ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী - ১৭
চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ
(পূর্ব প্রকাশের পর)
পৃথিবী জুড়ে চলছে এক দ্বৈরথ- ঐতিহ্য ও আধুনিকতার; আমরাও এতে যেন জড়িয়ে গেলাম। আমি বরাবর হাঁটি ঐতিহ্যের দিকে, আর নাবিল, নাতাশা, ফারজানা আধুনিকতার পথে।
রিভার ক্রুজ শেষ করে আগের কথামত আমরা যে যার পথে চললাম- আমি ঘোড়ার গাড়িতে, ওরা শুধু গাড়িতে।
ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে আমি ঘুরছি সেভিয়া-র পথে পথে, মনে হচ্ছে অতীতের কোনো এক সময়ে চলেছি। ওরা টেক্সিতে চলে গেল শহরের কেন্দ্রে আধুনিকতার প্রতীক মাশরুম-এ।
সেভিয়া-র প্রতিটি টাওয়ার, প্রতিটি মনুমেন্ট, প্রতিটি ভবন এক একটি ছবি, এক একটি গল্প, এক একটি ইতিহাস। ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে এ ইতিহাস দেখা, মনে হলো এক রাজকীয় ব্যাপার। এখন সবগুলিই বাইরে থেকে দেখা, অনেকটা বার্ডস আই ভিউ, পরে সবাই মিলে এক সাথে ভেতরে যাওয়া যাবে, টিকিট কেটে রেখেছি আগেই।
ঘোড়ার গাড়িতে যাত্রা শুরু হলো সেই থরে দেল ওরো টাওয়ার থেকে। একে একে দৃষ্টিতে ধরা দিল হিরালডা মিনারের চুড়া, সেভিয়া ক্যাথেড্রাল-এর সিংহদ্বার, আলকাছার দুর্গের প্রতিরক্ষা দেয়াল, পার্কে দি মারিয়া ল্ইসা-র ছড়ানো সবুজ, বর্শা হাতে ঘোড়ায় চড়া যোদ্ধা এল সিদ এর ভাষ্কর্য, আর মানুষের বিচিত্র জীবন-প্রবাহ- হাঁটছেন কেউ একাকী, আবার কেউ তার প্রিয় কুকুরের সাথে, কেউ দৌড়াচ্ছেন, তাকে পাড়ি দিল সারি সারি সাইকেল, আর অনেকে বসে আছেন পার্কে আর নদীর পাড়ে- একা একা ও জোড়ায় জোড়ায়। এসব দৃশ্য দেখে আমি বললাম, ‘সেভিয়া শহরটির রয়েছে এক ক্লাসিক বিউটি। মনে হয় এর প্রতিটি অংশ ছায়াছবিতে জায়গা পেতে পারে।’ শুনে গাড়ি চালক হুয়ারেস মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলল, ‘এ শহর সত্যিই সিনেম্যাটিক! সে জন্যই এ শহরের বিভিন্ন জায়গায় অনেক সিনেমার শ্যুটিং হয়েছে। এখন যেখানে যেয়ে থামব, সেখানে নামকরা এক সিনেমার লোকেশন। দেখি, তুমি সেটি ধরতে পার কিনা।’
হুয়ারেস কিছুদুর যেয়ে মনকাড়া স্থাপত্যের বিশাল এক ভবনের সামনে তার ঘোড়াটিকে থামতে বলল। আমরা দুজন নেমে রাস্তার পাশে দাঁড়াতেই সে বলল,‘এ হচ্ছে প্লাসা দে এস্পানিয়া। এটি অনেক কারণে বিখ্যাত হয়ে আছে। প্রথমত এটি ছিল ১৯২৯ সালের আইবেরীয়-আমেরিকান প্রদর্শনীর প্রধান কেন্দ্র। তাছাড়া অনেকগুলি ছবির শ্যুটিং লোকেশন হিসেবেও এটি বিখ্যাত হয়ে আছে। বেশ কটি অস্কার পাওয়া এক ছবির শ্যুটিং হয়েছিল এখানে। ধারণা করতে পার কোন ছবি?’ দেখে চেনা চেনা লাগল। অর্ধবৃত্তাকার নকশা, লাল ইটের সুরম্য ভবন,দুদিকে বিশাল দুটি টাওয়ার, সামনে খাল ও তার ওপরে ৪টি সেতু, মোজাইকের কাজ, ঠিক মাঝখানে ভাইসেন্তে থ্রেবার ঝরনা- অনেকবার দেখেছি এই প্লাসা দে এস্পানিয়া-কে, ছবিতে ও মুভিতে, সামনাসামনি এবার প্রথম। চিনতে একটুও ভুল হলো না। বললাম, ‘লরেন্স অফ অ্যারাবিয়া।’ হুয়ারেস হেসে বলল, ‘ঠিকই ধরেছ।’ বললাম, ‘মুভিটি আমার খুবই প্রিয়, দেখেছি অনেকবার। এর লোকেশনগুলো বেশ মনে আছে, তাই সামনের জায়গাটি চিনতে অসুবিধে হলো না।’
এর সামনে ছবি তুলে হুয়ারেসকে বললাম, ‘তুমি ও তোমার ঘোড়ার সাথে ছবি তুলতে পারি?’ সে হাঁক দিল ‘কর্টেজ’, নাম ডাকতেই ঘোড়াটি মাথা নেড়ে সায় দিল। স্পেনের এক বীরের নামে তার ঘোড়ার নাম। বেশ মজার! একটি সেলফি নিলাম তিনজনের- হুয়ারেস, তার ঘোড়া কর্টেজ ও আমি, পেছনে সেই প্লাসা দে এস্পানিয়া।
হুয়ারেস মজা করে বলল, “তুমি ‘লরেন্স অফ অ্যারাবিয়া’কয়েকবার দেখেছ। এখন বলতো, সামনের লোকেশন ছবিটির কোন দৃশ্যের?” আমরা তখনো ‘প্লাসা দে এস্পানিয়া’-র সামনেই দাঁড়িয়ে আছি। বাঁকানো ব্রিজের সাথে ‘প্লাসা দে এস্পানিয়া’-র এক পোর্টিকোর অংশ, ছবিটির এক দৃশ্য মনে পড়ল। বললাম, ‘এটি হলো কায়রোর ব্রিটিশ আর্মি হেড কোয়ার্টার।’ সে খুব খুশি হয়ে বলল, ‘প্রথমটিতেই তুমি পাস!’ আমার আগ্রহ দেখে হুয়ারেস বলল, ‘আরও ক’টি শ্যুটিং লোকেশন আছে ‘লরেন্স অব অ্যারাবিয়া’-র। তুমি চাইলে আমি ঘুরে দেখাতে পারি।’ আমি সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম।
ছবি তুলে চললাম এ প্লাজার আরেকটি লোকেশনে, মনোরম এক ভবন কাপিতানিয়া জেনারেল-এর সামনে। এর প্রধান চত্বরে রয়েছে লরেন্স অব অ্যারাবিয়া-র একটি দৃশ্য- অফিসার্স ক্লাব, যার চত্বরে বসে লরেন্স পানীয় গ্রহণ করছেন, সাথে আছে জেনারেল এলেনবাই ও কর্নেল হ্যারি ব্রাইটন।
এরপর আমরা ‘লাকাছা দে পিলাথোস’ প্রাসাদের সামনে পৌঁছলাম। হুয়ারেজ জানাল, ‘এখানে সিনেমার দৃশ্যটি হলো জেরুজালেমের ব্রিটিশ আর্মি হেড কোয়ার্টার। একটি দৃশ্যে এ ভবনের সদর দরজা দিয়ে ঢুকছেন লরেন্স। আরও ক’টি দৃশ্য নেয়া হয়েছে ভেতরে। সেখানে ঢুকতে টিকিট লাগবে। এবার তোমাকে একলা যেতে হবে। কর্টেজ ও আমি বাইরে অপেক্ষা করি, তুমি ভেতরে দেখে আস।’
হুয়ারেজ ও তার ঘোড়াকে বাইরে রেখে আমি প্রাসাদের ভেতরে ঢুকলাম। ১৬শ শতাব্দীতে নির্মিত ‘লাকাছা দে পিলাথোস’ প্রাসাদটি আন্দালুসীয় স্থাপত্যের এক অনন্য উদাহরণ। এখানে মিশেছে গথিক, মুদেহার ও ইতালীয় রেনেসাঁর স্থাপত্য শৈলী।১ কাউন্টারে জিজ্ঞেস করলাম কোথায় ‘লরেন্স অফ অ্যারাবিয়া’-র শ্যুটিং হয়েছিল। একজন নিয়ে গেল সেখানে। আঙিনার খিলানের নিচে যেতে যেতে চোখে পড়ল রোমান সম্্রাট ও গ্রিক দেবতাদের ২৪টি আবক্ষ মূর্তি। দেয়ালে রয়েছে আজুলেহোস২ নামে পরিচিত মুদেহার টাইলসের প্রায় ১৫০টির মতো নকশা। একটি সুন্দর ছোট চত্বরের মাঝখানে রয়েছে মার্বেলের এক ফোয়ারা। সিনেমার লোকেশনটি এ চত্বর ও তার আশেপাশে। এখানে কয়েকটি ছবি তুললাম।
ফিরে আসতেই একজন যেতে বলল ওপরের তলায়। সেখানে একটি কামরা ‘সালোন অফ লস ফ্রেসকোস’ এ রয়েছে লরেন্স অব অ্যারাবিয়া-র একটি দৃশ্য- লরেন্স আলাপ করছেন জেনারেল এলেনবাই, ড্রাইডেন ও প্রিন্স ফয়সাল এর সাথে। অভিভূত হয়ে দেখলাম ফ্রেস্কো আর্টের এক দুর্লভ সংগ্রহ। চোখ আটকে গেল নাম না জানা এক শিল্পীর আঁকা বিশাল ফ্রেস্কোতে-‘ট্রায়াম্ফ অফ দ্য ফোর সিজনস’, যা ওভিদ-এর ‘মেটামরফসিস’ দ্বারা অনুপ্রাণিত। অনেক ছবি নিলাম এ সব শিল্পকর্মের।
ফিরে এলাম ঘোড়ার গাড়িতে। কর্টেজ আমাদেরকে ধীরে ধীরে টেনে চলল পার্কে দে মারিয়া লুইজা এর মাঝ বরাবর। হুয়ারেজ তার ঘোড়াকে থামতে বলল প্লাসা দি আমেরিকাজ এর সুদৃশ্য প্লাজার সামনে। তারপর বলল, ‘লরেন্স অব অ্যারাবিয়া মুভিতে এটি হচ্ছে দামেস্কের প্যারেডের স্থান। তারা যাচ্ছে আর্কিওলজিক্যাল মিউজিয়াম এর দিকে, আর প্রেক্ষাপটে রয়েছে মিউজিয়াম অফ আর্টস এন্ড ট্রেডিশন্স।’ আজকের দিনেও সিনেমার দৃশ্যের মতো বিশাল প্লাজার সবদিকে জনসমাগম। অনেকগুলো ছবি নিলাম মানুষ ও ভবনের।
এরপর গেলাম ‘এভিনিদা দি মারিয়া লুইছা’ এলাকার অর্ধবৃত্তাকার ভবন ‘ক্যাসিনো দে লা এক্সপোসিসিঁও’-র সামনে। নাম শুনে ভাবলাম এটি জুয়া খেলার জায়গা। হুয়ারেজ-কে জিজ্ঞেস করতে বলল, ‘জুয়া খেলার জায়গাতো নয়ই, বরং এটি হচ্ছে সেভিয়া-র সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রধান কেন্দ্র। ১৯২৯ সালের এক্সপোজিশনে তা ছিল ‘প্যাভিলিয়ন দে সেভিয়া’। এখানে ‘লরেন্স অফ অ্যারাবিয়া’-র আরব কাউন্সিল এর দৃশ্য চিত্রায়িত হয়েছে।’ ছবি নেয়ার পর হুয়ারেজ নিয়ে চলল পরবর্তী লোকেশনে।
খানিক পরে অভিজাত‘হোটেল আলফনসো ঢওওও’-র সামনে গাড়িটি থামিয়ে হুয়ারেজ বলল, ‘লরেন্স অফ অ্যারাবিয়া-র কোন দৃশ্য এখানে ধরা হয়নি, তবে ছবিটির শ্যুটিং এর সময় এখানে শিল্পী ও কলাকুশলীরা ছিলেন।’ আমি হোটেলের লবিতে দাঁড়িয়ে কয়েকটি ছবি তুললাম।
বাইরে বেরিয়ে এসে বললাম, ‘মনে হচ্ছে সেভিয়া জুড়ে ‘লরেন্স অফ অ্যারাবিয়া’ ছবির দৃশ্য। আরও কি বাকি আছে?’ হুয়ারেজ হাসতে হাসতে বলল, ‘এখনো শেষ হয়নি। ছবিটির কিছু শুটিং লোকেশন আছে আলকাছার-এ। আমরা এখন সেখানে যেতে পারি।’ ধন্যবাদ দিয়ে বললাম, ‘দেখ, এখন হাতে সময় নেই। পরিবার অপেক্ষা করছে, আমাকে তাদের সাথে যোগ দিতে হবে।’ হুয়ারেজ তার কার্ড দিয়ে বলল, ‘আবার দরকার হলে আমাকে ফোন করবে। আমি চলে আসব। আমি বেশিরভাগ সময় প্লাছা দে এস্পানিয়া-র সামনে থাকি।’
এতক্ষণ মনে হচ্ছিল‘লরেন্স অফ অ্যারাবিয়া’-র ওপর এক ডকুমেন্টারি দেখছি। তবে এবার বাস্তবে ফেরার পালা।
একটি টেক্সি নিয়ে ছুটলাম সেভিয়া শহর কেন্দ্রে, গন্তব্য-মাশরুম। ভেবেছিলাম এটি এক শপিং সেন্টার। পৌঁছে দেখি এক বিশাল আধুনিক স্থাপনা- পারফর্মিং আর্টস সেন্টার, খেলার-হাঁটার-বসার অফুরন্ত এক জায়গা, সাথে রেস্তোরাঁ, বার, বুটিক শপ ইত্যাদি। এটি পৃথিবীতে কাঠের তৈরি বৃহত্তম স্থাপনা। আরো অনেক জায়গার মতো এরও একটি সরকারি নাম রয়েছে-‘মেথ্রোপল পারাসল’। স্পেনীয় নামগুলো বেশ লম্বা হলে অনেক সময় সেগুলো ছোট করে বলা হয়। এ যেন আমাদের আসল নাম ও ডাক নামের মতো।
ইতিহাস ও আধুনিকতার এক মেলবন্ধন হচ্ছে মাশরুম।
জায়গাটি সেভিয়া-র ঐতিহাসিক কেন্দ্র। এখানে একটি আন্ডার গ্রাউন্ড পার্কিং লট নির্মাণের জন্য মাটি খোঁড়া হচ্ছিল। মাটি খোঁড়াখুড়িতে বেরিয়ে আসে রোমান ধ্বংসাবশেষ- বাড়িঘরের অংশ ও মোজাইক। সিদ্ধান্ত হয় পার্কিং লটের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে এ পুরাকীর্তি সংরক্ষণ করে একটি আধুনিক স্থাপনা নির্মাণ করা হবে। এজন্য স্থপতিদের নকশা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। ৬৫টি নকশা থেকে জার্মান স্থপতি জুরগেন মেয়ার এর নকশাটি নির্বাচিত হয়। এ নকশায় পুরাকীর্তিটি সংরক্ষিত থাকে, তার সাথে যোগ করা হয় ভূগর্ভস্থ এক যাদুঘর। মাটির ওপরে যোগ করা হয় আরো ৩টি তলা। এর যোগফল হলো ‘মাশরুম’, পুরো নাম ‘মেথ্রোপল পারাসল’।
ওপর থেকে বোঝার উপায় নেই যে নিচে এক ইতিহাস লুকিয়ে আছে। আমি যথারীতি একলা যেয়ে এসব রোমান পুরাকীর্তি দেখে আসলাম।
এরপর যোগ দিলাম নাবিল, নাতাশা ও ফারজানা-র সাথে, তারা ‘মাশরুম’-এর ফুট ব্রিজের ওপর জড়ো হয়েছে আরো অনেকের সাথে। উদ্দেশ্য, এখান থেকে পুরো শহর দেখা। ‘মাশরুম’-এর চোখ ধাঁধানো আলোর ঝর্না- বহু রঙের, বহু নকশার- তা রঙ ছড়িয়ে দিচ্ছে ক্যাথেড্রাল, হিরালদো টাওয়ার, আলকাছার ও গুয়াদিলকিভির নদীর জলে। কবিগুরুর ভাষায় বলতে হয় : ‘আলোকের এই ঝর্নধারায় ধুইয়ে দাও’।
সেভিয়া-র ঐতিহাসিক এলাকায় এক আধুনিক মঞ্চ-এ যেন ইতিহাসের ধূসর পাতায় এক বর্ণচ্ছটা। মাশরুম-এর আধুনিক কাঠামোর চূড়ায় উঠে ঐতিহাসিক সেভিয়া-কে দেখলাম- বিপরীত কোণ থেকে দৃষ্টিপাত- সেভিয়াকে মনে হলো এক স্বপ্নপুরী।
সবাই মিলে ‘মাশরুম’-এ ঘোরাঘুরি করে ঢুকলাম এক রেস্তোরাঁয়। ম্যানেজার হোসুয়া মেহিয়া খুবই ফুর্তিবাজ তরুণ। আমাদেরকে খুব খাতির করে ঘুরে দেখাল তার রেস্তোরাঁ। বললাম আমার অনুভূতি- এ ঐতিহাসিক জায়গায় এ রকম ঝকমকে আধুনিক কেন্দ্র বেশ বেমানান। হোসুয়া বলল, ‘স্পেনীয়রা ইতিহাস থেকে পালাতে চায়, কারণ এ ইতিহাসে লেগে আছে অনেক অশ্রু ও রক্ত। জেমস জয়েস যেমন বলেছেন-History is a nightmare from which I am trying to awake.। মাশরুম-এর এ আলো ও আনন্দে লোকজন ভুলে থাকে সে অতীতকে।’ আমি তাকে বলিনি যে নাবিল নাতাশাও ইতিহাসের কোলাহল ভুলে বর্তমানের আনন্দে থাকতে পছন্দ করে। হোসুয়াকে ধন্যবাদ দিয়ে খাওয়া অর্ডার দিলাম। ডিনার সেরে সবাই বের হলাম হাঁটতে।
রাত বেড়েছে বেশ, তারপরও চারপাশে মানুষের কেমন এক চাঞ্চল্য। সামনেই দেখি এক প্লাজা-‘প্লাসা দে ন্যুয়েভা’। এখানে অনেক শহরেই দেখি ‘প্লাসা দে ন্যুয়েভা’, শহরের প্রাণকেন্দ্র, মনে করিয়ে দেয় আমেরিকার শহরগুলোর মেইন স্ট্রিটকে।
হঠাৎ চোখে পড়ল- ভবন, ল্যাম্পপোস্ট, মনুমেন্ট- সব রঙিন লাইট দিয়ে সাজানো, আর বড় বড় ব্যানারে সাজিয়ে লেখা-‘ফেলিছ আনিও নুয়েভ’ শুভ নববর্ষ! রাস্তার মোড়ে মোড়ে সাজসজ্জা। তাইতো! আজ বছরের শেষ দিন, তাই নতুন বছর ২০২৫-কে বরণ করে নেয়ার জন্য চলছে নানা আয়োজন।
সবদিকে আনন্দমুখর মানুষের ভিড়। ধীরে ধীরে জমায়েত বড় হতে লাগল। সবার হাতে ধরা আছে কিছু না কিছু- ফুল, গিফট বক্স, চকোলেট, শ্যাম্পেনের বোতল, মোমবাতি, ফ্ল্যাশ লাইট, সেলফোনের বাতি তো আছেই। একজনের হাতে দেখলাম আগরবাতি, আতর ও গোলাপজল। অনেক সংস্কৃতির বিচিত্র সমাবেশ এখানে, যেন এক রঙধনু। এ একটা দিন- ইংরেজি নববর্ষের আগমন- পৃথিবীর সবাই এক হয়ে যায়, সবাই তা উদযাপন করে। আর কোনো দিন এত সর্বজনীন নয়।
রাত বারোটায় শুরু হবে মূল উৎসব। এখানো ঘণ্টাখানেক বাকি। শুরু হয়েছে বিশাল এক ভবনের দেয়ালে ছায়াছবি প্রদর্শনী। বিশাল ফ্রেমে একে একে ভেসে উঠছে স্পেনের ইতিহাস, সাথে তার সাহিত্য ও সংস্কৃতি। এ ইতিহাস গৌরব, সংঘাত ও বেদনার সংমিশ্রণ। স্পেনের সাহিত্যের বর্ণনায় লোরকা এক বিশাল অংশ জুড়ে ছিল। সংস্কৃতির পর্বে ছিল ফ্লেমেনকো নৃত্য-গীতের চমকপ্রদ ইতিহাস। তবে লোরকা ও ফ্লেমেনকো এখন শুধু স্পেনের নয়, তা হয়ে গেছে বিশ্ব-মানুষের সম্পদ।
ধীর পায়ে বিদায় নিচ্ছে ২০২৪, হাত নাড়াচ্ছে ২০২৫! মনে হচ্ছে কত তাড়াতাড়ি চলে গেল একটি বছর। জীবনটিই এ রকম, খুব ছোট, আর খুব তাড়াতাড়ি চলে যায়।
শুরু হয়ে গেল কাউন্ট ডাউন। ডিজিটাল ঘড়িতে শুরু হল সেকেন্ড গণনা- ১০, ৯, ৮... আর শত কণ্ঠে তার প্রতিধ্বনি। নতুন বছর যতই এগিয়ে আসছে ততই এ শব্দ জোরালো হচ্ছে। বিদায়ী বছরের জন্য কোনো বিষাদ নেই, তবে নতুন বছরের জন্য আছে উত্তেজনা। নবীন বরণ উৎসব শুরু হলো, যখন সময় হলো রাত বারোটা। সবদিকে কোরাস-হ্যাপি নিউ ইয়ার! আমি নাবিল-নাতাশা-ফারজানাকে জড়িয়ে ধরে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানালাম। আশে পাশের অনেকে এসে জড়িয়ে ধরল, অনেকে গিফট দিল, তবে তাদের কাউকে চিনি না, তবুও মনে হলো বেশ আপন। কিছু সময়ের জন্য হলেও আজ সবাই এক হয়ে গেছে। সবসময় এ রকম হলে কত ভালো হতো!
উৎসবের এ মুহূর্তের কথা যথার্থই বলেছেন কবিগুরু: ‘প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী- কিন্ত উৎসবের দিন মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ!’
শুরু হয়ে গেল আরেক উৎসব- আতশবাজির আলোর রঙিন খেলায় নিকষ কালো আকাশ হয়ে উঠেছে আলোকিত। দেখা যাচ্ছে এখান থেকে, তবে তা উৎক্ষিপ্ত হচ্ছে গুয়াদালকিবির নদীর পাড় থেকে। নাতাশা গুগলে বের করল জায়গাটির নাম-‘পাসেও দি লাস দেলিসিয়াস’- আগে গিয়েছি রিভার ক্রুজে যাবার পথে, সেভিয়া-র সবচেয়ে বড় রাস্তা ‘পাসেও দি ক্রিস্টোবাল কলোন’-এর পাশেই। এটি নদীর পাড়ে সুন্দর এক বাঁধানো চত্বর। এখান থেকে বেশি দূরে নয়, হেঁটে যেতে সময় লাগবে না।
পাসেও দি লাস দেলিসিয়াস এ পৌঁছে দেখি সেখানে যেন চলছে এক মেলা। মঞ্চে চলছে গান বাজনা, তার সাথে মিলিয়ে চত্বরে চলছে নাচ ও গান। মানুষ, খাবার, পণ্য, আলো, সঙ্গীত, আনন্দ- সবকিছুই ছড়িয়ে আছে বিস্তৃত চত্বরে।
আতশবাজি ছোড়া হচ্ছে থ্রিয়ানা ব্রিজের ওপর থেকে, এসে পড়ছে গুয়াদালকিবির নদীর বুকে। আতশবাজির বর্ণিল আলোয় নদীর জল ঝিকমিক করছে। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে এ জায়গাগুলি আমরা পার হয়েছি রিভার ক্রুজে, তখন ছিল ২০২৪ সাল। এখন আবার দেখছি গুয়াদালকিবির ও থ্রিয়ানা ব্রিজকে, নববর্ষের উজ্জ্বল রাতে, নতুন বছর ২০২৫ সালে।
এ মুহূর্তের কথাই যেন বলেছেন লোরকা তাঁর কবিতায়:
মোম, দীপ,
লণ্ঠন, জোনাকি।
পুঞ্জ ক্ষান্তিহারা নারাচের
ঘুরপাক তারকামণ্ডল।
ছোটো ছোটো সোনার ঝরকা
কাঁপছে থরথর করে, আর
ক্রুশের ওপরে ক্রুশকাঠ শুধু
দোলা খেয়ে ওঠে ঊষাভোরে।
মোম, দীপ,
লণ্ঠন, জোনাকি।’৩
ক্রমশ...
Ref:
গথিক স্থাপত্য শৈলীতে জোর দেয়া হয় উচ্চতা ও আলোর ওপর, তার বৈশিষ্ট্য হলো সুচালো খিলান। মুদেহার স্থাপত্য হচ্ছে ইসলামী ও খ্রিস্টান শৈলীর মিশ্রণে স্পেনে বিকশিত এক স্থাপত্য শৈলী।
আজুলেহোস হচ্ছে এক প্রকার মুদেহার টাইলস, যা মূলত গ্লেজড সিরামিক টাইলস। মুররা স্পেনে এ রঙিন টাইলস-এর প্রবর্তন করে।
Poema de la Saeta: Noche সায়তা-র কবিতা: রাত্রি: অনুবাদ: দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী - ১৭
চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ
বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৫
(পূর্ব প্রকাশের পর)
পৃথিবী জুড়ে চলছে এক দ্বৈরথ- ঐতিহ্য ও আধুনিকতার; আমরাও এতে যেন জড়িয়ে গেলাম। আমি বরাবর হাঁটি ঐতিহ্যের দিকে, আর নাবিল, নাতাশা, ফারজানা আধুনিকতার পথে।
রিভার ক্রুজ শেষ করে আগের কথামত আমরা যে যার পথে চললাম- আমি ঘোড়ার গাড়িতে, ওরা শুধু গাড়িতে।
ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে আমি ঘুরছি সেভিয়া-র পথে পথে, মনে হচ্ছে অতীতের কোনো এক সময়ে চলেছি। ওরা টেক্সিতে চলে গেল শহরের কেন্দ্রে আধুনিকতার প্রতীক মাশরুম-এ।
সেভিয়া-র প্রতিটি টাওয়ার, প্রতিটি মনুমেন্ট, প্রতিটি ভবন এক একটি ছবি, এক একটি গল্প, এক একটি ইতিহাস। ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে এ ইতিহাস দেখা, মনে হলো এক রাজকীয় ব্যাপার। এখন সবগুলিই বাইরে থেকে দেখা, অনেকটা বার্ডস আই ভিউ, পরে সবাই মিলে এক সাথে ভেতরে যাওয়া যাবে, টিকিট কেটে রেখেছি আগেই।
ঘোড়ার গাড়িতে যাত্রা শুরু হলো সেই থরে দেল ওরো টাওয়ার থেকে। একে একে দৃষ্টিতে ধরা দিল হিরালডা মিনারের চুড়া, সেভিয়া ক্যাথেড্রাল-এর সিংহদ্বার, আলকাছার দুর্গের প্রতিরক্ষা দেয়াল, পার্কে দি মারিয়া ল্ইসা-র ছড়ানো সবুজ, বর্শা হাতে ঘোড়ায় চড়া যোদ্ধা এল সিদ এর ভাষ্কর্য, আর মানুষের বিচিত্র জীবন-প্রবাহ- হাঁটছেন কেউ একাকী, আবার কেউ তার প্রিয় কুকুরের সাথে, কেউ দৌড়াচ্ছেন, তাকে পাড়ি দিল সারি সারি সাইকেল, আর অনেকে বসে আছেন পার্কে আর নদীর পাড়ে- একা একা ও জোড়ায় জোড়ায়। এসব দৃশ্য দেখে আমি বললাম, ‘সেভিয়া শহরটির রয়েছে এক ক্লাসিক বিউটি। মনে হয় এর প্রতিটি অংশ ছায়াছবিতে জায়গা পেতে পারে।’ শুনে গাড়ি চালক হুয়ারেস মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলল, ‘এ শহর সত্যিই সিনেম্যাটিক! সে জন্যই এ শহরের বিভিন্ন জায়গায় অনেক সিনেমার শ্যুটিং হয়েছে। এখন যেখানে যেয়ে থামব, সেখানে নামকরা এক সিনেমার লোকেশন। দেখি, তুমি সেটি ধরতে পার কিনা।’
হুয়ারেস কিছুদুর যেয়ে মনকাড়া স্থাপত্যের বিশাল এক ভবনের সামনে তার ঘোড়াটিকে থামতে বলল। আমরা দুজন নেমে রাস্তার পাশে দাঁড়াতেই সে বলল,‘এ হচ্ছে প্লাসা দে এস্পানিয়া। এটি অনেক কারণে বিখ্যাত হয়ে আছে। প্রথমত এটি ছিল ১৯২৯ সালের আইবেরীয়-আমেরিকান প্রদর্শনীর প্রধান কেন্দ্র। তাছাড়া অনেকগুলি ছবির শ্যুটিং লোকেশন হিসেবেও এটি বিখ্যাত হয়ে আছে। বেশ কটি অস্কার পাওয়া এক ছবির শ্যুটিং হয়েছিল এখানে। ধারণা করতে পার কোন ছবি?’ দেখে চেনা চেনা লাগল। অর্ধবৃত্তাকার নকশা, লাল ইটের সুরম্য ভবন,দুদিকে বিশাল দুটি টাওয়ার, সামনে খাল ও তার ওপরে ৪টি সেতু, মোজাইকের কাজ, ঠিক মাঝখানে ভাইসেন্তে থ্রেবার ঝরনা- অনেকবার দেখেছি এই প্লাসা দে এস্পানিয়া-কে, ছবিতে ও মুভিতে, সামনাসামনি এবার প্রথম। চিনতে একটুও ভুল হলো না। বললাম, ‘লরেন্স অফ অ্যারাবিয়া।’ হুয়ারেস হেসে বলল, ‘ঠিকই ধরেছ।’ বললাম, ‘মুভিটি আমার খুবই প্রিয়, দেখেছি অনেকবার। এর লোকেশনগুলো বেশ মনে আছে, তাই সামনের জায়গাটি চিনতে অসুবিধে হলো না।’
এর সামনে ছবি তুলে হুয়ারেসকে বললাম, ‘তুমি ও তোমার ঘোড়ার সাথে ছবি তুলতে পারি?’ সে হাঁক দিল ‘কর্টেজ’, নাম ডাকতেই ঘোড়াটি মাথা নেড়ে সায় দিল। স্পেনের এক বীরের নামে তার ঘোড়ার নাম। বেশ মজার! একটি সেলফি নিলাম তিনজনের- হুয়ারেস, তার ঘোড়া কর্টেজ ও আমি, পেছনে সেই প্লাসা দে এস্পানিয়া।
হুয়ারেস মজা করে বলল, “তুমি ‘লরেন্স অফ অ্যারাবিয়া’কয়েকবার দেখেছ। এখন বলতো, সামনের লোকেশন ছবিটির কোন দৃশ্যের?” আমরা তখনো ‘প্লাসা দে এস্পানিয়া’-র সামনেই দাঁড়িয়ে আছি। বাঁকানো ব্রিজের সাথে ‘প্লাসা দে এস্পানিয়া’-র এক পোর্টিকোর অংশ, ছবিটির এক দৃশ্য মনে পড়ল। বললাম, ‘এটি হলো কায়রোর ব্রিটিশ আর্মি হেড কোয়ার্টার।’ সে খুব খুশি হয়ে বলল, ‘প্রথমটিতেই তুমি পাস!’ আমার আগ্রহ দেখে হুয়ারেস বলল, ‘আরও ক’টি শ্যুটিং লোকেশন আছে ‘লরেন্স অব অ্যারাবিয়া’-র। তুমি চাইলে আমি ঘুরে দেখাতে পারি।’ আমি সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম।
ছবি তুলে চললাম এ প্লাজার আরেকটি লোকেশনে, মনোরম এক ভবন কাপিতানিয়া জেনারেল-এর সামনে। এর প্রধান চত্বরে রয়েছে লরেন্স অব অ্যারাবিয়া-র একটি দৃশ্য- অফিসার্স ক্লাব, যার চত্বরে বসে লরেন্স পানীয় গ্রহণ করছেন, সাথে আছে জেনারেল এলেনবাই ও কর্নেল হ্যারি ব্রাইটন।
এরপর আমরা ‘লাকাছা দে পিলাথোস’ প্রাসাদের সামনে পৌঁছলাম। হুয়ারেজ জানাল, ‘এখানে সিনেমার দৃশ্যটি হলো জেরুজালেমের ব্রিটিশ আর্মি হেড কোয়ার্টার। একটি দৃশ্যে এ ভবনের সদর দরজা দিয়ে ঢুকছেন লরেন্স। আরও ক’টি দৃশ্য নেয়া হয়েছে ভেতরে। সেখানে ঢুকতে টিকিট লাগবে। এবার তোমাকে একলা যেতে হবে। কর্টেজ ও আমি বাইরে অপেক্ষা করি, তুমি ভেতরে দেখে আস।’
হুয়ারেজ ও তার ঘোড়াকে বাইরে রেখে আমি প্রাসাদের ভেতরে ঢুকলাম। ১৬শ শতাব্দীতে নির্মিত ‘লাকাছা দে পিলাথোস’ প্রাসাদটি আন্দালুসীয় স্থাপত্যের এক অনন্য উদাহরণ। এখানে মিশেছে গথিক, মুদেহার ও ইতালীয় রেনেসাঁর স্থাপত্য শৈলী।১ কাউন্টারে জিজ্ঞেস করলাম কোথায় ‘লরেন্স অফ অ্যারাবিয়া’-র শ্যুটিং হয়েছিল। একজন নিয়ে গেল সেখানে। আঙিনার খিলানের নিচে যেতে যেতে চোখে পড়ল রোমান সম্্রাট ও গ্রিক দেবতাদের ২৪টি আবক্ষ মূর্তি। দেয়ালে রয়েছে আজুলেহোস২ নামে পরিচিত মুদেহার টাইলসের প্রায় ১৫০টির মতো নকশা। একটি সুন্দর ছোট চত্বরের মাঝখানে রয়েছে মার্বেলের এক ফোয়ারা। সিনেমার লোকেশনটি এ চত্বর ও তার আশেপাশে। এখানে কয়েকটি ছবি তুললাম।
ফিরে আসতেই একজন যেতে বলল ওপরের তলায়। সেখানে একটি কামরা ‘সালোন অফ লস ফ্রেসকোস’ এ রয়েছে লরেন্স অব অ্যারাবিয়া-র একটি দৃশ্য- লরেন্স আলাপ করছেন জেনারেল এলেনবাই, ড্রাইডেন ও প্রিন্স ফয়সাল এর সাথে। অভিভূত হয়ে দেখলাম ফ্রেস্কো আর্টের এক দুর্লভ সংগ্রহ। চোখ আটকে গেল নাম না জানা এক শিল্পীর আঁকা বিশাল ফ্রেস্কোতে-‘ট্রায়াম্ফ অফ দ্য ফোর সিজনস’, যা ওভিদ-এর ‘মেটামরফসিস’ দ্বারা অনুপ্রাণিত। অনেক ছবি নিলাম এ সব শিল্পকর্মের।
ফিরে এলাম ঘোড়ার গাড়িতে। কর্টেজ আমাদেরকে ধীরে ধীরে টেনে চলল পার্কে দে মারিয়া লুইজা এর মাঝ বরাবর। হুয়ারেজ তার ঘোড়াকে থামতে বলল প্লাসা দি আমেরিকাজ এর সুদৃশ্য প্লাজার সামনে। তারপর বলল, ‘লরেন্স অব অ্যারাবিয়া মুভিতে এটি হচ্ছে দামেস্কের প্যারেডের স্থান। তারা যাচ্ছে আর্কিওলজিক্যাল মিউজিয়াম এর দিকে, আর প্রেক্ষাপটে রয়েছে মিউজিয়াম অফ আর্টস এন্ড ট্রেডিশন্স।’ আজকের দিনেও সিনেমার দৃশ্যের মতো বিশাল প্লাজার সবদিকে জনসমাগম। অনেকগুলো ছবি নিলাম মানুষ ও ভবনের।
এরপর গেলাম ‘এভিনিদা দি মারিয়া লুইছা’ এলাকার অর্ধবৃত্তাকার ভবন ‘ক্যাসিনো দে লা এক্সপোসিসিঁও’-র সামনে। নাম শুনে ভাবলাম এটি জুয়া খেলার জায়গা। হুয়ারেজ-কে জিজ্ঞেস করতে বলল, ‘জুয়া খেলার জায়গাতো নয়ই, বরং এটি হচ্ছে সেভিয়া-র সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রধান কেন্দ্র। ১৯২৯ সালের এক্সপোজিশনে তা ছিল ‘প্যাভিলিয়ন দে সেভিয়া’। এখানে ‘লরেন্স অফ অ্যারাবিয়া’-র আরব কাউন্সিল এর দৃশ্য চিত্রায়িত হয়েছে।’ ছবি নেয়ার পর হুয়ারেজ নিয়ে চলল পরবর্তী লোকেশনে।
খানিক পরে অভিজাত‘হোটেল আলফনসো ঢওওও’-র সামনে গাড়িটি থামিয়ে হুয়ারেজ বলল, ‘লরেন্স অফ অ্যারাবিয়া-র কোন দৃশ্য এখানে ধরা হয়নি, তবে ছবিটির শ্যুটিং এর সময় এখানে শিল্পী ও কলাকুশলীরা ছিলেন।’ আমি হোটেলের লবিতে দাঁড়িয়ে কয়েকটি ছবি তুললাম।
বাইরে বেরিয়ে এসে বললাম, ‘মনে হচ্ছে সেভিয়া জুড়ে ‘লরেন্স অফ অ্যারাবিয়া’ ছবির দৃশ্য। আরও কি বাকি আছে?’ হুয়ারেজ হাসতে হাসতে বলল, ‘এখনো শেষ হয়নি। ছবিটির কিছু শুটিং লোকেশন আছে আলকাছার-এ। আমরা এখন সেখানে যেতে পারি।’ ধন্যবাদ দিয়ে বললাম, ‘দেখ, এখন হাতে সময় নেই। পরিবার অপেক্ষা করছে, আমাকে তাদের সাথে যোগ দিতে হবে।’ হুয়ারেজ তার কার্ড দিয়ে বলল, ‘আবার দরকার হলে আমাকে ফোন করবে। আমি চলে আসব। আমি বেশিরভাগ সময় প্লাছা দে এস্পানিয়া-র সামনে থাকি।’
এতক্ষণ মনে হচ্ছিল‘লরেন্স অফ অ্যারাবিয়া’-র ওপর এক ডকুমেন্টারি দেখছি। তবে এবার বাস্তবে ফেরার পালা।
একটি টেক্সি নিয়ে ছুটলাম সেভিয়া শহর কেন্দ্রে, গন্তব্য-মাশরুম। ভেবেছিলাম এটি এক শপিং সেন্টার। পৌঁছে দেখি এক বিশাল আধুনিক স্থাপনা- পারফর্মিং আর্টস সেন্টার, খেলার-হাঁটার-বসার অফুরন্ত এক জায়গা, সাথে রেস্তোরাঁ, বার, বুটিক শপ ইত্যাদি। এটি পৃথিবীতে কাঠের তৈরি বৃহত্তম স্থাপনা। আরো অনেক জায়গার মতো এরও একটি সরকারি নাম রয়েছে-‘মেথ্রোপল পারাসল’। স্পেনীয় নামগুলো বেশ লম্বা হলে অনেক সময় সেগুলো ছোট করে বলা হয়। এ যেন আমাদের আসল নাম ও ডাক নামের মতো।
ইতিহাস ও আধুনিকতার এক মেলবন্ধন হচ্ছে মাশরুম।
জায়গাটি সেভিয়া-র ঐতিহাসিক কেন্দ্র। এখানে একটি আন্ডার গ্রাউন্ড পার্কিং লট নির্মাণের জন্য মাটি খোঁড়া হচ্ছিল। মাটি খোঁড়াখুড়িতে বেরিয়ে আসে রোমান ধ্বংসাবশেষ- বাড়িঘরের অংশ ও মোজাইক। সিদ্ধান্ত হয় পার্কিং লটের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে এ পুরাকীর্তি সংরক্ষণ করে একটি আধুনিক স্থাপনা নির্মাণ করা হবে। এজন্য স্থপতিদের নকশা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। ৬৫টি নকশা থেকে জার্মান স্থপতি জুরগেন মেয়ার এর নকশাটি নির্বাচিত হয়। এ নকশায় পুরাকীর্তিটি সংরক্ষিত থাকে, তার সাথে যোগ করা হয় ভূগর্ভস্থ এক যাদুঘর। মাটির ওপরে যোগ করা হয় আরো ৩টি তলা। এর যোগফল হলো ‘মাশরুম’, পুরো নাম ‘মেথ্রোপল পারাসল’।
ওপর থেকে বোঝার উপায় নেই যে নিচে এক ইতিহাস লুকিয়ে আছে। আমি যথারীতি একলা যেয়ে এসব রোমান পুরাকীর্তি দেখে আসলাম।
এরপর যোগ দিলাম নাবিল, নাতাশা ও ফারজানা-র সাথে, তারা ‘মাশরুম’-এর ফুট ব্রিজের ওপর জড়ো হয়েছে আরো অনেকের সাথে। উদ্দেশ্য, এখান থেকে পুরো শহর দেখা। ‘মাশরুম’-এর চোখ ধাঁধানো আলোর ঝর্না- বহু রঙের, বহু নকশার- তা রঙ ছড়িয়ে দিচ্ছে ক্যাথেড্রাল, হিরালদো টাওয়ার, আলকাছার ও গুয়াদিলকিভির নদীর জলে। কবিগুরুর ভাষায় বলতে হয় : ‘আলোকের এই ঝর্নধারায় ধুইয়ে দাও’।
সেভিয়া-র ঐতিহাসিক এলাকায় এক আধুনিক মঞ্চ-এ যেন ইতিহাসের ধূসর পাতায় এক বর্ণচ্ছটা। মাশরুম-এর আধুনিক কাঠামোর চূড়ায় উঠে ঐতিহাসিক সেভিয়া-কে দেখলাম- বিপরীত কোণ থেকে দৃষ্টিপাত- সেভিয়াকে মনে হলো এক স্বপ্নপুরী।
সবাই মিলে ‘মাশরুম’-এ ঘোরাঘুরি করে ঢুকলাম এক রেস্তোরাঁয়। ম্যানেজার হোসুয়া মেহিয়া খুবই ফুর্তিবাজ তরুণ। আমাদেরকে খুব খাতির করে ঘুরে দেখাল তার রেস্তোরাঁ। বললাম আমার অনুভূতি- এ ঐতিহাসিক জায়গায় এ রকম ঝকমকে আধুনিক কেন্দ্র বেশ বেমানান। হোসুয়া বলল, ‘স্পেনীয়রা ইতিহাস থেকে পালাতে চায়, কারণ এ ইতিহাসে লেগে আছে অনেক অশ্রু ও রক্ত। জেমস জয়েস যেমন বলেছেন-History is a nightmare from which I am trying to awake.। মাশরুম-এর এ আলো ও আনন্দে লোকজন ভুলে থাকে সে অতীতকে।’ আমি তাকে বলিনি যে নাবিল নাতাশাও ইতিহাসের কোলাহল ভুলে বর্তমানের আনন্দে থাকতে পছন্দ করে। হোসুয়াকে ধন্যবাদ দিয়ে খাওয়া অর্ডার দিলাম। ডিনার সেরে সবাই বের হলাম হাঁটতে।
রাত বেড়েছে বেশ, তারপরও চারপাশে মানুষের কেমন এক চাঞ্চল্য। সামনেই দেখি এক প্লাজা-‘প্লাসা দে ন্যুয়েভা’। এখানে অনেক শহরেই দেখি ‘প্লাসা দে ন্যুয়েভা’, শহরের প্রাণকেন্দ্র, মনে করিয়ে দেয় আমেরিকার শহরগুলোর মেইন স্ট্রিটকে।
হঠাৎ চোখে পড়ল- ভবন, ল্যাম্পপোস্ট, মনুমেন্ট- সব রঙিন লাইট দিয়ে সাজানো, আর বড় বড় ব্যানারে সাজিয়ে লেখা-‘ফেলিছ আনিও নুয়েভ’ শুভ নববর্ষ! রাস্তার মোড়ে মোড়ে সাজসজ্জা। তাইতো! আজ বছরের শেষ দিন, তাই নতুন বছর ২০২৫-কে বরণ করে নেয়ার জন্য চলছে নানা আয়োজন।
সবদিকে আনন্দমুখর মানুষের ভিড়। ধীরে ধীরে জমায়েত বড় হতে লাগল। সবার হাতে ধরা আছে কিছু না কিছু- ফুল, গিফট বক্স, চকোলেট, শ্যাম্পেনের বোতল, মোমবাতি, ফ্ল্যাশ লাইট, সেলফোনের বাতি তো আছেই। একজনের হাতে দেখলাম আগরবাতি, আতর ও গোলাপজল। অনেক সংস্কৃতির বিচিত্র সমাবেশ এখানে, যেন এক রঙধনু। এ একটা দিন- ইংরেজি নববর্ষের আগমন- পৃথিবীর সবাই এক হয়ে যায়, সবাই তা উদযাপন করে। আর কোনো দিন এত সর্বজনীন নয়।
রাত বারোটায় শুরু হবে মূল উৎসব। এখানো ঘণ্টাখানেক বাকি। শুরু হয়েছে বিশাল এক ভবনের দেয়ালে ছায়াছবি প্রদর্শনী। বিশাল ফ্রেমে একে একে ভেসে উঠছে স্পেনের ইতিহাস, সাথে তার সাহিত্য ও সংস্কৃতি। এ ইতিহাস গৌরব, সংঘাত ও বেদনার সংমিশ্রণ। স্পেনের সাহিত্যের বর্ণনায় লোরকা এক বিশাল অংশ জুড়ে ছিল। সংস্কৃতির পর্বে ছিল ফ্লেমেনকো নৃত্য-গীতের চমকপ্রদ ইতিহাস। তবে লোরকা ও ফ্লেমেনকো এখন শুধু স্পেনের নয়, তা হয়ে গেছে বিশ্ব-মানুষের সম্পদ।
ধীর পায়ে বিদায় নিচ্ছে ২০২৪, হাত নাড়াচ্ছে ২০২৫! মনে হচ্ছে কত তাড়াতাড়ি চলে গেল একটি বছর। জীবনটিই এ রকম, খুব ছোট, আর খুব তাড়াতাড়ি চলে যায়।
শুরু হয়ে গেল কাউন্ট ডাউন। ডিজিটাল ঘড়িতে শুরু হল সেকেন্ড গণনা- ১০, ৯, ৮... আর শত কণ্ঠে তার প্রতিধ্বনি। নতুন বছর যতই এগিয়ে আসছে ততই এ শব্দ জোরালো হচ্ছে। বিদায়ী বছরের জন্য কোনো বিষাদ নেই, তবে নতুন বছরের জন্য আছে উত্তেজনা। নবীন বরণ উৎসব শুরু হলো, যখন সময় হলো রাত বারোটা। সবদিকে কোরাস-হ্যাপি নিউ ইয়ার! আমি নাবিল-নাতাশা-ফারজানাকে জড়িয়ে ধরে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানালাম। আশে পাশের অনেকে এসে জড়িয়ে ধরল, অনেকে গিফট দিল, তবে তাদের কাউকে চিনি না, তবুও মনে হলো বেশ আপন। কিছু সময়ের জন্য হলেও আজ সবাই এক হয়ে গেছে। সবসময় এ রকম হলে কত ভালো হতো!
উৎসবের এ মুহূর্তের কথা যথার্থই বলেছেন কবিগুরু: ‘প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী- কিন্ত উৎসবের দিন মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ!’
শুরু হয়ে গেল আরেক উৎসব- আতশবাজির আলোর রঙিন খেলায় নিকষ কালো আকাশ হয়ে উঠেছে আলোকিত। দেখা যাচ্ছে এখান থেকে, তবে তা উৎক্ষিপ্ত হচ্ছে গুয়াদালকিবির নদীর পাড় থেকে। নাতাশা গুগলে বের করল জায়গাটির নাম-‘পাসেও দি লাস দেলিসিয়াস’- আগে গিয়েছি রিভার ক্রুজে যাবার পথে, সেভিয়া-র সবচেয়ে বড় রাস্তা ‘পাসেও দি ক্রিস্টোবাল কলোন’-এর পাশেই। এটি নদীর পাড়ে সুন্দর এক বাঁধানো চত্বর। এখান থেকে বেশি দূরে নয়, হেঁটে যেতে সময় লাগবে না।
পাসেও দি লাস দেলিসিয়াস এ পৌঁছে দেখি সেখানে যেন চলছে এক মেলা। মঞ্চে চলছে গান বাজনা, তার সাথে মিলিয়ে চত্বরে চলছে নাচ ও গান। মানুষ, খাবার, পণ্য, আলো, সঙ্গীত, আনন্দ- সবকিছুই ছড়িয়ে আছে বিস্তৃত চত্বরে।
আতশবাজি ছোড়া হচ্ছে থ্রিয়ানা ব্রিজের ওপর থেকে, এসে পড়ছে গুয়াদালকিবির নদীর বুকে। আতশবাজির বর্ণিল আলোয় নদীর জল ঝিকমিক করছে। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে এ জায়গাগুলি আমরা পার হয়েছি রিভার ক্রুজে, তখন ছিল ২০২৪ সাল। এখন আবার দেখছি গুয়াদালকিবির ও থ্রিয়ানা ব্রিজকে, নববর্ষের উজ্জ্বল রাতে, নতুন বছর ২০২৫ সালে।
এ মুহূর্তের কথাই যেন বলেছেন লোরকা তাঁর কবিতায়:
মোম, দীপ,
লণ্ঠন, জোনাকি।
পুঞ্জ ক্ষান্তিহারা নারাচের
ঘুরপাক তারকামণ্ডল।
ছোটো ছোটো সোনার ঝরকা
কাঁপছে থরথর করে, আর
ক্রুশের ওপরে ক্রুশকাঠ শুধু
দোলা খেয়ে ওঠে ঊষাভোরে।
মোম, দীপ,
লণ্ঠন, জোনাকি।’৩
ক্রমশ...
Ref:
গথিক স্থাপত্য শৈলীতে জোর দেয়া হয় উচ্চতা ও আলোর ওপর, তার বৈশিষ্ট্য হলো সুচালো খিলান। মুদেহার স্থাপত্য হচ্ছে ইসলামী ও খ্রিস্টান শৈলীর মিশ্রণে স্পেনে বিকশিত এক স্থাপত্য শৈলী।
আজুলেহোস হচ্ছে এক প্রকার মুদেহার টাইলস, যা মূলত গ্লেজড সিরামিক টাইলস। মুররা স্পেনে এ রঙিন টাইলস-এর প্রবর্তন করে।
Poema de la Saeta: Noche সায়তা-র কবিতা: রাত্রি: অনুবাদ: দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়