদ্ধা বা কুৎসিত মনোভাব ছিল না। এ কেবলই ভগ্নি সুপর্ণখার অপমানের প্রতিশোধ কল্পে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার শক্তি পরাক্রম প্রদর্শন।
“হায় সুপর্ণখা,
কি কুক্ষণে দেখেছিলি, তুই রে অভাগী
কাল পঞ্চবটী বনে কালকূটে ভরা
এ ভূজগে (১ম সর্গ)
পুত্রহারা কাতর চিত্রাঙ্গদা কে সান্ত¡না দিতে গিয়ে রাবণ বলেন-
এক পুত্রশোকে তুমি আকুলা, ললনে,
শত পুত্রশোকে বুক আমার ফাটিছে,
দিবা নিশি। (১ম সর্গ)
এ এক প্রজাসচেতন রাজার হাহাকার। স্নেহশীলা পিতা রাবণ। বীর বাহুর মৃত্যুতে তাঁর মর্মদাহ
“হা পুত্র! হা বীরবাহু! বীরেন্দ্র কেশরী
কেমনে ধরিব প্রাণ তোমার বিহনে
(১ম সর্গ)
অতঃপর আবার-
“যে শয্যায় আজি তুমি শুয়েছ কুমার
প্রিয়তম, বীর-কুল-সাধ এ শয়নে
সদা! রিপুদলবলে দলিয়া সমরে,
জন্মভূমি-রক্ষাহেতু কে ডরে মরিতে
(১ম সর্গ)
বলে পুত্র কৃতিত্বে গৌরবোধও করেছেন পিতৃস্নেহের আপত্য গভীরতা প্রমূর্ত হয়ে উঠেছে মেঘনাদকে আশ্রয় করে। মেঘনাদের মৃত্যু সংবাদ শোনা মাত্র হতচেতন হয়ে পড়েন রাবণ। কিন্তু জ্ঞান ফেরার পর মুহূর্তেই প্রতিশোধ নিতে হয়ে উঠেছিলেন ভয়ংকর। মেঘনাদের মৃত্যু চিতার সামনে দাঁড়িয়ে রাবণের হৃদয় বিদায়ক হাহাকার-
“ছিল আশা, মেঘনাদ, মুদিব অন্তিমে
এ নয়নদ্বয়, আমি তোমার সম্মুখে-
সপি রাজ্য ভার, পুত্র, তোমায়, করিব
মহাযাত্রা। কিন্তু বিধি-বুঝিব কেমনে
তাঁর লীলা ভাঁড়াইলা সে সুখ আমারে!
ছিল আশা, রক্ষকুল রাজ-সিংহাসনে
জুড়াইব আঁখি, বৎস, দেখিয়া তোমারে,
বামে রক্ষঃকুললক্ষী রক্ষোরাণীরূপে
পুত্রবধূ। বৃথা আশা। পূর্ব্বজন্মফলে
হেরি তোমা দোঁহে আজি এ কাল-
আসনে!
কর্ব্বূর গৌরব রবি চির রাহু গ্রাসে!”
রাবণ চরিত্রের এই হাহাকারই মেঘনাদবধ কাব্যকে বীর রসের পরিবর্তে করুণ রসের প্রাধান্য দিয়েছে। মধুসূদনের মতে, “রাবণ চরিত্র, মাহাত্ম্য ও গৌরবময় আদর্শের প্রতীক। সমসাময়িক সময়ে রামের নৈতিক আদর্শ অপেক্ষা রাবণের দৈবের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা রক্ষা জন্য সংগ্রামের অধিকতর উপযোগিতা এবং প্রবল আবেদন আছে বলেই এ রাবণ রাক্ষস নয় একান্তই দেশপ্রেমিক মানবিক রাজা।”
লক্ষণ ও রাম চরিত্র ও দেবতার আবরণ ভেদ করে মানুষের কাতারে এসে দাঁড়িয়েছেন এবং তা অনেকটাই কাপুরুষোচিত। দুর্বল আত্মবিশ্বাস হেতু দৈব শক্তির সাহায্য আর পেছন হতে নিরাশ্রয় মেঘনাদকে বধ, কাপুরুষ মানুষেরই কাজ। ছোট ভাই লক্ষণকে হারানোর ভয়ে রাম স্ত্রী সীতাকে রক্ষা থেকেও পিছু হটতে চেয়েছিল। স্বামী মেঘনাদকে সাহায্যের জন্য স্ত্রী প্রমীলার যুদ্ধ সাজে আগমন, রাম কে শঙ্কিত করে তোলে। এই কাপুরষতা, এই দ্বিধা, এই শঙ্কা- এ সকল আচরণই দেব দেবীর পরিবর্তে চরিত্রগুলিকে মানুষচিত রূপ দান করেছে।
“মেঘনাদবধ কাব্যে” মধুসূদন ছন্দকে যেমন মুক্তি দিয়েছেন তেমনি দেবদেবী ও রাক্ষসের খোলস ভেঙ্গে চরিত্রগুলোকে মানবিক আবেদনে দাঁড় করিয়েছেন।
প্রথম জীবনে রবীন্দ্রনাথ মধুসূদনের “মেঘনাদবধ কাব্যে”র তীব্র সমালোচনা করলেও পরবর্তীকালে তাঁর ভুল বুঝতে পেরেছেন এবং তা স্বীকার করেছেন। করেছেন যর্থাথই সুন্দর একটি সমালোচনা। পরিণত রবীন্দ্রনাথের অভিমত “ইংরেজি ভাষায় ও সাহিত্যে মাইকেলের অধিকার ছিল প্রশস্ত, অনুরাগও ছিলো সুগভীর। সেই সঙ্গে গ্রীক, ল্যাটিন আয়ত্ত করে য়ুরোপী সাহিত্যের অমরাবতীতে তিনি আমন্ত্রিত হয়েছেন ও তৃপ্ত হয়েছেন সেখানকার অমৃত রস ভোগে।... মাতৃভাষায় তিনি এমন কাব্য আবাহন করলেন যে কাব্যে স্খলিতগতি প্রথম-পদ-চারণার ভীরু সতর্কতা নেই। এই কাব্যের বাহিরের গঠনে আছে বিদেশীয় আদর্শ। অন্তরে আছে কৃত্তিবাসী বাঙালীর কল্পনার সাহায্যে মিল্টন-হোমার প্রতিভার আতিথিসৎকার। এ আতিথ্যে অগৌরব নেই।