খুর্শিদা বারী
অষ্টাদশ শতাব্দীর একদম শেষভাগ (১৭৯৫) ও ঊনবিংশ শতাব্দীর সত্তর দশক (১৮৭৭), বাংলা নাট্যমঞ্চ যে সময়ে হাঁটি হাঁটি পা পা করে বড় হয়ে উঠছে সেটাই ছিল গিরিশচন্দ্র ঘোষের উত্তরাধিকার। অজিত কুমার ঘোষ লিখেছেন, ‘গিরিশচন্দ্র যে সময়ে নাট্যরচয়িতার আসনে অধিষ্ঠিত হইলেন, তখন বাংলার নাট্যসাহিত্যের শৈশব ও কৈশোর অতিক্রম করিয়া যৌবনের সূচনা দেখা দিয়াছে।’
সিপাহি বিদ্রোহ কেটে গেছে বেশ কিছুদিন হয়েছে। রানির হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়েছে কোম্পানি। কলকাতার বুদ্ধিজীবী মহলের একাংশ সিপাহি বিদ্রোহ নিয়ে সন্দেহগ্রস্ত ছিল। স্বয়ং বিদ্যাসাগর মহাশয়ও সিপাহি বিদ্রোহকে সমর্থন করেননি। কিন্তু কলকাতার সাহিত্য, নাট্যমঞ্চ নানা সংকেতের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার কথা বলেছে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৮২, ’৮৪ ও ’৮৭ সালে যথাক্রমে আনন্দমঠ; দেবীচৌধুরানী ও সীতারাম লিখলেন, জাতীয়তাবাদকে ধর্মের মোড়কে মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিলেন। গিরিশচন্দ্র মাইকেলের শর্মিষ্ঠা করেছিলেন তাঁর নাট্যনির্দেশনার গোড়ার দিকে। তারপর তিনি মেঘনাদবধকে নাট্যরূপ দিয়ে মঞ্চস্থ করলেন। রাবণ প্রথম অঙ্কের তৃতীয় দৃশ্যে বলছেন,
রিপুদলবলে দলিয়া সময়ে
জন্মভূমি রক্ষাহেতু কে ডরে মরিতে?
রাম-রাবণের যুদ্ধ যে রাবণের জন্মভূমি রক্ষার্থে সংগ্রাম, এই দৃষ্টিকোণ দিয়ে মাইকেল মেঘনাদবধকাব্য রচনা করেছিলেন এবং স্বভাবতই এটির নাট্যরূপ দেবার সময় পরাধীন ভারতের কথা হয়তো জেগেছিল গিরিশের মনে। তাই মেঘনাদবধকাব্য হয়ে উঠেছিল আগ্রাসনের কাহিনি, প্রতিরোধের কাহিনি। পরবর্তীকালে বেশ কিছু নাট্যকার পৌরাণিক কাহিনিতে ভারতের পরাধীনতার কথা ইঙ্গিতাকারে প্রকট করেছিলেন। মন্মথ রায়ের কারাগার (১৯৩০) নাটকটি কারাগারের অন্তরালে শ্রীকৃষ্ণের জন্ম অবলম্বনে রচিত হয়েছিল। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার এটিকে বাজেয়াপ্ত করেছিলেন। গিরিশ সরাসরি মাইকেলকে অনুসরণ করে মেঘনাদবধ নাটক রচনা করেছিলেন।
গিরিশের নাটকে যদি আগ্রাসন আর প্রতিরোধের কথা ওঠে, তবে তাঁর পৌরাণিক নাটক জনার কথা আসবেই। অজিত কুমার ঘোষের মতে, জনা গিরিশের শ্রেষ্ঠ পৌরাণিক নাটক। জনার কাহিনি মহাভারতের অশ্বমোধিক পর্ব থেকে গৃহীত। জনা রচিত ও মঞ্চস্থ হয় ১৮৯৪ সালে। এরই ঠিক এগারো বছর পর বঙ্গভঙ্গ নিয়ে সারা বঙ্গভূমি উত্তাল হয়ে ওঠে এবং তার তিন বছর পর ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসির ঘটনা দিয়ে বাংলায় অগ্নিযুগের সূচনা হয়।
গিরিশ ৮৬টি নাট্য রচনা করেন। তার মধ্যে ছিল পৌরাণিক, ঐতিহাসিক এবং সামাজিক নাটক। সাধারণ বাঙালির মত কৃত্তিবাসী রামায়ণ ও কাশীদাসী মহাভারত তাঁর মানসিক সংস্কৃতি গঠন করেছিল। পিতৃ-মাতৃহীন গিরিশের খুড়িমা শিশুকালে তাঁকে কৃত্তিবাসী রামায়ণ, কাশীদাসী মহাভারত পড়ে শোনাতেন। সেই ভাষা সেই পয়ার ছন্দের সুর গিরিশের অন্তরে প্রবিষ্ট হয়ে থেকে গিয়েছিল।
গিরিশের প্রতিভার চূড়ান্ত নমুনার কথা লিখেছিলেন ভগিনী দেবমাতা, তাঁর পুস্তক উধুং রহ ধহ ওহফরধহ গড়হধংঃবৎু’তে লেখেন, তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটক ছয় অঙ্ক বিশিষ্ট বিল্বমঙ্গল তিনি কোনোরকম বিরতি ব্যতিরেকে ২৮ ঘণ্টার মধ্যে লিখে শেষ করেছিলেন। এছাড়া শোনা যায়, সীতার বনবাস তিনি একরাত্রে লিখেছিলেন। সধবার একাদশীর ২৬টি গানও তিনি একরাত্রে শেষ করেছিলেন।
গিরিশচন্দ্রের ঐতিহাসিক নাট্যরচনার মানসিকতাকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নাটকের বীররস ও স্বদেশপ্রেমের দৃপ্ত সমন্বয় প্রভাবিত করেছিল। ইতিহাসকে অতিক্রম করে দুই নাট্যকারই কিছু স্বাধীনতা নিয়েছিলেন। ১৯০৬ সালে গিরিশ সিরাজদ্দৌলা লিখেছিলেন। তখন বাংলা রঙ্গমঞ্চে ঐতিহাসিক নাটকের স্বর্ণযুগ শুরু হয়েছে। নাট্যকার হিসাবে দ্বিজেন্দ্রলালের আবির্ভাব হয়েছে। ১৯০৩ সাল থেকে ১৯০৬ পর্যন্ত তিনি তারাবাই, রানা প্রতাপসিংহ ও দুর্গাদাস নাটক লিখে ফেলেছেন। ক্ষিরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদও বেশ কিছু ঐতিহাসিক নাটক লিখেছিলেন, যার মধ্যে প্রতাপাদিত্য, আলমগীর ও বাংলার মসনদ উল্লেখযোগ্য। গিরিশচন্দ্র প্রণীত সিরাজদ্দৌলা ছিল এই সবক’টির মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য এবং জনপ্রিয়। গিরিশের সিরাজদ্দৌলা শুধুমাত্র একটি ইতিহাস-ভিত্তিক রাজনৈতিক নাটক নয়, নাটকটিতে একটি শক্তিশালী ধর্মনিরপেক্ষতার বাণী ছিল। সিরাজ তাঁর প্রজ্ঞাবর্গকে বলেছেন:
ওহে হিন্দু মুসলমান-
এস করি পরষ্পর মার্জনা এখন
বংগের সন্তান-হিন্দু মুসলমান
বাংলার সাধহ কল্যাণ।
হেমন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন, ‘তিনি দেশাত্ববোধ রসে জারিত একাধারে সিরাজদ্দৌলা ও মীরকাশিম লেখেন ও মিনার্ভাতে মঞ্চস্থ করেন। সিরাজদ্দৌলা ও মীরকাশিম সেই প্রথম জাতীয়তার যুগে দেশের যুব সম্প্রদায়ের উপর যে অপূর্ব প্রভাব বিস্তার করিয়াছেন তাহা ভাষায় শেষ করা যায় না। মীরকাশিম নাটকে সুশীলাবালা অবতীর্ণ হতেন বেগমের ভূমিকায়। অভিনয় করার সময় তকী খাঁ’র হাতে তরবারি তুলে দিয়ে গান ধরতেন, ‘বীর করে তরবারি ধরে’- তখন দর্শকরা আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনিতে প্রেক্ষাগৃহে অভূতপূর্ব উন্মাদনা সৃষ্টি করতেন।
তাঁর সামাজিক নাটক ও রাজনৈতিক ঐক্যের সাথে ধর্মীয় ঐক্যকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়। ‘আমার মতে ভারতে রিলিজাস ইউনিট ভিন্ন আর কোন ইউনিটি হতে পারে না।’ (মায়াবসান নাটকে (১:৫) কালীকিঙ্করের সংলাপ, ১৮৯৮)
বাংলার নাট্যমঞ্চের ইতিহাসের মাঝখান থেকে ধরলে গিরিশচন্দ্র ঘোষ বলেন, ‘মহাকবি শেক্সপীয়রই আমার আদর্শ। তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলেছি।’ এদিকে বারবার মালিকানা বদলের পর বিশৃঙ্খল অবস্থার পরিণতি হিসাবে ৬ বিডন স্ট্রিটে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার অবশেষে বিলুপ্ত হয়ে যায়। স্বত্বাধিকারী মহেন্দ্রলাল দাসের কাছ থেকে খালি পড়ে থাকা সেই জমি লিজ নিয়ে একটি রঙ্গমঞ্চ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন পাথুরিয়াঘাটার প্রসন্নকুমার ঠাকুরের দৌহিত্র নাগেন্দ্রভূষণ মুখোপাধ্যায়। গিরিশচন্দ্রের সঙ্গে তখন স্টার থিয়েটারের সম্পর্ক তিক্ততায় পর্যবসিত হয়েছে, নাগেন্দ্রভূষণ তাঁকে এই নতুন থিয়েটারের দায়িত্ব গ্রহণের অনুরোধ জানান। থিয়েটারের নাম হল ‘মিনার্ভা থিয়েটার’, থিয়েটারের উদ্বোধন হল ১৮৯২ সালে। ১৮৯৩ সালের ২৮ শে জানুয়ারি এই মিনার্ভা থিয়েটারে মাধ্যমে কলকাতার মাটিতে বাংলা ভাষায় প্রথম শেক্সপীয়র অভিনীত হলো; গিরিশ ঘোষ অনূদিত ম্যাকবেথ। নাম ভূমিকায় ও পরিচালনায় স্বয়ং তিনি। পরিচ্ছদ ও মঞ্চসজ্জা করেন সুদক্ষ ইংরেজ চিত্রকরগণ। তারপর একে একে স্টার এমারেন্ড, মিনার্ভা, ক্ল্যাসিক, কোহিনুর- কলকাতার এমন কোনো স্টেজ নেই যেখানে তাঁর পায়ের ছাপ পড়েনি। কিন্তু বারবার তিনি মিনার্ভা’তে নিয়ে এসেছিলেন।
গিরিশ একদিকে যেমন বাংলার মহান সাহিত্যকে নাট্যরূপ দিয়ে মঞ্চে উপস্থাপিত করেছিলেন, যেমন- বঙ্কিমচন্দ্রের মৃণালিনী, বিষবৃক্ষ, ও দুর্গেশনন্দিনী, মাইকেল মধুসূদনের মেঘনাদবধকাব্য ও নবীন সেনের পলাশীর যুদ্ধ। অন্যদিকে মৌলিক ঐতিহাসিক নাটক লিখে নাট্যমোদীদের মনে দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তুলেছিলেন। ১৮৭২ সালে বাংলার সাধারণ থিয়েটারের জন্ম। নাট্যমোদী বাঙালি মধ্যবিত্তের কাছে বাংলা নাটকের দরজা খুলে গিয়েছিল গিরিশচন্দ্রের কারণে, তাঁর লিখিত নাটক নিয়ে, অত্যাধুনিক পরিচালনার দক্ষতা নিয়ে, মঞ্চসজ্জার বৈচিত্র্য নিয়ে সেই নব আন্দোলনকে সাফল্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।
খুর্শিদা বারী
বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারী ২০২৫
অষ্টাদশ শতাব্দীর একদম শেষভাগ (১৭৯৫) ও ঊনবিংশ শতাব্দীর সত্তর দশক (১৮৭৭), বাংলা নাট্যমঞ্চ যে সময়ে হাঁটি হাঁটি পা পা করে বড় হয়ে উঠছে সেটাই ছিল গিরিশচন্দ্র ঘোষের উত্তরাধিকার। অজিত কুমার ঘোষ লিখেছেন, ‘গিরিশচন্দ্র যে সময়ে নাট্যরচয়িতার আসনে অধিষ্ঠিত হইলেন, তখন বাংলার নাট্যসাহিত্যের শৈশব ও কৈশোর অতিক্রম করিয়া যৌবনের সূচনা দেখা দিয়াছে।’
সিপাহি বিদ্রোহ কেটে গেছে বেশ কিছুদিন হয়েছে। রানির হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়েছে কোম্পানি। কলকাতার বুদ্ধিজীবী মহলের একাংশ সিপাহি বিদ্রোহ নিয়ে সন্দেহগ্রস্ত ছিল। স্বয়ং বিদ্যাসাগর মহাশয়ও সিপাহি বিদ্রোহকে সমর্থন করেননি। কিন্তু কলকাতার সাহিত্য, নাট্যমঞ্চ নানা সংকেতের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার কথা বলেছে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৮২, ’৮৪ ও ’৮৭ সালে যথাক্রমে আনন্দমঠ; দেবীচৌধুরানী ও সীতারাম লিখলেন, জাতীয়তাবাদকে ধর্মের মোড়কে মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিলেন। গিরিশচন্দ্র মাইকেলের শর্মিষ্ঠা করেছিলেন তাঁর নাট্যনির্দেশনার গোড়ার দিকে। তারপর তিনি মেঘনাদবধকে নাট্যরূপ দিয়ে মঞ্চস্থ করলেন। রাবণ প্রথম অঙ্কের তৃতীয় দৃশ্যে বলছেন,
রিপুদলবলে দলিয়া সময়ে
জন্মভূমি রক্ষাহেতু কে ডরে মরিতে?
রাম-রাবণের যুদ্ধ যে রাবণের জন্মভূমি রক্ষার্থে সংগ্রাম, এই দৃষ্টিকোণ দিয়ে মাইকেল মেঘনাদবধকাব্য রচনা করেছিলেন এবং স্বভাবতই এটির নাট্যরূপ দেবার সময় পরাধীন ভারতের কথা হয়তো জেগেছিল গিরিশের মনে। তাই মেঘনাদবধকাব্য হয়ে উঠেছিল আগ্রাসনের কাহিনি, প্রতিরোধের কাহিনি। পরবর্তীকালে বেশ কিছু নাট্যকার পৌরাণিক কাহিনিতে ভারতের পরাধীনতার কথা ইঙ্গিতাকারে প্রকট করেছিলেন। মন্মথ রায়ের কারাগার (১৯৩০) নাটকটি কারাগারের অন্তরালে শ্রীকৃষ্ণের জন্ম অবলম্বনে রচিত হয়েছিল। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার এটিকে বাজেয়াপ্ত করেছিলেন। গিরিশ সরাসরি মাইকেলকে অনুসরণ করে মেঘনাদবধ নাটক রচনা করেছিলেন।
গিরিশের নাটকে যদি আগ্রাসন আর প্রতিরোধের কথা ওঠে, তবে তাঁর পৌরাণিক নাটক জনার কথা আসবেই। অজিত কুমার ঘোষের মতে, জনা গিরিশের শ্রেষ্ঠ পৌরাণিক নাটক। জনার কাহিনি মহাভারতের অশ্বমোধিক পর্ব থেকে গৃহীত। জনা রচিত ও মঞ্চস্থ হয় ১৮৯৪ সালে। এরই ঠিক এগারো বছর পর বঙ্গভঙ্গ নিয়ে সারা বঙ্গভূমি উত্তাল হয়ে ওঠে এবং তার তিন বছর পর ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসির ঘটনা দিয়ে বাংলায় অগ্নিযুগের সূচনা হয়।
গিরিশ ৮৬টি নাট্য রচনা করেন। তার মধ্যে ছিল পৌরাণিক, ঐতিহাসিক এবং সামাজিক নাটক। সাধারণ বাঙালির মত কৃত্তিবাসী রামায়ণ ও কাশীদাসী মহাভারত তাঁর মানসিক সংস্কৃতি গঠন করেছিল। পিতৃ-মাতৃহীন গিরিশের খুড়িমা শিশুকালে তাঁকে কৃত্তিবাসী রামায়ণ, কাশীদাসী মহাভারত পড়ে শোনাতেন। সেই ভাষা সেই পয়ার ছন্দের সুর গিরিশের অন্তরে প্রবিষ্ট হয়ে থেকে গিয়েছিল।
গিরিশের প্রতিভার চূড়ান্ত নমুনার কথা লিখেছিলেন ভগিনী দেবমাতা, তাঁর পুস্তক উধুং রহ ধহ ওহফরধহ গড়হধংঃবৎু’তে লেখেন, তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটক ছয় অঙ্ক বিশিষ্ট বিল্বমঙ্গল তিনি কোনোরকম বিরতি ব্যতিরেকে ২৮ ঘণ্টার মধ্যে লিখে শেষ করেছিলেন। এছাড়া শোনা যায়, সীতার বনবাস তিনি একরাত্রে লিখেছিলেন। সধবার একাদশীর ২৬টি গানও তিনি একরাত্রে শেষ করেছিলেন।
গিরিশচন্দ্রের ঐতিহাসিক নাট্যরচনার মানসিকতাকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নাটকের বীররস ও স্বদেশপ্রেমের দৃপ্ত সমন্বয় প্রভাবিত করেছিল। ইতিহাসকে অতিক্রম করে দুই নাট্যকারই কিছু স্বাধীনতা নিয়েছিলেন। ১৯০৬ সালে গিরিশ সিরাজদ্দৌলা লিখেছিলেন। তখন বাংলা রঙ্গমঞ্চে ঐতিহাসিক নাটকের স্বর্ণযুগ শুরু হয়েছে। নাট্যকার হিসাবে দ্বিজেন্দ্রলালের আবির্ভাব হয়েছে। ১৯০৩ সাল থেকে ১৯০৬ পর্যন্ত তিনি তারাবাই, রানা প্রতাপসিংহ ও দুর্গাদাস নাটক লিখে ফেলেছেন। ক্ষিরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদও বেশ কিছু ঐতিহাসিক নাটক লিখেছিলেন, যার মধ্যে প্রতাপাদিত্য, আলমগীর ও বাংলার মসনদ উল্লেখযোগ্য। গিরিশচন্দ্র প্রণীত সিরাজদ্দৌলা ছিল এই সবক’টির মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য এবং জনপ্রিয়। গিরিশের সিরাজদ্দৌলা শুধুমাত্র একটি ইতিহাস-ভিত্তিক রাজনৈতিক নাটক নয়, নাটকটিতে একটি শক্তিশালী ধর্মনিরপেক্ষতার বাণী ছিল। সিরাজ তাঁর প্রজ্ঞাবর্গকে বলেছেন:
ওহে হিন্দু মুসলমান-
এস করি পরষ্পর মার্জনা এখন
বংগের সন্তান-হিন্দু মুসলমান
বাংলার সাধহ কল্যাণ।
হেমন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন, ‘তিনি দেশাত্ববোধ রসে জারিত একাধারে সিরাজদ্দৌলা ও মীরকাশিম লেখেন ও মিনার্ভাতে মঞ্চস্থ করেন। সিরাজদ্দৌলা ও মীরকাশিম সেই প্রথম জাতীয়তার যুগে দেশের যুব সম্প্রদায়ের উপর যে অপূর্ব প্রভাব বিস্তার করিয়াছেন তাহা ভাষায় শেষ করা যায় না। মীরকাশিম নাটকে সুশীলাবালা অবতীর্ণ হতেন বেগমের ভূমিকায়। অভিনয় করার সময় তকী খাঁ’র হাতে তরবারি তুলে দিয়ে গান ধরতেন, ‘বীর করে তরবারি ধরে’- তখন দর্শকরা আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনিতে প্রেক্ষাগৃহে অভূতপূর্ব উন্মাদনা সৃষ্টি করতেন।
তাঁর সামাজিক নাটক ও রাজনৈতিক ঐক্যের সাথে ধর্মীয় ঐক্যকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়। ‘আমার মতে ভারতে রিলিজাস ইউনিট ভিন্ন আর কোন ইউনিটি হতে পারে না।’ (মায়াবসান নাটকে (১:৫) কালীকিঙ্করের সংলাপ, ১৮৯৮)
বাংলার নাট্যমঞ্চের ইতিহাসের মাঝখান থেকে ধরলে গিরিশচন্দ্র ঘোষ বলেন, ‘মহাকবি শেক্সপীয়রই আমার আদর্শ। তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলেছি।’ এদিকে বারবার মালিকানা বদলের পর বিশৃঙ্খল অবস্থার পরিণতি হিসাবে ৬ বিডন স্ট্রিটে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার অবশেষে বিলুপ্ত হয়ে যায়। স্বত্বাধিকারী মহেন্দ্রলাল দাসের কাছ থেকে খালি পড়ে থাকা সেই জমি লিজ নিয়ে একটি রঙ্গমঞ্চ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন পাথুরিয়াঘাটার প্রসন্নকুমার ঠাকুরের দৌহিত্র নাগেন্দ্রভূষণ মুখোপাধ্যায়। গিরিশচন্দ্রের সঙ্গে তখন স্টার থিয়েটারের সম্পর্ক তিক্ততায় পর্যবসিত হয়েছে, নাগেন্দ্রভূষণ তাঁকে এই নতুন থিয়েটারের দায়িত্ব গ্রহণের অনুরোধ জানান। থিয়েটারের নাম হল ‘মিনার্ভা থিয়েটার’, থিয়েটারের উদ্বোধন হল ১৮৯২ সালে। ১৮৯৩ সালের ২৮ শে জানুয়ারি এই মিনার্ভা থিয়েটারে মাধ্যমে কলকাতার মাটিতে বাংলা ভাষায় প্রথম শেক্সপীয়র অভিনীত হলো; গিরিশ ঘোষ অনূদিত ম্যাকবেথ। নাম ভূমিকায় ও পরিচালনায় স্বয়ং তিনি। পরিচ্ছদ ও মঞ্চসজ্জা করেন সুদক্ষ ইংরেজ চিত্রকরগণ। তারপর একে একে স্টার এমারেন্ড, মিনার্ভা, ক্ল্যাসিক, কোহিনুর- কলকাতার এমন কোনো স্টেজ নেই যেখানে তাঁর পায়ের ছাপ পড়েনি। কিন্তু বারবার তিনি মিনার্ভা’তে নিয়ে এসেছিলেন।
গিরিশ একদিকে যেমন বাংলার মহান সাহিত্যকে নাট্যরূপ দিয়ে মঞ্চে উপস্থাপিত করেছিলেন, যেমন- বঙ্কিমচন্দ্রের মৃণালিনী, বিষবৃক্ষ, ও দুর্গেশনন্দিনী, মাইকেল মধুসূদনের মেঘনাদবধকাব্য ও নবীন সেনের পলাশীর যুদ্ধ। অন্যদিকে মৌলিক ঐতিহাসিক নাটক লিখে নাট্যমোদীদের মনে দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তুলেছিলেন। ১৮৭২ সালে বাংলার সাধারণ থিয়েটারের জন্ম। নাট্যমোদী বাঙালি মধ্যবিত্তের কাছে বাংলা নাটকের দরজা খুলে গিয়েছিল গিরিশচন্দ্রের কারণে, তাঁর লিখিত নাটক নিয়ে, অত্যাধুনিক পরিচালনার দক্ষতা নিয়ে, মঞ্চসজ্জার বৈচিত্র্য নিয়ে সেই নব আন্দোলনকে সাফল্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।