মামুন রশীদ
কবিতার মানুষ নুরুন্নাহার মুন্নি। কবিতার হাত ধরেই এ নামের সঙ্গে পাঠকের পরিচয়। বিচ্ছিন্নভাবে নানা কাগজে প্রকাশিত কবিতাগুলো তার পরিচয় তুলে ধরছিল। ছড়িয়ে থাকা সেই ভাবনাগুলো প্রথম মলাটবদ্ধ হয় ‘আধখোলা জানালার আলাপ’ নামে। যা কবিতার ভুবনে তাকে শনাক্ত করতে সহায়ক হয়ে ওঠে। এরপর ‘কেউ থাকে অন্ধকারে’ বইয়ের মাধ্যমে তিনি সেই শনাক্তকরণ প্রক্রিয়াকে আরও দৃঢ় করেছেন। তবে এই পরিচয়ের গণ্ডি ছাপিয়ে মুন্নি কথাকার হিসেবেও অবস্থান জানান দিয়েছেন ‘গণতন্ত্রে পুরুষতন্ত্র’ বইয়ের মাধ্যমে।
মানুষ দীর্ঘকাল ধরে গল্প শুনে আসছে। গল্প শুনতে মানুষ পছন্দ করে। তার ভেতরের কথা, নিজেকে জানানোর কথা, অন্যকে দেখে ভাবনার কথা, অনুভূতি-অনুভব, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, ক্ষোভ-বিস্ময়, ভূত-ভবিষ্যত সবই মানুষ বলতে পছন্দ করে। নিজের কথামালার সঙ্গে দৃশ্যমান বাস্তবতা ও কল্পনা মিলিয়ে-মিশিয়ে শোনাতে পছন্দ। সেই বলার বর্ণনা যার যতো বেশি আকর্ষনীয়, তা শুনতে মানুষ ততো বেশি পছন্দ করে।
গল্পের সেই ধারাবাহিকতাই বহন করে চলেছে মানুষ। যদিও এরই মাঝে ব্যক্তির আত্মসচেতনতায় এবং গল্পের বুননে কোথাও কোথাও সমাজের প্রচলিত ভারসাম্য বিঘ্নিত হওয়ার কারণেও অনেকক্ষেত্রেই গল্প হারিয়ে ফেলে তার পুরাতন সারল্য। তবে নুরুন্নাহার মুন্নি তার গল্পে ভারসাম্য রক্ষাতেই মনোযোগী হয়েছেন। তিনি তার গল্পের বুননে, গল্পের আকর্ষণ ধরে রাখতে উত্তম পুরুষে বর্ণনাকেই বেছে নিয়েছেন। সেই সঙ্গে তার গল্পের চরিত্রের কার্যকলাপের ভেতর দিয়ে দেখিয়েছেন ছকে বাঁধা জীবনের দিকগুলো। যেখানে তারা কোনোভাবে সীমালঙ্ঘন করেনা, বরং বাস্তব জীবন-কথা সম্পর্কে আগ্রহ জাগিয়ে রাখে। গল্পগ্রন্থটির কথামুখে গল্পকার নিজেও স্বীকার করেছেন, ‘গণতন্ত্রে পুরুষতন্ত্র গল্পগ্রন্থটি একটি অনুভূতির পাঠশালা।’
প্রশ্ন জাগতে পারে, সে অনুভূতির পাঠশালাটি কেমন? এই পাঠশালায় মুন্নি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বাস্তব বর্ণনার সাহায্যে শুধু পাঠককে অভিভূত করার জন্যই গল্প বলেননা বরং নিজের উপলব্ধিকেও প্রকাশ করেন। বলা হয়, ‘লেখক যখন পাঠককে অভিভূত করার জন্য, পাঠকের বিশ্বাস অর্জন করার বিষয়ে সচেষ্ট হতে শুরু করেন তখনই বোঝা যায়, তিনি একটা নতুন শিল্পরূপের আভাস পাচ্ছেন।’ মুন্নিও সচেষ্ট হয়েছেন তার গল্পে সেই শিল্পরূপের আভাস দিতে। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে তুলে আনা যায়, তার ‘প্রবাল জীবনে প্রসন্নময়ী শৈবাল’ শিরোনামের গল্পটিকে। গল্পের প্রধান চরিত্র জারা, পার্শ্বচরিত্র স্বামী মুহিত ও সন্তান ইফাদ। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু ইফাদের বেড়ে ওঠার পথে যে প্রতিবন্ধকতা, তাকে নিয়ে বাবা-মায়ের সংগ্রাম, ত্যাগ- সেইসবের মিলিত স্রোতে ইফাদের নিজেকে খুঁজে পাওয়া নিয়েই গল্প।
মুন্নি গল্প কথক, তিনি টানা গল্প বলে যান। সেই বলার ভেতর দিয়ে উঠে আসে জীবনের যন্ত্রকাতর অভিজ্ঞতা। গল্পকে বিশ্বাস্য করার জন্য বাস্তবকে যথাযথ বর্ণনা করতে হয়- এই বোধ বারেবারে প্রবল হয়ে উঠেছে মুন্নির গল্পে। ফলে সেখানে কৃত্রিমতা তো নয়ই বরং যেভাবে মানুষ জীবনকে অনুভব করে, যেভাবে জীবনের সঙ্গে গভীর সম্বন্ধ স্থাপন করে, মুন্নি সেই অনুভবকেই স্পষ্ট করতে চেষ্টা করেছেন। তার কাছে জীবনের থেকে বড় আর কিছু নেই। ফলে জীবনের দ্বন্দ্বমুখর অভিজ্ঞতাই তার গল্প। ফলে তা হয়ে উঠেছে জীবনেরই খণ্ডিত রূপ।
‘গণতন্ত্রে পুরুষতন্ত্র’ বইটি মুন্নির প্রথম ছোটগল্পের বই। ছয়টি গল্পের ভেতরে একটি গল্পের কথা উল্লেখ করেছি। কিন্তু এই উল্লেখ করা, এই যে মুন্নির গল্প নিয়ে আলাদা করে বলার চেষ্টা, সেখানে যদি প্রশ্ন করা হয়, লেখিকার কৃতিত্ব কোথায়? তাহলে বলতে হয়, মুন্নির কৃতিত্ব যতো না তার গল্পের বিষয়ে, তার চেয়েও বেশি তার দেখার দৃষ্টিতে, তার উপলব্ধির প্রকাশে। মুন্নি কবির অনুভূতিপ্রবণ মন নিয়ে দেখেন, আবেগী চোখ দিয়ে বিচার করেন। কিন্তু সেখানে কোনো সীমাবদ্ধতার জালে আটকে থাকেননা, বরং গদ্যকারের কঠোর কঠিন ভাষা দিয়েও আক্রমণ করেন, বাস্তবতার নির্মমতাকে তুলে ধরেন। যা প্রশংসনীয়। তার আরও একটি ঝোঁক খবুই চোখে পড়ে-তা হলো তিনি মানুষের, বিশেষত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কে খুব ভালো অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। আর সেই অভিজ্ঞতার আলোকেই চমৎকারভাবে মানব চরিত্র অঙ্কন করেছেন। তবে কোথাও কোথাও তার ভাষাশ্লথ, বর্ণনায় ক্লান্তিকর। কিন্তু তা যে দ্রুতই তিনি অতিক্রম করবেন, সে প্রত্যাশাও রাখা যায়। কারণ, মুন্নি ভাষা ও শব্দের স্বার্থরক্ষায় কার্পণ্য রাখেননি, নিজেকে অন্তরীণ করে রাখতেও আগ্রহী নন। ফলে দ্রুতই নতুন করে মলাটবদ্ধ হবার আয়োজনে তাকে শামিল হতে দেখার অপেক্ষা করাই যায়।
গণতন্ত্রে পুরুষতন্ত্র ॥ নুরুন্নাহার মুন্নি॥ প্রকাশক : অনুপ্রাণন প্রকাশন ॥ প্রথম প্রকাশ : নভেম্বর ২০২৪ ॥ প্রচ্ছদ : আইয়ুব আল আমিন ॥ মূল্য : ৩০০ টাকা।
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
মামুন রশীদ
বৃহস্পতিবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৫
কবিতার মানুষ নুরুন্নাহার মুন্নি। কবিতার হাত ধরেই এ নামের সঙ্গে পাঠকের পরিচয়। বিচ্ছিন্নভাবে নানা কাগজে প্রকাশিত কবিতাগুলো তার পরিচয় তুলে ধরছিল। ছড়িয়ে থাকা সেই ভাবনাগুলো প্রথম মলাটবদ্ধ হয় ‘আধখোলা জানালার আলাপ’ নামে। যা কবিতার ভুবনে তাকে শনাক্ত করতে সহায়ক হয়ে ওঠে। এরপর ‘কেউ থাকে অন্ধকারে’ বইয়ের মাধ্যমে তিনি সেই শনাক্তকরণ প্রক্রিয়াকে আরও দৃঢ় করেছেন। তবে এই পরিচয়ের গণ্ডি ছাপিয়ে মুন্নি কথাকার হিসেবেও অবস্থান জানান দিয়েছেন ‘গণতন্ত্রে পুরুষতন্ত্র’ বইয়ের মাধ্যমে।
মানুষ দীর্ঘকাল ধরে গল্প শুনে আসছে। গল্প শুনতে মানুষ পছন্দ করে। তার ভেতরের কথা, নিজেকে জানানোর কথা, অন্যকে দেখে ভাবনার কথা, অনুভূতি-অনুভব, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, ক্ষোভ-বিস্ময়, ভূত-ভবিষ্যত সবই মানুষ বলতে পছন্দ করে। নিজের কথামালার সঙ্গে দৃশ্যমান বাস্তবতা ও কল্পনা মিলিয়ে-মিশিয়ে শোনাতে পছন্দ। সেই বলার বর্ণনা যার যতো বেশি আকর্ষনীয়, তা শুনতে মানুষ ততো বেশি পছন্দ করে।
গল্পের সেই ধারাবাহিকতাই বহন করে চলেছে মানুষ। যদিও এরই মাঝে ব্যক্তির আত্মসচেতনতায় এবং গল্পের বুননে কোথাও কোথাও সমাজের প্রচলিত ভারসাম্য বিঘ্নিত হওয়ার কারণেও অনেকক্ষেত্রেই গল্প হারিয়ে ফেলে তার পুরাতন সারল্য। তবে নুরুন্নাহার মুন্নি তার গল্পে ভারসাম্য রক্ষাতেই মনোযোগী হয়েছেন। তিনি তার গল্পের বুননে, গল্পের আকর্ষণ ধরে রাখতে উত্তম পুরুষে বর্ণনাকেই বেছে নিয়েছেন। সেই সঙ্গে তার গল্পের চরিত্রের কার্যকলাপের ভেতর দিয়ে দেখিয়েছেন ছকে বাঁধা জীবনের দিকগুলো। যেখানে তারা কোনোভাবে সীমালঙ্ঘন করেনা, বরং বাস্তব জীবন-কথা সম্পর্কে আগ্রহ জাগিয়ে রাখে। গল্পগ্রন্থটির কথামুখে গল্পকার নিজেও স্বীকার করেছেন, ‘গণতন্ত্রে পুরুষতন্ত্র গল্পগ্রন্থটি একটি অনুভূতির পাঠশালা।’
প্রশ্ন জাগতে পারে, সে অনুভূতির পাঠশালাটি কেমন? এই পাঠশালায় মুন্নি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বাস্তব বর্ণনার সাহায্যে শুধু পাঠককে অভিভূত করার জন্যই গল্প বলেননা বরং নিজের উপলব্ধিকেও প্রকাশ করেন। বলা হয়, ‘লেখক যখন পাঠককে অভিভূত করার জন্য, পাঠকের বিশ্বাস অর্জন করার বিষয়ে সচেষ্ট হতে শুরু করেন তখনই বোঝা যায়, তিনি একটা নতুন শিল্পরূপের আভাস পাচ্ছেন।’ মুন্নিও সচেষ্ট হয়েছেন তার গল্পে সেই শিল্পরূপের আভাস দিতে। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে তুলে আনা যায়, তার ‘প্রবাল জীবনে প্রসন্নময়ী শৈবাল’ শিরোনামের গল্পটিকে। গল্পের প্রধান চরিত্র জারা, পার্শ্বচরিত্র স্বামী মুহিত ও সন্তান ইফাদ। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু ইফাদের বেড়ে ওঠার পথে যে প্রতিবন্ধকতা, তাকে নিয়ে বাবা-মায়ের সংগ্রাম, ত্যাগ- সেইসবের মিলিত স্রোতে ইফাদের নিজেকে খুঁজে পাওয়া নিয়েই গল্প।
মুন্নি গল্প কথক, তিনি টানা গল্প বলে যান। সেই বলার ভেতর দিয়ে উঠে আসে জীবনের যন্ত্রকাতর অভিজ্ঞতা। গল্পকে বিশ্বাস্য করার জন্য বাস্তবকে যথাযথ বর্ণনা করতে হয়- এই বোধ বারেবারে প্রবল হয়ে উঠেছে মুন্নির গল্পে। ফলে সেখানে কৃত্রিমতা তো নয়ই বরং যেভাবে মানুষ জীবনকে অনুভব করে, যেভাবে জীবনের সঙ্গে গভীর সম্বন্ধ স্থাপন করে, মুন্নি সেই অনুভবকেই স্পষ্ট করতে চেষ্টা করেছেন। তার কাছে জীবনের থেকে বড় আর কিছু নেই। ফলে জীবনের দ্বন্দ্বমুখর অভিজ্ঞতাই তার গল্প। ফলে তা হয়ে উঠেছে জীবনেরই খণ্ডিত রূপ।
‘গণতন্ত্রে পুরুষতন্ত্র’ বইটি মুন্নির প্রথম ছোটগল্পের বই। ছয়টি গল্পের ভেতরে একটি গল্পের কথা উল্লেখ করেছি। কিন্তু এই উল্লেখ করা, এই যে মুন্নির গল্প নিয়ে আলাদা করে বলার চেষ্টা, সেখানে যদি প্রশ্ন করা হয়, লেখিকার কৃতিত্ব কোথায়? তাহলে বলতে হয়, মুন্নির কৃতিত্ব যতো না তার গল্পের বিষয়ে, তার চেয়েও বেশি তার দেখার দৃষ্টিতে, তার উপলব্ধির প্রকাশে। মুন্নি কবির অনুভূতিপ্রবণ মন নিয়ে দেখেন, আবেগী চোখ দিয়ে বিচার করেন। কিন্তু সেখানে কোনো সীমাবদ্ধতার জালে আটকে থাকেননা, বরং গদ্যকারের কঠোর কঠিন ভাষা দিয়েও আক্রমণ করেন, বাস্তবতার নির্মমতাকে তুলে ধরেন। যা প্রশংসনীয়। তার আরও একটি ঝোঁক খবুই চোখে পড়ে-তা হলো তিনি মানুষের, বিশেষত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কে খুব ভালো অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। আর সেই অভিজ্ঞতার আলোকেই চমৎকারভাবে মানব চরিত্র অঙ্কন করেছেন। তবে কোথাও কোথাও তার ভাষাশ্লথ, বর্ণনায় ক্লান্তিকর। কিন্তু তা যে দ্রুতই তিনি অতিক্রম করবেন, সে প্রত্যাশাও রাখা যায়। কারণ, মুন্নি ভাষা ও শব্দের স্বার্থরক্ষায় কার্পণ্য রাখেননি, নিজেকে অন্তরীণ করে রাখতেও আগ্রহী নন। ফলে দ্রুতই নতুন করে মলাটবদ্ধ হবার আয়োজনে তাকে শামিল হতে দেখার অপেক্ষা করাই যায়।
গণতন্ত্রে পুরুষতন্ত্র ॥ নুরুন্নাহার মুন্নি॥ প্রকাশক : অনুপ্রাণন প্রকাশন ॥ প্রথম প্রকাশ : নভেম্বর ২০২৪ ॥ প্রচ্ছদ : আইয়ুব আল আমিন ॥ মূল্য : ৩০০ টাকা।