আবদুল ওয়াহাব
শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন সংবাদ সাময়িকী
‘নরেন ঘোষ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’ সাইনবোর্ডটি চোখে পড়তেই শরীরের ক্লান্তি যেন এক নিমিষেই মিলিয়ে গেল। আমি ধীর পায়ে গিয়ে কাঠের টুলে বসলাম। বাতাসে মাটির ঘ্রাণ, চারপাশে নির্জনতা আর সবুজের উচ্ছ্বাস, পাখিদের কিচির-মিচির। সব মিলিয়ে মনে হলো আমি এক অচেনা পৃথিবীতে এসে পড়েছি। অনেক দিন এমন পরিবেশের ছোঁয়া পাইনি।
দুই কারণে বেশ স্বস্তি বোধ করছিলাম। আমি যে মিষ্টির দোকানটি খুঁজছিলাম তা অবশেষে খুঁজে পেয়েছি, আর বিক্রির জন্য দোকানে তখনও কিছু মিষ্টি বাকি ছিল। আমি ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি যে সেখানে পৌঁছাতেই আমার পুরো সকালটা লেগে যাবে।
মিষ্টির দোকানটি ছিল একটি ছোট মাটির ঘর। পুরো ঘরও নয়। একটা অংশ মাত্র। উপরে একটি টিনের চালা। দোকানের সামনের দিকটা খোলা জানালার মতো। কাঠের ঝুলন্ত কপাট দিয়ে এটি বন্ধ করা যায়।ঘরের ভেতরে বসে ছিলেন এক বৃদ্ধ। গায়ে পুরোনো শাল, চোখের চারপাশটায় বয়সের কুঞ্চন, কিন্তু দৃষ্টিতে অদ্ভুত এক আলোকচ্ছটা। তার সামনে কাঠের চেয়ারে মাটির একটা বড়ো পাত্র রাখা। পাত্রের ভেতরে কয়েকটি মিষ্টি। তিনি স্থির হয়ে তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে, যেন বহু প্রতীক্ষিত অতিথির আগমন ঘটেছে।
আমার বন্ধু যেভাবে এই মিষ্টির প্রশংসা করেছে, তাতে আমার সাত-আটটা মিষ্টি না খেয়ে এখান থেকে ওঠার কথা না। ভাবলাম, আগে একটা খেয়ে দেখি। ভালো লাগলে পরে আরও নেওয়া যাবে। বললাম, ‘একটা মিষ্টি দিন।’
বৃদ্ধ লোকটি তার কুঁচকে যাওয়া খালি হাতে বাটি থেকে একটা তুলে নেওয়ার চেষ্টা করতেই আমি তাড়াতাড়ি বললাম, ‘একটা চামচ দিয়ে মিষ্টিটা তুলে দিন না!’
‘মিষ্টিতে আমার হাতের ছোঁয়া থাকতে হবে!’ বৃদ্ধ মৃদুস্বরে উত্তর দিলেন।
‘আর যদি এটা স্পর্শ না করেন তাহলে কী হবে?’ আমি ব্যঙ্গাত্মক হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
বৃদ্ধ লোকটি সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তাহলে আপনি যে স্বাদের জন্য এসেছেন সেটা আর থাকবে না।’
আপাতদৃষ্টিতে অর্থহীন কথাগুলো শুনে আমি শান্ত থাকার চেষ্টা করলাম। কিছুক্ষণ ভেবে নতুন পথে এগোতে চেষ্টা করলাম, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে। প্রথমে চামচ দিয়ে একটা মিষ্টি দিন, তারপর আপনার হাতের স্পর্শে আরেকটা খাব। এরপর আমি বুঝতে পারব কোনটা বেশি ভালো।’
‘আমার কাছে চামচ নেই। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আপনি দিনে একটার বেশি মিষ্টি খেতে পারবেন না।’
আমি অবাক হয়ে গেলাম। কিছুটা রেগে গিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, ‘এটা আপনার ব্যাপার নয়। এটা আমার ইচ্ছা! আমি যত খুশি মিষ্টি কিনব। এমনকি আপনার দোকানের সবগুলো মিষ্টি আমি কিনতে পারবো। আমার কাছে যথেষ্ট টাকা আছে! আর, আমার কোনো ডায়াবেটিস নাই। আমি দুইটা কেন, ইচ্ছে হলে দশটা মিষ্টিও খেতে পারব।’
‘আপনি একটির বেশি মিষ্টি খেতে পারবেন না। কেউ পারে না। এটা এই দোকানের রীতি। একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে এভাবেই চলে আসছে- প্রতিদিন চল্লিশজনের জন্য চল্লিশটি মিষ্টি। আপনি এই মিষ্টি বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবেন না; এখানেই খেতে হবে, আমার সামনে।’ বৃদ্ধ একটু থামলেন। আমার দিকে একবার তাকালেন, তারপর মিষ্টিটি আবার বাটিতে রাখলেন।
আমি তার কথাগুলো বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমার মতো মিষ্টিপ্রেমী মানুষ এতদূর এসেছে কেবল একটি মিষ্টির স্বাদ নিতে! তাও আবার কুঁচকে যাওয়া খালি হাতের স্পর্শ মাখা। রাজধানী থেকে আমি হাইওয়েতে আড়াই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে ভ্রমণ করেছি। তারপর জরাজীর্ণ সরু রাস্তা ধরে একটি লক্কড়-ঝক্কড় লোকাল বাসে প্রায় এক ঘণ্টা কাটিয়েছি। এরপর ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে জুতা জোড়া হাতে নিয়ে আইল ধরে হেঁটেছি।গরমে ঘেমে ধুয়ে একাকার। এতসব কিছু করেছি শুধু একটি মিষ্টির জন্য! এই মিষ্টির খোঁজ দেওয়া বন্ধুর উপর আমার রাগ হচ্ছিল। সে আমাকে ‘একটার বেশি মিষ্টি খাওয়া যাবে না’ এই নিয়মের কথা বলেনি। আমি দোকানের বাইরে কাঠের টুলে বসে সাইনবোর্ডের দিকে তাকালাম নিশ্চিত হওয়ার জন্য যে আমি সঠিক জায়গায় আছি কিনা। মরিচা পড়া টিনের সাইনবোর্ডে লেখা ছিল: নরেন ঘোষ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার।ঠিকই আছে।
‘আপনি কি নরেন ঘোষ?’
‘না, আমার নাম বীরেন ঘোষ। নরেন ঘোষ ছিলেন আমার দাদার বাবা। উনি একজন সাহসী ব্যক্তি ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন এবং যুদ্ধেই মারা গিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরে আমার দাদা ধীরেন ঘোষ দোকানটি চালাতেন। তিনি মারা যাওয়ার পর আমার বাবা সত্যেন ঘোষ দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সৈন্যরা এসেছিল মিষ্টি খেতে। তিনি তাদের শুধুমাত্র একটি মিষ্টি খাওয়ার নিয়ম ভাঙতে দেননি। তারা দোকানের ভেতরেই তাকে গুলি করে হত্যা করে।’ বীরেন ঘোষ একটি জায়গার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন।
ঘোষদের পারিবারিক ইতিহাসে আমার ততটা আগ্রহ ছিল না। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘মানুষ আপত্তি করে না?
‘কীসে?’
‘আপনার হাতের স্পর্শে।’
‘কেন তারা করবে? তারা তো এই ছোঁয়া পেতেই আসে।’
‘না, আমি বলতে চাইছি... ধর্মের দিক থেকে কি এটাকে একটি সমস্যা হিসেবে দেখা হয় না?’ আমি বিষয়টি উত্থাপন করতে চাইনি কিন্তু আমাকে থামাতে পারলাম না।
‘ধর্ম এখানে সমস্যা নয়। আসল সমস্যা হলো রাজনীতি। সেই কারণেই সাইনবোর্ডটি নতুন রূপ ধারণ করে- প্রথমে ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান বিভাগের সময় এবং তারপর আবার ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়। ধর্মের নামে দুর্বৃত্তরা বারবার এটি পুড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমি জানি এটি কখনই ধর্মের বিষয় ছিল না; এটি ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক।আপনি জেনে অবাক হবেন যে,প্রতিবারই একটি মুসলিম কাঠমিস্ত্রির পরিবার সাইনবোর্ডটি মেরামত করেছে। তাদের ঐতিহ্যবাহী স্পর্শ দিয়ে এটি পুনরুদ্ধার করেছে।’
‘মানুষ কেন যুদ্ধ করে? আপনার কী মনে হয়?’ প্রসঙ্গ পাল্টাতে বৃদ্ধকে জিজ্ঞাসা করলাম।
‘তারা লাভের জন্য লড়াই করে। কিন্তু তারা কখনও ভাবে না যে, তাদের লাভ অন্যদের ক্ষতি করে।’
আমি সম্মতিতে মাথা নাড়লাম এবং যুদ্ধের কথা বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। ‘আপনি কি আপনার দোকানে লাভ করেন না?’
‘এটা অলাভজনক। সবকিছু এক শতাব্দী আগের মতোই আছে।’
‘আপনি বলেছিলেন আপনার দাদার বাবা দিনে ৪০টি মিষ্টি বানাতেন, আর তাতে কোনও পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু দামের কী হবে? এক শতাব্দী আগের মতোই আছে? আমার তো সন্দেহ হয়!’
‘এটা অলাভজনক।’
‘আপনি মিষ্টির দাম বাড়িয়েছেন- আপনি এটাকে কীভাবে অলাভজনক বলেন?’
‘সহজ যুক্তি। দুধ ও চিনির দাম বেড়েছে, যার কারণে দাম বেড়েছে। আমরা এর থেকে মোটেও লাভবান হই না। আসলে, আমরা আমাদের শ্রম বা সময়ের জন্য কোনও চার্জ নিই না। মিষ্টি তৈরি করতে আমাদের যা খরচ হয় সেটা ভাগ করে প্রতিটি মিষ্টির দাম নির্ধারণ করা হয়।’
‘কিন্তু কেন? আপনারা এটা কেন করেন? কেবল একদিন বা এক মাসের জন্য নয়- বছরের পর বছর ধরে। কেন? আপনাদের স্বার্থ কী? মানুষের কাজের পেছনে কোনো না কোনো স্বার্থ থাকে। স্বার্থ ছাড়া মানুষ কাজ করে না।’
‘স্পর্শ আমাকে সমৃদ্ধ করে। আমি যখন স্পর্শ ছড়িয়ে দিই, তখন আমি আমার ভেতরে স্রষ্টার জাদু অনুভব করি। যখন আমি মিষ্টিগুলো তুলে দেই, তখন আমি সেগুলো স্পর্শ করে সেখানে আমার চিহ্ন রাখি- একজন স্রষ্টার চিহ্ন। যেহেতু এখানে লাভের কোনো ব্যাপার নাই, তাই এই স্পর্শ বাধা ছাড়াই চলতে থাকে। আমার থেকে অন্য ব্যক্তির কাছে। তার থেকে আপনার কাছে। আপনার থেকে অন্যদের কাছে।’
‘সারাদিন বেশি বেশি মিষ্টি তৈরি করে বিক্রি করে আপনি তো ধনী হতে পারেন। এটা একটা বিখ্যাত দোকান। গ্রাহকের অভাব নাই, তাই না?’
‘আমি এটা ভাবতেও পারি না। এটা আমার স্পর্শকে অপবিত্র করবে। সব জায়গায় লাভের খোঁজ করা উচিত নয়। অলাভজনক স্পর্শ সারা পৃথিবীতে কোনো না কোনোভাবে ছড়িয়ে আছে। অন্যথায় এই পৃথিবী বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে।’
আমি কয়েক সেকেন্ডের জন্য কিছু বলতে পারিনি। আমি আমার ভাবনার জগত থেকে কিছুটা সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকলাম। হঠাৎ আমি বুঝতে পারলাম যে, এখন আমার কিছু বলার পালা। আমি মাথা নাড়লাম এবং মৃদুস্বরে বললাম, ‘আমি আপনার সাথে একমত।’
কিছুক্ষণ পরে বৃদ্ধ আবার বললেন, ‘মনে রাখবেন যে মিষ্টি তৈরির সমস্ত উপাদান আমার এই কুঁচকানো আঙুল ও তালুর স্পর্শ বহন করে। সুতরাং, বিক্রির সময় এটিতে চূড়ান্ত স্পর্শ দেওয়ার অধিকার আমার আছে।’
গ্রাহকরা একে একে এলেন নরেশ ঘোষ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মিষ্টি এবং ঐতিহ্যবাহী স্পর্শ উপভোগ করার জন্য। মিষ্টি খেয়ে তৃপ্ত মনে চুপচাপ দোকান ছেড়ে চলে যান। এক পর্যায়ে বাটিতে কেবল একটি মিষ্টি অবশিষ্ট ছিল। সেই সময় একজন যুবক আমার পাশে দাঁড়িয়ে মিষ্টিটা কিনতে চাইল।
বৃদ্ধ লোকটি বললেন, ‘দোকান আজ বন্ধ। কাল এসো।’
যুবকটিকে হতাশ দেখাচ্ছিল। কিন্তু সে হেসে বলল, ‘আমি আগামীকাল তাড়াতাড়ি আসব।’
যুবকটি চলে যাওয়ার পর আমি বৃদ্ধ লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনি তাকে মিথ্যা বললেন কেন? আপনার কাছে এখনও একটা মিষ্টি বাকি আছে। আপনি এটা তার কাছে বিক্রি করতে পারতেন।’
‘না, আমি পারব না। মিষ্টিটা ইতোমধ্যেই আমার স্পর্শ পেয়েছে। আর এই (১০-এর পৃষ্ঠার পর)
স্পর্শটা আপনার জন্য বিশেষভাবে নির্ধারিত। একটু খেয়াল করে দেখেন, আমি এটা বাটির এক পাশে রেখেছি আর বাকিগুলো মাঝখান থেকে বিক্রি করেছি। আপনি চাইলে এখনও নিতে পারেন, কিন্তু যদি না চান, আমি এটা আমার নাতনিকে দেবো।’ আমি হাসিমুখে বললাম, ‘আমি নেবো।’
তৃপ্তির এক ঝলক তার মুখ উজ্জ্বল করে তুলল। ‘ওহ! এই নিন! আমি খুশি যে আপনি অবশেষে স্পর্শের গুরুত্ব বুঝতে শিখেছেন। অনেক মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে আমার মিষ্টির স্বাদ নিতে আসে, কিন্তু তারা স্পর্শের গুরুত্ব বুঝতে ব্যর্থ হয়। তারা আমার মিষ্টি না খেয়ে এবং স্পর্শের জ্ঞান ছাড়াই এই জায়গা ছেড়ে চলে যায়।’
বীরেন ঘোষ তার কুঁচকে যাওয়া, খালি হাতে পাত্র থেকে শেষ মিষ্টিটা তুলে একটা ছোট্ট মাটির বাটিতে রাখল এবং আমার হাতে দিল।
আমি মিষ্টির দিকে তাকিয়ে রইলাম। মিষ্টি থেকে রস বের হচ্ছিল। আমি এটি আমার বৃদ্ধাঙ্গুলি এবং তর্জনীর মধ্যে নিয়ে, মুখে ঢুকিয়ে, ধীরে ধীরে চেপে ধরলাম। আমি চোখ বন্ধ না করে থাকতে পারলাম না। আমার সাথে সাথেই মনে হলো, কেন নরেন ঘোষ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার সাইনবোর্ডটি একশ বছরেরও বেশি সময় ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মিষ্টিটির মধ্যে একটি জাদুকরী স্বাদ ছিল। আমাদের জিহ্বা চিনতে পারে এমন সমস্ত ধরনের মিষ্টি স্বাদকে গত এক শতাব্দী ধরে জমিয়ে রেখেছে। আমি বুঝতে পারলাম, কেন দোকানটি দুটি বিশ্বযুদ্ধ ও একটি মুক্তিযুদ্ধ সহ্য করে টিকে আছে, কেন ‘চল্লিশ জন গ্রাহকের জন্য দিনে ৪০টি মিষ্টি’ ঐতিহ্য নরেন ঘোষ থেকে ধীরেন ঘোষ, তারপর সত্যেন ঘোষ এবং এখন বীরেন ঘোষের কাছে চলে এসেছে।
মিষ্টিটা শেষ করতে পারলাম না, কারণ স্বাদটা আমার মুখেই আটকে ছিল। মিষ্টির বস্তুগত অংশটা আমার খাদ্যনালী দিয়ে চলে গেল, কিন্তু এর অপার্থিব স্পর্শ আমার জিহ্বায় আটকে গেল আর তা সেখানেই রইল।
আমি চোখ খুলে বললাম, ‘হ্যাঁ, আপনি ঠিক বলেছেন, মিষ্টিতে অবশ্যই আপনার স্পর্শ থাকতে হবে! আমি স্পর্শটা আমার হৃদয়ে অনুভব করলাম! আপনার স্পর্শ না থাকলে, এটা শুধু আরেকটি সাধারণ মিষ্টি হতো।’
বীরেন ঘোষ বেশ উৎসাহ নিয়ে বললেন, ‘যদি আপনি আরেকটির স্বাদ নিতে চান, তাহলে আপনি আমার বাড়িতে রাত কাটাতে পারেন। মিষ্টি তৈরির পদ্ধতিও দেখতে পারবেন। তারপর আগামীকাল সকালে আপনি আরেকটি খেতে পারবেন!’
আমি তার মিষ্টির রসযুক্ত আঠালো হাতটি ধরে চোখের দিকে তাকালাম। আমি কিছুই বললাম না, শুধু আমার স্পর্শের মাধ্যমে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম।
দীর্ঘক্ষণ থেমে রইলাম। পৃথিবীর সবকিছু এক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে গেল। তারপর আমি বললাম, ‘পৃথিবী অসুস্থ! আপনার স্পর্শ তার প্রয়োজন। আপনি একজন জ্ঞানী ব্যক্তি। আপনার কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি।’
বৃদ্ধ হাসলেন। ‘আমি একজন নিরক্ষর মানুষ। আমার সমস্ত কথা আমার পূর্বসূরিদের মাধ্যমে আমার কাছে এসেছে। এগুলো নরেন ঘোষের কাছ থেকে এসেছে। তিনিও একজন নিরক্ষর মানুষ ছিলেন। আমি জানি না তিনি কার কাছ থেকে এগুলো শিখেছিলেন। যখনই কোনো নতুন ব্যক্তি আমার দোকানে আসে এবং স্পর্শের কারণে মিষ্টি খেতে দ্বিধা করে, তখন আমি একই কথা বলি।’
আমি বৃদ্ধ লোকটির এবং তার কুঁচকে যাওয়া হাতের দিকে তাকালাম। আমি তাকে বললাম, ‘আমি এটা বিশ্বাস করি না! আপনি নিরক্ষর মানুষ হতে পারেন না। আপনার জীবনের একটি দর্শন আছে।’
‘দাঁড়ান, একটু অপেক্ষা করেন। আমি আমার নাতনি স্বর্ণাকে ডাকছি।’
তিনি বেশ জোরে শব্দ করে ডাকলেন, ‘স্বর্ণা! স্বর্ণা! এখানে এসো।’
একটি কিশোরী মেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। সে ছিল এই গ্রামে আমার দেখা প্রথম মেয়ে।
বৃদ্ধ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এবার আপনার পালা। আপনি স্বর্ণাকে যেকোনো একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেন যা আমার কাছে আগে জানতে চেয়েছেন।’
‘স্বর্ণা, আমি একটার বেশি মিষ্টি চাই। তুমি কী বলো? তুমি কি আমাকে খাওয়ার অনুমতি দেবে?’
‘আপনি একটার বেশি মিষ্টি খেতে পারবেন না। এটাই নিয়ম! একশ’ বছরেরও বেশি সময় ধরে এভাবেই চলে আসছেÑ প্রতিদিন চল্লিশজন লোকের জন্য চল্লিশটি মিষ্টি। আপনি এই মিষ্টি বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবেন না; এখানেই খেতে হবে, আমার সামনে।’ স্বর্ণা এক নিঃশ্বাসে এসব কথা বলে তারপর তার দাদুর দিকে তাকাল। বৃদ্ধের কাছ থেকে ইশারা পেয়ে সে বাড়ির ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
বীরেন ঘোষ আমাকে কিছু বলতে চেয়েছিলেন। আমি তাকে থামিয়ে দিয়েছিলাম, কারণ আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, পরিবারের প্রতিটি সদস্য এরকম প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রস্তুত। আমি বললাম, ‘আমি বুঝতে পেরেছি। দুর্ভাগ্যবশত আমি নরেন ঘোষের সাথে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করতে পারিনি। কিন্তু আমি যুগ যুগ ধরে সেই মহান স্পর্শ অনুভব করেছি আপনার মাঝে। এমনকি আমি স্বর্ণার মাঝেও তাকে খুঁজে পেয়েছি।’
‘সেই আমাদের পরবর্তী ঘোষ যে মিষ্টি বিক্রি করবে!’
আমি তার কণ্ঠে যন্ত্রণার স্পর্শ অনুভব করলাম। কিন্তু আমি তাকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করার সাহস পাইনি।
বীরেন ঘোষ আমাকে চুপ থাকতে দেখে নিজেই বলে উঠলেন, ‘স্বর্ণাই হবে পরবর্তী ঘোষ যে মিষ্টি বিক্রি করবে। কারণ তার বাবা, আমার একমাত্র ছেলে, ১৯৮৮ সালের বন্যায় কলেরায় মারা গিয়েছিল। স্বর্ণার বড় দুই ভাই আছে। তারা দুজনেই উচ্চশিক্ষার জন্য গ্রাম ছেড়েছে।’
‘কিন্তু তারা যেকোনো সময় আসতে পারে এবং ঐতিহ্যবাহী এই ব্যবসায় যোগ দিতে পারে।’
‘অবশ্যই তারা পারবে। কিন্তু তারা সম্ভবত করবে না। তারা আরও ভালো জীবন, আরও ভালো পরিবেশ চায়। তারা মাটির ঘর পছন্দ করে না। সর্বত্র ইঁদুর থাকে। বৃষ্টির সময় তারা কর্দমাক্ত রাস্তা পছন্দ করে না। গ্রীষ্মের তাপ তারা সহ্য করতে পারে না। এখানে বিদ্যুৎ নেই!’ বীরেন ঘোষ আর কিছু বলতে পারল না; কারণ তার গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল।
আমি নির্বাক হয়ে তার সামনে দাঁড়ালাম। বৃদ্ধ নিজেকে সামলে নিলেন এবং বললেন, ‘তারা বুঝতে পারে না যে, একটি পবিত্র দায়িত্ব আছে তাদের। মিষ্টির সাথে অলাভজনক, ঐতিহ্যবাহী স্পর্শ দেওয়ার দায়িত্ব।’
আমি তাকে বাধা দিতে চাইনি, কিন্তু আমি একটি যুক্তিসঙ্গত বিষয় তুলে ধরতে চাইলাম: ‘তারা তো অন্য ব্যবসা করেও অলাভজনক স্পর্শ দিতে পারে।’
বীরেন ঘোষ মাথা নেড়ে বললেন, ‘এটা হয় না। নিজের ঐতিহ্য ধরে রাখতে হবে। আমি কৃষিকাজ করি, কিন্তু সেখানে পবিত্র স্পর্শ পাবো না, কারণ আমি এটা করি এই পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য, নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য। পবিত্র স্পর্শ আমার মানসিক সুস্থতার সাথে আবদ্ধ। এটা আমার পূর্বসূরিদের সাথে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সংযুক্ত করার একটি সেতু। এই কারণেই ঐতিহ্য এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ।’
সেই মুহূর্তে আমি বুঝতে পারলাম যে, আমি একজন বৃদ্ধের কাছ থেকে নতুন কিছু শিখেছি যিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দ্বারা আলোকিত নন বরং ঐতিহ্য দ্বারা সমৃদ্ধ। আমি এমন কিছু শিখেছি যা আমার শিক্ষাজীবনে যা শিখেছি তার চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমি আরও বুঝতে পারলাম যে, আমি কোনোভাবে আমার পারিবারিক ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছি এবং পবিত্র স্পর্শ হারিয়ে ফেলেছি।’
আমি সেখান থেকে দ্রুত চলে আসতে চেয়েছিলাম; কারণ আমি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। তাকে বললাম, ‘আমি আবার একদিন আসব আপনার তৈরি মিষ্টি খেতে।’
‘আপনার ফিরে আসার দরকার নেই। আপনি নিজেই কারণটা জানেন।’ বীরেন ঘোষ হাসলেন। তার হাসিতে স্বর্গীয় স্পর্শ ছিল।
আমি আবার তার হাত ধরলাম। যাতে তার স্পর্শ আমার হাতের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। আমি তাকে বিদায় জানালাম।
মিষ্টির দোকান থেকে বেরিয়ে আসার পর আমি নিজেকে বললাম, ‘হ্যাঁ, আমার আর ফিরে আসার দরকার নেই। কারণটা আমি জানি। শতাব্দী প্রাচীন স্পর্শে কেবল একটি মিষ্টিই যথেষ্ট! এটি একদিনের জন্য যথেষ্ট, এমনকি সারা জীবনের জন্যও যথেষ্ট! যদি কেউ আমার শেষ নিঃশ্বাসের আগে এর স্বাদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, আমি সহজেই এটি বর্ণনা করতে পারব যেন আমি কয়েক সেকেন্ড আগেই এটির স্বাদ পেয়েছি! অলাভজনক স্পর্শ এর সাথে চিরন্তন জাদু বহন করে! এটি ধর্মকে অতিক্রম করে। এটি যুদ্ধকে অতিক্রম করে। এটি মানবতাকে এক কোণ থেকে অন্য কোণে, এক শতাব্দী থেকে অন্য শতাব্দীতে এবং অনাগত যুগের সাথে সংযুক্ত করে!’
আমি যখন মাঠের সবুজের মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে শুরু করলাম, তখন শেষবারের মতো পেছন ফিরে তাকালাম। বৃদ্ধ তখনও তার কুঁচকে যাওয়া ডান হাতটি নাড়ছিলেন। আমি বাতাসে তার মিষ্টি, নরম স্পর্শ অনুভব করলাম। সেই মিষ্টি, কোমল বাতাস আমাকে সারা ধানক্ষেত, গ্রামাঞ্চলের রাস্তা, হাইওয়ে এবং এমনকি রাজধানীতে আমার শোবার ঘরেও অনুসরণ করছিল।
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
আবদুল ওয়াহাব
শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন সংবাদ সাময়িকী
বৃহস্পতিবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৫
‘নরেন ঘোষ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’ সাইনবোর্ডটি চোখে পড়তেই শরীরের ক্লান্তি যেন এক নিমিষেই মিলিয়ে গেল। আমি ধীর পায়ে গিয়ে কাঠের টুলে বসলাম। বাতাসে মাটির ঘ্রাণ, চারপাশে নির্জনতা আর সবুজের উচ্ছ্বাস, পাখিদের কিচির-মিচির। সব মিলিয়ে মনে হলো আমি এক অচেনা পৃথিবীতে এসে পড়েছি। অনেক দিন এমন পরিবেশের ছোঁয়া পাইনি।
দুই কারণে বেশ স্বস্তি বোধ করছিলাম। আমি যে মিষ্টির দোকানটি খুঁজছিলাম তা অবশেষে খুঁজে পেয়েছি, আর বিক্রির জন্য দোকানে তখনও কিছু মিষ্টি বাকি ছিল। আমি ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি যে সেখানে পৌঁছাতেই আমার পুরো সকালটা লেগে যাবে।
মিষ্টির দোকানটি ছিল একটি ছোট মাটির ঘর। পুরো ঘরও নয়। একটা অংশ মাত্র। উপরে একটি টিনের চালা। দোকানের সামনের দিকটা খোলা জানালার মতো। কাঠের ঝুলন্ত কপাট দিয়ে এটি বন্ধ করা যায়।ঘরের ভেতরে বসে ছিলেন এক বৃদ্ধ। গায়ে পুরোনো শাল, চোখের চারপাশটায় বয়সের কুঞ্চন, কিন্তু দৃষ্টিতে অদ্ভুত এক আলোকচ্ছটা। তার সামনে কাঠের চেয়ারে মাটির একটা বড়ো পাত্র রাখা। পাত্রের ভেতরে কয়েকটি মিষ্টি। তিনি স্থির হয়ে তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে, যেন বহু প্রতীক্ষিত অতিথির আগমন ঘটেছে।
আমার বন্ধু যেভাবে এই মিষ্টির প্রশংসা করেছে, তাতে আমার সাত-আটটা মিষ্টি না খেয়ে এখান থেকে ওঠার কথা না। ভাবলাম, আগে একটা খেয়ে দেখি। ভালো লাগলে পরে আরও নেওয়া যাবে। বললাম, ‘একটা মিষ্টি দিন।’
বৃদ্ধ লোকটি তার কুঁচকে যাওয়া খালি হাতে বাটি থেকে একটা তুলে নেওয়ার চেষ্টা করতেই আমি তাড়াতাড়ি বললাম, ‘একটা চামচ দিয়ে মিষ্টিটা তুলে দিন না!’
‘মিষ্টিতে আমার হাতের ছোঁয়া থাকতে হবে!’ বৃদ্ধ মৃদুস্বরে উত্তর দিলেন।
‘আর যদি এটা স্পর্শ না করেন তাহলে কী হবে?’ আমি ব্যঙ্গাত্মক হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
বৃদ্ধ লোকটি সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তাহলে আপনি যে স্বাদের জন্য এসেছেন সেটা আর থাকবে না।’
আপাতদৃষ্টিতে অর্থহীন কথাগুলো শুনে আমি শান্ত থাকার চেষ্টা করলাম। কিছুক্ষণ ভেবে নতুন পথে এগোতে চেষ্টা করলাম, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে। প্রথমে চামচ দিয়ে একটা মিষ্টি দিন, তারপর আপনার হাতের স্পর্শে আরেকটা খাব। এরপর আমি বুঝতে পারব কোনটা বেশি ভালো।’
‘আমার কাছে চামচ নেই। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আপনি দিনে একটার বেশি মিষ্টি খেতে পারবেন না।’
আমি অবাক হয়ে গেলাম। কিছুটা রেগে গিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, ‘এটা আপনার ব্যাপার নয়। এটা আমার ইচ্ছা! আমি যত খুশি মিষ্টি কিনব। এমনকি আপনার দোকানের সবগুলো মিষ্টি আমি কিনতে পারবো। আমার কাছে যথেষ্ট টাকা আছে! আর, আমার কোনো ডায়াবেটিস নাই। আমি দুইটা কেন, ইচ্ছে হলে দশটা মিষ্টিও খেতে পারব।’
‘আপনি একটির বেশি মিষ্টি খেতে পারবেন না। কেউ পারে না। এটা এই দোকানের রীতি। একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে এভাবেই চলে আসছে- প্রতিদিন চল্লিশজনের জন্য চল্লিশটি মিষ্টি। আপনি এই মিষ্টি বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবেন না; এখানেই খেতে হবে, আমার সামনে।’ বৃদ্ধ একটু থামলেন। আমার দিকে একবার তাকালেন, তারপর মিষ্টিটি আবার বাটিতে রাখলেন।
আমি তার কথাগুলো বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমার মতো মিষ্টিপ্রেমী মানুষ এতদূর এসেছে কেবল একটি মিষ্টির স্বাদ নিতে! তাও আবার কুঁচকে যাওয়া খালি হাতের স্পর্শ মাখা। রাজধানী থেকে আমি হাইওয়েতে আড়াই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে ভ্রমণ করেছি। তারপর জরাজীর্ণ সরু রাস্তা ধরে একটি লক্কড়-ঝক্কড় লোকাল বাসে প্রায় এক ঘণ্টা কাটিয়েছি। এরপর ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে জুতা জোড়া হাতে নিয়ে আইল ধরে হেঁটেছি।গরমে ঘেমে ধুয়ে একাকার। এতসব কিছু করেছি শুধু একটি মিষ্টির জন্য! এই মিষ্টির খোঁজ দেওয়া বন্ধুর উপর আমার রাগ হচ্ছিল। সে আমাকে ‘একটার বেশি মিষ্টি খাওয়া যাবে না’ এই নিয়মের কথা বলেনি। আমি দোকানের বাইরে কাঠের টুলে বসে সাইনবোর্ডের দিকে তাকালাম নিশ্চিত হওয়ার জন্য যে আমি সঠিক জায়গায় আছি কিনা। মরিচা পড়া টিনের সাইনবোর্ডে লেখা ছিল: নরেন ঘোষ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার।ঠিকই আছে।
‘আপনি কি নরেন ঘোষ?’
‘না, আমার নাম বীরেন ঘোষ। নরেন ঘোষ ছিলেন আমার দাদার বাবা। উনি একজন সাহসী ব্যক্তি ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন এবং যুদ্ধেই মারা গিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরে আমার দাদা ধীরেন ঘোষ দোকানটি চালাতেন। তিনি মারা যাওয়ার পর আমার বাবা সত্যেন ঘোষ দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সৈন্যরা এসেছিল মিষ্টি খেতে। তিনি তাদের শুধুমাত্র একটি মিষ্টি খাওয়ার নিয়ম ভাঙতে দেননি। তারা দোকানের ভেতরেই তাকে গুলি করে হত্যা করে।’ বীরেন ঘোষ একটি জায়গার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন।
ঘোষদের পারিবারিক ইতিহাসে আমার ততটা আগ্রহ ছিল না। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘মানুষ আপত্তি করে না?
‘কীসে?’
‘আপনার হাতের স্পর্শে।’
‘কেন তারা করবে? তারা তো এই ছোঁয়া পেতেই আসে।’
‘না, আমি বলতে চাইছি... ধর্মের দিক থেকে কি এটাকে একটি সমস্যা হিসেবে দেখা হয় না?’ আমি বিষয়টি উত্থাপন করতে চাইনি কিন্তু আমাকে থামাতে পারলাম না।
‘ধর্ম এখানে সমস্যা নয়। আসল সমস্যা হলো রাজনীতি। সেই কারণেই সাইনবোর্ডটি নতুন রূপ ধারণ করে- প্রথমে ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান বিভাগের সময় এবং তারপর আবার ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়। ধর্মের নামে দুর্বৃত্তরা বারবার এটি পুড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমি জানি এটি কখনই ধর্মের বিষয় ছিল না; এটি ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক।আপনি জেনে অবাক হবেন যে,প্রতিবারই একটি মুসলিম কাঠমিস্ত্রির পরিবার সাইনবোর্ডটি মেরামত করেছে। তাদের ঐতিহ্যবাহী স্পর্শ দিয়ে এটি পুনরুদ্ধার করেছে।’
‘মানুষ কেন যুদ্ধ করে? আপনার কী মনে হয়?’ প্রসঙ্গ পাল্টাতে বৃদ্ধকে জিজ্ঞাসা করলাম।
‘তারা লাভের জন্য লড়াই করে। কিন্তু তারা কখনও ভাবে না যে, তাদের লাভ অন্যদের ক্ষতি করে।’
আমি সম্মতিতে মাথা নাড়লাম এবং যুদ্ধের কথা বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। ‘আপনি কি আপনার দোকানে লাভ করেন না?’
‘এটা অলাভজনক। সবকিছু এক শতাব্দী আগের মতোই আছে।’
‘আপনি বলেছিলেন আপনার দাদার বাবা দিনে ৪০টি মিষ্টি বানাতেন, আর তাতে কোনও পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু দামের কী হবে? এক শতাব্দী আগের মতোই আছে? আমার তো সন্দেহ হয়!’
‘এটা অলাভজনক।’
‘আপনি মিষ্টির দাম বাড়িয়েছেন- আপনি এটাকে কীভাবে অলাভজনক বলেন?’
‘সহজ যুক্তি। দুধ ও চিনির দাম বেড়েছে, যার কারণে দাম বেড়েছে। আমরা এর থেকে মোটেও লাভবান হই না। আসলে, আমরা আমাদের শ্রম বা সময়ের জন্য কোনও চার্জ নিই না। মিষ্টি তৈরি করতে আমাদের যা খরচ হয় সেটা ভাগ করে প্রতিটি মিষ্টির দাম নির্ধারণ করা হয়।’
‘কিন্তু কেন? আপনারা এটা কেন করেন? কেবল একদিন বা এক মাসের জন্য নয়- বছরের পর বছর ধরে। কেন? আপনাদের স্বার্থ কী? মানুষের কাজের পেছনে কোনো না কোনো স্বার্থ থাকে। স্বার্থ ছাড়া মানুষ কাজ করে না।’
‘স্পর্শ আমাকে সমৃদ্ধ করে। আমি যখন স্পর্শ ছড়িয়ে দিই, তখন আমি আমার ভেতরে স্রষ্টার জাদু অনুভব করি। যখন আমি মিষ্টিগুলো তুলে দেই, তখন আমি সেগুলো স্পর্শ করে সেখানে আমার চিহ্ন রাখি- একজন স্রষ্টার চিহ্ন। যেহেতু এখানে লাভের কোনো ব্যাপার নাই, তাই এই স্পর্শ বাধা ছাড়াই চলতে থাকে। আমার থেকে অন্য ব্যক্তির কাছে। তার থেকে আপনার কাছে। আপনার থেকে অন্যদের কাছে।’
‘সারাদিন বেশি বেশি মিষ্টি তৈরি করে বিক্রি করে আপনি তো ধনী হতে পারেন। এটা একটা বিখ্যাত দোকান। গ্রাহকের অভাব নাই, তাই না?’
‘আমি এটা ভাবতেও পারি না। এটা আমার স্পর্শকে অপবিত্র করবে। সব জায়গায় লাভের খোঁজ করা উচিত নয়। অলাভজনক স্পর্শ সারা পৃথিবীতে কোনো না কোনোভাবে ছড়িয়ে আছে। অন্যথায় এই পৃথিবী বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে।’
আমি কয়েক সেকেন্ডের জন্য কিছু বলতে পারিনি। আমি আমার ভাবনার জগত থেকে কিছুটা সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকলাম। হঠাৎ আমি বুঝতে পারলাম যে, এখন আমার কিছু বলার পালা। আমি মাথা নাড়লাম এবং মৃদুস্বরে বললাম, ‘আমি আপনার সাথে একমত।’
কিছুক্ষণ পরে বৃদ্ধ আবার বললেন, ‘মনে রাখবেন যে মিষ্টি তৈরির সমস্ত উপাদান আমার এই কুঁচকানো আঙুল ও তালুর স্পর্শ বহন করে। সুতরাং, বিক্রির সময় এটিতে চূড়ান্ত স্পর্শ দেওয়ার অধিকার আমার আছে।’
গ্রাহকরা একে একে এলেন নরেশ ঘোষ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মিষ্টি এবং ঐতিহ্যবাহী স্পর্শ উপভোগ করার জন্য। মিষ্টি খেয়ে তৃপ্ত মনে চুপচাপ দোকান ছেড়ে চলে যান। এক পর্যায়ে বাটিতে কেবল একটি মিষ্টি অবশিষ্ট ছিল। সেই সময় একজন যুবক আমার পাশে দাঁড়িয়ে মিষ্টিটা কিনতে চাইল।
বৃদ্ধ লোকটি বললেন, ‘দোকান আজ বন্ধ। কাল এসো।’
যুবকটিকে হতাশ দেখাচ্ছিল। কিন্তু সে হেসে বলল, ‘আমি আগামীকাল তাড়াতাড়ি আসব।’
যুবকটি চলে যাওয়ার পর আমি বৃদ্ধ লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনি তাকে মিথ্যা বললেন কেন? আপনার কাছে এখনও একটা মিষ্টি বাকি আছে। আপনি এটা তার কাছে বিক্রি করতে পারতেন।’
‘না, আমি পারব না। মিষ্টিটা ইতোমধ্যেই আমার স্পর্শ পেয়েছে। আর এই (১০-এর পৃষ্ঠার পর)
স্পর্শটা আপনার জন্য বিশেষভাবে নির্ধারিত। একটু খেয়াল করে দেখেন, আমি এটা বাটির এক পাশে রেখেছি আর বাকিগুলো মাঝখান থেকে বিক্রি করেছি। আপনি চাইলে এখনও নিতে পারেন, কিন্তু যদি না চান, আমি এটা আমার নাতনিকে দেবো।’ আমি হাসিমুখে বললাম, ‘আমি নেবো।’
তৃপ্তির এক ঝলক তার মুখ উজ্জ্বল করে তুলল। ‘ওহ! এই নিন! আমি খুশি যে আপনি অবশেষে স্পর্শের গুরুত্ব বুঝতে শিখেছেন। অনেক মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে আমার মিষ্টির স্বাদ নিতে আসে, কিন্তু তারা স্পর্শের গুরুত্ব বুঝতে ব্যর্থ হয়। তারা আমার মিষ্টি না খেয়ে এবং স্পর্শের জ্ঞান ছাড়াই এই জায়গা ছেড়ে চলে যায়।’
বীরেন ঘোষ তার কুঁচকে যাওয়া, খালি হাতে পাত্র থেকে শেষ মিষ্টিটা তুলে একটা ছোট্ট মাটির বাটিতে রাখল এবং আমার হাতে দিল।
আমি মিষ্টির দিকে তাকিয়ে রইলাম। মিষ্টি থেকে রস বের হচ্ছিল। আমি এটি আমার বৃদ্ধাঙ্গুলি এবং তর্জনীর মধ্যে নিয়ে, মুখে ঢুকিয়ে, ধীরে ধীরে চেপে ধরলাম। আমি চোখ বন্ধ না করে থাকতে পারলাম না। আমার সাথে সাথেই মনে হলো, কেন নরেন ঘোষ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার সাইনবোর্ডটি একশ বছরেরও বেশি সময় ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মিষ্টিটির মধ্যে একটি জাদুকরী স্বাদ ছিল। আমাদের জিহ্বা চিনতে পারে এমন সমস্ত ধরনের মিষ্টি স্বাদকে গত এক শতাব্দী ধরে জমিয়ে রেখেছে। আমি বুঝতে পারলাম, কেন দোকানটি দুটি বিশ্বযুদ্ধ ও একটি মুক্তিযুদ্ধ সহ্য করে টিকে আছে, কেন ‘চল্লিশ জন গ্রাহকের জন্য দিনে ৪০টি মিষ্টি’ ঐতিহ্য নরেন ঘোষ থেকে ধীরেন ঘোষ, তারপর সত্যেন ঘোষ এবং এখন বীরেন ঘোষের কাছে চলে এসেছে।
মিষ্টিটা শেষ করতে পারলাম না, কারণ স্বাদটা আমার মুখেই আটকে ছিল। মিষ্টির বস্তুগত অংশটা আমার খাদ্যনালী দিয়ে চলে গেল, কিন্তু এর অপার্থিব স্পর্শ আমার জিহ্বায় আটকে গেল আর তা সেখানেই রইল।
আমি চোখ খুলে বললাম, ‘হ্যাঁ, আপনি ঠিক বলেছেন, মিষ্টিতে অবশ্যই আপনার স্পর্শ থাকতে হবে! আমি স্পর্শটা আমার হৃদয়ে অনুভব করলাম! আপনার স্পর্শ না থাকলে, এটা শুধু আরেকটি সাধারণ মিষ্টি হতো।’
বীরেন ঘোষ বেশ উৎসাহ নিয়ে বললেন, ‘যদি আপনি আরেকটির স্বাদ নিতে চান, তাহলে আপনি আমার বাড়িতে রাত কাটাতে পারেন। মিষ্টি তৈরির পদ্ধতিও দেখতে পারবেন। তারপর আগামীকাল সকালে আপনি আরেকটি খেতে পারবেন!’
আমি তার মিষ্টির রসযুক্ত আঠালো হাতটি ধরে চোখের দিকে তাকালাম। আমি কিছুই বললাম না, শুধু আমার স্পর্শের মাধ্যমে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম।
দীর্ঘক্ষণ থেমে রইলাম। পৃথিবীর সবকিছু এক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে গেল। তারপর আমি বললাম, ‘পৃথিবী অসুস্থ! আপনার স্পর্শ তার প্রয়োজন। আপনি একজন জ্ঞানী ব্যক্তি। আপনার কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি।’
বৃদ্ধ হাসলেন। ‘আমি একজন নিরক্ষর মানুষ। আমার সমস্ত কথা আমার পূর্বসূরিদের মাধ্যমে আমার কাছে এসেছে। এগুলো নরেন ঘোষের কাছ থেকে এসেছে। তিনিও একজন নিরক্ষর মানুষ ছিলেন। আমি জানি না তিনি কার কাছ থেকে এগুলো শিখেছিলেন। যখনই কোনো নতুন ব্যক্তি আমার দোকানে আসে এবং স্পর্শের কারণে মিষ্টি খেতে দ্বিধা করে, তখন আমি একই কথা বলি।’
আমি বৃদ্ধ লোকটির এবং তার কুঁচকে যাওয়া হাতের দিকে তাকালাম। আমি তাকে বললাম, ‘আমি এটা বিশ্বাস করি না! আপনি নিরক্ষর মানুষ হতে পারেন না। আপনার জীবনের একটি দর্শন আছে।’
‘দাঁড়ান, একটু অপেক্ষা করেন। আমি আমার নাতনি স্বর্ণাকে ডাকছি।’
তিনি বেশ জোরে শব্দ করে ডাকলেন, ‘স্বর্ণা! স্বর্ণা! এখানে এসো।’
একটি কিশোরী মেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। সে ছিল এই গ্রামে আমার দেখা প্রথম মেয়ে।
বৃদ্ধ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এবার আপনার পালা। আপনি স্বর্ণাকে যেকোনো একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেন যা আমার কাছে আগে জানতে চেয়েছেন।’
‘স্বর্ণা, আমি একটার বেশি মিষ্টি চাই। তুমি কী বলো? তুমি কি আমাকে খাওয়ার অনুমতি দেবে?’
‘আপনি একটার বেশি মিষ্টি খেতে পারবেন না। এটাই নিয়ম! একশ’ বছরেরও বেশি সময় ধরে এভাবেই চলে আসছেÑ প্রতিদিন চল্লিশজন লোকের জন্য চল্লিশটি মিষ্টি। আপনি এই মিষ্টি বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবেন না; এখানেই খেতে হবে, আমার সামনে।’ স্বর্ণা এক নিঃশ্বাসে এসব কথা বলে তারপর তার দাদুর দিকে তাকাল। বৃদ্ধের কাছ থেকে ইশারা পেয়ে সে বাড়ির ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
বীরেন ঘোষ আমাকে কিছু বলতে চেয়েছিলেন। আমি তাকে থামিয়ে দিয়েছিলাম, কারণ আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, পরিবারের প্রতিটি সদস্য এরকম প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রস্তুত। আমি বললাম, ‘আমি বুঝতে পেরেছি। দুর্ভাগ্যবশত আমি নরেন ঘোষের সাথে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করতে পারিনি। কিন্তু আমি যুগ যুগ ধরে সেই মহান স্পর্শ অনুভব করেছি আপনার মাঝে। এমনকি আমি স্বর্ণার মাঝেও তাকে খুঁজে পেয়েছি।’
‘সেই আমাদের পরবর্তী ঘোষ যে মিষ্টি বিক্রি করবে!’
আমি তার কণ্ঠে যন্ত্রণার স্পর্শ অনুভব করলাম। কিন্তু আমি তাকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করার সাহস পাইনি।
বীরেন ঘোষ আমাকে চুপ থাকতে দেখে নিজেই বলে উঠলেন, ‘স্বর্ণাই হবে পরবর্তী ঘোষ যে মিষ্টি বিক্রি করবে। কারণ তার বাবা, আমার একমাত্র ছেলে, ১৯৮৮ সালের বন্যায় কলেরায় মারা গিয়েছিল। স্বর্ণার বড় দুই ভাই আছে। তারা দুজনেই উচ্চশিক্ষার জন্য গ্রাম ছেড়েছে।’
‘কিন্তু তারা যেকোনো সময় আসতে পারে এবং ঐতিহ্যবাহী এই ব্যবসায় যোগ দিতে পারে।’
‘অবশ্যই তারা পারবে। কিন্তু তারা সম্ভবত করবে না। তারা আরও ভালো জীবন, আরও ভালো পরিবেশ চায়। তারা মাটির ঘর পছন্দ করে না। সর্বত্র ইঁদুর থাকে। বৃষ্টির সময় তারা কর্দমাক্ত রাস্তা পছন্দ করে না। গ্রীষ্মের তাপ তারা সহ্য করতে পারে না। এখানে বিদ্যুৎ নেই!’ বীরেন ঘোষ আর কিছু বলতে পারল না; কারণ তার গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল।
আমি নির্বাক হয়ে তার সামনে দাঁড়ালাম। বৃদ্ধ নিজেকে সামলে নিলেন এবং বললেন, ‘তারা বুঝতে পারে না যে, একটি পবিত্র দায়িত্ব আছে তাদের। মিষ্টির সাথে অলাভজনক, ঐতিহ্যবাহী স্পর্শ দেওয়ার দায়িত্ব।’
আমি তাকে বাধা দিতে চাইনি, কিন্তু আমি একটি যুক্তিসঙ্গত বিষয় তুলে ধরতে চাইলাম: ‘তারা তো অন্য ব্যবসা করেও অলাভজনক স্পর্শ দিতে পারে।’
বীরেন ঘোষ মাথা নেড়ে বললেন, ‘এটা হয় না। নিজের ঐতিহ্য ধরে রাখতে হবে। আমি কৃষিকাজ করি, কিন্তু সেখানে পবিত্র স্পর্শ পাবো না, কারণ আমি এটা করি এই পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য, নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য। পবিত্র স্পর্শ আমার মানসিক সুস্থতার সাথে আবদ্ধ। এটা আমার পূর্বসূরিদের সাথে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সংযুক্ত করার একটি সেতু। এই কারণেই ঐতিহ্য এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ।’
সেই মুহূর্তে আমি বুঝতে পারলাম যে, আমি একজন বৃদ্ধের কাছ থেকে নতুন কিছু শিখেছি যিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দ্বারা আলোকিত নন বরং ঐতিহ্য দ্বারা সমৃদ্ধ। আমি এমন কিছু শিখেছি যা আমার শিক্ষাজীবনে যা শিখেছি তার চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমি আরও বুঝতে পারলাম যে, আমি কোনোভাবে আমার পারিবারিক ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছি এবং পবিত্র স্পর্শ হারিয়ে ফেলেছি।’
আমি সেখান থেকে দ্রুত চলে আসতে চেয়েছিলাম; কারণ আমি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। তাকে বললাম, ‘আমি আবার একদিন আসব আপনার তৈরি মিষ্টি খেতে।’
‘আপনার ফিরে আসার দরকার নেই। আপনি নিজেই কারণটা জানেন।’ বীরেন ঘোষ হাসলেন। তার হাসিতে স্বর্গীয় স্পর্শ ছিল।
আমি আবার তার হাত ধরলাম। যাতে তার স্পর্শ আমার হাতের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। আমি তাকে বিদায় জানালাম।
মিষ্টির দোকান থেকে বেরিয়ে আসার পর আমি নিজেকে বললাম, ‘হ্যাঁ, আমার আর ফিরে আসার দরকার নেই। কারণটা আমি জানি। শতাব্দী প্রাচীন স্পর্শে কেবল একটি মিষ্টিই যথেষ্ট! এটি একদিনের জন্য যথেষ্ট, এমনকি সারা জীবনের জন্যও যথেষ্ট! যদি কেউ আমার শেষ নিঃশ্বাসের আগে এর স্বাদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, আমি সহজেই এটি বর্ণনা করতে পারব যেন আমি কয়েক সেকেন্ড আগেই এটির স্বাদ পেয়েছি! অলাভজনক স্পর্শ এর সাথে চিরন্তন জাদু বহন করে! এটি ধর্মকে অতিক্রম করে। এটি যুদ্ধকে অতিক্রম করে। এটি মানবতাকে এক কোণ থেকে অন্য কোণে, এক শতাব্দী থেকে অন্য শতাব্দীতে এবং অনাগত যুগের সাথে সংযুক্ত করে!’
আমি যখন মাঠের সবুজের মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে শুরু করলাম, তখন শেষবারের মতো পেছন ফিরে তাকালাম। বৃদ্ধ তখনও তার কুঁচকে যাওয়া ডান হাতটি নাড়ছিলেন। আমি বাতাসে তার মিষ্টি, নরম স্পর্শ অনুভব করলাম। সেই মিষ্টি, কোমল বাতাস আমাকে সারা ধানক্ষেত, গ্রামাঞ্চলের রাস্তা, হাইওয়ে এবং এমনকি রাজধানীতে আমার শোবার ঘরেও অনুসরণ করছিল।