alt

হুমায়ূন আহমেদ

জনপ্রিয় সাহিত্যের জাদুকর

কাঙাল শাহীন

: বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৫

হুমায়ূন আহমেদ / জন্ম : ১৩ নভেম্বর ১৯৪৮; মৃত্যু : ১৯ জুলাই ২০১২

“বাংলা সাহিত্যে এমন লেখক খুব কমই এসেছেন, যিনি একসাথে পাঠকের হাসি, কান্না ও স্বপ্নের জগৎ নির্মাণ করতে পেরেছেন- হুমায়ূন আহমেদ তেমনই এক অনন্য নাম।” তিনি ছিলেন এক প্রজন্মের চেতনাবোধের স্থপতি, যিনি সাহিত্যের জগতে এসে পাঠকের অনুভূতিকে এমনভাবে ছুঁয়ে গেছেন যে, তাঁর চরিত্রগুলো আজও বেঁচে আছে পাঠকের হৃদয়ের অভ্যন্তরে। নিঃসন্দেহে তিনি শুধু একজন লেখক নন, বরং সংস্কৃতির ধারক- যার জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর, নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে, অথচ যার সৃষ্টিশক্তি ছড়িয়ে আছে সমগ্র বাংলাভাষী জগতে।

হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন মানুষের অন্তর্দৃষ্টি ও জীবনের রহস্যের একজন দার্শনিক অনুবাদক। তিনি বিশ্বাস করতেন- “মানুষের মধ্যে ভালোবাসা আছে, অন্ধকার আছে, কিন্তু আলোও আছে।” এই বিশ্বাস তার প্রতিটি রচনায় প্রতিফলিত হয়েছে

ষাট ও সত্তরের দশকের প্রেক্ষাপটে বাংলা সাহিত্য ছিলো এক গভীর উত্তাল সময়ের সাক্ষী। একদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অন্যদিকে সমাজবাস্তবতার কঠোরতা- সব মিলিয়ে পাঠক তখন খুঁজছিলেন একটুখানি আশ্রয়, একটুখানি হাসি, আর এমন এক গল্প, যা জীবনের গন্ধে ভরা। ঠিক সেই সময়েই আবির্ভূত হন হুমায়ূন আহমেদ- অদ্ভুত এক স্বচ্ছ কণ্ঠ নিয়ে, যিনি সাহিত্যকে ফিরিয়ে দিলেন জীবনের সহজ গভীর সৌন্দর্যে। তাঁর গল্পে যেমন ছিলো গ্রামের সন্ধ্যা, শহরের একাকিত্ব, তেমনি ছিলো মানুষের নিঃশব্দ ভালোবাসা, হারিয়ে যাওয়া সময়ের বিষণ্যতা, আর অলৌকিক কোনো আনন্দের ছোঁয়া।

হুমায়ূনের ভাষা সরল, কিন্তু সেই সরলতার ভেতরে লুকিয়ে থাকে গভীর দার্শনিকতা। তিনি জানতেন- মানুষ কেবল জটিল প্রাণি নয়; সে হাসতে চায়, ভালোবাসতে চায়, বাঁচতে চায়। তাই তাঁর লেখা জটিল তত্ত্ব নয়, বরং জীবনের নিরাভরণ সত্য। তাঁর উপন্যাস নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার, মিসির আলি বা হিমু- সবখানেই তিনি মানুষের মনের অদ্ভুত গোলকধাঁধাকে গল্পের মাধ্যমে উন্মোচন করেছেন। কেউ তাঁকে বলেছে “বাংলার রবিনসন ক্রুসো”, কেউ বলেছেন, “মানুষের মনের মনস্তত্ত্বের চিত্রকর।” কিন্তু আসলে তিনি ছিলেন পাঠকের আত্মীয়- যিনি আমাদের ভিতরে ঘুমিয়ে থাকা কল্পনাশক্তিকে জাগিয়ে তুলেছিলেন।

তাঁর লেখনীর বিশেষত্ব ছিলো বাস্তব ও কল্পনার এমন এক মিশ্রণ, যেখানে পাঠক বিশ্বাস করতে শুরু করে যে অলৌকিকতাও জীবনের অংশ। একদিকে বিজ্ঞানমনষ্ক চিন্তা, অন্যদিকে সহজ বিশ্বাস- এই দুই বিপরীত ধারা তিনি একসূত্রে গেঁথেছিলেন। তাই তাঁর কলমে “মিসির আলি” যেমন যুক্তিবাদী মননের প্রতীক, তেমনি “হিমু” জীবনের মায়াময় অযৌক্তিকতার প্রতিরূপ। এই দ্বৈততা, এই ভারসাম্যই হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যকে করেছে অনন্য।

বাংলা সাহিত্যে তাঁর আবির্ভাব কেবল নতুন ধারার সূচনা নয়, বরং এক মানসিক বিপ্লব। তিনি পাঠককে শিখিয়েছেন- সাহিত্য মানে শুধু উচ্চমার্গের জটিল চিন্তা নয়, বরং সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন অনুভূতির সহজ প্রকাশও হতে পারে শিল্প। তাঁর লেখার ভাষা যেনো এমন এক নদী, যা একইসাথে গভীর ও স্বচ্ছ; পাঠক সেখানে স্নান করে ফিরে আসে তৃপ্ত হয়ে, কিছুটা বদলে গিয়ে।

আজও যখন কেউ হিমুর হলুদ পাঞ্জাবি বা মিসির আলির যুক্তিপূর্ণ নীরবতা স্মরণ করে, তখন বোঝা যায়- হুমায়ূন আহমেদ কেবল লিখে যাননি, বরং জীবনের ভিতরে এক স্থায়ী ছাপ রেখে গেছেন। তাঁর সাহিত্য আমাদের শিখিয়েছে, মানুষ আসলে ছোট ছোট মুহূর্তেই বেঁচে থাকে- এক কাপ চা, একটুখানি হাসি, বা ভালোবাসার নীরব দৃষ্টিতে। এই মানবিকতা, এই সহজ অথচ গভীর বোধই তাঁকে করে তুলেছে বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে পাঠকপ্রিয়, এবং একইসাথে সবচেয়ে জীবন্ত লেখক।

হুমায়ূন আহমেদ তাই শুধু এক নাম নয়- এক আবহ, এক অনুভব, এক দীর্ঘস্থায়ী প্রতিধ্বনি; যিনি প্রমাণ করেছেন, সাহিত্য তখনই পূর্ণতা পায়, যখন তা মানুষের হৃদয়ে বাসা বাঁধে।

হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যজগৎ এমন এক আলোকিত ভুবন, যেখানে বাস্তবতা ও স্বপ্নের সীমানা মিশে গেছে এক অদ্ভুত নীরব জাদুতে। তাঁর কলমে চরিত্র মানে কেবল কাগজে আঁকা মানুষ নয়; বরং মানুষের অন্তর্লোকের প্রতিচ্ছবি- একেকটি মানসিক অবস্থা, একেকটি জীবনদর্শনের প্রতীক। যেমন হিমু, মিসির আলি, রূপা, শবনম কিংবা নন্দিতা- তাঁরা সবাই হুমায়ূনের সৃষ্টিশীল চেতনার একেকটি রূপান্তর।

হিমু- এক অদ্ভুত চরিত্র, যে জুতো পরে না, যুক্তির তোয়াক্কা করে না, অথচ মানবজীবনের গভীর সত্য উচ্চারণ করে যায় শিশুর সরলতায়। সে যেনো জ্যাঁ-পল সার্ত্রের “existential freedom”-এর জীবন্ত প্রতীক- যে সমাজের নিয়ম ভেঙে নিজের মতো বাঁচতে চায়। হিমু সমাজবিরোধী নয়, বরং সমাজের মায়াজালে বন্দী মানুষদের মুক্তি দিতে চায় তার অদ্ভুত দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে। সে যেনো বলে ওঠে- “মানুষ আসলে সুখী হতে চায়, কিন্তু ভুল পথে খোঁজে সুখ।”

অন্যদিকে মিসির আলি এক যুক্তিবাদী মননের প্রতিরূপ, যে অতিপ্রাকৃত রহস্যকে বিজ্ঞানের চোখে ব্যাখ্যা করতে চায়। মিসির আলি যেমন বাস্তবতার যুক্তি খোঁজেন, তেমনি তাঁর নীরবতাতেও থাকে এক গভীর দার্শনিকতা। তিনি যেনো আর্থার কোনান ডয়েল-এর শার্লক হোমসের বাঙালি উত্তরাধিকারী, তবে হুমায়ূনের সৃষ্টিতে তিনি আরও মানবিক, আরও একাকী। মিসির আলি জানেন, যুক্তি অনেক কিছু ব্যাখ্যা করতে পারে, কিন্তু মানুষের ভালোবাসা, কষ্ট কিংবা মৃত্যু- এসবের কোনও বৈজ্ঞানিক সূত্র নেই।

রূপা, শবনম ও নন্দিতার মতো নারী চরিত্রগুলোও হুমায়ূনের সাহিত্যকে দিয়েছে এক নরম, মানবিক সৌন্দর্য। রূপা শুধু হিমুর ভালোবাসা নয়, বরং সেই স্বপ্ন যা কখনও পাওয়া যায় না তবু হৃদয়ে থেকে যায়। শবনমের নির্ভেজাল সরলতা, নন্দিতার আধুনিক সত্তা- সব মিলিয়ে তাঁরা হুমায়ূনের নারীচরিত্রকে করেছে মাটির কাছাকাছি অথচ স্বপ্নের মতো কোমল। ভার্জিনিয়া উলফ একবার লিখেছিলেন, “Literature is strewn with the wreckage of men who have minded beyond reason the opinions of others..” - হুমায়ূনের নারীচরিত্ররা যেন সেই বক্তব্যের বিপরীতে দাঁড়িয়ে; তাঁরা নিজেদের মতো বাঁচে, ভালোবাসে, কাঁদে এবং জীবনের প্রতিটি ব্যথাকে নিজের মতো করে গ্রহণ করে।

হুমায়ূনের ভাষা ও বর্ণনা ছিলো এক বিরল শিল্প। তিনি প্রমাণ করেছিলেন, সাহিত্যিক ভাষা জটিল না হয়েও গভীর হতে পারে। তাঁর লেখার শব্দগুলো এত সহজ যে পাঠক ভাবেন, এ তো তাঁরই জীবনের কথা; অথচ সেই সরলতার আড়ালে লুকিয়ে থাকে অস্তিত্ববাদের সূক্ষ্ম দর্শন। তাঁর লেখার হাস্যরস ছিলো জীবনের অন্ধকার দূর করার আলোকরেখা, আবার একইসাথে সেই হাসির ভেতরে ছিলো হালকা বিষণ্যতার ছোঁয়া। এই হাসি ও বিষণ্যতার দ্বৈততা তাঁকে এনে দিয়েছে এক অনন্য সাহিত্যিক বৈশিষ্ট্য।

তাঁর গল্পের ভাষা যেনো গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটলের সেই কথারই প্রতিধ্বনি- “Poetry is finer and more philosophical than history; for poetry expresses the universal, and history only the particular.” হুমায়ূনের গল্পগুলোও ছিল সার্বজনীন, কারণ সেখানে শুধু চরিত্র নয়, মানবজীবনের অনন্ত আবেগ কথা বলে।

বাংলা সাহিত্যে তাঁর এই ভাষার সরলতা, চরিত্রের জটিলতা ও মানবিক রসের মিশ্রণ এক নতুন ধারার জন্ম দিয়েছে। হুমায়ূন আহমেদ আমাদের শিখিয়েছেন, সাহিত্য কখনও মানুষের উপরে নয়- তারই পাশে থাকে। তিনি সেই লেখক, যিনি জীবনের সাধারণ মুহূর্তগুলোকে করে তুলেছিলেন সাহিত্যিক বিস্ময়ে ভরা এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।

“আজ রবিবার” নাটকে তিনি তুলে ধরেছিলেন শহুরে জীবনের হাস্যরস, ব্যস্ততা ও পারিবারিক টানাপোড়েনকে। এই নাটক ছিলো এক মিষ্টি মায়াবী বিশ্রাম, যেখানে জীবনকে দেখা যায় রসিকতার চোখে, কিন্তু সেই রসিকতার ভেতরেও ছিলো এক হালকা বিষণ্যতা। তিনি আমাদের শিখিয়েছিলেন- দুঃখও হাসির মতোই জীবনের অংশ, এবং দুটিই মানুষকে পূর্ণ করে তোলে।

নাটকের সাফল্যের ধারাবাহিকতায় হুমায়ূন আহমেদ যখন চলচ্চিত্রে প্রবেশ করেন, তখনও তিনি তাঁর নিজস্ব স্বপ্নের পথেই হেঁটেছিলেন। তাঁর চলচ্চিত্র “শ্রাবণ মেঘের দিন” (১৯৯৯) ছিলো প্রেম, বেদনা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অনবদ্য ঝুসঢ়যড়হু। গ্রামীণ জীবনের স্নিগ্ধ বাস্তবতা, প্রেমের নিরাভরণ কোমলতা এবং হারিয়ে যাওয়া সময়ের বিষণ্য সুর এই চলচ্চিত্রকে পরিণত করেছিলো এক চিরকালীন ভালোবাসার চিত্রে।

পরবর্তী সময়ে “দারুচিনি দ্বীপ” (২০০৭) চলচ্চিত্রে তিনি তরুণ প্রজন্মের স্বপ্ন, একাকিত্ব ও আত্ম-অন্বেষণকে তুলে ধরেন এক ভিন্ন ভঙ্গিতে। এটি ছিলো আত্মিক ভ্রমণের গল্প, যেখানে বন্ধুত্ব, ভালোবাসা ও মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মানুষ নিজের ভেতরকে আবিষ্কার করে। তাঁর কাহিনি বলার ভঙ্গি দর্শককে নিয়ে যায় বাস্তবতার বাইরে, কিন্তু কখনও কৃত্রিমতায় নয়- এক নির্মল মানবিকতায়।

অন্যদিকে “ঘেটুপুত্র কমলা” (২০১২) তাঁর জীবনের শেষ চলচ্চিত্র- ছিলো সমাজবোধ ও সংবেদনশীলতার এক অসামান্য উদাহরণ। এই চলচ্চিত্রে তিনি স্পর্শ করেছিলেন গ্রামীণ সংস্কৃতির এক অন্ধকার বাস্তবতাকে, যেখানে শিল্প ও বেদনা পাশাপাশি হাঁটে। তিনি সমাজের নিগূঢ় স্তরে প্রবেশ করে প্রশ্ন করেছিলেন- কতোটা মানবিক আমরা, যখন শিল্পীর কণ্ঠে আনন্দ শুনি কিন্তু তার কষ্ট দেখি না?

হুমায়ূন আহমেদের নাটক ও চলচ্চিত্র কেবল বিনোদন ছিলো না; এগুলো ছিলো সামাজিক দলিল, মনস্তাত্ত্বিক প্রতিচ্ছবি এবং মানুষের অনুভূতির শ্রুতিমধুর রূপান্তর। তাঁর ক্যামেরা কখনও চরিত্রকে ছোট করে দেখেনি- বরং প্রতিটি মানুষকে দিয়েছে মর্যাদা, আবেগ ও স্বপ্ন দেখার অধিকার। ফরাসি চলচ্চিত্রকার François Truffaut-এর একটি উক্তি এখানে যথার্থ মনে হয়: “ÒA film is like a personal diary, but the audience reads it with their own emotions.”- হুমায়ূনের চলচ্চিত্রগুলোও যেনো ছিলো তাঁর ব্যক্তিগত ডায়েরি, যা পাঠক-দর্শক নিজেদের হৃদয় দিয়ে পড়েছে, আজও পড়ে চলেছে।

তাঁর সৃষ্টিতে মানুষ যেমন হাসতে শিখেছে, তেমনি কেঁদেও মুক্তি পেয়েছে। নাটক ও চলচ্চিত্রের মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদ প্রমাণ করেছেন- মানুষের গল্পই সবচেয়ে বড় শিল্প, আর জীবনের সরল মুহূর্তগুলোই হতে পারে চিরন্তন সিনেমা।

হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন মানুষের অন্তর্দৃষ্টি ও জীবনের রহস্যের একজন দার্শনিক অনুবাদক। তিনি বিশ্বাস করতেন- “মানুষের মধ্যে ভালোবাসা আছে, অন্ধকার আছে, কিন্তু আলোও আছে।” এই বিশ্বাস তার প্রতিটি রচনায় প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর দৃষ্টি মানুষকে শুধুমাত্র চরিত্র বা গল্পের অংশ হিসেবে দেখেননি; বরং মানুষকে দেখেছেন একটি জীবন্ত মহাবিশ্ব হিসেবে, যেখানে সুখ, বেদনা, আশা ও হতাশা একসাথে বাস করে।

তিনি একবার লিখেছেন- “মানুষের ভেতর একটা ছোট্ট রাজ্য আছে- সেখানে সে রাজা।” এই উক্তি মানুষের অন্তর্জগতকে চিহ্নিত করে, যেখানে প্রতিটি ব্যক্তি নিজের চিন্তা, অনুভূতি ও স্বাধীনতার অধিকার রাখে। মানুষের ভেতরের সেই ছোট্ট রাজ্যই হচ্ছে আসল স্বাধীনতা, যেখানে সে তার ভালোবাসা, আশাবাদ এবং স্বপ্নের সাথে মিলিত হয়। হুমায়ূন দেখিয়েছেন, জীবনের কঠিন মুহূর্তেও এই অন্তর্জগতের আলো মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যায়।

অলৌকিক ও রহস্যময়তায় তাঁর আগ্রহও ছিলো অবিস্মরণীয়। হিমু, মিসির আলি বা শবনমের মতো চরিত্রের মধ্য দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন, মানুষ কেবল যুক্তি ও বাস্তবতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; তার জীবনেও আছে অদেখা বিস্ময়, যার প্রতি কৌতূহল তাকে আরও মানবিক করে তোলে। তিনি বিশ্বাস করতেন, অদেখার রহস্যকে জিজ্ঞেস করতে পারাই মানুষের সৃজনশীলতা এবং জীবনের সৌন্দর্যকে শক্তিশালী করে।

তাঁর এই মানবদৃষ্টি পাঠককে এক অসাধারণ অনুভূতির কাছে পৌঁছে দেয়- যেখানে জীবনের সাধারণতা ও অলৌকিকতার মেলবন্ধন ঘটে। প্রেম, বন্ধুত্ব, একাকিত্ব, হাসি-কান্না- সবই তাঁর রচনায় একত্রিত হয়, এবং পাঠককে শেখায়, জীবনের আসল সৌন্দর্য নিহিত মানুষের অন্তর্জগতে। হুমায়ূন আহমেদ আমাদের মনে করিয়ে দেন, মানুষ শুধু বাস্তবের বন্দি নয়; সে তার মনোজগতের রাজ্যেও রাজা।

এই দর্শনই তাকে করেছে বাংলা সাহিত্যের এক অমোঘ শক্তি। তাঁর মানবদৃষ্টি পাঠককে দেখায়, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই মূল্যবান, এবং প্রতিটি মানুষের অন্তর্জগতে লুকিয়ে আছে অনন্ত সম্ভাবনার আলো। হুমায়ূনের চোখে মানুষ শুধুমাত্র চরিত্র নয়, বরং এক সম্ভাব্য জগৎ- যেখানে ভালোবাসা, আশা এবং রহস্য একসাথে জীবিত।

হুমায়ূন আহমেদ কেনো পাঠকের হৃদয়ে এতো অম্লান প্রভাব ফেলেছেন- এ প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়, তবে মূলটি নিহিত তাঁর লেখার সরলতা ও মানবিক গভীরে। তিনি কখনও পাঠকের সামনে জটিল শব্দের পাহাড় বা উচ্চমার্গের সাহিত্যিক গৃহীত রীতির প্রলোভনে আবদ্ধ হননি। বরং তাঁর ভাষা ছিলো নিজের মতো- সহজ, সরল, অথচ গভীর। পাঠক যেনো প্রতিটি বাক্য পড়তে পড়তে অনুভব করেন, “এটাই আমার জীবনের কথা।” তাঁর গল্পে জীবনকে দেখা যায় যেমনটা বাস্তবে আছে- হাসি, কান্না, প্রেম, ব্যর্থতা, একাকিত্ব- সব মিলিয়ে এক নিখুঁত মানবিক অভিজ্ঞতা।

হুমায়ূন আহমেদ কেবল জনপ্রিয় লেখক নয়; তিনি ছিলেন মানুষের অন্তর্জগতে প্রবেশকারী এক দার্শনিক। তাঁর কলমে বৃষ্টি কেবল জলবিন্দুর খেলা নয়, বরং এক অনুভূতির প্রতীক- যেমন “শঙ্খনীল কারাগার”-এ লিখেছেন, “বৃষ্টি পড়লে মনে হয় পৃথিবী একটু শান্ত হয়ে যায়।” রাত আর নিঃসঙ্গতাও তাঁর লেখায় নতুন অর্থ পেয়েছে- “একলা রাতে যখন ঘুম আসে না, তখন মনে হয় সময়ও কেবল আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছে।” এই সরল অথচ গভীর মনোভাব পাঠককে এক নতুন বাস্তবতার কাছে নিয়ে যায়, যেখানে দৈনন্দিন মুহূর্তও জাদুবর্ষিত হয়ে ওঠে।

তাঁর লেখায় স্পর্শ করা যায় গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের মতো যাদুবাস্তবতার ছোঁয়া। বাস্তবতা এবং অলৌকিকতা মিলেমিশে এক অনন্য অনুভূতি সৃষ্টি করে। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানবপ্রেমের মতো গভীর স্নেহ ও সহানুভূতি তাঁর গল্পের প্রতিটি চরিত্রে ফুটে ওঠে। হিমু বা রূপার মতো চরিত্র কেবল গল্প নয়; তারা পাঠকের আবেগ, আশার ও স্বপ্নের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়।

বাংলা সাহিত্য সমালোচকরা, যেমন সেলিনা হোসেন উল্লেখ করেছেন, “হুমায়ূনের গল্পে সাধারণ মানুষের মনোজগত এমনভাবে ফুটে ওঠে, যা অনেক বড় সাহিত্যিককেও অবাক করে।” সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, “তার কলমের জাদু পাঠককে শুধু আনন্দ দেয় না, বরং জীবনের অর্থ অন্বেষণে প্রেরণা যোগায়।” এই মতামতগুলো প্রমাণ করে, তিনি ছিলেন পাঠকের অন্তর স্পর্শকারী লেখক, যাঁর সাহিত্য কখনও সময়ের সীমানায় আবদ্ধ নয়।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথাও না বললে লেখাটি অসম্পূর্ণ থাকে। ছোটবেলায় নন্দিত নরক বা হিমু পড়ার সময় সেই চরিত্রগুলোর সঙ্গে আমি এতোটা মিশে যেতাম যে, মনে হতো তারা আমার পাশেই বসে আছে। হিমুর অদ্ভুত দৃষ্টিভঙ্গি আমাকে জীবনের সাধারণতাতেও সৌন্দর্য খুঁজতে শিখিয়েছে। মিসির আলির নীরব যুক্তি আমাকে ভাবিয়েছে, মানুষের ভিতরের জটিলতা বোঝা কতো গুরুত্বপূর্ণ। এই ব্যক্তিগত স্মৃতি শুধু আমার নয়; হাজারো পাঠকের জীবনেও একইভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।

আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তাঁর গল্পের ভেতর বৃষ্টি নামে, আকাশে মেঘ জমে। আমরা তাঁর সৃষ্টি জগতের একেকটি চরিত্র হয়ে বেঁচে আছি- হিমুর হাসি, মিসির আলির নীরবতা, রূপার কোমলতা আমাদের ভেতর আজও জ্বলছে। তিনি চলে গেছেন শারীরিকভাবে, কিন্তু সাহিত্যের দৃষ্টিকোণে তিনি চিরকাল জীবন্ত; পাঠকের অন্তর্জগতে তিনি আজও নিঃশব্দ আলো ছড়িয়ে চলেছেন।

“হুমায়ূন আহমেদ চলে গেছেন, কিন্তু তাঁর গল্পের ভেতর এখনো বৃষ্টি নামে, আকাশে মেঘ জমে- আর আমরা তাঁর সৃষ্টি জগতের একেকটি চরিত্র হয়ে বেঁচে আছি।”

এই উচ্চারণগুলো শুধু প্রবন্ধের সমাপ্তি নয়; এটি একটি স্বীকৃতি- যে সাহিত্য কখনও হারায় না, বরং সময়ের সাথে আরও গভীরভাবে আমাদের হৃদয়ে স্থান করে নেয়। হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য সেই চিরন্তন বন্ধন, যা পাঠককে শেখায় হাসতে, কাঁদতে, এবং জীবনের রহস্যের প্রতি কৌতূহল রাখতে।

দূরের পথ বাতিঘর

কচুরিপানা

অল্প-স্বল্প : মিথ্যা-সত্য

মানুষ চাই

বাঘ

বিষাদমন্ত্রী

বুকের রেহেলে

নবান্ন

জলের নক্ষত্র

সততাও লুপ্ত হচ্ছে লুপ্তবংশে

ছবি

বিলেতে বাঙালির শিল্পসাহিত্যের প্রতিনিধি

ছবি

বিপন্ন সময়ের জীবনশিল্পী

ছবি

লাল ফুলের খোঁপা

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

দেশ ভাগের আর্তনাদ

ছবি

অনুবাদকের দায় : বিশ্বস্ততা নাকি সরলতা?

কার্তিকের স্নান

আমি- শেষ

ছবি

মহিবুল আলমের কবিতায় নদী ও নারী

ছবি

কবি মাহমুদ কামাল ও নিমগ্ন আত্মার সাধক

ছবি

স্পর্শ

ছবি

নুরুন্নাহার মুন্নির গল্প

ছবি

মাটির মমতায় হেমন্ত বিকেল

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

জীবনানন্দ দাশ দূর-সময়ের সার্বভৌম কবি

ছবি

পথ ভিন্ন : প্রসঙ্গ লালন

ছবি

মার্গারেট অ্যাটউড ‘রানিং দ্য ব্যাট’

ছবি

এলোমেলো স্মৃতির সমরেশ মজুমদার

সাময়িকী কবিতা

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

বিমল গুহের কবিতার অন্তর্জগৎ ও শিল্পৈশ্বর্য

ছবি

কবিতার সুনীল সুনীলের কবিতা

ছবি

রূপান্তরের অকথিত গল্পটা

ছবি

মানব সভ্যতার আত্মবিশ্লেষণের আয়না

ছবি

বাইরে একটা কিছু জ্বলছে

ছবি

‘কাফকার মতো হবো বলে আইন পড়েছিলাম’

tab

হুমায়ূন আহমেদ

জনপ্রিয় সাহিত্যের জাদুকর

কাঙাল শাহীন

হুমায়ূন আহমেদ / জন্ম : ১৩ নভেম্বর ১৯৪৮; মৃত্যু : ১৯ জুলাই ২০১২

বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৫

“বাংলা সাহিত্যে এমন লেখক খুব কমই এসেছেন, যিনি একসাথে পাঠকের হাসি, কান্না ও স্বপ্নের জগৎ নির্মাণ করতে পেরেছেন- হুমায়ূন আহমেদ তেমনই এক অনন্য নাম।” তিনি ছিলেন এক প্রজন্মের চেতনাবোধের স্থপতি, যিনি সাহিত্যের জগতে এসে পাঠকের অনুভূতিকে এমনভাবে ছুঁয়ে গেছেন যে, তাঁর চরিত্রগুলো আজও বেঁচে আছে পাঠকের হৃদয়ের অভ্যন্তরে। নিঃসন্দেহে তিনি শুধু একজন লেখক নন, বরং সংস্কৃতির ধারক- যার জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর, নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে, অথচ যার সৃষ্টিশক্তি ছড়িয়ে আছে সমগ্র বাংলাভাষী জগতে।

হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন মানুষের অন্তর্দৃষ্টি ও জীবনের রহস্যের একজন দার্শনিক অনুবাদক। তিনি বিশ্বাস করতেন- “মানুষের মধ্যে ভালোবাসা আছে, অন্ধকার আছে, কিন্তু আলোও আছে।” এই বিশ্বাস তার প্রতিটি রচনায় প্রতিফলিত হয়েছে

ষাট ও সত্তরের দশকের প্রেক্ষাপটে বাংলা সাহিত্য ছিলো এক গভীর উত্তাল সময়ের সাক্ষী। একদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অন্যদিকে সমাজবাস্তবতার কঠোরতা- সব মিলিয়ে পাঠক তখন খুঁজছিলেন একটুখানি আশ্রয়, একটুখানি হাসি, আর এমন এক গল্প, যা জীবনের গন্ধে ভরা। ঠিক সেই সময়েই আবির্ভূত হন হুমায়ূন আহমেদ- অদ্ভুত এক স্বচ্ছ কণ্ঠ নিয়ে, যিনি সাহিত্যকে ফিরিয়ে দিলেন জীবনের সহজ গভীর সৌন্দর্যে। তাঁর গল্পে যেমন ছিলো গ্রামের সন্ধ্যা, শহরের একাকিত্ব, তেমনি ছিলো মানুষের নিঃশব্দ ভালোবাসা, হারিয়ে যাওয়া সময়ের বিষণ্যতা, আর অলৌকিক কোনো আনন্দের ছোঁয়া।

হুমায়ূনের ভাষা সরল, কিন্তু সেই সরলতার ভেতরে লুকিয়ে থাকে গভীর দার্শনিকতা। তিনি জানতেন- মানুষ কেবল জটিল প্রাণি নয়; সে হাসতে চায়, ভালোবাসতে চায়, বাঁচতে চায়। তাই তাঁর লেখা জটিল তত্ত্ব নয়, বরং জীবনের নিরাভরণ সত্য। তাঁর উপন্যাস নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার, মিসির আলি বা হিমু- সবখানেই তিনি মানুষের মনের অদ্ভুত গোলকধাঁধাকে গল্পের মাধ্যমে উন্মোচন করেছেন। কেউ তাঁকে বলেছে “বাংলার রবিনসন ক্রুসো”, কেউ বলেছেন, “মানুষের মনের মনস্তত্ত্বের চিত্রকর।” কিন্তু আসলে তিনি ছিলেন পাঠকের আত্মীয়- যিনি আমাদের ভিতরে ঘুমিয়ে থাকা কল্পনাশক্তিকে জাগিয়ে তুলেছিলেন।

তাঁর লেখনীর বিশেষত্ব ছিলো বাস্তব ও কল্পনার এমন এক মিশ্রণ, যেখানে পাঠক বিশ্বাস করতে শুরু করে যে অলৌকিকতাও জীবনের অংশ। একদিকে বিজ্ঞানমনষ্ক চিন্তা, অন্যদিকে সহজ বিশ্বাস- এই দুই বিপরীত ধারা তিনি একসূত্রে গেঁথেছিলেন। তাই তাঁর কলমে “মিসির আলি” যেমন যুক্তিবাদী মননের প্রতীক, তেমনি “হিমু” জীবনের মায়াময় অযৌক্তিকতার প্রতিরূপ। এই দ্বৈততা, এই ভারসাম্যই হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যকে করেছে অনন্য।

বাংলা সাহিত্যে তাঁর আবির্ভাব কেবল নতুন ধারার সূচনা নয়, বরং এক মানসিক বিপ্লব। তিনি পাঠককে শিখিয়েছেন- সাহিত্য মানে শুধু উচ্চমার্গের জটিল চিন্তা নয়, বরং সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন অনুভূতির সহজ প্রকাশও হতে পারে শিল্প। তাঁর লেখার ভাষা যেনো এমন এক নদী, যা একইসাথে গভীর ও স্বচ্ছ; পাঠক সেখানে স্নান করে ফিরে আসে তৃপ্ত হয়ে, কিছুটা বদলে গিয়ে।

আজও যখন কেউ হিমুর হলুদ পাঞ্জাবি বা মিসির আলির যুক্তিপূর্ণ নীরবতা স্মরণ করে, তখন বোঝা যায়- হুমায়ূন আহমেদ কেবল লিখে যাননি, বরং জীবনের ভিতরে এক স্থায়ী ছাপ রেখে গেছেন। তাঁর সাহিত্য আমাদের শিখিয়েছে, মানুষ আসলে ছোট ছোট মুহূর্তেই বেঁচে থাকে- এক কাপ চা, একটুখানি হাসি, বা ভালোবাসার নীরব দৃষ্টিতে। এই মানবিকতা, এই সহজ অথচ গভীর বোধই তাঁকে করে তুলেছে বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে পাঠকপ্রিয়, এবং একইসাথে সবচেয়ে জীবন্ত লেখক।

হুমায়ূন আহমেদ তাই শুধু এক নাম নয়- এক আবহ, এক অনুভব, এক দীর্ঘস্থায়ী প্রতিধ্বনি; যিনি প্রমাণ করেছেন, সাহিত্য তখনই পূর্ণতা পায়, যখন তা মানুষের হৃদয়ে বাসা বাঁধে।

হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যজগৎ এমন এক আলোকিত ভুবন, যেখানে বাস্তবতা ও স্বপ্নের সীমানা মিশে গেছে এক অদ্ভুত নীরব জাদুতে। তাঁর কলমে চরিত্র মানে কেবল কাগজে আঁকা মানুষ নয়; বরং মানুষের অন্তর্লোকের প্রতিচ্ছবি- একেকটি মানসিক অবস্থা, একেকটি জীবনদর্শনের প্রতীক। যেমন হিমু, মিসির আলি, রূপা, শবনম কিংবা নন্দিতা- তাঁরা সবাই হুমায়ূনের সৃষ্টিশীল চেতনার একেকটি রূপান্তর।

হিমু- এক অদ্ভুত চরিত্র, যে জুতো পরে না, যুক্তির তোয়াক্কা করে না, অথচ মানবজীবনের গভীর সত্য উচ্চারণ করে যায় শিশুর সরলতায়। সে যেনো জ্যাঁ-পল সার্ত্রের “existential freedom”-এর জীবন্ত প্রতীক- যে সমাজের নিয়ম ভেঙে নিজের মতো বাঁচতে চায়। হিমু সমাজবিরোধী নয়, বরং সমাজের মায়াজালে বন্দী মানুষদের মুক্তি দিতে চায় তার অদ্ভুত দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে। সে যেনো বলে ওঠে- “মানুষ আসলে সুখী হতে চায়, কিন্তু ভুল পথে খোঁজে সুখ।”

অন্যদিকে মিসির আলি এক যুক্তিবাদী মননের প্রতিরূপ, যে অতিপ্রাকৃত রহস্যকে বিজ্ঞানের চোখে ব্যাখ্যা করতে চায়। মিসির আলি যেমন বাস্তবতার যুক্তি খোঁজেন, তেমনি তাঁর নীরবতাতেও থাকে এক গভীর দার্শনিকতা। তিনি যেনো আর্থার কোনান ডয়েল-এর শার্লক হোমসের বাঙালি উত্তরাধিকারী, তবে হুমায়ূনের সৃষ্টিতে তিনি আরও মানবিক, আরও একাকী। মিসির আলি জানেন, যুক্তি অনেক কিছু ব্যাখ্যা করতে পারে, কিন্তু মানুষের ভালোবাসা, কষ্ট কিংবা মৃত্যু- এসবের কোনও বৈজ্ঞানিক সূত্র নেই।

রূপা, শবনম ও নন্দিতার মতো নারী চরিত্রগুলোও হুমায়ূনের সাহিত্যকে দিয়েছে এক নরম, মানবিক সৌন্দর্য। রূপা শুধু হিমুর ভালোবাসা নয়, বরং সেই স্বপ্ন যা কখনও পাওয়া যায় না তবু হৃদয়ে থেকে যায়। শবনমের নির্ভেজাল সরলতা, নন্দিতার আধুনিক সত্তা- সব মিলিয়ে তাঁরা হুমায়ূনের নারীচরিত্রকে করেছে মাটির কাছাকাছি অথচ স্বপ্নের মতো কোমল। ভার্জিনিয়া উলফ একবার লিখেছিলেন, “Literature is strewn with the wreckage of men who have minded beyond reason the opinions of others..” - হুমায়ূনের নারীচরিত্ররা যেন সেই বক্তব্যের বিপরীতে দাঁড়িয়ে; তাঁরা নিজেদের মতো বাঁচে, ভালোবাসে, কাঁদে এবং জীবনের প্রতিটি ব্যথাকে নিজের মতো করে গ্রহণ করে।

হুমায়ূনের ভাষা ও বর্ণনা ছিলো এক বিরল শিল্প। তিনি প্রমাণ করেছিলেন, সাহিত্যিক ভাষা জটিল না হয়েও গভীর হতে পারে। তাঁর লেখার শব্দগুলো এত সহজ যে পাঠক ভাবেন, এ তো তাঁরই জীবনের কথা; অথচ সেই সরলতার আড়ালে লুকিয়ে থাকে অস্তিত্ববাদের সূক্ষ্ম দর্শন। তাঁর লেখার হাস্যরস ছিলো জীবনের অন্ধকার দূর করার আলোকরেখা, আবার একইসাথে সেই হাসির ভেতরে ছিলো হালকা বিষণ্যতার ছোঁয়া। এই হাসি ও বিষণ্যতার দ্বৈততা তাঁকে এনে দিয়েছে এক অনন্য সাহিত্যিক বৈশিষ্ট্য।

তাঁর গল্পের ভাষা যেনো গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটলের সেই কথারই প্রতিধ্বনি- “Poetry is finer and more philosophical than history; for poetry expresses the universal, and history only the particular.” হুমায়ূনের গল্পগুলোও ছিল সার্বজনীন, কারণ সেখানে শুধু চরিত্র নয়, মানবজীবনের অনন্ত আবেগ কথা বলে।

বাংলা সাহিত্যে তাঁর এই ভাষার সরলতা, চরিত্রের জটিলতা ও মানবিক রসের মিশ্রণ এক নতুন ধারার জন্ম দিয়েছে। হুমায়ূন আহমেদ আমাদের শিখিয়েছেন, সাহিত্য কখনও মানুষের উপরে নয়- তারই পাশে থাকে। তিনি সেই লেখক, যিনি জীবনের সাধারণ মুহূর্তগুলোকে করে তুলেছিলেন সাহিত্যিক বিস্ময়ে ভরা এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।

“আজ রবিবার” নাটকে তিনি তুলে ধরেছিলেন শহুরে জীবনের হাস্যরস, ব্যস্ততা ও পারিবারিক টানাপোড়েনকে। এই নাটক ছিলো এক মিষ্টি মায়াবী বিশ্রাম, যেখানে জীবনকে দেখা যায় রসিকতার চোখে, কিন্তু সেই রসিকতার ভেতরেও ছিলো এক হালকা বিষণ্যতা। তিনি আমাদের শিখিয়েছিলেন- দুঃখও হাসির মতোই জীবনের অংশ, এবং দুটিই মানুষকে পূর্ণ করে তোলে।

নাটকের সাফল্যের ধারাবাহিকতায় হুমায়ূন আহমেদ যখন চলচ্চিত্রে প্রবেশ করেন, তখনও তিনি তাঁর নিজস্ব স্বপ্নের পথেই হেঁটেছিলেন। তাঁর চলচ্চিত্র “শ্রাবণ মেঘের দিন” (১৯৯৯) ছিলো প্রেম, বেদনা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অনবদ্য ঝুসঢ়যড়হু। গ্রামীণ জীবনের স্নিগ্ধ বাস্তবতা, প্রেমের নিরাভরণ কোমলতা এবং হারিয়ে যাওয়া সময়ের বিষণ্য সুর এই চলচ্চিত্রকে পরিণত করেছিলো এক চিরকালীন ভালোবাসার চিত্রে।

পরবর্তী সময়ে “দারুচিনি দ্বীপ” (২০০৭) চলচ্চিত্রে তিনি তরুণ প্রজন্মের স্বপ্ন, একাকিত্ব ও আত্ম-অন্বেষণকে তুলে ধরেন এক ভিন্ন ভঙ্গিতে। এটি ছিলো আত্মিক ভ্রমণের গল্প, যেখানে বন্ধুত্ব, ভালোবাসা ও মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মানুষ নিজের ভেতরকে আবিষ্কার করে। তাঁর কাহিনি বলার ভঙ্গি দর্শককে নিয়ে যায় বাস্তবতার বাইরে, কিন্তু কখনও কৃত্রিমতায় নয়- এক নির্মল মানবিকতায়।

অন্যদিকে “ঘেটুপুত্র কমলা” (২০১২) তাঁর জীবনের শেষ চলচ্চিত্র- ছিলো সমাজবোধ ও সংবেদনশীলতার এক অসামান্য উদাহরণ। এই চলচ্চিত্রে তিনি স্পর্শ করেছিলেন গ্রামীণ সংস্কৃতির এক অন্ধকার বাস্তবতাকে, যেখানে শিল্প ও বেদনা পাশাপাশি হাঁটে। তিনি সমাজের নিগূঢ় স্তরে প্রবেশ করে প্রশ্ন করেছিলেন- কতোটা মানবিক আমরা, যখন শিল্পীর কণ্ঠে আনন্দ শুনি কিন্তু তার কষ্ট দেখি না?

হুমায়ূন আহমেদের নাটক ও চলচ্চিত্র কেবল বিনোদন ছিলো না; এগুলো ছিলো সামাজিক দলিল, মনস্তাত্ত্বিক প্রতিচ্ছবি এবং মানুষের অনুভূতির শ্রুতিমধুর রূপান্তর। তাঁর ক্যামেরা কখনও চরিত্রকে ছোট করে দেখেনি- বরং প্রতিটি মানুষকে দিয়েছে মর্যাদা, আবেগ ও স্বপ্ন দেখার অধিকার। ফরাসি চলচ্চিত্রকার François Truffaut-এর একটি উক্তি এখানে যথার্থ মনে হয়: “ÒA film is like a personal diary, but the audience reads it with their own emotions.”- হুমায়ূনের চলচ্চিত্রগুলোও যেনো ছিলো তাঁর ব্যক্তিগত ডায়েরি, যা পাঠক-দর্শক নিজেদের হৃদয় দিয়ে পড়েছে, আজও পড়ে চলেছে।

তাঁর সৃষ্টিতে মানুষ যেমন হাসতে শিখেছে, তেমনি কেঁদেও মুক্তি পেয়েছে। নাটক ও চলচ্চিত্রের মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদ প্রমাণ করেছেন- মানুষের গল্পই সবচেয়ে বড় শিল্প, আর জীবনের সরল মুহূর্তগুলোই হতে পারে চিরন্তন সিনেমা।

হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন মানুষের অন্তর্দৃষ্টি ও জীবনের রহস্যের একজন দার্শনিক অনুবাদক। তিনি বিশ্বাস করতেন- “মানুষের মধ্যে ভালোবাসা আছে, অন্ধকার আছে, কিন্তু আলোও আছে।” এই বিশ্বাস তার প্রতিটি রচনায় প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর দৃষ্টি মানুষকে শুধুমাত্র চরিত্র বা গল্পের অংশ হিসেবে দেখেননি; বরং মানুষকে দেখেছেন একটি জীবন্ত মহাবিশ্ব হিসেবে, যেখানে সুখ, বেদনা, আশা ও হতাশা একসাথে বাস করে।

তিনি একবার লিখেছেন- “মানুষের ভেতর একটা ছোট্ট রাজ্য আছে- সেখানে সে রাজা।” এই উক্তি মানুষের অন্তর্জগতকে চিহ্নিত করে, যেখানে প্রতিটি ব্যক্তি নিজের চিন্তা, অনুভূতি ও স্বাধীনতার অধিকার রাখে। মানুষের ভেতরের সেই ছোট্ট রাজ্যই হচ্ছে আসল স্বাধীনতা, যেখানে সে তার ভালোবাসা, আশাবাদ এবং স্বপ্নের সাথে মিলিত হয়। হুমায়ূন দেখিয়েছেন, জীবনের কঠিন মুহূর্তেও এই অন্তর্জগতের আলো মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যায়।

অলৌকিক ও রহস্যময়তায় তাঁর আগ্রহও ছিলো অবিস্মরণীয়। হিমু, মিসির আলি বা শবনমের মতো চরিত্রের মধ্য দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন, মানুষ কেবল যুক্তি ও বাস্তবতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; তার জীবনেও আছে অদেখা বিস্ময়, যার প্রতি কৌতূহল তাকে আরও মানবিক করে তোলে। তিনি বিশ্বাস করতেন, অদেখার রহস্যকে জিজ্ঞেস করতে পারাই মানুষের সৃজনশীলতা এবং জীবনের সৌন্দর্যকে শক্তিশালী করে।

তাঁর এই মানবদৃষ্টি পাঠককে এক অসাধারণ অনুভূতির কাছে পৌঁছে দেয়- যেখানে জীবনের সাধারণতা ও অলৌকিকতার মেলবন্ধন ঘটে। প্রেম, বন্ধুত্ব, একাকিত্ব, হাসি-কান্না- সবই তাঁর রচনায় একত্রিত হয়, এবং পাঠককে শেখায়, জীবনের আসল সৌন্দর্য নিহিত মানুষের অন্তর্জগতে। হুমায়ূন আহমেদ আমাদের মনে করিয়ে দেন, মানুষ শুধু বাস্তবের বন্দি নয়; সে তার মনোজগতের রাজ্যেও রাজা।

এই দর্শনই তাকে করেছে বাংলা সাহিত্যের এক অমোঘ শক্তি। তাঁর মানবদৃষ্টি পাঠককে দেখায়, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই মূল্যবান, এবং প্রতিটি মানুষের অন্তর্জগতে লুকিয়ে আছে অনন্ত সম্ভাবনার আলো। হুমায়ূনের চোখে মানুষ শুধুমাত্র চরিত্র নয়, বরং এক সম্ভাব্য জগৎ- যেখানে ভালোবাসা, আশা এবং রহস্য একসাথে জীবিত।

হুমায়ূন আহমেদ কেনো পাঠকের হৃদয়ে এতো অম্লান প্রভাব ফেলেছেন- এ প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়, তবে মূলটি নিহিত তাঁর লেখার সরলতা ও মানবিক গভীরে। তিনি কখনও পাঠকের সামনে জটিল শব্দের পাহাড় বা উচ্চমার্গের সাহিত্যিক গৃহীত রীতির প্রলোভনে আবদ্ধ হননি। বরং তাঁর ভাষা ছিলো নিজের মতো- সহজ, সরল, অথচ গভীর। পাঠক যেনো প্রতিটি বাক্য পড়তে পড়তে অনুভব করেন, “এটাই আমার জীবনের কথা।” তাঁর গল্পে জীবনকে দেখা যায় যেমনটা বাস্তবে আছে- হাসি, কান্না, প্রেম, ব্যর্থতা, একাকিত্ব- সব মিলিয়ে এক নিখুঁত মানবিক অভিজ্ঞতা।

হুমায়ূন আহমেদ কেবল জনপ্রিয় লেখক নয়; তিনি ছিলেন মানুষের অন্তর্জগতে প্রবেশকারী এক দার্শনিক। তাঁর কলমে বৃষ্টি কেবল জলবিন্দুর খেলা নয়, বরং এক অনুভূতির প্রতীক- যেমন “শঙ্খনীল কারাগার”-এ লিখেছেন, “বৃষ্টি পড়লে মনে হয় পৃথিবী একটু শান্ত হয়ে যায়।” রাত আর নিঃসঙ্গতাও তাঁর লেখায় নতুন অর্থ পেয়েছে- “একলা রাতে যখন ঘুম আসে না, তখন মনে হয় সময়ও কেবল আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছে।” এই সরল অথচ গভীর মনোভাব পাঠককে এক নতুন বাস্তবতার কাছে নিয়ে যায়, যেখানে দৈনন্দিন মুহূর্তও জাদুবর্ষিত হয়ে ওঠে।

তাঁর লেখায় স্পর্শ করা যায় গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের মতো যাদুবাস্তবতার ছোঁয়া। বাস্তবতা এবং অলৌকিকতা মিলেমিশে এক অনন্য অনুভূতি সৃষ্টি করে। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানবপ্রেমের মতো গভীর স্নেহ ও সহানুভূতি তাঁর গল্পের প্রতিটি চরিত্রে ফুটে ওঠে। হিমু বা রূপার মতো চরিত্র কেবল গল্প নয়; তারা পাঠকের আবেগ, আশার ও স্বপ্নের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়।

বাংলা সাহিত্য সমালোচকরা, যেমন সেলিনা হোসেন উল্লেখ করেছেন, “হুমায়ূনের গল্পে সাধারণ মানুষের মনোজগত এমনভাবে ফুটে ওঠে, যা অনেক বড় সাহিত্যিককেও অবাক করে।” সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, “তার কলমের জাদু পাঠককে শুধু আনন্দ দেয় না, বরং জীবনের অর্থ অন্বেষণে প্রেরণা যোগায়।” এই মতামতগুলো প্রমাণ করে, তিনি ছিলেন পাঠকের অন্তর স্পর্শকারী লেখক, যাঁর সাহিত্য কখনও সময়ের সীমানায় আবদ্ধ নয়।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথাও না বললে লেখাটি অসম্পূর্ণ থাকে। ছোটবেলায় নন্দিত নরক বা হিমু পড়ার সময় সেই চরিত্রগুলোর সঙ্গে আমি এতোটা মিশে যেতাম যে, মনে হতো তারা আমার পাশেই বসে আছে। হিমুর অদ্ভুত দৃষ্টিভঙ্গি আমাকে জীবনের সাধারণতাতেও সৌন্দর্য খুঁজতে শিখিয়েছে। মিসির আলির নীরব যুক্তি আমাকে ভাবিয়েছে, মানুষের ভিতরের জটিলতা বোঝা কতো গুরুত্বপূর্ণ। এই ব্যক্তিগত স্মৃতি শুধু আমার নয়; হাজারো পাঠকের জীবনেও একইভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।

আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তাঁর গল্পের ভেতর বৃষ্টি নামে, আকাশে মেঘ জমে। আমরা তাঁর সৃষ্টি জগতের একেকটি চরিত্র হয়ে বেঁচে আছি- হিমুর হাসি, মিসির আলির নীরবতা, রূপার কোমলতা আমাদের ভেতর আজও জ্বলছে। তিনি চলে গেছেন শারীরিকভাবে, কিন্তু সাহিত্যের দৃষ্টিকোণে তিনি চিরকাল জীবন্ত; পাঠকের অন্তর্জগতে তিনি আজও নিঃশব্দ আলো ছড়িয়ে চলেছেন।

“হুমায়ূন আহমেদ চলে গেছেন, কিন্তু তাঁর গল্পের ভেতর এখনো বৃষ্টি নামে, আকাশে মেঘ জমে- আর আমরা তাঁর সৃষ্টি জগতের একেকটি চরিত্র হয়ে বেঁচে আছি।”

এই উচ্চারণগুলো শুধু প্রবন্ধের সমাপ্তি নয়; এটি একটি স্বীকৃতি- যে সাহিত্য কখনও হারায় না, বরং সময়ের সাথে আরও গভীরভাবে আমাদের হৃদয়ে স্থান করে নেয়। হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য সেই চিরন্তন বন্ধন, যা পাঠককে শেখায় হাসতে, কাঁদতে, এবং জীবনের রহস্যের প্রতি কৌতূহল রাখতে।

back to top