সাহিত্য আড্ডা
নভেরা হোসেন
কবি রফিক আজাদ স্মৃতি পর্ষদের আয়োজনে মানিকগঞ্জের গড়পাড়ায় কবি দিলারা হাফিজের ‘মাটির মমতা’ বাড়িতে হেমন্তকালীন আড্ডায় কবি-লেখকগণ
কবিতা ও প্রকৃতি পরস্পর সম্পর্কিত। কবি যখন প্রকৃতির সান্নিধ্যে যান তার ভেতরের দুয়েন্দে বা প্রাণ জেগে ওঠে। নগরকেন্দ্রিক একঘেয়ে জীবন ছেড়ে একটি দিনের জন্য ঢাকার বেশ কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক গত ৩১ অক্টোবর শুক্রবার জড়ো হয়েছিলাম মানিকগঞ্জ জেলার সদর থানার গড়পাড়া গ্রামে। কবি দিলারা হাফিজের গ্রামের বাড়িতে। মূলত কবি রফিক আজাদ স্মৃতি পর্ষদের হেমন্তকালীন একটি সমাবেশকে ঘিরেই এই আয়োজন। কবি রফিক আজাদ স্মৃতি পর্ষদ কবির জন্মদিন, মৃত্যুদিন ছাড়াও বর্ষা, শীত বিভিন্ন ঋতুতে কবিতা পাঠ ও আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। এর আগে কবির ধানমণ্ডির বাড়িতেই সব অনুষ্ঠান হয়েছে। এবারই ব্যতিক্রম। মানিকগঞ্জের গড়পাড়া কালিগঙ্গা নদীবর্তী একটি গ্রাম। ঢাকা থেকে যাওয়ার পথে সাভারের সিঙ্গাইর থেকে একটি পথ ধরে মূল সড়ক এড়িয়ে গ্রামের ভেতরের পথ দিয়ে দুধারে ধানক্ষেত, বৃক্ষরাজি, জলাশয়, তেলাকুচা ফুল, নানা চেনা, অচেনা লতাগুল্ম, জয়মনটপের মতো বিচিত্র নামে গ্রাম। গ্রাম বাংলায় প্রবেশ করলে বোঝা যায় প্রতিটি গ্রাম, নদী এখানকার প্রকৃতি, সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত, তাদের নামকরণের সাথে মিশে আছে এখানকার আদি ইতিহাস, প্রতœ ইতিহাস, লোক ইতিহাস, নৃবিজ্ঞান।
গ্রামের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া সড়ক পথে এঁকেবেঁকে পৌঁছে গেলাম গড়পাড়া গ্রামের কাছে। শেষে কিছুটা পথ মটরচালিত রিক্সায় করে মাটির মমতায়। কবি দিলারা হাফিজ পরম যতেœ , ভালোবাসায়, নান্দনিক রুচি দিয়ে তৈরি করেছেন এই “মাটির মমতা” নামের বাড়িটি। বৃক্ষরাজিতে আবৃত মনোরম পরিবেশে নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীতে গড়া বাড়িটি একটি সাহিত্য-বান্ধব কুটির। সকালে আপ্যায়নে পাটিসাপ্টা পিঠা আর লেবুর ঠাণ্ডা শরবত অমৃতের মতো লাগলো। শীতের আগমনী চলছে কিন্তু প্রকৃতিতে তার ছাপ নেই।
সকালের সময়টা কথাবার্তা আর বিকালের অনুষ্ঠান নিয়ে ভাবনা-চিন্তায় কাটলো। দুপুরে মানিকগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী সব শাক, ভর্তা, মাছ দিয়ে আপ্যায়ন। এর মধ্যে পাতা ভাজি ছিল অসাধারণ। চালকুমড়ো পাতাকে ডাল দিয়ে বড়ার মতো করে ভাজা হয়েছে। লাল চালের ভাত থেকে মঁ মঁ গন্ধ আসছিল। সাধারণ শাক, ভর্তা , মাছ হয়ে উঠেছিল দারুণ সুস্বাদু। গ্রামের যেকোনো খাবার শহরবাসীর কাছে টাটকা ভিন্ন, স্বাদ এনে দেয়।
মধ্যাহ্ন ভোজনের পর কবি দিলারা হাফিজদের পরিবারের চেষ্টায় গড়ে ওঠা হাফিজউদ্দিন কলেজ দর্শন। গ্রামের উঁচুনিচু পথ ধরে হেঁটে আসতে আসতে কালীগঙ্গা নদীতে একঝাঁক হাঁস ভেসে যেতে দেখে কবি ওবায়েদ আকাশ বলে উঠলেন শেক্সপিয়ারের বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া এভন নদীতে তিনি এরকম হাঁসের ঝাঁক দেখেছেন।
বিকালে দই-মিষ্টি, চায়ের সাথে ‘মাটির মমতায় হেমন্ত বিকেল’ শিরোনামে শুরু হয় মূল অনুষ্ঠান। সঞ্চালক কবি পিয়াস মজিদ শুরুতেই কবি জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে আলোচনা করার জন্য কবি, গবেষক আসমা চৌধুরীকে অনুরোধ করেন। সুদূর বরিশাল থেকে এসে তিনি জীবনানন্দীয় স্বাদ ছড়িয়ে দেন সবার মাঝে। তিনি বলেন- জীবনানন্দ আমাদের প্রাণের সুবাস। প্রকৃতি প্রেম তার মূল উপজীব্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেরপরের সময়টা খুব খারাপ ছিল। সেসময় তিনি কবিতায় অন্ধকারের ব্যবহার করেছেন। আবার আলোর কথা বলেছেন। জীবনানন্দ অসামান্য, তাঁর কবিতা অসামান্য, তিনি রবীন্দ্র প্রভাবমুক্ত হতে চেয়েছেন, পেরেছেন।
কবি জরিনা আখতার কবি রফিক আজাদকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন। তিনি বলেন তার ‘কালো ময়ূরের ডাক’ বইটিতে বেশ কিছু অক্ষরবৃত্তে লেখা কবিতা আছে, মূলত কবি রফিক আজাদের অনুপ্রেরণায় সেগুলো লেখা হয়েছে। তার সাথে রফিক আজাদের প্রথম দেখা হয় শাহবাগে রেডিও অফিসের ট্রান্সমিশন বিভাগে। ওখানে মহাদেব সাহা, আবদুল মান্নান সৈয়দ, রফিক আজাদ প্রমুখ কবিকে দেখে তিনি কিছুটা অস্বস্তি বোধ করেন। কবিতা পড়ার পর জরিনা আখতার একটা রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তখন হঠাৎ কবি রফিক আজাদ এসে বলেন, আমি তো আপনার কবিতা শুনে চমকে উঠেছি, শব্দ চয়ন শুনে। কবি দিলারা হাফিজের কবিতা থেকে ‘মাটির মমতা’ শব্দবন্ধ দিয়ে এই বাড়ির নামকরণের প্রস্তাব করেন পিয়াস। কবি দিলারা হাফিজসহ উপস্থিত সবাই তাকে এটাকে সমর্থন করেন।
কবি ওবায়েদ আকাশ বলেন ‘আমি যদি হতাম বনহংস / বনহংসী হতে যদি তুমি’ জীবনানন্দ দাশের এই উক্তি কবি আসমা চোধুরীর কণ্ঠে শুনে তিনি শিহরিত হয়ে উঠেছেন। এর সরলতা তাকে স্পর্শ করেছে। কবি পিয়াস মজিদকে তিনি সাহিত্যের এনসাইক্লোপিডিয়া বলে আখ্যায়িত করেন তার তথ্য ও জ্ঞানভা-ারের কারণে।
কবি রফিক আজাদ সম্পর্কে তিনি বলেন কবি তাকে বলেছিলেন, ‘তুই কিন্তু আমার প্রিয় কবি।’
কলকাতার কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে কথা বলেন তিনি। প্রথম জীবনে, ১৯৯০ সালে, ঢাকায় দুইশো টাকার মেসে থাকার সময় বই পড়ার জন্য মশারির ভেতর টেবিল ল্যাম্প নিয়ে নিতেন। ওই সময়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা পড়তেন। সুনীলের কবিতার চিত্রকল্প তাকে আকৃষ্ট করত। সুনীলের সাথে ঢাকার প্রেসক্লাবের উল্টো পাশের একটি আবাসিক হোটেলে প্রথম দেখা করে তিনি তাঁকে ‘শালুকের’ প্রথম সংখ্যাটা উপহার দেন, ২০০০ সালে। ‘প্রিয় কবিদের রন্ধনশালায়’ গ্রন্থে তিনি সুনীলকে নিয়ে দুটি কবিতা লিখেছেন। সেখান থেকে পাঠ করে শোনান। রফিক আজাদকে নিয়ে লেখা কবিতাও পাঠ করেন।
নভেরা হোসেন কবি শামসুর রাহমানকে নিয়ে লেখা ছোট একটি নিবন্ধ পাঠ করেন। ‘শামসুর রাহমান : দেখা, না দেখার কবি’ শিরোনামের লেখাটিতে কবিকে নিয়ে লেখা একটি কবিতাও পাঠ করেন। তিনি বলেন- শামসুর রাহমান আমাদের একজন গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় কবি, আবার বহুল পঠিত। এটা বেশ দ্বান্দ্বিক বিষয়। শামসুর রাহমান একটা বিষয়ের খুব গভীরে তলিয়ে যান আবার পরিচিত মানুষের মতো কবিতায় পুরান-নতুন ঢাকার কথা বলেন, সবুজ পতাকার মাঝে লাল রক্তবর্ণের কথা, প্রকৃতি, প্রেম, ঘৃণা, একটা জাতির একটু একটু করে রোপিত হওয়ার কথা বলেন কবিতায়। ষাটের দশকে বাংলা কবিতার পরিবর্তনের ধারায় তিনি ছিলেন একজন কা-ারী। শামসুর রাহমান কোনো দশকে বাঁধা পড়েননি, হয়ে উঠেছিলেন সমকালীন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা তার কবিতা অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন বাংলাদেশিদের মুখে মুখে ছিল।
কবি ও নন্দনতাত্ত্বিক মাহফুজ আল-হোসেন বাংলা ইংরেজি দু ভাষাতেই কবিতা লিখতে পারঙ্গম। সাবলীল অনুবাদও করেন। তিনি বলেন তার গ্রামের নাম গড়চাপড়া আর এই গ্রামের নাম গড়পাড়া- সামান্য পার্থক্য। কবি রফিক আজাদকে তিনি স্মরণ করেন তার সৃষ্টিশীলতার জন্য। কবি ওবায়েদ আকাশের অফিসে বসে তিনি অনেক সময় লিখে থাকেন- এটা উল্লেখ করেন। মাধবী নামে একটি কবিতা তিনি পাঠ করেন। তিনি বলেন মাধবী একটা মেটাফর। দেশের ক্রান্তিকালে কবিরা কলম হাতে নেন, তিনিও তাই করেছিলেন। আমাদের সাংস্কৃতিক অস্তিত্বের মূলে যখন আঘাত করা হয় তখন এধরনের কবিতা লেখা হয়ে ওঠে। তিনি আরো বলেন কবিতা হতে পারে প্রতিরোধের একটি হাতিয়ার।
সাবেরা তাবাস্সুম কবি মোহাম্মদ রফিকের প্রথম বই ‘বৈশাখী পূর্ণিমা’- প্রকাশের পটভূমি নিয়ে লেখা হতে পাঠ করেন। লেখাটির শিরোনাম “আমার প্রথম বই বৈশাখী পূর্ণিমা”। একটা দেশের জন্মের সময়ে একজন কবির প্রথম বই প্রকাশের অনুভূতি যেন মিলেমিশে গেছে।
কবি দিলারা হাফিজ তার বক্তব্যে উপস্থিত সকলকে ধন্যবাদ জানান অনুষ্ঠানটিকে সার্থক করে তোলার জন্য। তিনি সবার কাজের প্রশংসা করেন। কবি জরিনা আখতার কবি রফিক আজাদকে নিয়ে যে স্মৃতিচারণ করেন তার উল্লেখ করে বলেন, জরিনা যথার্থই ওই সময়কে তুলে ধরেছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার কবি মাহফুজ আল-হোসেনের উপস্থিতিকে তিনি সাধুবাদ জানান। ওবায়েদ আকাশকে নব্বইয়ের দশকের একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি বলে উল্লেখ করেন। নভেরা হোসেনের গদ্য ও পদ্য রচনার প্রশংসা করে তিনি বলেন, সঠিক বিচার হলে নভেরা অনেককেই ছাড়িয়ে যেত।
তরুণ কবি পিয়াস মজিদের বিষয়ে তিনি বলেন পিয়াসের সব বিষয়েই জানাশোনা আছে, বিশ্বকোষ। পিয়াস সম্পর্কে আকাশের মন্তব্যকে তিনি যথার্থ মনে করেন। এছাড়া তিনি পরিবারের সদসদেরকে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য ধন্যবাদ জানান।
কবি পিয়াস মজিদের সঞ্চালনায় সমৃদ্ধ হয়েছিল সন্ধ্যাটি। পিয়াস নানা কবির উদ্ধৃতি দিয়ে এবং নানা তথ্যে সমৃদ্ধ করে তুলেছিল অনুষ্ঠানটিকে। ‘আমি ও জালালুদ্দিন রুমি’ শিরোনামে কবিতা দিয়ে শেষ করেন পিয়াস। অন্যরাও কবিতা পড়েন।
অনুষ্ঠান শেষে চিতই পিঠার স্বাদ মুখে করে দীর্ঘ আনন্দময় একটি দিনকে হৃদয়ে নিয়ে সবাই নগরের পথে ফিরে এলাম। কালীগঙ্গা নদীর ঘ্রাণ আমাদের স্মৃতিময় করে তুললো, এক মুহূর্তেই যেন সব স্মৃতি হয়ে গেলো মনের আরশিতে।
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
সাহিত্য আড্ডা
নভেরা হোসেন
কবি রফিক আজাদ স্মৃতি পর্ষদের আয়োজনে মানিকগঞ্জের গড়পাড়ায় কবি দিলারা হাফিজের ‘মাটির মমতা’ বাড়িতে হেমন্তকালীন আড্ডায় কবি-লেখকগণ
বৃহস্পতিবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৫
কবিতা ও প্রকৃতি পরস্পর সম্পর্কিত। কবি যখন প্রকৃতির সান্নিধ্যে যান তার ভেতরের দুয়েন্দে বা প্রাণ জেগে ওঠে। নগরকেন্দ্রিক একঘেয়ে জীবন ছেড়ে একটি দিনের জন্য ঢাকার বেশ কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক গত ৩১ অক্টোবর শুক্রবার জড়ো হয়েছিলাম মানিকগঞ্জ জেলার সদর থানার গড়পাড়া গ্রামে। কবি দিলারা হাফিজের গ্রামের বাড়িতে। মূলত কবি রফিক আজাদ স্মৃতি পর্ষদের হেমন্তকালীন একটি সমাবেশকে ঘিরেই এই আয়োজন। কবি রফিক আজাদ স্মৃতি পর্ষদ কবির জন্মদিন, মৃত্যুদিন ছাড়াও বর্ষা, শীত বিভিন্ন ঋতুতে কবিতা পাঠ ও আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। এর আগে কবির ধানমণ্ডির বাড়িতেই সব অনুষ্ঠান হয়েছে। এবারই ব্যতিক্রম। মানিকগঞ্জের গড়পাড়া কালিগঙ্গা নদীবর্তী একটি গ্রাম। ঢাকা থেকে যাওয়ার পথে সাভারের সিঙ্গাইর থেকে একটি পথ ধরে মূল সড়ক এড়িয়ে গ্রামের ভেতরের পথ দিয়ে দুধারে ধানক্ষেত, বৃক্ষরাজি, জলাশয়, তেলাকুচা ফুল, নানা চেনা, অচেনা লতাগুল্ম, জয়মনটপের মতো বিচিত্র নামে গ্রাম। গ্রাম বাংলায় প্রবেশ করলে বোঝা যায় প্রতিটি গ্রাম, নদী এখানকার প্রকৃতি, সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত, তাদের নামকরণের সাথে মিশে আছে এখানকার আদি ইতিহাস, প্রতœ ইতিহাস, লোক ইতিহাস, নৃবিজ্ঞান।
গ্রামের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া সড়ক পথে এঁকেবেঁকে পৌঁছে গেলাম গড়পাড়া গ্রামের কাছে। শেষে কিছুটা পথ মটরচালিত রিক্সায় করে মাটির মমতায়। কবি দিলারা হাফিজ পরম যতেœ , ভালোবাসায়, নান্দনিক রুচি দিয়ে তৈরি করেছেন এই “মাটির মমতা” নামের বাড়িটি। বৃক্ষরাজিতে আবৃত মনোরম পরিবেশে নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীতে গড়া বাড়িটি একটি সাহিত্য-বান্ধব কুটির। সকালে আপ্যায়নে পাটিসাপ্টা পিঠা আর লেবুর ঠাণ্ডা শরবত অমৃতের মতো লাগলো। শীতের আগমনী চলছে কিন্তু প্রকৃতিতে তার ছাপ নেই।
সকালের সময়টা কথাবার্তা আর বিকালের অনুষ্ঠান নিয়ে ভাবনা-চিন্তায় কাটলো। দুপুরে মানিকগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী সব শাক, ভর্তা, মাছ দিয়ে আপ্যায়ন। এর মধ্যে পাতা ভাজি ছিল অসাধারণ। চালকুমড়ো পাতাকে ডাল দিয়ে বড়ার মতো করে ভাজা হয়েছে। লাল চালের ভাত থেকে মঁ মঁ গন্ধ আসছিল। সাধারণ শাক, ভর্তা , মাছ হয়ে উঠেছিল দারুণ সুস্বাদু। গ্রামের যেকোনো খাবার শহরবাসীর কাছে টাটকা ভিন্ন, স্বাদ এনে দেয়।
মধ্যাহ্ন ভোজনের পর কবি দিলারা হাফিজদের পরিবারের চেষ্টায় গড়ে ওঠা হাফিজউদ্দিন কলেজ দর্শন। গ্রামের উঁচুনিচু পথ ধরে হেঁটে আসতে আসতে কালীগঙ্গা নদীতে একঝাঁক হাঁস ভেসে যেতে দেখে কবি ওবায়েদ আকাশ বলে উঠলেন শেক্সপিয়ারের বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া এভন নদীতে তিনি এরকম হাঁসের ঝাঁক দেখেছেন।
বিকালে দই-মিষ্টি, চায়ের সাথে ‘মাটির মমতায় হেমন্ত বিকেল’ শিরোনামে শুরু হয় মূল অনুষ্ঠান। সঞ্চালক কবি পিয়াস মজিদ শুরুতেই কবি জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে আলোচনা করার জন্য কবি, গবেষক আসমা চৌধুরীকে অনুরোধ করেন। সুদূর বরিশাল থেকে এসে তিনি জীবনানন্দীয় স্বাদ ছড়িয়ে দেন সবার মাঝে। তিনি বলেন- জীবনানন্দ আমাদের প্রাণের সুবাস। প্রকৃতি প্রেম তার মূল উপজীব্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেরপরের সময়টা খুব খারাপ ছিল। সেসময় তিনি কবিতায় অন্ধকারের ব্যবহার করেছেন। আবার আলোর কথা বলেছেন। জীবনানন্দ অসামান্য, তাঁর কবিতা অসামান্য, তিনি রবীন্দ্র প্রভাবমুক্ত হতে চেয়েছেন, পেরেছেন।
কবি জরিনা আখতার কবি রফিক আজাদকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন। তিনি বলেন তার ‘কালো ময়ূরের ডাক’ বইটিতে বেশ কিছু অক্ষরবৃত্তে লেখা কবিতা আছে, মূলত কবি রফিক আজাদের অনুপ্রেরণায় সেগুলো লেখা হয়েছে। তার সাথে রফিক আজাদের প্রথম দেখা হয় শাহবাগে রেডিও অফিসের ট্রান্সমিশন বিভাগে। ওখানে মহাদেব সাহা, আবদুল মান্নান সৈয়দ, রফিক আজাদ প্রমুখ কবিকে দেখে তিনি কিছুটা অস্বস্তি বোধ করেন। কবিতা পড়ার পর জরিনা আখতার একটা রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তখন হঠাৎ কবি রফিক আজাদ এসে বলেন, আমি তো আপনার কবিতা শুনে চমকে উঠেছি, শব্দ চয়ন শুনে। কবি দিলারা হাফিজের কবিতা থেকে ‘মাটির মমতা’ শব্দবন্ধ দিয়ে এই বাড়ির নামকরণের প্রস্তাব করেন পিয়াস। কবি দিলারা হাফিজসহ উপস্থিত সবাই তাকে এটাকে সমর্থন করেন।
কবি ওবায়েদ আকাশ বলেন ‘আমি যদি হতাম বনহংস / বনহংসী হতে যদি তুমি’ জীবনানন্দ দাশের এই উক্তি কবি আসমা চোধুরীর কণ্ঠে শুনে তিনি শিহরিত হয়ে উঠেছেন। এর সরলতা তাকে স্পর্শ করেছে। কবি পিয়াস মজিদকে তিনি সাহিত্যের এনসাইক্লোপিডিয়া বলে আখ্যায়িত করেন তার তথ্য ও জ্ঞানভা-ারের কারণে।
কবি রফিক আজাদ সম্পর্কে তিনি বলেন কবি তাকে বলেছিলেন, ‘তুই কিন্তু আমার প্রিয় কবি।’
কলকাতার কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে কথা বলেন তিনি। প্রথম জীবনে, ১৯৯০ সালে, ঢাকায় দুইশো টাকার মেসে থাকার সময় বই পড়ার জন্য মশারির ভেতর টেবিল ল্যাম্প নিয়ে নিতেন। ওই সময়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা পড়তেন। সুনীলের কবিতার চিত্রকল্প তাকে আকৃষ্ট করত। সুনীলের সাথে ঢাকার প্রেসক্লাবের উল্টো পাশের একটি আবাসিক হোটেলে প্রথম দেখা করে তিনি তাঁকে ‘শালুকের’ প্রথম সংখ্যাটা উপহার দেন, ২০০০ সালে। ‘প্রিয় কবিদের রন্ধনশালায়’ গ্রন্থে তিনি সুনীলকে নিয়ে দুটি কবিতা লিখেছেন। সেখান থেকে পাঠ করে শোনান। রফিক আজাদকে নিয়ে লেখা কবিতাও পাঠ করেন।
নভেরা হোসেন কবি শামসুর রাহমানকে নিয়ে লেখা ছোট একটি নিবন্ধ পাঠ করেন। ‘শামসুর রাহমান : দেখা, না দেখার কবি’ শিরোনামের লেখাটিতে কবিকে নিয়ে লেখা একটি কবিতাও পাঠ করেন। তিনি বলেন- শামসুর রাহমান আমাদের একজন গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় কবি, আবার বহুল পঠিত। এটা বেশ দ্বান্দ্বিক বিষয়। শামসুর রাহমান একটা বিষয়ের খুব গভীরে তলিয়ে যান আবার পরিচিত মানুষের মতো কবিতায় পুরান-নতুন ঢাকার কথা বলেন, সবুজ পতাকার মাঝে লাল রক্তবর্ণের কথা, প্রকৃতি, প্রেম, ঘৃণা, একটা জাতির একটু একটু করে রোপিত হওয়ার কথা বলেন কবিতায়। ষাটের দশকে বাংলা কবিতার পরিবর্তনের ধারায় তিনি ছিলেন একজন কা-ারী। শামসুর রাহমান কোনো দশকে বাঁধা পড়েননি, হয়ে উঠেছিলেন সমকালীন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা তার কবিতা অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন বাংলাদেশিদের মুখে মুখে ছিল।
কবি ও নন্দনতাত্ত্বিক মাহফুজ আল-হোসেন বাংলা ইংরেজি দু ভাষাতেই কবিতা লিখতে পারঙ্গম। সাবলীল অনুবাদও করেন। তিনি বলেন তার গ্রামের নাম গড়চাপড়া আর এই গ্রামের নাম গড়পাড়া- সামান্য পার্থক্য। কবি রফিক আজাদকে তিনি স্মরণ করেন তার সৃষ্টিশীলতার জন্য। কবি ওবায়েদ আকাশের অফিসে বসে তিনি অনেক সময় লিখে থাকেন- এটা উল্লেখ করেন। মাধবী নামে একটি কবিতা তিনি পাঠ করেন। তিনি বলেন মাধবী একটা মেটাফর। দেশের ক্রান্তিকালে কবিরা কলম হাতে নেন, তিনিও তাই করেছিলেন। আমাদের সাংস্কৃতিক অস্তিত্বের মূলে যখন আঘাত করা হয় তখন এধরনের কবিতা লেখা হয়ে ওঠে। তিনি আরো বলেন কবিতা হতে পারে প্রতিরোধের একটি হাতিয়ার।
সাবেরা তাবাস্সুম কবি মোহাম্মদ রফিকের প্রথম বই ‘বৈশাখী পূর্ণিমা’- প্রকাশের পটভূমি নিয়ে লেখা হতে পাঠ করেন। লেখাটির শিরোনাম “আমার প্রথম বই বৈশাখী পূর্ণিমা”। একটা দেশের জন্মের সময়ে একজন কবির প্রথম বই প্রকাশের অনুভূতি যেন মিলেমিশে গেছে।
কবি দিলারা হাফিজ তার বক্তব্যে উপস্থিত সকলকে ধন্যবাদ জানান অনুষ্ঠানটিকে সার্থক করে তোলার জন্য। তিনি সবার কাজের প্রশংসা করেন। কবি জরিনা আখতার কবি রফিক আজাদকে নিয়ে যে স্মৃতিচারণ করেন তার উল্লেখ করে বলেন, জরিনা যথার্থই ওই সময়কে তুলে ধরেছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার কবি মাহফুজ আল-হোসেনের উপস্থিতিকে তিনি সাধুবাদ জানান। ওবায়েদ আকাশকে নব্বইয়ের দশকের একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি বলে উল্লেখ করেন। নভেরা হোসেনের গদ্য ও পদ্য রচনার প্রশংসা করে তিনি বলেন, সঠিক বিচার হলে নভেরা অনেককেই ছাড়িয়ে যেত।
তরুণ কবি পিয়াস মজিদের বিষয়ে তিনি বলেন পিয়াসের সব বিষয়েই জানাশোনা আছে, বিশ্বকোষ। পিয়াস সম্পর্কে আকাশের মন্তব্যকে তিনি যথার্থ মনে করেন। এছাড়া তিনি পরিবারের সদসদেরকে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য ধন্যবাদ জানান।
কবি পিয়াস মজিদের সঞ্চালনায় সমৃদ্ধ হয়েছিল সন্ধ্যাটি। পিয়াস নানা কবির উদ্ধৃতি দিয়ে এবং নানা তথ্যে সমৃদ্ধ করে তুলেছিল অনুষ্ঠানটিকে। ‘আমি ও জালালুদ্দিন রুমি’ শিরোনামে কবিতা দিয়ে শেষ করেন পিয়াস। অন্যরাও কবিতা পড়েন।
অনুষ্ঠান শেষে চিতই পিঠার স্বাদ মুখে করে দীর্ঘ আনন্দময় একটি দিনকে হৃদয়ে নিয়ে সবাই নগরের পথে ফিরে এলাম। কালীগঙ্গা নদীর ঘ্রাণ আমাদের স্মৃতিময় করে তুললো, এক মুহূর্তেই যেন সব স্মৃতি হয়ে গেলো মনের আরশিতে।