ইশিতা জেরীন
আঠারো দিন হলো অদ্রিজা মারা গিয়েছে। তার মৃত্যুর জন্য তনয় নিজেকেই দায়ী করে। হ্যাঁ, সব দোষ তারই। সে-ই অদ্রিজার হত্যাকারী।
অদ্রিজা পানি ভয় পেতো। তারপরেও সেদিন বিকেলে তনয় তাকে জোর করে নিয়ে গিয়েছিল বুড়িগঙ্গার ধারে। অদ্রিজার চোখেমুখে আতংকের রেখা দেখেও তাকে সাথে নিয়ে একটি ডিঙি নৌকায় চেপে বসেছিল। সারাটি ক্ষণ অদ্রিজা পাথরের মতো মুখ করে রেখেছিল। তনয় পাত্তা দেয় নি। জলের প্রতি অদ্রিজার এই অহেতুক ভয় কাটিয়ে দেয়াই ছিল তার একমাত্র উদ্দেশ্য।
কিন্তু কে জানতো ভাগ্য এমন নিষ্ঠুর লীলায় মেতে উঠবে তাদের সাথে?
কিছুক্ষণের মধ্যেই আকাশ ঢেকে গেলো ঘন কালো মেঘে। সজোরে বাতাস বইতে লাগলো। শুরু হলো ঝড়বৃষ্টি। নদী ফুলে-ফেঁপে উঠলো। ঝড়ের প্রবল তা-বে এক হাত দূরের দৃশ্যও স্পষ্ট দেখা যায় না।
তারা তখন মাঝ নদীতে। নৌকা দুলে দুলে উঠছে। সে শক্ত করে অদ্রিজার হাত ধরে বসে রইলো। বৃষ্টির মধ্যেও অদ্রিজার আয়ত চোখের জল সে আলাদা করতে পারছিল। সে মৃদু স্বরে বলেছিল, ভয় পেও না। আমি আছি।
অদ্রিজা কোনো উত্তর দেয় নি। এভাবেই নীরবে পেরিয়ে গেলো দীর্ঘ কিছু মুহূর্ত। তারপর তারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই নৌকাটি উল্টে গেলো। সে কিংবা অদ্রিজা কেউই সাঁতার জানতো না। তারা তলিয়ে যেতে লাগলো উন্মত্ত নদীর জলে। তখনও সে অদ্রিজার হাত ছাড়ে নি। কিন্তু ¯্রােতের তোড়ে সেই হাত ধরেও রাখতে পারলো না বেশিক্ষণ। কখন যেন হাত ফসকে হাত ছুটে গেলো। দু’জনে ভেসে গেলো দু’দিকে।
সেও ডুবে যেতে লাগলো। সত্যি বলতে, তার আর বাঁচতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু ভাগ্য অন্য কিছু পরিকল্পনা করে রেখেছিল তার জন্য। অকস্মাৎ একটি শক্ত হাত তাকে আঁকড়ে ধরলো উপর থেকে। এরপর তাকে নিজের পিঠে চড়িয়ে নিয়ে কঠিন বলয়ে আবদ্ধ করে সাঁতরে যেতে লাগলো পাড়ের দিকে।
পাড়ে উঠে সে দেখলো, তাদেরই নৌকার মাঝি। লোকটি হাঁপাচ্ছে। তনয়ের মাথায় রক্ত চড়ে গেলো। সে রূঢ় স্বরে বলল, বাঁচালেন কেন আমাকে? কেন বাঁচালেন? -বলতে বলতেই সে আবার ছুটে গেলো নদীর দিকে। কিন্তু লোকটি তাকে দুই বাহুর বলয়ে আবদ্ধ করে ফেলল আবারো। বড় বড় শ্বাস নিতে নিতে বলল, কই যান? পাগল হইছেন? আপনি কি পাগল হইছেন নি, মামা?
যতক্ষণ ঝড় হলো, মাঝি তাকে জাপ্টে ধরে রাখলো। লিকলিকে সেই শরীরে কী শক্তি! তনয় এক চুলও নড়তে পারলো না। ঝড়বৃষ্টি থামার পরেও অদ্রিজার আর দেখা পাওয়া যায় নি। পাওয়া যায় নি তার কোনো খোঁজ।
সেদিন রাতেই তনয় নড়াইলে তার গ্রামের বাড়িতে চলে এসেছে। ফোন বন্ধ করে নিজেকে এক রকম ঘরবন্দী করে রেখেছে। সেদিন থেকে মুহূর্তের জন্যও সে দুই চোখের পাতা এক করতে পারে নি। তবু মানসপটে বারবার ভেসে উঠছে অদ্রিজার সেই ভয়ার্ত মুখ। এই মুখচ্ছবি সে কি কখনো ভুলতে পারবে?
একটি মাত্র ভুল সিদ্ধান্ত, একটি মাত্র জেদের কারণে মানুষের জীবন কীভাবে না উলোটপালোট হয়ে যায়! তনয়ের মনে হচ্ছে যেকোনো মুহূর্তে সে পাগল হয়ে যাবে। হয়ে যাবে কী, কিছুটা পাগল সে ইতিমধ্যেই হয়ে গিয়েছে। পাগল না হলে মানুষ আঠারো দিন না ঘুমিয়ে কাটাতে পারে না। নিজেকে জগত থেকে এভাবে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে পারে না।
খাবার জন্যও সে ঘর থেকে বের হয় না। মা এসে ঘরে খাবার দিয়ে যান। তনয় দু-এক নলা ভাত মুখে দিয়েই বমি করে সব উগরে দেয়। মা বসে বসে কাঁদতে থাকেন আর বারবার জানতে চান, তার কী হয়েছে সে কোনো উত্তর দেয় না। কী উত্তর দেবে? বলবে, সে তার প্রেমিকার খুনী? খুনের ভার সামলাতে গিয়ে তার অবস্থা উ™£ান্ত? শীঘ্রই সে বদ্ধ উন্মাদে পরিণত হতে চলেছে?
এখনো মা বসে রয়েছেন তার ঘরে। তার হাত ধরে কেঁদে কেঁদে বলছেন, কী হয়েছে তোর, বাবা? বল, বল আমাকে।
তনয় উত্তর দিলো না। তিনি বললেন, কিছু তো বল। এভাবে আর কতদিন?
এবারেও সে নীরব। মা বললেন, ওই মুসলমান মেয়েটার জন্য এমন করছিস? আমরা ওকে মেনে নেবো। তাও তুই স্বাভাবিক। তিনি কথা শেষ করতে পারলেন না। তনয় ধমকে উঠে বলল, যাও তো। যাও এখান থেকে।
তিনি আর কিছু না বলে চলে গেলেন। তনয় আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়। ফ্যানের ঘটাং ঘটাং শব্দটা মাথায় এসে আঘাত করছে। ফ্যানটা খুলে তার উপর পড়ে তার মৃত্যু হলে বেশ হতো।
সে উঠে ফ্যান বন্ধ করে দিলো। অন্ধকারের মাঝেই একটি সিগারেট ধরালো। তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যা সিদ্ধান্ত নেবার এখনই, এই মুহূর্তে নিতে হবে। সে কি পারবে জীবনের সবচেয়ে কঠিন কিন্তু জরুরি সিদ্ধান্তটি নিতে?
মাথার ভেতরটা এলোমেলো হয়ে রয়েছে। মনে হচ্ছে যেন মাথায় চলছে সেদিনকার সেই ঝড়। এই ঝড় রুখে দেবার একটি মাত্র পন্থাই রয়েছে এবং সে সেই পন্থাটি অবলম্বন করবে। এখন কেবল চারপাশ নিগূঢ় নিদ্রায় তলিয়ে যাবার অপেক্ষা।
তনয় একটার পর একটা সিগারেট জ্বালছে। কোনোটাই পুরোপুরি শেষ করতে পারছে না। মুখ বিস্বাদ হয়ে রয়েছে। তারপরেও সে একটা সিগারেট ফেলে দিয়ে পরক্ষণেই আবার আরেকটি ধরাচ্ছে। যতক্ষণ হাতে সিগারেট জ্বলছে ততক্ষণই সে নিজেকে খানিকটা বিন্যস্ত রাখতে পারছে।
রাত্রির ছায়ারা আবর্তিত হচ্ছে দেয়াল থেকে দেয়ালে। সে উঠে জানালা খুলে দিলো। জানালা ভেদ করে অনেকখানি আকাশ ঢুকে পড়লো ঘরে। আকাশে ঘোলাটে চাঁদ বাঁকা কাস্তের মতো ঝুলে রয়েছে। সেদিকে সে কিছুক্ষণ নির্নিমেষ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। এভাবে কতক্ষণ পেরিয়ে গেলো সে নিজেও বুঝলো না। তার সম্বিৎ ফিরে এলো সেই রহস্যময় ডাকে- আয়!
তনয় সাবধানে ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। বসার ঘরে স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইলো এক দ-। এরপর মূল দরজা খুলে ধীর পায়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলো।
তনয়ের লাশ ভাসছিল মাঝ পুকুরে, এক ঝাঁক কচুরিপানা ফুলের মধ্যেখানে। গ্রামের লোকজন যতক্ষণে পুকুর থেকে তার শব টেনে পাড়ে তুলেছে তখন আকাশে ঝকঝকে রোদ উঠে গিয়েছে। তার শার্টের বুক পকেটে পাওয়া গেলো জলে ভিজে অস্পষ্ট হয়ে আসা একটি মেয়ের ছবি। ছবির পেছনে গুটিগুটি অক্ষরে লেখা—তোমার মৃত্যুর ভার সইতে না পেরে আমিও পাড়ি দিলাম তোমার পথে।
পরিশিষ্ট: অদ্রিজার ফোন বাজছে। অচেনা নাম্বার। সে ফোন ধরলো না। পাশ ফিরে চাদরে মুখ ঢাকলো। তার আয়ত চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো। আজ উনিশ দিন হলো তনয়ের কোনো খোঁজ নেই। তার ফোনও বন্ধ। সেদিন বিকেলে তাদের মধ্যে উত্তপ্ত বাকবিত-া হয়েছিল। তনয় তাকে নিয়ে বুড়িগঙ্গার ধারে যাবার জন্য জোর করছিল। অদ্রিজা শেষে তার সাথে এক রকম রাগারাগি করেই বাড়িতে চলে এসেছে। এরপর থেকেই তনয় সব রকম যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। সে বেশ কয়েকবার ভেবেছে তনয়ের গ্রামের বাড়িতে চলে যাবে। কিন্তু সাহস হয় নি। ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হবার কারণে তনয়ের পরিবারের কেউ তাকে পছন্দ করে না। অনাহুতের মতো সেখানে চলে যাওয়া যায় না। কিন্তু ছেলেটা এভাবে নিরুদ্দেশ হলো কেন? অনেক চিন্তা করেও অদ্রিজার মাথায় কিছু আসছে না। তনয় কি আর তাদের সম্পর্কটা রাখতে আগ্রহী নয়? সেই কারণেই সে নিজেকে এভাবে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছে তার থেকে?
আবারো ফোন বেজে উঠেছে। সেই একই নাম্বার। অদ্রিজা ফোন সাইলেন্ট করে দিলো। কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। ফোন ধরলে সে জানতে পেতো, মানবমনের অলীক অন্ধকার থেকে উঠে আসা এক তীব্র ভ্রান্তিতে আক্রান্ত হয়ে, তাকে মৃত ভেবে তনয় আত্মাহুতি দিয়েছে।
ইশিতা জেরীন
বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
আঠারো দিন হলো অদ্রিজা মারা গিয়েছে। তার মৃত্যুর জন্য তনয় নিজেকেই দায়ী করে। হ্যাঁ, সব দোষ তারই। সে-ই অদ্রিজার হত্যাকারী।
অদ্রিজা পানি ভয় পেতো। তারপরেও সেদিন বিকেলে তনয় তাকে জোর করে নিয়ে গিয়েছিল বুড়িগঙ্গার ধারে। অদ্রিজার চোখেমুখে আতংকের রেখা দেখেও তাকে সাথে নিয়ে একটি ডিঙি নৌকায় চেপে বসেছিল। সারাটি ক্ষণ অদ্রিজা পাথরের মতো মুখ করে রেখেছিল। তনয় পাত্তা দেয় নি। জলের প্রতি অদ্রিজার এই অহেতুক ভয় কাটিয়ে দেয়াই ছিল তার একমাত্র উদ্দেশ্য।
কিন্তু কে জানতো ভাগ্য এমন নিষ্ঠুর লীলায় মেতে উঠবে তাদের সাথে?
কিছুক্ষণের মধ্যেই আকাশ ঢেকে গেলো ঘন কালো মেঘে। সজোরে বাতাস বইতে লাগলো। শুরু হলো ঝড়বৃষ্টি। নদী ফুলে-ফেঁপে উঠলো। ঝড়ের প্রবল তা-বে এক হাত দূরের দৃশ্যও স্পষ্ট দেখা যায় না।
তারা তখন মাঝ নদীতে। নৌকা দুলে দুলে উঠছে। সে শক্ত করে অদ্রিজার হাত ধরে বসে রইলো। বৃষ্টির মধ্যেও অদ্রিজার আয়ত চোখের জল সে আলাদা করতে পারছিল। সে মৃদু স্বরে বলেছিল, ভয় পেও না। আমি আছি।
অদ্রিজা কোনো উত্তর দেয় নি। এভাবেই নীরবে পেরিয়ে গেলো দীর্ঘ কিছু মুহূর্ত। তারপর তারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই নৌকাটি উল্টে গেলো। সে কিংবা অদ্রিজা কেউই সাঁতার জানতো না। তারা তলিয়ে যেতে লাগলো উন্মত্ত নদীর জলে। তখনও সে অদ্রিজার হাত ছাড়ে নি। কিন্তু ¯্রােতের তোড়ে সেই হাত ধরেও রাখতে পারলো না বেশিক্ষণ। কখন যেন হাত ফসকে হাত ছুটে গেলো। দু’জনে ভেসে গেলো দু’দিকে।
সেও ডুবে যেতে লাগলো। সত্যি বলতে, তার আর বাঁচতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু ভাগ্য অন্য কিছু পরিকল্পনা করে রেখেছিল তার জন্য। অকস্মাৎ একটি শক্ত হাত তাকে আঁকড়ে ধরলো উপর থেকে। এরপর তাকে নিজের পিঠে চড়িয়ে নিয়ে কঠিন বলয়ে আবদ্ধ করে সাঁতরে যেতে লাগলো পাড়ের দিকে।
পাড়ে উঠে সে দেখলো, তাদেরই নৌকার মাঝি। লোকটি হাঁপাচ্ছে। তনয়ের মাথায় রক্ত চড়ে গেলো। সে রূঢ় স্বরে বলল, বাঁচালেন কেন আমাকে? কেন বাঁচালেন? -বলতে বলতেই সে আবার ছুটে গেলো নদীর দিকে। কিন্তু লোকটি তাকে দুই বাহুর বলয়ে আবদ্ধ করে ফেলল আবারো। বড় বড় শ্বাস নিতে নিতে বলল, কই যান? পাগল হইছেন? আপনি কি পাগল হইছেন নি, মামা?
যতক্ষণ ঝড় হলো, মাঝি তাকে জাপ্টে ধরে রাখলো। লিকলিকে সেই শরীরে কী শক্তি! তনয় এক চুলও নড়তে পারলো না। ঝড়বৃষ্টি থামার পরেও অদ্রিজার আর দেখা পাওয়া যায় নি। পাওয়া যায় নি তার কোনো খোঁজ।
সেদিন রাতেই তনয় নড়াইলে তার গ্রামের বাড়িতে চলে এসেছে। ফোন বন্ধ করে নিজেকে এক রকম ঘরবন্দী করে রেখেছে। সেদিন থেকে মুহূর্তের জন্যও সে দুই চোখের পাতা এক করতে পারে নি। তবু মানসপটে বারবার ভেসে উঠছে অদ্রিজার সেই ভয়ার্ত মুখ। এই মুখচ্ছবি সে কি কখনো ভুলতে পারবে?
একটি মাত্র ভুল সিদ্ধান্ত, একটি মাত্র জেদের কারণে মানুষের জীবন কীভাবে না উলোটপালোট হয়ে যায়! তনয়ের মনে হচ্ছে যেকোনো মুহূর্তে সে পাগল হয়ে যাবে। হয়ে যাবে কী, কিছুটা পাগল সে ইতিমধ্যেই হয়ে গিয়েছে। পাগল না হলে মানুষ আঠারো দিন না ঘুমিয়ে কাটাতে পারে না। নিজেকে জগত থেকে এভাবে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে পারে না।
খাবার জন্যও সে ঘর থেকে বের হয় না। মা এসে ঘরে খাবার দিয়ে যান। তনয় দু-এক নলা ভাত মুখে দিয়েই বমি করে সব উগরে দেয়। মা বসে বসে কাঁদতে থাকেন আর বারবার জানতে চান, তার কী হয়েছে সে কোনো উত্তর দেয় না। কী উত্তর দেবে? বলবে, সে তার প্রেমিকার খুনী? খুনের ভার সামলাতে গিয়ে তার অবস্থা উ™£ান্ত? শীঘ্রই সে বদ্ধ উন্মাদে পরিণত হতে চলেছে?
এখনো মা বসে রয়েছেন তার ঘরে। তার হাত ধরে কেঁদে কেঁদে বলছেন, কী হয়েছে তোর, বাবা? বল, বল আমাকে।
তনয় উত্তর দিলো না। তিনি বললেন, কিছু তো বল। এভাবে আর কতদিন?
এবারেও সে নীরব। মা বললেন, ওই মুসলমান মেয়েটার জন্য এমন করছিস? আমরা ওকে মেনে নেবো। তাও তুই স্বাভাবিক। তিনি কথা শেষ করতে পারলেন না। তনয় ধমকে উঠে বলল, যাও তো। যাও এখান থেকে।
তিনি আর কিছু না বলে চলে গেলেন। তনয় আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়। ফ্যানের ঘটাং ঘটাং শব্দটা মাথায় এসে আঘাত করছে। ফ্যানটা খুলে তার উপর পড়ে তার মৃত্যু হলে বেশ হতো।
সে উঠে ফ্যান বন্ধ করে দিলো। অন্ধকারের মাঝেই একটি সিগারেট ধরালো। তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যা সিদ্ধান্ত নেবার এখনই, এই মুহূর্তে নিতে হবে। সে কি পারবে জীবনের সবচেয়ে কঠিন কিন্তু জরুরি সিদ্ধান্তটি নিতে?
মাথার ভেতরটা এলোমেলো হয়ে রয়েছে। মনে হচ্ছে যেন মাথায় চলছে সেদিনকার সেই ঝড়। এই ঝড় রুখে দেবার একটি মাত্র পন্থাই রয়েছে এবং সে সেই পন্থাটি অবলম্বন করবে। এখন কেবল চারপাশ নিগূঢ় নিদ্রায় তলিয়ে যাবার অপেক্ষা।
তনয় একটার পর একটা সিগারেট জ্বালছে। কোনোটাই পুরোপুরি শেষ করতে পারছে না। মুখ বিস্বাদ হয়ে রয়েছে। তারপরেও সে একটা সিগারেট ফেলে দিয়ে পরক্ষণেই আবার আরেকটি ধরাচ্ছে। যতক্ষণ হাতে সিগারেট জ্বলছে ততক্ষণই সে নিজেকে খানিকটা বিন্যস্ত রাখতে পারছে।
রাত্রির ছায়ারা আবর্তিত হচ্ছে দেয়াল থেকে দেয়ালে। সে উঠে জানালা খুলে দিলো। জানালা ভেদ করে অনেকখানি আকাশ ঢুকে পড়লো ঘরে। আকাশে ঘোলাটে চাঁদ বাঁকা কাস্তের মতো ঝুলে রয়েছে। সেদিকে সে কিছুক্ষণ নির্নিমেষ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। এভাবে কতক্ষণ পেরিয়ে গেলো সে নিজেও বুঝলো না। তার সম্বিৎ ফিরে এলো সেই রহস্যময় ডাকে- আয়!
তনয় সাবধানে ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। বসার ঘরে স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইলো এক দ-। এরপর মূল দরজা খুলে ধীর পায়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলো।
তনয়ের লাশ ভাসছিল মাঝ পুকুরে, এক ঝাঁক কচুরিপানা ফুলের মধ্যেখানে। গ্রামের লোকজন যতক্ষণে পুকুর থেকে তার শব টেনে পাড়ে তুলেছে তখন আকাশে ঝকঝকে রোদ উঠে গিয়েছে। তার শার্টের বুক পকেটে পাওয়া গেলো জলে ভিজে অস্পষ্ট হয়ে আসা একটি মেয়ের ছবি। ছবির পেছনে গুটিগুটি অক্ষরে লেখা—তোমার মৃত্যুর ভার সইতে না পেরে আমিও পাড়ি দিলাম তোমার পথে।
পরিশিষ্ট: অদ্রিজার ফোন বাজছে। অচেনা নাম্বার। সে ফোন ধরলো না। পাশ ফিরে চাদরে মুখ ঢাকলো। তার আয়ত চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো। আজ উনিশ দিন হলো তনয়ের কোনো খোঁজ নেই। তার ফোনও বন্ধ। সেদিন বিকেলে তাদের মধ্যে উত্তপ্ত বাকবিত-া হয়েছিল। তনয় তাকে নিয়ে বুড়িগঙ্গার ধারে যাবার জন্য জোর করছিল। অদ্রিজা শেষে তার সাথে এক রকম রাগারাগি করেই বাড়িতে চলে এসেছে। এরপর থেকেই তনয় সব রকম যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। সে বেশ কয়েকবার ভেবেছে তনয়ের গ্রামের বাড়িতে চলে যাবে। কিন্তু সাহস হয় নি। ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হবার কারণে তনয়ের পরিবারের কেউ তাকে পছন্দ করে না। অনাহুতের মতো সেখানে চলে যাওয়া যায় না। কিন্তু ছেলেটা এভাবে নিরুদ্দেশ হলো কেন? অনেক চিন্তা করেও অদ্রিজার মাথায় কিছু আসছে না। তনয় কি আর তাদের সম্পর্কটা রাখতে আগ্রহী নয়? সেই কারণেই সে নিজেকে এভাবে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছে তার থেকে?
আবারো ফোন বেজে উঠেছে। সেই একই নাম্বার। অদ্রিজা ফোন সাইলেন্ট করে দিলো। কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। ফোন ধরলে সে জানতে পেতো, মানবমনের অলীক অন্ধকার থেকে উঠে আসা এক তীব্র ভ্রান্তিতে আক্রান্ত হয়ে, তাকে মৃত ভেবে তনয় আত্মাহুতি দিয়েছে।